এই-ই সেই দিবস, যে-দিবসে ঐশী প্রতিশ্রুতি পূর্ণতা লাভ করিয়াছে, যে-দিবসে ঐশী বাণী প্রত্যাদিষ্ট হইয়াছে, এবং তাঁহার প্রমাণ দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। তোমাদের মঙ্গলের জন্য এবং তোমাদিগকে ঐশী সান্নিধ্য উপভোগ করণার্থে প্রত্যাদেশের প্রভূর সন্নিধানে তাঁহার স্বর তোমাদিগকে আহ্বান জ্ঞাপন করিতেছে।
- বাহা‘উল্লাহ্
কিতাবে ঈক্বান ফারসী ভাষায় অবতারিত সন্দেহাতীত প্রামাণ্য গ্রন্থ। ইহার নামেই প্রকাশ করে যে, এই গ্রন্থ ঐশী সৃষ্টিশীলতার প্রমাণ বহন করিতেছে। বাহা‘উল্লাহ কর্তৃক তাঁহার অবতারত্ব সম্বন্ধে সাধারণ্যে ঘোষণা প্রকাশের পূর্বে ১৮৬২ খ্রীস্টাব্দে এবং যখন তিনি নির্বাসিত জীবন যাপন করিতেছিলেন, তখন ইহা দুই দিবস ও রজনীতে অবতীর্ণ হয়। হজরত বাহা’উল্লাহর পথিকৃৎ হজরত বা’ব-এর ভবিষ্যদ্বাণীর পূর্ণতাপ্রাপ্তি এবং হজরত বা’ব এর ‘বায়ান’ গ্রন্থের সারাংশ এবং পূর্ণতাপ্রাপ্তি হিসাবে ইহা অবতারিত হয় এবং ইহা বাহা’ই ধর্ম সম্বন্ধে তাঁহার যৌবনকালে ঘোষিত স্বর্গীয় সত্যের প্রমাণ বহন করে। ১৮৫০ খ্রীস্টাব্দে তাঁহাকে (বা’বকে) তেব্রিজে শহীদ করা হয়। ইহা (এই হত্যাকান্ড) এমন একটি ঘটনা, যাহা প্রাচ্য দেশকে আলোড়িত করে এবং সমগ্র পাশ্চাত্যের বহু চিন্তাশীল ব্যক্তিও ইহাতে আকৃষ্ট হইয়া পড়েন। এই গ্রন্থ অতীত কালের পৃথিবীর যাবতীয় স্বর্গীয় ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা এবং তাঁহাদের প্রচারিত মতবাদ ও পদমর্যাদার স্বীকৃতি প্রদান করে—যেমন হজরত ইব্রাহিম (আঃ), মূসা (আঃ), ঈসা (আঃ) এবং হজরত মোহাম্মদ (সঃ), যাঁহারা অতীত যুগের ধর্মীয় বিধানাবলীর অবতরণকারী। তাঁহারা মানবজাতিকে নৈতিকতা শিক্ষাদানকল্পে যে ধর্মীয় বিধানাবলী প্রদান করেন, তাহার প্রতিও ইহা স্বীকৃতি প্রদান করে। তাঁহাদের আনুক্রমিকতা এমন একটি মহাজাগতিক উপন্যাস, যাহা সমগ্র বিশ্বের রূপরেখাকে প্রতিফলিত করে। তাঁহাদের বাণীতে মানব সমাজের ক্রমোন্নতিমূলক ধরন, ইহার ইতিহাস এবং লক্ষ্য বিস্তারিত ভাবে প্রকাশ পাইয়াছে। তাঁহারা যুগ হইতে যুগান্তর অথবা এক ব্যবস্থার পরে অন্য ব্যবস্থা প্রদানপূর্বক মানব জাতিকে এমন একটি সমষ্টিগত আধ্যাত্মিকতা প্রদান করিয়াছেন, যাহার ফলে মানব জাতির আত্মা নবজীবন লাভ করিয়াছে এবং তাহাদের দৈনন্দিন জীবনের ব্যাখ্যা ও উদ্দেশ্য সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করিয়াছে। এই সমস্ত ঐশী প্রকাশের মাধ্যমে সভ্যতা নবরূপ লাভ করতঃ উন্নতির পথে ধাবিত হইয়াছে, এবং তাহাদের যুগের সমগ্র মানব জাতিকে ঐক্যবন্ধনে আবদ্ধ করিয়াছে। অতীত যুগের ধর্মীয় বিধানাবলী তাহাদের স্ব স্ব বসন্তকালে ও দীর্ঘ গ্রীষ্মকালের মহিমান্বিত ঋতুতে—যেমন ইহুদী, খ্রীস্টান বা ইসলাম ধর্মের গৌরবময় যুগে—এই সমস্ত ধর্ম যুগের পরিবেশকে পরিবর্তিত করিয়া দিয়াছে এবং মানুষের বুদ্ধিমত্তা বা গুণপনাকে নূতন রূপে প্রয়োগ করিয়াছে। এই সমস্ত বিশিষ্ট সংস্কৃতির মূলে যে সাধারণ ধর্মীয় ও উদ্যমশীল বৈশিষ্ট্য কার্যকরী ছিল, তাহা হইল আল্লাহর প্রতি নির্ভরশীলতা—যিনি যাবতীয় বস্তুর পরিচালক। ইসরায়েলী, খ্রীস্টীয় এবং মুসলিম ধর্মগ্রন্থসমূহে দীর্ঘকাল যাবৎ পরস্পরবিরোধী বলিয়া কথিত যে-সমস্ত জটিল ও রূপক বাক্য রহিয়াছে, বাহা’উল্লাহ্-প্রদত্ত ব্যাখ্যা সত্যানুসন্ধানী ব্যক্তিগণের বোধগম্যতার পক্ষে অধিকতর সহায়ক হইয়াছে এবং ইহা প্রত্যাদেশের প্রগতি ও ক্রমবিকাশমূলক চরিত্রকে প্রকটিত করিয়াছে। বর্তমানে বাহা’উল্লাহ্র বাণী পুনরায় বিশ্বমানবকে আর একটি নূতন আধ্যাত্মিক বসন্তকে স্বীকৃতি দানের আহ্বান জানাইতেছে। ইহা পূর্বকালীন যুগসমূহের সর্বপ্রকারের কুসংস্কার ও সীমাবদ্ধতা, জাতীয় প্রাধান্য, বিবদমান জাতীয়তা, পুরুষানুক্রমিক যুদ্ধ-বিগ্রহ, ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা এবং যে-সমস্ত কার্য আল্লাহর প্রতিশ্রুত ও দীর্ঘ-প্রতীক্ষিত ঐশী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পথে অন্তরায় সৃষ্টি করে, তৎসমুদয় পরিহারপূর্বক পৃথিবীতে জাতিসমূহের প্রতি ন্যায় বিচারমূলক এবং শান্তিপ্রদ বিশ্ব-বিধান প্রবর্তনের নির্দেশ প্রদান করিতেছে।
প্রথমেই বলা হইয়াছে যে, এই গ্রন্থ ফারসী ভাষায় অবতীর্ণ হইয়াছে। তৎপর বাহা’ই ধর্মের অভিভাবক শৌকী এফেন্দী ইংরেজী ভাষায় ইহার অনুবাদ করেন। উক্ত ইংরেজী অনূদিত গ্রন্থ হইতে অত্র বঙ্গানুবাদ করা হইয়াছে। সুতরাং মূল গ্রন্থের বক্তব্যকে অক্ষুণ্ণ রাখিয়া ইহাকে বাংলা ভাষায় প্রকাশ করা এক দুরূহ ব্যাপার। তবুও আমরা আমাদের সামর্থ্য ও জ্ঞান-বুদ্ধিকে দুঃসাহসের সঙ্গে প্রয়োগ করিয়াছি। ঐশী বাণীর ভাষান্তরণ সহজসাধ্য ব্যাপার নহে। আমাদের সীমাবদ্ধ জ্ঞানকে এই মহতী কার্যে প্রয়োগ করতঃ বাংলাভাষী জনগণের সমক্ষে এই মহাগ্রন্থকে উপস্থাপিত করণে ভাষা, বর্ণনা ও ব্যাখ্যায় যদি কোন অস্পষ্টতা ও দুর্বলতা থাকিয়া থাকে, তজ্জন্য আমরা দুঃখিত এবং আল্লাহর নিকট আমরা ক্ষমা প্রার্থনা করি।
অনুবাদকের পক্ষে-
বাংলাদেশ জাতীয় বাহা’ই আধ্যাত্মিক পরিষদ।
মহৎ ও মহিয়ান পরম প্রভূ আল্লাহর নামে।
যদি কোনও লোক স্বর্গ ও মর্ত্যস্থ যাবতীয় বস্তু হইতে নিজেকে মুক্ত করিতে না পারে, তাহা হইলে সে কখনই যথার্থ জ্ঞান ও উপলব্ধির মহাসাগরের তীরে উপনীত হইতে সমর্থ হইবে না। হে পৃথিবীর জনগণ! তোমরা তোমাদের আত্মাকে পবিত্র কর, যেহেতু হয়ত তোমরা সেই পদমর্যাদা লাভ করিতে পার, যাহা আল্লাহ্ তোমাদের জন্য অবধারিত করিয়াছেন, এবং এইরূপে সেই চন্দ্রাতপতলে প্রবিষ্ট হইতে পার, যাহা বিধাতার বিধানানুযায়ী ‘বয়ান’-রূপ ধর্মাকাশে বিস্তারিত করা হইয়াছে।
এই সকল বাক্যের সারমর্ম এইঃ যাহারা ধর্মবিশ্বাসের পথে পদবিক্ষেপ করে, যাহারা সুনিশ্চয়তার মদিরার জন্য পিপাসার্ত, তাহাদের উচিত যেন তাহারা পার্থিব সকল বিষয় হইতে নিজেদের পবিত্র করে, অর্থাৎ তাহাদের কর্ণকে অলস কথা-বার্তা হইতে, মনকে বৃথা কল্পনাদি হইতে, অন্তরকে পার্থিব স্নেহ-মমতা হইতে, চক্ষুকে বিনশ্বর বিষয় হইতে। আল্লাহর উপর তাহাদের সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হইতে হইবে, এবং তাঁহাকেই দৃঢ়ভাবে ধারণ করিয়া, তাঁহারই পথ অনুসরণ করিয়া চলিতে হইবে। তবেই তাহারা স্বর্গীয় জ্ঞান ও উপলব্ধির সূর্যের দীপ্তিময় প্রভাসমূহের প্রকাশের যোগ্য পাত্রে পরিগণিত হইবে, এবং এইরূপ এক অনুকম্পার আধার হইবে, যাহা অনন্ত ও অদৃশ্য, কেন না, মানুষ কখনও সর্বপ্রভাময় প্রভূর জ্ঞান লাভের আশা পোষণ করিতে পারে না, কখনও স্বর্গীয় জ্ঞান ও বিজ্ঞতার স্রোতস্বতী হইতে অতিমাত্রায় পান করিতে পারে না, কখনও অমর ধামে প্রবেশ লাভ করিতে পারে না, এবং কখনও স্বর্গীয় নৈকট্যের ও অনুগ্রহের পান-পাত্র ভোগে অংশগ্রহণ করিতে পারে না, যে পর্যন্ত না সে নশ্বর মানবের বাক্য ও কার্যাবলীকে আল্লাহর এবং তাঁহার পয়গম্বরগণের সম্বন্ধে সত্যজ্ঞান ও পরিচয়-লাভের কার্যে মানদ-স্বরূপ গ্রহণ করা হইতে বিরত না হয়।
এক্ষণে, অতীতকাল সম্বন্ধে ভাবিয়া দেখুন। উচ্চ ও নিম্ন শ্রেণীর কত অধিক সংখ্যক লোক, সর্বসময়ে, পবিত্র মানবীয় দেহে আল্লাহর মনোনীত প্রকাশগণের আবির্ভাবের প্রত্যাশায় উৎসুকভাবে প্রতীক্ষা করিয়াছে। কত অধিকবারই তাহারা তাঁহার আগমন আশা করিয়াছে, কত অবিরতভাবে তাহারা এই প্রার্থনা করিয়াছে, যেন স্বর্গীয় করুণার সমীরণ প্রবাহিত হয় এবং রহস্য-লোকের অন্তরাল হইতে প্রতিশ্রুত সুষমা ধরা-বক্ষে পদার্পণ করেন এবং পৃথিবীর সকলের নিকট প্রকাশিত হইতে পারেন। কিন্তু যখন যখনই অনুকম্পার দ্বারসমূহ উদ্ঘাটিত হইয়াছে এবং স্বর্গীয় বদান্যতার মেঘপুঞ্জ মানবজাতির উপর বারিবর্ষণ করিয়াছে, এবং অদৃশ্য প্রভূর আলোক স্বর্গীয় শক্তির চক্রবালের উপর উজ্জ্বলভাবে কিরণ দান করিয়াছে, অমনি তাহারা সকলেই তাঁহাকে অস্বীকার করিয়াছে এবং তাঁহার দিক হইতে মুখ ফিরাইয়া লইয়াছে—যাঁহা স্বয়ং আল্লাহরই আনন। এই সত্য প্রত্যেক পবিত্র গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করা হইয়াছে, ইহা সপ্রমাণ করিবার জন্য তৎ প্রতি লক্ষ্য করিবেন।
এক মূহুর্তের জন্য চিন্তা করুন এবং বিশেষভাবে বিবেচনা করিয়া দেখুন, যাহারা এইরূপ ব্যগ্রতা ও ঔৎসুক্যের সহিত অনুসন্ধানে রত ছিল, তাহাদের পক্ষে এইরূপ অস্বীকার করিবার কারণই বা কি হইতে পারে। তাহাদের আক্রমণও এইরূপ ভয়ঙ্কর ছিল যে, ভাষা বা লেখনী তাহা বর্ণনা করিতে অক্ষম। এমন একজন পবিত্রতার প্রকাশেরও আবির্ভাব হয় নাই, যিনি তাঁহার চতুর্দিকস্থ মনুষ্যগণের অস্বীকার, প্রত্যাখ্যান ও প্রচন্ড প্রতিবন্ধকতার অত্যাচারে জর্জরিত হন নাই। ইহা এইরূপই অবতীর্ণ হইয়াছেঃ “আহা! সেই লোকদের জন্য বড়ই আক্ষেপ! যখনই তাহাদের নিকট কোনও রসুল আগমন করেন, তাহারা তাঁহাকে উপহাস করে!” (ক্বোরআন ৩৬।৩০)। তিনি পুনরায় বলিয়াছেনঃ “প্রত্যেক সম্প্রদায় তাহাদের নিকট প্রেরিত রসুলের বিরুদ্ধে ভীষণ ষড়যন্ত্র করিয়াছিল, যেন তাঁহাকে ধর-পাকড় করিয়া অত্যাচার করিতে পারে, এবং তাহারা সত্যকে পদদলিত করিবার জন্য নিরর্থক বাক্যাবলী প্রয়োগে ঝগড়া করিয়াছিল।” (ক্বোরআন ৪০।৫)।
এই প্রকারে, এই সকল বাক্য, যাহা ঐশী-শক্তির উৎস হইতে প্রবাহিত হইয়াছে, এবং প্রভার স্বর্গ হইতে অবতীর্ণ হইয়াছে, তাহা অসংখ্য, এবং মানবের সাধারণ বুদ্ধির অগম্য। যে সকল লোকের নিকট সত্যোপলব্ধি ও অন্তর্দৃষ্টি আছে, তাঁহাদের জন্য সূরাহ্ হূদের বাক্যাবলীই যথেষ্ট। এই সকল পবিত্র বাক্য কিয়ৎকালের জন্য আপনার অন্তরে ভাবিয়া দেখুন এবং সম্পূর্ণ নির্লিপ্তভাবে তাহাদের তাৎপর্য হৃদয়ঙ্গম করিতে চেষ্টিত হউন। পয়গম্বরগণের অত্যাশ্চর্য আচরণ পরীক্ষা করুন এবং অস্বীকারকারী ও মিথ্যাবাদী লোকদের দ্বারা উচ্চারিত দুর্নাম ও প্রতিবাদসমূহ স্মরণ করুন, তাহা হইলে হয়ত আপনি মানবের অন্তরপক্ষীকে অমনোযোগিতা ও সন্দেহের আবাসস্থান হইতে বিশ্বাস ও নিশ্চয়তার নীড়ের দিকে উড্ডীয়মান করিতে সক্ষম হইবেন এবং শাশ্বত জ্ঞানের পবিত্র জলধারা হইতে আকণ্ঠ পান করিতে ও জ্ঞানবৃক্ষের ফলভোগ করিতে সমর্থ হইবেন। অনাদি-অনন্ত ও পবিত্রতার রাজ্য হইতে অবতীর্ণ খাদ্য-ভান্ডারে পবিত্র অন্তঃকরণবিশিষ্ট লোকদের ইহাই প্রাপ্য।
আল্লাহর পয়গম্বরগণের উপর যে সমস্ত অপমান স্তূপাকারে বর্ষিত হইয়াছে, সেগুলি যদি আপনি অবগত হন এবং তাঁহাদের অত্যাচারীদের দ্বারা উচ্চারিত আপত্তিসমূহের প্রকৃত কারণগুলি অনুধাবন করিতে সক্ষম হন, তাহা হইলে আপনি নিশ্চয়ই তাঁহাদের পদমর্যাদার মর্মার্থ যথাযথভাবে উপলব্ধি করিতে পারিবেন, অধিকন্তু, স্বর্গীয় গুণাবলীর প্রকাশগণের বিরুদ্ধে যাহারা প্রতিবাদ করিয়াছে, তাহাদের অস্বীকারাদি যতই অধিকতর ঘনিষ্ঠভাবে অবলোকন করিবেন, আল্লাহর ধর্মে আপনার বিশ্বাস ততই অধিকতর সুদৃঢ় হইবে। সুতরাং, আল্লাহর পয়গম্বরগণের সম্বন্ধে প্রদত্ত বিভিন্ন বিবরণ এই ফলকলিপিতে (গ্রন্থে) সংক্ষেপে উল্লিখিত হইবে, যেন তাহাতে এই সত্য প্রকাশিত হয় যে, সকল যুগে ও সকল শতাব্দীতে ঐশী শক্তি ও মহিমার প্রকাশগণের উপর, এইরূপ ঘৃণিত নিষ্ঠুরতা নিপাতিত করা হইয়াছিল, যাহা কোন লেখনী বর্ণনা করিতে সাহস করিবে না। হয়ত এই বর্ণনা এই যুগের ধর্মাচার্যদের ও মূর্খ ব্যক্তিদের আপত্তি ও অস্বীকৃতি, অন্ততঃ অল্প কিছু সংখ্যক লোককে ব্যাকুলতা হইতে রক্ষা করিতে সমর্থ হইতে, এবং তাঁহাদের বিশ্বাস ও নিশ্চয়তা সবল করিতে সাহায্য করিবে।
ঐশী পয়গম্বরগণের মধ্যে একজন ছিলেন নূহ্ (আঃ)। নয় শত পঞ্চাশ বৎসর যাবৎ তিনি তাঁহার দেশবাসীগণকে প্রার্থনা সহকারে সদুপোদেশ দানে উৎসাহিত করিয়াছিলেন এবং তাহাদিগকে নিরাপত্তা ও শান্তির স্বর্গলোকের দিকে আহ্বান করিয়াছিলেন; কিন্তু কেহই তাঁহার আহ্বানে কর্ণপাত করে নাই। বরং প্রত্যহ তাঁহার পবিত্র দেহের উপর এইরূপ যন্ত্রণা ও ক্লেশ দিতে লাগিল যে, কেহই বিশ্বাস করে নাই যে তিনি জীবিত থাকিবেন। কত বারই না তাহারা তাঁহাকে অস্বীকার করিল, কতই ঈর্ষাপরায়ণতার সহিত তাঁহার বিরুদ্ধে তাহারা তাহাদের সন্দেহের বিষয় ইঙ্গিত করিল। এই সম্বন্ধে অবতীর্ণ হইয়াছেঃ “যখন যখনই তাঁহার সম্প্রদায়ের একদল লোক তাঁহার পার্শ্ব দিয়া চলিয়া যাইত, তখন তাহারা তাঁহাকে উপহাস করিত। তিনি তাহাদিগকে বলিতেনঃ ‘যদিও তোমরা এক্ষণে আমাদিগকে উপহাস করিতেছ, অতঃপর আমরাও তোমাদিগকে উপহাস করিব—যেরূপ উপহাস তোমরা আমাদিগকে করিতেছ। অবশেষে তোমরা জানিতে পারিবে’।” ক্বোরআন ১১।৩৮)। ইহার অনেক পরে, তিনি তাঁহার অনুগামিগণকে অনেকবার স্বর্গীয় সাহায্য দ্বারা জয়লাভের প্রতিশ্রুতি দিয়াছিলেন, এবং ইহার সময়ও নির্দিষ্ট করিয়া দিয়াছিলেন। কিন্তু যখন নির্দিষ্ট সময় উপস্থিত হইল, স্বর্গীয় প্রতিশ্রুতি প্রতিপালিত হইল না। ইহাতে তাঁহার অল্পসংখ্যক অনুগামিদের মধ্য হইতেও কতক লোক তাঁহার ধর্ম ত্যাগ করিয়া তাঁহার নিকট হইতে বিচ্ছিন্ন হইল, এবং অনেক প্রসিদ্ধ গ্রন্থের লিপিবদ্ধ বিবরণ ইহার সাক্ষ্য বহন করিতেছে। আপনি নিশ্চয়ই এই সকল পড়িয়া থাকিবেন, যদি না পড়িয়া থাকেন, তাহা হইলে আপনি অবশ্যই ইহা পড়িয়া লইবেন। ঐতিহাসিক গ্রন্থাদিতে এবং হাদিসসমূহে এইরূপ বর্ণিত আছে যে, শেষ পর্যন্ত তাঁহার অনুগামিদের মধ্যে মাত্র চল্লিশ কি বাহাত্তর জন লোক তাঁহার সঙ্গে রহিল। অবশেষে অতি ভারাক্রান্ত অন্তঃকরণের সহিত তিনি প্রার্থনা করিলেনঃ হে প্রভূ! অবিশ্বাসীদের মধ্য হইতে একজনকেও ধরাপৃষ্ঠে রাখিও না।” (ক্বোরআন ৭১।২৬)।
এক্ষণে, এই সকল লোকের অবাধ্যতা সম্বন্ধে এক মূহুর্তের জন্য চিন্তা করিয়া দেখুন। তাহাদের পক্ষে এইরূপ অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যান করিবার কি কারণ থাকিতে পারে ? প্রত্যাখ্যানের বেশ পরিত্যাগ করিয়া গ্রহণের পরিবেশে অলঙ্কৃত হইতে কিই-বা তাহাদিগকে নিবৃত্ত করিতে সক্ষম হইত ? অধিকন্তু, স্বর্গীয় প্রতিশ্রুতি প্রতিপালিত না হওয়ারই বা কি কারণ ছিল, যে কারণে অনুসন্ধানকারীরা পূর্বে যাহা গ্রহণ করিয়াছিল, তাহারা তাহা প্রত্যাখ্যান করিল ? গভীরভাবে অনুধাবন করুন, যেন অদৃশ্যলোকের রহস্য আপনার নিকট প্রকাশিত হইতে পারে, যেন আপনি আধ্যাত্মিক অবিনশ্বর সৌরভের সুঘ্রাণ উপভোগ করিতে সমর্থ হন, এবং যেন আপনি এই সত্য স্বীকার করিতে পারেন যে, সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ অনাদি কাল হইতে অনন্ত কাল পর্যন্ত তাঁহার সেবকগণকে পরীক্ষা করিয়াছেন এবং পরীক্ষা করিতে থাকিবেন; যেন আলোক অন্ধকার হইতে, সুখ দুঃখ হইতে, গোলাপ পুষ্প কণ্টক হইতে প্রভেদ করিয়া লইতে পারা যায়। তজ্জন্য তিনি অবতীর্ণ করিয়াছেনঃ “মানুষ কি এই মনে করে যে, ‘আমরা বিশ্বাস করি’ বলিলেই তাহাদিগকে ছাড়িয়া দেওয়া হইবে এবং তাহাদিগকে পরীক্ষা করা হইবে না ?” ( ক্বোরআন ২৯।২)।
নূহ (আঃ)-র পরে হূদ (আঃ)-র সুষমার আলোক নব-সৃষ্টির চক্রবালের উপর উজ্জ্বল কিরণ প্রদান করিল। ভিন্ন ভিন্ন্ লোকের মতানুসারে প্রায় সাত শত বৎসর যাবত তিনি জনগণকে স্বর্গীয় বিভূতির নৈকট্যের স্বর্গোদ্যানের দিকে মুখ ফিরাইয়া অগ্রবর্তী হইতে উৎসাহিত করিতে লাগিলেন। কিন্তু অজস্র বিপদসমূহ বর্ষার বৃষ্টি-ধারার ন্যায় তাঁহার উপর বর্ষিত হইল। অবশেষে তিনি যতই অধিক শপথ-বাক্যাবলী উচ্চারণ করিলেন, তাহাদের বিদ্রোহ ততই অধিক বৃদ্ধি পাইল, এবং তাঁহার অক্লান্ত উদ্যমসমূহ তাঁহার দেশবাসীদের মধ্যে কেবল ইচ্ছাকৃত অন্ধত্বের ফলই প্রসব করিল। “তাহাদের (অবিশ্বাসীদের) অবিশ্বাস কেবল তাহাদের নিজেদের ধ্বংসের পথই প্রশস্ত করিল।” ক্বোরআন ৩৫।৩৯)।
এবং তাঁহার পর পবিত্র পুরুষ সালেহ্ (আঃ) অনাদি অনন্ত অদৃশ্য স্বর্গরাজ্যের উদ্যান হইতে আবির্ভূত হইয়া পুনরায় জনগণকে চিরস্থায়ী জীবন-নদের দিকে আহ্বান করিতে লাগিলেন। তিনি এক শত বছরের অধিককাল যাবৎ উপদেশ দিতে লাগিলেন, যেন তাহারা আল্লাহর আদেশসমূহ দৃঢ়তার সহিত পালন করিতে থাকে, এবং যাহা নিষিদ্ধ করা হইয়াছে, তাহা পরিত্যাগ করে। কিন্তু তাঁহার উপদেশ ফলপ্রসূ হইল না। অনেকবার তিনি চক্ষুর অন্তরালে গমন করিয়া সংসারত্যাগীর ন্যায় বাস করিতে লাগিলেন। এইরূপ ব্যবহারই তিনি জনগণের নিকট হইতে প্রাপ্ত হইলেন, যদিও সেই অনন্ত সুষমা মনুষ্যগণকে কেবল আল্লাহর শাশ্বত ধর্ম-নগরের দিকে আহ্বান করিতেছিলেন। এই সম্বন্ধে অবতীর্ণ হইয়াছেঃ “সমুদয় জাতির নিকট তাহাদের ভ্রাতা সালেহ্কে পাঠাইলাম। তিনি বলিলেনঃ ‘হে আমার সম্প্রদায়ের লোকগণ! তোমরা একমাত্র আল্লাহরই উপাসনা কর, তিনি ভিন্ন তোমাদের অন্য কোন উপাস্য নাই।” তাহারা বলিলঃ ‘হে সালেহ্! নিশ্চয়ই ইতিপূর্বে তুমি আমাদের আশা-ভরসার স্থল ছিলে; আমাদের পূর্ব-পুরুষগণ যাহাদের উপাসনা করিত, তুমি কি এখন তাহাদের উপাসনা করিতে আমাদের নিষেধ করিতেছ ? আমরা বাস্তবিকই তৎ সম্বন্ধে ঘোরতর সন্দেহের মধ্যে অবস্থান করিতেছি’।”( ক্বোরআন ১১।৬১-৬২)। এই সকলে কিছুই ফল হইল না, অবশেষে এক মহা নিনাদ উত্থিত হইল, এবং সকলেই সম্পূর্ণরূপে ধ্বংসমুখে পতিত হইল।
পরবর্তী সময়ে, ‘আল্লাহর বন্ধু’র (ইব্রাহিম খলিলুল্লাহ্র) আনন-সুষমা পর্দার অন্তরাল হইতে আবির্ভূত হইল, এবং স্বর্গীয় পথ-প্রদর্শনের আর একটি পতাকা উত্তোলিত হইল। তিনি পৃথিবীর লোকগণকে ন্যায়পরায়ণতার আলোকের দিকে আহ্বান করিলেন। তিনি যতই অধিকতর অনুরাগ সহকারে তাহাদিগকে উৎসাহিত করিতে লাগিলেন, লোকের হিংসা, দ্বেষ, ও অবাধ্যতা ততই প্রচন্ডতর হইল; কিন্তু ঐ সকল লোক ব্যতীত, যাহারা আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য সকল হইতে নিজেদের সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন করিয়াছিল এবং নিশ্চয়তার পক্ষ সহকারে সেই পদমর্যাদার দিকে উড্ডীন হইয়াছিল—যাহা আল্লাহ্ মানবের উপলব্ধির অতি উচ্চে উন্নীত ও মহিমান্বিত করিয়াছেন। ইহা সকলেই বিদিত আছে যে, অনেক শত্রু তাঁহাকে বেষ্টন করিয়াছিল, অবশেষে তাঁহার বিরুদ্ধে ঈর্ষা ও বিদ্রোহের অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করা হইল। তাঁহাকে অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করিবার সে কাহিনী সর্বসাধারণের নিকট পরিজ্ঞাত, সেই ঘটনার পর, জনগণ তাঁহাকে, যিনি মানুষের মধ্যে ঐশী-প্রদীপস্বরূপ ছিলেন, তাঁহার নিজ নগরী হইতে নির্বাসিত করিয়াছিল। এই কথা সকল গ্রন্থে ও ইতিবৃত্তে লিপিবদ্ধ আছে।
এবং যখন তাঁহার যুগ অতীত হইল, মূসা (আঃ)-র যুগ আসিয়া উপস্থিত হইল। স্বর্গীয় রাজত্বের রাজদন্ডে সজ্জিত হইয়া, স্বর্গীয় জ্ঞানের শ্বেত-হস্তে অলঙ্কৃত হইয়া, এবং ঐশী-প্রেমের ফারান উপত্যকা হইতে অগ্রবর্তী হইয়া, এবং শক্তি ও অনন্ত মহিমার ‘অজগর’ সর্পকে পরিচালিত করিয়া, তিনি সিনাই পার্বত্য আলোকে আলোকিত হইয়া ধরাপৃষ্ঠে উজ্জ্বল কিরণ প্রদান করিতে লাগিলেন। পৃথিবীর সকল জাতির ও স্বজাতির লোকগণকে তিনি অনন্ত রাজত্বের দিকে আহ্বান করিলেন, এবং তাহাদিগকে বিশ্বস্ততা-বৃক্ষের ফল ভোগ করিবার জন্য আমন্ত্রণ করিলেন। নিশ্চয়ই আপনি ফেরাঊনের ও তাহার লোকদের ভীষণ বিরোধিতার কথা, এবং সেই পবিত্র বৃক্ষের (মূসার) প্রতি অবিশ্বাসীদের হস্তসমূহ অলস-কল্পনার যে সকল লোষ্ট্র নিক্ষেপ করিয়াছিল, সে সম্বন্ধে অবগত আছেন। ব্যাপার এতদূর অগ্রসর হইল যে, ফেরাঊন ও তাহার জাতি অবশেষে তাঁহার বিরুদ্ধে দন্ডায়মান হইল, এবং তাহাদের অসত্যবাদিতা ও প্রত্যাখ্যান-রূপ বারি-বর্ষণ দ্বারা সেই পবিত্র বৃক্ষের অনল নির্বাপিত করিতে তাহারা চরম উদ্যম প্রয়োগ করিল; কিন্তু তাহারা এই সত্য ভুলিয়া গিয়াছিল যে, কোন পার্থিব সলিল স্বর্গীয় জ্ঞান-বিজ্ঞতার অগ্নিশিখা নির্বাপিত করিতে সক্ষম নহে, আর, কোনও নশ্বর মানবীয় বাত্যাসমূহ শাশ্বত রাজ্যের প্রদীপ নির্বাপিত করিতে পারে না। না, বরং এইরূপ সলিল অগ্নিশিখার দাহনশক্তিকে অত্যুগ্র না করিয়া ছাড়ে না, এবং এইরূপ ঝঞ্ঝাবাত প্রদীপ-সংরক্ষণের নিশ্চয়তা দান না করিয়া যায় না; যদি আপনি তীক্ষ্ন দৃষ্টি সহকারে দেখিতেন এবং আল্লাহর পবিত্র ইচ্ছা ও সন্তোষের পথে ভ্রমণ করিতেন, তাহা হইলে নিশ্চয়ই ইহা বুঝিতে সক্ষম হইতেন। ফেরাঊনের স্বজাতীয় একজন বিশ্বাসী কত সুন্দর বর্ণনা-ই না দিয়াছে, এবং তাহার কাহিনী মহিমাময় পরম প্রভূ তাঁহার গ্রন্থে (ক্বোরআনে) উল্লেখ করিয়াছেন, যাহা তাঁহার প্রেমাস্পদের প্রতি অবতীর্ণ হইয়াছে। তিনি অনুযোগ সহকারে বলিলেনঃ “ফেরাঊনের পরিবারের একজন বিশ্বাসী লোক, যে নিজ বিশ্বাস গোপন করিত, বলিলঃ ‘তোমরা কি একজন লোককে বধ করিবে, যেহেতু তিনি বলেন—“আল্লাহ্ আমার প্রতিপালক প্রভূ”, এবং তিনি তোমাদের প্রভূর নিকট হইতে স্পষ্ট নিদর্শনাদিসহ তোমাদের নিকট আসিয়াছেন ? এবং তিনি যদি মিথ্যাবাদী হন, তবে তাঁহার মিথ্যা-বাক্যের জন্য তিনিই শাস্তি ভোগ করিবেন; কিন্তু তিনি যদি সত্যবাদী হন, তবে তিনি যে শাস্তির ভয় প্রদর্শন করিতেছেন, তাহার কতকাংশ তোমাদের উপর পতিত হইবে। সত্য সত্যই, যে ব্যক্তি সীমা লঙ্ঘনকারী ও মিথ্যাবাদী, তাহাকে আল্লাহ্ সুপথ প্রদর্শন করেন না’।” (ক্বোরআন ৪০।২৮)। অবশেষে, তাহাদের অবিচার এতই বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হইল যে, তাহারা সেই বিশ্বাসী ব্যক্তিকে নির্লজ্জভাবে নিহত করিত। “অত্যাচারীদের উপর আল্লাহর অভিসম্পাত বর্ষিত হউক।”
এবং এক্ষণে, এই সকল বিষয় সম্বন্ধে একটু গভীরভাবে চিন্তা করিয়া দেখুন। এইরূপ বিবাদ ও বিরোধিতার কারণ কিই-বা ছিল ? আল্লাহর প্রত্যেক সত্য প্রকাশের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে কেন পৃথিবীতে এইরূপ বিরোধ ও শোর-গোল, অত্যাচার ও অভ্যুত্থান দৃষ্ট হয় ? এইরূপই ঘটিয়া থাকে, যদিও আল্লাহর সকল সুসংবাদদাতা পৃথিবীর জাতিসমূহের নিকট আত্মপ্রকাশ করিয়াছেন, তাঁহাদের প্রত্যেকেই তাঁহাদের জীবদ্দশায় আর একজন পরবর্তী সুসংবাদদাতার আগমন সম্বন্ধে একইভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করিয়াছেন, এবং এইরূপ নিদর্শনসমূহ স্থাপিত করিয়া গিয়াছেন, যাহা ভবিষ্যতের ধর্ম-বিধানের আবির্ভাব সম্বন্ধে অগ্রদূতের ন্যায় ঘোষণাবাণী প্রচার করিবে। এই বাক্যের সত্যতা সম্বন্ধে সকল পবিত্র গ্রন্থের লিপিবদ্ধ বাণীসমূহ সাক্ষ্য প্রদান করিতেছে। তবে কেন আল্লাহর পবিত্রতার প্রকাশগণের আবির্ভাব সম্বন্ধে অনুসন্ধান রত মানুষের পক্ষে আশান্বিভাবে প্রতীক্ষা করা সত্ত্বেও এবং পবিত্র গ্রন্থসমূহে তৎ সম্বন্ধে লক্ষণাদি লিপিবদ্ধ থাকা সত্ত্বেও, প্রত্যেক যুগে এবং প্রত্যেক আবির্ভাবকালে আল্লাহর সুসংবাদদাতা ও মনোনীত মহাপুরুষগণের প্রতি এইরূপ উপদ্রব, অত্যাচারমূলক কার্যসমূহ সম্পাদিত হইল ? তিনি অবতীর্ণ করিয়াছেনঃ “যখন যখনই আল্লাহর একজন সুসংবাদবাহক তোমাদের নিকট এইরূপ কিছু লইয়া আসেন, যাহা তোমাদের নিজেদের বাসনার বিপরীত, তখনই তোমরা অহঙ্কারে স্ফীত হও এবং একদলকে প্রতারক বলিয়া অভিযুক্ত কর এবং অপর একদলকে বধ কর।” ক্বোরআন ২।৮৭)।
বিশেষভাবে বিবেচনা করিয়া দেখুন, এইরূপ অপকার্যাদির হেতু কিই-বা ছিল ? সর্বপ্রভাময়ের সুষমার অবতারণকারীদের প্রতি এইরূপ আচরণ করার দিকে কিই-বা তাহাদিগকে প্রবৃত্ত করিয়াছিল ? অতীত কালে ঐ সকল লোকের অস্বীকার ও বিরোধিতার যে হেতু ছিল, সেই একই হেতু বর্তমান যুগের মনুষ্যগণকে এক্ষণে পথভ্রষ্টতার দিকে লইয়া গিয়াছে। যদি এই ধারণা করা হয় যে, বিশ্ব-বিধাতার সাক্ষ্য-প্রমাণ অসম্পূর্ণ ছিল; সুতরাং ইহা জনগণের অস্বীকারের কারণ হইয়াছে, তাহা হইলে ইহা সুস্পষ্ট ধর্ম-বিরোধী বাক্য। ইহা সেই পরম উদার আল্লাহর অনুকম্পা হইতে অনেক দূরে এবং তাঁহার প্রেমপূর্ণ বিধান ও সদয় করুণারাশির প্রাচুর্য হইতে এত দূরে যে, তিনি তাঁহার প্রাণীকূলের পথপ্রদর্শকরূপে মানবগণের মধ্য হইতে একজনকে নির্বাচিত করিবেন, অথচ একদিকে, তাঁহাকে পরিপূর্ণ স্বর্গীয় প্রমাণাদি হইতে বঞ্চিত করিবেন এবং অন্যদিকে, তাঁহার মনোনীত পুরুষ হইতে মুখ ফিরাইয়া লইবার দরুন তাঁহার জনগণকে কঠোর শাস্তি প্রদান করিবেন। না, তাহা কখনই নহে; বরং সর্বজীবের প্রভূর বহুবিধ বদান্যতা, সর্বসময়ে, তাঁহার নিজ স্বর্গীয় সার-সত্তার প্রকাশগণের মধ্যস্থতায় সমগ্র জগৎ ও জগদ্বাসীদের পরিবেষ্টন করিয়া রাখিয়াছে। এক মূহুর্তের জন্যও তাঁহার অনুকম্পা হইতে তাহাদিগকে বঞ্চিত করা হয় নাই, মানব জাতির উপর তাঁহার স্নেহপূর্ণ দয়াশীলতার বারি-বর্ষণ ক্ষান্ত হয় নাই। ফলতঃ, এইরূপ আচরণ কেবল ঐ সকল সঙ্কীর্ণচেতা লোকেরই উপর অর্পিত হইতে পারে, যাহারা ঔদ্ধত্য ও অহঙ্কারের উপত্যকায় পদবিক্ষেপ করে, এবং তাহাদের ধর্ম-নেতাদের আদেশের অন্ধ-অনুকরণ করতঃ দূরত্বের জঙ্গলে পথহারা হইয়া পরিভ্রমণ করে ও নিজেদের অলস কল্পনার পথে চলিতে থাকে। তাহাদের প্রধান কার্য হইল কেবল বিরুদ্ধাচরণ; তাহাদের একমাত্র কামনা সত্যকে অস্বীকার করা। প্রত্যেক সত্য-দৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তির নিকট ইহা সুস্পষ্ট ও সুপ্রকটিত যে, যদি এই সকল লোক এই সমস্ত সত্য-সূর্যের প্রকাশগণের প্রত্যেকের আবির্ভাবের সময় তাহাদের চক্ষু, কর্ণ, ও অন্তরকে সকল দুষ্ট, শ্রুত ও অনুভূত বিষয়াদি হইতে পবিত্র রাখিত, তাহা হইলে তাহারা নিশ্চয়ই আল্লাহর সেই সুষমার অবলোকন হইতে বঞ্চিত হইত না, এবং প্রভা-ধামসমূহ হইতে বেশী দূরে বিচরণ করিত না। কিন্তু তাহাদের ধর্ম-নেতাদের শিক্ষাসমূহ হইতে সংগৃহীত তাহাদের জ্ঞানের তুলা- দ্বারা তাহারা যখন আল্লাহর অবতীর্ণ সাক্ষ্য-প্রমাণ পরিমাপ ও পরীক্ষা করিল, এবং ইহা তাহাদের সীমাবদ্ধ দুর্বল উপলব্ধির নিকট বিপরীত প্রতিপন্ন হইল, তখন তাহারা এইরূপ অপকার্যসমূহ করিবার জন্য দন্ডায়মান হইল।
প্রত্যেক যুগে ধর্ম-নেতাগণই তাহাদের অনুসরণকারী জনগণকে অনন্ত পরিত্রাণ-সাগরের তটভূমিতে উপনীত হওয়ার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করিয়াছে, কারণ জনগণের উপর কর্তৃত্বের লাগাম তাহারাই তাহাদের শক্তিশালী হস্তে ধারণ করিয়া রাখিয়াছে। তাহাদের মধ্যে কতক লোক নেতৃত্বের লালসার জন্য, অপর কতক লোক প্রকৃত জ্ঞান ও বোধশক্তির অভাবের কারণে জনগণকে সত্য-জ্ঞান হইতে বঞ্চিত রাখার কারণ হইয়াছে। তাহাদেরই স্বীকৃতি ও আদেশক্রমে, আল্লাহ প্রত্যেক সংবাদ-বাহককে স্বীয় প্রাণ বলিদানের পানপাত্র সেবন করিতে হইয়াছে, এবং প্রভা-রাজ্যের উচ্চ শৃঙ্গে উড্ডীন করিতে হইয়াছে। যাহারা কর্তৃত্ব ও বিদ্যার আসনাদি অধিকার করিয়া বসিয়াছিল, তাহারা পৃথিবীর ঐ সকল স্বর্গীয় গুণসম্পন্ন হীরকসদৃশ সত্য-সম্রাটগণের উপর কতই না অকথ্য, নিষ্ঠুর অত্যাচার বর্ষণ করিয়াছিল! তাহারা এই ক্ষণস্থায়ী কর্তৃত্বে সন্তুষ্ট থাকিয়া একটি অনন্ত সাম্রাজ্য হইতে নিজেদের বঞ্চিত করিয়া রাখিয়াছে। এইরূপে তাহাদের নয়ন সেই প্রেমাষ্পদের বিভূতির আলোক-দর্শন হইতে বঞ্চিত রহিল, এবং তাহাদের কর্ণ সেই অভিলষিত বুল্বুল্ পক্ষীর সুমধুর গীতির শ্রবণ হইতে নিরাশ হইল। এই কারণে, সমুদয় স্বর্গীয় গ্রন্থে প্রত্যেক যুগের ধর্ম-নেতাদের কার্য-কলাপাদি উল্লিখিত হইয়াছে। এই সম্বন্ধে তিনি বলিয়াছেনঃ “হে গ্রন্থধারী মনুষ্যগণ! তোমরা কেন আল্লাহর বাণী ও নিদর্শনাবলী অবিশ্বাস করিতেছ, অথচ তোমরা নিজেরাই ঐ সমুদয়ের সাক্ষী!” ( ক্বোরআন ৩।৭০)। তিনি আরও বলেনঃ “ হে গ্রন্থানুগামীগণ! তোমরা কেন সত্যকে মিথ্যার সহিত মিশ্রিত করিতেছ, এবং সত্যকে গোপন করিতেছ, অথচ তোমরা ইহা অবগত আছ ? ক্বোরআন ৩।৭১)। তিনি পুনঃ বলেনঃ “তুমি (হে মোহাম্মদ)(সঃ) বল, হে গ্রন্থ-প্রাপ্ত মনুষ্যগণ! তোমরা কেন বিশ্বাসীগণকে আল্লাহর পথ হইতে বিতাড়িত করিতেছ?” ক্বোরআন ৩।৯৯)। ইহা সুস্পষ্ট যে, “গ্রন্থধারী মনুষ্য”, যাহারা তাহাদের সহগামী জনগণকে আল্লাহর সরল পথ হইতে বিতাড়িত করিয়াছে, তাহারা সকলেই ঐ যুগের ধর্ম-নেতা ব্যতীত অন্য কেহই নহে, যাহাদের নাম ও স্বভাব সম্বন্ধে পবিত্র গ্রন্থাদিতে অবতীর্ণ হইয়াছে, এবং উল্লিখিত আয়াতসমূহ ও শ্রুতিবাক্যসমূহে (হাদিসে) এইগুলিরই ইঙ্গিত করা হইয়াছে, যদি আপনি আল্লাহর চক্ষু সহকারে দেখিতেন।
আল্লাহর নির্ভূল দৃষ্টিসঞ্জাত অটল একাগ্রতার সহিত কিছুকালের জন্য ঐশী জ্ঞানের চক্রবাল পরীক্ষা করুন এবং অনাদি অনন্ত প্রভূর সকাশ হইতে যে পূর্ণতাসম্পন্ন বাক্যাবলী অবতীর্ণ হইয়াছে, সেগুলি গভীরভাবে অনুধাবন করুন, যেন স্বর্গীয় জ্ঞান-বিজ্ঞতার রহস্যসমূহ, যাহা এখনও পর্যন্ত প্রভার অন্তরালে নিহিত এবং ঐশী অনুকম্পার ভান্ডারে সঞ্চিত, তাহা আপনার নিকট প্রকাশমান হইতে পারে। এই সকল ধর্ম-নেতার অস্বীকার ও আপত্তিসমূহ প্রধানতঃ তাহাদের জ্ঞান ও বোধশক্তির অভাবের কারণেই হইয়াছে। একমাত্র সত্য আল্লাহর বিভূতির প্রকাশগণের উচ্চারিত বাক্যাবলী, যাহা ভবিষ্যতে আগমনকারী পরবর্তী ঐশী প্রকাশের আবির্ভাব ঘোষণাকারী লক্ষণাদি বিবৃত করিয়াছিল, তাহা তাহারা কখনও বুঝিতে ও তাহার মর্ম ভেদ করিতে পারে নাই। এই কারণে তাহারা বিদ্রোহের পতাকা উত্তেলন করিয়াছিল, এবং অনিষ্টকারিতা ও বিদ্রোহ সৃষ্টির জন্য লোককে উত্তেজনা প্রদান করিয়াছিল। ইহা সুস্পষ্ট ও অতি পরিস্কার যে, অনাদি অনন্তের উচ্চারিত বাক্যাবলীর প্রকৃত মর্মার্থ চিরস্থায়ী অনাদি-অনন্ত সত্তার প্রকাশকারী ব্যতীত অপর কাহারো নিকট অবতীর্ণ হয় না, এবং স্বর্গীয় পবিত্রতার বুল্বুলের সুমধুর গীতসমূহ অনন্ত রাজ্যের নাগরিক ব্যতীত অন্য কাহারো কর্ণ শ্রবণ করিতে সক্ষম নহে। অত্যাচারী “কব্তী” জাতির লোকেরা কখনও ন্যায়পরায়ণ “সব্তী” লোকের ওষ্ঠ-স্পর্শিত পান-পাত্র হইতে পান করিতে পারে না, এবং অবিশ্বাসী ফেরাঊন সত্যের সেবক মূসা (আঃ)-র শ্বেত-হস্তের সঠিক মর্ম উপলব্ধি করিতে পারে না। যেমন তিনি বলেনঃ “আল্লাহ্ এবং গভীর জ্ঞানে সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিগণ ব্যতীত অপর কেহই ইহার প্রকৃত তাৎপর্য অবগত নহে।” (ক্বোরআন ৩।৭)। এবং ইহা সত্ত্বেও তাহারা অজ্ঞানতা-রূপ পর্দান্তরালাবৃত লোকের নিকট হইতে স্বর্গীয় গ্রন্থের তাৎপর্য অবগত হইতে চাহিয়াছে, এবং জ্ঞানের উৎস হইতে আলোক অনুসন্ধান করিতে অস্বীকার করিয়াছে।
এবং যখন মূসা (আঃ)-র যুগের অবসান হইল, এবং ঈসা (আঃ)-র আলোক পরমাত্মার প্রভাতকাল হইতে প্রকাশিত হইয়া পৃথিবী পরিবেষ্টিত করিল, তখন ইস্রায়েলের লোকেরা (ইহুদীরা) তাঁহাকে অস্বীকার করিবার জন্য দন্ডায়মান হইল। তাহারা এই বলিয়া আপত্তি করিল যে, যে মহাপুরুষের আবির্ভাব সম্বন্ধে তৌরীত গ্রন্থে ভবিষ্যদ্বাণী করা হইয়াছে, তাঁহাকে অবশ্যই মূসা (আঃ)-র বিধি-ব্যবস্থা প্রচার ও সম্পূর্ণ করিতে হইবে, কিন্তু এই নাসেরীয় যুবক যিনি আপনাকে “স্বর্গীয় মসীহ্” বলিয়া অভিহিত করিয়াছিলেন, তিনি স্ত্রী-বর্জন ও বিশ্রাম-দিবস পালন বিধিগুলি রহিত করিলেন—অথচ এই দুইটি ধর্ম-বিধান মূসা (আঃ)-র ধর্ম-বিধানসমূহের মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। অধিকন্তু, যে ঐশী প্রকাশ সম্বন্ধে ভবিষ্যতে আবির্ভূত হইবার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হইয়াছে, তাঁহার সমুদয় নিদর্শন এখনও প্রকাশিত হয় নাই। ইস্রায়েল বংশের এই সকল লোকেরা, এমন কি, বর্তমান সময় পর্যন্ত তৌরীত গ্রন্থে প্রতিশ্রুত ঐশী প্রকাশের জন্য প্রতীক্ষা করিয়া রহিয়াছে। মূসা (আঃ)-র সময়ের পর, কত অধিক স্বর্গীয় পবিত্রতার প্রকাশ, কত অধিক স্বর্গীয় অনন্ত আলোকের অবতরণকারী এই ধরাপৃষ্ঠে আবির্ভূত হইয়াছেন, তথাপি ইস্রায়েল বংশের এই সকল লোক নিজেদের কু প্রবৃত্তিপূর্ণ ধারণা ও মিথ্যা কল্পনার গভরীতম জালে জড়িত হইয়া এখনও প্রতীক্ষা করিয়া রহিয়াছে যে, তাহাদের সেই মানস-প্রতিমা তাহাদের কল্পিত নিদর্শনাবলীর সহিত আবির্ভূত হইবেন। এই প্রকারে আল্লাহ্ তাহাদিগকে তাহাদের পাপের জন্য ধৃত করিয়াছেন, তাহাদের মধ্যে বিশ্বাসের আত্মা নির্বাপিত করিয়াছেন এবং তাহাদিগকে নরকের নিম্নতম গহ্বরের অগ্নিশিখা দ্বারা যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি প্রদান করিয়াছেন। ইহা কেবল এই কারণে যে, ইস্রায়েলের লোকগণ তৌরীত গ্রন্থে প্রতিশ্রুত ভবিষ্যতে আগ মনকারী প্রকাশের নিদর্শনাবলী সম্বন্ধে যে সকল বাক্য অবতীর্ণ হইয়াছে, সেইগুলির তাৎপর্য উপলব্ধি করিতে অস্বীকার করিয়াছে। তাহারা উহার প্রকৃত অর্থ হৃদয়ঙ্গম করিতে পারে নাই, এবং প্রকাশ্যতঃ যখন এইরূপ ঘটনাবলীর কিছুই ঘটিল না, এইজন্য তাহারা যীশুর সুষমার পরিচয় ও ঐশী বিভূতি অবলোকন হইতে বঞ্চিত রহিল, এবং তাহারা এখনও পর্যন্ত তাঁহার আগমন প্রতীক্ষা করিয়া রহিয়াছে! স্মরণাতীত কাল হইতে এ পর্যন্ত, পৃথিবীর সকল জাতি ও সকল লোক, এইরূপ কাল্পনিক ও নিরর্থক ধারণাসমূহে আবদ্ধ থাকিয়া, বিশুদ্ধতা ও পবিত্রতার উৎসসমূহ হইতে যে নির্মল জলরাশি প্রবাহিত হইয়াছে, তাহা হইতে নিজেদের বঞ্চিত করিয়া রাখিয়াছে।
এই সমস্ত রহস্যের মর্ম উদ্ঘাটন করিবার জন্য আমরা আমাদের একজন বন্ধুর নিকট লিখিত পূর্ববর্তী ফলক-লিপিসমূহে সুমধুর হেজাজী ভাষায় অতীত কালের ঐশী সুসংবাদদাতাগণের নিকট অবতীর্ণ কতিপয় আয়াত উদ্ধৃত করিয়াছিলাম। এবং এক্ষণে আপনার অনুরোধ রক্ষার্থে এই পৃষ্ঠাগুলিতে আমরা পুনরায় ঐ সকল আয়াত উদ্ধৃত করিবঃ এবার কিন্তু আশ্চর্যজনক ইরাকী সুরে, যাহাতে হয়ত দূরবর্তী মরুপ্রান্তরে ভ্রমণকারী, অতীব পিপাসার্তগণ, স্বর্গীয় মিলনের মহাসাগরের তীরে পৌঁছিতে পারে এবং যাহারা বিচ্ছেদের জঙ্গলসমূহে শ্রান্ত ও ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছে, তাহারা যেন চিরস্থায়ী পুনর্মিলন-ধামের দিকে পরিচালিত হইতে পারে। এই প্রকারে ভ্রান্তির কুয়াশাসমূহ বিদূরিত হইতে পারে, এবং স্বর্গীয় সত্য-পথের উজ্জ্বল আলোক মানব-অন্তরসমূহের দিক্ম-লের উপর প্রভাতিক কিরণ বিকীরণ করিতে পারে। আল্লাহরই উপর আমরা নির্ভরশীল, এবং তাঁহারই নিকট আমরা সাহায্য প্রার্থনা করি, যেন এই লেখনী হইতে তাহাই প্রবাহিত হয়, যাহা মানুষের অন্তরসমূহে প্রাণ সঞ্চার করে, যেন তাহারা সকলেই তাহাদের উদাসীনতা-রূপ সমাধির বিশ্রামাগার হইতে উত্থিত হইতে পারে এবং যেন আল্লাহর আদেশক্রমে, ঐশী শক্তির হস্ত সর্বপ্রভাময় স্বর্গীয় “রেজওয়ান” উদ্যানে যে বৃক্ষ রোপণ করা হইয়াছে, তাহা হইতে ঐশী স্বর্গের পত্রসমূহের সুমধুর গীতি শুনিতে পায়।
বোধশক্তিসম্পন্ন লোকের নিকট ইহা সুস্পষ্ট ও প্রকটমান যে, যখন যীশুর ঐশী-প্রেমের অগ্নি ইহুদীদের বিরোধিতা-রূপ অন্তরালসমূহের সীমারেখাগুলি ভস্মীভূত করিল, এবং, কর্তৃত্ব সুস্পষ্ট হইল ও কিয়ৎ পরিমাণে সংস্থাপিত হইল, তখন তিনি সেই অদৃশ্যের সুষমার প্রকাশক, একদিন তাঁহার অনুগামিদের সম্বোধন করিয়া তাঁহার পরলোক-গমন সম্বন্ধে উল্লেখ করিলেন, এবং তাহাদের অন্তরসমূহে বিচ্ছেদ-অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করিয়া তাহাদিগকে বলিলেনঃ “আমি চলিয়া যাইতেছি এবং পুনরায় তোমাদের নিকট আসিব। (যোহন ১৪ অধ্যায় ৩ পদ)। অন্য এক স্থানে তিনি বলিয়াছেনঃ “আমি যাইতেছি, এবং অপর একজন আসিবেন, যিনি তোমাদিগকে ঐ সকল কথা বলিবেন, যাহা আমি তোমাদিগকে বলি নাই। এবং যাহা আমি বলিয়াছি, তৎ সমুদয় তিনি পূর্ণ করিবেন।” (যোহন ১৪ অধ্যায় ২৬ পদ)। এই দুইটি পদের অর্থ বাস্তবিকপক্ষে একই—যদি আপনি আল্লাহর এককত্বের প্রকাশগণ সম্বন্ধে স্বর্গীয় তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সহিত গভীরভাবে অনুধাবন করিতে সমর্থ হন।
প্রত্যেক তীক্ষ্ন বুদ্ধিসম্পন্ন পরিদর্শক ইহা স্বীকার করিবে যে, ক্বোরআন গ্রন্থের ধর্ম-বিধানে যীশুর ধর্মগ্রন্থ এবং ধর্ম উভয়ই সপ্রমাণিত হইয়াছিল। নামের সম্বন্ধে হজরত মোহাম্মদ (সঃ) স্বয়ং ঘোষণা করিয়াছেনঃ “আমিই ঈসা।” তিনি যীশুর বর্ণিত নিদর্শনাবলী, ভবিষ্যদ্বাণীসমূহ ও বাক্যাবলীর সত্যতা স্বীকার করিয়াছিলেন এবং সাক্ষ্যদান করিয়াছিলেন যে, এই সকলই আল্লাহর নিকট হইতে আসিয়াছিল। এই অর্থে, যীশুর ব্যক্তিত্ব ও তাঁহার ধর্মগ্রন্থের লিপিসমূহের এবং হজরত মোহাম্মদ (সঃ)-র ব্যক্তিত্ব ও তাঁহার পবিত্র ধর্মগ্রন্থের মধ্যে কোনও পার্থক্য নাই, কারণ উভয়েই আল্লাহর ধর্মার্থে অভ্যুত্থান করিয়াছিলেন, উভয়েই আল্লাহর প্রশংসা-গীতি গান করিয়াছিলেন এবং উভয়েই তাঁহারই আদেশাবলী অবতীর্ণ (প্রকাশ) করিয়াছিলেন। এইজন্যই যীশু স্বয়ং ঘোষণা করিয়াছেনঃ “আমি চলিয়া যাইতেছি এবং পুনরায় তোমাদের নিকট আসিব।”( যোহন ১৪।৩)। সূর্য সম্বন্ধে বিবেচনা করিয়া দেখুন। যদি অদ্যকার এই কথা বলে, ‘আমি গতকালের সূর্য’, তবে ইহা সত্য কথাই বলিবে। এবং যদি দিবসের ক্রম হিসাবে বলে, “আমি গতকালের সূর্য হইতে ভিন্ন,’ ইহাও সত্য বৈ মিথ্যা হইবে না। এইরূপে, যদি ইহা বলা হয় যে, সকল দিনই এক ও অভিন্ন; তবে তাহা সত্য, মিথ্যা নহে। এবং তাহাদের নাম ও মর্যাদা হিসাবে যদি এই কথা বলা হয় যে, তাহারা পরস্পর বিভিন্ন; তবে ইহাও ঠিক। কারণ যদিও তাহারা সকলেই এক, তবুও তাহারা প্রত্যেকে নাম, বিশেষণ ও পদবী হিসাবে পৃথক পৃথক দৃষ্ট হয়। এই একই নিয়মানুসারে আপনি বিভিন্ন ঐশী পবিত্রতার প্রকাশগণের স্বাতন্ত্র্য, প্রভেদ ও একত্বের পদবীর বৈশিষ্ট্য বুঝিয়া লউন, যেন আপনি, নাম ও বিশেষণাদির সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্ একত্ব ও পৃথকত্বের রহস্যাদি সম্বন্ধে যাহা ইঙ্গিত করিয়াছেন, তাহার মর্ম উপলব্ধি করিতে পারেন, এবং আপনার জিজ্ঞাসিত এই প্রশ্নের উত্তর সম্বন্ধে অবগত হইতে পারেন—কেন সেই চিরস্থায়ী সুষমা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে নিজেকে বিভিন্ন নাম ও পদবীতে অভিহিত করিয়া প্রকাশ করিয়াছেন।
ইহার পর, যীশুর সঙ্গী ও অনুগামিগণ তাঁহাকে ঐ সমুদয় লক্ষণাদি সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করিল—যাহা তাঁহার পুনরাগমনের সংকেত ঘোষণা করিবে। তাহারা জিজ্ঞাসা করিলঃ “কখন এই সকল সংঘটিত হইবে ?” (মথি ২৪।৩)। কয়েক বার এই অতুলনীয় সুষমাকে তাহারা জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, এবং প্রত্যেক বারই তিনি উত্তর দান করিয়াছিলেন, এবং প্রত্যেক বারই তিনি এক একটি বিশেষ লক্ষণ বর্ণনা করিয়াছিলেন — যাহা প্রতিশ্রুত ধর্ম-বিধানের আবির্ভাব ঘোষণা করিবে। চারিটি ইঞ্জিলের লিপিবদ্ধ বাক্যাবলী ইহার সাক্ষ্য প্রদান করিতেছে।
এই অত্যাচারিত ব্যক্তি উহাদের মধ্য হইতে কেবল একটিমাত্র দৃষ্টান্ত উদ্ধৃত করিবে, এবং এইরূপে, আল্লাহরই জন্য, মানব জাতির উপর এই প্রকারের অনুকম্পাদি বিতরণ করিবে, যাহা এখনও পর্যন্ত সেই পবিত্র ও নিহিত বৃক্ষের ভান্ডারে গোপনীয়ভাবে রহিয়াছে, যেন হয়ত বিনশ্বর মানব সেই অবিনশ্বর ফলে তাহাদের অংশ হইতে বঞ্চিত না হয়, এবং যেন অনন্ত জীবন-নদীসমূহের এক বিন্দু সলিল পান করিতে সক্ষম হয়, যাহা শান্তি নগরী, বাগদাদ হইতে সকল মানব জাতির জন্য প্রবাহিত করা হইতেছে। আমরা প্রতিফলও চাহি না, পুরস্কারও চাহি না। “আমরা তোমাদিগকে কেবল আল্লাহর জন্যই খাদ্যদান করিতেছি। তোমাদের নিকট হইতে কোনও প্রতিদান ও ধন্যবাদ চাহি না।” (ক্বোরআন ৭৬।৯)। ইহা ঐ খাদ্য, যাহা পবিত্র ও উজ্জ্বল আত্মাবিশিষ্ট লোককে অনন্ত জীবন দান করিয়া থাকে। ইহা ঐ খাদ্য, যাহার সম্বন্ধে বলা হইয়াছেঃ “ হে আমার প্রভূ! স্বর্গ হইতে আমাদের জন্য খাদ্য অবতীর্ণ কর।” (ক্বোরআন ৫।১১৭)। যাহারা ইহার যোগ্য পাত্র, এই খাদ্য হইতে তাহাদিগকে কখনও বঞ্চিত করা হইবে না, এবং ইহা কখনও নিঃশেষিত হইতে পারে না। অনুকম্পার বৃক্ষ হইতে ইহা চিরস্থায়ীভাবে জন্মলাভ করে; ন্যায়ের ও করুণার আকাশম-ল হইতে সকল ঋতুতেই অবতরণ করে। যেমন তিনি বলিয়াছেনঃ তুমি কি ইহা লক্ষ্য কর নাই, আল্লাহ্ একটি ভাল কথার কিরূপ দৃষ্টান্ত প্রদান করেন ? উহা একটি উত্তম বৃক্ষের মত, যাহার মূল দৃঢ়ভাবে সংবদ্ধ এবং উহার শাখা গগন-স্পর্শী। উহার প্রভূর আদেশে সকল ঋতুতে উহা ফল প্রদান করে। (ক্বোরআন ১৪।২৪-২৫)।
ইহা কতই অনুশোচনার বিষয় যে, মানুষ এই উৎকৃষ্ট দান হইতে, এই অবিনশ্বর বদান্যতা হইতে, এই চিরস্থায়ী জীবন হইতে নিজেকে বঞ্চিত করিয়া রাখিবে। তাহার উচিত, স্বর্গ হইতে যে খাদ্য আসে, উহার উপযুক্ত মর্যাদা দান করা, যেন হয়ত সত্য-সূর্যের এই অত্যাশ্চর্য অনুকম্পাসমূহের মধ্যস্থতায় মৃত ব্যক্তিগণ নবজীবন পাইতে পারে, এবং মৃতপ্রায় শুষ্ক আত্মাসমূহ অনন্ত ঐশী আত্মা দ্বারা সজীবতা প্রাপ্ত হইতে পারে। হে ভ্রাতঃ! ত্বরা করুন, যেন সময় থাকিতে আমাদের ওষ্ঠসমূহ অমর সুধার এক চুমুক আস্বাদন করিতে পারে, কেন না, প্রিয়তম বন্ধুর নগর হইতে জীবনদায়িনী বায়ুর প্রবাহ অধিক কাল স্থায়ী হইতে পারে না, এবং পবিত্র বাক্যোচ্চারণের প্রবহমান নদীর স্রোত নিশ্চয়ই নিস্তব্ধ হইবে, এবং “ রেজওয়ান” স্বর্গোদ্যানের দ্বারসমূহ চিরকাল অবারিত থাকিতে পারে না। সময় নিশ্চয় আসিবে, স্বর্গীয় বুল্বুল্ ইহার পার্থিব ধাম হইতে ইহার স্বর্গীয় নীড়ের দিকে উড্ডীয়মান হইবে। তৎপর ইহার সুমধুর গানের সুর আর শুনা যাইবে না এবং গোলাপ পুষ্পের সুষমা উজ্জ্বল কিরণ প্রদানে ক্ষান্ত হইবে। স্বর্গীয় বসন্তকালের প্রভা অতিবাহিত হওয়ার পূর্বে এবং অনন্তের পক্ষীর সুমধুর সুর-সঞ্চার নিস্তব্ধ হওয়ার পূর্বে সময়ের সুযোগ গ্রহণ করুন, যেন আপনার অন্তর-কর্ণ এই গীতি শ্রবণ হইতে বঞ্চিত না হয়। আপনার প্রতি এবং আল্লাহর প্রিয় ব্যক্তিদের প্রতি ইহাই আমার উপদেশ। যাহার ইচ্ছা সে উহা গ্রহণ করুক; যাহার ইচ্ছা সে উহা হইতে বিমুখ হউক। আল্লাহ্ নিশ্চয়ই তাহা হইতে এবং যাহা সে দেখিতে ও প্রত্যক্ষ করিতে পারে, তাহা হইতে স্বাধীন ও মুক্ত।
এই সকল গানই মরিয়মের পুত্র যীশু ইঞ্জিলের স্বর্গোদ্যানে মহিমান্বিত শক্তির সুরে তাঁহার পরবর্তী প্রকাশের আবির্ভাবের আবশ্যকীয় লক্ষণাদি ঘোষণা করিয়া গাহিয়াছিলেন। মথি লিখিত প্রথম ইঞ্জিল গ্রন্থে এইরূপ লিপিবদ্ধ আছেঃ “এবং যখন তাহারা তাঁহাকে আগমনের লক্ষণসমূহ সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, তিনি তাহাদিগকে বলিলেনঃ সেই সময়ের অত্যাচার ও ক্লেশের ঠিক পরবর্তী কালে সূর্য অন্ধকার হইবে, এবং চন্দ্র আলোক দিবে না এবং আকাশ হইতে তারকাসমূহ পতিত হইবে, এবং পৃথিবীর শক্তিসমূহ প্রকম্পিত হইবে, আর যখন মনুষ্য পুত্রের লক্ষণ আকাশে প্রকাশিত হইবে, এবং, তখন পৃথিবীর সকল জাতি বিলাপ করিবে এবং তাহারা মানব-পুত্রকে আকাশের মেঘমালার মধ্যে শক্তি ও মহান্ প্রতাপের সহিত আসিতে দেখিবে। এবং তিনি তাঁহার স্বর্গীয় দূতগণকে বিশাল ভেরী-নিনাদ সহকারে প্রেরণ করিবেন।” (মথি ২৪।২৯-৩১)। পারস্য ভাষার অনুবাদে এই বাক্যগুলির মর্ম এইঃ “যখন অত্যাচার ও দুঃখাবস্থা যাহা মানব জাতির উপর অবশ্যই ঘটিবার, তাহা সংঘটিত হইবে, তখন সূর্য কিরণ দান হইতে, চন্দ্র আলোক প্রদান হইতে ক্ষান্ত থাকিবে, আকাশের তারকাগুলি ভূতলে পতিত হইবে, এবং পৃথিবীর শক্তিরূপ স্তম্ভগুলি কম্পিত হইবে। সেই সময়ে, আকাশে মানবপুত্রের নিদর্শনগুলি প্রকাশ পাইবে, অর্থাৎ যখন এই সকল লক্ষণ প্রকাশিত হইয়া পড়িবে, প্রতিশ্রুত সুষমা ও জীবন-সত্তা অদৃশ্য রাজ্য হইতে দৃশ্যমান জগতে আবির্ভূত হইবেন।” এবং তিনি আরও বলেনঃ “সেই সময়ে পৃথিবীর অধিবাসী সকল জাতির লোক বিলাপ ও শোক করিবে; এবং তাহারা সেই স্বর্গীয় সুষমাকে মেঘমালার উপর আরোহণ করিয়া শক্তি, ঐশ্বর্য ও জাঁক-জমকের সহিত স্বর্গ হইতে আসিতে দেখিবে, এবং তিনি তাঁহার ফেরেশতাগণকে বিশাল ভেরী-নিনাদ সহকারে চতুর্দিকে প্রেরণ করিবেন।” এইরূপ, একই প্রকার বাণী অপর তিন ইঞ্জিলে, যথা লুক, মার্কস ও যোহনের ইঞ্জিলে লিপিবদ্ধ অবস্থায় পাওয়া যাইবে। আরবী ফলক-লিপিসমূহে এই সকল বাক্য আমরা বিস্তৃতভাবে বর্ণনা করিয়াছি, এই কারণে এখানে ঐ সকল উল্লিখিত হইল না, আর আমরা একটি মাত্র বাক্যের ইঙ্গিতই যথেষ্ট মনে করিয়াছি।
খ্রীস্টান ধর্মাচার্যগণ এই সকল বাক্যের মর্মার্থ বুঝিতে পারে নাই, এবং এই সকল বাক্যের নিহিত তাৎপর্য ও উদ্দেশ্য ধরিয়া লইতে সক্ষম হয় নাই এবং যীশুর বাক্যাবলীর কেবল আক্ষরিক অর্থের দিকেই ঝুঁকিয়া রহিয়াছে : সুতরাং তাহারা হজরত মোহাম্মদ (সঃ)-র নিকট অবতীর্ণ অনুগ্রহ-বাণীর প্রবাহ হইতে এবং ইহার বদান্যতা-রূপ মেঘমালার বর্ষণ হইতে বঞ্চিত রহিয়াছে। খ্রীস্টান সম্প্রদায়ের অজ্ঞ ও অশিক্ষিত লোকেরা তাহাদের ধর্ম-নেতাদের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করায় সেই মহিমাময় সম্রাটের সুষমার দর্শন হইতে তাহারাও বঞ্চিত হইয়াছিল, কারণ হজরত মোহাম্মদ (সঃ)-র ধর্মবিধান-রূপ সূর্যের প্রভাতকালে যে সকল লক্ষণ প্রকটিত হওয়ার কথা ছিল, বাস্তবিক পক্ষে সেগুলি সেইরূপভাবেই সংঘটিত হয় নাই। এইরূপে, যুগের পর যুগ, শতাব্দীর পর শতাব্দী অতীত হইয়া গিয়াছে, এবং অতীব পবিত্র আত্মা নিজ চিরস্থায়ী সাম্রাজ্যে প্রত্যাবর্তন করিয়াছেন। আর একবার সেই অনাদি-অনন্ত আত্মা সেই ঐশী-ভেরী নিনাদিত করিয়াছেন, এবং মৃত ব্যক্তিগণকে তাহাদের উদাসীনতা ও ভ্রান্তির সমাধিসমূহ হইতে বহির্গত করিয়া সত্য পথ ও অনুকম্পার রাজ্যের দিকে দ্রুতগতিতে অগ্রবর্তী করিয়াছেন। এবং, তথাপি, সেই প্রতীক্ষমান খ্রীস্টান সম্প্রদায় এখনও পর্যন্ত চিৎকার করিতেছেঃ “কখন এই সকল সংঘটিত হইবে ? আমাদের সেই প্রতিশ্রুত মহামানব, যাঁহার জন্য আমরা প্রতীক্ষা করিয়া রহিয়াছি, কখন প্রকাশিত হইবেন : যেন তাঁহার ধর্মের বিজয় লাভের জন্য আমরা দন্ডায়মান হইতে পারি, যেন তাঁহার জন্য আমরা আমাদের সর্বস্ব উৎসর্গ করিতে পারি, যেন তাঁহার ধর্মের পথে আমাদের জীবন বলিদান করিতে পারি ?” এইরূপে, অন্যান্য ধর্মীয় লোকগণও এই প্রকারের মিথ্যা কুসংস্কারপূর্ণ ধারণার বশবর্তী হইয়া বিধাতার অসংখ্য অনুকম্পার ‘কওসর’-উৎস হইতে দূরে রহিয়াছে এবং নিজেদের অলস কল্পনার ধ্যানে মগ্ন রহিয়াছে।
এই বাক্য ব্যতীত ইঞ্জিলে আরও একটি বাক্য আছে, সেখানে তিনি বলেনঃ “আকাশ ও পৃথিবী ধ্বংস হইয়া যাইবে; কিন্তু আমার বাক্যাবলী কখনও ধ্বংস হইবে না।” (লূক ২১।৩৩)। এই প্রকারে এই বাক্য হইতে যীশুর অনুগামিগণ এই সিদ্ধান্ত করিয়াছিল যে, ইঞ্জিলের বিধান কখনো রহিত হইবে না, এবং যখনই সেই প্রতিশ্রুত সুষমা প্রকাশিত হইবেন এবং সমুদয় লক্ষণও প্রকটিত হইবে, তিনি নিশ্চয়ই ইঞ্জিলে বিঘোষিত বিধানই পুনঃ প্রবর্তিত ও স্থাপিত করিবেন, যেন পৃথিবীতে তাঁহার ধর্ম ব্যতীত আর কোন ধর্ম না থাকে। ইহাই তাহাদের ধর্ম-বিশ্বাসের মূল। তাহাদের বিশ্বাস এই যে, যদি কোন ব্যক্তি সমুদয় প্রতিশ্রুত নিদর্শনসহ আবির্ভূত হন, এবং ইঞ্জিলের সুস্পষ্ট আক্ষরিক বিধানের বিপরীত আদেশ প্রচার করেন, তবে তাহারা নিশ্চয় তাঁহাকে পরিত্যাগ করিবে, তাঁহার বিধান মানিয়া লইতে অস্বীকার করিবে, তাঁহাকে অবিশ্বাসী বলিয়া ঘোষণা করিবে এবং তাঁহাকে অবজ্ঞা-ভরে বিদ্রƒপ করিবে। হজরত মোহাম্মদ (সঃ)-র আবির্ভাব কালে যখন ক্বোরআন-রূপ সূর্য অবতীর্ণ হইয়াছিল, তখন যাহা ঘটিয়াছিল তদ্বারা এই বিষয় প্রমাণিত হইতেছে। যদি তাহারা প্রত্যেক ধর্ম-বিধানের আবির্ভাব কালে আল্লাহর প্রকাশগণের নিকট হইতে পবিত্র গ্রন্থসমূহে অবতীর্ণ এই সকল বাক্যের প্রকৃত মর্মার্থ সম্বন্ধে বিনীতভাবে অনুসন্ধান করিত, যে-সমস্ত বাক্যের শান্তিপূর্ণ অর্থ মানুষকে ‘সিদ্রাতুল-মোন্তাহা’ অর্থাৎ চরম উদ্দেশ্য চিনিয়া লওয়া হইতে বঞ্চিত করিয়াছে, তাহা হইলে তাহারা নিশ্চয়ই সত্য-সূর্যের আলোকের দিকে পথ প্রদর্শিত হইত, এবং ঐশী-জ্ঞানের ও বিজ্ঞানের রহস্যাবলী আবিষ্কার করিতে সমর্থ হইত।
এক্ষণে, এই সেবক, যীশুর এই সকল পবিত্র বাক্যের অতলস্পর্শী মহাসাগর-ভান্ডারে সঞ্চিত সত্যসমূহ হইতে এক শিশিরবিন্দুবৎ সামান্য সত্য আপনাকে অবগত করাইবে, যাহাতে হয়ত তীক্ষèবুদ্ধিসম্পন্ন অন্তরসমূহ পরম পবিত্রতার উচ্চারিত বাক্যাবলীর সঙ্কেত ও তাৎপর্যাদি উপলব্ধি করিতে সক্ষম হইতে পারে, যেন ঐশী বাণীর প্রতাপশালী মহিমা তাহাদিগকে তাঁহার নাম ও গুণাবলীর সমুদ্রের তাৎপর্য হৃদয়ঙ্গম করিবার পথে বাধা প্রদান না করে, এবং তাহাদিগকে আল্লাহর সেই প্রদীপ চিনিয়া লওয়া হইতে বঞ্চিত না করে, যাহা তাঁহার মহিমান্বিত পবিত্র সত্তার অবতরণের আসন।
এক্ষণে, যীশুর এই সমস্ত বাক্য সম্বন্ধে “সেই দিনগুলির অত্যাচারের ও ক্লেশের ঠিক পরবর্তী কালে”- এই বাক্যগুলি সেই সময়ের নির্দেশ দান করিতেছে, যখন জনসাধারণ অত্যাচারিত ও বিপদগ্রস্ত হইবে, যখন সত্য-সূর্যের বহুকালীন চিহ্নগুলি ও জ্ঞান-বিজ্ঞান-বৃক্ষের ফল মানুষের মধ্য হইতে বিলুপ্ত হইয়া যাইবে, যখন মানব জাতির কর্তৃত্বভার মূর্খ ও অজ্ঞ লোকের হস্তে পতিত হইবে, যখন সৃষ্টির মূল ও শ্রেষ্ঠতম উদ্দেশ্য, স্বর্গীয় একত্ব ও জ্ঞান-বুদ্ধির দ্বারসমূহ রুদ্ধ হইয়া যাইবে, যখন নিশ্চিত জ্ঞান আলস্য-জড়িত কল্পনায় পর্যবসিত হইবে, এবং দুর্নীতি ন্যায়পরায়ণতার স্থান অধিকার করিয়া বসিবে। এক্ষণে, যখন প্রত্যেক ধর্ম-সম্প্রদায়ের কর্তৃত্বভার অজ্ঞ নেতাদের হস্তগত হইয়াছে, যাহারা নিজ নিজ কল্পনা ও বাসনানুসারে জনগণকে পরিচালিত করে, এইরূপ অবস্থা বর্তমান সময়েও পরিদৃষ্ট হইতেছে। তাহাদের রসনায় আল্লাহর নাম উচ্চারণ একটি অর্থহীন বাক্যে পর্যবসিত হইয়াছে; তাহাদের মধ্যে আল্লাহর পবিত্র বাক্য একটি মৃত অক্ষরে পরিণত হইয়াছে। তাহাদের উপর তাহাদের বাসনাসমূহের আধিপত্য এইরূপ অধিক হইয়াছে যে, বিবেকের ও বিচার-শক্তির প্রদীপ তাহাদের অন্তরে নির্বাপিত হইয়া গিয়াছে, এবং এই সব ঘটিয়াছে, অথচ স্বর্গীয় শক্তিরূপ অঙ্গুলিসমূহ আল্লাহর জ্ঞানের সিংহদ্বারসমূহ উন্মুক্ত করিয়া দিয়াছে, এবং স্বর্গীয় জ্ঞান ও অপার্থিব অনুকম্পার আলোক প্রত্যেক সৃষ্ট জীবের প্রকৃত সত্তাকে এইরূপভাবে আলোকিত ও অনুপ্রাণিত করিয়াছে যে, প্রত্যেক পদার্থে জ্ঞানের দ্বার খুলিয়া দিয়াছে এবং পরমাণুতে (এটম বিন্দুতে) সূর্যের নিদর্শনসমূহ প্রকাশিত করিয়াছে। এবং তত্রাচ, স্বর্গীয় জ্ঞানের বিবিধ অবতীর্ণ বাণীসমূহ, যাহা পৃথিবী পরিবেষ্টন করিয়াছে, তাহা সত্ত্বেও তাহারা এখনও পর্যন্ত নিরর্থক ইহা ধারণা করে যে, জ্ঞানের দ্বার রুদ্ধ করা হইয়াছে এবং ঐশী অনুকম্পার বর্ষণ নিস্তব্ধ হইয়াছে। তাহারা তাহাদের অলস কল্পনাসক্ত হইয়া স্বর্গীয় জ্ঞানের শক্তিশালী রজ্জু হইতে অনেক দূরে চলিয়া গিয়াছে। তাহাদের জ্ঞান ও উহার দ্বারের দিকে আকৃষ্ট হয় বলিয়া বোধ হয় না, আর তাহারা ইহার প্রকাশের বিষয়ও চিন্তা করে না; কারণ তাহারা তাহাদের অলস কল্পনায় পার্থিব ধন-ঐশ্বর্যের দ্বারই উন্মুক্ত পাইয়াছে; পক্ষান্তরে, স্বর্গীয় জ্ঞান অবতরণকারীর প্রকাশে তাহারা কেবল আত্মোৎসর্গের আহ্বানই প্রাপ্ত হইয়া থাকে। সুতরাং তাহারা প্রথমটিকেই স্বভাবতঃ দৃঢ়ভাবে ধারণ করিয়া থাকে এবং পরবর্তীটি হইতে দূরে পলায়ন করে। যদিও তাহারা তাহাদের অন্তরে আল্লাহর ধর্ম-বিধান একই বলিয়া স্বীকার করে, তথাপি প্রত্যেক দিক হইতে তাহারা এক একটি নূতন আদেশ প্রদান করে, এবং প্রত্যেক সময়ে এক নূতন বিচার-মীমাংসা ঘোষণা করে। কোন দুই ব্যক্তিকে একটি ধর্ম-বিধান সম্বন্ধে একমতালম্বী দেখিতে পাওয়া যায় না; কারণ তাহারা আল্লাহর অনুসন্ধান করে না, কেবল নিজ নিজ বাসনা পূর্ণ করিতে চাহে, এবং ভ্রান্তির পথ ব্যতীত অন্য কোন পথ অনুসরণ করে না। নেতৃত্ব লাভই তাহাদের উদ্যমের একমাত্র লক্ষ্য বলিয়া তাহারা ধরিয়া লইয়াছে, এবং অহঙ্কার ও ঔদ্ধত্যই তাহাদের অন্তরের বাসনার উচ্চতম কাম্য বস্তু বলিয়া মনে করে। তাহারা তাহাদের জঘন্য প্রতারণাসমূহকে স্বর্গীয় আদেশের উর্দ্ধে স্থাপন করিয়াছে, আল্লাহর ইচ্ছার প্রতি সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ পরিত্যাগ করিয়াছে, নিজ নিজ স্বার্থ উদ্ধারের হিসাব-নিকাশ কার্যে লিপ্ত রহিয়াছে এবং কপটতাপূর্ণ ব্যক্তিদের পথে বিচরণ করিতেছে। তাহাদের সব প্রকার শক্তি-সামর্থ্য সত্ত্বেও তাহারা তাহাদের ক্ষুদ্র নেতৃত্বের কার্যে নিজেকে নিরাপদ রাখিতে চেষ্টা করে এই ভয়ে যে,পাছে সামান্য পরিমাণ অবিশ্বাস তাহাদের কর্তৃত্বের মূলোৎপাটন করে, বা ঐশ্বর্যের জাঁকজমক প্রদর্শনে তাহারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যদি আল্লাহর জ্ঞান-রূপ কাজল দ্বারা তাহাদের চক্ষু মদিত, পবিত্র ও উজ্জ্বল করা হইত, তবে নিশ্চয়ই তাহারা ইহা আবিষ্কার করিতে সমর্থ হইত যে, অনেকগুলি ঔদরিক জন্তু একত্রিত হইয়া মানুষের আত্মাসমূহের গলিত পঁচা মাংস ভক্ষণ করিতেছে।
যাহা লিপিবদ্ধ করা হইয়াছে, তদপেক্ষা কোন্ “অত্যাচার” বৃহত্তর ? ইহা অপেক্ষা কোন্ “অত্যাচার” অধিকতর সাংঘাতিক যে, একটি আত্মা সত্য অন্বেষণ করিতে ও আল্লাহর জ্ঞান অর্জন করিতে ইচ্ছুক, অথচ সে জানে না ইহা লাভ করার জন্য তাহাকে কোথায় যাইতে হইবে এবং কাহার নিকট অনুসন্ধান করিতে হইবে ? এইরূপ মতানৈক্য চরমে পৌঁছিয়াছে এবং আল্লাহর উপলব্ধির পন্থাসমূহ বহুগুণে বৃদ্ধি পাইয়াছে। এই “অত্যাচার” প্রত্যেক ঐশী-অবতরণের মৌলিক উপাদানে পরিগণিত হইয়াছে। ইহা “অত্যাচার” সংঘটিত না হইলে, ঐশী-সত্যের সূর্য প্রকট হইবে না। কারণ ভুল-ভ্রান্তি-রূপ রাত্রির অন্ধকারের পরেই স্বগীয় পথ-প্রদর্শনের প্রভাতের প্রকাশ অবশ্যই হইয়া থাকে। এই কারণেই, সকল ইতিবৃত্তে ও শ্রুতি বাক্যসমূহে (হাদীসে) এই সকল বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করা হইয়াছে, অর্থাৎ অবিচার পৃথিবী-পৃষ্ঠ আবৃত করিয়া ফেলিবে এবং অন্ধকার মানব জাতিকে ঢাকিয়া ফেলিবে। পূর্বোক্ত জনশ্রুতিসমূহ সকলের নিকট পরিজ্ঞাত হওয়ায় এবং সংক্ষেপে বর্ণনা এই সেবকের উদ্দেশ্য হওয়ায়, এই সকল জন-শ্রুতির মূল বাক্য উদ্ধৃত করা হইতে তিনি ক্ষান্ত থাকিবেন।
এই “অত্যাচার” কে (যাহার আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে ‘চাপ প্রয়োগ’) যদি এরূপ ব্যাখ্যা করা হয় যে, পৃথিবী সংকীর্ণ হইবে, অথবা মানুষের অলস কল্পনা ইহা মনে করে যে, এই প্রকারের বিপদাবলী মনুষ্য জাতির উপর আপতিত হইবে, তাহা হইলে ইহা অতীব পরিষ্কার ও প্রকট যে, সেইরূপ কোনও প্রকারের ঘটনা কখনও সংঘটিত হইবে না। তাহারা নিশ্চয়তার সহিত প্রতিবাদচ্ছলে একথা বলিবে যে, স্বর্গীয় অবতরণের এই অত্যাবশ্যকীয় পূর্ববর্তী বিষয় প্রকট হয় নাই। ইহাই তাহাদের আপত্তির কারণ হইয়া রহিয়াছে এবং বর্তমান সময়েও। পক্ষান্তরে, “অত্যাচার”—এই শব্দের প্রয়োগে আধ্যাত্মিক জ্ঞানার্জনের শক্তির ও আল্লাহর বাণী উপলব্ধি করিবার সামর্থ্যরে অভাব বুঝানো হইয়াছে। ইহার প্রকৃত অর্থ এই—যখন সত্যের সূর্য অস্তমিত হইয়াছে এবং ঐ সকল দর্পণ যাহারা তাঁহার ঐশী আলোক প্রতিফলিত করে, তাঁহারাও অন্তর্ধান করিয়াছেন, মানব জাতি তখন অত্যাচার ও উৎপীড়নে জর্জরিত হইবে, এবং পথ-প্রাপ্তির জন্য কাহার দিকে ফিরিবে, তাহা তাহারা জানিতে পারিবে না। এই প্রকারে আমরা আপনাকে হাদীসসমূহের ব্যাখ্যা শিক্ষা দিতেছি। এবং আপনার নিকট স্বর্গীয় জ্ঞানের রহস্যাবলী প্রকাশ করিতেছি, যাহাতে আপনি হয়ত ইহার তাৎপর্য অনুধাবন করিতে পারিবেন, এবং তাহাদের মধ্যে এমন এক ব্যক্তিরূপে পরিগণিত হইতে পারিবেন, যাঁহারা ঐশী-জ্ঞান ও বোধশক্তির পানপাত্র হইতে প্রচুর পরিমাণে স্বর্গীয় সুধা পান করিয়াছে।
এবং এক্ষণে যীশুর এই বাক্যাবলী সম্বন্ধে—“সূর্য অন্ধকার হইবে এবং চন্দ্র কিরণ দান করিবে না এবং তারকারাজি আকাশ হইতে ভূতলে খসিয়া পড়িবে।” “সূর্য ও “চন্দ্র” শব্দদ্বয় যাহা আল্লাহর পয়গম্বরগণের লেখনীসমূহে উল্লেখ করা হইয়াছে, তদ্বারা এই দৃশ্যমান কেবল প্রকৃতিক সূর্য ও চন্দ্রকে বুঝায় না। বরং তাঁহারা এই শব্দদ্বয়ের বিবিধ অর্থ পোষণ করিয়াছেন। প্রকৃত দৃষ্টান্তে তাঁহারা ইহাদের জন্য একটি বিশেষ অর্থ সংযোগ করিয়া দিয়াছেন। এইরূপে এক অর্থে “সূর্য” শব্দ দ্বারা ঐশী সত্যের সকল সূর্যকে বুঝাইয়াছেন, যাঁহারা সেই আদিম প্রভার প্রভাত হইতে উদিত হন, এবং উচ্চতম স্বর্গ হইতে ঐশী অনুকম্পার বদান্যতার কিরণ বিস্তার করিয়া পৃথিবী পরিপূর্ণ করেন। এই সকল সত্যের সূর্য, আল্লাহর গুণাবলী ও নামাবলীর জগৎসমূহে, আল্লাহরই সার্বজনীন প্রকাশসমূহ, ঠিক এইরূপভাবে যেরূপে দৃশ্যমান প্রকৃতিক সূর্য, সেই একক, সুপ্রশংসিত আল্লাহর আদেশক্রমে পৃথিবীর সকল দ্রব্যাদির বিকাশ সাধনে সহায়তা করে- যথ বৃক্ষ, ফল ও তার বর্ণ, মৃত্তিকাগর্ভস্থ খনিজাদি এবং সৃষ্ট জগতে দৃষ্ট অন্যান্য দ্রব্যাদি। এ্ই একই প্রকারে স্বর্গীয় আলোকদানকারী শিক্ষাদাতাগণ, তাঁহাদের ভালবাসা-রূপ যত্ন এবং শিক্ষাদানকারী প্রভাব দ্বারা স্বর্গীয় একতা-রূপ বৃক্ষাদির জন্মদান করেন, তাঁহারই একতার ফল, পৃথককারী পত্রনিচয়, জ্ঞানের ও নিশ্চয়তার মুকুল, বিজ্ঞতা ও উচ্চারণের ‘মেদি’ বৃক্ষাদি উৎপাদন ও প্রকাশিত করেন। এই প্রকারে আল্লাহর এই সকল উজ্জ্বলতা প্রদানকারী শিক্ষকদের অভ্যুত্থানে পৃথিবী নতুন পরিবেশ ধারণ করে, চিরস্থায়ী জীবন-সলিলের স্রোত প্রবাহিত হয়, প্রেম ও দয়াশীলতার তরঙ্গ উদ্বেলিত হয়, অনুকম্পার মেঘরাশি পুঞ্জীভূত হয় এবং সকল সৃষ্ট জীবের উপর বদান্যতার সুশীতল সমীরণ প্রবাহিত হয়। এই সকল ঐশী উজ্জ্বলতা দানকারী শিক্ষাদাতা যে অনুরাগ উৎপাদন করেন এবং তাঁহারা যে অবিনশ্বর অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করেন, তাহার প্রভাবে মনুষ্য জাতির অন্তরে আল্লাহর প্রেমের আলোক প্রকটভাবে জ্বলিতে থাকে। এই সকল বস্তু-প্রীতিহীন ঐশী-নিদর্শনের অনুকম্পার প্রাচুর্যের মধ্য দিয়াই মৃত ব্যক্তিদের দেহে অনন্ত জীবনের আত্মা প্রবেশ লাভ করে। নিশ্চয়ই এই দৃশ্যমান সূর্য সেই সত্য-সূর্যের উজ্জ্বলতার একটি নিদর্শন মাত্র। সেই সত্য-সূর্যের সমকক্ষ, অনুরূপ বা প্রতিদ্বন্দ্বী থাকিতে পারে না। তাঁহারই মাধ্যমে সকল কিছুই জীবন ধারণ করিয়া আছে, চলাচল করে, এবং তাহাদের অস্তিত্ব রক্ষা করে। তাঁহারই অনুকম্পায় ইহাদের বিকাশ হয় এবং ইহারা সকলে তাঁহারই দিকে প্রত্যাবর্তন করে। তাঁহার সকাশ হইতেই সকল কিছু উৎপন্ন হইয়াছে এবং তাঁহারই অবতরণের সঞ্চয়াগারের দিকে তাহারা সকলে প্রত্যাগমন করিয়াছে। তাঁহারই নিকট হইতে সমুদয় সৃষ্ট পদার্থ নির্গত হইয়াছে এবং তাঁহারই বিধানের সঞ্চয়াগারের দিকে তাহারা পুনঃ প্রত্যাবর্তন করিয়াছে।
এইসব স্বর্গীয় জ্যোতিষ্ক (শিক্ষাদাতাগণ) সময় সময় কোনও কোনও বিশেষ নাম, পদবী ও গুণসমূহে সীমাবদ্ধ বলিয়া অনুভূত হয়, যেমন আপনি দেখিয়াছেন এবং এখনও দেখিতেছেন; ইহা কেবল কোনও কোনও লোকের মনের অসম্পূর্ণ ও সীমাবদ্ধ অবস্থার জন্যই হইয়াছে। পক্ষান্তরে, তাঁহারা সকল সময়েই প্রত্যেক প্রশংসাকারী নামের উর্দ্ধে উন্নত ও প্রত্যেক বর্ণিত গুণ হইতে পবিত্র ছিলেন এবং অনন্তকাল পর্যন্ত এইরূপ থাকিবেন। প্রত্যেক নামের সারাংশ তাঁহাদের পবিত্রতার দরবারে প্রবেশাধিকার লাভ করার কোন আশা পোষণ করিতে পারে না, এবং উচ্চতম ও পবিত্রতম গুণাবলী কখনও তাঁহাদের আবহা রাজ্যের নিকটবর্তী হইতে পারে না। আল্লাহর পয়গম্বরগণ মানুষের ধারণার অপরিমিত উর্দ্ধে উন্নীত, এবং তাহারা তাঁহাদের অভিব্যক্তি ব্যতীত তাঁহাদিগকে কখনও জানিতে পারে না। তাঁহার (আল্লাহর) আভা হইতে ইহা এতখানি দূরে যে, তাঁহার মনোনীত (মহাপুরুষগণ) তাঁহাদের নিজেদের ব্যক্তিত্বের সাহায্য ব্যতীত অন্য কাহারও দ্বারা উচ্চ প্রশংসিত হইবেন। তাঁহারা মানুষের প্রশংসার অনেক উর্দ্ধে অবস্থিত, মানুষের বোধগম্যতার অনেক উচ্চে তাহাদের আসন।
“সূর্যসমূহ” শব্দটি “নির্দোষ পবিত্রাত্মাগণের” লিখিত বাক্যসমূহে অনেকবার পয়গম্বরগণের ঐ সকল উজ্জ্বল বস্তুপ্রীতিহীন মৌলিক আদর্শ সমূহের প্রতি প্রয়োগ করা হইয়াছে। ঐ সকল লিখিত বাক্যের মধ্যে “নোদবার প্রার্থনা” (হজরত আলী (রাঃ)-র “বিলাপ প্রার্থনা”) নামক লিপিতে নিম্নলিখিত বাক্যগুলি লিপিবদ্ধ করা হইয়াছেঃ “সেই উজ্জ্বল সূর্যসমূহ কোথায়? ঐ দীপ্তিমান চন্দ্রগুলি ও দীপ্তিশালী নক্ষত্ররাজি কোথায় অন্তর্হিত হইয়াছে? এইরূপে ইহা সুস্পষ্ট হইল যে, “সূর্যসমূহ”, “চন্দ্রগুলি” ও “নক্ষত্ররাজি” শব্দগুলি দ্বারা মূলতঃ আল্লাহর প্রকাশ পয়গম্বরগণ, সিদ্ধ পুরুষগণ এবং তাঁহাদের অনুগামিগণ অর্থাৎ ঐ সকল জ্যোতিষ্মান পুরুষগণকেই লক্ষ্য করা হ্ইয়াছে, যাঁহাদের জ্ঞানের আলোক দৃশ্য ও অদৃশ্য জগতগুলির উপর আলোক সম্পাত করিয়াছে।
আর এক অর্থে, এই সকল শব্দ দ্বারা পূর্ববর্তী ধর্ম-বিধানের ধর্মাচার্যদের লক্ষ্য করা হইয়াছে, যাহারা পরবর্তী ঐশী-বিধান অবতরণের সময় জীবিত থাকে এবং যাহারা তাহাদের হস্তে ধর্মের কর্তৃত্বভার ধারণ করে। যদি এই সকল ধর্ম-নেতা পরবর্তী অবতীর্ণ বাণীর আলোক দ্বারা আলোকিত হয়, তবে তাহারা আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য হইবে এবং তাহারা চিরস্থায়ী আলোকে উজ্জ্বল হইবে। অন্যপক্ষে, তাহাদিগকে অন্ধকারে নিমগ্ন বলিয়া ঘোষণা করা হইবে, যদিও বাহ্য দৃষ্টিতে তাহারা মানুষের নেতা থাকিবে, কারণ বিশ্বাস ও অবিশ্বাস, সুপথ ও ভ্রান্ত-পথ, সুখ ও দুঃখ, আলোক ও অন্ধকার, এইগুলি যিনি সত্যের সূর্য, তাঁহারই অনুমোদনের উপর নির্ভর করে। প্রত্যেক যুগের ধর্ম-নেতাদের মধ্যে যাহারা সেই বিচার-মীমাংসার দিনে সত্য-জ্ঞানের উৎসের অধিকারীর নিকট হইতে সত্য-বিশ্বাসের সাক্ষ্য-প্রমাণ গ্রহণ করিবে, তাহারাই সত্য-জ্ঞানের, স্বর্গীয় অনুকম্পার ও সত্য-উপলব্ধির আলোক গ্রহণকারী হইবে। পক্ষান্তরে, তাহাদিগকে মূর্খতা, অস্বীকারকারী, ধর্ম-অবজ্ঞাকারী, এবং অত্যাচারী-এই সমস্ত দোষে দোষী হইয়া কলঙ্কিত হইতে থাকিবে।
প্রত্যেক তীক্ষ্ণ বিচার-বুদ্ধিসম্পন্ন দ্রষ্টার পক্ষে ইহা সুস্পষ্ট ও প্রকটমান যে, ঠিক যেরূপ সূর্যের দীপ্তিমান আভার সম্মুখে তারকার আলো নিষ্প্রভ হয়, সেইরূপ পার্থিব জ্ঞান, বিজ্ঞতা ও বুদ্ধির অধিকারী বাহ্যিক উজ্জ্বলতাসম্পন্ন ব্যক্তিও যখন সে সত্যের সূর্যের, স্বর্গীয় জ্ঞানালোকোজ্জ্বল দিবাকরের অত্যুজ্জ্বল প্রভাসমূহের সম্মুখীন হয়, তখন সে শূন্যতায় পরিণত হয়।
“সূর্য” শব্দটি যে ধর্ম-নেতাদের প্রতি প্রয়োগ করা হইয়াছে, তাহার কারণ এই যে, তাহাদের উচ্চ পদবী, খ্যাতি ও যশ আছে। প্রত্যেক যুগের সার্বজনীনভাবে স্বীকৃত ধর্ম-নেতাগণ, যাহারা কর্তৃত্বের সহিত কথা বলে এবং যাহাদের খ্যাতি সুনিশ্চিতভাবে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে, তাহারা ঐরূপ সূর্য। যদি তাহারা সত্যের সূর্যের অনুরূপ হয়, তবে তাহাদিগকে সকল জ্যোতিষ্কের মধ্যে অতীব উন্নত বলিয়া নিশ্চয়ই গণ্য করা হইবে; পক্ষান্তরে, তাহাদিগকে নরকাগ্নির অক্ষ-কেন্দ্ররূপে গণ্য করা হইবে। যেমন তিনি বলিয়াছেনঃ “নিশ্চয়ই সূর্য ও চন্দ্র, উভয়কেই নরকাগ্নির অসহ্য যন্ত্রণার দন্ডে দন্ডিত করা হইয়াছে।” (ক্বোরআন ৫৫।৫)। এই আয়াতে উল্লিখিত “সূর্য” ও “চন্দ্র” শব্দের তাৎপর্য আপনি নিঃসন্দেহে অবগত আছেন। সুতরাং ইহা এখানে উল্লেখ করার প্রয়োজন নাই। এবং যে-কেহ এই “সূর্য” ও “চন্দ্রের” উপাদান বিশিষ্ট অর্থাৎ যে-কেহ এই সকল নেতার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করিয়া মিথ্যার দিকে তাহার মুখ ফিরায় এবং সত্য হইতে অন্যত্র মুখ ফিরাইয়া লয়, সে নিঃসন্দেহে নারকীয় অন্ধকার হইতে বহির্গত হইয়া পুনরায় তাহাতেই প্রত্যাবর্তন করে।
এবং এক্ষণে, হে সত্য অনুসন্ধানকারী! সেই সুদৃঢ় রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করিয়া থাকা আমাদের কর্তব্য, যেন আমরা ভ্রান্তির অন্ধকারময় রাত্রিকে পশ্চাতে ফেলিয়া রাখিয়া স্বর্গীয় সুপথের প্রাভাতিক আলোক আলিঙ্গন করিতে পারি। আমরা কি প্রত্যাখ্যানের সম্মুখ হইতে পলায়ন করিয়া নিশ্চয়তার আশ্রয়-দানকারী ছায়া অনুসন্ধান করিব না ? আমরা কি শয়তানীর ভয়াবহ অন্ধকার হইতে আপনাদিগকে মুক্ত করিয়া স্বর্গীয় সুষমার ঊর্দ্ধগামী আলোকের দিকে ত্বরান্বিত হইব না ? সেই অবস্থায় আমরা আপনার উপর দিব্যজ্ঞানের ঐশী-বৃক্ষের ফল প্রদান করি, যেন আপনি স্বর্গীয় জ্ঞানের রেজওয়ান উদ্যানে সানন্দে, প্রফুল্ল চিত্তে স্থায়ীভাবে বাস করিতে পারেন।
অন্য এক অর্থে, “সূর্য”, “চন্দ্র” ও “তারকারাজি”র অর্থ ঐ সকল বিধান ও শিক্ষা, যাহা প্রত্যেক ধর্ম-বিধানে স্থাপিত ও ঘোষিত হইয়াছে; যেমন, নামাজ ও রোজার বিধানসমূহ। ক্বোরআন মজিদের শিক্ষানুসারে এই সকল বিধানকে ভবিষ্যদ্বাদী হজরত মোহাম্মদ (সঃ)-র সুষমার পরলোকে অন্তরালবর্তী হওয়ার সময় তাঁহার ধর্ম-বিধানের অত্যন্ত মৌলিক ও বাধ্যতামূলক বিধান বলিয়া মানিয়া লওয়া হইয়াছে। হাদীস ও ইতিবৃত্তাদির মূল বাক্যাবলী ইহার সত্যতার সাক্ষ্য প্রদান করে। এই সমুদয় সর্বত্র সকলের নিকট বিদিত থাকায় এখানে উল্লেখ করার প্রয়োজন নাই। না, বরং প্রত্যেক ধর্ম-বিধানে উপাসনা সম্বন্ধীয় আদেশের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হইয়াছে এবং ইহা সার্বজনীনভাবে বাধ্যতামূলক করা হইয়াছে। ঐশী-সত্যের সূর্য মোহাম্মদ (সঃ)-র শিক্ষার সারস্বরূপ যে সকল আলোক তাঁহার নিকট হইতে বিকীর্ণ হইয়াছিল, সেই সকলের প্রতি যে সকল লিপিবদ্ধ হাদীস আরোপ করা হয়, সেইগুলি এই বিষয়ে সাক্ষ্য প্রদান করিতেছে।
হাদীসসমূহ ইহা প্রমাণ করিতেছে যে, সকল ধর্ম-বিধানে উপাসনা সম্বন্ধীয় আল্লাহর সকল ভবিষ্যদ্বক্তার নিকট অবতীর্ণ ধর্ম-বিধানের একটি মৌলিক উপাদান ও আদেশ। ইহা এইরূপ একটি বিধান যাহার আকৃতি-প্রকৃতি প্রত্যেক যুগের পরিবর্তনশীল প্রয়োজনীয়তার উপযুক্ত করা হইয়াছে। যেহেতু পূর্ববর্তী যুগে যে সকল আচরণ, অভ্যাস ও শিক্ষা পরিষ্কাররূপে বিশেষভাবে ও দৃঢ়তার সহিত সংস্থাপিত করা হইয়াছিল, তাহা প্রত্যেক পরবর্তী যুগে অবতীর্ণ বাণী দ্বারা রহিত করা হইয়াছে, এই সমুদয়ই “সূর্য” এবং “চন্দ্র” প্রভৃতি অনুরূপ ভাবপ্রকাশক চিহ্ন দ্বারা ব্যক্ত করা হইয়াছে। “ যেন তিনি (আল্লাহ) ইহা প্রমাণ করিতে পারেন তোমাদের মধ্যে কে এই সকল কর্মে উৎকর্ষতা দেখাইতে পার।” (ক্বোরআন ৬৭।২)।
অধিকন্তু, হাদীসসমূহে “সূর্য” ও “চন্দ্র” শব্দদ্বয় ‘উপাসনা’ ও ‘উপবাসে’র (নামাজ ও রোজার) প্রতি প্রয়োগ করা হইয়াছে, যেমন বলা হইয়াছেঃ “উপবাস—সূর্য, উপাসনা—চন্দ্র।” একদিন একজন খ্যাতনামা ধর্ম- নেতা আমাদের সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিলেন। আমরা যখন তাঁহার সহিত কথা-বার্তা বলিতেছিলাম, তখন তিনি পূর্বোক্ত শ্রুতিবাণীর কথা উল্লেখ করিলেন। তিনি বলিলেনঃ “যেহেতু উপবাস শরীরের উষ্ণতা বৃদ্ধি করে; সুতরাং ইহা সূর্যালোকের সহিত তুলনা করা হইয়াছে, এবং যেহেতু রাত্রিকালীন প্রার্থনা মানুষের মন সতেজ করে; এইজন্য ইহাকে চন্দ্রের দীপ্তির সহিত তুলনা করা হইয়াছে। ইহাতে আমরা উপলব্ধি করিলাম যে, সত্য জ্ঞানের সমুদ্রের একটি মাত্র বিন্দুও বেচারার ভাগ্যে পড়ে নাই, এবং তিনি স্বর্গীয় জ্ঞানের জলন্ত ঝোপ হইতে অনেক দূরে চলিয়া গিয়াছেন। তখন আমরা শিষ্টতা সহকারে তাহাকে বলিলাম ঃ আপনি এই হাদীসের যে ব্যাখ্যা প্রদান করিলেন, তাহা লোকের মধ্যে প্রচলিত আছে। ইহা কি ভিন্ন প্রকারে ব্যাখ্যা করা যাইত না ?” তিনি তখন আমাদিগকে বলিলেন ঃ “ইহার কি ব্যাখ্যা হইতে পারে ? আমরা উত্তর করিলামঃ হজরত মোহাম্মদ (সঃ) যিনি ঐশী খাতেমান্নবীঈন এবং আল্লাহর মনোনীত মহাপুরুষদের মধ্যে অত্যন্ত খ্যাতনামা, তিনি ক্বোরআন মজিদের ধর্ম-বিধানকে আকাশের সহিত তুলনা করিয়াছেন, এই কারণে যে, ইহা অতীব উচ্চ, ইহার প্রভাব শ্রেষ্ঠ, ইহার মহিমা সুমহান, এবং এই বাস্তবতার জন্য যে, ইহা সকল পূর্ববর্তী ধর্মকে ইহার মধ্যে ধারণ করে। এবং আকাশমন্ডলে সূর্য ও চন্দ্র যেরূপ উজ্জ্বলতম ও শ্রেষ্ঠতম জ্যোতিষ্ক, ঠিক সেইরূপ আল্লাহর ধর্মরূপ আকাশেও দুইটি উজ্জ্বলতম গ্রহ-উপগ্রহের ব্যবস্থা করা হইয়াছে—তাহা উপবাস ও উপাসনা। ইসলাম ধর্ম আকাশ; উপবাস ইহার সূর্য, উপাসনা ইহার চন্দ্র।
আল্লাহর প্রকাশগণের নিদর্শনসূচক বাক্যাবলীর ইহাই অন্তর্নিহিত মর্ম। সুতরাং পূর্বোল্লিখিত বিষয়-বস্তুর সহিত “সূর্য” ও “চন্দ্র” শব্দদ্বয়ের প্রয়োগ পবিত্র আয়াতাদির মূল বাক্য এবং লিপিবদ্ধ হাদীস দ্বারা প্রদর্শিত ও প্রমাণিত হইয়াছে। অতএব, ইহা পরিষ্কার ও সুস্পষ্ট যে, “সূর্য অন্ধকারে আচ্ছন্ন হইবে, এবং চন্দ্র আলোক দিবে না এবং তারকারাজি আকাশ হইতে ভূতলে খসিয়া পড়িবে”, এই বাক্যগুলির দ্বারা ধর্ম-নেতাদের একগুঁয়েমি এবং স্বর্গীয় প্রত্যাদেশ দ্বারা সুদৃঢ়ভাবে স্থাপিত ধর্ম-বিধিগুলির রহিত করাই উদ্দেশ করা হইয়াছে, এবং এই সমুদয় ব্যাপার আল্লাহর প্রকাশের রূপক ভাষার মধ্যস্থতায় পূর্ব হইতেই ভবিষ্যদ্বাণীরূপে উল্লিখিত হইয়াছে। ধর্মপরায়ণ ব্যক্তি ব্যতীত অপর কেহই এই পানপাত্র হইতে পান করিতে পারে না, পূণ্যশীল ব্যক্তি ব্যতীত আর কেহই ইহাতে অংশগ্রহণ করিতে পারে না। “ধর্মপরায়ণ ব্যক্তিরাই কর্পূর মিশ্রিত পানপাত্র হইতে পান করিবে।” (ক্বোরআন ৭৬।৫)।
ইহাতে কোন সন্দেহ নাই যে, প্রত্যেক পূর্ববর্তী ধর্ম-বিধানে “সূর্য” ও “চন্দ্র” সদৃশ যে সকল শিক্ষা, বিধি-ব্যবস্থা, আদেশ ও নিষেধ প্রতিষ্ঠিত করা হইয়াছে, এবং যাহা সেই যুগের জনগণকে আবৃত করিয়া ফেলিয়াছে, এই সকলই, প্রত্যেক অনুগামী পরবর্তী যুগে স্বর্গীয় বাণী অবতীর্ণ হওয়ার সময় অন্ধকারময় হয় অর্থাৎ ইহারা নিঃশেষিত হয় এবং ইহারা তাহাদের প্রভাব অক্ষুন্ন রাখিতে পারে না। এখন বিবেচনা করিয়া দেখুন, যদি ইঞ্জিল গ্রন্থের অনুসরণকারীগণ “সূর্য” ও “চন্দ্র” প্রভৃতি রূপক শব্দাদির অর্থ উপলব্ধি করিত এবং তাহারা যদি একগুঁয়ে ও বিপথগামী লোকদের ন্যায় না হইয়া স্বর্গীয় জ্ঞান অবতরণকারীর নিকট হইতে আলোক অনুসন্ধান করিত, তাহা হইলে তাহারা নিশ্চয়ই এই সকল বাক্যের তাৎপর্য উপলব্ধি করিতে পারিত, এবং তাহাদের স্বার্থপর বাসনাসমূহের অন্ধকার দ্বারা দুর্দশাগ্রস্ত ও উৎপীড়িত হইত না। সত্য বটে, যেহেতু তাহারা ইহার মূল উৎস হইতে সত্যজ্ঞান অর্জন করিতে অসমর্থ হইয়াছে, তাহারা অবাধ্যতা ও অবিশ্বাসের বিপদসঙ্কুল উপত্যকায় ধ্বংসপ্রাপ্ত হইয়াছে। এখনও পর্যন্ত তাহাদের এই বোধশক্তি জাগ্রত হয় নাই যে, যে সকল লক্ষণ সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী করা হইয়াছিল, তাহার সমস্তই প্রকট হইয়াছে, এবং প্রতিশ্রুত সূর্য স্বর্গীয় অবতরণের চক্রবালের উপর আবির্ভূত হইয়াছে, এবং পূর্ববর্তী ধর্ম-বিধানের “সূর্য” ও “চন্দ্র”-স্বরূপ শিক্ষা, বিধান ও জ্ঞান অন্ধকারময় হইয়াছে এবং অস্তগমন করিয়াছে।
এবং এক্ষণে, নিশ্চিত দৃষ্টি ও স্থির পক্ষসমূহের সহায়তায় নিশ্চয়তা ও সত্যের পথে প্রবেশ করুন। “বল, তিনি আল্লাহ্, তৎপর তাহাদিগকে তাহাদের মিথ্যা বাদানুবাদের সহিত আমোদে মত্ত হইতে দাও।” (ক্বোরআন ৬।৯১)। এইরূপে আপনি ঐ সকল সঙ্গীর মধ্যে গণ্য হইবেন, যাহাদের সম্বন্ধে তিনি (আল্লাহ্) বলিয়াছেন ঃ “ তাহারা বলেঃ ‘আমাদের প্রভূ আল্লাহ’ এবং তাঁহার প্রথে অটল থাকে; নিশ্চয়ই তাহাদের প্রতি ফেরেশতাগণ অবতীর্ণ হইবে।” (ক্বোরআন ৪১।৩০)। তৎপর আপনি স্বচক্ষে এই সকল নিগূঢ় তত্ত্ব অবলোকন করিবেন।
হে ভ্রাতঃ! আপনি আধ্যাত্মিক পন্থা অবলম্বন করুন, যেন চক্ষুর পলকের ন্যায় দ্রুতগতিতে, দূরত্বের ও হৃতসর্বস্বতার মরু-জঙ্গলের মধ্য দিয়া বিদ্যুতের ন্যায় চম্কাইতে পারেন, এবং চিরস্থায়ী পুনর্মিলনের স্বর্গীয় ‘রেজওয়ান’ উদ্যানে প্রবেশলাভ করিতে পারেন, এবং এক নিঃশ্বাসে স্বর্গীয় আত্মাগণের সহিত আলাপ-আলাপন করিতে পারেন। কারণ, মানবীয় পদযোগে আপনি কখনও এই সকল অপরিমিত দূরত্ব অতিক্রম করিয়া গন্তব্যস্থানে পৌঁছিতে পারিবেন বলিয়া আশা করিতে পারেন না। যাহাকে সত্যের আলোকমালা সত্যের দিকে পরিচালিত করে, এবং যে আল্লাহর নামে, তাঁহার ধর্মের পথে, সত্য-উপলব্ধির সমুদ্রকূলে দন্ডায়মান হয়, তাহার উপর শান্তি বর্ষিত হউক।
এই পবিত্র আয়াতের অর্থ ইহাইঃ “কিন্তু না, আমি পূর্বসমূহ ও পশ্চিমসমূহের প্রভূর শপথ করিতেছি।” ক্বোরআন ৭০।৪০)। যেহেতু “সূর্যসমূহ”, যাহাদের বিষয় পূর্বে উল্লেখ করা হইয়াছে, তাহাদের প্রত্যেকের উদয়স্থল ও অস্তগমনস্থল আছে। এবং যেহেতু পবিত্র ক্বোরআনের ব্যাখ্যাদাতাগণ, এই “সূর্যসমূহের” রূপক অর্থ হৃদয়ঙ্গম করিতে অপারগ হইয়াছে; সুতরাং তাহার পূর্বোক্ত আয়াতের কষ্টকল্পিত ব্যাখ্যা দিতে বাধ্য হইয়াছে। তাহাদের কেহ কেহ বলিয়াছে যে, যেহেতু সূর্য প্রত্যহ চক্রবালের বিভিন্ন বিন্দু হইতে উদিত হয় (ও অস্তগমন করে), এইজন্য “পূর্বসমূহ” ও “পশ্চিমসমূহ” বহুবচনে উল্লিখিত হইয়াছে। অন্য লোকেরা লিখিয়াছে যে এই শ্লোক দ্বারা বৎসরের চারি ঋতুই অভিপ্রেত; কারণ সূর্যের উদয় ও অস্তগমন-বিন্দু ঋতুর পরিবর্তন অনুসারে পরিবর্তিত হয়। তাহাদের জ্ঞানের পরিধি ইহাই। তথাপি তাহারা জ্ঞানের ঐ সকল রত্নাবলী ও বিজ্ঞতার ঐ সকল অনিন্দনীয় ও পবিত্র নিদর্শনাবলীর প্রতি ভ্রান্তি ও অজ্ঞতাদোষ আরোপ করিতে থাকে।
সেই একই প্রকারে, এই সকল বিশদ, শক্তিশালী, সিদ্ধান্তমূলক ও নিঃসন্দেহে বর্ণনা হইতে “আকাশ বিদীর্ণ হওয়ার” অর্থ বুঝিতে চেষ্টা করুন, —ইহা শেষ সময়ের, উত্থান দিবসের আগমন সুনিশ্চিতভাবে ঘোষণাকারী লক্ষণসমূহের একটি লক্ষণ। যেমন তিনি বলিয়াছেনঃ “যখন আকাশ বিদীর্ণ হইবে।” ( ক্বোরআন ৮২।১) “আকাশ” শব্দ দ্বারা স্বর্গীয় প্রত্যাদেশ-রূপ আকাশকে বুঝান হয়, যাহা পরবর্তী ঐশী-প্রকাশের সময় উন্নীত হয় এবং প্রত্যেক পরবর্র্তী ঐশী-প্রকাশের সময় বিদীর্ণ হইয়া যায়। “বিদীর্ণ হওয়া” শব্দাদি দ্বারা পূর্ববর্তী ধর্ম-বিধান রহিত হওয়া এবং অন্য একটি পরবর্তী ধর্ম দ্বারা পরিবর্তিত হওয়া বুঝাইয়া থাকে। আল্লাহর শপথ করিয়া বলিতেছি যে, ‘এই আকাশ বিদীর্ণ হওয়া’ তীক্ষè বুদ্ধিসম্পন্ন লোকের নিকট ‘আকাশসমূহ বিদীর্ণ হওয়া’ অপেক্ষা অধিকতর পরাক্রমশীল কার্য। ক্ষণমাত্র চিন্তা করুন, একটি স্বর্গীয় প্রত্যাদেশ ধর্ম অনেক বৎসর যাবৎ নির্বিঘেœ সংস্থাপিত হইয়াছে; ইহার ছায়ার আশ্রয়ে, যাহারা উহা গ্রহণ করিয়াছে, লালিত-পালিত হইয়াছে; ইহার বিধানের আলোকে জনগণ বংশানুক্রমে শিক্ষিত ও শাসিত হইয়াছে; ইহার বাণীর শ্রেষ্ঠত্ব সম্বন্ধে তাহাদের পিতৃপুরুষগণ কর্তৃক বিশেষভাবে উল্লেখ করা হইয়াছে, ইহা তাহারা শুনিয়াছে; এবং এইরূপ ভাবে তাহারা তাহা করিয়াছে যে, মানব-চক্ষু ইহার সৌন্দর্য ও মহতী প্রভাব ব্যতীত আর কিছুই দেখে নাই, এবং নশ্বর মানব-কর্ণ ইহার আদেশ ও বিধানের মহিমার প্রতিধ্বনি ব্যতীত আর কিছুই শুনে নাই—ইহা অপেক্ষা কোন্ কার্য অধিকতর শক্তিশালী যে, এইরূপ একটি প্রত্যাদেশ (ধর্ম-বিধান) আল্লাহর শক্তি দ্বারা “বিদীর্ণ হইবে”, এবং একটিমাত্র আত্মার (পুরুষের) আবির্ভাবে তাহা রহিত হইয়া যাইবে ? চিন্তা করিয়া দেখুন, এই সকল হেয় ও মূর্খ লোক “আকাশ বিদীর্ণ হওয়ার” যে অর্থ কল্পনা করিয়া রাখিয়াছে, তদপেক্ষা ইহা কি শক্তিশালী কার্য নহে?
অধিকন্তু, ঐ সকল স্বর্গীয় সুষমার অবতরণকারীদের জীবনের অত্যাচার ও তিক্ততাসমূহ বিবেচনা করুন। ইহাও ভাবিয়া দেখুন, তাঁহারা কিরূপ নিঃসহায় ও একাকী সমস্ত পৃথিবী ও ইহার সকল জাতির লোকের সম্মুখীন হইয়াছিলেন, এবং আল্লাহর ধর্ম-বিধান ঘোষণা করিয়াছিলেন। ঐ সকল পবিত্র, মহা মূল্যবান, দয়াশীল আত্মাসমূহের উপর যতই উৎপীড়ন বর্ষণ করা হউক না কেন, তাঁহারা তাঁহাদের শক্তির পূর্ণতা সত্ত্বেও সহিষ্ণু ছিলেন, এবং তাঁহাদের প্রাধান্য সত্ত্বেও তাঁহারা অতীব সহিষ্ণুতা প্রদর্শন করিয়াছিলেন।
সেই একই প্রকারে, “পৃথিবী পরিবর্তিত হওয়ার” অর্থ বুঝিতে চেষ্টা করুন। ইহা জানিয়া রাখুন যে, স্বর্গীয় প্রত্যাদেশের “আকাশ” হইতে যে সকল অন্তঃকরণের উপর কৃপার বদান্যতাপূর্ণ বৃষ্টি-ধারা বর্ষিত হইয়াছে, ঐ সকল অন্তঃকরণের মৃত্তিকা, সত্য সত্যই স্বর্গীয় জ্ঞান ও বিজ্ঞতার মৃত্তিকায় পরিবর্তিত হইয়াছে। তাঁহাদের অন্তরের মৃত্তিকা কতই-না একতার ‘মেদি’ বৃক্ষ উৎপন্ন করিয়াছে। তাঁহাদের আলোকিত অন্তরসমূহ কতই-না সত্যজ্ঞান ও বিজ্ঞতার মুকুলসমূহ প্রস্ফুটিত করিয়াছে! যদি তাঁহাদের অন্তরের মৃত্তিকা অপরিবর্তিত থাকিত, তাহা হইলে সেই আত্মাসমূহ, যাঁহাদিগকে একটি মাত্র অক্ষরও শিক্ষা দেওয়া হয় নাই, যাঁহাদিগকে কোন শিক্ষক দেখে নাই, এবং যাঁহারা কোন স্কুলে প্রবেশ করেন নাই, তাঁহারা কি সেইরূপ বাক্য উচ্চারণ করিতে পারিতেন, যাহা কেহ বুঝিতে সমর্থ নহে। আমার মনে হয়, অসীম জ্ঞানের কর্দম হইতে তাঁহাদিগকে গড়িয়া তোলা হইয়াছে, এবং স্বর্গীয় জ্ঞানের সলিল দ্বারা সিক্ত করা হইয়াছে। সুতরাং ইহা বলা হইয়াছেঃ “জ্ঞান একটি আলোক, যাহা আল্লাহ্ যাঁহাকে ইচ্ছা তাঁহার অন্তরে নিক্ষেপ করেন।” এই প্রকার জ্ঞানই প্রশংসার্হ এবং সর্বদা প্রশংসিত হইয়া আসিয়াছে, এবং ইহা সেই সীমাবদ্ধ জ্ঞান নহে, যাহা পর্দার অন্তরাল দ্বারা আবৃত এবং অন্ধকারাচ্ছন্ন মন হইতে উৎপন্ন হইয়াছে। এই সীমাবদ্ধ জ্ঞানই একে অন্যের নিকট হইতে অপহরণ করে, এবং তজ্জন্য নিরর্থক অহঙ্কার করিয়া থাকে।
কত-ই না ভাল হইত, যদি মানুষের অন্তরকে এই সকল মানব-সৃষ্ট সীমাবদ্ধতা ও তাহাদের উপর চাপানো অস্পষ্ট ধারণাসমূহ হইতে পরিষ্কৃত করা হইত। হয়ত সত্য-জ্ঞানের সূর্যের আলোকে তাহাদের অন্তর উজ্জ্বল হইয়া উঠিত এবং তাহারা স্বর্গীয় জ্ঞান-বিজ্ঞতার রহস্যাবলী হৃদয়ঙ্গম করিতে সমর্থ হইত। এক্ষণে ভাবিয়া দেখুন, যদি এই সকল অন্তরের বিদগ্ধ, শুষ্ক ও অনুর্বর মৃত্তিকা অপরিবর্তিত থাকিত, তাহা হইলে কিরূপে, ও কখনও কি, তাঁহারা আল্লাহর রহস্যাবলীর প্রত্যাদেশ গ্রহণকারী ও স্বর্গীয় সারাৎসারের অবতরণকারী হইতে পারিতেন ? এইরূপে তিনি বলিয়াছেনঃ “সেইদিন এই পৃথিবীকে অন্য এক ভিন্ন পৃথিবীতে পরিবর্তিত করা হইবে। (ক্বোরআন ১৪।৪৮)।
সৃষ্টি-সম্রাটের মৃদু মন্দ বাতাস, এমন কি, এই প্রাকৃতিক পৃথিবীকেও পরিবর্তিত করিয়াছে, যদি আপনি স্বর্গীয় প্রত্যাদেশের রহস্যসমূহ আপনার অন্তরে অনুধাবন করিতেন ( তাহা হইলে আপনি নিশ্চয়ই ইহার মহান প্রভাব সম্বন্ধে অবগত হইতেন)।
এক্ষণে, এই আয়াতের অর্থ বুঝিতে চেষ্টা করুনঃ “অভ্যুত্থান দিবসে সমস্ত পৃথিবী তাঁহার মুষ্ঠিগত হইবে, এবং আকাশম-ল তাঁহার দক্ষিণ হস্তে বিজড়িত থাকিবে। তিনিই পবিত্রতম এবং তাহাদের অংশী-বাদিগণ হইতে তিনি অতীব সমুন্নত।” ( ক্বোরআন ৩৯।৬৭)। এবং এক্ষণে আপনার বিচার-কার্যে আপনি ন্যায়পরায়ণ হন। তাহারা যাহা কল্পনা করে, তাহা যদি এই আয়াতের অর্থ হইত, তবে জিজ্ঞাসা করা যায়, ইহা মানুষের কি কল্যাণে আসিত ? অধিকন্তু, ইহা স্পষ্টতঃ প্রতীয়মান ও সুস্পষ্ট যে, মানুষের দৃষ্টির গোচরীভূত কোনও হস্ত তাহা করিতে সমর্থ হইত না, অথবা একমাত্র সত্য আল্লাহর অতীব মহিমান্বিত সারাৎসার সত্তার প্রতি কোনও প্রকার হস্তের প্রয়োগ সম্ভবতঃ হইতে পারিত না। না, এমন কি, সেইরূপ একটি ধারণা স্বীকার করাও আল্লাহর প্রতি নিতান্ত অবজ্ঞাসূচক কার্য, ইহা সত্যের সম্পূর্ণ বিপরীত আচরণ বৈ আর কিছু নহে। এবং যদি ইহা মনে করা হয় যে, এই আয়াতের দ্বারা আল্লাহর প্রকাশগণেরই অর্থ করা হয়, যাঁহাদিগকে বিচার-দিবসে এই সকল কাজ করিতে আহ্বান করা হইবে, তাহা হইলে ইহাও সত্য হইতে অনেক দূরে বলিয়া বোধ হয়, এবং নিশ্চয়ই ইহা কোন লাভজনক কার্য নহে। পক্ষান্তরে, “মৃত্তিকা” শব্দ দ্বারা জ্ঞান ও বুদ্ধির মৃত্তিকা এবং “আকাশমন্ডল” শব্দ দ্বারা স্বর্গীয় প্রত্যাদেশের আকাশসমূহকে বুঝান হয়। চিন্তা করিয়া দেখুন, কিরূপে, একপক্ষে, তিনি তাঁহার শক্তিশালী হস্তে পূর্ব-প্রকাশিত জ্ঞান-বুদ্ধির মৃত্তিকাকে মাত্র এক মুষ্ঠিতে পরিণত করিয়াছেন, এবং অন্যপক্ষে, মানব-অন্তরে এক নূতন ও অত্যুন্নত মৃত্তিকা বিস্তৃত করিয়া দিয়াছেন। এইরূপে তিনি অতীব সুন্দর সদ্য মুকুলসমূহ প্রস্ফুটিত করিয়াছেন, এবং আলোকোজ্জ্বল মানব-অন্তর হইতে অতীব শক্তিশালী ও অত্যুচ্চ বিটপীসমূহের জন্মদান করিয়াছেন।
এই প্রকারে চিন্তা করিয়া দেখুন কিরূপে অতীত কালের ধর্ম-বিধানসমূহের উন্নত আকাশগুলিকে শক্তির দক্ষিণ হস্তে একত্রে ধৃত ও জড়িত করা হইয়াছে, কিরূপে আল্লাহর আদেশে স্বর্গীয় প্রত্যাদেশের আকাশসমূহ বিস্তারিত করা হইয়াছে, এবং সেইগুলিকে তাঁহার অত্যাশ্চর্য আদেশাবলী-রূপ সূর্য, চন্দ্র ও তারকারাজির দ্বারা সুশোভিত করা হইয়াছে। আল্লাহর বাক্যের রহস্যাবলী এইরূপই, যাহা এক্ষণে আবরণমুক্ত করা হইয়াছে এবং প্রকাশ করা হইয়াছে।, যাহাতে আপনি স্বর্গীয় সুপথের প্রভাতিক আলোক অনুধাবন করিতে পারেন, যেন নির্ভরতা ও ত্যাগের শক্তি দ্বারা অলস কল্পনা, মিথ্যা কুসংস্কারপূর্ণ ধারণাদি, ইতস্ততঃতা ও সন্দিগ্ধতার প্রদীপ নির্বাপিত করিতে সক্ষম হন, এবং যেন আপনার অন্তরের অন্তঃস্থলে দিব্যজ্ঞান ও সুনিশ্চয়তার নবজাত আলোক প্রজ্জ্বলিত করিতে সমর্থ হন।
নিশ্চিতরূপে জানিয়া রাখুন যে, এই সকল নিদর্শন-সম্বলিত শব্দের ও দুর্বোধ্য সঙ্কেতাদির অন্তর্নিহিত মর্মাদি যাহা আল্লাহর পবিত্র ধর্মের অবতরণকারীদের নিকট হইতে বিনির্গত হয়, তাহা পৃথিবীর সকল জাতির লোকগণকে পরীক্ষা ও সপ্রমাণ করার জন্যই উদ্দেশ করা হইয়াছে, যেন ধ্বংসশীল ও অনুর্বর মৃত্তিকা হইতে পবিত্র ও আলোকোজ্জ্বল অন্তঃকরণের মৃত্তিকাকে পরিচিহ্ন করিতে পারা যায়। অনন্তকাল হইতে আল্লাহর সৃষ্ট জীবগণের মধ্যে আল্লাহর এই নিয়মই চলিয়া আসিয়াছে, এবং পবিত্র স্বর্গীয় গ্রন্থসমূহের লিপিবদ্ধ বাক্যাবলী ইহার সাক্ষ্যদান করিতেছে।
এবং এই প্রকারে, “কিবলা” সম্বন্ধে অবতীর্ণ আয়াতের বিষয় ভাবিয়া দেখুন। যখন সেই নবীত্বের সূর্য, হজরত মোহাম্মদ (সঃ) ‘বাতহা’ (মক্কা) নগরী-রূপ প্রভাতিক উদয়াচল হইতে “ইয়াস্রেব” (মদিনা) নগরীতে হিজরত করিয়াছিলেন, তখন তিনি প্রার্থনাকালে পবিত্র নগরী জেরুজালেমের দিকে মুখ ফিরাইতেন, ঐ সময় পর্যন্ত, যে পর্যন্ত না ইহুদীরা তাঁহার বিরুদ্ধে অনুচিত বাক্যাবলী উচ্চারণ করিয়াছিল, — যে বাক্যাবলীর উল্লেখ এখানে সমীচীন হইবে না, এবং পাঠকের বিরক্তির কারণ হইবে। হজরত মোহাম্মদ (সঃ) কঠোরভাবে এই সমুদয় বাক্য প্রত্যাখ্যান করিয়াছিলেন। গভীর ধ্যানমগ্ন অবস্থায় ও বিস্ময়ে তিনি যখন আকাশ পানে এক দৃষ্টিতে দেখিতেছিলেন, তখন তিনি জিব্রাইলের মধুর স্বর শুনিতে পাইলেনঃ “আমরা উপর হইতে তোমাকে স্বর্গের দিকে মুখ ফিরাইতে দেখিলাম; কিন্তু আমরা তোমাকে একটি কিব্লার দিকে ফিরাইব, যাহা তোমাকে আনন্দ দান করিবে।” (ক্বোরআন ২।১৪৪)। তৎপর একদিন যখন রসুলুল্লাহ হজরত মোহাম্মদ (সঃ) তাঁহার সঙ্গীগণসহ জোহরের নামাজে দন্ডায়মান ছিলেন এবং নির্ধারিত নামাজের দুই রাকা’ত শেষ করিয়াছিলেন, তখন পুনরায় জিব্রাইলের স্বর শুনিতে পাওয়া গেলঃ “পবিত্র (কা’বা) মসজিদের দিকে তোমাদের মুখ ফিরাও।” (ক্বোরআন ২।১৪৯) সেই একই নামাজের মধ্যে হজরত মোহাম্মদ (সঃ) হঠাৎ জেরুজালেমের দিক হইতে তাঁহার মুখ ফিরাইলেন, এবং পবিত্র কা’বার দিকে মুখ করিলেন। ইহাতে তাঁহার সঙ্গীগণ হঠাৎ এক গভীর আতঙ্কগ্রস্ত হইল এবং তাহাতে তাহাদের ধর্ম-বিশ্বাস ভয়ঙ্করভাবে আন্দোলিত হইল। তাহাদের আতঙ্ক এরূপ ভয়ঙ্কর হইয়াছিল যে তাহাদের অনেকেই নামাজ ত্যাগ করিয়া ধর্মভ্রষ্ট হইল। সত্য সত্যই আল্লাহ্ তাঁহার সেবকদের পরীক্ষা ও বিশ্বাস প্রমাণ করিবার জন্য তাহাদের উপর এইরূপ আপদ পাঠাইলেন। নতুবা তিনি, যিনি আদর্শ-সম্রাট, সহজে সেই কিব্লা পরিবর্তন না করিয়াও পারিতেন এবং জেরুজালেমকে তাঁহার ধর্ম-বিধান কালের শেষকাল পর্যন্ত নামাজের কেন্দ্রস্থলরূপে রাখিতে পারিতেন, তদ্দারা এই পবিত্র নগরীকে কিব্লা-স্বরূপ গ্রহণ করায় ইহাকে যে শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করা হইয়াছিল, তাহা কিছুতেই ক্ষুন্ন হইত না।
হজরত মূসা (আঃ)-র প্রকাশিত হওয়ার পর, হজরত মূসার ও হজরত মোহাম্মদ (সঃ)-র প্রতি ধর্মাদেশ অবতরণের মধ্যবর্তী সময়ে যে সকল অপেক্ষাকৃত গৌরবান্বিত পয়গম্বর আল্লাহর বাণীর বাহকরূপে আবির্ভূত হইয়াছিলেন, যথা দায়ূদ (আঃ), যীশু এবং অন্যান্য, তাঁহাদের কেহই কখনও কিব্লা সম্বন্ধীয় আদেশ পরিবর্তন করেন নাই। সৃষ্টিকর্তা মহাপ্রভূর এই সকল সুসংবাদ-বাহক প্রত্যেকেই তাঁহার অনুগামী লোকগণকে সেই একই প্রার্থনা-কেন্দ্রের দিকে মুখ ফিরাইতে আদেশ দান করিয়াছিলেন। সেই আদর্শ-সম্রাট আল্লাহর চক্ষে পৃথিবীর সকল স্থানই একই প্রকারের মর্যাদাসম্পন্ন, একমাত্র ঐ স্থান ব্যতীত, যাহা তিনি তাঁহার প্রকাশগণের সময়ে কোনও বিশেষ উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট করিয়া দেন। যেমন তিনি অবতীর্ণ করিয়াছেনঃ “পূর্ব ও পশ্চিমসমূহ আল্লাহরই, সুতরাং তুমি যেদিকে মুখ ফিরাও সেদিকেই আল্লাহর মুখ।” (ক্বোরআন ২।১১৫)। এই সকল বিষয়ের সত্যতা সত্ত্বেও, কেন উপাসনা-কেন্দ্র পরিবর্তিত হইল, যে কারণে রাসুলুল্লাহ্র সঙ্গীগণ ইতস্ততঃ করিতে লাগিল এবং তাহাদের মধ্যে এক মহা বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হইল ? হ্যাঁ, যে সমুদয় বিষয় সকল মানুষের অন্তরে ভীতির সঞ্চার করে, তাহা কেবল এই কারণে সংঘটিত হয় যেন প্রত্যেক আত্মা (ব্যক্তি) আল্লাহর কষ্টি-পাথর দ্বারা পরীক্ষিত হইতে পারে, যেন সত্যকে অবগত হইতে পারা যায় এবং মিথ্যা হইতে ইহাকে পৃথক করা যায়। জনগণের মধ্যে এইরূপ বিরোধের পর তিনি এই প্রকার বাণী অবতীর্ণ করিয়াছেনঃ “তুমি যাহা কিব্লা রূপে পাইতে বাসনা করিয়াছিলে তাহা আমরা ঐরূপ নির্দিষ্ট করিয়াছিলাম, কেবল এইজন্য যাহাতে, কে স্বর্গীয় বার্তাবাহকের অনুসরণ করে এবং কে তাঁহার নিকট হইতে পশ্চাৎপদ হয়, তাহা অবগত হইতে পারি।” (ক্বোরআন ২।১৪৩)। “ সিংহ হইতে পলায়মান সন্ত্রস্ত গর্দভ সদৃশ।” (ক্বোরআন ৭৪।৫০)।
আপনি যদি কিয়ৎকালের জন্য আপনার অন্তরে এই সকল উচ্চারিত বাক্য সম্বন্ধে ভাবিয়া দেখেন, তবে আপনি নিশ্চয়ই আপনার সম্মুখে জ্ঞানের দ্বারসমূহ অবারিত দেখিতে পাইবেন এবং সর্বপ্রকার জ্ঞান ও জ্ঞানের রহস্যসমূহ আপনার চক্ষুর সমক্ষে অনাবৃত দেখিতে পাইবেন। এই সকল বিষয় কেবল এই কারণে ঘটে, যেন মানুষের আত্মাসমূহ উন্নত হইতে পারে, এবং স্বার্থ ও আকাঙ্খার কারাগার-রূপ পিঞ্জর হইতে উদ্ধার পাইতে পারে। পক্ষান্তরে, সেই আদর্শ-সম্রাট অনন্তকাল যাবৎ নিজ সারাৎসার-প্রকৃতিতে সকল মানুষের বোধগম্যতার অতীত হইয়া রহিয়াছেন এবং চিরকাল নিজ অস্তিত্বে প্রত্যেক মানব-আত্মার অর্চনার উর্দ্ধে মহীয়ানরূপে অবস্থান করিতে থাকিবেন। তাঁহার সমৃদ্ধির প্রাচুর্যের একটিমাত্র মৃদু মন্দ প্রবাহ সমস্ত মানব জাতিকে ঐশ্বর্যের বেশ-ভূষায় অলঙ্কৃত করিতে সমর্থ এবং তাঁহার বদান্যতাপূর্ণ করুণা-সমুদ্রের মাত্র এক বিন্দুই সকল প্রাণীকে অনন্ত জীবনের প্রভা দান করিতে যথেষ্টভাবে সক্ষম; কিন্তু, যেহেতু ঐশী-ইচ্ছা এই আজ্ঞা প্রদান করিয়াছে যে, সত্যকে মিথ্যা হইতে পৃথক করিতে হইবে, এবং সূর্যকে ছায়া হইতে, সুতরাং তিনি প্রত্যেক যুগে তাঁহারই গৌরবান্বিত রাজ্য হইতে মানব জাতির উপর কষ্টি-পাথরের সাহায্যে পরীক্ষার বৃষ্টি বর্ষণ করিয়াছেন।
যদি জনগণ অতীত কালের পয়গম্বরগণের জীবনী সম্বন্ধে চিন্তা ভাবনা করিত, তাহা হইলে তাহারা এই সকল পয়গম্বরের রীতি-নীতি ও কার্য-প্রণালী এত সহজে জানিতে ও উপলব্ধি করিতে সক্ষম হইত যে, তাহাদের নিজেদের পার্থিব বাসনার বিপরীত কোন কার্য দ্বারা তাহারা আবরণযুক্ত হইত না, এবং এই প্রকারে দিব্যজ্ঞানের ঝোপের জলন্ত অগ্নি দ্বারা প্রত্যেক মধ্যবর্তী (প্রতিরোধকারী) আবরণ ভষ্মীভূত করিয়া দিত এবং শান্তি ও নিশ্চয়তার সিংহাসনে নিঃসঙ্কোচে অবস্থান করিত। দৃষ্টান্তস্বরূপ, এমরান-পুত্র মূসা (আঃ)-র কথা অবধারণ করুন, যিনি একজন উচ্চ-প্রশংসিত ঐশী-ভবিষ্যদ্বক্তা ও স্বর্গীয় অবতীর্ণ গ্রন্থের মাধ্যম ছিলেন। তাঁহার প্রাথমিক জীবনে যখন একদিন তিনি বাজারের মধ্য দিয়া যাইতেছিলেন, তখনও তাঁহার স্বর্গীয় দৌত্য ঘোষিত হয় নাই, তখন তিনি দুইজন লোককে ঝগড়ায় প্রবৃত্ত দেখিতে পাইলেন তাহাদের একজন তাহার শত্রুর বিরুদ্ধে মূসা (আঃ)-র সাহায্য প্রার্থনা করিল। তাহাতে মূসা (আঃ) হস্তক্ষেপ করিলেন এবং তাহাকে হত্যা করিলেন। পবিত্র গ্রন্থের লিপি ইহার সাক্ষ্য দিতেছে। বিশেষ বিবরণ উল্লিখিত হইলে বিতর্কের ধারা প্রলম্বিত ও বাধাপ্রাপ্ত হইবে। এই ঘটনার কাহিনী নগরের সর্বত্র বিস্তৃত হইয়া পড়িল, এবং মূসা (আঃ) অন্তর ভয়ে পরিপূর্ণ হইল। ক্বোরআন গ্রন্থে ইহার সাক্ষ্য দেখিতে পাওয়া যাইবে। যখন এই সাবধানবাণীঃ “হে মূসা! রাজ্যের প্রধানবর্গ তোমাকে হত্যা করার পরামর্শ গ্রহণ করিয়াছে।” (ক্বোরআন ২৮।২০), তাঁহার কর্ণগোচর হইল, তখন তিনি নগর হইতে বহির্গত হইলেন এবং মদিয়ন্ শহরে শো’আয়বের কার্যে নিযুক্ত হইয়া কিছুদিন বাস করিতে লাগিলেন। প্রত্যাবর্তনকালে মূসা (আঃ) সিনাইয়ের মরু প্রান্তরে অবস্থিত পবিত্র উপত্যকায় প্রবেশ করিলেন, এবং সেখানে “যে বৃক্ষ, না পূর্বদিকের, না পশ্চিমের”, তাহা হইতে আভা-সম্রাটের দিব্য সুষমা দর্শন করিলেন। সেখানে প্রজ্জ্বলিত দিব্য অগ্নি-শিখা হইতে উচ্চারিত স্বর্গীয় পরমাত্মার প্রাণমুগ্ধকারী আদেশ-বাণী শ্রবণ করিবেন, —আদেশ ছিল, ফেরাঊনের স্বভাব বিশিষ্ট লোকের অন্তরসমূহে স্বর্গীয় সুপথের আলোক বিতরণ করা, তিনি যেন তাহাদিগকে ব্যক্তিগত স্বার্থ ও বাসনার ছায়া হইতে মুক্ত করিয়া স্বর্গীয় আনন্দের সবুজ উদ্যানসমূহ লাভ করায় সক্ষম করিতে পারেন এবং ত্যাগ-রূপ স্বর্গীয় “সল্সবিল” উৎসের মাধ্যমে দূরত্বের দিশাহারা অবস্থা হইতে উদ্ধার করিয়া স্বর্গীয় আনন সন্দর্শনের জন্য তাহাদিগকে শান্তিপূর্ণ নগরীতে প্রবেশ করাইতে পারেন। আল্লাহ্ কর্তৃক প্রত্যাদিষ্ট হইয়া মূসা (আঃ) যখন স্বর্গীয় সুসংবাদ সহকারে ফেরাঊনের নিকট গমন করিলেন এবং তাহাকে ঐ বাণী প্রদান করিলেন, তখন ফেরাঊন তাঁহাকে অবমাননার স্বরে বলিলঃ “তুমি কি ঐ ব্যক্তি নহ, যে হত্যাকান্ড সম্পাদন করিয়া বিশ্বাসঘাতকতা করিয়াছিলে ? ফেরাঊন কর্তৃক মূসা (আঃ)-কে যাহা বলা হইয়াছিল, মহিমান্বিত প্রভূ তাহা বিশেষভাবে পুনরুল্লেখ করিয়াছেনঃ “তুমি কিরূপ ভয়ানক কু কার্য করিয়াছ! তুমি একজন অকৃতজ্ঞ লোক।” তিনি (মূসা আঃ) বলিলেনঃ আমি বাস্তবিক উহা করিয়াছিলাম, কিন্তু তখন আমি পথ-ভ্রান্তদের অন্যতম ছিলাম। এবং আমি যখন তোমাদের ভয়ে ভীত ছিলাম, তখন তোমাদের নিকট হইতে পলায়ন করিয়াছিলাম; কিন্তু আমার প্রভূ আমাকে বিচার-বুদ্ধি দান করিয়াছেন, এবং আমাকে তাঁহার প্রেরিত সংবাদ-বাহকদের দলভূক্ত করিয়াছেন।” (ক্বোরআন ২৬।১৯-২১)।
এবং এক্ষণে, আল্লাহ্ যে উত্তেজনা সৃষ্টি করেন, তৎসম্বন্ধে আপনি মনে ভাবিয়া দেখুন, কিরূপে নানাবিধ আশ্চর্যজনক প্রমাণাদি দ্বারা আল্লাহ্ তাঁহার সেবকগণকে পরীক্ষা করেন। বিবেচনা করুন, আল্লাহ্ কি প্রকারে তাঁহার সেবকগণের মধ্য হইতে হঠাৎ এমন এক ব্যক্তিতে মনোনীত করিলেন, এবং তাঁহাকে স্বর্গীয় পথ প্রদর্শনের উচ্চ শ্রেণীর দৌত্যকার্যের ভার সমর্পণ করিলেন, যিনি মানব-হত্যার অপরাধে অপরাধী বলিয়া সকলের নিকট বিদিত ছিলেন এবং যিনি নিজের নিষ্ঠুরতা নিজে স্বীকার করিয়াছিলেন এবং যিনি সর্বসমক্ষে প্রায় ত্রিশ বৎসর যাবৎ ফেরাঊনের রাজবাড়ীতে লালিত-পালিত হইয়াছিলেন এবং একই টেবিলে তাহার সহিত খাদ্য গ্রহণ করিয়াছিলেন। সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ তাঁহার হস্ত হত্যাকান্ড হইতে কি বিরত রাখিতে সক্ষম ছিলেন না, যাহাতে তিনি মানব-হত্যার দায়ে লোক-সমাজে বিহ্বলতার কারণ ও ঘৃণার পাত্র হন ?
এই প্রকারে মরিয়মের অবস্থা ও দুর্দশার কথা চিন্তা করিয়া দেখুন। সেই অতীব সুষমাসম্পন্নার বিহ্বলতা এরূপ গভীর ছিল এবং তাঁহার অবস্থা এরূপ কষ্টদায়ক ছিল যে, তিনি কঠোরভাবে তাঁহার মানব জন্মের জন্য অনুশোচনা করিয়াছিলেন। পবিত্র আয়াতের মূল বাক্য এই বিষয়ের সাক্ষ্য দান করে—যেখানে ইহা উল্লিখিত আছে যে, যীশুকে জন্মদান করার পর মরিয়ম তাঁহার শোচনীয় অবস্থার জন্য বিলাপ করিয়া বলিয়াছিলেন, “আহা! ইতিপূর্বে যদি আমার মৃত্যু হইত, এবং যদি আমি সম্পূর্ণরূপে বিস্মৃতির গর্ভে বিলীন হইতাম!” (ক্বোরআন ১৯।২২)। আল্লাহর শপথ করিয়া বলিতেছি যে, এইরূপ অনুশোচনা অন্তরাত্মা জ্বালাইয়া দেয় এবং অস্তিত্বকে প্রকম্পিত করে। আত্মার এইরূপ আতঙ্ক, এইরূপ হতাশা, শত্রুদের নিন্দা ও অবিশ্বাসীদের ও বিপথগামীদের মিথ্যা অপবাদের দরুনই ঘটিয়াছিল। চিন্তা করিয়া দেখুন, মরিয়ম তাঁহার চতুর্দিকস্থ জনগণকে কি উত্তর দিতে পারিতেন, তিনি কি প্রকারে দাবি করিতে পারিতেন যে, একটি শিশু, যাঁহার পিতা অপরিজ্ঞাত ছিল, তিনি পবিত্রাত্মার গর্ভ-ধারণে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। সুতরাং সেই অবগুণ্ঠনাবৃতা ও অবিনশ্বর সুষমামন্ডিতা তাঁহার শিশু পুত্রকে লইয়া স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করিয়াছিলেন। তাঁহাকে দেখিবামাত্র সকলে এই বলিয়া চীৎকার ধ্বনি করিয়া উঠিল, “হে হারুনের ভগ্নি! তোমার পিতা দুষ্ট প্রকৃতির লোক ছিলেন না, তোমার মাতাও অসতী ছিলেন না।” (ক্বোরআন ১৯।২৮)।
এক্ষণে, এই মহা আলোড়ন এইরূপ সংঘাতিক পরীক্ষা সম্বন্ধে বিবেচনা করিয়া দেখুন। এই সমুদয় সত্ত্বেও আল্লাহ্ এই পবিত্রাত্মার সারাৎসারকে যিনি সকলের নিকট পিতৃহীন বলিয়া পরিজ্ঞাত ছিলেন, পয়গম্বরের মহান্ পদ-গৌরব প্রদান করিয়াছিলেন এবং তাঁহাকে স্বর্গে ও মর্ত্যে যাহারা আছে তাহাদের সকলেরই জন্য তাঁহার সাক্ষ্যরূপে দাঁড় করাইয়াছিলেন।
দেখুন, সৃষ্টি-সম্রাট আল্লাহ্ তাঁহার প্রকাশগণের জন্য মানুষের রীতি-নীতি ও বাসনার কিরূপ বিপরীত পন্থাসমূহ স্থাপিত করিয়াছেন। যখন আপনি এই সকল স্বর্গীয় রহস্যের সারবত্তা উপলব্ধি করিতে পারিবেন, তখন আপনি স্বর্গীয় যাদুকর, সর্বাপেক্ষা প্রিয়তম প্রেমাস্পদ আল্লাহর উদ্দেশ্য বুঝিতে সক্ষম হইবেন। আপনি সেই সর্বশক্তিমান রাজাধিরাজের বাক্যাবলী ও কার্যাবলী এক ও অভিন্ন বলিয়া মনে করিবেন, এইরূপে তাঁহার কার্যাবলীতে আপনি যাহা দেখিতে পান, তাঁহার বাণীসমূহেও তাহা দেখিতে পাইবেন এবং তাঁহার বাক্যাবলীতে আপনি যাহা পাঠ করেন, তাঁহার কার্যাবলীতেও তাহা দেখিতে পাইবেন। ইহা এইরূপ যে, বাহ্যতঃ সেই সকল বাক্য ও কার্য দুষ্ট লোকের জন্য প্রতিহিংসার অগ্নি, কিন্তু আভ্যন্তরীণভাবে সৎ লোকের জন্য ইহা প্রকৃতই করুণার জলধারা সদৃশ। যদি অন্তর-চক্ষু খুলিয়া যাইত, তবে ইহা অনুভূত হইত যে, আল্লাহর ইচ্ছা-শক্তির স্বর্গ হইতে অবতীর্ণ বাণীসমূহ ও দিব্য শক্তির রাজ্য হইতে উদ্ভূত কার্যাবলী সম্পূর্ণ এক ও একই প্রকারের।
এবং এক্ষণে, হে ভ্রাতঃ। মনোযোগ দিন। যদি এই ধর্ম-বিধানে ঐরূপ বিষয়াদি অবতীর্ণ হয় এবং বর্তমান সময়ে যদি ঐরূপ ঘটনাবলী সংঘটিত হয়, তবে মানুষ কি করিবে ? যিনি মানবজাতির প্রকৃত শিক্ষাদাতা ও আল্লাহর বাণীর অবতরণকারী তাঁহার শপথ করিয়া বলিতেছি যে, জনগণ তখন তখনই ইতস্ততঃ না করিয়া তাঁহাকে অবিশ্বাসী বলিয়া মত প্রকাশ করিবে এবং তাঁহাকে হত্যার আদেশ দান করিবে। জনগণ এইরূপ কথায় কখনও কর্ণপাত করিবে না, যদি তাহাদিগকে বলা হয়—দেখ, একজন যীশু পবিত্রাত্মার নিঃশ্বাস দ্বারা জন্মলাভ করিয়াছিলেন এবং একজন মূসা (আঃ) আল্লাহর নির্দেশিত কার্য সম্পাদনের জন্য আহূত হইয়াছিলেন। যদি দশ সহস্র স্বর উচ্চারণ করা হইত, তাহা হইলেও এই কথায় কেহই কর্ণপাত করিত না, যদি আমরা বলিতাম যে, একজন পিতৃহীন বালকের উপর ঐশী ভবিষ্যদ্বাদীর কার্যভার অর্পণ করা হইয়াছে, অথবা একজন হত্যাকারী জ্বলন্ত ঝোপের অগ্নিশিখা হইতে এই বাণী আনয়ন করিয়াছেনঃ “নিশ্চয়, নিশ্চয়, আমিই আল্লাহ্!”
যদি ন্যায় বিচারের চক্ষু উন্মিলিত হয়, তাহা হইলে পূর্বোল্লিখিত আলোকের সাহায্যে ইহা বুঝিতে সক্ষম হইবেন যে, যিনি এই সকলের একমাত্র কারণ ও চরম উদ্দেশ্য, তিনিই এই দিনে প্রকাশিত হইয়াছেন। যদিও সাদৃশ্যমূলক ঘটনাসমূহ এই ধর্ম-বিধানে সংঘটিত হয় নাই, তথাপি জনসাধারণ এখনও পর্যন্ত ঐরূপ অর্থহীন কাল্পনিক ধারণাসমূহ দৃঢ়ভাবে আঁকড়াইয়া ধরিয়া রহিয়াছে—যাহা ভ্রষ্ট পাপাচারীরা পোষণ করিয়া থাকে। তাঁহার বিরুদ্ধে কিরূপ গুরুতর অভিযোগ আনয়ন করা হইয়াছিল। তাঁহার উপর কত কঠোর নির্যাতন বর্ষণ করা হইয়াছিল—এইরূপ অভিযোগ ও নির্যাতন যাহা মানুষ কখনো দেখে নাই ও শুনে নাই।
সুমহান পবিত্র আল্লাহ্! যখন উচ্চারিত বাণী প্রবাহ এতদূর অগ্রসর হইল, তখন আমরা দেখিতে পাইলাম- দেখ! আল্লাহর সুমধুর সুগন্ধ প্রকাশের প্রভাত হইতে উড়িয়া আসিতেছিল এবং অনন্তর “শেবা” রাজ্য হইতে সমীরণ প্রবাহিত হইতেছিল। ইহার সুসংবাদসমূহ অন্তরকে পুনরায় আনন্দে পরিপূর্ণ করিল এবং আত্মাকে অপরিমেয় আহ্লাদ প্রদান করিল। ইহা সকলকেই নব কলেবর দান করিল এবং সেই অজ্ঞেয় বন্ধুর নিকট হইতে অসংখ্য ও অমূল্য দানসমূহ লইয়া আসিল। মানবীয় প্রশংসার পরিচ্ছদ ইহার মহীয়ান সমুচ্চতার সমতুল্য হওয়ার আশা কখনও পোষণ করিতে পারে না এবং কখনও উচ্চারিত বাক্যের পরিচ্ছদ ইহার উজ্জ্বল আকৃতির উপযোগী হইতে পারে না। বিনা শব্দব্যয়ে ইহা আভ্যন্তরীণ রহস্যাবলী প্রকাশ করে। এবং বিনা বাক্যোচ্চারণে ইহা স্বর্গীয় বাণীসমূহের রহস্যাবলী বিকাশ করে। দূরত্বের ও বিচ্ছেদের শাখা-উপবিষ্ট সংগীতরত বুল্বুল্দের ইহা শোক ও বিলাপ শিক্ষা দিতেছে, তাহাদিগকে প্রেমের পথের কৌশল শিক্ষা দিতেছে এবং তাহাদিগকে অন্তর-সমর্পণের রহস্য প্রদর্শন করিতেছে। স্বর্গীয় পুনর্মিলনের ‘রেজওয়ান’ উদ্যানের পুষ্পাবলীর নিকট ইহা অধৈর্যপূর্ণ প্রেমিকের প্রণয়-প্রচেষ্টাসমূহ ব্যক্ত করিতেছে। এবং প্রিয়তমা প্রেমিকার সুষমার মোহিনী-শক্তির অবগুণ্ঠন উন্মোচন করিতেছে। প্রেমোদ্যানের বায়ু পুষ্পসমূহের উপর ইহা সত্যের রহস্যাদি প্রদান করে এবং প্রেমিকগণের বক্ষের মধ্যে ইহা সুক্ষ্মতম রহস্যাদির নিদর্শনসমূহ সমর্পণ করে। এই সময়ে ইহার অনুকম্পার ঘন-বর্ষণ এরূপ মুক্তহস্ত যে, পবিত্রাত্মা স্বয়ংই ইহার জন্য ঈর্ষান্বিত। ইহা ক্ষুদ্র জলকণাকে সাগরের উর্মিমালার শক্তি প্রদান করিয়াছে এবং অণু-বিন্দুকে সূর্যের অত্যুজ্জ্বলতা দান করিয়াছে। ইহার বদান্যতা-রূপ বন্যার স্রোতের প্রাবল্য এতই অধিক যে, অতীব অপরিচ্ছন্ন গুবরে-কীট মৃগ-নাভির সুগন্ধ অনুসন্ধানে তৎপর হইয়াছে এবং বাদুড় সূর্যালোকের প্রার্থী হইয়াছে। ইহা প্রাণ-বায়ু সঞ্চালনে মৃতকে জীবন দান করিয়াছে এবং তাহাদিগকে তাহাদের নশ্বর মানবীয় শরীর-রূপ সমাধি হইতে দ্রুতগতিতে বহির্গত করিয়া আনিয়াছে। ইহা অজ্ঞ লোকগণকে জ্ঞানের আসনসমূহের উপর সংস্থাপিত করিয়াছে এবং অত্যাচারীগণকে ন্যায়-বিচারের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করিয়াছে।
এই বিশ্বজগৎ এই সব বিভিন্ন প্রকারের বদান্যতায় পরিপূর্ণ হইয়া ঐ নির্ধারিত সময়ের জন্য প্রতীক্ষা করিয়া রহিয়াছে, কখন ইহার অদৃশ্য দানসমূহের প্রভাব ও ফল এই পৃথিবীতে প্রকটিত হইবে, কখন ক্লান্ত ও অতীব পিপাসার্তগণ তাহাদের প্রিয়তম প্রেমাস্পদের জীবন্ত “কাওসর”-উৎসের সন্ধান পাইবে এবং যে বিপথগামী দূরত্ব ও শূণ্যতার জঙ্গলে পথ হারাইয়াছে, সে জীবন-মন্দিরে প্রবেশ করিবে এবং তাহার অন্তরের অভিলষিতের সহিত পুনর্মিলন লাভ করিতে পারিবে। কাহার অন্তরের মৃত্তিকায় এই সকল পবিত্র বীজ অঙ্কুরিত হইবে ? কাহার আত্মার উদ্যান হইতে এই সকল অদৃশ্য বাস্তব সত্যনিচয়ের পুষ্পসমূহ মুকুলিত হইবে ? নিশ্চয়ই, আমি বলি, অন্তরের পবিত্র সিনাই পর্বতে প্রজ্জ্বলিত প্রেমের ঝোপের অগ্নি-শিখা এতই উগ্র যে, পবিত্র উচ্চারিত বাণীর প্রবহমান জলরাশির স্্েরাত কখনও ইহা তেজ নির্বাপিত করিতে পারে না। মহাসমুদ্রগুলি এই প্রকা- দেহবিশিষ্ট সামুদ্রিক “লিভায়েথান্” জন্তুর জ্বলন্ত পিপাসা কখনও দমন করিতে পারে না, এবং এই অমর-অগ্নি-রূপ “ফিনিক্স” প্রিয়তম প্রেমাস্পদের মুখশ্রীর রক্তিমাভা ব্যতীত আর কুত্রাপি থাকিতে পারে না। অতএব, হে ভ্রাতঃ! আপনার অন্তরের আভ্যন্তরীণ প্রকোষ্ঠে বিজ্ঞতার তৈল সহযোগে আধ্যাত্মিক প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত করুন এবং ইহাকে উপলব্ধির কু-লি দ্বারা সুরক্ষিত করুন, যাহাতে অবিশ্বাসীদের নিঃশ্বাস ইহার শিখাকে নির্বাপিত করিতে বা ইহার উজ্জ্বলতা মলিন করিতে না পারে। এইরূপে আমরা উচ্চারিত বাণীর আকাশম-লকে ঐশী বিজ্ঞতা ও জ্ঞানের সূর্যের অত্যুজ্জ্বল আলোকরাশি দ্বারা আলোকিত করিয়াছি, যেন আপনার অন্তর শান্তি লাভ করিতে পারে; যাহারা নিশ্চিত বিশ্বাসের পক্ষ সহকারে সর্বকরুণাময় প্রভূর প্রেমের স্বর্গে উড্ডীয়মান হইয়াছে, আপনি যেন তাহাদের ন্যায় হইতে পারেন।
এবং এক্ষণে, তাঁহার এই বাক্যাবলী সম্বন্ধে বলিতেছিঃ “এবং তখন মানব-পুত্রের লক্ষণ আকাশে দেখা যাইবে।” বাক্যগুলির অর্থ এই যে, যখন স্বর্গীয় শিক্ষাসমূহের সূর্যগ্রহণ হইয়াছে, স্বর্গীয় প্রত্যাদেশ দ্বারা সংস্থাপিত বিধানসমূহের তারকারাজি আকাশ হইতে ভূতলে পতিত হইয়াছে, এবং সত্য-জ্ঞানের চন্দ্র, অর্থাৎ মানব জাতির শিক্ষাদাতা অন্ধকারাচ্ছন্ন হইয়াছে; যখন স্বর্গীয় পথ-প্রদর্শনকারী ও আনন্দ প্রদানকারী আদর্শসমূহ সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হইয়া যাইবে এবং রাত্রির অন্ধকারে সত্য ও ন্যায়পরায়ণতার প্রভাত আবৃত হইয়া যাইবে, তখন মনুষ্য-পুত্রের নিশানা আকাশে দেখা যাইবে। “আকাশ” শব্দ দ্বারা সচরাচর দৃষ্ট আকাশ বুঝান হইয়াছে, কারণ যখনই সেই নির্দিষ্ট সময় নিকটবর্তী হয়, যে-সময়ে ন্যায় বিচারের আকাশের সূর্য প্রকাশিত করা হইবে, এবং স্বর্গীয় পথ-প্রদর্শনের তরী প্রভা-সমুদ্রে পাল তুলিয়া যাত্রা শুরু করিবে, তখন আকাশে একটি তারকা উদিত হইয়া লোক-জনকে সেই সুমহান আলোকের আবির্ভাবের সুসংবাদ ঘোষণা করিবে। সেই প্রকারে, অদৃশ্য আকাশে একটি তারকা প্রকাশিত হইবেন, যিনি পৃথিবীর লোকের নিকট সেই সত্য ও মহীয়ান প্রভাত কালের উদয়ের অগ্রগামী দূতের কার্য করিবেন। সর্বসাধারণের বিশ্বাস অনুযায়ী এই সকল দ্বিগুণিত নিদর্শন, দৃশ্য ও অদৃশ্য আকাশে আল্লাহর প্রত্যেক আবির্ভাব ঘোষণা করিয়াছে।
আল্লাহর প্রেরিত পয়গম্বরগণের মধ্যে আল্লাহর বন্ধু ইব্রাহিম (আঃ) একজন ছিলেন। তাঁহার আবির্ভাবের পূর্বে নমরূদ এক স্বপ্ন দেখিয়াছিল। সেইজন্য সে গণকদের সমবেত করিয়াছিল, তাহারা তাহাকে আকাশে একটি নক্ষত্র উদিত হওয়ার সংবাদ দিয়াছিল। এই প্রকারে একজন অগ্রগামী দূতের আবির্ভাব হইয়াছিল, যিনি ইব্রাহিম (আঃ)-র আগমন সম্বন্ধে দেশের সর্বত্র ঘোষণা-বাণী প্রচার করিয়াছিলেন।
তাঁহার পরে আসিলেন মূসা (আঃ), যিনি আল্লাহর সহিত বাক্যালাপ করিতেন। তাঁহার সময়ের গণকগণ ফেরাঊনকে এই বলিয়া সাবধান করিয়াছিলঃ “আকাশে একটি তারকা উদিত হইয়াছে। দেখুন, ইহা মাতৃগর্ভে এমন একটি শিশুর জন্ম ধারণের সংবাদ দিতেছে, যাহার হস্তে আপনার এবং আপনার জনগণের ভাগ্য নির্ভর করে।” এই প্রকারে রাত্রির অন্ধকারে একজন জ্ঞানী লোকের আবির্ভাব হইয়াছিল, তিনি বনি ইস্রায়েলের নিকট আনন্দ-সংবাদ আনয়ন করিয়াছিলেন, যদ্দ্বারা তিনি তাহাদের মনে সান্ত¡না ও অন্তরে দৃঢ় বিশ্বাস প্রদান করিয়াছিলেন। পবিত্র গ্রন্থাদির লিপিবদ্ধ বিবরণসমূহ ইহার সাক্ষ্য দিতেছে। বিশেষ বিবরণাদি উল্লিখিত হইলে এই পত্র সুদীর্ঘ হইয়া বিরাট গ্রন্থাকার ধারণ করিবে। অধিকন্তু, অতীত কালের কাহিনীসমূহ বর্ণনা করা আমাদের ইচ্ছা নহে। আল্লাহ্ এই বিষয়ে আমাদের সাক্ষ্য যে, এমন কি, এখন আমরা যাহা উল্লেখ করিতেছি, তাহাও আপনার প্রতি আমাদের সদয় স্নেহের কারণে, যাহার ফলে, হয়ত পৃথিবীর দরিদ্রেরা বিভব-সমুদ্রের তটভূমিতে পৌঁছিতে পারে, অজ্ঞ লোকেরা দিব্যজ্ঞান-সাগরের দিকে পরিচালিত হইতে পারে এবং যাহারা মর্মবোধের জন্য পিপাসার্ত, তাহারা স্বর্গীয় জ্ঞান-বিজ্ঞতার “সল্সবিল”-উৎস হইতে পান করিতে সমর্থ হয়। অন্যপক্ষে, এই সেবক এই প্রকার বিবরণাদির উল্লেখ একটি মহা ভুল ও গুরুতর নিয়ম-লঙ্ঘন বলিয়া মনে করে।
সেই একই প্রকারে, যখন আবির্ভাবের সময় নিকটবর্তী হইল, পারস্য দেশীয় কয়েকজন জ্ঞানী ব্যক্তি আকাশে যীশুর তারকার আবির্ভাব সম্বন্ধে অবগত হইয়া ইহার অনুসন্ধান ও অনুসরণ করতঃ অবশেষে হেরদের রাজধানীতে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিল। সেই সময় সে-দেশের সর্বত্র তাহার আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত ছিল। এই সকল জ্ঞানী ব্যক্তি বলিয়াছিলঃ “যিনি ইহুদীদের রাজা-রূপে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন, তিনি কোথায়? কারণ পূর্বদেশে আমরা তাঁহার তারকা দেখিতে পাইয়াছি এবং তাঁহাকে প্রণাম করিতে আসিয়াছি”। (মথি ২।২)। তাহারা অনুসন্ধান করিয়া জানিতে পারিল যে, যুডীয়া দেশের বেথ্ল্্হেম্ নগরে সেই শিশু জন্মলাভ করিয়াছেন। দৃশ্যমান আকাশে এই নিদর্শনের আবির্ভাব হইয়াছিল। অদৃশ্য আকাশের নিদর্শন সম্বন্ধে অর্থাৎ স্বর্গীয় জ্ঞান ও উপলব্ধির আকাশ সম্বন্ধে, ইহাই বলা যায় যে যকরিয়ার পুত্র যোহন যীশুর প্রকাশ হওয়া সম্বন্ধে জনসাধারণকে সুসংবাদ প্রদান করিয়াছিল। এমন কি, তিনি বলিয়াছেনঃ “আল্লাহ্ তোমার নিকট যোহনের সুসংবাদ দিতেছেন, যিনি আল্লাহর নিকট হইতে অবতীর্ণ এক বাণীর সাক্ষ্য প্রদান করিবেন, এবং যিনি একজন মহান ও পবিত্রাত্মা বিশিষ্ট ব্যক্তি হইবেন।” (ক্বোরআন ৩।৩৯)। “বাক্য” বা “বাণী” শব্দ দ্বারা যীশুকে লক্ষ্য করা হইয়াছে, যাঁহার আবির্ভাব সম্বন্ধে যোহন ভবিষ্যদ্বাণী করিয়াছিলেন। অধিকন্তু, স্বর্গীয় গ্রন্থে লিখিত আছেঃ “সেই যোহন ব্যাপকতা ইযক্ জুডীয়ার প্রান্তরে প্রচার করিতে লাগিলেন, এবং তিনি বলিলেনঃ ‘মন ফিরাও, কেন না, স্বর্গ-রাজ্য সন্নিকট হইল।” (মথি ৩।১-২)। এখানে ‘যোহন’ নাম দ্বারা এহ্য়াকেই লক্ষ্য করা হইয়াছে।
এই প্রকারে, হজরত মোহাম্মদ (সঃ)-র সুষমার আবরণ উন্মোচিত হওয়ার পূর্বে দৃশ্যমান আকাশের নিদর্শনসমূহ প্রকটিত করা হইয়াছিল। অদৃশ্য আকাশের নিদর্শনসমূহ সম্বন্ধে চারি ব্যক্তির আবির্ভাব হইয়াছিল, যাহারা ক্রমান্বয়ে সেই স্বর্গীয় জ্যোতির অভ্যুত্থানের আনন্দদায়ক সুসংবাদ জনগণের নিকট ঘোষণা করিয়াছিলেন। ‘রুয্-বিহ’, যিনি পরে সুলায়মান নামে আখ্যায়িত হইয়াছিলেন, তাঁহাদের সেবায় নিযুক্ত হওয়ার সম্মান লাভ করিয়াছিলেন। যখন তাঁহাদের মধ্যে একজনের অন্তিম কাল উপস্থিত হইত, তিনি রুয্-বিহকে অপরের নিকট পাঠাইতেন; অবশেষে চতুর্থ ব্যক্তি তাঁহার মৃত্যু নিকটবর্তী জানিয়া রুয্বিহকে সম্বোধন করিয়া বলিয়াছিলেনঃ “ হে রুয্-বিহ! তুমি আমার দেহকে বহন করিয়া লইয়া গিয়া সমাধিস্থ করিবে, তৎপর হেজাজে যাইবে, কারণ সেখানে মোহাম্মদ (সঃ)-র সূর্য উদিত হইবে। তুমি সুখী, কারণ তুমি তাঁহার পবিত্র আনন সন্দর্শন করিবে।”
এবং এক্ষণে, এই অত্যাশ্চর্য ও অত্যুন্নত ধর্মাদেশের আবির্ভাব সম্বন্ধে অবহিত হউন। আপনি ইহা নিশ্চিতরূপে জানিয়া রাখুন যে, অনেক জ্যোতির্বিদ পন্ডিত দৃশ্যমান আকাশে ইহার তারকার আবির্ভাব সম্বন্ধে ঘোষণা করিয়াছেন। সেই প্রকারে, আহ্মদ (শেখ আহ্মদ আহ্সা’য়ী) এবং কাযেম্ (সৈয়দ কাযেম্ রশ্তী) নামক দুইটি অত্যুজ্জ্বল আলোক পৃথিবীতে আবির্ভূত হইয়াছিলেন—আল্লাহ্ তাঁহাদের বিশ্রাম-স্থানকে পবিত্র করুন।
আমাদের পূর্ববর্ণিত বিবরণ হইতে ইহা সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত ও প্রকাশিত হইয়াছে যে, স্বর্গীয় সারাৎসার প্রতিফলিত করিয়া যে সকল ঐশী দর্পণ আবির্ভূত হন, তাঁহাদের প্রত্যেকের আবির্ভাবের পূর্বে দৃশ্যমান ও অদৃশ্য আকাশে তাঁহাদের আবির্ভাব ঘোষণাকারী নিদর্শনসমূহ নিশ্চয়ই আবির্ভূত হইবে, যাহার মধ্যে জ্ঞান-রূপ সূর্যের ও বিজ্ঞতা-রূপ চন্দ্রের ও উপলব্ধি ও উচ্চারণরূপ তারকারাজির আসন থাকিবে। অদৃশ্য আকাশের নিদর্শন নিশ্চয়ই সেই পূর্ণ মানবের ব্যক্তিত্বে আবির্ভূত হইবেন। যিনি প্রত্যেক ঐশী-প্রকাশের আবির্ভাবের পূর্বে মানুষের মধ্যে স্বর্গীয় জ্যোতি, সেই ঐশী-একত্বের আলোক আবির্ভাবের জন্য মানুষের অন্তরসমূহকে শিক্ষিত করিয়া প্রস্তুত করেন।
এক্ষণে, তাঁহার ( যীশুর) এই বাক্যাবলী সম্বন্ধে অবগত হউনঃ “আর তখন পৃথিবীর সমুদয় জাতি বিলাপ করিবে, এবং তাহারা মানব-পুত্রকে আকাশের মেঘমালার মধ্যে পরম শক্তি ও বিরাট প্রভায় ভূষিত হইয়া আসিতে দেখিবে।” এই সমুদয় বাক্যের তাৎপর্য এই যে, ঐ সকল দিনে লোকেরা স্বর্গীয় সুষমা-রূপ সূর্যের ও জ্ঞান-রূপ চন্দ্রের এবং স্বর্গীয় বিজ্ঞতা-রূপ তারকারাজির আবির্ভাবের জন্য বিলাপ করিবে। তখন তাহাতে, তাহারা সেই প্রতিশ্রুত মহামানবকে, সেই পূজনীয় সুষমাকে, আকাশ হইতে মেঘমালা-রূপ রথে আরোহণ করিয়া অবতরণ করিতে দেখিতে পাইবে। ইহার অর্থ এই যে, আল্লাহর ইচ্ছা-রূপ আকাশ হইতে স্বর্গীয় সুষমা প্রকটিত হইবেন এবং মানবীয় শরীর ধারণ করিয়া উপস্থিত হইবেন। “আকাশ” শব্দের তাৎপর্য- উচ্চ মর্যাদা ও মাহাত্ম্যের পদ, যেহেতু ইহা ঐ সকল পবিত্র-প্রকাশগণের, শাশ্বত-আভার প্রভাতসমূহের অবতরণের আসন। এই সমুদয় শাশ্বত-সত্তা, যদিও বাহ্যতঃ মাতৃ-জঠর হইতে আবির্ভূত হন, তথাপি প্রকৃতপক্ষে তাঁহারা আল্লাহর পরম আদেশের স্বর্গ হইতে অবতরণ করিয়াছেন। যদিও তাঁহারা এই ধরাপৃষ্ঠে অবস্থিতি করেন, তথাপি তাঁহাদের বাস্তব বাসস্থান উর্দ্ধদেশে-আভা-বিশ্রামাগারের গৌরবময় আসনে। এই পৃথিবীতে নশ্বর মানবের মধ্যে বিচরণকালেও তাঁহারা পরম-সান্নিধ্যের আকাশে উড্ডীয়মান থাকেন। পদ-সঞ্চালন ব্যতীত আত্মার পথে পরিভ্রমণ করেন, এবং পক্ষ বিনা ঐশী-একত্বের মহিমান্বিত উচ্চ শৃঙ্গে আরোহণ করেন। প্রত্যেক দ্রুতগামী নিঃশ্বাসে তাঁহারা অসীম দূরত্ব অতিক্রম করেন এবং প্রত্যেক মূহুর্তে দৃশ্য ও অদৃশ্য রাজ্যসমূহ পরিভ্রমণ করেন। তাঁহাদের সিংহাসনের সম্বন্ধে লিখিত আছেঃ “কোনও কিছুই তাঁহাকে অন্য কোন বিষয়ে লিপ্ত থাকা হইতে বিরত রাখিতে পারে না।” এবং তাঁহাদের আননসমূহের উপর লিখিত আছেঃ “নিশ্চয়ই প্রত্যেক দিনই তিনি নূতন নূতন কার্য সম্পাদন করেন।” ( ক্বোরআন ৫৫। ২৯।) শাশ্বত প্রভূর অত্যুন্নত শক্তির দ্বারাই তাঁহারা প্রেরিত হন, এবং সর্বশক্তিমান সম্রাট, আল্লাহর মহিমান্বিত পরম আদেশেই তাঁহাদের অভ্যুত্থান হইয়া থাকে। ‘আকাশের মেঘমালার রথে আরোহণ করিয়া আসিবার” অর্থ ইহাই।
স্বর্গীয় জ্যোতিসম্পন্ন পুরুষগণের বাণীসমূহে “আকাশ” শব্দটিকে বহু ও বিভিন্ন প্রকার অর্থে প্রয়োগ করা হয়েছে, যথা—“স্বর্গীয় আদেশের আকাশ”, “স্বর্গীয় জ্ঞানের আকাশ”, “স্বর্গীয় অভিপ্রায়ের আকাশ”, “স্বর্গীয় ইচ্ছার আকাশ”, “ স্বর্গীয় নিশ্চয়তার আকাশ”, “স্বর্গীয় বাণী উচ্চারণের আকাশ”, “স্বর্গীয় প্রত্যাদেশ অবতরণের আকাশ”, স্বর্গীয় গুপ্ত রহস্যের আকাশ”, ইত্যাদি। প্রত্যেক স্থানেই, তিনি “আকাশ” শব্দকে একটি বিশেষ অর্থ প্রদান করিয়াছেন, যাহার তাৎপর্য অপর কাহারও নিকট অবতীর্ণ হয় নাই, কেবল উঁহারা ব্যতীত-যাঁহাদিগকে স্বর্গীয় রহস্যাবলীতে দীক্ষিত করা হইয়াছে এবং যাঁহারা কেবল অবিনশ্বর জীবনের পান-পাত্র হইতে পান করিয়াছেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ, তিনি বলিয়াছেন ঃ “আকাশে তোমাদের জন্য উপজীবিকা রহিয়াছে এবং ঐখানে তাহা আছে যাহার প্রতিশ্রুতি তোমাদিগকে দেওয়া হইয়াছে। (ক্বোরআন ৫১।২২)। পক্ষান্তরে, পৃথিবীই ঐরূপ খাদ্য প্রদান করিয়া থাকে। সেইরূপে বলা হইয়াছে : “নামগুলি আকাশ হইতে নিম্নে অবতরণ করে”, অথচ মানুষের মুখ হইতে সে-গুলি বাহির হইয়া থাকে। যদি আপনি আপনার অন্তরের দর্পণ হিংসা-রূপ ধুলি হইতে পরিস্কৃত করিতেন, তবে প্রত্যেক ধর্ম-বিধানে সর্বার্থসূচক ঐশী বাণী দ্বারা প্রকাশিত যে সকল নিদর্শন-প্রকাশক বাক্য অবতীর্ণ হইয়াছে, তৎসমুদয়ের অর্থ হৃদয়ঙ্গম করিতে সক্ষম হইতেন। এবং স্বর্গীয় জ্ঞানের রহস্যাবলী আবিষ্কার করিতে পারিতেন। যাহা হউক, যে পর্যন্ত না আপনি আলস্য-জাল জড়িত বিদ্যার আবরণগুলি—যাহা লোকের মধ্যে প্রচলিত আছে, পূর্ণ মোহ-মুক্তির অগ্নিশিখা দ্বারা ভস্মীভূত করিবেন, সে-পর্যন্ত আপনি সত্য-জ্ঞানের উজ্জ্বল প্রভাত অবলোকন করিতে সক্ষম হইবেন না।
জানিয়া রাখুন যে, বিদ্যা দুই প্রকারের—স্বর্গীয় ও শয়তানী। একটি স্বর্গীয় প্রেরণার উৎস হইতে বহির্গত হয়, অপরটি বৃথা ও অস্পষ্ট ধারণা সমূহের প্রতিবিম্ব মাত্র। প্রথমটির আদি উৎস আল্লাহ্ স্বয়ং, অন্যটির পরিচালনাকারী শক্তি হইতেছে স্বার্থ-প্রণোদিত আকাঙ্খার গুঞ্জন। একটি পরিচালিত হয় এই নীতি দ্বারাঃ “আল্লাহকে ভয় কর, আল্লাহ তোমাকে শিক্ষা দিবেন” অপরটি এই সত্যের যাথার্থ্য প্রমাণ করেঃ “জ্ঞান মানুষ ও তদীয় সৃষ্টিকর্তার মধ্যে একটি অত্যন্ত সাংঘাতিক আবরণ।” পূর্বোক্তটি সহিষ্ণুতা, অত্যুগ্র বাসনা, সত্য-উপলব্ধি ও প্রেমের ফল প্রদান করে; অন্য পক্ষে, পরবর্তীটি ঔদ্ধত্য, বৃথা গর্ব, মিথ্যা আত্মাভিমান ব্যতীত আর কিছুই দিতে পারে না। পবিত্র বাক্যোচ্চারণকারী ঐ সকল স্বর্গীয় শিক্ষাদাতা যাঁহারা সত্য-জ্ঞানের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করিয়াছেন, তাঁহাদের বাক্যাবলী হইতে এই সকল নারকীয় শিক্ষার দুর্গন্ধ, যাহা পৃথিবীকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করিয়াছে, কোনও প্রকারে খুঁজিয়া বাহির করিতে পারা যাইবে না। এইরূপ শিক্ষার বৃক্ষ অবিচার ও বিদ্রোহ ব্যতীত অন্য কোনও ফল প্রদান করে না, এবং হিংসা, দ্বেষ ব্যতীত অন্য কোনও ফল প্রসব করে না। ইহার ফল মারাত্মক বিষ; ইহার ছায়া একটি ভস্মকারী অগ্নি। কত ভাল কথাই-না বলা হইয়াছেঃ “তোমার অন্তরের অভিলাষের পরিচ্ছদ দৃঢ়রূপে ধরিয়া থাক এবং সর্বপ্রকার লজ্জা ত্যাগ কর। সাংসারিক জ্ঞানীগণকে একই কালে পরিত্যাগ কর, তাহাদের নাম ও যশ যত বড়ই হউক না কেন।”
অতএব, নিশ্চয়ই অন্তরকে মানুষের নিরর্থক বাক্যাবলী হইতে পরিস্কৃত করিতে হইবে এবং প্রত্যেক পার্থিব স্নেহ-মমতা হইতে পবিত্র রাখিতে হইবে, যেন ইহা স্বর্গীয় প্রেরণার নিহিত অর্থ আবিষ্কার করিতে পারে, এবং স্বর্গীয় জ্ঞানের রহস্যাবলীর ভান্ডারস্বরূপ হইতে পারে। এইরূপে বলা হইয়াছেঃ “যে-ব্যক্তি বরফ সদৃশ শ্বেত পথে চলে; কিন্তু রক্তলাল স্তম্ভের পদবিক্ষেপ অনুসরণ করে, সে কখনও তাঁহার গন্তব্য স্থানে পৌঁছিতে পারিবে না, যদি না হস্ত মানবের অভীপ্সিত পার্থিব দ্রব্যাদি হইতে বিরত হয়।” যে-কেহ এই পথে চলে, তাহার জন্য ইহা অত্যাবশ্যকীয় প্রাথমিক বিষয়। এই বিষয়ে অনুধাবন করুন, যেন অনাবৃত চক্ষে আপনি এই সকল বাক্যের সত্যতা উপলব্ধি করিতে পারেন।
আমাদের বক্তব্য বিষয়ের প্রকৃত উদ্দেশ্য হইতে আমরা বিষয়ান্তে চলিয়া গিয়াছি, যদিও যাহা উল্লেখ করা হইয়াছে, তাহাতে কেবল আমাদের উদ্দেশ্যই সিদ্ধ হইয়াছে। আল্লাহর শপথ! আমাদের সংক্ষেপ করার ইচ্ছা যত বড়ই হউক না কেন, তত্রাচ আমরা অনুভব করি, আমাদের লেখনী নিরস্ত করিতে পারি না। এই সকল অনেক বিষয় উল্লেখ করা সত্ত্বেও কত অসংখ্য মুক্তা আমাদের অন্তরের আবরণের মধ্যে অভেদ্য রহিয়া গিয়াছে। দিব্য বিজ্ঞতার প্রকোষ্ঠসমূহের অভ্যন্তরে আধ্যাত্মিক তাৎপর্যের কত হূর এখনও পর্যন্ত লুক্কায়িত রহিয়াছে। কেহই এখনও পর্যন্ত তাহাদের নিকটবর্তী হয় নাই : এই সকল হূর “যাহাদিগকে কোন মনুষ্য বা জিন্ন ইতিপূর্বে স্পর্শ করে নাই।” (ক্বোরআন ৫৫।৫৬)। এত সব কিছু বলা সত্ত্বেও বোধ হইতেছে যে, আমাদের উদ্দেশ্যের একটি বর্ণও উচ্চারিত হয় নাই, আমাদের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে একটি মাত্র নিদর্শনও ব্যক্ত করা হয় নাই। এইরূপ বিশ্বস্ত অনুসন্ধানকারী কোথায় পাওয়া যাইবে, যিনি তীর্থযাত্রীদের বেশ পরিহিত হইয়া অন্তরের বাসনার কাবা-তীর্থে পৌঁছিবেন, এবং কর্ণ ও জিহ্বা ব্যতীত স্বর্গীয় উচ্চারিত বাণীর রহস্যাবলী আবিষ্কার করিবেন?
এই সমস্ত উজ্জ্বল, চূড়ান্ত সিদ্ধান্তমূলক ও পরিষ্কার বর্ণনাসমূহের দ্বারা পূর্বোক্ত আয়াতে “আকাশ” শব্দের তাৎপর্য পরিষ্কার ও সুস্পষ্ট করা হইয়াছে। এক্ষণে, তাঁহার এই বাক্য সম্বন্ধে বলা হইতেছে যে মনুষ্য-পুত্র “আকাশের মেঘমালার রথে চড়িয়া আসিবেন।” “ মেঘমালা” শব্দটি মানবের অহং, বুদ্ধি ও আত্মাভিলাষের বিপরীপ বস্তুসমহের অর্থে ব্যবহৃত হইয়াছে। যেমন তিনি পূর্বোল্লিখিত এই আয়াতে বলিয়াছেনঃ “যখন যখনই আল্লাহ্ একজন সংবাদবাহক তোমাদের আত্ম-বাসনার বিপরীত কিছু লইয়া তোমদের নিকট উপস্থিত হন, তখনই তোমরা অহঙ্কারে স্ফীত হও, কাহাকেও প্রতারক বলিয়া অভিযুক্ত কর এবং অপর কাহাকেও হত্যা কর।” (ক্বোরআন ২।২৮)। এক অর্থে এই সকল “মেঘমালার” তাৎপর্য হইতেছে—বিধি-নিষেধ ইত্যাদি আইন-কানুন লোপ করা, পূর্ববর্তী বিধানসমূহ রহিত করা, মানুষের মধ্যে প্রচলিত আচার-অনুষ্ঠানাদি রদ করা, বিশ্বাসী নিরক্ষরগণকে ধর্মবিরোধী শিক্ষিত লোকদের উপর প্রাধান্য দান করা; আর এক অর্থে ইহার তাৎপর্য হইতেছে, নশ্বর মানবাকৃতিতে অবিনশ্বর শাশ্বত সুষমার প্রকাশ, তবে সেই মানবীয় সঙ্কীর্ণতা সহকারে, যেমন পান ও ভোজন, দারিদ্র ও ঐশ্বর্য, গৌরব ও হীনতা, নিদ্রা ও জাগরণ এবং এইরূপ অন্যান্য সবই যাহা লোকের মনে সংশয় উৎপাদন করে এবং তাঁহার নিকট হইতে মুখ ফিরাইয়া লইবার কারণ হয়। এই ধরনের অন্তরালগুলিকে রূপকভাবে “মেঘমালা” নামে অভিহিত করা হইয়াছে।
এই সমস্তই “মেঘমালা”, যাহা পৃথিবীস্থ সকলের জ্ঞান ও উপলব্ধির আকাশসমূহের আবৃত করিয়া রাখে। তিনি যেমন অবতীর্ণ করিয়াছেনঃ “সেইদিন আকাশ মেঘমালা দ্বারা আবৃত হইব।” ( ক্বোরআন ২৫।২৫)। মেঘমালা যেমন প্রাকৃতিক সূর্য-দর্শন কার্যে মানব-চক্ষুর প্রতিবন্ধকতা সৃষ্ট করে, তেমনই এই সমুদয় অবস্থা মানুষর অন্তরাত্মাকে স্বর্গীয় আদর্শ-সূর্যের আলোক চিনিয়া লইতে বাধা প্রদান করিয়া থাকে। অবিশ্বাসীদের মুখ হইতে যাহা বহির্গত হইয়াছে, তাহা ইহার সাক্ষ্য প্রদান করে—যেমন পবিত্র গ্রন্থে অবতীর্ণ হইয়াছেঃ “এবং তাহারা বলিয়াছেঃ ‘ইনি কি প্রকারের প্রেরিত পুরুষ, তিনি আহার করিয়া থাকেন এবং রাস্তায় চলাফেরা করেন ? যদি একজন ফেরেশতা এই পৃথিবীতে প্রেরিত হইয়া তাঁহার এই সাবধান-বাণীতে অংশ গ্রহণ না করে তবে আমরা তাঁহার উপর বিশ্বাস স্থাপন করিব না’। ( ক্বোরআন ২৫।৭)। অন্যান্য পয়গম্বরগণও এইরূপ এই পৃথিবীর দারিদ্রতা, দুঃখ-কষ্ট, ক্ষুধা-তৃষ্ণা, রোগ-ব্যাধি ও দৈব-দুর্ঘটনার অধীন ছিলেন। এই সকল পবিত্র পুরুষ এই সব অভাব ও অনটনের অধীন ছিলেন বলিয়া জনসাধারণ সংশয় ও সন্দেহের জঙ্গলে পথহারা হইত এবং হতবুদ্ধি ও দ্বিধায় বিভক্ত হইয়া কষ্ট পাইত। তাহারা ইহাতে আশ্চর্য বোধ করিত—কিরূপে এইরূপ এক ব্যক্তি আল্লাহর সান্নিধ্য হইতে প্রেরিত হইতে পারে, পৃথিবীর সকল জাতির ও লোকের উপর আধিপত্য দাবি করিতে পারে এবং আপনাকে সমুদয় সৃষ্টির কারণ বলিয়া নির্দেশ করিতে পারে- যেমন তিনি বলিয়াছেন, “ যদি তুমি না হইতে, তবে, আমি আকাশ ও পৃথিবীতে যাহা কিছু আছে তাহার কিছুই সৃষ্টি করিতাম না”, অথচ এইরূপ সামান্য বিষয়ের জন্য উৎপীড়িত হইয়া থাকেন ? আপনি ইহা নিশ্চয়ই শুনিয়া থাকিবেন, আল্লাহ্ প্রত্যেক পয়গম্বর ও তাঁহার সঙ্গিগণ কতই-না দুর্দশা, দারিদ্র, রোগ-শোক ও অপমান সহ্য করিয়াছিলেন। আপনি নিশ্চয়ই শুনিয়া থাকিবেন, তাঁহাদের অনুগামিদের কতই-না মস্তক উপহার স্বরূপ বিভিন্ন নগরে প্রেরিত হইয়াছিল। তাঁহারা তাঁহাদের প্রত্যাদিষ্ট কর্তব্য কার্য সম্পাদনে কতই-না বাধাপ্রাপ্ত হইয়াছিলেন। তাঁহাদের প্রত্যেককেই ধর্মের শত্রুদের হস্তে শিকার-স্বরূপ পতিত হইতে হইয়াছিল এবং তাহাদের ব্যবস্থা-মত তাঁহাদিগকে কষ্ট ভোগ করিতে হইয়াছিল।
ইহা সুস্পষ্ট যে, প্রত্যেক ধর্ম-বিধানে যে সকল পরিবর্তন আনয়ন করা হইয়াছিল, সেইগুলিই কৃষ্ণ মেঘমালা, যাহা মানুষের বোধশক্তি-রূপ চক্ষু ও স্বর্গীয় সারাৎসারের প্রভাত হইতে উদিত ঐশী আদর্শ-সূর্যের মধ্যে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। বিবেচনা করিয়া দেখুন, মানুষ পুরুষানুক্রমে যে অন্ধের ন্যায় তাহাদের পিতৃপুরুষগণের অনুকরণ করিয়া আসিতেছে এবং তাহাদের ধর্মের ব্যবস্থানুসারে যে-সকল রীতি-নীতি প্রচলিত হইয়া আসিয়াছে, যে-সমস্ত বিষয়ে তাহারা শিক্ষা পাইয়া আসিয়াছে। যদি এই সকল লোক হঠাৎ ইহা আবিষ্কার করে যে, এমন একজন লোক তাহাদের মধ্যে বাস করিয়া আসিতেছেন, যিনি প্রত্যেক মানবীয় সীমাবদ্ধতা সম্বন্ধে তাহাদের সমকক্ষ, সে-হেন ব্যক্তি তাহাদের ধর্মে প্রতিষ্ঠিত প্রত্যেকটি রীতি-নীতি রহিত করার জন্য অভ্যুত্থান করিয়াছেন—যে সকল নীতি দ্বারা তাহারা শত শত বৎসর যাবৎ শাসিত হইয়া আসিয়াছে এবং যে-সমস্ত বিষয়ের প্রত্যেক বিরুদ্ধাচারী ও অস্বীকারকারীকে তাহারা অবিশ্বাসী, লম্পট ও দুষ্ট বলিয়া আখ্যা দিয়া আসিয়াছে—তাহারা নিশ্চয়ই তাঁহার সত্যকে স্বীকার করিয়া লইতে অন্তরালবর্তী হইবে ও বাধাপ্রাপ্ত হইবে। যাহাদের অন্তর ত্যাগের সল্সবিল্-উৎসের সুস্বাদু সলিলের স্বাদ পায় নাই এবং ঐশী-জ্ঞানের ‘কাওসর’ ঝর্ণার জলও পান করে নাই, এই সমস্তই “মেঘমালা”-সদৃশ ঐ সকল লোকের চক্ষু পর্দাবৃত করিয়া রাখে। সেইরূপ লোক যখন এই সকল অবস্থা অবগত হয়, তখন তাহারা এইরূপ পর্দাবৃত হয় যে, বিনা দ্বিধায় তাহারা আল্লাহর প্রকাশকে অবিশ্বাসী বলিয়া মত প্রদানে তাঁহাকে মৃত্য-দন্ডাদেশ প্রদান করে, অতীত কালে সকল সময়ে এই প্রকার বহু ঘটনা যে সংঘটিত হইয়াছে, তাহা আপনি অবশ্যই শুনিয়া থাকিবেন এবং এই দিবসসমূহের এই সব দেখিতে পাইতেছেন।
অতএব, আমাদের উচিত অতীব চেষ্টা করা, যেন আল্লাহর অদৃশ্য সাহায্য বলে এই সমস্ত অন্ধকারময় পর্দা, এই সকল ঐশী পরীক্ষা-রূপ মেঘমালা তাঁহার অত্যুজ্জ্বল আনন-সুষমা অবলোকন করার কার্যে আমাদের বাধা প্রদান করিতে না পারে এবং যেন আমরা কেবল তাঁহার নিজ পরিচয় দ্বারাই তাঁহাকে চিনিয়া লইতে পারি। এবং যদি আমরা তাঁহার সত্যতার প্রমাণ চাহি, তবে আমরা কেবল একটি মাত্র প্রমাণেই সন্তুষ্ট থাকিব, যেন তদ্বারা আমরা তাঁহারই নিকট পৌঁছিতে পারি, যিনি অনন্ত করুণার উৎস এবং যাঁহার সকাশে পৃথিবীর যাবতীয় প্রাচুর্য শূন্যে পরিণত হয়; যেন আমরা প্রত্যহ তাঁহার মিথ্যা অপবাদ করা হইতে ক্ষান্ত থাকিতে পারি এবং আমাদের অলস কল্পনাকে জড়াইয়া ধরিয়া থাকা হইতে মুক্ত হইতে পারি।
পরম দয়ালু আল্লাহ্! অতীত কালে আশ্চর্য রকম ভাষায় ও সুক্ষ্ম সংকেত-বাণী দ্বারা সাবধান-বাণী উচ্চারিত হইয়া থাকিলেও এবং তাহাও পৃথিবীর জনগণকে জাগ্রত করিবার জন্য ও তাহাদিগকে আল্লাহর করুণার তরঙ্গায়িত মহাসাগরের নিজ নিজ প্রাপ্য অংশ হইতে বঞ্চিত না হওয়ার জন্য দেওয়া হইয়াছিল, তত্রাচ এইরূপ ঘটনাসমূহ যাহা পূর্বে দৃষ্ট হইয়াছিল,বর্তমান কালেও তাহা ঘটিয়াছে। ক্বোরআনেও এই সকল বিষয় উল্লেখ করা হইয়াছে, যেমন এই আয়াতে দেখিতে পাওয়া যাইবে ঃ “ইহারা এই ব্যতীত আর কিই-বা প্রত্যাশা করিতে পারে যে, আল্লাহ্ মেঘমালার ছায়ার তলে তাহাদের নিকট আসিবেন।” (ক্বোরআন ২।২১০)। কয়েকজন শিক্ষিত ধর্ম-নেতা, যাহারা আল্লাহর বাক্যের আক্ষরিক অর্থ দৃঢ়ভাবে ধরিয়া রহিয়াছে, তাহারা এই আয়াতটিকে তাহাদের অলস মানস কল্পনাপ্রসূত সেই প্রতীক্ষিত নিদর্শনসমূহের একটি নিদর্শন মনে করিয়া রহিয়াছে। যদিও অধিকাংশ স্বর্গীয় গ্রন্থে এই প্রকার বাক্য উল্লিখিত রহিয়াছে এবং ভবিষ্যতে আগমনকারী ঐশী প্রকাশের নিদর্শনসমূহের সহিত সম্পর্কিত বাক্যাবলীতেও উল্লিখিত হইয়াছে।
একই প্রকারে, তিনি বলিলেনঃ “ঐদিন যখন আকাশ স্পষ্ট ধূম্রর উদ্গীরণ করিবে, যাহা মনুষ্য জাতিকে আবৃত করিয়া ফেলিবে, তখন ইহা একটি কষ্টদায়ক যন্ত্রণায় পরিণত হইবে।” ( ক্বোরআন ৪৪।১০)। পরম প্রভাসম্পন্ন প্রভু এই সকল বিষয়েরই আজ্ঞা প্রদান করিয়াছেন, যাহা পাপাত্মাগণের বাসনার বিপরীত, তাহারা যেন এইরূপ কষ্টি-প্রস্তর ও আদর্শ হয়, যাহা দ্বারা তিনি তাঁহার ভৃত্যগণকে যাচাই করিয়া থাকেন, যেন ন্যায়বানকে দুষ্ট প্রকৃতির লোক হইতে, বিশ্বাসীকে অবিশ্বাসী হইতে পৃথক করিতে পারেন। সাদৃশাত্মক “ধূম্র” শব্দের তাৎপর্য হইতেছে গুরুতর বিরোধ, স্বীকৃত মানদ-সমূহ রহিত ও ধ্বংস করা এবং উহাদের সংকীর্ণমনা ব্যাখ্যাদাতাদের আমূল ধ্বংস। বর্তমানে যে-ধূম্র পৃথিবীর সকল লোককে আবৃত করিয়া ফেলিয়াছে, যাহা এখন তাহাদের যন্ত্রণার কারণ হইয়াছে, যাহা হইতে সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা সত্ত্বেও তাহারা তাহাদিগকে মুক্ত করিতে নিরাশভাবে অসমর্থ, তদপেক্ষা কোন্ ধূম্র অধিকতর ঘনীভূত ও দুর্দমনীয় হইতে পারে ? এই অন্তরাগ্নি, যাহা তাহাদের মনের মধ্যে সর্বক্ষণ জ্বলিতেছে, তাহা এরূপ ভয়াবহ যে, বোধ হয় প্রত্যেক মূহুর্তে তাহাদিগকে নূতন নূতন অসহনীয় যন্ত্রণার সম্মুখীন হইতে হইতেছে। যতই অধিক বার তাহাদিগকে এই কথা বলা হউক না কেন যে, আল্লাহরই এই অত্যাশ্চর্য ধর্ম-ব্যবস্থা, মহিমান্বিত প্রভূর এই প্রত্যাদেশ মানব জাতির সকলের নিকট প্রকাশিত হইয়াছে এবং প্রত্যহ দূরতর দেশে প্রসারিত ও অধিকতর শক্তিশালী হইতেছে, ততই প্রচ-ভাবে তাহাদের অন্তরাগ্নির শিখা জ্বলিতে থাকে। আল্লাহর পবিত্র সহচরদের অদমনীয় শক্তি, মহান ত্যাগ ও অটল দৃঢ়তা, যাহা দ্বারা আল্লাহর সহায়তায় তাঁহারা অধিকতর মহিমান্বিত ও মর্যাদাসম্পন্ন হইতেছেন, তাহারা এই সকল যতই অধিক অবলোকন করে ততই তাহাদের অন্তরাত্মা-আলোড়নকারী ভীতি অধিকতর বর্ধিত হয়। আল্লাহ্কে ধন্যবাদ! এই দিবসে তাঁহার বাক্যের শক্তি মানবের উপর এইরূপ প্রাধান্য লাভ করিয়াছে যে, তাহারা কোন কথা উচ্চারণ করিতে সাহস করে না। তাহারা যদি আল্লাহর সহচরদের একজনের সহিত মোকাবেলা করে, যিনি, সাধ্যমত, মুক্তভাবে ও সানন্দে তাঁহার প্রিয়তমের জন্য দশ সহস্র জীবন উৎসর্গ করিতে প্রস্তুত, তখন তাহারা এতই অধিকতর ভীতিপূর্ণ হইবে যে, তাহারা তৎক্ষণাৎ তাহার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করিবে; পক্ষান্তরে, গোপনীয়ভাবে তাহারা তাঁহাকে ভীতি প্রদর্শন করিবে এবং তাঁহার নামে অভিসম্পাত করিবে। যেমন তিনি অবতীর্ণ করিয়াছেনঃ “এবং তাহারা যখন তোমাদের সহিত মিলিত হয়, তখন তাহারা বলে—‘আমরা বিশ্বাস স্থাপন করিয়াছি’; কিন্তু যখন তাহারা পৃথক হয়, তখন তোমাদের প্রতি আক্রোশে দন্ত দ্বারা তাহাদের অঙ্গুলির অগ্রভাগ দংশন করে, তুমি বলঃ ‘তোমরা নিজেদের আক্রোশে মরিয়া যাও; নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ তোমাদের অন্তরের কথাও অবগত আছেন’।” (ক্বোরআন ৩।১১৯)।
অনতিবিলম্বে আপনি সর্ব দেশের সর্বত্র ঐশী শক্তির পতাকাসমূহ উড্ডীন হইতে এবং প্রত্যেক দেশে তাঁহার বিজয়-শক্তি ও আধিপত্যের নিদর্শনসমূহ প্রকাশিত হইতে দেখিতে পাইবেন। যেহেতু অধিকাংশ ধর্ম-নেতা এই সমস্ত আয়াতের অর্থ বুঝিতে অসমর্থ হইয়াছে এবং অভ্যুত্থান দিবসের তাৎপর্য উপলব্ধি করিতে পারে নাই : সুতরাং তাহারা তাহাদের অলস ও ত্রুটিপূর্ণ কল্পনার সাহায্যে নির্বোধ লোকের ন্যায় এই সকল আয়াতের ব্যাখ্যা করিয়াছে। একমাত্র আল্লাহ্ই আমার সাক্ষী। এই দুইটি আয়াতে রূপক ভাষা দ্বারা আমরা যাহা ব্যাখ্যা করিতে মনস্থ করিয়াছি, তাহা হইতে তাহা সংগ্রহ করিতে এবং এই প্রকার সর্বকরুণাময়ের অনুগ্রহে সর্বসুনিশ্চয়তার উজ্জ্বল প্রভাতিক আলোক পাইতে অল্প বোধশক্তিরই প্রয়োজন। স্বর্গীয় গীতির সুরসমূহ এইরূপই, তাহা স্বর্গীয় অমর পক্ষী “বাহা”-রূপ “সিদ্রা”-বৃক্ষের শাখায় গান গাহিয়া আপনার উপর বর্ষণ করিতেছেন, যেন আল্লাহর আদেশক্রমে আপনি স্বর্গীয় জ্ঞান ও বিজ্ঞতার পথে পদবিক্ষেপ করিতে পারেন।
এক্ষণে, তাঁহার (যীশুর) এই বাক্য সম্বন্ধেঃ “এবং তিনি তাঁহার ফেরেশতাগণকে ডাকিয়া পাঠাইবেন . . .” এস্থলে “ফেরেশতা” দের তাৎপর্য হইতেছে ঐ সকল আত্মা, যাঁহারা আধ্যাত্মিক শক্তি বলে বলীয়ান হইয়া স্বর্গীয় প্রেমের অগ্নির দাহনে সমুদয় মানবীয় স্বভাব ও সসীমতা ভস্মীভূত করিয়াছেন এবং অত্যুন্নত পুরুষদের ও ফেরেশতাদের বিশেষণে বিশেষিত হইয়াছেন। এই সেই পুরুষ সাদেক (শীয়া মতালম্বীদের ষষ্ঠ ইমান) তাঁহার ফেরেশতাদের প্রশংসায় বলিয়াছেনঃ “সিংহাসনের পশ্চাতে আমাদের সহধর্মালম্বীদের শীয়াদের একটি দল দন্ডায়মান রহিয়াছে।” “সিংহাসনের পশ্চাতে” শব্দগুলিতে বিভিন্ন প্রকার অনেক তাৎপর্য রহিয়াছে। ইহার একটি অর্থ এই যে, কোনও প্রকৃত বিশ্বাসী শীয়ার অস্তিত্ব নাই। তিনি আর এক স্থানে এইরূপই বলিয়াছেনঃ “একজন সত্য বিশ্বাসীকে ‘দার্শনিকের প্রস্তরের’ সহিত তুলনা করা হয়।” পরে তাঁহার শ্রোতাকে সম্বোধন করিয়া বলিলেনঃ “তুমি কি কখনও দার্শনিকের প্রস্তর দেখিয়াছ ?” বিশেষভাবে চিন্তা করিয়া দেখুন, কিরূপে এইরূপ ভাষা সরল বাক্য অপেক্ষা অধিকতর চিত্তাকর্ষক ভাষায় একজন সত্য-বিশ্বাসীরও অনস্তিত্বের সম্বন্ধে সাক্ষ্য দিতেছে। এইরূপই সাদেকের সাক্ষ্য। এবং এক্ষণে বিবেচনা করুন, উহার কত অন্যায়কারী এবং অসংখ্য, যাহারা, যদিও তাহারা নিজেরা বিশ্বাসের সৌরভের স্বাদ গ্রহণ করিতে অকৃতকার্য হইয়াছে, তথাপি তাহারা ঐ সকল ব্যক্তিকে অবিশ্বাসী বলিয়া সিদ্ধান্ত করিয়াছে—যাহাদের মুখ-নিঃসৃত বাক্য দ্বারা বিশ্বাস স্বয়ং স্বীকৃত ও প্রমাণিত হয়।
এবং এক্ষণে, এই সকল পবিত্র পুরুষ যখন প্রত্যেক মানবীয় সীমাবদ্ধতা হইতে আপনাদিগকে পবিত্র করিয়াছেন, তাঁহারা আধ্যত্মিক পুরুষগণের গুণাবলী দ্বারা বিভূষিত হইয়াছেন, এবং আল্লাহর অনুগৃহীত ও আশীষপ্রাপ্তদের মহৎ গুণাবলী দ্বারা বিভূষিত হইয়াছেন; সুতরাং তাঁহাদিগকে “ ফেরেশতাগণ” এই আখ্যা প্রদান করা হইয়াছে। এই সমুদয় আয়াতের ইহাই অর্থ, যাহার প্রত্যেক বাক্য অত্যন্ত বিশদ মূল বাক্যাবলীর অতীব প্রত্যয়কারী যথার্থ বিতর্ক ও অত্যুৎকৃষ্ট স্বীকৃত প্রমাণাদির সহায়তায় ব্যাখ্যা করা হইয়াছে।
যীশুর অনুসরণকারীগণ যখন এই সমুদয় বাক্যের নিহিত তাৎপর্য কখনও বুঝিতে পারে নাই এবং তাহারা ও তাহাদের ধর্ম-নেতাগণ যেরূপ আশা করিত, তদনুযায়ী এইসব লক্ষণ বাহ্যিকভাবে প্রকাশিত হয় নাই; সুতরাং তাহারা এখনও পর্যন্ত ঐ সমস্ত পূত পবিত্র ঐশী-প্রকাশগণের সত্যতা স্বীকার করিতে অসমর্থ হইয়াছে—যাঁহারা যীশুর পরবর্তীকালে আবির্ভূত হইয়াছেন। এইরূপে তাহারা আল্লাহর পবিত্র অনুগ্রহাদির বর্ষণ ও তাঁহার স্বর্গীয় বাক্যাবলীর অলৌকিক শক্তি হইতে আপনাদিগকে বঞ্চিত করিয়াছে। এই পুনরুত্থানের দিবসে তাহাদের নীচ দৈন্যাবস্থা এই রকমই। এমন কি, তাহারা এই কথা বুঝিতেও পারে নাই যে, প্রত্যেক যুগে যদি ঐশী প্রকাশের আবির্ভাবের লক্ষণাদি যেরূপ প্রমাণিত হাদীস গ্রন্থাদির মূল বাক্যে বর্ণিত আছে, তদনুরূপ প্রত্যক্ষ জগতে প্রকাশিত হইত, তাহা হইলে কেহই আপত্তি বা অস্বীকার করিতে পারিত না; আর পূণ্যবানকে পাপী হইতে ও ধার্মিককে অধার্মিক হইতে কোনও প্রকারে পৃথক করিতে পারা যাইত না। আপনি ন্যায়ভাবে বিচার করুনঃ যদি ইঞ্জিলে লিখিত বর্ণনানুযায়ী ভবিষ্যদ্বাণীসমূহ (অর্থাৎ লক্ষণাদি) বাহ্যিকভাবে প্রকাশ পাইত, এবং যদি মরিয়মের পুত্র যীশু স্বর্গীয় ফেরেশতাগণের সহিত মেঘমালার উপর আরোহণ করিয়া প্রকাশ্য আকাশ হইতে অবতীর্ণ হইতেন, তাহা হইলে কাহার সাধ্য ছিল তাঁহাকে অবিশ্বাস করে, তাঁহার সত্য অগ্রাহ্য করে এবং অবজ্ঞা সহকারে তাঁহাকে প্রত্যাখ্যান করে ? না, বরং ইহাতে পৃথিবীর সকল অধিবাসীর মনে তৎক্ষণাৎ এরূপ আতঙ্ক সৃষ্টি হইয়া যাইত যে, এই সত্য স্বীকার বা অস্বীকার করার কথা দরে থাকুক, কাহারও মুখ হইতে একটি বাক্যও নিঃসৃত হইত না। এই সকল সত্য প্রকৃতভাবে বুঝিয়া লইতে অসমর্থ হওয়ায় অনেক খ্রীস্টান ধর্মাচার্য হজরত মোহাম্মদ (সঃ) সম্বন্ধে আপত্তি উত্থাপন করিয়াছে এবং এইরূপ বাক্য বলিয়াছেঃ “আপনি যদি সত্যই সেই প্রতিশ্রুত পয়গম্বর হন, তাহা হইলে আমাদের পবিত্র গ্রন্থাদিতে উল্লিখিত ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে আপনার সহিত ঐ সকল ফেরেশতা কেন আসে নাই, যাহারা প্রতশ্রুত স্বর্গীয় সুষমাকে তাঁহারই প্রত্যাদিষ্ট কার্যে তাঁহাকে সাহায্য করিতে এবং তাঁহার লোকের নিকট সতর্ককারীস্বরূপ কার্য করিতে অবশ্য অবতীর্ণ হওয়ার কথা?” সর্বপ্রভাসমন্বিত প্রভূ যেমন তাঁহার গ্রন্থে তাহাদের আপত্তির বর্ণনা লিপিবদ্ধ করিয়াছেনঃ “ কেন তাঁহার নিকট একজন ফেরেশতা পাঠান হয় নাই, যাহাতে সেই ফেরেশতা তাঁহার সহিত একজন সতর্ককারী হইতে পারিত ?” (ক্বোরআন ২৫।৭)।
এইরূপ আপত্তি ও মতানৈক্য প্রত্যেক যুগে ও শতাব্দীতে পুনঃ পুনঃ দেখা দিয়াছে। জনসাধারণ সর্বদাই এইরূপ নিরর্থক আপত্তিসূচক সুদীর্ঘ বিতর্কে লিপ্ত রহিয়াছে, “কেন এই লক্ষণ, ঐ লক্ষণ প্রকাশিত হয় নাই ?” এইরূপ তাহাদের উপর ঘটিবার একমাত্র কারণ এই যে, যে-যুগে তাহারা বাস করিত, সেই যুগের ধর্মাচার্যদের কার্যপ্রণালী তাহারা আঁকড়াইয়া ধরিয়া থাকিত এবং এই সকল বস্তুলিপ্সাহীন সারাৎসারকে, এই সকল স্বর্গীয় মহাপুরুষকে গ্রহণ ও প্রত্যাখ্যানের ব্যাপারে তাহারা তাহাদের (ধর্ম-নেতাদের) অন্ধ অনুসরণ করিত। এই সকল ধর্ম-নেতা তাহাদের নিজেদের স্বার্থসমূহে নিমজ্জিত থাকায় এবং ক্ষণস্থায়ী ও নীচ প্রকৃতির কার্যাদির অনুসরণে লিপ্ত থাকায়, এই সকল স্বর্গীয় জ্যোতিসম্পন্ন শিক্ষাদাতাকে তাহাদের জ্ঞান ও উপলব্ধির মাপকাঠিগুলির বিরোধী ও তাহাদের রীতি-নীতি ও বিচার-মীমাংসার শত্রু বলিয়া মনে করিত। যেহেতু তাহারা ঐশী বাণীকে এবং একত্বের অক্ষরসমূহের বাক্যাবলী ও হাদীসসমূহকে আক্ষরিক ভাবে ব্যাখ্যা করিয়াছে, এবং তাহাদের নিজেদের অসম্পূর্ণ বোধশক্তি মতে অর্থ করিয়াছে। সুতরাং তাহারা নিজেদের ও নিজেদের অনুগামী সকল লোককে আল্লাহর অনুগ্রহের ও অনুকম্পার বদান্য বারিবর্ষণ হইতে বঞ্চিত করিয়াছে। তথাপি তাহারা এই বিখ্যাত হাদীসের সত্যতার সাক্ষ্য দান করে ঃ “নিশ্চয়ই আমাদের বাক্য জটিল, বিহ্বলকারীরূপে দুর্বোধ্য।” অন্য এক স্থানে বলা হইয়াছে ঃ “আমাদের প্রত্যাদেশ বেদনাপ্রদভাবে পরীক্ষামূলক, অতীব চিত্তবিহ্বলকারী। স্বর্গের অনুগৃহীত ব্যক্তি বা অনুপ্রেরণা প্রাপ্ত পয়গম্বর, অথবা এইরূপ ব্যক্তি, যাঁহার ধর্ম-বিশ্বাস আল্লাহ্ পরীক্ষা করিয়াছেন, তিনি ব্যতীত আর কেহই ইহার ভার বহন করিতে সক্ষম নহে।” এই সকল ধর্ম-নেতা ইহা স্বীকার করে যে, এই তিনটি বিশেষ অবস্থার কোনওটিই তাহাদের প্রতি প্রযোজ্য নহে। প্রথম দুইটি শর্ত প্রকাশ্যতঃ তাহাদের নাগালের বাহিরে; তৃতীয়টি সম্বন্ধে ইহা সুস্পষ্ট যে, কোনও সময়েই তাহারা এই সমস্ত পরীক্ষা, যাহা আল্লাহ্ কর্তৃক প্রেরিত হইয়াছে, তাহাতে উত্তীর্ণ হয় নাই। এবং যখনই স্বর্গীয় কষ্টি-প্রস্তর প্রকাশিত হইয়াছে, তখনই তাহারা আপনাদিগকে অসার ব্যতীত আর কিছুই প্রমাণিত করিতে পারে নাই।
হে, মহামহিম আল্লাহ্! এই হাদীসের সত্যতা গ্রহণ করা সত্ত্বেও এই সকল ধর্ম-নেতা, যাহারা এখনও পর্যন্ত তাহাদের ধর্মের পরমার্থ বিদ্যা সম্বন্ধীয় অস্পষ্ট বিষয়াদি সম্পর্কে সন্দেহে আচ্ছন্ন এবং বাদানুবাদে মত্ত, তথাপি তাহারা আপনাদিগকে আল্লাহর বিধানের সুক্ষ্মতিসুক্ষ্ম বিষয়াদির ব্যাখ্যাকর্তা এবং তাঁহার পবিত্র বাক্যের অত্যাবশ্যকীয় রহস্যাবলীর তাৎপর্য প্রকাশকারী বলিয়া দাবি করে। তাহারা দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়ের সহিত বলে যে প্রতিশ্রুত ‘কায়েমে’র (ইমাম মেহ্দীর) আবির্ভাব সম্বন্ধে হাদীসসমূহে যে সকল লক্ষণ উল্লিখিত হইয়াছে, সেগুলি এখনও পর্যন্ত সম্পূর্ণ হয় নাই। অথচ তাহারা নিজেরা এই সমস্ত হাদীসের বাণীর অর্থের সৌরভের স্বাদ গ্রহণ করিতে অসমর্থ হইয়াছে। এবং এখনও পর্যন্ত তাহারা ইহা ভুলিয়া রহিয়াছে যে, যে-সমস্ত লক্ষণ সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী করা হইয়াছিল, উহার সমস্তই ঘটিয়া গিয়াছে এবং আল্লাহর পবিত্র প্রত্যাদেশ-রূপ ধর্মে সুপথ অবতীর্ণ হইয়াছে, এবং বিশ্বাসী দল বিদ্যুতের ন্যায় দ্রুতগতিতে এখনও পর্যন্ত সেই ধর্ম-পথ (পুল্-সিরাত) অতিক্রম করিতেছে। পক্ষান্তরে, এই সকল নির্বোধ ধর্ম-নেতা ঐসব লক্ষণ, যাহার সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী করা হইয়াছে, সেইগুলি ভবিষ্যতে সংঘটিত হইতে দেখিতে পাইবে—এই আশায় প্রতীক্ষা করিয়া রহিয়াছে। ‘বলঃ হে মূর্খ লোকগণ! তোমরাও প্রতীক্ষা করিতে থাক, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীরা অপেক্ষা করিতেছে।’
যদি সেই সকল নিদর্শন সম্বন্ধে তাহাদিগকে প্রশ্ন করা হয়—মোহাম্মদীয় ধর্ম-ব্যবস্থার সূর্যের অভ্যুত্থান ও বাণী অবতরণ সম্বন্ধে যে সকল লক্ষণ অগ্রদূতের ন্যায় পূর্বাহ্নে অবশ্য ঘোষণা-বাণী প্রচার করার কথা, যে সম্বন্ধে আমরা ইতিপূর্বে উল্লেখ করিয়াছি, উহাদের মধ্য হইতে একটিমাত্র লক্ষণও এখনও পর্যন্ত আক্ষরিকভাবে পূর্ণ হয় নাই, এবং যদি তাহাদিগকে বলা হয়ঃ “ তোমরা কেন খ্রীস্টান ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী লোকের প্রদত্ত নিদর্শন সম্বন্ধীয় দাবিগুলি প্রত্যাখ্যান করিয়াছ এবং কেন তাহাদিগকে অবিশ্বাসী বলিয়া মনে কর ?” তখন কি প্রত্যুত্তর দিতে হইবে, তাহা না জানায় তাহারা বলিবেঃ “এই গ্রন্থাবলী নষ্ট বা পরিবর্তন করা হইয়াছে, এবং এইগুলি ঐশী গ্রন্থ নহে ও উহা ঐরূপ ছিল না।” ভাবিয়া দেখুনঃ এই আয়াতগুলির বাক্যাবলীই সুস্পষ্টভাবে এই সত্য সম্বন্ধে সাক্ষ্য প্রদান করে যে, এইগুলি আল্লাহরই নিকট হইতে অবতীর্ণ হইয়াছে। ইহার সদৃশ আয়াত ক্বোরআনেও অবতীর্ণ হইয়াছে, যদি আপনি তাহাদের অন্যতম হইতেন, যাহারা বুঝিতে সক্ষম। আমি নিশ্চয় করিয়া বলিতেছি যে, গ্রন্থের মূল বাক্য নষ্ট বা পরিবর্তন করার অর্থ কি, তাহা তাহারা এই যুগের আদি হইতে অন্ত পর্যন্ত বুঝিয়া লইতে সম্পূর্ণরূপে অকৃতকার্য হইয়াছে।
হ্যাঁ, সত্য বটে! মোহাম্মদী ধর্ম-বিধানের সূর্যকে যে-সমস্ত দর্পণ প্রতিফলিত করিয়াছে, তাঁহাদের লেখনী ও উচ্চারিত বাণীসমূহের প্রখ্যাত মহাপুরুষগণ কর্তৃক “পরিবর্তন বা শুদ্ধকরণ,” এবং “ হেয়জন কর্তৃক পরিবর্তন” উল্লেখ করা হইয়াছে; কিন্তু এই সকল উদ্ধৃত বাক্য বিশেষ ঘটনাসমূহকে লক্ষ্য করিয়া বলিয়াছে। উহাদের মধ্যে ইব্নে সূরিয়ার গল্প একটি। যখন খায়বরের অধিবাসীরা মোহাম্মদীয় প্রত্যাদেশের কেন্দ্রীয় শক্তিকে একজন বিবাহিত পুরুষের ও একজন বিবাহিতা স্ত্রীলোকের মধ্যস্থ ব্যভিচার দোষের শাস্তির ব্যবস্থা সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, তখন হজরত মোহাম্মদ (সঃ) বলিয়াছিলেন ঃ “আল্লাহর বিধান হইতেছে প্রস্তর আঘাতে মৃত্যু। তাহাতে তাহারা অস্বীকার করিয়া বলিলঃ “ তৌরিতে এই রকম কোনও আইন অবতীর্ণ হয় নাই।” হজরত মোহাম্মদ (সঃ) উত্তরে বলিলেনঃ “ তোমাদের শিক্ষিত ধর্মগুরুদের মধ্যে কাহাকে তোমরা একজন স্বীকৃত ব্যবস্থা-দাতা ও সত্য সম্বন্ধে নিশ্চিত জ্ঞানসম্পন্ন বলিয়া মনে কর ? তাহারা ইব্নে সূরিয়া সম্বন্ধে একমত হইল। তাহাতে হজরত মোহাম্মদ (সঃ) তাহাকে ডাকাইয়া বলিলেনঃ “আমি তোমাকে আল্লাহর শপথ দিয়া বলিতেছি, যে-আল্লাহ্ তোমাদের জন্য সমুদ্রকে বিভাগ করিয়াছিলেন, তোমাদের উপর স্বর্গ হইতে ‘মান্না’ খাদ্য অবতীর্ণ করিয়াছিলেন, তোমাদিগকে মেঘের ছায়া-দ্বারা আচ্ছাদন করিয়াছিলেন, যিনি তোমাদিগকে ফেরাঊন ও তাহার সম্প্রদায়ের নিকট হইতে উদ্ধার করিয়াছিলেন, এবং সকল মানবের উপর তোমাদিগকে উন্নত করিয়াছিলেন, এক্ষণে আমাদিগকে বল, একজন বিবাহিত পুরুষ এবং একজন বিবাহিতা স্ত্রীলোকের মধ্যস্থ ব্যভিচারের শাস্তি সম্বন্ধে মূসা (আঃ) কি আদেশ দান করিয়াছিলেন ?” সে উত্তর দিলঃ “ হে মোহাম্মদ (সঃ)। প্রস্তরাঘাতে মৃত্যু আইনের ব্যবস্থা।” হজরত মোহাম্মদ (সঃ) উল্লেখ করিলেনঃ “তাহা হইলে ইহুদীদের মধ্যে কেন এই আইন রহিত করা হইল এবং এখন কার্যকরী নহে? সে উত্তরে বলিলঃ “সম্রাট নেবুচাডনেজ্জার (বখ্তনস্সর) জেরুজালেম নগরী অগ্নিতে দগ্ধ করিয়া দিয়াছিল এবং ইহুদীদিগকে মৃত্যুমুখে পতিত করিয়াছিল, তখন মাত্র কয়েকজন ইহুদী জীবিত রহিল। সেই সময়ের ইহুদী ধর্ম-নেতাগণ, জীবিত ইহুদীদের সংখ্যা অতি নগণ্য এবং আমেলে কাইত্দের সংখ্যা অত্যধিক দেখিয়া সকলে সম্মিলিতভাবে পরামর্শ করিয়া এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইল যে, তাহারা যদি তৌরিতের বিধান প্রবর্তন করিতে চাহে, তবে নেবুচাড্নেজ্জারের হস্ত হইতে যাহারা প্রাণ রক্ষা করিয়াছে, তাহদের প্রত্যেককেই তৌরিত গ্রন্থের আদেশ মতে মৃত্যুমুখে পতিত হইতে হইবে। এই সমস্ত বিষয় বিবেচনা করিয়া তাহারা মৃত্যুদন্ড একেবারে রহিত করিয়া দিল। ”ইতিমধ্যে জিব্রাইল এই সমস্ত বাক্য দ্বারা হজরত মোহাম্মদ (সঃ)-র উজ্জ্বল অন্তঃকরণ অনুপ্রাণিত করিয়াছিল: “তাহারা আল্লাহর মূল বাক্য পরিবর্তন করে।” ( ক্বোরআন ৪।৪৫)।
দৃষ্টান্তগুলির মধ্য হইতে এই একটি মাত্র দৃষ্টান্ত বিবেচনার জন্য উপস্থাপিত করা হইয়াছে। বাস্তবিক “গ্রন্থের মূল বাক্য পরিবর্তন করা ” দ্বারা এই অর্থ করা হয় নাই, যাহা এই সকল নির্বোধ ও হীনচেতা ব্যক্তি মনে করিয়াছে, এমন কি, কিছু সংখ্যক লোক বলে যে, ইহুদী ও খ্রীস্টান ধর্ম-নেতারা তাহাদের ধর্ম-গ্রন্থ হইতে ঐ সকল শ্লোক বিলোপ করিয়া দিয়াছে, যাহা হজরত মোহাম্মদ (সঃ)-র মুখশ্রীর উচ্চ ও অত্যধিক প্রশংসা করিয়াছে এবং তদস্থলে বিপরীত শ্লোক সন্নিবিষ্ট করিয়াছে। এই সকল বাক্য সম্পূর্ণ নিরর্থক ও মিথ্যা। যে-ব্যক্তি একটি গ্রন্থে বিশ্বাস স্থাপন করে এবং ইহাকে আল্লাহর নিকট হইতে প্রেরণামূলক বলিয়া মনে করে, সে-ব্যক্তি কি ইহার অঙ্গচ্ছেদ করিতে পারে ? অধিকন্তু, তৌরিত গ্রন্থ পৃথিবীর সকল স্থানে বিস্তৃত হইয়া পড়িয়াছিল এবং কেবলমাত্র মক্কা ও মদিনাতে সীমাবদ্ধ ছিল না, যাহাতে তাহারা গোপনে ইহার মূল বচন নষ্ট ও পরিবর্তন করিতে পারিত। না, তাহা নহে, বরং মূল বাক্য নষ্ট করার অর্থ ইহাই -- যে-কার্যে সকল মুসলমান ধর্ম-নেতা অদ্যকার দিনে প্রবৃত্ত রহিয়াছে, এবং তাহা হইল, তাহাদের অলস কল্পনা ও নিষ্ফল কামনা মতে আল্লাহর পবিত্র গ্রন্থের ব্যাখ্যা প্রদান করা। এবং হজরত মোহাম্মদ (সঃ)-র অভ্যূত্থান কালে, যখন ইহুদীরা তাহাদের নিজেদের কল্পনা মতে তৌরিতের ঐ সকল শ্লোকের ব্যাখ্যা করিয়াছিল, যেগুলি তাঁহার (হজরত মোহাম্মদ (সঃ)-র প্রকাশের সহিত সম্পর্কিত ছিল এবং তাঁহার পবিত্র উচ্চারিত বাণীতে সন্তুষ্ট থাকিতে অসম্মত হইয়াছিল, তখন তাহাদের বিরুদ্ধে “মূল বাক্য পরিবর্তন করার” অনুযোগ দেওয়া হইয়াছিল। সেইরূপে ইহাও পরিষ্কার যে, কিরূপে ক্বোরআন-অনুসরণকারীরা অদ্যকার দিনে প্রকাশিত ঐশী প্রকাশের নিদর্শনাবলী সম্বন্ধে আল্লাহর পবিত্র গ্রন্থ ক্বোরআনের মূল বাক্যসমূহের পরিবর্তন করিয়াছে এবং তাহাদের মনের ভাবপ্রবণতা ও বাসনাদি মতে তাহাদের ব্যাখ্যা প্রদান করিয়াছে।
আর একটি দৃষ্টান্তে তিনি বলেনঃ “তাহাদের মধ্যে একদল আল্লাহর বাণী শ্রবণ করিত এবং তৎপরে উহা হৃদয়ঙ্গম করিবার পর তাহারা উহার পরিবর্তন করিত”। ( ক্বোরআন ২।৭৫)। এই আয়াতটিও দেখাইতেছে যে আল্লাহর বাক্যের অর্থ বিকৃত করা হইয়াছে; ইহা নহে যে, মূল শব্দগুলি বিলোপ করা হ্য়াছে। সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন লোকেরা এই বাক্যের সত্যতা সম্বন্ধে সাক্ষ্য দিবেন।
অন্য এক দৃষ্টান্তে আল্লাহ বলেনঃ “তাহাদের জন্য আক্ষেপ, যাহারা অর্থ বিকৃত করিয়া স্বহস্তে পুস্তক রচনা করে, তৎপর বলে, ‘ইহা আল্লাহর নিকট হইতে’, যেন তাহারা ইহা দ্বারা সামান্য মূল্য লাভ করিতে পারে।” (ক্বোরআন ২।৭৯)। এই আয়াতটি ইহুদী ধর্মের ধর্মোপদেষ্টা ও ধর্ম-নেতাদের সম্বন্ধে অবতীর্ণ হইয়াছিল, এই সকল ধর্ম-নেতা ধনী লোকদের সন্তুষ্ট করিবার জন্য, পার্থিব লাভ অর্জনের জন্য এবং তাহাদের নিজেদের ঈর্ষা ও মিথ্যা-বিশ্বাস প্রকাশ করিবার জন্য অনেকগুলি পুস্তিকা লিখিয়াছিল; তাহাতে তাহারা হজরত মোহাম্মদ (সঃ)-র দাবিকে মিথ্যা প্রমাণ করিয়াছিল, তাহাদের বিতর্কগুলির পোষকতায় তাহারা এইরূপ প্রমাণাদি দিয়াছিল, যাহার উল্লেখ সমীচীন হইবে না এবং তাহারা দাবি করিয়াছিল যে, এই সকল তর্কজাল তৌরিত গ্রন্থের মূল বাক্য হইতে সংগ্রহ করা হইয়াছে।
অদ্যকার দিনেও ঐরূপ দৃষ্ট হইতে পারে। এই যুগের নির্বোধ ধর্মাচার্যদের দ্বারা এই অত্যাশ্চর্য ধর্ম-বিধানের বিরুদ্ধে লিখিত ভীতি-প্রদর্শনাবলী কতই প্রচুর, তাহা বিবেচনা করিয়া দেখুন। তাহাদের কল্পনারাজি কতই নিরর্থক যে, তাহারা মনে করে, এই সমুদয় অপবাদ আল্লাহর পবিত্র গ্রন্থের আয়তসমূহের সাদৃশ্যাত্মক এবং সুবিবেচক লোকদের উচ্চারিত বাক্যাবলীর সহিত সামঞ্জস্য রক্ষাকারী!
আমাদের এই সকল বিষয় বর্ণনা করার উদ্দেশ্য হইল—আপনাকে এই বিষয়ে সাবধান করা যে, যদি তাহারা বলে—ইঞ্জিলের ঐ সমুদয় আয়াত, যাহাতে লক্ষণাদি উল্লিখিত হইয়াছে, যেমন পূর্বে বলা হইয়াছে, সেইগুলির অর্থ বিকৃত করা হইয়াছে, আর তাহারা যদি সেগুলি অগ্রাহ্য করে এবং তৎ পরিবর্তে অন্যান্য আয়াত ও হাদীসের দিকে আকৃষ্ট হয়, তাহা হইলে জানিয়া রাখুন যে, তাহাদের বাক্যগুলি সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং অপবাদ বৈ আর কিছুই নহে। হ্যাঁ, সত্য বটে! “মূল বাক্যের বিকৃতি” যে-অর্থে আমরা পূর্বে উল্লেখ করিয়াছি, কয়েকটি বিশেষ বিশেষ স্থলে তাহা বাস্তবিক ঘটিয়াছে। এই সকলের কতক আমরা উল্লেখ করিয়াছি, যাহাতে প্রত্যেক সুবিবেচক অবলোকনকারীর নিকট ইহা পরিষ্কাররূপে প্রকাশিত হয় যে, কেবল অল্প কয়েকজন অশিক্ষিত পবিত্র মানবকে মানবীয় জ্ঞানের প্রভূত্ব প্রদান করা হইয়াছে, যাহাতে ঈর্ষাপরায়ণ প্রতিদ্বন্দ্বী বলিতে না পারে যে, কোনও এক নির্দিষ্ট আয়াত মূল বাক্যের “বিকৃত অর্থ” প্রকাশ করে, এবং এই কথা ইঙ্গিত না করে যে, আমরা জ্ঞানের অভাবের কারণে এই সকল বিষয়ের উল্লেখ করিয়াছি। অধিকন্তু, অধিকাংশ আয়াত যাহা “মূল বাক্যের বিকৃত অর্থ” প্রকাশ করে, সেইগুলি ইহুদীদের সম্পর্কে অবতীর্ণ করা হইয়াছিল, যদি আপনি ক্বোরআনের বাক্যাদির অবতরণের কারণাদি-রূপ দ্বীপসমূহ অন্বেষণ করিতেন।
পৃথিবীর কতক মূর্খ লোককেও এই কথা বলিতে আমরা শুনিয়াছি যে, স্বর্গীয় ইঞ্জিলের প্রকৃত মূল খ্রীস্টানদের মধ্যে নাই এবং ইহা স্বর্গে উঠিয়া গিয়াছে। ইহা তাহাদের পক্ষে কত বড় সাংঘাতিক ভুল। এই বিষয়ে তাহারা কতই-না ভ্রান্ত যে, এইরূপ বাক্য দ্বারা এক পরম দয়ালু ও অত্যন্ত স্নেহশীল বিধাতার প্রতি কত গুরুতর অবিচার ও নিষ্ঠুরতাই আরোপ করা হয়। যখন যীশুর সুষমার প্রভাতিক সূর্যের আলোক তাঁহার জাতির দৃষ্টি হইতে অন্তর্হিত হইল এবং তিনি চতুর্থ স্বর্গে আরোহণ করিলেন, আল্লাহ্ কি প্রকারে তাঁহার পবিত্র গ্রন্থ, যাহা তাঁহার জাতির মধ্যে তাঁহার অত্যুৎকৃষ্ট সাক্ষ্য, তাহাও অন্তর্হিত করিতে পারেন ? যীশুর প্রভাতিক তারকার সূর্য অস্ত গমনের সময় হইতে মোহাম্মদীয় ধর্ম-বিধান-রূপ সূর্যের উদয়-কাল পর্যন্ত জনগণের নিকট এমন কি-ই বা রাখিয়া যাইতে পারা যাইত যে, তাহারা তাহা আঁকড়াইয়া ধরিয়া থাকিতে পারিত ? কোন্ বিধান তাহাদের স্থিতির কারণ ও পথ-প্রদর্শক হইত ? সেইরূপ লোক সর্বশক্তিমান প্রতিফলদাতা আল্লাহর ক্রোধের শাস্তি-রূপ প্রতিফল ভোগের বলি কি প্রকারে হইতে পারিত ? তাহারা স্বর্গীয় সম্রাটের দন্ডের কশাঘাতে কি প্রকারে দন্ডিত হইতে পারিত ? সর্বোপরি, সেই সর্ব-বদান্যতাপূর্ণ প্রভূর অনুকম্পার প্রবাহ কি প্রকারে স্থগিত রাখিতে পারা যাইত ? তাঁহার সদয় করুণাদির মহাসমুদ্র কি প্রকারে শান্ত করা যাইত ? আল্লাহর সৃষ্ট জীবেরা তাঁহার সম্বন্ধে যে-মিথ্যা কল্পনা করিয়া রহিয়াছে, তাহা হইতে আমরা তাঁহার নিকট আশ্রয় গ্রহণ করি। তিনি তাহাদের বুদ্ধির ধারণা হইতে অতীব উর্দ্ধে!
হে প্রিয় বন্ধু ! এখন যখন আল্লাহর চিরস্থায়ী প্রভাতের আলোক দিকমন্ডল উজ্জ্বল করিতেছে; যখন তাঁহার পবিত্র বাক্যসমূহের উজ্জ্বল আভা, “আল্লাহ্ই নভোমন্ডল ও ভূ-মন্ডলের জ্যোতি” ( ক্বোরআন ২৪। ৩৫), সমস্ত মানব জাতির উপর আলো বিকিরণ করিতেছে; যখন পবিত্র উচ্চারিত বাণী দ্বারা তাঁহার অবতরণ-মন্দিরের অলঙ্ঘনীয়তা ঘোষণা করা হইতেছেঃ “আল্লাহ্ তাঁহার জ্যোতিকে পূর্ণ করিতে ইচ্ছা করিয়াছিলেন। (ক্বোরআন ৯।৩৩); এবং সর্বশক্তিমানের হস্ত-রূপ শক্তি, তাঁহার এই সাক্ষ্য বহন করিয়া “তাঁহারই মুষ্ঠিতে তিনি সকল জিনিষের কর্তৃক ধারণ করেন,” এই বাণী যখন পৃথিবীর সকল জাতির ও সকল মানুষের নিকট প্রসারিত করা হইতেছে, আমাদের উচিত কোমর বাঁধিয়া চেষ্টায় প্রবৃত্ত হওয়া, যাহাতে হয়ত আল্লাহর বদান্যতা ও অনুকম্পা দ্বারা আমরা স্বর্গীয় ধর্ম-নগরে প্রবেশ লাভ করিতে পারিঃ “নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহরই”, এবং আমরা অত্যুন্নত বাসস্থানে স্থায়ীভাবে বাস করিয়া থাকিঃ “এবং তাঁহারই নিকট আমরা প্রত্যাবর্তন করিতে পারি।” ইহা আপনার অবশ্য কর্তব্য যে, আপনি আল্লাহর অনুমতিক্রমে আপনার অন্তর চক্ষুকে পার্থিব দ্রব্যাদি হইতে পরিষ্কৃত করিবেন, যেন আপনি স্বর্গীয় জ্ঞানের অসীমতা উপলব্ধি করিতে পারেন। এবং সত্যকে এইরূপ পরিষ্কার রূপে দেখিতে পান, যেন তাঁহার বাস্তবতা প্রদর্শন করিতে আপনার কোনও প্রমাণের প্রয়োজন না হয় এবং তাঁহার প্রমাণের সাক্ষ্য দিতে যেন অন্য কোন প্রকার প্রমাণের প্রয়োজন না হয়।
হে স্নেহভাজন তত্ত্বানুসন্ধানকারী! আপনি যদি পবিত্র আধ্যাত্মিক রাজ্যে আরোহণ করেন, তাহা হইলে আপনি আল্লাহ্কে সকল দ্রব্যের উপর এরূপভাবে প্রকাশিত ও মহিমামন্ডিত দেখিতে পাইবেন যে, আপনার চক্ষু তাঁহাকে ভিন্ন আর কাহাকেও অবলোকন করিবে না। “আল্লাহ্ একাই ছিলেন, তিনি ব্যতীত আর কেহ ছিল না।” এই পদবী এতই মহান যে, কোনও প্রমাণ ইহার সাক্ষ্য দিতে সক্ষম নহে, কোনও সাক্ষ্যই ইহার সত্যতা সম্বন্ধে যথেষ্ট হইবে না। যদিও আপনি অনুসন্ধান করতঃ সত্যের পবিত্র রাজ্য প্রাপ্ত হন, তবে দেখিতে পাইবেন যে, সকল কিছুই কেবল তাঁহারই পরিচয়ের আলোকে জানা যায়, আর তিনি তাঁহার নিজের মধ্য দিয়াই অতীত কালে সর্বদা পরিচিত হইয়াছেন এবং ভবিষ্যতেও চিরকাল তদ্রুপই পরিচিত হইতে থাকিবেন। এবং আপনি যদি প্রমাণের দেশে বাস করেন, তবে তিনি স্বয়ং যাহা অবতীর্ণ করিয়াছেন, তাহাতেই সন্তুষ্ট থাকুনঃ “তাহাদের জন্য ইহাই কি যথেষ্ট নহে যে, আমি তোমার প্রতি গ্রন্থ অবতীর্ণ করিয়াছি ?” (ক্বোরআন ২৯।৫১)। ইহাই প্রমাণ— যাহা তিনি স্বয়ং আদেশ করিয়াছেন। ইহা অপেক্ষা বৃহত্তর প্রমাণ নাই, ভবিষ্যতেও থাকিবে না ঃ “এই প্রমাণ হইতেছে তাঁহার বাক্য; তিনি স্বয়ং তাঁহার সত্যের প্রমাণ। ”
এবং এক্ষণে, আমরা “বয়ান” গ্রন্থ অনুসরণকারীগণকে, সকল শিক্ষিত ব্যক্তিকে, জ্ঞানী পন্ডিত লোককে, ধর্মচার্যগণকে এবং তাহাদের মধ্যস্থ সাক্ষীগণকে মিনতি সহকারে বলিতেছি, যেন তাহাদের স্বর্গীয় গ্রন্থে ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে যে-সকল আশা ও উপদেশ অবতীর্ণ করা হইয়াছে, তাহা যেন তাহারা না ভুলে। তাহাদের উচিত সকল সময় যেন তাঁহার ধর্মের মূল শিক্ষাগুলির উপর তাহাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখে, পাছে যেন তিনি, যিনি সত্যের সারাৎসার, সকল দ্রব্যের মধ্যস্থিত প্রকৃত সত্য, সকল আলোকের উৎস, প্রকাশিত হন, তখন যেন তাহারা গ্রন্থের কতক বাক্যাংশ আঁকড়াইয়া ধরিয়া না থাকে এবং তাঁহার উপর ঐরূপ কষ্ট নিপাতিত না করে, যাহা ক্বোরআন মজিদের ধর্ম-বিধান কালে নিপাতিত করা হইয়াছিল। কারণ, নিশ্চয়ই তিনি শক্তিশালী, তিনি স্বর্গীয় শক্তির সম্রাট, তাঁহার অত্যাশ্চর্য বাক্যাবলীর একটি মাত্র বর্ণ দ্বারা সমস্ত ‘বয়ান’-গ্রন্থের ও উহার অনুসরণকারীদের প্রাণ-বায়ু নির্বাপিত করিতে সক্ষম এবং একটি মাত্র বর্ণ দ্বারা তাহাদের উপর নূতন ও চিরস্থায়ী জীবন দান করিতে পারেন, এবং তাহাদিগকে তাহাদের নিরর্থক ও স্বার্থপর বাসনাসমূহের সমাধি হইতে উত্থিত করিতে এবং দ্রুততর বাহির করিয়া লইয়া আসিতে সক্ষম। মনোযোগ দিন এবং সতর্ক হউন; এবং স্মরণ রাখিবেন যে, তাঁহার প্রতি বিশ্বাস স্থাপনে, তাঁহার এই মহা দিবসকে চিনিতে সমর্থ হওয়ায় এবং তাঁহার স্বর্গীয় উপস্থিতির পরিচয় লাভ করাতেই সকল জিনিসের পূর্ণতা প্রাপ্তি ঘটে। “পূর্ব বা পশ্চিম দিকে তোমাদের মুখম-ল প্রত্যাবর্তিত করায় তোমাদের কোনও পূণ্য নাই : কিন্তু সেই পূণ্যবান, যে আল্লাহর প্রতি এবং শেষ দিনের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে।” (ক্বোরআন ২।১৭৬)। সত্যের প্রতি কর্ণপাত কর, হে ‘বয়ান’ গ্রন্থের অনুসরণকারী লোকগণ, যে সম্বন্ধে আমরা তোমাদিগকে উপদেশ দান করিয়াছি, যেন, আল্লাহর দিনে, সকল মানব জাতির উপর যে ছায়া প্রসারিত করা হইয়াছে, হয়ত তোমরা সেই ছায়ায় আশ্রয় অনুসন্ধান করিতে পার।
প্রথম ভাগ সমাপ্ত
কিতাবে ঈক্বান
বাহা‘উ’ল্লাহ্ কর্তৃক অবতারিত
যদিও পৃথিবীতে এমন কোন মানুষ পাওয়া যায় না, যে তাঁহার আজ্ঞা পালন করে, তথাপি, নিশ্চয়ই, যিনি সত্যের প্রভাতিক তারকা এবং পরম সত্তার প্রকাশক, তিনি সর্বকালে, স্বর্গে ও মর্ত্যে যাহাকিছু আছে, সকলেরই উপর অবিসম্বাদিত আধিপত্যের অধিকারী, যদিও তিনি সম্পূর্ণরূপে কপর্দকহীন, তিনি প্রকৃতপক্ষে সর্বপ্রকার পার্থিব অধীনতা হইতে মুক্ত ও উহারা বহু উর্দ্ধে অবস্থিত। এইরূপে আমরা আপনার নিকট আল্লাহর ধর্মের রহস্যাবলী প্রকাশ করিতেছি এবং আপনাকে স্বর্গীয় জ্ঞান-বিজ্ঞতার মুক্তাবলী প্রদান করিতেছি, যাহাতে হয়ত, সর্বস্বত্যাগের পক্ষ সহকারে ঐ সকল উন্নত স্থান যাহা মানব-চক্ষুর অন্তরালে রহিয়াছে, আপনি তাহার দিকে উড্ডীন করিতে পারেন।
এই সমুদয় বাক্যের তাৎপর্য ও প্রকৃত উদ্দেশ্য হইতেছে, পবিত্র অন্তর ও পরিশুদ্ধ আত্মাবিশিষ্ট লোকের নিকট ইহা প্রকাশ করা ও প্রমাণ করার জন্য যে, যাঁহারা সত্যের জ্যোতিষ্কম-লী ও স্বর্গীয় একত্বের আলোক প্রতিফলনকারী দর্পণ, তাঁহারা মানুষের আত্মাকে শিক্ষিত করিবার জন্য এবং সমুদয় সৃষ্ট বস্তুকে অনুগ্রহ দান করিবার জন্য তাঁহাদের অনাদি-অনন্ত আভা রাজ্যের, অদৃশ্য বাসস্থানসমূহ হইতে, যে-যুগে ও যে-কালে, এই পৃথিবীতে প্রেরিত হউন না কেন, সাধারণতঃ নিত্যরূপে অপ্রতিহত ক্ষমতা সহকারে এবং অপরাজেয় পূর্ণ আধিপত্যে বিভূষিত হইয়াই আবির্ভূত হইয়া থাকেন। কারণ এই সকল নিহিত মুক্তা, এই সকল গোপনীয় ও অদৃশ্য ধন-ভান্ডার নিজেরাই স্বয়ং এই সমস্ত পবিত্র বাক্যের বাস্তব সত্য প্রকাশ ও প্রমাণ করে ঃ “নিশ্চয়ই আল্লাহ্ যাহা ইচ্ছা করেন, তাহা তিনি করিয়া থাকেন এবং যাহা হওয়া পছন্দ করে, তাহা তিনি আদেশ করেন।”
প্রত্যেক সুবিচারসম্পন্ন ও জ্ঞানালোকিত অন্তরবিশিষ্ট ব্যক্তির নিকট ইহা সুস্পষ্ট যে, আল্লাহ্ সেই অজ্ঞেয় সারাৎসার, সেই স্বর্গীয় সত্তা, প্রত্যেক মানবীয় গুণ, যথা দৈহিক সত্তা, আরোহণ, অবরোহণ, বহির্গমন ও প্রত্যাবর্তন হইতে অপরিমিতরূপে মহিমান্বিত। তাঁহার প্রভার মহিমা ইহা হইতে এত অধিক যে, মানুষের ভাষা যথোপযুক্তরূপে তাঁহার প্রশংসা কীর্তন অথবা মানুষের অন্তর তাঁহার অতলস্পর্শী রহস্য উপলব্ধি করিতে অসমর্থ। তিনি তাঁহার শাশ্বত অনন্ত সত্তায় অন্তরালবর্তী হইয়া আছেন এবং ছিলেন, এবং তাঁহার বাস্তব সত্তায় চিরকাল মানুষের দৃষ্টি হইতে অদৃশ্য থাকিবেন। “মানবের দৃষ্টিশক্তি তাঁহার মহিমা অবধারণ (উপলব্ধি) করিতে অক্ষম; কিন্তু তিনি সকলকেই অবলোকন করিয়া থাকেন, তিনি অক্যন্ত সূক্ষ্মদর্শী ও সর্বজ্ঞ।” (ক্বোরআন ৬।১০৩)। তিনি কোনও সুস্পষ্ট সম্পর্ক-বন্ধনে তাঁহার সৃষ্ট জীবের সহিত আবদ্ধ থাকিতে পারেন না। তিনি সর্বপ্রকার বিচ্ছেদ ও মিলন, সর্বপ্রকার নৈকট্য ও দূরত্বের অতি দূরে, উর্দ্ধে উন্নীত। কোনও প্রকার লক্ষণ তাঁহার উপস্থিতি ও অনুপস্থিতি প্রদর্শন করিতে সক্ষম নহে; কারণ তাঁহার একটিমাত্র আদেশ-বাক্যেই স্বর্গ-মর্ত্যস্থ সকলই অস্তিত্ব লাভ করিয়াছে এবং তাঁহারই ইচ্ছা-শক্তি, যাহা তাঁহারই অনাদি-অনন্ত শাশ্বত ইচ্ছা-শক্তি তাহার সাহায্যে সমস্ত-কিছুই সম্পূর্ণ অনস্তিত্ব হইতে সত্তা-জগতে, এই দৃশ্য-জগতে বহির্গত হইয়া আসিয়াছে।
পরম দয়াশীল আল্লাহ্! তাঁহার আদেশ-বাক্য এবং যাহা কিছু তদ্দদ্বরা সৃষ্টি হইয়াছে, এই উভয়ের মধ্যে কি প্রকারে সম্পর্ক বা সম্ভাব্য সম্বন্ধ বিদ্যমান থাকিতে পারে ? “আল্লাহ্ তোমাদিগকে তাঁহার সম্বন্ধে সাবধান করিতেছেন,” এই আয়াত অভ্রান্তরূপে আমাদের যুক্তির বাস্তবতা সম্বন্ধে সাক্ষ্য প্রদান করিতেছে এবং “আল্লাহ্ একাকী ছিলেন; তিনি ব্যতীত আর কেহ ছিল না”, এই বাক্যগুলি উহার সত্যতার একটি নিশ্চিত সাক্ষ্য। আল্লাহর সকল পয়গম্বর এবং তাঁহাদের মনোনীত ব্যক্তিগণ, সকল যুগের যাবতীয় ধর্মাচার্য, সাধু-সন্ত-পন্ডিত ও জ্ঞানী লোক, সকলেই একমতালম্বী হইয়া সেই সর্বসত্যের সারাৎসারের স্বরূপ উপলব্ধি করণে তাঁহাদের অক্ষমতা স্বীকার করেন, এবং যিনি সকল-কিছুর আভ্যন্তরীণ বাস্তব সত্তা, তাঁহারা তাঁহাতে জানিতে বা বুঝিতে পারার অসমর্থতা প্রকাশ করেন।
সেই অনাদি-অনন্ত শাশ্বত সত্তার উপলব্ধি সম্বন্ধে জ্ঞানের দ্বার এইরূপে সকলের সম্মুখে অবরুদ্ধ হইয়া যাওয়ায়, সেই অনন্ত করুণার উৎস, তাঁহারই বাক্যানুসারেঃ “তাঁহার অনুকম্পা সকলকেই অতিক্রম করিয়াছে; আমার করুণা তাহাদের সকলকেই পরিবেষ্টন করিয়া রহিয়াছে,” এই সকল পবিত্রতার উজ্জ্বল রত্নাবলীকে পরমাত্মার রাজ্য হইতে মানবীয় দেহরূপ সুমহান আকৃতিতে অবতীর্ণ করিয়াছেন এবং তাঁহাদিগকে সকল মানবের নিকট প্রকাশিত করিয়াছেন, যাহাতে তাঁহারা সেই অপরিবর্তনশীল শাশ্বত সত্তার রহস্যাবলী জগতের মনুষ্যগণকে দান করিতে পারেন এবং তাঁহার অবিনশ্বর সত্তার সূক্ষ্মতম রহস্যাবলী বর্ণনা করিতে পারেন। এই সকল পূত-পবিত্র দর্পণ, এই সকল অনাদি-অনন্ত শাশ্বত বিভূতির প্রভাতিক সূর্য প্রত্যেকেই এই ধরাপৃষ্ঠে তাঁহারই প্রকাশকারী, যিনি এই বিশ্ব-ব্রহ্মান্ডের মধ্যমণি, ইহার সারাৎসার এবং চরম ও পরম লক্ষ্য। তাঁহারই নিকট হইতে তাঁহাদের জ্ঞান ও শক্তি আসিয়া থাকে; তাঁহারই নিকট হইতে তাঁহাদের আধিপত্যের উদ্ভব হইয়া থাকে। তাঁহাদের আনন-সুষমা তাঁহারই প্রতিকৃতির একটি প্রতিফলিত প্রতিবিম্ব মাত্র এবং তাঁহাদের আবির্ভাব তাঁহার অমর প্রভার একটি নিদর্শন বৈ নহে। তাঁহারা স্বর্গীয় জ্ঞানের ভান্ডার এবং দিব্য বিজ্ঞতার পাত্রাবলী। তাঁহাদেরই মাধ্যমে এমন একটি করুণার ধারা প্রবাহিত করা হয় যাহা অনন্ত, অসীম এবং তাঁহাদেরই মধ্য দিয়া এইরূপ আলোক প্রকাশিত হয়, যাহা চির অক্ষয়। এমন কি, তিনি বলিয়াছেনঃ তোমার এবং তাঁহাদের মধ্যে কোন পার্থক্য নাই; তবে তাহারা “ তোমারই সেবক এবং তোমারই সৃষ্ট।” ইহা হজরত মোহাম্মদ (সঃ)-র এই হাদীসের তাৎপর্যঃ “আমিই তিনি, স্বয়ং, এবং তিনিই আমি, স্বয়ং।”
যে সকল হাদীস ও বিবরণ আমাদের এই আলোচ্য বিষয়ের সহিত সঠিকভাবে সম্পর্কিত, সেইগুলি বিভিন্ন ও বহু প্রকারের; সংক্ষিপ্ত বর্ণনার জন্য আমরা সেইগুলি আবৃত্তি করা হইতে নিবৃত্ত রহিলাম। না, তাহা নহে; আকাশম-লে ও ভূম-লে যাহা-কিছু আছে, তাহা ইহার মধ্যস্থিত আল্লাহর নামাবলী ও গুণাবলী প্রকাশের একটি সঠিক সাক্ষ্য, কারণ প্রত্যেকটি পরমাণুর মধ্যে এইরূপ লক্ষণসমূহ সুরক্ষিত আছে, যাহা সেই মহা মহীয়ান স্বর্গীয় আলোকের প্রকাশের বাগ্মিতাপূর্ণ সাক্ষ্য প্রদান করে। আমার বিশ্বাস, সেই প্রকাশের শক্তি ব্যতীত কোনও জীব কখনও অস্তিত্ব লাভ করিতে পারিত না। একটি পরমাণুর মধ্যে জ্ঞানের যে-সমস্ত জ্যোতি কিরণ প্রদান করে, তাহারা কতই উজ্জ্বল এবং একটি জলবিন্দুর মধ্যে বিজ্ঞতার মহাসাগরসমূহ যে-তরঙ্গ উদ্বেলিত করে, তাহা কতই সুদূর বিস্তৃত! মহৎ রূপে মানুষের সম্পর্কে ইহা সত্য, কারণ সকল সৃষ্ট জীবের মধ্যে তাহাকেই এইরূপ দানসমূহের পরিচ্ছদে বিভূষিত করা হইয়াছে এবং এইরূপ পার্থক্য প্রদর্শনকারী শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদার জন্য তাহাকেই মনোনীত করা হইয়াছে। কারণ তাহারই মধ্যে আল্লাহর নামাবলী ও গুণাবলী এইরূপ সম্ভাবনা সূচকভাবে এত পরিমাণে অবতীর্ণ করা হইয়াছে যে, অন্য কোনও সৃষ্ট জীব শ্রেষ্ঠতায় তাহাকে অতিক্রম করে নাই বা তাহার অগ্রবর্তী হয় নাই। এই নামাবলী ও গুণাবলীর সবই তাহারই প্রতি প্রযোজ্য। এমনকি তিনি বলিয়াছেনঃ “মানুষ আমার রহস্য এবং আমি তাহার রহস্য।” এই অতীব সূক্ষ্মতম আলোচ্য প্রসঙ্গ প্রকাশ করিয়া সকল স্বর্গীয় গ্রন্থে ও পবিত্র ধর্ম-শাস্ত্রসমূহে বার বার অনেক আয়াত অবতীর্ণ করা হইয়াছে। তিনি অবতীর্ণ করিয়াছেনঃ “নিশ্চয়ই আমরা তাহাদিগকে এই পৃথিবীতে এবং তাহাদের নিজেদের মধ্যে আমাদের নিদর্শনাবলী প্রদর্শন করিব।” (ক্বোরআন ৪১।৫৩)। পুনঃ তিনি বলেনঃ “এবং তোমাদের নিজেদের মধ্যেও, তবুও কি তোমরা আল্লাহর নিদর্শাবলী দেখিবে না ?” (ক্বোরআন ৫১।২১)। এবং তিনি পুনঃ অবতীর্ণ করেনঃ “এবং তোমরা উহাদের মত হইও না, যাহারা আল্লাহ্কে বিস্মৃত হয়, এবং অতঃপর যাহাদিগকে আল্লাহ্ তাহাদের নিজেদের সম্বন্ধে বিভ্রান্ত করিয়া দিয়াছেন।” (ক্বোরআন ৫৯।১৯)। এই সম্পর্কে তিনি হজরত ইমাম আলী (রাঃ), যিনি চির-সম্রাট—যাহারা আধ্যাত্মিক মন্দিরে অবস্থান করে, তাহাদের সকলের পবিত্র আত্মা তাঁহার জন্য উৎসর্গীকৃত হউক—বলিয়াছেনঃ “সেই ব্যক্তিই আল্লাহ্কে জানিয়াছে, যে নিজেকে জানিয়াছে।”
হে শ্রদ্ধেয় ও সম্মানিত বন্ধু! আল্লাহর শপথ করিয়া বলিতেছি, যদি আপনি এই সকল বাক্য আপনার অন্তরে গভীরভাবে চিন্তা করিয়া দেখেন, তাহা হইলে আপনি নিশ্চয়ই স্বর্গীয় বিজ্ঞতা ও অনন্ত জ্ঞানের দ্বারসমূহ আপনার সম্মুখে উন্মুক্ত দেখিতে পাইবেন।
যাহা বলা হইয়াছে, তাহা হইতে ইহা সুস্পষ্ট হয় যে, সকল বস্তু উহাদের আভ্যন্তরীণ বাস্তবতায় উহাদের মধ্যস্থিত আল্লাহর নামাবলী ও গুণাবলী প্রকাশেরই সাক্ষ্য প্রদান করে। প্রত্যেকে তাহার সাধ্যানুসারে আল্লাহর জ্ঞানই প্রদর্শন ও প্রকাশ করে। এই প্রকাশ এইরূপ শক্তিশালী ও সার্বজনীন যে, ইহা সমস্ত দৃশ্য ও অদৃশ্য বস্তুকে পরিবেষ্টন করিয়া রহিয়াছে। তিনি অবতীর্ণ করিয়াছেনঃ “তুমি ব্যতীত আর কাহারও কি এরূপ প্রকাশের শক্তি আছে, যে-শক্তির অধীশ্বর তুমি নহ, উহা কি তোমাকে প্রকাশ করিতে পারিত ? সেই চক্ষু অন্ধ, যাহা তোমাকে দেখিতে পায় না।” এই প্রকারে, চিরস্থায়ী সম্রাট (হজরত ইমাম আলী (রাঃ) বলিয়াছেনঃ “আমি এমন কিছুই দেখি নাই যাহার মধ্যে, যাহার সম্মুখে ও যাহার পশ্চাতে আমি আল্লাহ্কে দেখি নাই।” এতদ্ব্যতীত কোমায়লের হাদীসে লিখিত আছেঃ “দেখ, অনন্তকালের প্রভাত হইতে একটি আলোক প্রজ্জ্বলিত হইয়া আসিয়াছে, এবং দেখ, ইহার তরঙ্গসমূহ সকল মানবের আভ্যন্তরীণ বস্তুসত্তায় প্রবেশ লাভ করিয়াছে।” যে-মানব সমস্ত সৃষ্ট জীবের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম ও সম্পূর্ণতম, সে এই প্রকাশের আতিশয্যে সকলকে অতিক্রম করে এবং সে ইহার প্রভার একটি অপেক্ষাকৃত পূর্ণতর প্রকাশ। এবং সকল মানবের মধ্যে ঐশী সত্য সূর্যের প্রকাশগণই সর্বাপেক্ষা কৃতবিদ্য, সর্বাপেক্ষা খ্যাতনামা ও সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। শুধু ইহাই নহে, বরং এই সকল আর সকলে তাঁহাদেরই ইচ্ছাশক্তির কার্যকারিতায় জীবন ধারণ করে এবং তাঁহাদের অনুকম্পার বর্ষণের মাধ্যমেই তাঁহাদের গতিবিধি ও সত্তা নির্ভরশীল। “তুমি না হইলে আমি নভোম-ল সৃষ্টি করিতাম না।” না, শুধু ইহাই নহে, বরং তাঁহাদের পবিত্র উপস্থিতি সম্মুখে সকলেই শূণ্যে পরিণত হয় এবং বিস্মৃতির গর্ভে বিলীন হয়। মানুষের ভাষা কখনও যথোপযুক্তভাবে তাঁহাদের প্রশংসা-গীতি গান করিতে পারে না এবং মানুষের বাক্য কখনও তাঁহাদের রহস্য প্রকাশ করিতে পারে না। পবিত্রতার এই সকল মন্দির, এই সকল শাশ্বত দর্পণ, যাহা চির অম্লান প্রভার আলোক প্রতিফলিত করে, তাঁহারা তাঁহারই প্রকাশসমূহ, যিনি অদৃশ্যাবলীরও অদৃশ্য। এই সকল স্বর্গীয় রতেœর প্রকাশ দ্বারা আল্লাহর নামাবলী ও গুণাবলী, যথা জ্ঞান ও শক্তি, আধিপত্য ও প্রাধান্য, করুণা ও বিজ্ঞতা, বিভূতি, বদান্যতা ও অনুকম্পা প্রকাশিত হয়।
আল্লাহর এই সকল গুণ যে কেবল বিশেষ বিশেষ কয়েকজন পয়গম্বরকেই প্রদান করা হইয়াছে এবং অন্য সকলকে তাহা হইতে বঞ্চিত করা হইয়াছে, এমন নহে, এবং কখনও এমন করা হয় নাই। শুধু ইহাই নহে, বরং আল্লাহর সকল পয়গম্বর, ব্যতিক্রমহীন রূপে বিশেষভাবে তাঁহার অনুগৃহীত, তাঁহার পবিত্র ও মনোনীত রসুল, সকলেই তাঁহার নামাবলীর বাহক ও তাঁহার গুণাবলীর বাহক। তাঁহারা কেবল তাঁহাদের প্রকাশের আতিশয্যেই এবং তাঁহাদের আলোকের আপেক্ষিক শক্তিতেই বিভিন্ন। যেমন তিনি অবতীর্ণ করিয়াছেনঃ “কতিপয় রসুলকে আমরা অপর কতিপয়ের উপর শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করিয়াছি।” (ক্বোরআন ২। ২৫৩)। অতএব, ইহা সুপ্রকাশিত ও সুষ্পষ্ট যে, আল্লাহর এই সকল পয়গম্বর ও মনোনীত পুরুষগণের দেহ-মন্দিরসমূহে আল্লাহর অনন্ত নামাবলী ও অত্যুন্নত গুণাবলী প্রতিফলিত হইয়াছে—যদিও এই গুণাবলীর কিছু আলোক এই সকল উজ্জ্বল মন্দির হইতে লোকের চক্ষে বাহ্যতঃ প্রকাশিত না-ও হইতে পারে। আল্লাহর কোনও একটি গুণ এই সকল প্রকৃত বৈরাগ্যের সারবত্তা হইতে বাহ্যতঃ প্রকাশিত না হইলেও, ইহাতে কখনও বুঝায় না যে, তাঁহারা—যাঁহারা আল্লাহর গুণাবলীর প্রভাতিক সূর্য এবং তাঁহার পবিত্র নামাবলীর ভান্ডার, বাস্তবিকপক্ষে এই সকলের অধিকারী ছিলেন না। সুতরাং, এই সকল আলোকিত আত্মা, এই সকল সুষমাসম্পন্ন আনন, প্রত্যেকেই আল্লাহর যাবতীয় গুণাবলী দ্বারা বিভূষিত হইয়াছেন, যথা, আধিপত্য, কর্তৃত্ব এবং এই প্রকারের অন্যান্য গুণ—যদিও বাহ্য দৃষ্টিতে তাঁহারা সকল প্রকার পার্থিব মহিমা হইতে বঞ্চিত। প্রত্যেক দৃষ্টিসম্পন্ন লোকের নিকট ইহা সুস্পষ্ট ও সুপ্রকাশিত, ইহার কোনও প্রমাণ বা সাক্ষের প্রয়োজন হয় না।
সত্য বটে, যেহেতু পৃথিবীর মনুষ্যগণ স্বর্গীয় জ্ঞানের উজ্জ্বল ও স্বচ্ছ উৎসসমূহ হইতে আল্লাহর পবিত্র বাক্যাবলীর নিগূঢ় অর্থ অনুসন্ধান করিতে অকৃতকার্য হইয়াছে; সুতরাং তাহারা অলস কল্পনা ও অবাধ্যতার উপত্যকায় আহত ও তৃষ্ণার্ত অবস্থায় অবসন্ন দেহে পড়িয়া রহিয়াছে। তাহারা বিশুদ্ধ ও তৃষ্ণা নিবারণকারী স্রোতস্বতীসমূহের সলিল হইতে অনেক দূরে চলিয়া গিয়াছে এবং লবনাক্ত সলিলে—যাহা তাহাদিগকে যন্ত্রণাপ্রদভাবে দগ্ধ করিতেছে, তাহার চতুর্দিক পরিবেষ্টন করিয়া রহিয়াছে। তাহাদের সম্বন্ধে চিরস্থায়ী কপোত বলিয়াছেঃ “যদি তাহারা ন্যায়ের পথ নিরীক্ষণ করে, তাহা হইলেও তাহারা উহাকে তাহাদের পথ বলিয়া গ্রহণ করিবে না, এবং যদি তাহারা ভ্রান্ত পথ অবলোকন করে, তবে তাহারা সেই পথই অবলম্বন করিবে, ইহার কারণ এই যে, তাহারা আমাদের নিদর্শনাবলীকে অবিশ্বাস করিয়াছে এবং তাহারা উহাদের প্রতি অমনোযোগী।” (ক্বোরআন ৭।১৪৫)।
এই অত্যাশ্চর্য ও অত্যুন্নত ধর্ম-বিধানে যাহা দৃষ্ট হইয়াছে, তাহা এই বিষয়ে সাক্ষ্য প্রদান করিতেছে। শক্তি ও অনুকম্পার স্বর্গ হইতে অসংখ্য পবিত্র আয়াত অবতীর্ণ হইয়াছে, তত্রাচ কেহই সেদিকে মন দেয় নাই এবং সাধারণ মনুষ্য-কথিত ঐ সমুদয় বাক্যকে আঁকড়াইয়া ধরিয়া থাকা হইতে ক্ষান্ত হয় নাই, যদিও তাহারা, যাঁহারা ঐ সকল বাক্য বলিয়াছেন, তাঁহাদের বাক্যের একটি বর্ণও বুঝিতে সক্ষম নহে। এই কারণে জনগণ এইরূপ অবিসম্বাদিত সত্যের প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করিয়াছে এবং আপনাদিগকে স্বর্গীয় ‘রেজওয়ান’-উদ্যান হইতে ও দিব্য বিজ্ঞতার চিরস্থায়ী সবুজ ময়দান হইতে বঞ্চিত করিয়াছে।
এক্ষণে এই প্রশ্ন সম্বন্ধে আমাদের বক্তব্য পুনঃ আরম্ভ করা হইতেছেঃ যাহা লিপিবদ্ধ হাদীসসমূহের মূল বাক্যসমূহে প্রমাণিত বাক্যরূপে গৃহীত হইয়াছে এবং যাহা মোহাম্মদীয় ধর্ম-বিধানের উজ্জ্বল নক্ষত্রাবলী দ্বারা বর্তমান সময় পর্যন্ত শুদ্ধ বলিয়া গৃহীত হইয়া ক্রমান্বয়ে চলিয়া আসিয়াছে, কেন তাহাতে ক্বায়েমের কর্তৃত্ব বিন্দুমাত্র প্রকাশিত হয় নাই ? শুধু ইহাই নহে, বরং ইহার বিপরীত ঘটিয়াছে। তাঁহার শিষ্যগণ ও সঙ্গিগণ কি জনসাধারণ কর্তৃক নির্যাতিত হয় নাই ? তাহারা কি এখনও পর্যন্ত তাহাদের শত্রুদের ভয়াবহ বিরোধিতার বলি নহে ? তাহারা কি অদ্যাবধি অপমানিত ও শক্তিহীন নশ্বর মানবরূপে জীবনযাপন করিতেছে না ? হ্যাঁ, যে আধিপত্য ক্বায়েমের প্রতি আরোপিত হইয়াছে এবং যাহা ধর্মগ্রন্থে কথিত হইয়াছে, তাহা কি বাস্তব সত্য, যাহার সত্যতা সম্বন্ধে কেহ কোন সন্দেহ পোষণ করিতে পারে না। যাহা হউক, এই আধিপত্য সেই আধিপত্য নহে, যে-সম্বন্ধে সাধারণ মানুষের মন মিথ্যা ধারণা পোষণ করিয়া রহিয়াছে। অধিকন্তু, অতীত কালের পয়গম্বরগণ প্রত্যেকে তাঁহাদের সমসাময়িক মনুষ্যগণের নিকট ভবিষ্যতে প্রতিশ্রুত ঐশী প্রকাশের আবির্ভাব সম্বন্ধে ঘোষণা-বাণী প্রচার করার সময়, সর্বসময়েই এবং বিশেষভাবে, সেই আধিপত্য সম্বন্ধে উল্লেখ করিয়াছেন, যদ্দদ্বরা প্রতিশ্রুত ঐশী প্রকাশ ভবিষ্যতে ভূষিত হইবেন। অতীত কালের ধর্মগ্রন্থসমূহের লিপিগুলি ইহার সাক্ষ্য প্রদান করে। এই আধিপত্য এককভাবে ও বিশেষভাবে কেবল ক্বায়েমের প্রতিই আরোপ করা হয় নাই। শুধু ইহাই নহে, বরং এই আধিপত্যের গুণ এবং আল্লাহর অন্যান্য নামাবলী ও গুণাবলী, তাঁহার পূর্বে ও পরে, আল্লাহর সমস্ত পয়গম্বরের বা প্রকাশের প্রতি প্রযুক্ত হইয়াছে; কারণ এই সকল ঐশী প্রকাশ, যেমন পূর্বে ব্যাখ্যা করা হইয়াছে, অদৃশ্য আল্লাহর গুণাবলীর প্রতিরূপ ধারণকারী এবং স্বর্গীয় রহস্যাবলীর প্রকাশকারী।
অধিকন্তু, আধিপত্যের অর্থ হইতেছে সর্বব্যাপী, সর্বশক্তিশালী ক্ষমতা, যাহা ‘ক্বায়েম’ সহজাতভাবে প্রয়োগ করেন, অবশ্য তিনি পার্থিব আধিপত্যের মহিমায় ভূষিত হইয়া এই পৃথিবীতে আবির্ভূত হউন বা না হউন, ইহা সম্পূর্ণরূপে কায়েমের ইচ্ছা ও সন্তোষের উপর নির্ভরশীল। আপনি সহজেই ইহা স্বীকার করিবেন যে, অতীতের ধর্মগ্রন্থসমূহে আধিপত্য, ঐশ্বর্য, জীবন, মৃত্যু, বিচার-মীমাংসা ও পুনরুত্থান প্রর্ভতি যে-সকল বাক্য কথিত হইয়াছে, সেইগুলির প্রকৃত অর্থ এইরূপ নহে, যে-রূপ বর্তমান যুগের লোকেরা মনে করিয়াছে ও নিরর্থক কল্পনা করিয়া রহিয়াছে। শুধু ইহাই নহে, বরং আধিপত্য শব্দ দ্বারা সেই আধিপত্যই বুঝান হইয়াছে, যাহা প্রত্যেক ধর্ম-বিধানে ঐশী প্রকাশের ব্যক্তিত্বেই অবস্থান করে, যিনি সত্যের প্রভাত-তারকা এবং তাঁহারই কর্তৃত্ব উহা প্রয়োগ করা হয়। সেই আধিপত্য হইতেছে আধ্যাত্মিক আধিপত্য, যাহা তিনি স্বর্গ-মর্ত্যস্থ সকলেরই উপর পূর্ণভাবে প্রয়োগ করিয়া থাকেন এবং যাহা উপযুক্ত সময়ে পৃথিবীতে পৃথিবীর মানুষের সামর্থ্য ও আধ্যাত্মিক গ্রহণ-ক্ষমতানুযায়ী প্রকাশিত হইয়া থাকে। ঠিক এইরূপভাবে যে-রূপভাবে অদ্যকার দিনে আল্লাহর রসুল হজরত মোহাম্মদ (সঃ)-র আধিপত্য মানব-সাধারণের মধ্যে সুস্পষ্ট ও সুপ্রকাশিত। তাঁহার ধর্ম-বিধানের প্রাথমিক দিবসসমূহের তাঁহার ধর্মের উপর কিরূপ দুর্যোগ আপতিত হইয়াছিল, তাহা আপনি উত্তমরূপে অবগত আছেন। সেই আধ্যাত্মিক সারসত্তা, সেই অতীব পূত-পবিত্র সত্তার উপর সেই যুগের অবিশ্বাসী, বিপথগামী, ধর্মাচার্যগণ ও তাহাদের সহযোগিগণের হস্ত কতই-না দুঃখ-ক্লেশ বর্ষণ করিয়াছিল। তাঁহার পথে কত অধিক পরিমানে কণ্টক ও কণ্টক-লতাই-না তাহারা ছড়াইয়া দিত! ইহা সুস্পষ্ট যে, সেই হতভাগাগণ তাহাদের দুষ্ট-বুদ্ধি ও শয়তানী কল্পনায় সেই অবিনশ্বর সত্তার প্রতি প্রত্যেকটি ক্ষতিজনক কার্যকে চিরস্থায়ী আনন্দ-প্রদায়ক বলিয়া মনে করিত; কেন না, সেই যুগের কুখ্যাত ধর্মাচার্যগণ, যথা আব্দুল্লাহ উবায়ী, সন্নাসী আবু আমির, কা’ব ইব্নে আশরাফ, এবং নযর ইব্নে হারিস, সকলেই তাঁহাকে একজন প্রতারক বলিয়া মনে করিত এবং তাঁহাকে একজন বিকৃত মস্তিষ্ক ও অপবাদকারী বলিয়া ঘোষণা করিয়াছিল। তাহারা তাঁহার বিরুদ্ধে এইরূপ বেদনাদায়ক অভিযোগসমূহ আনয়ন করিয়াছিল যে, তৎসমুদয়ের উল্লেখ করিতে, আল্লাহ্ মসিকে প্রবাহিত হইতে, আমাদের লেখনীকে চলিতে অথবা কাগজের পৃষ্ঠাকে উহা ধারণ করিতে নিষেধ করিয়াছেন। এই সকল বিদ্বেষপূর্ণ অপবাদ জনসাধারণকে তাঁহার বিরুদ্ধে দন্ডায়মান হওয়ার জন্য এবং তাঁহাকে যন্ত্রণা দেওয়ার জন্য উত্তেজিত করিয়াছিল। যদি সমসাময়িক যুগের ধর্মাচার্যগণ ইহার প্রধান উত্তেজক হয়, তাহা হইলে সেই যন্ত্রণা প্রদান কতই ভয়াবহ হইয়া থাকে, যদি তাহারা তাহাদের অনুসরণকারীদের নিকট প্রকাশ্যভাবে তাঁহার দুর্নাম রটনা করে, তাহা হইলে, তাহারা তাঁহাকে তাহাদের মধ্য হইতে বিতাড়িত করে এবং তাঁহাকে একজন অবিশ্বাসী দূরাত্মা বলিয়া ঘোষণা করে! এই সেবকের উপরও কি সেই প্রকারের অত্যাচার ঘটে নাই এবং জনসাধারণ কর্তৃক ইহা কি দৃষ্ট হয় নাই ?
এই কারণে হজরত মোহাম্মদ (সঃ) চীৎকার করিয়া বলিয়াছিলেন ঃ “আমি যে-রূপ ক্ষতি ভোগ করিয়াছি, অন্য কোন পয়গম্বরকে সেইরূপ ক্ষতি ভোগ করিতে হয় নাই।” তাঁহার বিরুদ্ধে যে-সকল অপবাদ ও তিরস্কার উচ্চারিত হইয়াছিল এবং যে-সকল দুঃখ-কষ্ট তাঁহাকে ভোগ করিতে হইয়াছিল, সমস্তই ক্বোরআন মজিদে লিপিবদ্ধ আছে। ক্বোরআনের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করুন, তাহা হইলে হয়ত তাঁহার উপর যাহা ঘটিয়াছিল, তৎসম্বন্ধে আপনি অবগত হইতে পারিবেন। তাঁহার অবস্থা এইরূপ শোচনীয় হইয়াছিল যে, এক নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তাঁহার সহিত ও তাঁহার সঙ্গিগণের সহিত সকল প্রকার সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করা হইয়াছিল। যে-কেহ তাঁহার সহিত সম্মিলিত হইয়াছিল, তাহাকে তাঁহার শত্রুদের হস্তে নির্দয় নিষ্ঠুরতার বলি হইতে হইয়াছিল।
আমরা এই সম্পর্কে সেই গ্রন্থের মাত্র একটি আয়াত উদ্ধৃত করিব। যদি আপনি সুতীক্ষè দৃষ্টির সহিত ইহা অবলোকন করেন, তাহা হইলে সেই অবিচারগ্রস্ত ও অত্যাচারিত রসুল হজরত মোহাম্মদ (সঃ)-র সেই ক্ষতির জন্য আপনার জীবনের অবশিষ্ট দিবসসমূহ বিলাপ করিবেন ও শোক প্রকাশ করিতে থাকিবেন। সেই আয়াতটি ঐ সময়ে অবতীর্ণ হইয়াছিল, যখন হজরত মোহাম্মদ (সঃ) জনগণের বিরোধিতা ও অবিরত যন্ত্রণার ভারে ক্লান্ত, অবসন্ন ও দুঃখে পরিপূর্ণ হইয়াছিলেন। তাঁহার এই যন্ত্রণার সময় স্বর্গীয় ‘সদ্রাতুল্ মোন্তাহা’ হইতে জিব্রাইলের আহ্বান ধ্বনি এই বলিতে শুনা গিয়াছিলঃ “যদি তাহাদের বিরোধিতা তোমার পক্ষে অতিশয় কষ্টদায়ক হয়, তবে যদি পার পৃথিবীর অভ্যন্তরে এক সুড়ঙ্গ অথবা আকাশে একটি সিঁড়ি অনুসন্ধান কর।” (ক্বোরআন ৬।৩৫)। এই উক্তির ইঙ্গিত এই যে, তাঁহার অবস্থার কোনও প্রতিকার ছিল না, আর তাহারা তাঁহার উপর হইতে তাহাদের অত্যাচারী হস্ত সংযত করিয়া রাখিবে না, যে-পর্যন্ত না, তিনি নিজেকে পৃথিবীর অভ্যন্তরে লুক্কায়িত রাখেন বা স্বর্গে উড্ডীন করেন।
বিবেচনা করিয়া দেখুন, অদ্যকার দিনে কত বৃহৎ পরিবর্তন ঘটিয়াছে! অবলোকন করুন, কত অধিক সংখ্যক সম্রাট তাঁহার নামে নতজানু হয়! যাহারা তাঁহার ধর্মের বশ্যতা স্বীকার করে এবং তাহাতে আপনাদিগকে গৌরবান্বিত মনে করে, তেমন কত অসংখ্য জাতি ও রাজ্য তাঁহার ছায়ায় আশ্রয় অনুসন্ধান করিয়াছে। ধর্ম-প্রচারকের উচ্চ বেদীর শীর্ষ হইতে অদ্য কত প্রশংসা-বাক্য উর্দ্ধে উত্থিত হয়, যাহা অতীব বিনয় সুরে তাঁহার পবিত্র নামের স্তব করে এবং মসজিদের মিনার হইতে কত আজান প্রতিধ্বনিত হয়—যাহা তাঁহার উপাসনাকারী জনতাকে তাঁহার অর্চনার জন্য আহ্বান করে জ্ঞাপন করে। এমনকি পৃথিবীর ঐ সকল রাজা, যাহারা তাঁহার ধর্ম গ্রহণ করিতে এবং অবিশ্বাসের পরিচ্ছদ পরিত্যাগ করিতে অস্বীকার করিয়াছে, তাহারাও স্নেহশীল দয়ার প্রভাত-সূর্যের মহত্ত্ব ও পরাক্রমশীল মহিমা স্বীকার করে। এইরূপই তাঁহার পার্থিব আধিপত্য, যাহার সাক্ষ্য-প্রমাণসমূহ আপনি চতুর্দিকে দেখিতে পাইতেছেন। এই আধিপত্য নিশ্চয়ই প্রত্যেক ঐশী-প্রকাশের জীবদ্দশায় অথবা তাঁহার প্রকৃত আবাস, স্বর্গে আরোহণের পরে প্রকাশিত ও স্থাপিত হয়। অদ্য আপনি যাহা দেখিতেছেন, তাহা এই সত্যের একটি প্রমাণ। কিন্তু ঐ আধ্যাত্মিক প্রাধান্য, যাহা মূলতঃ উদ্দেশ করা হইয়াছে, তাহা অনন্ত কাল হইতে অনন্ত কাল পর্যন্ত তাঁহাদের মধ্যে অবস্থান করে এবং তাঁহাদেরই চতুর্দিকে আবর্তন করিয়া থাকে । ইহা কখনও মূহুর্তের জন্য তাঁহাদের নিকট হইতে পৃথক করা যায় না। ইহার পরাক্রম স্বর্গ-মর্ত্যে অবস্থিত সমস্ত-কিছুই পরিবেষ্টন করিয়া রহিয়াছে।
সত্যের প্রভাত-সূর্য হজরত মোহাম্মদ (সঃ) যে আধিপত্য পরিচালনা করিতেন, নিম্নে তাহার একটি প্রমাণ দেওয়া যাইতেছে। আপনি কি শুনেন নাই, তিনি কিরূপে একটিমাত্র আয়াত দ্বারা আলোককে অন্ধকার হইতে, ন্যায়পরায়ণতাকে অধার্মিকতা হইতে, বিশ্বাসিগণকে অবিশ্বাসিগণ হইতে পৃথক করিয়াছেন ? বিচার-দিবস সম্বন্ধে আপনি যে সকল নিদর্শন ও সঙ্কেতের কথা শুনিয়াছেন, যথা, মৃত ব্যক্তিদের পুনরুত্থান, হিসাব-মীমাংসার দিবস, শেষ-বিচার ও অন্যান্য বিষয়াদি, সেই আয়াতের অবতরণ দ্বারা এই সকলই প্রকাশিত হইয়াছে। এই সকল অবতীর্ণ বাক্য ন্যায়পরায়ণ লোকের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ ছিল, যাহারা ইহা শুনিয়া বলিয়াছিলঃ “ হে আল্লাহ, আমাদের প্রভূ, আমরা শ্রবণ করিয়াছি ও অনুগত হইয়াছি।” (ক্বোরআন ৫।৭)। এইগুলি অন্যায়কারীদের জন্য অভিশাপ ছিল, যাহারা ইহা শুনিয়া বলিয়াছিলঃ “আমরা শুনিয়াছি ও বিদ্রোহী হইয়াছি।” এই সমুদয় বাক্য আল্লাহর সুতীক্ষè তরবারির ন্যায় বিশ্বাসীকে অবিশ্বাসী হইতে এবং পিতাকে পুত্র হইতে পৃথক ও বিচ্ছিন্ন করিয়াছে। আপনি নিশ্চয়ই দেখিয়া থাকিবেন, কি রূপে, যাহারা তাঁহার প্রতি তাহাদের বিশ্বাস স্বীকার করিয়াছে এবং যাহারা তাঁহাকে পরিত্যাগ করিয়াছে, একে অন্যের সহিত যুদ্ধ করিয়াছে এবং পরস্পরের সম্পত্তি অধিকার করিতে চাহিয়াছে। কত পিতা পুত্র হইতে পৃথক হইয়াছে; কত প্রেমিক প্রেমাস্পদকে পরিত্যাগ করিয়াছে। আল্লাহর এই আশ্চর্যজনক তরবারি এমন নিষ্ঠুরভাবে সুতীক্ষè ছিল যে, ইহা সকল প্রকার সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করিয়া ফেলিল! অন্যপক্ষে, তাঁহার বাক্যের একত্রীভূত করার শক্তি সম্বন্ধে বিবেচনা করিয়া দেখুন। লক্ষ্য করিয়া দেখুন, যাহাদের মধ্যে শয়তান-রূপী স্বার্থপর আত্মা অনেক বৎসর যাবৎ হিংসা ও বিদ্বেষের বীজসমূহ বপন করিয়াছিল, এই আশ্চর্যজনক ও অত্যুন্নত অবতীর্ণ ধর্মের প্রতি আনুগত্য স্বীকারের মাধ্যমে তাহারা এরূপ মিলিত ও একত্রিত হইল যে, বোধ হইল যেন তাহারা একই ব্যক্তি হইতে জন্মলাভ করিয়াছিল। আল্লাহর বাক্যের একত্রীভূত করিবার প্রভাব এইরূপই; ইহা তাহাদেরই অন্তরসমূহ মিলিত করে, যাহারা তাঁহাকে ব্যতীত আর সকলকে পরিত্যাগ করিয়াছে, যাহারা তাঁহার নিদর্শনসমূহে বিশ্বাস স্থাপন করিয়াছে এবং প্রভার হস্ত হইতে আল্লাহর পবিত্র অনুকম্পার ‘কওসর’-উৎসের সলিল পান করিয়াছে। অধিকন্তু, ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের বিশ্বাসের, বিপরীত ধর্মাদির ও বিরুদ্ধ-স্বভাবের কত অসংখ্য মানুষ আছে, যাহারা আল্লাহর ‘ রেজওয়ান’ স্বর্গোদ্যান হইতে প্রবাহিত স্বর্গীয় বসন্ত কালের পুনর্জীবন দানকারী সৌরভের প্রভাবে স্বর্গীয় একতার নব পরিচ্ছদে ভূষিত হইয়াছে এবং তাঁহার একত্বের পানপাত্র হইতে পান করিয়াছে।
ইহাই এই বিখ্যাত বাক্যাদির তাৎপর্যঃ “ নেকড়ে বাঘ ও মেষ-শাবক একত্রে আহার করিবেই।” (ঈসায়াহ ৬৫।২৫)। এই সকল লোকের অজ্ঞতা ও মূর্খতা অবলোকন করুন, যাহারা প্রাচীন কালের জাতিসমূহের লোকের ন্যায় উক্ত সময়ে এই সকল জীব একই চারণ-ভূমিতে একত্রে আহার করিবে, তাহা প্রত্যক্ষ করার জন্য এখনও পর্যন্ত প্রতীক্ষা করিতেছে। এতই নীচ তাহাদের মানসিক শক্তির অবস্থা! বোধ হয়, তাহাদের ওষ্ঠ কখনও উপলব্ধির পানপাত্র স্পর্শ করে নাই. তাহাদের পদও ন্যায়বিচারের পথে পরিচালিত হয় নাই। ইহা ব্যতীত, যদি এইরূপই ঘটিত, তাহা হইলে পৃথিবীর লোকের কিই-বা উপকার হইত ? তাহাদের সম্বন্ধে তিনি কত ভাল কথাই বলিয়াছেনঃ “অন্তর তাহাদের আছে বটে, তদ্দদ্বরা তাহারা উপলব্ধি করে না, এবং চক্ষু তাহাদের আছে বটে, কিন্তু তদ্দদ্বারা তাহারা দেখিতে পায় না।” (ক্বোরআন ৭।১৭৮)।
বিবেচনা করিয়া দেখুন, কি প্রকারে এই একই আয়াত দ্বারা, যাহা আল্লাহর ইচ্ছার স্বর্গ হইতে অবতীর্ণ হইয়াছে, কি প্রকারে পৃথিবী ও তৎস্থিত সকলকেই তাঁহার সম্মুখে বিচার-মীমাংসাক্ষেত্রে উপস্থিত করা হইয়াছে। যে-কেহ তাঁহাকে ও তাঁহার সত্যকে স্বীকার করিয়াছে এবং তাঁহার দিকে প্রত্যাবর্তন করিয়াছে, তাহার সৎ কার্যগুলি তাহার মন্দ কার্য অপেক্ষা পরিমাণে অধিক হইয়াছে এবং তাহার সমুদয় পাপ ক্ষমা করা হইয়াছে। এতদ্দদ্বারা তাঁহার সম্বন্ধে এই সকল বাক্যের সত্যতা সুস্পষ্ট করা হইয়াছেঃ “তিনি ত্বরিত হিসাব গ্রহণ করিয়া থাকেন।” (ক্বোরআন ৫।৪)। এই প্রকারে আল্লাহ্ অন্যায়কে ন্যায়পরায়ণতায় পরিবর্তিত করেন, যদি আপনি স্বর্গীয় জ্ঞানের রাজ্যসমূহ পরীক্ষা করিতেন এবং তাঁহার বিজ্ঞতার ভেদসমূহের গভীরতা পরিমাপ করিতেন, তাহা হইলে সকলই অবগত হইতে পারিতেন। এইরূপে, যে-ব্যক্তি প্রেমের পাত্র হইতে পান করিয়াছে, সে অনন্ত অনুকম্পার মহাসাগরের ও চিরস্থায়ী করুণার বৃষ্টিধারা হইতে তাহার প্রাপ্য নিজ অংশ প্রাপ্ত হইয়াছে এবং বিশ্বাসের জীবনে যাহা স্বর্গীয় অনন্ত জীবন, তাহাতে প্রবেশ লাভ করিয়াছে। কিন্তু যে সেই পানপাত্র হইতে মুখ ফিরাইয়া লইয়াছে, সে চির-মৃত্যু-দন্ডে দন্ডিত হইয়াছে। “জীবন” ও “মৃত্যু” এই দুইটি শব্দ, যাহা ধর্মগ্রন্থে উল্লিখিত হইয়াছে, উহাদের অর্থ, বিশ্বাস-রূপ জীবন এবং অবিশ্বাস-রূপ মৃত্যু। জনসাধারণ এই সকল শব্দের অর্থ বুঝিতে না পারিয়া ঐশী প্রকাশের ব্যক্তিত্বকে অগ্রাহ্য ও অবজ্ঞা করিয়াছে, তাঁহার স্বর্গীয় পথ-পরিচালনার আলোক হইতে নিজেদের বঞ্চিত করিয়াছে এবং সেই শাশ্বত সুষমার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করিতে অস্বীকার করিয়াছে।
ক্বোরআনের অবতীর্ণ বাণীর আলোক যখন হজরত মোহাম্মদ (সঃ)-র পবিত্র অন্তর-প্রকোষ্ঠে প্রজ্জ্বলিত হইয়া উঠিল, তখন তিনি লোকের উপর শেষ দিবসের, পুনরুত্থানের, বিচার-মীমাংসার, জীবনের ও মৃত্যুর বিচার-নিষ্পত্তি ঘোষণা করিলেন। তাহাতে বিদ্রোহের পতাকাসমূহ উত্তোলিত হইল এবং বিদ্রুপের দ্বারসমূহ উদ্ঘাটিত হইল। এইরূপেই, তিনি, সেই ঐশী-পরমাত্মা, অবিশ্বাসীদের উচ্চারিত বাক্য লিপিবদ্ধ করিয়াছেনঃ “এবং যদি তুমি তাহাদিগকে বল, ‘মৃত্যুর পর নিশ্চয় তোমরা পুনরুত্থিত হইবে’, তাহাতে অবিশ্বাসীরা নিশ্চয় বলিবে, “ইহা সুস্পষ্ট যাদু ব্যতীত আর কিছুই নহে’।” (ক্বোরআন ১১।৭)। পুনঃ তিনি বলেনঃ “যদি তুমি কখনও আশ্চর্যান্বিত হও, তবে তাহাদের এই বাক্য বাস্তবিকই আশ্চর্যজনকঃ ‘কি! যখন আমরা ধুলিতে পরিণত হইয়াছি, আমরা কি এখন একটি নূতন সৃষ্টিতে পুনরুত্থিত হইব’ ? (ক্বোরআন ১৩।৫)। এইরূপ অন্য এক স্থানে তিনি ক্রোধস্বরে বলিয়া উঠেনঃ “প্রথম সৃষ্টিতে আমরা কি ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছি ? কিন্তু তাহারা নূতন সৃষ্টি সম্বন্ধে সন্দেহের মধ্যে আছে।” (ক্বোরআন ৫০।৫১)।
পবিত্র ক্বোরআনের ব্যাখ্যাকর্তাগণ এবং যাহারা ইহার আক্ষরিক অর্থ করে তাহারা, যখন আল্লাহর বাক্যাবলীর মর্মার্থের ভুল ব্যাখ্যা করিয়াছিল এবং ইহাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য হৃদয়ঙ্গম করিতে অসমর্থ হইয়াছিল, তখন তাহারা প্রমাণ করিতে চাহিয়াছিল যে, ব্যাকরণের নিয়মানুসারে যখন “এযা” শব্দ (যাহার অর্থ “যদি” বা “যখন”) অতীত কালের পূর্বে বসে, তখন ইহার অর্থ নিত্যই ভবিষ্যৎ কাল বুঝাইয়া থাকে। পরে যেখানে এই শব্দটি বাস্তবিকই পাওয়া গেল না, সেখানে গ্রন্থের ঐ সকল আয়াতের ব্যাখ্যা করিতে যাইয়া তাহারা অত্যন্ত কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া পড়িল। যেমন তিনি অবতীর্ণ করিয়াছেনঃ “ভেরি নিনাদিত হইল,—দেখ! ইহাই সতর্কীকৃত প্রতিশ্রুত দিবস— প্রত্যেক ব্যক্তিকে তাহার একজন পরিচালক ও একজন সাক্ষীসহ বিচার-মীমাংসার ক্ষেত্রে উপস্থিত করা হইয়াছে।” (ক্বোরআন ৫০।২০)। এই আয়াত এবং এই প্রকারের আয়াতাদির ব্যাখ্যা করার সময় তাহারা কোনও কোনও স্থলে এই বিতর্ক উপস্থিত করিয়াছে যে, “এযা” শব্দ উহ্য রহিয়াছে। অন্যান্য স্থলে তাহারা নিরর্থক এই কারণ প্রদর্শন করিয়াছে যে, যেহেতু বিচার-মীমাংসা দিবস একটি অপরিহার্য দিবস; সুতরাং ইহাকে ভবিষ্যৎ কালের একটি ঘটনা না বলিয়া, ইহাকে অতীত কালের ঘটনা বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে। তাহাদের মিথ্যা বিতর্ক কতই নিরর্থক! তাহাদের অন্ধত্ব কতই সাংঘাতিক! হজরত মোহাম্মদ (সঃ)-র নিকট অবতীর্ণ বাণীর মাধ্যমে এই মূল বাক্যস্থিত ভেরি-নিনাদ, যাহা এইরূপ সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হইয়াছিল, তাহা তাহারা চিনিয়া লইতে অস্বীকার করে। আল্লাহর পুনর্জীবন প্রদানকারী পরমাত্মা, যাহা ইহা নিনাদিত করিয়াছিল, তাহা হইতে তাহারা নিজেদের বঞ্চিত করে এবং মূর্খ লোকের ন্যায় আল্লাহর ইস্রাফীলের ভেরি-নিনাদ শুনিতে আশা করে, যে-স্বর্গীয় দূত তাঁহার সেবকগণের একজন। ইস্রাফীল স্বয়ং, যিনি তাহাদের মতে বিচার-দিবসের ফেরেশতা এবং তাঁহার সদৃশ অন্যান্য ফেরেশতার অস্তিত্ব কি হজরত মোহাম্মদ (সঃ)-র উচ্চারিত বাক্য দ্বারাই প্রমাণিত হয় নাই ? ‘বল ঃ কি! যাহা তোমাদের হিতকারী তাহা কি একটি মন্দ জিনিসের পরিবর্তে দিয়া দিবে ? ইহা কতই দুর্ভাগ্যের কারণ হইবে, যাহা তোমরা এইরূপ ভ্রান্ত বিনিময় করিয়াছ! নিশ্চয়ই তোমরা হতভাগা লোক, তোমরা সাংঘাতিক ক্ষতির মধ্যে রহিয়াছ।’
না, শুধু তাহাই নহে; “ভেরি-নিনাদ” শব্দের অর্থ হইতেছে হজরত মোহম্মদ (সঃ)-র অবতরণের আহ্বান-ধ্বনি, যাহা বিশ্বের হৃদয়-কেন্দ্রে নিনাদিত হইয়াছিল এবং “পুনরুত্থান” শব্দের মর্মার্থ হইতেছে, আল্লাহর প্রত্যাদেশ ঘোষণা করিবার জন্য তাঁহার অভ্যুত্থান। তিনি বিপথগামী ও অবাধ্য লোকগণকে তাহাদের দেহ-রূপ সমাধিসমূহ হইতে দ্রুততর বহির্গত হইয়া আসিতে আদেশ দিয়াছিলেন, তাহাদিগকে বিশ্বাস-রূপ সুন্দর নব পরিচ্ছদে ভূষিত করিয়া এক নূতন ও অত্যাশ্চর্য জীবন-নিঃশ্বাস দ্বারা পুনর্জীবিত করিয়াছিলেন। এইরূপে যখন একদিন সেই স্বর্গীয় সুষমা, হজরত মোহাম্মদ (সঃ), “পুনরুত্থান”, “বিচার-মীমাংসা”, “স্বর্গ” ও “নরক” প্রভৃতি নিদর্শন সম্বলিত শব্দাবলীর মধ্যে নিহিত রহস্যগুলির মধ্য হইতে একটি রহস্য উদ্ঘাটন করিতে যাইতেছিলেন, তখন প্রেরণা প্রদানকারী জিব্রাইলের কণ্ঠকে বলিতে শুনা গিয়াছিলঃ “শীঘ্রই তাহারা তোমার প্রতি তাহাদের মস্তক সঞ্চালন করিবে, এবং বলিবে ‘বল’ত, ইহা কখন হইবে ?’ তুমি বলঃ ‘খুব সম্ভব, ইহা শীঘ্রই হইবে, নিকটবর্তী সময়ে’।” (ক্বোরআন ১৭।৫১)। একমাত্র এই আয়াতের ইঙ্গিতগুলিই পৃথিবীর লোকের পক্ষে যথেষ্ট, যদি তাহারা তাহাদের অন্তরে ইহা অনুভব করে।
করুণাময় আল্লাহ্! ঐ সকল লোক আল্লাহর সুপথ হইতে কত দূরেই চলিয়া গিয়াছে! যদিও হজরত মোহাম্মদ (সঃ)-র প্রতি অবতীর্ণ বাক্যের মাধ্যমে অভ্যুত্থান দিবস উপস্থিত করা হইয়াছিল, যদিও তাঁহার আলোক ও নিদর্শনাবলী পৃথিবী ও তন্মধ্যস্থ সকলকেই পরিবেষ্টন করিয়া ফেলিয়াছিল, তথাপি ঐ সকল লোক তাঁহাকে বিদ্রুপ করিয়াছিল এবং ঐ যুগের সকল ধর্মাচার্যের অলস কল্পনাপ্রসূত মিথ্যা ধারণাবলীর প্রতিমাসমূহের নিকট আত্মসমর্পণ করিয়াছিল এবং আপনাদিগকে স্বর্গীয় অনুকম্পার আলোক ও স্বর্গীয় করুণার ধারা হইতে বঞ্চিত করিয়াছিল। হ্যাঁ, সত্যই হীন প্রকৃতির গুব্রে কীট কখনও পবিত্রতার সুঘ্রাণ আস্বাদন করিতে পারে না এবং অন্ধকারের বাদুড় কখনও সূর্যের উজ্জ্বল আলোকের সম্মুখীন হইতে পারে না।
প্রত্যেক ঐশী প্রকাশের সময় এইরূপ বিষয়াদি সংঘটিত হইয়াছে। যেমন যীশু বলিয়াছেনঃ “ তোমাদের নব-জন্ম গ্রহণ করিতে হইবে।” (যোহন ৩।৭)। এবং পুনরায় তিনি বলিলেনঃ “যদি মনুষ্য জল ও আত্মা হইতে জন্মলাভ না করে, তবে সে আল্লাহর রাজ্যে প্রবেশ লাভ করিতে পারে না; কেন না, যাহা মাংস হইতে জাত, তাহা মাংসই; যাহা আত্মা হইতে উৎপন্ন, তাহা আত্মাই।” (যোহন ৩।৫-৬)। এই বাক্যাবলীর মর্মার্থ এই যে, যে-ব্যক্তি প্রত্যেক ঐশী প্রকাশের সময় পরমাত্মা হইতে জন্মলাভ করে এবং পবিত্র ঐশী প্রকাশের সঞ্জীবনী শক্তির দ্বারা সঞ্জীবিত ও অনুপ্রাণিত হয়, সে-ই তাহাদের মধ্যে একজন যাহারা “জীবন” এবং “পুনরুত্থান” লাভ করিয়াছে, এবং ঐশী প্রেমের স্বর্গে প্রবেশাধিকার প্রাপ্ত হইয়াছে। এবং অপর সকলকে “মৃত” ও “জড়”-এর দ- প্রদানে আল্লাহর “ক্রোধ” ও অবিশ্বাসের “নরকাগ্নিতে” নিক্ষিপ্ত করা হয়। সকল ধর্মগ্রন্থে, পুস্তকে ও ইতিবৃত্তে, তাহাদেরই সম্বন্ধে মৃত্যু, নরকাগ্নি, অন্ধত্ব, জ্ঞানশক্তিহীনতা, শ্রবণ শক্তিশূন্যতার দন্ডাদেশ প্রদান করা হইয়াছে, যাহাদের অধর সত্য জ্ঞানের স্বর্গীয় পানপাত্র আস্বাদন করে নাই এবং যাহাদের অন্তর তাহাদের সময়ে পবিত্রাত্মার অনুকম্পা হইতে বঞ্চিত হইয়াছে। যেমন পূর্বে বর্ণিত হইয়াছেঃ “তাহাদের অন্তর আছে বটে; কিন্তু তাহারা উপলব্ধি করে না।” (ক্বোরআন ৭।১৭৮)।
ইঞ্জিলের অন্য এক স্থানে লিখিত আছে ঃ “একদিন এরূপ ঘটিল যে, যীশুর এক শিষ্যের পিতার মৃত্যু হইল। শিষ্যটি যীশুকে তাহার পিতার মৃত্যু সংবাদ প্রদান করিল এবং বাড়ী যাইয়া তাহাকে সমাধিস্থ করার জন্য যীশুর নিকট হইতে অনুমতি চাহিল। সেই বৈরাগ্যের অবতার যীশু উত্তরে তাহাকে বলিলেন ঃ “মৃত ব্যক্তিগণই তাহাদের মৃত ব্যক্তিকে সমাধিস্থ করুক।” (লুক ৯।৬০)।
সেই প্রকারে, কুফার দুইজন লোক বিশ্বাসীদের নেতা হজরত আলী (রাঃ)-র নিকট আসিল। তাহাদের একজনের বাড়ী ছিল, উহা সে বিক্রয় করিতে চাহিল; অপর লোকটি উহা ক্রয় করিতে ইচ্ছা করিল। তাহারা এই বিষয়ে সম্মত হইল যে, হজরত আলী (রাঃ)-র জ্ঞাতসারে এই চুক্তিনামা সম্পাদিত ও লিখিত হইবে। তিনি, যিনি আল্লাহর আইনের একজন ব্যাখ্যাদাতা ছিলেন, লেখককে সম্বোধন করিয়া বলিলেনঃ “তুমি লিখঃ ‘একজন মৃত ব্যক্তি আর একজন মৃত ব্যক্তি হইতে একটি বাড়ী ক্রয় করিয়াছে। সেই বাড়ীটি চারিটি সীমা দ্বারা আবদ্ধ। একটি সীমা সমাধি পর্যন্ত বিস্তৃত, আর একটি সমাধির খিলান পর্যন্ত, তৃতীয়টি ‘সিরাত’ পর্যন্ত, চতুর্থটি হয়ত স্বর্গ, নহে ত নরক পর্যন্ত বিস্তৃত।” ভাবিয়া দেখুন, যদি এই দুই ব্যক্তির আত্মা হজরত আলী (রাঃ)-র ভেরি-নিনাদে সঞ্জীবিত হইত, যদি তাহারা তাঁহার প্রেমের শক্তি দ্বারা ভ্রান্তির সমাধি হইতে উত্থিত হইত, তাহা হইলে তাহাদের বিরুদ্ধে বিচারে নিশ্চয়ই মৃত্যুদ- দেওয়া হইত না।
প্রত্যেক যুগে ও শতাব্দীতে, পয়গম্বরগণ ও তাঁহাদের মনোনীতগণের উদ্দেশ্য হইতেছে, “জীবন”, “পুনরুত্থান”, “বিচার-মীমাংসা” প্রভৃতি বাক্যের আধ্যাত্মিক আধ্যাত্মিক তাৎপর্য সম্বন্ধে নিশ্চিত সত্যবাণী প্রদান করা। যদি কেহ কিয়ৎ কালের জন্য তাহার অন্তরে হজরত আলী (রাঃ)-র উচ্চারিত এই বাক্য অনুধাবন করে, তাহা হইলে “সমাধি-স্থান”. “সমাধি”, “পুল্সিরাত”, “স্বর্গ” ও “নরক” প্রভৃতি শব্দে যে ভেদসমূহ নিহিত আছে, তাহার সবই সে নিশ্চয়ই আবিষ্কার করিতে পারিবে। কিন্তু, আহা! ইহা কতই আশ্চর্যজনক ও শোচনীয়! দেখুন, সমস্ত মানুষ নিজ নিজ প্রবৃত্তির সমাধিতে কারারুদ্ধ এবং পার্থিব বাসনার নিম্নতম গহ্বরে সমাধিস্থ! যদি আপনি স্বর্গীয় জ্ঞানের স্বচ্ছ নির্মল বারির এক বিন্দুমাত্র পান করিতেন, তাহা হইলে বুঝিতে পারিতেন যে, দৈহিক জীবন প্রকৃত জীবন নহে, আধ্যাত্মিক জীবনই প্রকৃত জীবন। কারণ মানব ও পশু সমভাবে দৈহিক জীবনের অধিকারী; কিন্তু আধ্যাত্মিক জীবন কেবল ঐ সমুদয় পবিত্র অন্তঃকরণবিশিষ্ট লোকের নিকটই পাওয়া যায়, যাহারা বিশ্বাসের মহাসমুদ্র হইতে প্রচুর পরিমাণে পান করিয়াছে এবং নিশ্চয়তার ফল আস্বাদন করিয়াছে। এইরূপ জীবনের কোনও মৃত্যু নাই এবং এই অস্তিত্বের মুকুট হইতেছে অমরত্ব। যেমন বলা হইয়াছে ঃ “প্রকৃত বিশ্বাসী—বর্তমান ও পরবর্তী—এই উভয় জগতে জীবিত।” যদি “জীবন” অর্থে দৈহিক জীবনই অর্থ করা হইত,তবে ইহা সুস্পষ্ট যে, অবশেষে মৃত্যু অবশ্যই ইহাকে পরাভূত করিবে।
এই প্রকারে, সকল স্বর্গীয় গ্রন্থের লিপিবদ্ধ বাণী এই মহান সত্যের ও এই মহোন্নত বাক্যের সত্যতার সাক্ষ্য প্রদান করিতেছে। অধিকন্তু, ধর্মার্থে নিহত ও উৎসর্গীকৃতদের সম্রাট, হজরত হামজা (হজরত মোহাম্মদ (সঃ)-র পিতৃব্য) ও আবু জেহ্ল সম্বন্ধে পবিত্র ক্বোরআনে অবতীর্ণ এই আয়াত আমাদের বাক্যের সত্যতা সম্বন্ধে একটি উজ্জ্বল প্রমাণ ও নিশ্চিত সাক্ষীঃ “যে-ব্যক্তি মৃত ছিল এবং যাহাকে আমি পরে জীবিত করিয়াছি এবং যাহার জন্য আমি আলোকের ব্যবস্থা করিয়াছি, যাহার সাহায্যে সে লোকের মধ্যে চলাফেরা করে, সে কি ঐ ব্যক্তির মত হইতে পারে, যে অন্ধকারের মধ্যে পড়িয়া আছে, যাহা হইতে বহির্গত হইতে পারে না ?” (ক্বোরআন ৬।২২)। এই আয়াত ঐ সময় পরম অনাদি-অনন্ত ইচ্ছা-শক্তির স্বর্গ হইতে অবতীর্ণ হইয়াছিল, যখন হজরত হামজা ধর্ম-বিশ্বাসের পরিচ্ছদে বিভূষিত হইয়াছিলেন, এবং আবু জেহ্ল তাহার বিরোধিতা ও অবিশ্বাসে কঠোরচিত্ত হইয়া গিয়াছিল। সর্বশক্তিমান প্রস্রবণ ও পবিত্রতার অনন্ত উৎস হইতে বিচার-মীমাংসা অবতীর্ণ হইয়া হজরত হামজাকে অনন্ত জীবন দান করিল এবং আবু জেহ্লকে অনন্ত দন্ডে দন্ডিত করিল। এই কারণে অবিশ্বাসীদের অন্তরে অবিশ্বাসের অগ্নিশিখা প্রবলভাবে প্রজ্জ্বলিত হইল এবং তাহাদিগকে তাঁহার সত্য ধর্ম প্রত্যাখ্যান করিবার জন্য প্রকাশ্যভাবে উত্তেজিত করিল। তাহারা উচ্চৈঃস্বরে আপত্তি করিতে লাগিলঃ “হামজা কখন মরিয়া গিয়াছিল ? কখনই-বা সে উত্থিত হইল ? কোন্ সময়ে তাহার মধ্যে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা হইল ?” যেহেতু তাহারা এই সমুদয় মহৎ বাক্যের তাৎপর্য বুঝিতে পারে নাই এবং ধর্মের ঐ সমস্ত খ্যাতনামা ব্যাখ্যাকর্তা, যাঁহারা স্বর্গীয় জ্ঞানের “কওসর”-উৎসের সলিল তাহাদের উপর বর্ষণ করিতে পারিত, তাহাদের নিকট হইতে আলোক-প্রাপ্তির জন্য তাহারা চেষ্টিত হয় নাই, এই কারণে মানুষের মধ্যে এইরূপ অপকারিতার অগ্নি প্রজ্জ্বলিত হইয়াছিল।
অদ্য আপনি দেখিতে পাইতেছেন, স্বর্গীয় জ্ঞান-সূর্যের আভা সত্ত্বেও কি প্রকারে উচ্চ-নীচ সকল লোক অজ্ঞানান্ধকারের অধিনায়ক শয়তানের নীচ প্রকৃতির প্রকাশকারী প্রতিনিধিদের কুসংস্কারাচ্ছন্ন পথসমূহ আঁকড়াইয়া ধরিয়া রহিয়াছে। এই সকল লোক ধর্মের জটিল বিষয়সমূহ মীমাংসা করার জন্য সব সময়েই তাহাদের নিকট হইতে সাহায্য প্রার্থনা করে; কিন্তু তাহাদের জ্ঞানের অভাব হেতু তাহারা এইরূপ উত্তর দেয়, যেন ইহাতে কোনও প্রকারে তাহাদের যশ-প্রতিপত্তি ও পার্থিব সৌভাগ্যের ক্ষতি না হয়। ইহা সুস্পষ্ট যে, গুব্রে কীট-সদৃশ এই সকল নীচ ও হতভাগা লোকের নিকট সেই অনন্তের মৃগ-নাভির সুগন্ধযুক্ত সমীরণের কোনও অংশই পাওয়া যায় না এবং স্বর্গীয় আনন্দপূর্ণ ‘রেজওয়ান’-উদ্যানে তাহারা কখনও প্রবেশলাভ করে নাই। সুতরাং তাহারা কি প্রকারে অন্য লোককে সেই পবিত্রতার অবিনশ্বর সৌরভ প্রদান করিতে পারে ? এইরূপই তাহাদের পন্থা এবং ইহা সর্বদা এইরূপই থাকিবে। কেবল ঐ সকল মানুষই ঐশী-বাণীর জ্ঞান অর্জন করিতে পারে, যাহারা তাঁহার দিকে প্রত্যাবর্তিত হইয়াছে এবং শয়তানের প্রকাশগণকে প্রত্যাখ্যান করিয়াছে। এইরূপে, আল্লাহ্ তাঁহার প্রত্যাদেশ অবতরণের বা পুনরভ্যুত্থান দিবস সম্পর্কিত আইন-কানুন পুনঃ সুদৃঢ় করিয়াছেন এবং স্বর্গীয় আভার অন্তরালে নিহিত আধ্যাত্মিক ফলকে স্বর্গীয় শক্তির লেখনী দ্বারা ইহা লিপিবদ্ধ করিয়াছেন। যদি আপনি এই সকল বাক্যের প্রতি মনোযোগ দিতেন, যদি আপনি আপনার অন্তরে ইহার প্রকাশ্য ও অন্তর্নিহিত অর্থ অনুধাবন করিতেন, যাহা অদ্যকার দিনে মানুষের ও বিচার-দিবসের জ্ঞানের মধ্যে অনতিক্রম্য প্রতিবন্ধকতা স্বরূপ হইয়া দাঁড়াইয়াছে, তাহা হইলে আপনি সে-সমস্ত জটিল সমস্যার তাৎপর্য উপলব্ধি করিতে সমর্থ হইতেন। তখন আপনাকে হতভম্ব করিবার আর কোনও প্রশ্নই থাকিবে না। আমরা, কতই আনন্দ সহকারে আশা করিতেছি যে, আল্লাহর ইচ্ছায়, আপনি স্বর্গীয় করুণার মহাসাগরের তটসমূহ হইতে তৃষ্ণার্ত ও বঞ্চিত হইয়া ফিরিয়া আসিবেন না এবং আপনার অন্তরের বাসনার অবিনশ্বর আশ্রয়স্থান হইতে রিক্তহস্তে প্রত্যাবর্তন করিবেন না। এক্ষণে দেখা যাউক, আপনার অনুসন্ধান ও উদ্যম কি পরিমাণে ফলবতী হয়।
পূর্ববর্তী বিষয়টি পুনরারম্ভ করা যাউকঃ এই সমুদয় সত্যের বর্ণনা করার আমাদের উদ্দেশ্য হইল—যিনি রাজাদের রাজা তাঁহার সর্বাধিপত্য প্রদর্শন করা। ন্যায়ভাবে বিবেচনা করুন, এই সর্বাধিপত্য—মাত্র একটি বাক্য উচ্চারণে এইরূপ শক্তিশালী প্রভাব, এইরূপ প্রাধান্য এবং ভীতিসঙ্কুল মহিমা প্রকাশ করিয়াছে—এই প্রাধান্য কি শ্রেষ্ঠ, না এই সকল রাজাদের পার্থিব রাজত্ব শ্রেষ্ঠ, যাহারা তাহাদের প্রজাবর্গের জন্য চিন্তা করা সত্ত্বেও এবং গরীব লোককে সাহায্য প্রদান করা সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাহ্যিক ও ক্ষণস্থায়ী রাজ-ভক্তি সম্বন্ধেই নিশ্চিত; পক্ষান্তরে মানুষের অন্তরে তাহারা কোনও প্রকার ভালবাসা বা সম্মানের উদ্রেক করিতে সক্ষম হয় না ? সেই সর্বাধিপত্য কি একটিমাত্র বাক্যের শক্তির প্রভাবে সমস্ত পৃথিবীকে পরাভূত, উজ্জীবিত ও পুনর্জীবিত করে নাই ? কি! অতি নীচ ধুলিকে কি তাঁহার সহিত তুলনা দেওয়া যায়, যিনি প্রভূদের প্রভূ ? না, সর্বপ্রকার তুলনা তাঁহার সর্বাধিপত্যের পবিত্র মন্দিরে প্রবেশলাভ করিতে নিতান্ত অক্ষম। যদি মানুষ চিন্তা করিত, তবে সে নিশ্চয়ই দেখিতে পাইত যে, এমন কি, তাঁহার দ্বারের একজন ভৃত্যও সমস্ত সৃষ্ট পদার্থের উপর কর্তৃত্ব করে। ইহা ইতিপূর্বেই দৃষ্ট হইয়াছে এবং ভবিষ্যতেও প্রকাশ করা হইবে।
ইহা আধ্যত্মিক আধিপত্যের তাৎপর্যসমূহের একটিমাত্র তাৎপর্য, যাহা আমরা লোকের সামর্থ্য ও গ্রহণক্ষম শক্তি অনুসারে বর্ণনা করিয়াছি। কারণ তিনি, যিনি সর্বজীবের পরিচালক, সেই প্রভাসম্পন্ন আনন, তিনি এইরূপ শক্তিসমূহের উৎস, যাহা—না এই অত্যাচারিত ব্যক্তি প্রকাশ করিতে পারে, না এই সকল অযোগ্য লোকেরা উপলব্ধি করিতে সক্ষম। তাঁহার সর্বাধিপত্য মানবের প্রশংসার অতীব উর্দ্ধে; তাহারা তাঁহার প্রতি যে-গুণাবলী আরোপ করে, তাহা হইতে তিনি অত্যধিক মর্যাদাসম্পন্ন!
এবং এক্ষণে, আপনার অন্তরে ইহা গভীরভাবে অনুধাবন করুনঃ যদি সর্বাধিপত্যের অর্থ পার্থিব আধিপত্য ও পার্থিব রাজত্ব হইত, যদি ইহা দ্বারা পৃথিবীর সকল লোকের ও জাতির অধীনতা ও বাহ্যিক আনুগত্য বুঝাইত, যদ্দদ্বারা তাঁহার প্রিয়পাত্রগণ গৌরবান্বিত হইতেন এবং শান্তিতে বাস করিতে সমর্থ হইতেন, এবং তাঁহার শত্রুগণ অধঃপতিত ও যন্ত্রণাগ্রস্ত হইত, তবে সেই প্রকারের আধিপত্য স্বয়ং আল্লাহর সত্য আধিপত্য হইত না—যিনি সর্বপ্রকার রাজত্বের উৎস এবং সকল কিছুই তাঁহার মহিমা ও শক্তির সাক্ষ্য প্রদান করে। কারণ, আপনি কি দেখিতেছেন না, অধিকাংশ মানুষই তাঁহার শত্রুদের কর্তৃত্বের অধীন ? তাহারা সকলেই কি তাঁহার অভীপ্সিত পথ হইতে মুখ ফিরাইয়া লয় নাই ? তিনি যাহা নিষেধ করিয়াছেন, তাহারা কি তাহা করে নাই এবং তিনি যাহা করিতে আদেশ দিয়াছেন, তাহারা কি তাহা পরিত্যাগ করে নাই, এমন কি, প্রত্যাখ্যান ও উহার প্রতিকূলতা করে নাই ? তাঁহার বন্ধুগণ কি সর্বদা তাঁহার শত্রুগণের অত্যাচারের বলি হয় নাই ? এই সকল বিষয় মধ্যাহ্ন সূর্যের উজ্জ্বলতা অপেক্ষাও সুস্পষ্ট।
অতএব, হে সত্যান্বেষণকারী প্রশ্নকর্তা! জানিয়া রাখুন যে, আল্লাহর ও তাঁহার মনোনীত পুরুষগণের চক্ষে পার্থিব আধিপত্যের কোনও মূল্য নাই এবং কখনও হইবে না। অধিকন্তু, যদি প্রাধান্য ও রাজত্ব দ্বারা পার্থিব প্রাধান্য ও ঐহিক শক্তি ব্যাখ্যা করা হয়, তাহা হইলে এই সমস্ত আয়াতের ব্যাখ্যা করা আপনার পক্ষে কতই অসম্ভব হইবেঃ “এবং নিশ্চয়ই আমাদের সেনাবাহিনীই জয়লাভ করিবে।” (ক্বোরআন ৩৭।১৭৩)। “তাহারা তাহাদের মুখের ফুৎকারে আল্লাহর আলোক নির্বাপিত করিতে ইচ্ছা করেঃ কিন্তু আল্লাহ্ তাঁহার আলোক প্রজ্জ্বলিত রাখিতেই কৃতসংকল্প, যদিও অবিশ্বাসীদের জন্য ইহা অপ্রতিকর।” (ক্বোরআন ৯।৩৩)। “তিনি সব কিছুর উপরই সর্বশক্তিমান।” এইরূপে পবিত্র ক্বোরআনের অধিকাংশ আয়াতই এই সত্যের সাক্ষ্য দান করে।
যদি এই সকল মূর্খ ও ঘৃণার্হ ব্যক্তিগণের অলস বিতর্কের বিষয় সত্য হইত, তাহা হইলে এই সকল পবিত্র বাক্য ও স্বর্গীয় সঙ্কেতাদি প্রত্যাখ্যান করা ব্যতীত তাহাদের অন্য কোন উপায় থাকিত না। কারণ, হজরত আলী (রাঃ)-র পুত্র হোসেইন (রাঃ) অপেক্ষা উৎকৃষ্টতর ও আল্লাহর নিকটতর কোনও যোদ্ধা পৃথিবী-পৃষ্ঠে পাওয়া যাইবে না, তিনি এমনই অপ্রতিদ্বন্দ্বী ও অতুলনীয় ছিলেন। “পৃথিবীতে তাঁহার সমকক্ষ বা প্রতিদ্বন্দ্বী কেহ ছিল না।” তত্রাচ, তাঁহার উপর কি কি ঘটিয়াছিল তাহা নিশ্চয়ই আপনি শ্রবণ করিয়া থাকিবেন। “অত্যাচারীদের উপর আল্লাহর অভিসম্পাত বর্ষিত হউক।” (ক্বোরআন ১১।১৮)।
“এবং নিশ্চয় আমাদের সৈন্যবাহিনীই জয়লাভ করিবে”, এই আয়াতটি যদি আক্ষরিক অর্থে ব্যাখ্যা করা হয়, তাহা হইলে ইহা সুস্পষ্ট যে, ইহা কোনও প্রকারেই আল্লাহর মনোনীত পুরুষগণের ও তাঁহার বাহিনীসমূহের প্রতি প্রযোজ্য হইবে না; কারণ, এমন কি হজরত হোসেইন (রাঃ)-কেও, যাঁহার বীরত্ব সূর্যের সদৃশ সুস্পষ্ট ছিল, পরাজিত ও পরাভূত হইয়া অবশেষে তাফদেশ কারবালাতে ধর্মার্থে হত্যাকারীদের পানপাত্র সেবন করিত হইয়াছিল। এই প্রকারে এই পবিত্র আয়াতঃ “তাহারা তাহাদের মুখের ফুৎকারে আল্লাহর আলোক নির্বাপিত করিতে ইচ্ছা করেঃ কিন্তু আল্লাহ্ তাঁহার আলোক প্রজ্জ্বলিত রাখিতেই কৃতসংকল্প, যদিও অবিশ্বাসীদের জন্য ইহা অপ্রীতিকর।” (ক্বোরআন ৯।৩৩)। যদি আক্ষরিকভাবে ইহার ব্যাখ্যা করা হয়, তাহা হইলে সত্যের সহিত কখনও ইহার ঐক্য হইবে না। কারণ, প্রত্যেক যুগে পৃথিবীর লোকেরা, বাহ্যতঃ, আল্লাহর সত্যের আলোক নির্বাপিত করিয়া ফেলিয়াছে, এবং আল্লাহর প্রদীপসমূহ তাহাদের দ্বারা নির্বাপিত করা হইয়াছে। তাহা হইলে কি প্রকারে এই সকল প্রদীপের সর্বাধিপত্যের প্রাধান্য ব্যাখ্যা করা যায় ? “তাঁহার আলোক প্রজ্জ্বলিত রাখিবার” আল্লাহর ইচ্ছা-শক্তির পরাক্রমশীলতার তাৎপর্য কি ? যেমন অতি পূর্বে দৃষ্ট হইয়াছে, অবিশ্বাসীদের শত্রুতা এতই অধিক ছিল যে, এই সকল স্বর্গীয় সূর্যের একজনও কখনও কোনও আশ্রয়স্থান পান নাই, বা শান্তির পানপাত্র আস্বাদন করিতে সমর্থ হন নাই। তাঁহারা এইরূপ ভয়ঙ্করভাবে উৎপীড়িত হইয়াছিলেন যে, মানুষের মধ্যে অতি নিকৃষ্টতম লোকও এই সকল অস্তিত্বের সারাৎসারের উপর যথেচ্ছ দন্ড দিয়াছিল। এইসব যন্ত্রণা মানুষ দেখিয়াছে এবং তাহার পরিমাণও অবগত হইয়াছে। সুতরাং কি প্রকারে ঐরূপ লোক আল্লাহর এই সব বাক্য, এই সব চিরস্থায়ী প্রভাসম্পন্ন আয়াত উপলব্ধি ও ব্যাখ্যা করিতে পারে ?
কিন্তু এই সব আয়াতের তাৎপর্য তাহারা যাহা মনে করিয়াছে, তাহা নহে। না, বরং “প্রাধান্য”, “শক্তি”, ও “ক্ষমতা” প্রভৃতি শব্দ এক একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন পদবী ও ভিন্ন অর্থ সূচনা করে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, হজরত হোসেইন (রাঃ)-র ঐ সকল রক্তবিন্দু যাহা পৃথিবী সিক্ত করিয়াছে, তাহার প্রভাবের শক্তি সম্বন্ধে বিবেচনা করুন। সেই রক্তের পরম পবিত্রতা ও প্রভাবের মাধ্যমে ধুলি স্বয়ং মানব শরীর ও আত্মার উপর কিরূপ আশ্চর্যজনক প্রাধান্য ও প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল। ঐ প্রভাব এতই অধিক ছিল যে, যে-ব্যক্তি তাহার পীড়া হইতে আরোগ্য লাভ করিতে চাহিয়াছে, সে সেই পবিত্র স্থানের ধুলি স্পর্শ দ্বারা আরোগ্য লাভ করিয়াছে, এবং যে-ব্যক্তি তাহার ধন-সম্পদ রক্ষা করিতে ইচ্ছা করিয়া পূর্ণ বিশ্বাস ও জ্ঞানের সহিত সেই পবিত্র ধুলির সামান্য পরিমাণ অংশ তাহার গৃহে রাখিয়া দিয়াছে, তাহার সমুদয় সম্পত্তি নিরাপদ হইয়াছে। এই সকলই ইহার প্রভাবের বাহ্যিকভাবে প্রকাশিত নিদর্শন এবং আমরা যদি ইহার আভ্যন্তরীণ গুণাবলী বিশেষভাবে উল্লেখ করি, তাহা হইলে তাহারা নিশ্চয়ই বলিয়া উঠিবেঃ “তিনি নিশ্চয়ই ধুলিকণাকে প্রভূদের মহাপ্রভূ বলিয়া মনে করিয়াছেন, এবং আল্লাহর ধর্ম-বিশ্বাসকে সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করিয়াছেন।”
অধিকন্তু, হজরত হোসেইন (রাঃ)-র ধর্মার্থে আত্ম-বলিদান করার সময়ের লজ্জাকর অবস্থাসমূহ স্মরণ করুন। তাঁহার একাকিত্ব সম্বন্ধে চিন্তা করুন, এমন কি, বাহ্যতঃ তাঁহাকে সাহায্য করিবার জন্য, তাঁহার মৃতদেহ উঠাইয়া লইয়া গিয়া সমাহিত করিবার জন্য কাহাকেও পাওয়া গেল না। তথাপি, এক্ষণে দেখুন, কত অসংখ্য লোক পৃথিবীর অতি দূরবর্তী প্রান্ত হইতে তীর্থযাত্রীর বেশে তাঁহার সমাধিস্থান অন্বেষণ করিয়া আগমন করে, যাহাতে তাঁহার মাজারের আস্তানায় তাহাদের মস্তক স্থাপন করিতে পারে! আল্লাহর প্রাধান্য ও শক্তি এইরূপই! তাঁহার রাজত্ব ও মহিমার প্রভা এইরূপই!
হজরত হোসেইন (রাঃ)-র শাহাদাতের পরেই এই সব ঘটিয়াছিল, সেইজন্য মনে করিবেন না যে, এই সব মর্যাদা তাঁহার কোনও উপকারে আসে নাই। কারণ সেই পবিত্র আত্মা অবিনশ্বর, তিনি ঐশী জীবনযাপন করেন এবং স্বর্গীয় পুনর্মিলনের সিদ্রা বৃক্ষের উপর স্বর্গীয় প্রভা-রাজ্যের নিভৃত আশ্রয়ে বাস করিতেছেন। অস্তিত্বের এই সকল সারাৎসার আত্মোৎসর্গের উজ্জ্বল প্রতীক। তাঁহারা তাঁহাদের জীবন, তাঁহাদের সর্বসত্তা, তাঁহাদের আত্মা, তাঁহাদের তেজস্বীতা, তাঁহাদের যথাসর্বস্ব প্রিয়তম প্রেমাস্পদের পথে উৎসর্গ করিয়াছেন ও করিতে থাকিবেন। যতই উচ্চতর হউক না কেন, তাঁহাদের জন্য ইহা অপেক্ষা অধিকতর প্রিয়তম পদমার্যাদা তাঁহারা আকাঙ্খা করিতে পারেন না। কারণ তাঁহাদের প্রিয়তম প্রেমাস্পদের সন্তোষ ব্যতীত প্রেমিকদের অন্য কোনও বাসনা থাকিতে পারে না এবং তাঁহার সহিত পুনর্মিলন ব্যতীত তাঁহাদের অন্য কোনও লক্ষ্য নাই।
হজরত হোসেইন (রাঃ)-র আত্ম-বলিদানের রহস্যাবলীর ক্ষীণ প্রভাও যদি আপনাকে জানাইতে ইচ্ছা করি এবং ইহার ফলসমূহ আপনার নিকট প্রকাশ করি, তাহা হইলে এই পৃষ্ঠাসমূহ যথেষ্ট হইবে না এবং তাহার অর্থও শেষ হইবে না। আমাদের আশা এই যে, আল্লাহর ইচ্ছায়, অনুকম্পার সমীরণ প্রবাহিত হইতে পারে এবং স্বর্গীয় বসন্ত কাল অস্তিত্বের বৃক্ষকে নবজীবনের পরিচ্ছদে ভূষিত করিতে পারে, যাহার ফলে আমরা স্বর্গীয় জ্ঞান-বিজ্ঞতার রহস্যাবলী আবিষ্কার করিতে পারি এবং তাঁহারই বিধাতৃত্বে অন্য দ্রব্যাদির রহস্যাবলী আবিষ্কার করিতে পারি। আমরা এ-পর্যন্ত কেবল মুষ্টিমেয় কয়েকজন খ্যাতিশূন্য লোক আবিষ্কার করিয়াছি—যাঁহারা এই পদবী লাভ করিয়াছেন। আল্লাহর বিচার-মীমাংসা কি আদেশ করে এবং তাঁহার প্রত্যাদেশের রেজওয়ান-উদ্যানের চন্দ্রাপত কি অবতীর্ণ করে, ভবিতব্যই তাহা ঘোষণা করিবে। এইরূপে আমরা আল্লাহর ধর্মের আশ্চর্যজনক বিষয়াদি আপনার নিকট বিশেষ সবিস্তৃতভাবে বর্ণনা করিতেছি এবং স্বর্গীয় সুমধুর গানের স্বর আপনার কর্ণে বর্ষণ করিতেছি, যাহাতে আপনি সত্যজ্ঞানের উচ্চপদ লাভ করিতে পারেন এবং তাহার সুফল ভোগ করিতে পারেন। অতএব, আপনি নিশ্চয় করিয়া জানিয়া রাখুন যে, স্বর্গীয় মহিমার এ্ সকল সূর্য, যদিও তাহাদের বাসস্থান মৃত্তিকার উপর, তথাপি সর্বোচ্চ রাজ্যসমূহের প্রভাময় সিংহাসনই তাঁহাদের প্রকৃত বাসস্থান। যদিও তাঁহারা যাবতীয় পার্থিব সম্পদ হইতে বিচ্যুত, তথাপি তাঁহারা অপরিমিত বিভবসমূহের রাজ্যে উড্ডীন হন। এবং যদিও তাঁহারা শত্রুর কবলে ভয়ঙ্করভাবে নির্যাতিত হন, তত্রাচ তাঁহারা শক্তির দক্ষিণ হস্তে ও স্বর্গীয় রাজ্যে অবস্থান করেন। তাঁহাদের অবমাননার অন্ধকারের মধ্যেও অম্লান প্রভার আলোক তাঁহাদিগকে আলোকিত করে এবং তাঁহাদের নিঃসহায়তার মধ্যেও তাঁহাদের উপর অপরাজেয় আধিপত্যের নিদর্শনাবলী বর্ষিত হয়।
এই প্রকারে, মরিয়মের পুত্র যীশু, একদিন উপবেশন করিয়া পবিত্রাত্মার সুরে কথা বলিতেছিলেন, তখন এই সকল বাক্য উচ্চারণ করিয়াছিলেন ঃ “হে মনুষ্যগণ, আমার খাদ্য মাঠের ঘাস, যদ্দদ্বারা আমি আমার ক্ষুধা নিবৃত্ত করি। আমার শয্যা ধুলি, রাত্রিতে আমার প্রদীপ হইল চন্দ্রের আলো, আমার অশ্ব হইল আমার পদদ্বয়। দেখ, পৃথিবী-পৃষ্ঠে আমা অপেক্ষা ধনী কে ?” আল্লাহর ন্যায়পরায়ণতার শপথ! সহস্র সহস্র ধন-ভান্ডার এই দারিদ্রের চতুর্দিকে পরিবেষ্টন করিয়া আছে এবং মহিমার অসংখ্য রাজত্ব এইরপ অবমাননার জন্য উৎসুক হইয়া রহিয়াছে! এই সকল বাক্যের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য-রূপ মহাসাগরের এক বিন্দুও যদি লাভ করিতে সক্ষম হন, তাহা হইলে আপনি নিশ্চয়ই সংসার ও তন্মধ্যস্থ সকলই পরিত্যাগ করিবেন এবং অমর “ফীনিক্স’ পক্ষীর ন্যায় অমর-অগ্নির শিখায় নিজেকে ভস্মীভূত করিবেন।
এইরূপে বর্ণিত হইয়াছে যে, একদিন হজরত সাদেক (রাঃ)-র জনৈক সঙ্গী তাঁহার নিকট দরিদ্রতা সম্বন্ধে অসন্তোষ প্রকাশ করিল। তাহাতে সেই অবিনশ্বর সুষমা, সাদেক, উত্তরে বলিলেনঃ “নিশ্চয়ই তুমি ধনী, এবং নিশ্চয়ই তুমি ঐশ্বর্যের চুমুক পান করিয়াছ”। সেই দারিদ্র প্রপীড়িত লোকটি সেই আলোকিত আননের উচ্চারিত বাক্যে হতভম্ব হইয়া বলিলঃ “আমার সম্পদ কোথায়, আমি ত একটি মাত্র মুদ্রারও ভিখারী ?” তাহাতে হজরত সাদেক (রাঃ) বলিলেন, “তুমি কি আমাদের ভালবাসা পোষণ কর না ?” সে উত্তর করিলঃ “হ্যাঁ ! হে আল্লাহর রসুলের বংশধর, তাহা আমার আছে। ইমাম সাদেক (রাঃ) তৎপর তাহাকে এই বলিয়া প্রশ্ন করিলেনঃ “ তুমি কি এই ভালবাসা এক হাজার দিনারের পরিবর্তে বিনিময় করিবে ?” সে উত্তর দিলঃ “না, আমি কখনই ইহা বিনিময় করিব না, যদিও এই পৃথিবী ও তন্মধ্যস্থিত সমস্ত-কিছুই আমাকে দেওয়া হয়।” তৎপর ইমাম সাদেক (রাঃ) এই মন্তব্য করিলেনঃ “যাহার নিকট এহেন ধন-ভান্ডার আছে, তাহাকে কি প্রকারে দরিদ্র আখ্যা দিব ?”
এই দারিদ্র ও এই সকল বিভব, এই হীনতা ও এই মর্যাদা, এই রাজত্ব, শক্তি ইত্যাদি, যাহার উপর এই সকল বৃথা-গর্বিত ও মূর্খ লোকদের দৃষ্টি ও অন্তর নিবদ্ধ, তাঁহার দরবারে এই সকলই শূন্যতায় পর্যবসিত হয়। তিনি বলিয়াছেনঃ “ হে মানবমন্ডলী, তোমরা দরিদ্র আল্লাহর সমক্ষে ! এবং আল্লাহ্ই ধনী, (স্বয়ংসম্পূর্ণ)।” (ক্বোরআন ৩৫।১৫)। “সম্পদ” শব্দ দ্বারা আল্লাহ্ ব্যতীত আর সকল হইতে মুক্ত এবং “দারিদ্র” শব্দ দ্বারা আল্লাহর প্রদত্ত যাবতীয় বিষয়ের অভাব বুঝান হইয়াছে।
একই প্রকারে, ঐ দিবসটি স্মরণ করুন, যখন ইহুদীরা মরিয়মের পুত্র হজরত ঈসা (আঃ)-কে পরিবেষ্টন করিয়া, তাঁহাকে তাঁহার মসীহ্ত্ব ও নবীত্বের পদবী স্বীকার করাইবার জন্য ভিড় জমাইয়াছিল, যাহাতে তাহারা তাঁহাকে একজন অবিশ্বাসী বলিয়া ঘোষণা করিতে ও মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করিতে পারে। তৎপর, যিনি স্বর্গীয় ধর্মাকাশের সূর্য ছিলেন, তাঁহাকে তাহারা পীলাত ও সেই সময়ের প্রধান মহাযাজক কেয়াফার নিকট লইয়া গেল, মহাযাজকেরা সকলেই রাজবাড়ীতে একত্রিত হইল, তাহাদের সঙ্গে অসংখ্য লোকজন ছিল, তাহারা তাঁহার কাৎরানি দেখিবার জন্য, তাঁহাকে বিদ্রুপ করিবার ও কষ্ট দেওয়ার জন্য সমবেত হইয়াছিল। যদিও তাহারা তাঁহাকে বার বার এই আশায় প্রশ্ন করিয়াছিল যে, তিনি তাঁহার দাবি স্বীকার করিবেন, তত্রাচ যীশু শান্তভাব ধারণ করিলেন এবং কোন কথাই বলিলেন না। অবশেষে একজন অভিশপ্ত ব্যক্তি দাড়াইল এবং যীশুর নিকটবর্তী হইয়া তাঁহাকে শপথ করিয়া বলিল ঃ “তুমি কি স্বর্গীয় মসীহ্ত্বের দাবি কর নাই ? তুমি কি বল নাই, ‘আমি রাজাদের সম্রাট, আমার বাক্য আল্লাহর বাক্য, আমি বিশ্রাম দিবসের আদেশ রহিতকারী ?” তৎপর যীশু তাঁহার মস্তক উত্তোলন করিলেন এবং বলিলেন ঃ “তুমি কি মনুষ্যপুত্রকে শক্তি ও ক্ষমতার দক্ষিণ হস্তে বসিতে দেখিতে পাইতেছ না ?” এই সব তাঁহারই বাক্য, তত্রাচ, দেখুন, বাহ্য দৃষ্টিতে তিনি কিরূপ সর্বশক্তিহীন ছিলেন; কিন্তু আভ্যন্তরীণ ঐশী শক্তি ব্যতীত, যাহা পার্থিব ও স্বর্গীয় সমস্ত-কিছুই বেষ্টন করিয়াছিল। এই সমস্ত কথা বলার পর তাঁহার উপর যাহা যাহা ঘটিয়াছিল, তাহা আমি কি প্রকারে বর্ণনা করিতে পারি ? তাঁহার প্রতি যেরূপ ঘৃণিত ব্যবহার তাহারা করিয়াছিল, তাহা আমি কিরূপে লিখিব ? অবশেষে তাহারা তাঁহার পবিত্র দেহের উপর এরূপ যন্ত্রণা পুঞ্জীভূত করিয়াছিল যে, চতুর্থ স্বর্গে তাঁহাকে উড্ডীন করিতে হইয়াছিল।
সন্ত লুক লিখিত সুসমাচারে লিপিবদ্ধ আছে যে, একদিন যীশু পক্ষাঘাত রোগগ্রস্ত একজন ইহুদীর নিকট দিয়া চলিয়া যাইতেছিলেন। সেই ইহুদী একটি খাটে শায়িত ছিল। ইহুদী যখন তাঁহাকে দেখিল, সে তাঁহাকে চিনিতে পারিল এবং তাঁহার নিকট সাহায্য প্রার্থনা করিল। যীশু তাহাকে বলিলেনঃ “তোমার শয্যা হইতে উত্থান কর; তোমার পাপ ক্ষমা করা হইয়াছে।” জনৈক ইহুদী, যে নিকটে দাঁড়াইয়া ছিল, সে বলিলঃ ‘আল্লাহ্ ব্যতীত আর কে-ই বা পাপ ক্ষমা করিতে পারে ?’ এবং তৎক্ষণাৎ তিনি তাহাদের মনের ভাব বুঝিতে পারিয়া উত্তরে বলিলেনঃ ‘একজন পক্ষাঘাতীকে তুমি উঠ এবং তোমার শয্যা লইয়া হাঁটিয়া চল, এ কথা বলা কি সহজ, না তাহাকে ইহা বলা সহজ যে, ‘তোমার পাপ ক্ষমা করা হইয়াছে’, যাহাতে তুমি জানিতে পার যে, মনুষ্য-পুত্রের পৃথিবীতে পাপ ক্ষমা করার ক্ষমতা আছে।” (মার্কস ২।৩-১২)। ইহাই প্রকৃত আধিপত্য এবং এইরূপই হইতেছে আল্লাহর মনোনীত পুরুষগণের শক্তি। এই সকল বিষয় যাহা আমরা বার বার উল্লেখ করিয়াছি এবং বিভিন্ন স্থান হইতে যে বিশেষ বিবরণাদি উদ্ধৃত করা হইয়াছে, তাহাতে আমাদের অন্য কোনও উদ্দেশ্য ছিল না, ইহা ব্যতীত, যেন আল্লাহর মনোনীত পুরুষগণের উচ্চারিত বাক্যাবলীতে যে সমস্ত ইঙ্গিত দেওয়া হইয়াছে, তাহার মর্ম আপনি উপলব্ধি করিতে পারেন, পাছে এই সমস্ত বাক্যের কতকগুলি দ্বারা আপনার পদস্খলন হয় এবং আপনার অন্তর ভীতিগ্রস্ত হয়।
এইরূপে ধীর-স্থির পদ-বিক্ষেপে আমরা সুনিশ্চয়তার পথে চলিতে পারি, যাহাতে হয়ত আল্লাহর সন্তোষের সবুজ ময়দানসমূহ হইতে যে মৃদু সমীরণ প্রবাহিত হয়, তাহা স্বর্গীয় অনুমোদনের সুমধুর সৌরভ আমাদের নিকট বহন করিয়া লইয়া আসিতে পারে এবং আমরা নশ্বর মানবকে অনন্ত আভা রাজ্যে পৌঁছাইয়া দিতে পারি। তখনই আপনি সর্বাধিপত্য ও তদ্রƒপ শব্দাদি, যাহা হাদীস ও ধর্মগ্রন্থসমূহে উল্লিখিত হইয়াছে, উহার অন্তর্নিহিত মর্মাদি উপলব্ধি করিতে সক্ষম হইবেন। অধিকন্তু, ইতিপূর্বে আপনার নিকট ইহা সুস্পষ্ট হইয়াছে এবং আপনি ইহা অবগত রহিয়াছেন যে, ইহুদী ও খ্রীস্টানেরা যে সকল মত আঁকাড়াইয়া ধরিয়া রহিয়াছে এবং তাহারা হজরত মোহাম্মদ (সঃ)-র সুষমার উপর যে সমস্ত মিথ্যা অপবাদ পুঞ্জীভূতভাবে বর্ষণ করিয়াছে, ক্বোরআন গ্রন্থের অনুসারী লোকেরা অদ্যকার দিনে সেইগুলিই আঁকড়াইয়া ধরিয়া রহিয়াছে এবং “বয়ান-বিন্দু” অর্থাৎ হজরত বা’বকে অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যান করার বেলায় সেই একই রকম অপবাদ ও আপত্তি পরিদৃষ্ট হইতেছে—স্বর্গীয় ধর্মরাজ্যে অবস্থিত সকল আত্মা তাঁহার জন্য উৎসর্গীকৃত হউক। তাহাদের মূর্খতা অবলোকন করুন ঃ পুরাতন কালের ইহুদীদের দ্বারা উচ্চারিত একই প্রকার বাক্য তাহারাও উচ্চারণ করিতেছে, আপনি কি তাহা জানেন না ? তাহাদের সম্বন্ধে তাঁহার বাক্য কতই উপযোগী এবং সত্যঃ “তাহাদিগকে তাহাদের বিতর্ক-ক্রীড়ার মধ্যে পরিত্যাগ কর।” (ক্বোরআন ৬।৯১)। “তোমার জীবনের শপথ, হে মোহাম্মদ (সঃ)! তাহারা তাহাদের মিথ্যা ধারণার নেশার ঘোরে অন্ধের মত ঘুরিতেছে।” (ক্বোরআন ১৫।৭২)।
যখন অদৃশ্য, অনাদি-অনন্ত, স্বর্গীয় সারাৎসার জ্ঞানের চক্রবালের উপর মোহাম্মদী সূর্যকে উদিত করিলেন, তখন ইহুদী ধর্মাচার্যগণ যে সকল মিথ্যা অপবাদ তাঁহার বিরুদ্ধে উত্থাপন করিয়াছিল তন্মধ্যে একটি এই ছিল যে, হজরত মূসা (আঃ)-র পর আল্লাহ্ আর কোনও পয়গম্বর পাঠাইবেন না। হ্যাঁ, সত্য বটে, ধর্মগ্রন্থসমূহে উল্লেখ আছে যে, একটি মহান আত্মার অভ্যুত্থান নিশ্চয়ই ঘটিবে; কিন্তু তিনি মূসা (আঃ)-র ধর্মের উন্নতি সাধন করিবেন এবং তিনি মূসা (আঃ)-র ধর্মাবলম্বী লোকদের স্বার্থ বর্ধিত করিবেন, যাহাতে মূসা (আঃ)-র ধর্ম-বিধানের আইনকানুন সমস্ত পৃথিবী বেষ্টন করিতে পারে। এইরূপে অনাদি-অনন্ত প্রভার সম্রাট তাঁহার গ্রন্থে ঐ সমুদয় বাক্যের প্রতি ইঙ্গিত করিয়াছেন, যাহা দূরবর্তী ও ভ্রান্তিপূর্ণ উপত্যকায় পরিভ্রমণকারীদের দ্বারা উচ্চারিত হইয়াছিলঃ “ ইহুদীরা বলে যে, ‘আল্লাহর হস্ত শৃঙ্খলাবদ্ধ’; তাহাদের নিজেদের হস্তসমূহ শৃঙ্খলাবদ্ধ হউক! এবং তাহারা যাহা বলিয়াছিল, তজ্জন্য তাহারা অভিশপ্ত হইয়াছিল। শুধু ইহাই নহে, তাঁহার উভয় হস্ত সুপ্রসারিত।” (ক্বোরআন ৫।৬৪)। “আল্লাহর হস্ত তাহাদের হস্তের ঊর্দ্ধে।” (ক্বোরআন ৪৮।১০)।
যদিও পবিত্র ক্বোরআনের ব্যাখ্যাকর্তাগণ এই আয়াতটি অবতরণের কারণ সম্বন্ধে নানা অবস্থাদি নানা প্রকারে বর্ণনা করিয়াছে, তত্রাচ আপনার উচিত ইহার উদ্দেশ্য উপলব্ধি করিতে চেষ্টা করা। তিনি বলেনঃ “ ইহুদীরা যাহা কল্পনা করিয়াছে, তাহা কতই মিথ্যা। যিনি সত্য সত্যই সম্রাট, যিনি মূসা (আঃ)-র আনন্দ-বিভূতি প্রকাশিত করিয়াছিলেন এবং তাঁহাকে নবীত্বের পরিচ্ছদ প্রদান করিয়াছিলে, তাঁহার হস্ত কি প্রকারে শৃঙ্খলাবদ্ধ ও বেড়ীযুক্ত হইতে পারে ? কি প্রকারে ইহা কল্পনা করা যাইতে পারা যায় যে, তিনি মূসা (আঃ)-র পরে আরও একজন ঐশী সংবাদবাহক আবির্ভূত করিতে অক্ষম ? তাহাদের বাক্যের যুক্তি-বিরুদ্ধতা সম্বন্ধে ভাবিয়া দেখুন; জ্ঞান ও সত্যের উপলব্ধির পথ হইতে ইহারা কতদূরে চলিয়া গিয়াছে! আরও লক্ষ্য করিয়া দেখুন, বর্তমান যুগেও এই সমস্ত লোক এইরূপ অজ্ঞতাপূর্ণ যুক্তিবিরুদ্ধ ধারণাসমূহে লিপ্ত রহিয়াছে। এক হাজারেরও অধিক বৎসর যাবৎ তাহারা এই আয়াত আবৃত্তি করিতেছে এবং অজ্ঞতা সহকারে ইহুদীদের বিরুদ্ধে নিন্দাবাদ উচ্চারণ করিতেছে; কিন্তু তাহারা সম্পূর্ণরূপে অজ্ঞাত যে, তাহারা নিজেরাই প্রকাশ্যে ও অলক্ষিতে ইহুদীদেরই বিশ্বাস ও ধারণাগুলিই প্রকাশ করিতেছে। আপনি তাহাদের এই অলস বিরোধিতা সম্বন্ধে নিশ্চয়ই অবগত আছেন যে, যাবতীয় ঐশী প্রকাশ শেষ হইয়া গিয়াছে, স্বর্গীয় অনুকম্পার দ্বারসমূহ বন্ধ হইয়া গিয়াছে, অনাদি-অনন্ত পবিত্রতার প্রভাতসমূহ হইতে আর সূর্য উদিত হইবে না, চিরস্থায়ী বদান্যতার মহাসাগর চিরকালের জন্য নিস্তব্ধ হইয়া গিয়াছে, এবং, অনাদি-অনন্ত প্রভা-রাজ্যের মন্দির হইতে রসুলগণের প্রকাশ রহিত হইয়া গিয়াছে। এই সকল ক্ষুদ্রমনা, ঘৃণার্হ ব্যক্তির উপলব্ধির পরিমাপ ইহাই। এই সকল লোক মনে করিয়াছে যে, আল্লাহর সর্ববেষ্টনকারী অনুগ্রহ ও প্রাচুর্যপূর্ণ করুণাদির প্রবাহ নিস্তব্ধ হইয়া গিয়াছে; কিন্তু কোনও মনই ইহার বিরতি কল্পনা করিতে পারে না। প্রত্যেক দিক হইতে উত্থিত হইয়া অত্যাচারের জন্য তাহারা কোমর বাঁধিয়াছে এবং চরম উদ্যম প্রয়োগ করিয়াছে, যেন তাহাদের বৃথা কাল্পনিক তিক্ত জল দ্বারা আল্লাহর জ্বলন্ত ঝোপের অগ্নিশিখা নির্বাপিত করিতে পারে; কিন্তু এই বিষয় তাহারা সম্পূর্ণ বিস্মৃত হইয়াছে যে, শক্তির গোলক নিজ শক্তিশালী দুর্গ-প্রাচীরের অভ্যন্তরে আল্লাহর প্রদীপ রক্ষা করিবে। এই সমস্ত লোক যে অতীব দীনহীন অবস্থার মধ্যে পতিত হইয়াছে, তাহা নিশ্চয়ই তাহাদের জন্য যথেষ্ট, যেহেতু তাহারা আল্লাহর ধর্ম-বিধানের মূল উদ্দেশ্য চিনিয়া লইতে ও ইহার রহস্যের ও মূলসূত্রের জ্ঞান-লাভ হইতে বঞ্চিত হইয়াছে। কারণ, অত্যুচ্চ ও শ্রেষ্ঠতম অনুকম্পা, যাহা মানবকে প্রদান করা হইয়াছে তাহা হইতেছে “আল্লাহর সাক্ষাৎকার লাভ করার” এবং তাঁহাকে চিনিয়া লওয়ার অনুকম্পা এবং সকল মনুষ্যকেই ইহার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হইয়াছে। মানবের প্রতি সর্ববদান্যতাপূর্ণ, অনাদি-অনন্ত আল্লাহর প্রদত্ত ইহাই চরম অনুগ্রহ এবং তাঁহার সৃষ্টজীবের উপর ইহাই তাঁহার অসীম বদান্যতার পরিপূর্ণতা। এই সকল লোকের কেহই এই অনুকম্পা ও বদান্যতার অংশ গ্রহণ করে নাই, আর তাহারা এই অত্যুচ্চ শ্রেষ্ঠত্বের সম্মানও লাভ করে নাই। কত অসংখ্য অবতীর্ণ আয়াত এই অতি গুরুত্বপূর্ণ সত্যের ও অত্যুন্নত বিষয়ের সম্বন্ধে সুস্পষ্টভাবে সাক্ষ্য দিতেছে। তত্রাচ তাহারা ইহা প্রত্যাখ্যান করিয়াছে এবং ইচ্ছানুসারে তাহারা ইহার অপব্যাখ্যা করিয়াছে। যেমন তিনি অবতীর্ণ করিয়াছেনঃ “এবং যাহারা আল্লাহর নিদর্শনসমূহ এবং তাঁহার সহিত সাক্ষাৎকার লাভ সম্বন্ধে অস্বীকার করে, তাহারাই আমার করুণা হইতে নিরাশ হইবে এবং তাহাদের জন্যই যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি অপেক্ষা করিতেছে।” (ক্বোরআন ২৯।২৩)। তিনি আরও বলেনঃ “তাহারা- যাহারা মনে মনে ধারণা করে যে, নিশ্চয়ই তাহারা তাহাদের প্রভূর সাক্ষাৎকার লাভ করিবে এবং তাহারা তাঁহারই দিকে প্রত্যাগমন করিবে।” (ক্বোরআন ২।৪৬)। অন্য এক স্থানে তিনি বলেনঃ “যাহাদের ধারণা ছিল যে, তাহারা নিশ্চয়ই আল্লাহর সহিত সাক্ষাৎকার লাভ করিবে, তাহারা বলিয়াছিলঃ ‘আল্লাহর আদেশে অনেক সময় ক্ষুদ্র দল বৃহৎ দলের উপর জয়লাভ করিয়াছে’।” ( ক্বোরআন ২।২৪৯)। আর এক স্থানে তিনি অবতীর্ণ করিয়াছেনঃ “অতএব, যে ব্যক্তি আল্লাহর সাক্ষাৎকার লাভের আশা রাখে, সে যেন ভাল কাজ করে।” (ক্বোরআন ১৮।১১১)। তিনি আরও বলিয়াছেনঃ “তিনি সমস্ত-কিছুই সুনিয়ন্ত্রিত করেন। তিনি তাঁহার নিদর্শনসমূহ সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেন, যাহাতে তোমরা তোমাদের প্রভূর সাক্ষাৎকার লাভ সম্বন্ধে সুনিশ্চিত বিশ্বাস পোষণ করিতে পার।” (ক্বোরআন ১৩।২)।
এই সমস্ত লোক এই সমস্ত আয়াতের মর্মার্থ প্রত্যাখ্যান করিয়াছে অথচ এই আয়াতসমূহ নির্ভুলরূপে “স্বর্গীয় সাক্ষাৎকার লাভে”র বাস্তবতা সম্বন্ধে সাক্ষ্য দিতেছে। পবিত্র গ্রন্থসমূহে অন্য কোনও বিষয় অধিকতর গুরুত্বের সহিত এইরূপ সুদৃঢ়ভাবে লিপিবদ্ধ করা হয় নাই। ইহা সত্ত্বেও তাহারা এই সু-উচ্চ ও অতীব প্রশংসিত মর্যাদা, এই অত্যুচ্চ ও শ্রেষ্ঠ পদবী হইতে নিজেদের বঞ্চিত করিয়াছে। কেহ কেহ এইরূপ বিরুদ্ধ মত প্রকাশ করিয়াছে যে, “স্বর্গীয় সাক্ষাৎকার লাভে”র তাৎপর্য হইতেছে পুনরুত্থান দিবসে আল্লাহর “অবতরণ” (অভ্যুত্থান)। যদি তাহারা বলে যে, আল্লাহর “অবতরণে”র অর্থ একটি “সার্বজনীন আবির্ভাব”, তাহা হইলে ইহা পরিষ্কার ও সুস্পষ্ট যে, এইরূপ আবির্ভাব সকল বস্তুর মধ্যে ইতিপূর্বেই বিদ্যমান আছে। ইহার সত্যতা আমরা ইতিপূর্বে প্রতিষ্ঠা করিয়াছি, কারণ আমরা দেখিয়াছি যে, সকল কিছুই সেই আদর্শ সম্রাটের উজ্জ্বলতার গ্রহণকারী ও প্রকাশকারী এবং ইহাও দেখিয়াছি যে, সেই সূর্য—যাহা সকল উজ্জ্বলতার উৎস, তাহার আবির্ভাবের নিদর্শনাবলী সৃষ্ট জীবদের দর্পণসমূহে অবস্থান করে ও প্রকাশ পাইয়া থাকে। শুধু ইহাই নহে, বরং মানুষ যদি স্বর্গীয় ও আধ্যাত্মিক তীক্ষè বুদ্ধি সহকারে দৃষ্টিপাত করে, তাহা হইলে সে সহজে চিনিয়া লইতে পারিবে যে, এই আদর্শ সম্রাট আল্লাহর বিভূতির আবির্ভাব ব্যতীত কিছুই অস্তিত্ব জগতে আগমন করিতে পারে না। বিবেচনা করিয়া দেখুন, কি প্রকারে সমুদয় সৃষ্ট পদার্থ অতীব বাগ্মিতা সহকারে সেই আভ্যন্তরীণ আলোকের আবির্ভাব সম্বন্ধে সাক্ষ্য প্রদান করে। অবলোকন করুন, কি রূপে প্রত্যেক দ্রব্যের মধ্যে আল্লাহর ‘রেজওয়ান’-উদ্যানের দ্বারসমূহ উন্মুক্ত করা হয়, যাহাতে সত্য অনুসন্ধানকারীরা উপলব্ধি ও বিজ্ঞতার নগরসমূহে পৌঁছিতে পারে এবং জ্ঞান ও শক্তির উদ্যানসমূহে প্রবেশ লাভ করিতে পারে। প্রত্যেক উদ্যানের মধ্যে উচ্চারিত বাক্যাবলীর প্রকোষ্ঠের অভ্যন্তরে মর্মার্থের রহস্যময়ী বধূকে পরম সৌন্দর্য ও অলঙ্কারে বিভূষিত হইয়া সুরক্ষিত দেখিতে পাইবে। ক্বোরআন গ্রন্থের অধিকাংশ আয়াত এই আধ্যাত্মিক বিষয় প্রকাশ করে ও ইহার সাক্ষ্য প্রদান করে। এই আয়াতঃ “এমন কিছুই নাই, যাঁহা তাঁহার প্রশংসার্হ মহিমা কীর্তণ করে না।” (ক্বোরআন ১৭।৪৪), সেই সম্বন্ধে উৎকৃষ্ট সাক্ষ্য; “এবং আমরা এই সকল বিষয়ই চিহ্নিত করিয়াছি ও লিখিয়া রাখিয়াছি” (ক্বোরআন ৭৮।২৯), এই আয়াত এই সম্বন্ধে একটি বিশ্বাসযোগ্য সাক্ষী। এক্ষণে, যদি “আল্লাহর সাক্ষাৎকার লাভ” বাক্য দ্বারা এইরূপ অবতীর্ণ বাণীর জ্ঞান-লাভের অর্থ করা হয়, তাহা হইলে ইহা সুস্পষ্ট যে, সকল মানবই ইতিপূর্বে সেই অতুলনীয় সম্রাটের অপরিবর্তনীয় আননের সাক্ষাৎ লাভ করিয়াছে। তবে কেন এইরূপ আবির্ভাব কেবল পুনরুত্থান দিবসের জন্য সীমাবদ্ধ করিতেছেন ?
এবং যদি তাহারা এই ধারণা আঁকড়াইয়া রাখিতে চায় যে, “স্বর্গীয় সাক্ষাৎকার” অর্থ আল্লাহর বিশেষ আবির্ভাব”, যেমন কিছু সংখ্যক আধ্যাত্মিক সুফী ব্যক্তি ইহাকে “অত্যধিক পবিত্র প্রভা-বিকিরণ” বলিয়া প্রকাশ করে, যদি ইহা স্বয়ং সার সত্তাতেই অবস্থিত, তাহা হইলে ইহা সুস্পষ্ট যে, ইহা চিরকাল স্বর্গীয় জ্ঞানেই অবস্থিত। এই অনুমানের সত্যতা স্বীকার করিয়া লইলে এই অর্থে “স্বর্গীয় সাক্ষাৎকার লাভ” স্পষ্টতঃ কাহারও পক্ষে সম্ভবপর নহে, কারণ এই আবির্ভাব নিগূঢ় আভ্যন্তরীণ সত্তাতেই সীমাবদ্ধ, যাহা কোনও মানুষ লাভ করিতে পারে না । “এই পথ রুদ্ধ এবং সকল প্রকার অনুসন্ধানই অগ্রাহ্য।” অন্ধকারাচ্ছন্ন ও সীমাবদ্ধ অন্তরসমূহের উপলব্ধির কথা দূরে থাকুক, স্বর্গের অনুগৃহীত ব্যক্তিগণের মন যত উর্দ্ধে উড্ডীন হউক না কেন, কখনও এই উচ্চ পদলাভ করিতে পারে না।
এবং যদি তাহারা বলে যে, “স্বর্গীয় সাক্ষাৎকার” দ্বারা “আল্লাহর অপ্রধান আবির্ভাব” অর্থ করা হয় এবং ইহাকে “পবিত্র প্রভা-বিকিরণ” রূপে ব্যাখ্যা করা হয়, তাহা হইলে ইহা স্বীকৃতিপ্রাপ্ত মতে সৃষ্টি-জগতের প্রতিই প্রযোজ্য, অর্থাৎ আল্লাহর মৌলিক ও প্রাথমিক প্রকাশেরই রাজ্যে। এইরূপ আবির্ভাব তাঁহার সুসংবাদদাতা পয়গম্বরগণ ও মনোনীত পুরুষগণের জন্যই সীমাবদ্ধ, কারণ অস্তিত্ব জগতে তাঁহাদের অপেক্ষা অধিকতর শক্তিশালী আর কেহ আবির্ভূত হন নাই। এই সত্য সকলেই স্বীকার করে এবং সকলেই ইহার সাক্ষ্য প্রদান করে। আল্লাহর এই সকল পয়গম্বর ও মনোনীত পুরুষগণ আল্লাহর সকল অপরিবতর্নীয় গুণ ও নামের আধার ও প্রকাশক, তাঁহারই দর্পণ, যাঁহারা আল্লাহর আলোককে সঠিকভাবে ও বিশ্বস্ততার সহিত প্রতিফলিত করে। তাঁহাদের প্রতি যাহা প্রযোজ্য, বাস্তবিক পক্ষে স্বয়ং আল্লাহর প্রতি ও যিনি যুগপৎভাবে দৃশ্য ও অদৃশ্য, তাহাই প্রযোজ্য। যিনি সকল বস্তুরই মূল, তাঁহার জ্ঞান লাভ ও তাঁহার সান্নিধ্য লাভ, সত্য-সূর্য হইতে উদ্ভূত এই সকল উজ্জ্বল সত্তার জ্ঞানেরও সান্নিধ্য-প্রাপ্তির মাধ্যম ব্যতীত অসম্ভব। অতএব, এই সকল পবিত্র জ্যোতিষ্কের সান্নিধ্য বা দর্শন লাভ দ্বারা স্বয়ং “আল্লাহর সাক্ষাৎ লাভ” হয়। তাঁহাদের জ্ঞান হইতে আল্লাহর জ্ঞান অবতীর্ণ হয়, এবং তাঁহাদের আননের আলোক হইতে আল্লাহর মুখশ্রীর উজ্জ্বলতা প্রকাশিত হয়। এই সকল বৈরাগ্যের সারবত্তা, যাঁহারা একাধারে আদি ও অন্ত, দৃশ্য ও অদৃশ্য, ইঁহাদেরই বহুবিধ গুণের মাধ্যমে ইহা স্পষ্ট হয় যে, তিনি, যিনি সত্যের সূর্য, তিনি “আদি ও অনন্ত, দৃশ্য ও অদৃশ্য” (ক্বোরআন ৫৭।৩)। এইরূপে আল্লাহর অন্যান্য উচ্চ নামসমূহ ও মহিমান্বিত গুণাবলী উপলব্ধি করুন। সুতরাং, যে-কেহ, যে-কোন ধর্ম-বিধানকালে এই সকল উজ্জ্বল ও অত্যুৎকৃষ্ট জ্যোতিষ্ককে চিনিতে পারিয়াছে এবং তাঁহাদের লাভ করিয়াছে, সে বাস্তবিকই স্বয়ং “আল্লাহর সাক্ষাৎকার” লাভ করিয়াছে, এবং এই অনাদি-অনন্ত ও অবিনশ্বর জীবন-নগরে প্রবেশ লাভ করিয়াছে। এইরূপ দর্শন বা সাক্ষাৎকার লাভ কেবল পুনরুত্থান দিবসেই সম্ভবপর, যে-দিন আল্লাহর সার্বজনীন আবির্ভাবের মাধ্যমে স্বয়ং তাঁহারই অভ্যুত্থানের দিন।
ইহাই “পুনরুত্থান দিবসে”র অর্থ, যাহা সকল ধর্মগ্রন্থে উল্লিখিত হইয়াছে এবং সকল লোকের নিকট ঘোষণা করিয়াছে। ভাবিয়া দেখুন, ইহা অপেক্ষা কি অধিকতর মূল্যবান, শক্তিশালী, উজ্জ্বল দিবস কল্পনা করা যায় যে, মানব স্বেচ্ছায় ইহার প্রসাদ পরিত্যাগ করিবে, এবং ইহার বদান্যতাসমূহ হইতে নিজেকে বঞ্চিত রাখিবে, যাহা বসন্তকালীন বারি-ধারার ন্যায় করুণার স্বর্গ হইতে সকল মানুষের উপর বর্ষিত হইতেছে ? এইরূপে নিঃসন্দিগ্ধভাবে ইহা প্রমাণ করার পর, যে, এইদিন অপেক্ষা কোনও দিনই মহৎ নহে, কোনও আবির্ভাবই এই স্বর্গীয় আবির্ভাব অপেক্ষা উজ্জ্বলতর নহে এবং এই সকল গুরুত্বপূর্ণ ও অভ্রান্ত প্রমাণ, যাহা সম্বন্ধে কোনও বোধসম্পন্ন ব্যক্তি তুচ্ছ জ্ঞান করিতে পারে না, এবং কোনও বিদ্বান ব্যক্তি তুচ্ছ জ্ঞান করিতে পারে না, তাহা পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করা সত্ত্বেও কিরূপে ইহা সম্ভব হইতে পারে যে, মানুষ সন্দেহাচ্ছন্ন ও ভ্রান্ত ধারণাপূর্ণ লোকের অলস বিসম্বাদের কারণে এইরূপ ঐশ্বর্যশালী অনুকম্পা হইতে নিজেকে বঞ্চিত করিয়া রাখিতে পারে ? তাহারা কি সেই সর্বজনবিদিত হাদীস শুনিতে পায় নাইঃ “যখন ক্বায়েম আবির্ভূত হইবেন, সেই দিনই পুনরভ্যুত্থানের দিন ? ” এইরূপে, ধর্ম-নেতা ইমামগণ, সেই সকল স্বর্গীয় পথপ্রদর্শনকারী অনির্বচনীয় আলোক, ক্বোরআনের এই আয়াত এইরূপভাবে ব্যাখ্যা করিয়াছেনঃ “তাহারা কেবল ইহাই প্রতীক্ষা করিতেছে যে, আল্লাহ্ স্বর্গীয় দূতগণের সহিত মেঘপুঞ্জের ছায়াতলে তাহাদের নিকট উপস্থিত হইবেন।” (ক্বোরআন ২।২১০)—এই আয়াতে কথিত নিদর্শনটি যাহা তাঁহারা নিঃসন্দিগ্ধরূপে পুনরুত্থান দিবসের একটি প্রধান বিশিষ্ট লক্ষণ বলিয়া মনে করিয়াছেন—ইহা ক্বায়েম ও তাঁহার আবির্ভাবের প্রতি ইঙ্গিত করিতেছে বলিয়া তাঁহারা ব্যাখ্যা করিয়াছেন।
অতএব, হে ভ্রাতঃ! “পুনরুত্থান” শব্দের অর্থ উপলব্ধি করিতে চেষ্টা করুন এবং এই সকল পরিত্যক্ত লোকের অলস বাক্যাবলী হইতে আপনার কর্ণদ্বয় পরিষ্কার করুন। আপনি যদি পূর্ণ বৈরাগ্যের রাজ্যে পদ-বিক্ষেপ করেন, তাহা হইলে আপনি অবাধে এই সাক্ষ্য দিবেন যে, এই দিন অপেক্ষা কোনও দিনই অধিকতর শক্তিশালী নহে এবং এই অভ্যুত্থান দিবস অপেক্ষা কোন অভ্যুত্থান দিবসই অধিকতর ভয়াবহ বলিয়া কখনও কল্পনা করা যাইতে পারা যায় না। এই দিনে সম্পাদিত একটিমাত্র সৎ কার্য, মানুষ অসংখ্য শতাব্দীতে যে সকল পূণ্য কার্য করিয়াছে, তাহার সমতুল্য হইবে না; শুধু ইহাই নহে, বরং এইরূপ তুলনার জন্য আমরা আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করি! যেহেতু, নিশ্চয়ই, এইরূপ কার্যের যোগ্য পুরস্কার মানবের নির্ধারণের অনেক ঊর্দ্ধে অবস্থিত। যেহেতু এই সকল অবিবেচক ও হতভাগ্য লোক “অভ্যুত্থান” ও “স্বর্গীয় সাক্ষাৎকার লাভের” প্রকৃত অর্থ উপলব্ধি করিতে অসমর্থ হইয়াছে; সুতরাং তাহারা ইঁহার অনুকম্পা হইতে সম্পূর্ণরূপে বঞ্চিত রহিয়াছে। যদিও সকল বিদ্যার ও বিদ্যার্জনের জন্য শ্রম ও ক্লেশের একমাত্র ও মূল উদ্দেশ্য এই পদবী প্রাপ্ত হওয়া ও ইহার পরিচয় লাভ করা; তত্রাচ তাহারা সকলেই নিজ নিজ পার্থিব উন্নতির জন্য অধ্যয়ন কার্যে নিমজ্জিত রহিয়াছে। তাহারা তাহাদের অবকাশের প্রত্যেক মূহুর্তে নিজেকে বঞ্চিত করে এবং তাঁহাকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করে, যিনি সকল বিদ্যার সার এবং তাহাদের অনুসন্ধানের একমাত্র লক্ষ্য। বোধ হয়, তাহাদের ওষ্ঠদ্বয় কদাপি জ্ঞানের পানপাত্র স্পর্শ করে নাই, আর স্বর্গীয় জ্ঞানের অনুকম্পার ধারার একটি মাত্র শিশিরবিন্দুও লাভ করিতে সমর্থ হইয়াছে বলিয়া মনে হয় না।
বিবেচনা করিয়া দেখুন, আল্লাহর প্রত্যাদেশ অবতরণের দিনে যে-ব্যক্তি “স্বর্গীয় সাক্ষাৎকার লাভ” এবং তাঁহার প্রকাশের পরিচয় লাভ করার অনুকম্পা অর্জনে অকৃতকার্য হইয়াছে, যদিও সে জ্ঞানার্জনে সংখ্যাতীত বৎসর ব্যয় করিয়াছে এবং মানবের সমুদয় সীমাবদ্ধ ও বৈষয়িক বিদ্যা অর্জন করিয়াছে, তথাপি তাহাকে কি প্রকারে ন্যায়তঃ বিদ্বান বলা যাইতে পারা যায় ? ইহা নিশ্চয়ই সুস্পষ্ট যে কোনও মতেই তাহাকে সত্যজ্ঞানের অধিকারী বলিয়া মনে করা যাইতে পারা যায় না। পক্ষান্তরে, সকল মানুষের মধ্যে যে অত্যন্ত অশিক্ষিত, সে যদি এই পরম শ্রেষ্ঠতা লাভের সম্মান প্রাপ্ত হয়, নিশ্চয়ই তাহাকে স্বর্গীয় জ্ঞানপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণের মধ্যে, যাঁহাদের জ্ঞান আল্লাহর নিকট হইতে আসিয়াছে, তাঁহাদের একজন বলিয়া গণ্য করা হইবে। কারণ এইরূপ লোক জ্ঞানের উচ্চতম শিখরে আরোহণ করিয়াছে এবং বিদ্যার সর্বাপেক্ষা দূরবর্তী চূঁড়ায় পৌঁছিয়াছে।
এই পদবী প্রত্যাদেশ অবতরণের দিনের নিদর্শনসমূহের মধ্যে একটি নিদর্শন; যেমন বলা হইয়াছেঃ “ তোমাদের মধ্যস্থিত নীচ ব্যক্তিকে তিনি উন্নত করিবেন; এবং যাহারা উন্নত, তাহাদিগকে নীচু স্তরে নামাইয়া দিবেন।” এবং এই প্রকারে তিনি ক্বোরআনে অবতীর্ণ করিয়াছেনঃ “এবং আমরা ইচ্ছা করিলাম যে, যাহারা রাজ্য-মধ্যে হীনবল ছিল, তাহাদের প্রতি অনুগ্রহ প্রদর্শন করিব, এবং তাহাদিগকে ধর্মের নেতা করিব এবং তাহাদিগকে আমাদের ধর্মের উত্তরাধিকারী করিব।” (ক্বোরআন ২৮।৫)। এই দিনে দেখা গিয়াছে, কত অধিক সংখ্যক ধর্ম-নেতা, সত্য অস্বীকারের হেতুতে, অজ্ঞানতার নিম্নস্তরে পতিত হইয়া তথায় অবস্থান করিতেছে এবং তাহাদের নাম শিক্ষিত ও মর্যাদাসম্পন্নদের নামাবলী হইতে বিলুপ্ত করা হইয়াছে। এবং অনেক অজ্ঞ ব্যক্তি, এই ধর্ম গ্রহণের কারণে ঊর্দ্ধ দিকে উড্ডীন হইয়াছে এবং জ্ঞানের উচ্চ শিখরে পৌঁছিয়াছে এবং তাহাদের নাম ক্ষমতার লেখনী দ্বারা ঐশী জ্ঞানের ফলকে লিপিবদ্ধ করা হইয়াছে। এই প্রকারে, “আল্লাহ্ যাহা ইচ্ছা করেন, তাহা রহিত করেন; অথবা যাহা ইচ্ছা, তাহা সুদৃঢ় করেন; কারণ তাঁহারই সন্নিধানে গ্রন্থের মূল উৎস রহিয়াছে।” (ক্বোরআন ১৩।৪১)। সুতরাং ইহা বলা হইয়াছেঃ “ যখন বিষয়টি প্রমাণিত হইয়াছে, তখন সাক্ষ্য অনুসন্ধান করা একটি অনুচিত কার্য এবং যখন বিদ্যার্জনের সকল উদ্দেশ্য সিদ্ধ হইয়াছে, তখন জ্ঞান অন্বেষণে রত থাকা বাস্তবিকই নিন্দার্হ।” বল, হে পৃথিবীর জনগণ! এই অগ্নি-শিখা সদৃশ যুবকের প্রতি দৃষ্টিপাত কর, যে আধ্যাত্মিক রাজ্যের সীমাহীন মহাসাগর দ্রুতগতিতে অতিক্রম করিয়া তোমাদের নিকট মহা সুসংবাদ ঘোষণা করিতেছেঃ “ দেখ, আল্লাহর প্রদীপ উজ্জ্বলভাবে জ্বলিতেছে”, এবং তোমাদিগকে তাঁহার প্রত্যাদেশের দিকে মনোযোগ দেওয়ার জন্য আহ্বান করিতেছে, যাহা, যদিও চিরন্তন উজ্জ্বলতার পর্দান্তরালে লুক্কায়িত, তত্রাচ ইরাক দেশে অনাদি-অনন্ত পবিত্রতার প্রভাতিক আলোক চক্রবালের উপর হইতে উজ্জ্বল কিরণ দান করিতেছে।
হে বন্ধু! যদি আপনার অন্তর-পক্ষী ক্বোরআন অবতরণের আকাশসমূহ আবিষ্কার করিত, যদি সেখানে বিস্তৃত স্বর্গীয় জ্ঞানরাজ্য সম্বন্ধে ইহা গভীরভাবে চিন্তা করিত, তাহা হইলে আপনি নিশ্চয়ই জ্ঞানের অসংখ্য দ্বার আপনার সম্মুখে অবারিত দেখিতে পাইতেন। আপনি নিশ্চয়ই চিনিতে পারিতেন যে, ঐ সমস্ত বিষয়—যাহা এই দিবসে জনগণকে অনাদি-অনন্ত অনুকম্পার মহাসাগরের তটসমূহে উপস্থিত হওয়ার পক্ষে বাধা প্রদান করিয়াছে; তৎসমুদয়ই মোহাম্মদীয় ধর্ম-বিধান যুগে জনসাধারণকে সেই স্বর্গীয় জ্যোতিষ্ক হজরত মোহাম্মদ (সঃ)-কে চিনিয়া লওয়ার কার্যে ও তাঁহার সত্যের সাক্ষ্যদান কার্যে বাধা প্রদান করিয়াছিল। অধিকন্তু আপনি “প্রত্যাবর্তন” ও “প্রত্যাদেশ অবতরণ” প্রভৃতির রহস্য উপলব্ধি করিতে পারিবেন এবং নিরাপদভাবে নিশ্চয়তা ও নিঃসন্দিগ্ধতার উচ্চতম প্রকোষ্ঠসমূহে বাস করিতে সমর্থ হইবেন।
এবং একদিন এইরূপ ঘটিয়াছিল যে, সেই অতুলনীয় সুষমার কতিপয় বিরুদ্ধবাদী লোক, যাহারা আল্লাহর সেই অবিনশ্বর পবিত্র মন্দির হইতে অনেক দূরে চলিয়া গিয়াছিল, অবজ্ঞাভরে হজরত মোহাম্মদ (সঃ)-কে এই সকল বাক্য বলিয়াছিলঃ “অবশ্যই আল্লাহ্ আমাদের সহিত এই অঙ্গীকারে আবদ্ধ হইয়াছেন যে, আমরা যেন কোনও রসুলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন না করি, যে পর্যন্ত না তিনি এমন একটি ক্বোরবানী আনয়ন করেন, যাহা স্বর্গীয় অনল গ্রাস করিবে।” (ক্বোরআন ৩।১৮৩)। এই আয়াতের মর্ম এই যে, আল্লাহ্ তাহাদের সহিত অঙ্গীকার করিয়াছেন যে, তাহারা কোন রসুলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করিবে না, যদি না তিনি আবেল ও কায়েন-এর অলৌকিক কার্য সম্পাদন করেন, অর্থাৎ এমন একটি ক্বোরবাণী প্রদান করেন, যাহা স্বর্গীয় অনল গ্রাস করিবে, যেমন তাহারা হাবেলের গল্পে বর্ণিত হইতে শুনিতে পাইয়াছিল, যে-গল্প ধর্মগ্রন্থসমূহে লিপিবদ্ধ আছে। ইহাতে হজরত মোহাম্মদ (সঃ) উত্তরে বলিলেনঃ “আমার সময়ের পূর্বে সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলীসহ এবং তোমরা যাহা বলিতেছ তৎসহ পয়গম্বরগণ তোমাদের নিকট আসিয়াছিলেন, তবুও তোমরা কেন তাঁহাদিগকে হত্যা করিয়াছিলে ? যদি তোমরা সত্যবাদী হও, তবে আমাকে বল।” (ক্বোরআন ৩।১৮৩)। এক্ষণে, ন্যায়পরায়ণ হউন। হজরত মোহাম্মদ (সঃ)-র সময় যে-সমস্ত লোক বাস করিতেছিল, তাহারা কি প্রকারে হাজার হাজার বৎসর পূর্বে হজরত আদম (আঃ) ও অন্যান্য পয়গম্বরের যুগেও অবস্থান করিতেছিল ? কেন এই সততার সারবত্তা, হজরত মোহাম্মদ (সঃ) তাঁহার সময়ের লোককে হাবেল বা অন্যান্য পয়গম্বরকে হত্যার জন্য অপরাধী বলিয়া অনুযোগ করিয়াছেন ? হজরত মোহাম্মদ (সঃ)-কে একজন প্রতারক বা নির্বোধ ব্যক্তি—আল্লাহ্ না করুন—বলিয়া মনে করা ব্যতীত অন্য কোনও উপায় নাই, অথবা এই মত পোষণ করা যে, ঐ সমস্ত দুষ্ট প্রকৃতির লোক একই প্রকারের লোক ছিল, যাহারা প্রত্যেক যুগে আল্লাহর পয়গম্বর ও রসুলগণকে বাধাদান করিত ও অন্যায়ভাবে বাদানুবাদ করিত, অবশেষে তাহারা তাঁহাদিগকে হত্যা করিত।
আপনার অন্তরে ইহা গভীরভাবে অনুধাবন করুন, যেন করুণার সবুজ ময়দানসমূহ হইতে স্বর্গীয় জ্ঞানের সুমধুর বাত্যা প্রবাহিত হইয়া প্রিয়তমের উচ্চারিত বাক্যের সৌরভ আপনার নিকট বহন করিয়া লইয়া আসিতে পারে এবং আপনার আত্মাকে উপলব্ধির ‘রেজওয়ান’-উদ্যানে পৌঁছাইয়া দিতে পারে। প্রত্যেক যুগে একগুঁয়ে লোকগণ যখন এই সকল গভীর ভাব ও গুরুত্বপূর্ণ উচ্চারিত বাক্যের নিগূঢ় অর্থ উপলব্ধি করিতে সক্ষম হয় নাই এবং পয়গম্বরগণের প্রত্যুত্তরগুলি অসংলগ্ন বলিয়া মনে করিয়াছিল, তখন তাহারা এই সকল জ্ঞান ও উপলব্ধির সারবত্তাসমূহের প্রতি অজ্ঞতা ও নির্বুদ্ধিতা আরোপ করিয়াছিল।
সেইরূপে, হজরত মোহাম্মদ (সঃ) আর একটি আয়াতে সেই যুগের মানুষের বিরুদ্ধে তাঁহার দৃঢ় অস্বীকার বাক্য উচ্চারণ করিয়াছিলেন। তিনি বলিয়াছিলেনঃ “যদিও তাঁহারা পূর্ব হইতেই অবিশ্বাসীদের উপর বিজয় প্রার্থনা করিতেছিলেন, তত্রাচ অবশেষে যখন তিনি, যাঁহাকে তাহারা চিনিত, তাহাদের নিকট আসিলেন, তখন তাঁহারা তাহাকে অস্বীকার করিল। অবিশ্বাসীদের উপর আল্লাহর অভিসম্পাত বর্ষিত হইক।” (ক্বোরআন ২। ৮৯)। চিন্তা করিয়া দেখুন, এই আয়াতটিও এই কথার ইঙ্গিত করিতেছে যে, হজরত মোহাম্মদ (সঃ)-র সমসাময়িক লোকেরা সেই একই লোক ছিল, যাহারা অতীত কালের পয়গম্বরগণের সময়ে বিবাদ করিয়াছিল ও যুদ্ধ করিয়াছিল, যাহাতে তাহারা আল্লাহর ধর্মের উন্নতি সাধন করিতে পারে এবং ধর্ম-বিধান শিক্ষা দিতে পারে। তত্রাচ, হজরত ঈসা (আঃ) এবং হজরত মূসা (আঃ)-র সময়ে যে সকল লোক বাস করিতেছিল, তাহাদিগকে প্রকৃতপক্ষে এক ও অভিন্ন লোক বলিয়া কিরূপে মনে করা যাইতে পারে ? অধিকন্তু পূর্বকালের যাহাদিগকে তাহারা জানিত, তাহাদের একজন ছিলেন মূসা (আঃ), যাহার মাধ্যমে তৌরীত অবতীর্ণ হইয়াছিল এবং আর একজন ছিলেন ঈসা (আঃ), যাঁহার প্রতি ইঞ্জিল অবতীর্ণ হইয়াছিল। ইহা সত্ত্বেও হজরত মোহাম্মদ (সঃ) কেন বলিয়াছিলেনঃ “যখন তিনি তাহাদের নিকট আসিলেন, যাঁহাকে তাহারা চিনিত” অর্থাৎ মূসা (আঃ) বা ঈসা (আঃ), তখন “তাহারা তাঁহাকে অবিশ্বাস করিল ?” বাহ্য দৃষ্টিতে হজরত মোহাম্মদ (সঃ)-কে কি একটি ভিন্ন নামে ডাকা হইত না ? তিনি কি একটি ভিন্ন শহরে আবির্ভূত হন নাই ? তিনি কি একটি ভিন্ন ভাষায় কথাবার্তা বলিতেন না এবং একটি ভিন্ন ধর্ম-বিধান (শরীয়ত-আইন) অবতীর্ণ করেন নাই ? তবে কি প্রকারে এই আয়াতের সত্যতা সংস্থাপিত হইতে পারে এবং ইহার অর্থ পরিষ্কার করা যাইতে পারে ?
অতএব, আপনি “প্রত্যাবর্তন শব্দটির অর্থ বুঝিতে চেষ্টা করুন, যাহা ক্বোরআনে এইরূপ সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হইয়াছে এবং যাহা এখনও পর্যন্ত কেহ উপলব্ধি করিতে পারে নাই। আপনি কি বলেন ? যদি আপনি বলেন যে, হজরত মোহাম্মদ (সঃ) পূর্ববর্তী পয়গম্বরগণের “প্রত্যাবৃত্ত ব্যক্তি” ছিলেন, যেরূপ এই আয়াত সাক্ষ্য দিতেছে, তাঁহার সঙ্গিগণও নিশ্চয়ই এই একই প্রকারে অতীত কালের সঙ্গীগণের প্রত্যাবৃত্ত ব্যক্তিগণ হইবেন, ঠিক যেমন পূর্ববর্তী লোকগণের “প্রত্যাবর্তন” পূর্বোল্লিখিত হাদীসটির মূল বাক্য দ্বারা পরিষ্কারভাবে প্রমাণিত হয়। এবং যদি আপনি ইহা অস্বীকার করেন, তবে যে-ক্বোরআন মানুষের নিকট আল্লাহর অতীব নিশ্চিত সাক্ষী, আপনি নিশ্চয়ই সেই ক্বোরআনের সত্যকে অগ্রাহ্য করিবেন। এইরূপে, “প্রত্যাবর্তন”, “অবতরণ” ও “পুনরুত্থান” শব্দগুলির তাৎপর্য উপলব্ধি করিতে চেষ্টা করুন, যাহা স্বর্গীয় সারাৎসারের প্রকাশগণের সময়ে দৃষ্ট হয়, যাহাতে আপনি নিজ চক্ষে, পবিত্র ও উজ্জ্বল দেহসমূহে পবিত্র আত্মাগণের “প্রত্যাবর্তন” অবলোকন করিতে পারেন, অজ্ঞতার ধুলি ধৌত করিয়া দূর করিতে পারেন এবং স্বর্গীয় জ্ঞানের উৎস হইতে প্রবাহিত করুণার জলস্্েরাত দ্বারা অন্ধকারাচ্ছন্ন অন্তরাত্মাকে পরিষ্কার করিতে পারেন, যাহার ফলে, হয়ত আল্লাহর শক্তি ও স্বর্গীয় পথ-প্রদর্শনের সাহায্যে আপনি ভ্রান্তির অন্ধকারময় রাত্রি হইতে চিরস্থায়ী উজ্জ্বলতার প্রভাত কালকে পৃথক করিয়া লইতে পারেন।
অধিকন্তু, আপনার নিকট ইহা সুস্পষ্ট যে, আল্লাহর অর্পিত দৌত্যকার্যের ভার বহনকারিগণকে একটি নূতন ধর্মের ব্যাখ্যাদাতা ও নূতন সংবাদ-বহনকারী রূপে পৃথিবীর মানুষের নিকট প্রকাশ করা হয়। যেহেতু স্বর্গীয় সিংহাসনের এই সকল পক্ষীর সকলেই ঐশী ইচ্ছা-শক্তির স্বর্গ হইতে পৃথিবীতে প্রেরিত হন এবং যেহেতু তাঁহারা সকলেই তাঁহার অনিবার্য ধর্ম ঘোষণা করিবার জন্য দন্ডায়মান হন; সুতরাং তাঁহাদের সকলকেই একত্বের এক আত্মা ও এক দেহবিশিষ্ট বলিয়া মনে করা হয়। কারণ তাঁহারা সকলেই ঐশী প্রেমের একই পানপাত্র হইতে পান করেন, এবং সকলেই একত্বের বৃক্ষের ফল ভোগ করেন। আল্লাহর এই সকল প্রকাশের প্রত্যেকেরই দুই রকমের পদবী আছে। একটি পদবী হইতেছে প্রকৃত পূর্ণ স্বতন্ত্রতা ও মৌলিক একত্ব। এই পদবী সম্পর্কে যদি আপনি সকলকে একই নামে আহ্বান করেন এবং সকলের প্রতি একই গুণ আরোপ করেন, তাহা হইলে আপনি সত্য হইতে ভুল পথে যাইবেন না। যেমন তিনি অবতীর্ণ করিয়াছেনঃ “আমরা তাঁহার রসুলগণের মধ্যে কোনও পার্থক্য করি না।” ক্বোরআন ২।২৮৫)। কারণ তাঁহারা সকলেই আল্লাহর একত্ব স্বীকার করিবার জন্য পৃথিবীর লোককে আহ্বান করেন। এবং তাহাদের জন্য অসীম অনুকম্পা ও বদান্যতার কওসর-উৎসের ঘোষণা করেন। তাঁহারা সকলেই পয়গম্বরের পদবীর পোশাকে বিভূষিত হন এবং প্রভার পরিচ্ছদে সম্মানিত হন। এইরূপে ক্বোরআনের আদি-বিন্দু হজরত মোহাম্মদ (সঃ) অবতীর্ণ করিয়াছিলেনঃ “আমিই সকল ঐশী পয়গম্বর।” এইরূপে তিনি আরও বলিয়াছেনঃ “আমিই প্রথম আদম, নূহ, মূসা, ঈসা।” হজরত আলীও এই প্রকার বাক্য বলিয়াছেন। এই প্রকার বাক্যাবলী একত্বের ঐ সকল ব্যাখ্যাকর্তার মৌলিক একত্ব প্রকাশ করে, সেইগুলিও আল্লাহর অমর বাণীর স্্েরাতস্বতীসমূহ ও স্বর্গীয় জ্ঞানের রতœাবলীর ভান্ডারসমূহ হইতে প্রবাহিত ও নির্গত হইয়াছে এবং ধর্মগ্রন্থসমূহে লিপিবদ্ধ করা হইয়াছে। এই আননসমূহ স্বর্গীয় প্রত্যাদেশ গ্রহণকর্তা ও ঐশী প্রত্যাদেশের প্রভাতসমূহ। এই প্রত্যাদেশ বহুত্বের পর্দান্তরালের ও সংখ্যার প্রয়োজনীয়তার উর্দ্ধে উন্নীত। এইরূপে তিনি বলেনঃ “আমাদের প্রত্যাদেশ মাত্র একটিই।” (ক্বোরআন ৫৪।৫০)। যেহেতু প্রত্যাদেশ ধর্ম মাত্র একটি এবং একই, সুতরাং ইহার ব্যাখ্যাকর্তাও নিশ্চয়ই এক ও একমাত্রই। এই প্রকারে মোহাম্মদীয় ধর্মের ঐ সকল নিশ্চিত জ্ঞানের প্রদীপ ইমামগণ বলিয়াছেনঃ “হজরত মোহাম্মদ (সঃ) আমাদের আদি, হজরত মোহাম্মদ (সঃ) আমাদের অন্ত, হজরত মোহাম্মদ (সঃ) আমাদে সব-কিছুই।”
আপনার নিকট ইহা পরিষ্কার ও সুস্পষ্ট যে, সকল পয়গম্বরই আল্লাহর প্রত্যাদেশের মন্দির, যাঁহারা বিভিন্ন প্রকারের পরিচ্ছদ পরিহিত হইয়া প্রকাশিত হইয়াছেন। আপনি যদি প্রভেদকারী দৃষ্টি সহকারে লক্ষ্য করেন, তাহা হইলে দেখিতে পাইবেন যে, তাঁহারা সকলেই চন্ত্রতপ-তলে বাস করেন, একই আকাশে উড্ডীন করেন, একই সিংহাসনে অধিষ্ঠিত থাকেন, একই বাক্য উচ্চারণ এবং একই ধর্ম ঘোষণা করেন। ঐ সকল অস্তিত্বের সারাৎসারের ঐসব অনন্ত ও অপরিমেয় আভার জ্যোতিষ্কের একতা এইরূপই। সুতরাং যদি ঐ সকল স্বর্গীয় পবিত্রতার প্রকাশ এই বলিয়া ঘোষণা করেনঃ “আমিই সমস্ত পয়গম্বরের প্রত্যাবর্তন,” তিনি নিশ্চয়ই সত্য কথাই বলেন। এই প্রকারে, প্রত্যেক পরবর্তী আবির্ভাবের সময় পূর্ববর্তী প্রকাশের প্রত্যাবর্তন একটি সত্য, যাহার সত্যতা দৃঢ়ভাবে স্থাপিত হইয়াছে। যেহেতু, আয়াত ও হাদীসসমূহের দ্বারা আল্লাহর পয়গম্বরগণের প্রত্যাবর্তন সুনিশ্চিতরূপে প্রমাণিত হইয়াছে; সুতরাং তাঁহাদের মনোনীতগণের প্রত্যাবর্তনও সঠিকভাবে প্রমাণিত হয়। এই প্রত্যাবর্তন এতই সুস্পষ্ট যে, ইহা নিজেই ইহার সাক্ষ্য বা প্রমাণ। দৃষ্টান্তস্বরূপ পয়গম্বরগণের মধ্যে নূহ (আঃ)-র বিষয় বিবেচনা করুন। যখন তিনি পয়গম্বরগণের পরিচ্ছদে বিভূষিত হইয়াছিলেন এবং যখন তিনি অভ্যুত্থান করার জন্য ও তাঁহার প্রত্যাদেশ ঘোষণা করার জন্য ঐশী আত্মার দ্বারা উদ্বুদ্ধ হইয়াছিলেন, তখন যে-কেহ তাঁহার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করিয়াছিল এবং তাঁহার ধর্ম স্বীকার করিয়াছিল, সে এক নূতন জীবনের প্রসাদে বিভূষিত হইয়াছিল। তাহার সম্বন্ধে সত্যই এরূপ বলা যাইতে পারা যায় যে, তাহার পুনর্জন্ম হইয়াছিল, এবং সে পুনরুজ্জীবিত হইয়াছিল; কারণ আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস করার ও তাঁহার প্রকাশকে গ্রহণ করার পূর্বে পার্থিব দ্রব্যাদির প্রতি তাহার আসক্তি ন্যস্ত করিয়াছিল, যথা পার্থিব আসবাবপত্রের প্রতি, স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি, খাদ্য, পেয় ইত্যাদির প্রতি ভালবাসা এইরূপ অত্যধিক ভাবে যে, রাত্রি-দিন ধন-দৌলত সঞ্চয় করা এবং আমোদ-প্রমোদ ও সুখভোগ করার উপায় সংগ্রহ করাই তাহার একমাত্র চিন্তার বিষয় ছিল। এই সকল ব্যতীত, ধর্ম-বিশ্বাসের পুনর্জীবন প্রদানকারী বারি পান করিবার পূর্বে, সে তাহার পিতৃ-পিতামহের জন-শ্রুতিসমূহে সহিত এইরূপ নিবদ্ধ ছিল এবং তাহাদের রীতিনীতি আইন-কানুনাদি এইরূপ অনুরাগ সহকারে পালন করিত যে, তাহার জাতির মধ্যে প্রচলিত ঐ সকল কুসংস্কারপূর্ণ রীতি-নীতির একটিমাত্র বর্ণের ব্যতিক্রম করা অপেক্ষা মৃত্যুকে শ্রেয়ঃ মনে করিত। যেমন জনসাধারণ উচ্চ রবে বলিয়াছিলঃ “নিশ্চয়ই আমরা আমাদের পিতৃ-পুরুষদিগকে একটি ধর্ম অনুসরণকারীরূপে প্রাপ্ত হইয়াছিলাম এবং নিশ্চয়ই আমরা তাহাদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করিতেছি।” (ক্বোরআন ৪৩।২২)।
এই সকল একই ভাবাপন্ন ব্যক্তি, যদিও তাহারা এই সকল সীমাবদ্ধতার পর্দান্তরালে জড়িত ছিল এবং এইরূপ রীতি-নীতি প্রতিপালনের প্রতিবন্ধকতায় আবদ্ধ ছিল, তত্রাচ যখনই তাহারা সর্বপ্রভাময়ের প্রকাশের হস্তে নিশ্চয়তার পানপাত্র হইতে বিশ্বাসের অমর চুমুক পান করিল, তখন তাহারা এইরূপ রূপান্তরিত হইল যে, তাহারা তাঁহার জন্য তাহাদের আত্মীয়-স্বজন, তাহাদের ধন-দৌলত, তাহাদের জীবন, তাহাদের বিশ্বাস, এমন কি, আল্লাহ্ ব্যতীত আর সব-কিছুই পরিত্যাগ করিল। আল্লাহর জন্য তাহাদের ঔৎসুক্য এতই প্রবল ছিল এবং তাহাদের আনন্দ-উল্লাসের মত্ততায় তাহারা এতই উন্নত ভাবাপন্ন হইয়াছিল যে, পৃথিবী ও তন্মধ্যস্থ সকলই তাহাদের চক্ষের সম্মুখে শূন্যে পরিণত হইল। এই সকল লোক কি “পুনর্জন্ম” এবং “প্রত্যাবর্তনের” রহস্যাবলীর দৃষ্টান্ত প্রদর্শন করে নাই ? ইহা কি দৃষ্ট হয় নাই যে, এই সকল মানুষই আল্লাহর এই নূতন ও আশ্চর্যজনক অনুকম্পায় ভূষিত হওয়ার পূর্বে অসংখ্য উপায়ে তাহাদের জীবনকে ধ্বংস হইতে সুরক্ষিত করিতে করার জন্য চেষ্টা করিত ? একটি কণ্টকও কি তাহাদিগকে ভীতিপূর্ণ করিত না এবং একটি শৃগালের দৃষ্টিও কি তাহাদিগকে পলায়নপর করিত না ? কিন্তু একবার যখন তাহারা আল্লাহর পরম শ্রেষ্ঠতা দ্বারা সম্মানিত হইয়াছে এবং তাঁহার বদান্যতাপূর্ণ অনুকম্পা প্রাপ্ত হইয়াছে, যদি সম্ভব হইত, তাহা হইলে তাহারা তাঁহারই পথে দশ সহস্র জীবন অবাধে উৎসর্গ করিত! শুধু ইহাই নহে, এমন কি, তাহাদের পবিত্র আত্মা, দেহ-পিঞ্জরকে তুচ্ছ জ্ঞান করিয়া তথা হইতে মুক্তির জন্য আগ্রহান্বিত হইত। সেই বাহিনীর একজন মাত্র বীর সৈনিক একটি বৃহৎ সৈন্যদলের সম্মুখীন হইয়া যুদ্ধ করিত। এবং তত্রাচ, তাহাদের জীবনে যে রূপান্তর সাধিত হইয়াছিল, তাহা না হইলে, তাহারা কি প্রকারে এইরূপ সাহসের কার্যাবলী প্রদর্শন করিতে সমর্থ হইত, যাহা মানবের কার্য-প্রণালীর সম্পূর্ণ বিপরীত ও তাহাদের পার্থিব বাসনাগুলির সহিত অসঙ্গত ছিল ?
ইহা সুস্পষ্ট যে এই আধ্যাত্মিক রূপান্তর ব্যতীত, যাহা তাহাদের পূর্ববর্তী রীতি-নীতির সম্পূর্ণ পরিপন্থী, এই অস্তিত্বের জগতে আর কিছুই এইরূপ তেজস্বী আত্মা ও আচরণ প্রকাশ করিতে পারিত না। কারণ তাহাদের উত্তেজনা শান্তিতে, তাহাদের সন্দেহ নিশ্চয়তায়, তাহাদের ভীরুতা সৎ সাহসে পরিণত হইয়াছিল। স্বর্গীয় অমর সুধার এমন শক্তি, যাহা চক্ষের নিমেষের ন্যায় দ্রুততর অন্তরকে রূপান্তরিত করিতে পারে।
দৃষ্টান্তস্বরূপ, তাম্্েরর উপাদান সম্বন্ধে বিবেচনা করুন। ইহা যদি ইহার খনিতে ঘনীভূত হইয়া রক্ষিত হইত, তাহা হইলে সত্তর বৎসর সময়ের মধ্যে স্বর্ণের অবস্থা প্রাপ্ত হইত। কিছু সংখ্যক লোক এইরূপও আছে যাহারা বলে তাম্র, যাহা ঘনীভূত হইয়া পীড়াগ্রস্ত অবস্থায় আছে উহা নিজেই স্বর্ণ; সুতরাং ইহা তাহার বাস্তব অবস্থায় পৌঁছে নাই।
সে যাহা হউক, প্রকৃত স্পর্শমণি এক মূহুর্তে তাম্্েরর উপাদানকে প্রকৃত স্বর্ণের অবস্থায় পরিণত করিবে এবং এক মূহুর্তের মধ্যে সত্তর বৎসরের দূরত্ব অতিক্রম করিবে। এই স্বর্ণকে কি তাম্র বলিয়াই আখ্যায়িত করা হইবে ? যে পর্যন্ত ইহা পরীক্ষা করার জন্য স্পর্শমনি পাওয়া যায় এবং ইহাতে তাম্র হইতে পৃথক করিতে পারে, ততক্ষণ পর্যন্ত কি বলা যাইতে পারা যাইবে যে, উহা স্বর্ণের অবস্থা প্রাপ্ত হয় নাই ?
এইরূপে, এই সকল আত্মা, স্বর্গীয় স্পর্শ মণির শক্তিমত্তার সাহায্যে চক্ষের নিমেষে মৃত্তিকার পৃথিবী অতিক্রম করে এবং পবিত্রতার রাজ্যে অগ্রবর্তী হয়, এবং এক পদবিক্ষেপে সীমাবদ্ধ পৃথিবী অতিক্রম করিয়া নিঃসীম রাজ্যে পৌঁছে। যাহা একটিমাত্র দ্রুতগামী নিঃশ্বাসে অজ্ঞতার পাশ্চাত্যকে জ্ঞানের প্রাচ্য দেশে পৌঁছাইয়া দেয়, চন্দ্রের উজ্জ্বলতা দ্বারা রাত্রির অন্ধকারকে আলোকোজ্জ্বল করে, সন্দেহের মরু-প্রান্তরে বিচরণকারীকে স্বর্গীয় সাক্ষাৎকার লাভ ও নিশ্চয়তার প্রস্রবণের দিকে পরিচালিত করে, এবং নশ্বর মানবাত্মার উপর অবিনশ্বর স্বর্গীয় ‘ রেজওয়ান’-উদ্যানে প্রবেশাধিকারের মর্যাদা দান করে, এক্ষণে, আপনার উচিত এই স্পর্শমণি লাভ করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করা। এই সম্পর্কে যদি ইহাকে তাম্র বলিয়া মনে করিতে পারা যায়, তবে এইরূপে এই সমস্ত মনুষ্যকে তাহাদের ধর্ম-বিশ্বাস লাভ করিবার পূর্বে এই একই প্রকারের বলিয়া মনে করিতে পারা যাইত।
হে ভ্রাতঃ! দেখুন, কিরূপে এই সকল প্রাচুর্যপূর্ণ, অকাট্য ও সিদ্ধান্তমূলক বাক্যের মধ্য দিয়া “পুনর্জন্ম”, “প্রত্যাবর্তন” ও “পুনরুত্থান” প্রভৃতি শব্দের প্রত্যেকটির আভ্যন্তরীণ রহস্য আপনার চক্ষুর সম্মুখে উন্মুক্ত ও উদ্ধার করা হইয়াছে। আল্লাহর নিকট প্রার্থনা এই—যেন তিনি আপনাকে তাঁহার অনুকম্পাসম্পন্ন অদৃশ্য সাহায্য দান করেন, যেন আপনি আপনার দেহ ও আত্মাকে পুরাতন পরিচ্ছদ হইতে মুক্ত করিয়া নূতন ও অবিনশ্বর পরিবেশে সজ্জিত করিতে পারেন।
অতএব, যাহারা পূর্ববর্তী ধর্ম-বিধানের সময় এইরূপ শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করিয়াছিল, প্রত্যেক পরবর্তী ধর্ম-বিধানকালে যাহারা মানব জাতির মধ্যে অপর সকলের অগ্রবর্তী হইয়া আল্লাহর ধর্ম গ্রহণ করিয়াছিল, স্বর্গীয় সুষমার হস্ত হইতে জ্ঞানের পরিষ্কৃত বারি প্রচুর পরিমাণে পান করিয়াছিল, এবং বিশ্বাস ও নিশ্চয়তার উচ্চতম শিখরে আরোহণ করিয়াছিল, তাহাদিগকে নামে, বাস্তবতায়, কার্যে, বাক্যে এবং পদবীতে তাহাদেরই “প্রত্যাবর্তন” বলিয়া মনে করিতে পারা যায়; কারণ পূর্ববর্তী ধর্ম-বিধানের লোকেরা যাহা কিছু প্রকাশ করিয়াছে, এই পরবর্তী সময়ের মনুষ্য দ্বারা তাহাই প্রদর্শন করা হইয়াছে। গোলাপ পুষ্প সম্বন্ধে বিবেচনা করিয়া দেখুন, পূর্বদেশে প্রস্ফুটিত হউক বা পশ্চিম দেশে প্রস্ফুটিত হইক, ইহা গোলাপ পুষ্প বৈ আর কিছু নহে। এই সম্পর্কে যাহা প্রকৃত জ্ঞাতব্য বিষয়, তাহা হইল গোলাপ পুষ্পের বাহ্য আকৃতি-প্রকৃতি জ্ঞাতব্য বিষয় নহে, বরং ঘ্রাণ ও সৌরভ, যাহা সে প্রদান করে।
সুতরাং আপনার দৃষ্টিকে সকল প্রকার পার্থিব সীমাবদ্ধতা হইতে পরিষ্কৃত করুন, যেন আপনি তাঁহাদের সকলকে একই নামধারী, একই প্রত্যাদেশের ব্যাখ্যাকারী, একই পরমাত্মার প্রকাশ এবং একই পরম সত্যের অবতরণকারীরূপে অবলোকন করিতে পারেন, এবং যেন আপনি এই সকল উচ্চারিত বাক্যের দ্বারা সবিস্তারে প্রকাশিত ঐশী বাণীসমূহের নিগূঢ় তত্ত্বপূর্ণ “প্রত্যাবর্তন” উপলব্ধি করিতে সক্ষম হন। কিয়ৎকালের জন্য মোহাম্মদীয় ধর্ম-বিধানের সময়ের হজরত মোহাম্দ (সঃ)-র সঙ্গীদের আচার-ব্যবহার সম্বন্ধে চিন্তা করুন। বিবেচনা করিয়া দেখুন, কিরূপে হজরত মোহাম্মদ (সঃ)-র পুনরুজ্জীবিতকারী নিঃশ্বাস দ্বারা তাহারা পার্থিব ভ্রান্ত অহঙ্কারাদির অপবিত্রতা হইতে পরিষ্কৃত ও পবিত্র হইয়াছিল, স্বার্থপর বাসনাসমূহ হইতে মুক্ত হইয়াছিল এবং তিনি ব্যতীত আর সকল হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়াছিল। দেখুন, তাহারা তাঁহার পবিত্র সাক্ষাৎকার—যাহা স্বয়ং আল্লাহরই সাক্ষাৎকার—লাভ করিবার জন্য কি প্রকারে পৃথিবীর অন্য সকল লোকের অগ্রবর্তী হইয়াছিল, কি প্রকারে তাহারা পৃথিবী ও পৃথিবীস্থ যাবতীয় বস্তু বর্জন করিয়াছিল, এবং সর্বপ্রভাময়ের প্রকাশের পদতলে মুক্তভাবে ও সানন্দে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করিয়াছিল। এবং এক্ষণে ‘বয়ান’-গ্রন্থের ‘আদি-বিন্দুর’ সঙ্গিগণ দ্বারা প্রদর্শিত সেই স্থির-প্রতিজ্ঞা, সেই একই অটলতা এবং ত্যাগের প্রত্যাবর্তন অবলোকন করুন। আপনি দেখিয়াছেন, প্রভূদের প্রভূর অনুকম্পার আশ্চর্যের মধ্য দিয়া কিরূপে এই সকল সঙ্গী মহিমার অগম্য উচ্চতাসমূহের শীর্ষে পরম ত্যাগের ধ্বজাসমূহ উত্তোলন করিয়াছিল। এই সকল লোক একই মাত্র উৎস হইতে অগ্রবর্তী হইয়াছে এবং এই সকল ফল একই বৃক্ষের ফল। আপনি ইহাদের মধ্যে কোনও পার্থক্য ও শ্রেষ্ঠতা নিরীক্ষণ করিবেন না। এই সব আল্লাহরই অনুগ্রহ! যাহার উপর ইচ্ছা, তিনি তাঁহার অনুগ্রহ বর্ষণ করেন। আল্লাহর অনুগ্রহ বর্ষিত হউক, যেন আমরা অস্বীকারের ক্ষেত্র এড়াইতে পারি এবং স্বীকৃতির মহাসাগরের দিকে অগ্রসর হইতে পারি, যেন আমরা সেই চক্ষুর দৃষ্টি সাহায্যে সকল প্রকারের বিরুদ্ধবাদী উপাদান হইতে মুক্ত হইয়া একতা ও বিভিন্নতা, বহুত্ব ও একত্ব, সীমাবদ্ধতা ও ব্যাপকতার জগৎসমূহ অবলোকন করিতে পারি এবং আল্লাহর বাণীর মর্মার্থের অত্যুচ্চ ও অতীব আভ্যন্তরীণ পবিত্র স্থানে উড্ডীন করিতে পারি।
অতএব, এই সমস্ত বর্ণনা হইতে ইহা সুস্পষ্ট ও সুপ্রকাশিত হইয়াছে যে, যদি একটি ঐশী আত্মা “অনন্তের অন্তে” প্রকাশিত হয়, এবং অন্য একটি ঐশী আত্মা “প্রান্তরহীন প্রারম্ভে” যে-প্রত্যাদেশ ঘোষণা করিয়াছিল ও তাহার সহায়তা করিয়াছিল, তাহা ঘোষণা করিবার জন্য ও তাহার সহায়তা করিবার জন্য দন্ডায়মান হয়, তবে এই অবস্থায় যিনি শেষ ব্যক্তি ছিলেন এবং যিনি প্রথম ব্যক্তি ছিলেন, তাঁহাদের উভয়ের সম্বন্ধে সত্যই এই কথা বলা যায় যে, তাঁহারা এক ও একই ব্যক্তি, পৃথক নহেন, কারণ উভয়েই এক ও একই প্রত্যাদেশের ব্যাখ্যাকর্তা। এই কারণে ‘বয়ান’ এর ‘আদি-বিন্দু’—তিনি ব্যতীত আর সকলের জীবন তাঁহার জন্য উৎসর্গীকৃত হউক—ঐশী প্রকাশগণকে সূর্যের সহিত তুলনা করিয়াছেন, যে-সূর্য যদিও “আদিহীন আদি” হইতে “অন্তহীন অন্ত” পর্যন্ত উদিত হয়, তত্রাচ ইহা একই সূর্য। এক্ষণে, যদি আপনি বলেন, এই সূর্য পূর্বের সেই সূর্যের “প্রত্যাবর্তন”, তথাপি আপনি সত্য কথাই বলিবেন। সেই প্রকারে, এই বিবরণ হইতে ইহা সুস্পষ্ট হইতেছে যে, “অন্ত” শব্দাটি “আদি” শব্দটির প্রতি প্রযোজ্য। এবং “আদি” শব্দটি “অন্ত” শব্দটির প্রতি প্রযোজ্য; কারণ “আদি” ও “অন্ত” উভয়েই এক ও একই ধর্মের ঘোষণা করা জন্য দন্ডায়মান হইয়াছে। যাঁহারা জ্ঞান ও নিশ্চয়তার মদিরা প্রচুর পরিমাণে পান করিয়াছেন, তাঁহাদের চক্ষে এই বিষয়টির সুস্পষ্টতা সত্ত্বেও এরূপ কত অধিক সংখ্যক লোক আছে, যাহারা ইহার মর্মার্থ বুঝিতে অসমর্থ হইয়া “পয়গম্বরগণের সীল-মোহর” বাক্যটি তাহাদের উপলব্ধিকে অন্ধকারাচ্ছন্ন হইতে দিয়াছে এবং তাঁহার সর্বপ্রকারের বদান্যতার অনুকম্পা হইতে নিজেদের বঞ্চিত করিয়াছে। হজরত মোহাম্মদ (সঃ) স্বয়ং কি প্রকাশ করেন নাই “আমিই সমস্ত পয়গম্বর ?” তিনি কি বলেন নাই, যেমন আমরা ইতিপূর্বে উল্লখ করিয়াছি ঃ “আমিই আদম, নূহ্, মূসা ও ঈসা ?” কেন এই অবিনশ্বর সুষমা হজরত মোহাম্মদ (সঃ) যিনি বলিয়াছেন ঃ আমিই প্রথম আদম”, তিনি কি এইকথা বলিতে অসমর্থ ঃ “পয়গম্বরগণের প্রথম” অর্থাৎ আদম বলিয়া মনে করিয়াছিলেন, সেই প্রকারে, “পয়গম্বরগণের সীল-মোহর”ও সেই স্বর্গীয় সুষমার প্রতি প্রযোজ্য। ইহা স্বতঃসিদ্ধরূপে সুস্পষ্ট যে, তিনি যখন “পয়গম্বরদের প্রথম”, সেইরূপে তিনি তাঁহাদের “সীল-মোহর”ও।
এই বিষয়টির রহস্য, এই ধর্ম-বিধানে সকল মানবের জন্য একটি বেদনাদায়ক পরীক্ষা। লক্ষ্য করিয়া দেখুন, কত অধিক সংখ্যক মানুষ আছে, যাহারা এই সমস্ত বাক্য আঁকড়াইয়া ধরিয়া থাকায়, যিনি তাহাদের জন্য সত্য-বিধান প্রকাশকারী, তাঁহার প্রতি অবিশ্বাসী হইয়াছে। আমরা জিজ্ঞাসা করি, এই সমস্ত মানুষ “প্রথম” ও “শেষ”—এই শব্দ দুইটির অর্থ কি বলিয়া তাহারা অনুমান করে, যখন তাহারা ইহাদের দ্বারা আল্লাহর দিকে —তাঁহার নাম মহিমান্বিত হউক—ইঙ্গিত করে ? যদি তাহারা এই কথা বলে যে, এই দুইটি শব্দ এই জড়-জগতের প্রতি ইঙ্গিত করে, তাহা হইলে ইহা কি প্রকারে সম্ভব হইতে পারে, যখন পার্থিব দ্রব্যাদির পরিদৃশ্যমান শৃঙ্খলা এখনও পর্যন্ত সুস্পষ্টভাবে বর্তমান ? না, শুধু ইহাই নহে, এইখানে, “প্রথম” শব্দের অর্থ “ শেষ” ব্যতীত আর কিছুই নহে এবং “শেষ” শব্দের অর্থ “প্রথম” ব্যতীত অন্য কিছুই নহে।
ঠিক যেমন “প্রারম্ভহীন প্রারম্ভে,” “শেষ” শব্দটি সত্যই তাঁহার প্রতি প্রযোজ্য যিনি দৃশ্য ও অদৃশ্যের শিক্ষাদাতা, সেই একই প্রকারে “প্রথম” ও “শেষ”—শব্দদ্বয় তাঁহার প্রকাশগণের প্রতিও প্রযোজ্য। সঙ্গে সঙ্গে তাঁহারা “প্রথম” ও “শেষ” উভয়ের ব্যাখ্যাকর্তা। যখন তাঁহারা “প্রথমের” আসনে স্থিত হন, তাঁহারা “শেষের” সিংহাসনও অধিকার করেন। যদি তীক্ষè দৃষ্টিসম্পন্ন লোক পাওয়া যাইত, তাহা হইলে সে সহজে দেখিতে পাইত যে, “প্রথম” ও “শেষ”, “প্রকাশিত” ও “নিহিত”, “প্রারম্ভ” ও “সীলমোহর” এর ব্যাখ্যাকর্তা এই সকল পবিত্র সত্তা, এই সকল ত্যাগের সারবত্তা ও এই সকল স্বর্গীয় আত্মা তিনি ব্যতীত অপর কেহই নহেন। এবং যদি আপনি “একা আল্লাহ্ই ছিলেন, তিনি ব্যতীত অপর কেহই ছিল না,” এই পবিত্র রাজ্যে উড্ডীন করিতেন, তাহা হইলে আপনি দেখিতে পাইতেন যে, সেই প্রাঙ্গণে এই সকল নাম একেবারে অনস্তিত্বে এবং সম্পূর্ণ বিস্মৃতিতে ছিল। তাহা হইলে এই সকল বাক্য ও এই সকল ইঙ্গিত দ্বারা আপনার চক্ষু অন্ধকারাচ্ছন্ন হইবে না। এই পদবী কতই স্বর্গীয় ও উচ্চতম, যেখানে, এমন কি, পরিচালক বিহীনভাবে, জিব্রাইলও কখনও প্রবেশ লাভ করিতে পারে না এবং স্বর্গের বিহঙ্গমও সাহায্য ব্যতিরেকে কখনও পৌঁছিতে পারে না।
এখন, আপনি বিশ্বাসীদের পরিচালক, হজরত আলী (রাঃ)-র এই বাক্যের মর্ম উপলব্ধি করিতে চেষ্টা করুন ঃ “বিনা সহায়তায় প্রভার পর্দান্তরালসমূহ ভেদ করিয়া।” এই সকল “প্রভার অন্তরালসমূহের” মধ্যে আছে ধর্মাচার্য ও ধর্ম-নেতাগণ, যাহারা আল্লাহর প্রকাশগণের সময়ে বাস করে, যাহারা নিজেদের সুতীক্ষè বুদ্ধির ও প্রেমের অভাবের কারণে এবং নেতৃত্বের প্রতি তাহাদের প্রবল আসক্তি বশতঃ আল্লাহর প্রত্যাদেশ স্বীকার করিতে অসমর্থ হইয়াছে; শুধু ইহাই নহে, এমন কি, যাহারা স্বর্গীয় সুমধুর গীতির দিকে কর্ণপাতও করে নাই। “তাহারা তাহাদের কর্ণে তাহাদের স্ব স্ব অঙ্গুলি প্রবেশ করাইয়া দিয়াছে।” (ক্বোরআন ২।২৯)। এবং জনসাধারণও আল্লাহকে সম্পূর্ণরূপে অবহেলা করিয়া এবং তাহাদিগকেই তাহাদের শিক্ষাদাতারূপে গ্রহণ করিয়া এই সকল জাঁক-জমকশীল ও ভ- কপটচারী নেতার কর্তৃত্বাধীনে আপনাদিগকে সম্পূর্ণরূপে সমর্পণ করিয়াছে; কারণ, তাহাদের নিজেদের কোনও দৃষ্টিশক্তি ও কোনও শ্রবণ শক্তি ও অন্তর নাই—যদ্দদ্বারা তাহারা সত্যকে মিথ্যা হইতে পৃথক করিতে পারে।
যদিও যাবতীয় পয়গম্বর, সিদ্ধপুরুষ ও আল্লাহর মনোনীত পুরুষগণ, ঐশী প্রেরণা-মূলে, সকল লোককে এই নির্দেশ দিয়াছিলেন যে, তাহারা যেন স্বচক্ষে দেখে স্বকর্ণে শুনে, তত্রাচ তাহারা অবজ্ঞাভরে তাঁহাদের উপদেশসমূহ প্রত্যাখ্যান করিয়াছে এবং তাহাদের ধর্ম-নেতাগণকে অন্ধ লোকের ন্যায় অনুসরণ করিয়াছে এবং অনুসরণ করিতে থাকিবে। যদি একজন দরিদ্র ও অজ্ঞাত ব্যক্তি, যাহার নিকট বিদ্বান ব্যক্তির উপযোগী কোনও পরিচ্ছদ নাই, তাহাদিগকে সম্বোধন করিয়া বলেঃ “হে মনুষ্যগণ, তোমরা রসুলগণের অনুসরণ কর।” (ক্বোরআন ৩৬।২০)। ইহাতে তাহারা এইরূপ বাক্যে অত্যন্ত আশ্চর্যান্বিত হইয়া বলিবেঃ “কি! তুমি কি বলিতে চাহ যে, এই সকল ধর্মাচার্য, এই সকল মহা বিদ্বান ব্যক্তি, তাহাদের সকল প্রকার ক্ষমতা, জাঁক-জমক ও মহাসমারোহ সত্ত্বেও ভুল করিয়াছে এবং সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য করিতে অসমর্থ হইয়াছে ? তুমি ও তোমার ন্যায় লোকেরা কি এমন বুঝিতে পারিয়াছে বলিয়া দাবি কর, যাহা তাহারা বুঝিতে পারে নাই ?” যদি সংখ্যার আধিক্য ও পরিচ্ছদের উৎকৃষ্টতাকে বিদ্যা ও সত্যের বিচারের মানদ- বলিয়া মনে করা হয়, তাহা হইলে অতীত যুগের জাতিসমূহের জনগণকে, যাহাদিগকে বর্তমান সময়ের লোকেরা সংখ্যাধিক্য জাঁক-জমকে ও শক্তিতে কখনও অতিক্রম করে নাই, নিশ্চয়ই তাহাদিগকে উৎকৃষ্টতর ও যোগ্যতর লোক বলিয়া গণ্য করিতে হইবে।
ইহা পরিষ্কার ও সুস্পষ্ট যে, যখন যখনই পবিত্রতার প্রকাশগণ আবির্ভূত হইতেন, তাঁহাদের সমসাময়িক ধর্মাচার্যগণ জনগণকে সত্য পথ লাভ করার পথে বাধা প্রদান করিত। সকল ধর্ম-শাস্ত্র ও স্বর্গীয় গ্রন্থাদির লিপিবদ্ধ বাক্যসমূহ এই বিষয়ে সাক্ষ্য প্রদান করে। আল্লাহর এমন একজন পয়গম্বরও আবির্ভূত হন নাই, যিনি তাঁহার সময়ের ধর্ম-নেতাদের কঠোর ঘৃণার, তাহাদের ভীতি-প্রদর্শনের, অস্বীকৃতির ও অভিশাপের বলি-রূপে তাহাদের কবলে পতিত হন নাই। পূর্বকালে তাহাদের হস্ত যে সকল অবিচারের কার্য করিয়াছিল, তজ্জন্য কত আক্ষেপ! বর্তমানে তাহারা যাহা করিতেছে, তজ্জন্য কতই আফসোস! এই সকল ভ্রান্তির প্রতিচ্ছবি অপেক্ষা অধিকতর সাংঘাতিক প্রভা-অন্তরাল কি থাকিতে পারে ? আল্লাহর ন্যায়পরায়ণতার শপথ! এইরূপ যবনিকা ভেদ করা সকল কার্য অপেক্ষা অধিকতর শক্তিশালী, এবং তাহাদিগকে বিদীর্ণ করা অধিকতর প্রশংসনীয় কার্য। হে আধ্যাত্মিক সম্প্রদায়! আল্লাহ্ আমাদিগকে ও তোমাদিগকে সাহায্য করুন, যেন তোমরা হয়ত তাঁহার প্রকাশের সময়ে এইরূপ কার্যাদি সম্পাদন করিতে পার, তাঁহার অনুকম্পার সাহায্য প্রাপ্ত হইতে পার এবং তাঁহার সময়ে আল্লাহর সাক্ষাৎকার লাভ করিতে পার।
অধিকন্তু, “প্রভার যবনিকা-অন্তরালসমূহের” মধ্যে “পয়গম্বরদের সীল-মোহর” এবং তদ্রুপ শব্দ আছে, যাহার যবনিকা অপসারণ করা এই সকল নীচ-জন্মা ও ভ্রান্তিপূর্ণ আত্মার পক্ষে একটি মহান কৃতকার্যতা। সকল মানুষই এই সমস্ত রহস্যময় বাক্যের ও এই সকল প্রভা-অন্তরালসমূহের কারণে সত্যের আলোক অবলোকন করার কার্যে প্রতিবন্ধকতা প্রাপ্ত হইয়াছে। তাহারা কি সেই স্বর্গীয় বিহঙ্গমের (ইমাম হজরত আলী (রাঃ)-র) এই রহস্যপূর্ণ বাক্য উচ্চারণকালে তাঁহার সুমধুর গীতি শুনে নাইঃ “আমি এক হাজার ফাতেমার পাণি গ্রহণ করিয়াছি, তাহাদের প্রত্যেকে আব্দুল্লাহ্র পুত্র মোহাম্মদ (সঃ)-র কন্যা ছিল, যিনি ঐশী নবীদের ‘সীল-মোহর” ছিলেন।” দেখুন, আল্লাহর জ্ঞান-মন্দিরের মধ্যে কত অধিক রহস্য এখনও পর্যন্ত অপ্রকাশিত রহিয়াছে এবং কত অধিক ঐশী জ্ঞান-রত্ন সমূহ তাঁহার অলঙ্ঘনীয় ভান্ডারে এখনও পর্যন্ত গোপনীয়ভাবে রহিয়াছে। যদি আপনি আপনার অন্তরে ইহা অনুধাবন করেন, তবে উপলব্ধি করিবেন যে, তাঁহার শিল্প-কর্মের আদি ও অন্ত নাই। তাঁহার আদেশের রাজ্য এতই সুদূর বিস্তৃত যে, নশ্বর মানবের বাক্শক্তির পক্ষে তাহা বর্ণনা করা বা মানব-মন-পক্ষীর পক্ষে তাহা অতিক্রম করা অসম্ভব; এবং তাঁহার বিধাতৃত্বের বিলি-ব্যবস্থা মানব-মনের পক্ষে উপলব্ধি করা অতীব রহস্যময়। তাঁহার সৃষ্টিকে কোনও অন্তর ধৃত করে নাই, এবং ইহা “আদিহীন আদি” হইতে চিরকাল বর্তমান রহিয়াছে, এবং কোনও আদি তাঁহার সুষমার প্রকাশগণকে অবলোকন করে নাই, এবং তাঁহারা “অন্তহীন অন্ত” পর্যন্ত চলিতে থাকিবেন। আপনার অন্তরে এই উচ্চারিত বাক্য অনুধাবন করুন এবং চিন্তা করিয়া দেখুন, কিরূপে ইহা এই সকল পবিত্র আত্মার প্রতি প্রযোজ্য।
এই প্রকারে সেই অনন্ত সুষমা, হজরত আলী (রাঃ)-র পুত্র ইমাম হোসেইন (রাঃ)-র সুমধুর গীতির তাৎপর্য উপলব্ধি করিতে চেষ্টা করুন, যখন তিনি সল্মানকে সম্বোধন করিয়া এই বাক্যগুলি বলিয়াছিলেনঃ “আমি এক হাজার আদমের সহিত ছিলাম, প্রত্যেক আদম ও তৎপরবর্তী আদমের মধ্যবর্তকালের পরিমাণ পঞ্চাশ হাজার বৎসর ছিল এবং ইঁহাদের প্রত্যেকের নিকট আমি আমার পিতার উপর যে উত্তরাধিকারিত্ব অর্পিত হইয়াছিল, তাহা ঘোষণা করিয়াছিলাম।” তিনি তৎপর কতিপয় বিশেষ বিবরণ উল্লেখ করিয়াছিলেন, অবশেষে তিনি বলেনঃ “আমি আল্লাহর পথে এক হাজার যুদ্ধ করিয়াছিলাম, তাহাদের মধ্যে ক্ষুদ্রতম ও অতি সামান্যটি খায়বারের যুদ্ধের মত, যে-যুদ্ধে আমার পিতা অবিশ্বাসীদের সহিত যুদ্ধ ও বিরোধিতা করিয়াছিলেন।” এক্ষণে এই দুইটি হাদীস হইতে “অন্ত”, “প্রত্যাবর্তন” ও “আদি-অন্তহীন সৃষ্টি” শব্দগুলির রহস্য উপলব্ধি করিতে চেষ্টিত হউন।
হে আমার প্রিয়! স্বর্গীয় সুমধুর গীতি মানব-কর্ণের, শ্রবণ-শক্তির ও মানব-মনের রহস্য-উপলব্ধির উদ্যমের অপরিমেয় ঊর্দ্ধে উন্নত। সহায়হীন পিপিলিকা কি রূপে সর্ব-প্রভাময়ের দরবারে পদ-বিক্ষেপ করিতে পারে ? এবং তত্রাচ, দুর্বল আত্মাবিশিষ্ট লোকগণ উপলব্ধির অভাবে এই সকল দুর্বোধ্য বাণীকে অগ্রাহ্য করে এবং এইরূপ হাদীসসমূহের সত্যতা সম্বন্ধে সন্দেহ পোষণ করে, শুধু তাহাই নহে, যাহাদের নিকট বোধ-শক্তিসম্পন্ন অন্তর আছে, তাহারা ব্যতীত অন্য কেহ এইগুলি উপলব্ধি করিতে পারে না। বল, তিনিই সেই অন্ত, যাহার জন্য সর্ববিশ্বে কোনও অন্ত কল্পনা করিতে পারা যায় না, এবং যাঁহার জন্য সৃষ্টি-জগতে কোনও আদি ধারণা করিতে পারা যায় না। হে পৃথিবীর জনগণ! দেখ, অন্তের উজ্জ্বলতাসমূহ আদির প্রকাশগণের মধ্যেই অবতীর্ণ হইয়াছে।
ইহা কতই আশ্চর্যজনক! এই সকল লোক একদিকে পবিত্র ক্বোরআনের ঐ সমস্ত আয়াতের দিকে ও নিশ্চিত জ্ঞানসম্পন্ন মানুষের শ্রুতিসমূহকে আঁকড়াইয়া ধরিয়া রহিয়াছে, যাহা তাহাদের প্রবৃত্তি ও স্বার্থের অনুযায়ী এবং অপর পক্ষে যে-গুলি তাহাদের স্বার্থসমন্বিত ইচ্ছার বিরোধী, সেইগুলিকে প্রত্যাখ্যান করিতেছে। “তবে কি তোমরা স্বর্গীয় গ্রন্থের কিয়দংশ বিশ্বাস কর এবং কিয়দংশ অবিশ্বাস কর ?” (ক্বোরআন ২।৮৫)। তোমরা যাহা উপলব্ধি কর না, তাহা কি প্রকারে বিচার করিবে” এমন কি, অস্তিত্বের প্রভূ তাঁহার অভ্রান্ত গন্থে, তাঁহার মহিমান্বিত বাণীতে “সীল-মোহর” সম্বন্ধে এই আয়াত উল্লেখ করিবার পরঃ “মোহাম্মদ আল্লাহর প্রেরিত রসুল ও ঐশী নবীগণের সীল-মোহর।” (ক্বোরআন ৩৩।৪০), “স্বর্গীয় সাক্ষাৎকার লাভের” প্রতিশ্রুতি সকল মানুষের নিকট অবতীর্ণ করিয়াছেন। ক্বোরআন গ্রন্থের অনেক আয়াত এই অমর সম্রাটের সাক্ষাৎকার লাভের সাক্ষ্য প্রদান করে, এই সকলের কতকগুলি ইতিপূর্বে উল্লেখ করিয়াছে। একমাত্র সত্য আল্লাহ্ই আমার সাক্ষী! পবিত্র ক্বোরআনে “স্বর্গীয় সাক্ষাৎকার লাভ” অপেক্ষা অধিকতর সুমহান ও অধিকতর সুস্পষ্ট আর কিছুই অবতীর্ণ হয় নাই। এই দিনে যে-ব্যক্তি তাহা লাভ করিয়াছে, ইহা তাহার কতই শ্রেয়ঃ ও সৌভাগ্যের বিষয়, পক্ষান্তরে, যেদিনে, যেমন আপনি দেখিতে পাইতেছেন, অধিকাংশ লোক ইহা হইতে মুখ ফিরাইয়া লইয়াছে।
এবং তথাপি, পূর্ববর্তী আয়াতের রহস্যের কারণে তাহারা পরবর্তী আয়াতে যে অনুকম্পার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হইয়াছে, তাহা হইতে মুখ ফিরাইয়া লইয়াছে, এই প্রকৃত সত্য সত্ত্বেও যে, “পুনরুত্থান দিবসে” “স্বর্গীয় সাক্ষাৎকার লাভ” পরিষ্কারভাবে ক্বোরআন গ্রন্থে বর্ণনা করা হইয়াছে। ইহা প্রমাণ করা হইয়াছে এবং নিশ্চিতরূপে, পরিষ্কার সাক্ষ্য-প্রমাণ দ্বারা স্থিরীকৃত হইয়াছে যে, “পুনরুত্থান” শব্দ দ্বারা তাঁহার প্রত্যাদেশ ঘোষণা করিবার জন্য আল্লাহর রসুলের অভ্যুত্থান বুঝান হয় এবং “স্বর্গীয় সাক্ষাৎকার লাভ” বাক্য দ্বারা তাঁহার প্রকাশের ব্যক্তিত্বের মাধ্যমে তাঁহার সুষমার দর্শন লাভ বুঝান হয়। কারণ, নিশ্চয়ই “ কোনও চক্ষু তাঁহাকে দর্শন করিতে পারে না; কিন্তু তিনি সকল চক্ষু অবলোকন করেন।” (ক্বোরআন ৬।১০৩)। এই সকল নিঃসন্দিগ্ধ ও সুস্পষ্ট বর্ণনাদি সত্ত্বেও, তাহারা মূর্খ লোকের ন্যায় “সীল-মোহর” শব্দটিকে আঁকড়াইয়া ধরিয়া রহিয়াছে, এবং তাঁহার সাক্ষাৎকারের দিনে তাঁহাকে চিনিতে পারা হইতে সম্পূর্ণরূপে বঞ্চিত রহিয়াছে, যিনি “সীল-মোহর” ও আদি, উভয়েরই অবতরণ ও প্রকাশকারী। “যদি আল্লাহ্ মানুষকে তাহাদের অত্যাচারের জন্য ধৃত করিতেন, তবে তিনি ভূপৃষ্ঠে একটি সজীব প্রাণীকেও বাদ দিতেন না; কিন্তু তিনি একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তাহাদের অবসর প্রদান করেন।” (ক্বোরআন ১৬।৬১)। কিন্তু এই সকল সত্ত্বেও যদি এই লোকেরা এই সকল বাক্য হইতে যে-সকল পরিষ্কার স্্েরাতস্বতী প্রবাহিত হইতেছিল, তাহার একটি বিন্দুও লাভ করিত ঃ “আল্লাহ্ যাহা ইচ্ছা করেন, তাহা তিনি করেন, এবং যাহা তিনি আকাঙ্খা করেন, তাহা তিনি আদেশ করেন,” তাহা হইলে তাহারা, তাঁহার প্রকাশের অক্ষ-কেন্দ্রের বিরুদ্ধে এইরূপ কোনও প্রকার অনুচিত আপত্তি উত্থাপন করিত না। আল্লাহর প্রত্যাদেশ, সকল কার্য ও বাক্য, তাঁহারই শক্তির হস্তে ধৃত রহিয়াছে। “সকল পদার্থই তাঁহার শক্তিশালী হস্তের মুষ্ঠির মধ্যে অবরুদ্ধ আছে; তাঁহার পক্ষে সকলই সহজ ও সম্ভব।” তিনি যাহা ইচ্ছা করেন, তিনি তাহা সম্পন্ন করেন এবং তিনি তাহা করেন, যাহা তিনি আকাঙ্খা করেন। “যে-কেহ বলে, ‘কেন’ বা ‘কি জন্য’, সে আল্লাহর প্রতি অবজ্ঞাসূচক বাক্য উচ্চারণ করে।” যদি এই সকল লোক অমনোযোগিতা-রূপ নিদ্রা দূর করিয়া দিত এবং তাহাদের হস্ত যাহা করিয়াছে তাহা উপলব্ধি করিতে পারিত, তাহা হইলে তাহারা নিশ্চয়ই ধ্বংস হইত এবং স্বেচ্ছায় আপনাদিগকে অগ্নিতে নিক্ষেপ করিত, যাহা তাহাদের পরিণতি ও প্রকৃত বাসস্থান। তিনি যাহা অবতীর্ণ করিয়াছেন, তাহা কি তাহারা শুনে নাই ঃ “তিনি যাহা করেন তৎসম্বন্ধে তাঁহাকে প্রশ্ন করা যাইবে না।” (ক্বোরআন ২১।২৩)। এই সকল উচ্চারিত বাক্য সত্ত্বেও মানুষ কিরূপে এইরূপ সাহসী হইতে পারে যে, সে তাঁহাকে প্রশ্ন করে, এবং অলস বাক্যাবলীতে ব্যস্ত থাকে ?
মহিমময় প্রভূ! লোকের মূর্খতা ও একগুঁয়েমি এতই অধিক যে, তাহারা তাহাদের নিজেদের চিন্তা ও বাসনার দিকে মুখ ফিরাইয়াছে এবং আল্লাহর জ্ঞান ও আকাঙ্খার দিকে তাহাদের পৃষ্ঠ প্রদর্শন করিয়াছে, তাঁহার নাম পবিত্র ও প্রভাময় হউক!
ন্যায়বান হউন ঃ যদি এই সকল লোক এইসব উজ্জ্বল বাক্য ও পবিত্র ইঙ্গিতসমূহের সত্যতা স্বীকার করিত এবং আল্লাহকে “তিনি যাহা আকাঙ্খা করেন, তিনি তাহাই করেন” বলিয়া স্বীকার করিত, তবে কি প্রকারে তাহারা এই সকল অসঙ্গত বাক্য আঁকড়াইয়া থাকিতে পারিত ? না, বরং তাহারা, তিনি যাহা বলেন সর্বান্তঃকরণে তাহা গ্রহণ ও স্বীকার করিয়া লইত। আমি আল্লাহর শপথ করিয়া বলিতেছি। স্বর্গীয় আদেশ ও বিধাতার অজ্ঞেয় নিয়ম-বিধানাদি না থাকিলে, পৃথিবী স্বয়ং এই সকল লোককে ধ্বংস করিয়া দিত। “কিন্তু তিনি তাহাদিগকে একটি জ্ঞাত দিবসের নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অবকাশ দিবেন।”
মোহাম্মদীয় ধর্ম-বিধানের প্রভাত হইতে এই পর্যন্ত বার শত আশি বৎসর (১২৭০ হিজরী) অতীত হইয়া গিয়াছে, এবং প্রত্যেক প্রভাতকালে, এই সকল অন্ধ ও নীচমনা লোক তাহাদের ক্বোরআন আবৃত্তি করিয়াছে, এবং তথাপি তাহারা ঐ গ্রন্থের একটিমাত্র অক্ষরও বুঝিতে সমর্থ হয় নাই। বার বার তাহারা এই সকল আয়াত পাঠ করিয়া থাকে, যাহা পরিষ্কারভাবে এই সকল বিষয়ের বাস্তবতা সম্বন্ধে সাক্ষ্য প্রদান করে, তত্রাচ তাহারা উহাদের উদ্দেশ্য উপলব্ধি করিতে সমর্থ নহে। এমন কি, এই পর্যন্ত তাহারা ইহা উপলব্ধি করিতে পারে নাই যে, প্রত্যেক যুগে, ধর্মগ্রন্থ ও পবিত্র গ্রন্থসমূহ পাঠ করিবার ইহা ব্যতীত অন্য কোনও উদ্দেশ্য নাই যে, তদ্দদ্বারা পাঠক তাহাদের অর্থ উপলব্ধি করিবে, এবং উহাদের আভ্যন্তরীণ রহস্যসমূহ উদ্ঘাটন করিবে। পক্ষান্তরে, উপলব্ধি ব্যতীত কেবল পঠন দ্বারা মানুষের কোনও স্থায়ী উপকার লাভ হয় না।
এবং একদিন এইরূপ ঘটিল যে, একজন অভাবগ্রস্ত লোক তাঁহার জ্ঞান-সমুদ্র হইতে জ্ঞান লাভ করিবার বাসনায় এই আত্মার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিল। তাহার সহিত বাক্যালাপ করিবার সময় বিচার-দিবস, পুনরুত্থান, পুনর্জীবন লাভ, হিসাব-মীমাংসা প্রভৃতি নিদর্শন সম্বন্ধে উল্লেখ করা হইল। তিনি আমাদিগকে এই বিষয় ব্যাখ্যা করিতে অনুরোধ করিলেন, যখন কাহাকেও এই বিষয় অবগত করান হয় নাই, তখন কি প্রকারে এই আশ্চর্যজনক ধর্ম-বিধানের কালে পৃথিবীর মানুষ ও জাতিসমূহের বিচার-মীমাংসা হইতেছিল। তখন আমরা তাহার সামর্থ্য ও উপলব্ধি করার শক্তি অনুসারে, বিজ্ঞান ও পুরাতন বিজ্ঞতার কতিপয় সত্য সম্বন্ধে জ্ঞান দান করিলাম। তৎপর আমরা এই বলিয়া তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম ঃ “তুমি কি ক্বোরআন মজিদ পাঠ কর নাই, এবং তুমি কি এই পবিত্র আয়াত সম্বন্ধে অবগত নহ ঃ “ঐ দিবস, মনুষ্য বা জিন্ন, কাহাকেও তাহার অপরাধ সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করা হইবে না।” (ক্বোরআন ৫৫।৩৯)। তুমি কি উপলব্ধি করিতেছ না যে, “জিজ্ঞাসা করার অর্থ, জিহ্বা বা বাক্য দ্বারা জিজ্ঞাসা করা নহে, এমন কি, যেমন স্বয়ং আয়াতটি ইহা প্রদর্শন ও প্রমাণ করে ? কারণ, পরে ইহা বলা হইয়াছে ঃ “অপরাধীরা তাহাদের নিদর্শন দ্বারা পরিচিত হইবে, এবং তখন তাহারা তাহাদের সম্মুখের কেশগুচ্ছ ও পদসমূহ দ্বারা ধৃত হইবে।” (ক্বোরআন ৫৫।৪১)।
এই প্রকারে পৃথিবীর মনুষ্যগণের বিচার তাহাদের আকৃতির দ্বারা মীমাংসিত হয়। ইহা দ্বারা তাহাদের অবিশ্বাস, তাহাদের বিশ্বাস ও তাহাদের অবিচার, সকলই প্রকাশিত হয়। এমন কি, যেমন এই দিবসে ইহা সুস্পষ্ট, কি প্রকারে ভ্রান্তিপূর্ণ লোকগণকে স্বর্গীয় সুপথের অনুসরণকারীদের নিকট হইতে তাহাদের আকৃতি নিদর্শন দ্বারা পরিজ্ঞাত ও পার্থক্য করা হইতেছে। যদি এই সকল লোক, সম্পূর্ণরূপে কেবল আল্লাহর জন্য এবং নিজের কোনও বাসনা ব্যতীত কেবল তাঁহারই সন্তোষের জন্য তাহাদের অন্তরে স্বর্গীয় গ্রন্থের এই সমুদয় আয়াত সম্বন্ধে অনুধাবন করিত, তাহা হইলে তাহারা যাহা অনুসন্ধান করে, নিশ্চয়ই তাহা পাইত। এই ধর্ম-বিধানে, বড় বা ছোট, যাহা সংঘটিত হইয়াছে, তাহার সবই এই (ক্বোরআন) গ্রন্থের আয়াতসমূহ হইতে অবতীর্ণ ও সুস্পষ্টরূপে প্রকাশিত দেখিতে পাইবেন। এমন কি, তাহারা ইহার মধ্যে আল্লাহর নামসমূহ ও গুণাবলীর প্রকাশগণের জন্মস্থান হইতে অন্যত্র যাত্রা করার, দেশের শাসকবর্গ ও জনসাধারণের প্রতিকূলতা ও ঘৃণ্য ঔদ্ধত্য এবং বিশ্বজনীন ঐশী প্রকাশের একটি নির্দিষ্ট ও বিশিষ্টরূপে নির্দেশিত স্থানে বাস ও বসতি স্থাপন ইত্যাদি বিষয়ের ইঙ্গিতসমূহ অবগত হইবে। যাহার নিকট উপলব্ধি করার অন্তর আছে, সে ব্যতীত অন্য কোনও লোক কিন্তু ইহা বুঝিতে সক্ষম নহে।
আমরা আমাদের আলোচ্য বিষয় উহা দ্বারা সীল- মোহরাঙ্কিত করিতেছি. যাহা পূর্বে হজরত মোহাম্মদ (সঃ)-র নিকট অবতীর্ণ হইয়াছিল, যেন ইহার সীল-মোহর সেই কস্তুরীর সুগন্ধ ছড়াইতে পারে—যাহা মানুষকে অম্লান উজ্জ্বলতার স্বর্গীয় ‘রেজওয়ান’-উদ্যানে লইয়া যায়। তিনি বলিয়াছেন, এবং তাঁহার বাক্য সত্যই ঃ “এবং আল্লাহ্ শান্তি-নিকেতনের দিকে আহ্বান করিয়াছেন, এবং যাহাকে ইচ্ছা সরল সুপথের দিকে পরিচালিত করিয়া থাকেন।” (ক্বোরআন ১০।২৫)। “তাহাদের জন্য তাহাদের প্রভূর নিকট শান্তি-নিকেতন রহিয়াছে, এবং তাহারা যাহা করিতেছিল তজ্জন্য তিনি তাহাদের রক্ষক হইবেন।” (ক্বোরআন ৬।১২৭)। ইহা তিনি অবতীর্ণ করিয়াছেন, যেন তাঁহার অনুকম্পা সমস্ত পৃথিবী পরিবেষ্টন করিতে পারে। সর্বপ্রশংসা আল্লাহরই, যিনি সকলের প্রভূ!
আমরা প্রত্যেক বিষয়ের অর্থ নানাভাবে ও বারংবার প্রকাশ করিয়াছি, যেন হয়ত, উচ্চ, নীচ, প্রত্যেক আত্মা, নিজ নিজ শক্তির পরিমাণ ও সামর্থ্য অনুসারে তাহা হইতে তাহার নিজের অংশ ও ভাগ পাইতে পারে। যদি সে কোনও একটি বিতর্কের বিষয় বুঝিয়া লইতে অপারগ হয়, তবে সে অন্যটির দ্বারা তাহার উদ্দেশ্য সফল করিতে পারিবে। “যেন সকল প্রকার লোক জানিতে পারে, কোথায় তাহাদের তৃষ্ণা নিবারণ করিতে পারে।”
আল্লাহর শপথ! এই স্বর্গীয় বিহঙ্গম, যিনি এক্ষণে মৃত্তিকার উপর অবস্থানকারী, এই সকল সুমধুর গীতি ব্যতীত, সহস্র সহস্র গান উচ্চারণ করিতে পারে এবং এই সকল উচ্চারিত বাক্য ব্যতীত, অসংখ্য রহস্য ভেদ করিতে পারে। ইহার অনুচ্চারিত বাক্যাবলীর প্রত্যেকটির সুর ইতিপূর্বে যাহা অবতীর্ণ হইয়াছে, তাহা অপেক্ষা অপরিমিতরূপে উন্নত এবং এই লেখনী হইতে যাহা অবতীর্ণ হইয়াছে, তাহা অপেক্ষা অতীব প্রভাসম্পন্ন। ভবিষ্যৎ সেই নির্দিষ্ট সময় প্রকাশ করিবে, যখন মর্মার্থসূচক সুসজ্জিত বধূসমূহ আল্লাহর ইচ্ছানুসারে তাহাদের আধ্যাত্মিক আলয় হইতে অবগুন্ঠন বিহীন দ্রুত বহির্গত হইবে এবং সনাতন অস্তিত্ব রাজ্যে নিজেকে প্রকাশ করিবে। তাঁহার অনুমতি ব্যতীত কিন্তু কিছুই সম্ভবপর নহে; তাঁহার শক্তির মাধ্যম ব্যতীত কোনও শক্তিই স্থায়ী হইতে পারে না; এবং তিনি ব্যতীত অন্য কোনও উপাস্য নাই। সৃষ্ট জগৎ তাঁহারই, এবং ঐশী প্রত্যাদেশ তাঁহারই। সকলেই তাঁহার প্রত্যাদেশ ঘোষণা করে এবং সকলেই তাঁহার পরমাত্মার রহস্যসমূহ প্রকাশ করে।
আমরা ইতিপূর্বে পূর্ববর্তী পৃষ্ঠাসমূহে অনাদি-অনন্ত পবিত্রতার উদয়াচল হইতে সমুদিত প্রত্যেক জ্যোতিষ্ককে দুইটি পদবী প্রদান করিয়াছি। এই দুইটি পদবীর একটি হইতেছে মৌলিক একত্বের পদবী, যেমন আমরা ইতিপূর্বে ব্যাখ্যা করিয়াছি। আমরা তাহাদের কাহারও মধ্যে কোন প্রভেদ করি না।” (ক্বোরআন ২।১৩৬)। অপরটি হইতেছে, প্রভেদের পদবী এবং ইহা সৃষ্ট জগতের ও মানবীয় সঙ্কীর্ণতার সহিত সম্পর্কিত। এই পদবীতে প্রত্যেক ঐশী প্রকাশের জন্য একটি বিশেষ ব্যক্তিত্ব, একটি সঠিক সীমা, নির্দিষ্ট বিধান নিরূপিত একটি পূর্ব-নির্ধারিত প্রত্যাদেশ এবং বিশেষভাবে অবধারিত সীমাবদ্ধতা আছে। প্রত্যেকেই একটি নির্দিষ্ট ভিন্ন নামে অভিহিত, একটি বিশেষ বিশেষণে বিশেষিত, প্রত্যেকেরই একটি সুনির্দিষ্ট বিধান ও কর্তব্য রহিয়াছে, এবং প্রত্যেকের উপর একটি বিশেষ প্রত্যাদেশ সমর্পিত হইয়াছে। যেমন তিনি বলিয়াছেনঃ “ কতিপয় রসুলকে আমরা অপেক্ষকৃত অধিকতর প্রাধান্য প্রদান করিয়াছি। তাঁহাদের কয়েকজনের সহিত আল্লাহ্ কথোপকথন করিয়াছেন, অপর কয়েকজনের পদ তিনি উন্নত ও মহিমান্বিত করিয়াছেন এবং মরিয়মের পুত্র যীশুকে আমরা প্রকাশ্য নিদর্শন দিয়াছিলাম এবং তাঁহাকে পরমাত্মার বলে বলীয়ান করিয়াছিলাম।” (ক্বোরআন ২।২৫৩)।
তাঁহাদের পদবীতে ও দৌত্য-কার্যে পার্থক্যের কারণে এই সকল ঐশী জ্ঞানের উৎসের বর্ণিত বাক্যে ও উচ্চারিত বাণীসমূহে পার্থক্য ও বিভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। পক্ষান্তরে, যাহারা স্বর্গীয় বিজ্ঞতার রহস্যসমূহে দীক্ষিত হইয়াছে, তাহাদের চক্ষে তাঁহাদের উচ্চারিত বাণীসমূহ বাস্তবতঃ একটিমাত্র সত্যেরই বিভিন্ন প্রকাশমাত্র। যেহেতু অধিকাংশ লোক ঐ সকল পূর্বোল্লিখিত পদবীর পার্থক্য ও প্রকৃত মূল্য নির্ধারণ করিতে সমর্থ হয় নাই, সুতরাং তাহারা এই সকল ঐশী প্রকাশের উচ্চারিত বিভিন্ন বাক্য দ্বারা ব্যাকুল ও ভীত হয়, যদিও সেগুলি মূলতঃ এক ও অভিন্ন।
ইহা সর্ব সময়েই সুস্পষ্ট হইয়াছে যে, এই সকল উচ্চারিত বাক্যের বিভিন্নতা তাঁহাদের পদবীর পার্থক্যের প্রতিই আরোপনীয়। এইরূপে, তাঁহাদের এককত্বের ও চরম ত্যাগের পদবীর দিক হইতে লক্ষ্য করিলে এই সকল অস্তিত্বের সারাৎসারের প্রতি ঐশীত্বপূর্ণ দেবত্ব, পরম এককত্ব ও মৌলিক সারাৎসারত্ব প্রভৃতি গুণাবলী আরোপ করা হইয়াছে ও হইয়া থাকে, কারণ, তাঁহারা সকলেই স্বর্গীয় প্রত্যাদেশের সিংহাসনে বিরাজমান এবং স্বর্গীয় নিগূঢ় রহস্যের আসনে অধিষ্ঠিত আছেন। তাঁহাদের আবির্ভাবের মাধ্যমে আল্লাহর সুষমার অবতরণ হয়। এইরূপেই, স্বর্গীয় অস্তিত্বের এই সকল প্রকাশের মাধ্যমে যেন স্বয়ং আল্লাহরই কণ্ঠস্বর শ্রুত হইয়াছে।
তাঁহাদের দ্বিতীয় পদবী অর্থাৎ বিভিন্নতা, স্বতন্ত্র্য, ঐহিক সীমাবদ্ধতা, বিশেষত্ব ও নিদর্শনাবলী প্রভৃতি পদবীর দিক হইতে দৃষ্টিপাত করিলে দেখিতে পাওয়া যাইবে যে, তাঁহারা পূর্ণ দাসত্ব, চরম রিক্ততা ও একান্ত আত্ম-বিলুপ্তিই প্রকাশ করিয়া থাকেন। যেমন তিনি বলেনঃ “আমি আল্লাহর একজন দাসমাত্র। নিশ্চয়ই আমি তোমাদের ন্যায় একজন মানব।” (ক্বোরআন ৪১।৬)।
এই সমুদয় অকাট্য ও পূর্ণরূপে প্রমাণিত বর্ণনা হইতে আপনার জিজ্ঞাসিত প্রশ্নগুলির অর্থ উপলব্ধি করিতে চেষ্টা করুন, যেন আপনি আল্লাহর ধর্মের সংকল্পে দৃঢ় হইতে পারেন, এবং তাঁহার পয়গম্বর ও মনোনীতগণের উক্তিসমূহের বিভিন্নতা দ্বারা ভীত না হন।
যদি আল্লাহর পূর্ণ প্রকাশগণের মধ্য হইতে একজন বলেনঃ “আমিই আল্লাহ্!” তিনি নিশ্চয়ই সত্য কথা বলেন, ইহাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহের স্থান নাই। কেন না, ইহা পুনঃ পুনঃ প্রদর্শিত হইয়াছে যে, তাঁহাদের প্রকাশ, তাঁহাদের নাম ও বিশেষণের মাধ্যমেই আল্লাহর প্রকাশ, তাঁহার নাম ও বিশেষণগুলি পৃথিবীতে প্রকাশিত হইয়া থাকে। এইরূপে অবতীর্ণ করিয়াছেনঃ “যখন তুমি তীর নিক্ষেপ করিয়াছিলে, তুমি উহা নিক্ষেপ কর নাই; কিন্তু আল্লাহ্ই নিক্ষেপ করিয়াছিলেন।” (ক্বোরআন ৮।১৭)। এবং তিনি আরও বলেনঃ “বাস্তবিকই, যাহারা বশ্যতা স্বীকার করিয়াছিল, তাহারা আল্লাহরই প্রতি বশ্যতা স্বীকার করিয়াছিল।” (ক্বোরআন ৪৮।১০)। এবং যদি তাঁহাদের যে-কোনও একজন উচ্চারণ করিতেনঃ “ আমি আল্লাহর রসুল” তাহা হইলে তিনি সত্য কথাই বলেন, ইহা নিঃসন্দিগ্ধ সত্য। যেমন তিনি বলেনঃ “মোহাম্মদ (সঃ) তোমাদের মধ্যস্থ কোনও পুরুষের পিতা নহেন, বরং তিনি আল্লাহর রসুল।” (ক্বোরআন ৩৩।৪০)। এই আলোতে দৃষ্টিপাত করিলে তাঁহারা সকলেই সেই অপরিবর্তনশীল সারাৎসারের, সেই আদর্শ সম্রাটের প্রেরিত রসুল। এবং যদি তাঁহারা সকলেই ঘোষণা করিতেনঃ “আমিই নবীগণের সীল-মোহর”, তাহা হইলে তাঁহারা নিশ্চয়ই সত্য কথাই বলিতেন, ইহাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকিত না। কেন না, তাঁহারা সকলেই এক ব্যক্তি, এক আত্মা, এক আধ্যাত্মিক সত্তা, এক অস্তিত্ব, এক প্রকাশ মাত্র। তাঁহারা সকলেই “আদি” ও “অন্ত”, “প্রথম” ও “শেষ”, “দৃশ্য” ও “অদৃশ্য”, এই সকল গুণের প্রকাশ, এবং এই সকল তাঁহারই, যিনি আত্মাসমূহের নিগূঢ় পরমাত্মা ও যিনি সারসত্তাসমূহের অনাদি-অনন্ত সারাৎসার। এবং যদি তাঁহারা বলেনঃ “আমরা আল্লাহর ভৃত্য” (ক্বোরআন ৩৩।৪০), ইহাও সুস্পষ্ট ও অকাট্য সত্য। কেন না, তাঁহারা সীমাহীন দাসত্বের পদবীতে অধিষ্ঠিত হইয়া প্রকাশিত হইয়াছেন, যেরূপ দাসত্ব সম্ভবতঃ কোনও মানবই লাভ করিতে সক্ষম নহে। এইরূপে যে সময় এই সকল অস্তিত্বের সারাৎসার, ঐশী অনাদি-অনন্ত পবিত্রতার সমুদ্রে নিমজ্জিত থাকিতেন, অথবা স্বর্গীয় রহস্যাবলীর উচ্চতম শৃঙ্গে উড্ডীন থাকিতেন, তখন তাঁহারা তাঁহাদের বাক্যেচ্চারণকে ঐশীত্বের স্বর, স্বয়ং আল্লাহরই আহ্বান ধ্বনি বলিয়া দাবি করিতেন। সুতীক্ষè দৃষ্টিসম্পন্ন চক্ষু যদি খোলা হয়, তাহা হইতে বুঝিলে পারা যায় যে, তাঁহারা এইরূপ অবস্থায় নিজেদের সেই পরম সার্বজনীন অস্তিত্বের ও অবিনশ্বর অক্ষয়ের সম্মুখে সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত ও সত্তাবিহীন মনে করিয়াছেন। বোধ হয় তাঁহারা নিজেদের সম্পূর্ণ সত্তাবিহীন বলিয়া মনে করিয়াছেন, এবং সেই প্রাঙ্গনে নিজেদের উল্লেখকে আল্লাহর প্রতি একটি অবজ্ঞাসূচক বাক্য বলিয়া মনে করিয়াছেন। কারণ এইরূপ প্রাঙ্গনে নিজ অস্তিত্বে বিন্দুমাত্র পরোক্ষ কল্পনা, আত্ম-প্রধানতা ও স্বাধীন সত্তা প্রমাণ করে। যাঁহারা সেই দরবারে প্রবেশাধিকার লাভ করিয়াছেন, তাঁহাদের চক্ষে এইরূপ একটি সঙ্কেত একটি সাংঘাতিক বিচ্যুতি। যদি সেই উপস্থিতিতে অন্য কিছুর উল্লেখ করা হইত, যদি মানুষের অন্তর, জিহ্বা, মন বা আত্মা, প্রেমাস্পদ ব্যতীত অন্য কাহারও সহিত লিপ্ত থাকিত, তাঁহার সুষমা ব্যতীত যদি তাহার চক্ষু অন্য কাহারও আনন অবলোকন করিত, তাঁহার স্বর ব্যতীত তাহার কর্ণ যদি অন্য কোনও গীতির দিকে আকৃষ্ট থাকিত, এবং তাহার পদদ্বয় তাঁহার পথে ব্যতীত অন্য কোনও পথে বিচরণ করিত, তাহা হইলে ইহা কতই অধিকতর সাংঘাতিক কার্য হইত।
অদ্যকার দিনে আল্লাহর মৃদু সমীরণ প্রবাহিত হইয়াছে এবং তাঁহার পরমাত্মা সকলের মধ্যে প্রবেশ লাভ করিয়াছে। তাঁহার অনুকম্পার বর্ষণ এইরূপ অত্যধিক হইয়াছে যে, লেখনী নিস্তব্ধ ও জিহ্বা বাকশক্তিহীন।
এই পদের অধিকারী হওয়ায় তাঁহারা নিজেদের জন্য ঐশীত্বের স্বর ইত্যাদি দাবি করিয়াছেন, অন্যপক্ষে, ঐশী সংবাদ-বাহকত্বের পদের জন্য তাঁহারা আপনাদিগকে আল্লাহর সংবাদ-বাহক বলিয়া প্রকাশ করিয়াছেন। প্রত্যেক স্থানে তাঁহারা উক্ত স্থানের ও সময়ের ও পরিবেশের উপযোগী বাক্য উচ্চারণ করিয়াছেন এবং এই সকল ঘোষণাকে নিজেদের প্রতি আরোপ করিয়াছেন, এই সকল ঘোষণা স্বর্গীয় প্রকাশের রাজ্য হইতে সৃষ্টি-জগতের প্রতি ও ঐশিত্বের রাজ্য হইতে, এমন কি, পার্থিব অস্তিত্ব জগতের দিকে প্রকাশিত হইয়াছে। সুতরাং তাঁহারা ঐশীত্ব, প্রভূত্ব, ভবিষ্যদ্বক্তৃত্ব, বার্তা-বাহকত্ব, অভিভাবকত্ব, প্রেরিতত্ব, বা দাসত্ব সম্পর্কে যাহাই বলুন না কেন, তাহা সমস্তই সর্বতোভাবে সত্য, সন্দেহাতীত। সুতরাং, আমাদের বক্তব্যের প্রসঙ্গে আমরা যে সমস্ত বাক্য বলিয়াছি, তাহা মনোযোগ সহকারে বিবেচনা করুন, যেন অদৃশ্যলোকের প্রকাশগণের ও পবিত্রতার প্রভাতসমূহের উচ্চারিত বিভিন্ন বাক্য আপনার আত্মাকে আলোড়িত করিতে ও আপনার মনকে ব্যকুল করিতে না পারে।
সত্যের জ্যোতিষ্কসমূহের উচ্চারিত বাক্যগুলি বিশেষভাবে অনুধাবন করিতে হইবে, এবং যদি উহার মর্মার্থ গ্রহণ করিতে অসমর্থ হন, তাহা হইলে জ্ঞান-ভান্ডারের অধিকারীগণের নিকট হইতে আলোক অনুসন্ধান করিতে হইবে, যেন তাঁহারা উহার অর্থ ব্যাখ্যা করিতে পারেন এবং উহাদের রহস্য ভেদ করিতে পারেন। কারণ, পবিত্র বাক্যগুলি নিজের অসম্পূর্ণ বোধ-শক্তি দ্বারা ব্যাখ্যা করা কোনও লোকের পক্ষে উচিত নহে, আর ইহাদের নিজেদের ইচ্ছা ও বাসনার বিপরীত প্রাপ্ত হইয়া উহাদের পরিত্যাগ করা ও উহাদের সত্য অস্বীকার করাও উচিত নহে। কারণ, অদ্যকার দিনে এই যুগের ধর্মাচার্য ও শিক্ষিত ধর্ম-নেতাগণ, যাহারা জ্ঞান ও বিদ্যার সকল স্থান অধিকার করিয়া বসিয়াছে, এবং যাহারা অজ্ঞতাকে জ্ঞান আখ্যা দিয়াছে, এবং অত্যাচারকে ন্যায়বিচার নামে অভিহিত করিয়াছে, তাহাদের আচরণ এইরূপই। যদি ইহারা সেই বদ্ধমূল ধারণা, যাহা তাহাদের অলস কল্পনা গড়িয়াছে, তাহাদের সম্বন্ধে সত্যের আলোক প্রাপ্ত লোকের নিকট জিজ্ঞাসা করিত এবং যদি তাহারা তাঁহার উত্তর তাহাদের ধারণার, ও ঐশী গ্রন্থের আয়াতাদির মর্ম তাহাদের উপলব্ধির বিপরীত প্রাপ্ত হইত, তাহা হইলে যিনি সর্ব জ্ঞানের খনি ও উৎস, তাহারা নিশ্চয়ই তাঁহাকে জ্ঞানহীন মূর্খ বলিয়া তাঁহার বদনাম করিত। প্রত্যেক যুগেই এইরূপ ঘটিয়াছে।
দৃষ্টান্ত স্বরূপ বলা যায়, যখন অস্তিত্ব জগতের প্রভূ হজরত মোহাম্মদ (সঃ)-কে নবচন্দ্রসমূহ সম্বন্ধে প্রশ্ন করা হইয়াছিল, তখন তিনি আল্লাহর আদেশমতে উত্তরে বলেছিলেন ঃ “উহারা মানুষের সময়-নির্দেশক উপায়।” (ক্বোরআন ২।১৮৯)। ইহাতে, যাহারা তাঁহাদের উত্তর শুনিয়াছিল, তাহারা তাঁহাকে একজন অজ্ঞ লোক বলিয়া গালি দিয়াছিল।
সেই প্রকারে, “পবিত্রাত্মা” সম্পর্কীয় আয়াতে তিনি বলিয়াছেনঃ “এবং তাহারা তোমাকে পবিত্র-আত্মা সম্বন্ধে জিজ্ঞসা করিতেছে। তুমি বলঃ ‘পবিত্রাত্মা আমার প্রতিপালক প্রভূর আদেশেই আবির্ভূত হইয়া থাকেন।” (ক্বোরআন ১৭।৮৫)। হজরত মোহাম্মদ (সঃ) যখন এইরূপ উত্তর দিয়াছিলেন, তখন তাহারা সকলে গোলমাল বাধাইয়া অস্বীকার করিয়া বলিল ঃ “দেখ ! ইনি এমন একজন অজ্ঞ লোক যিনি আত্মা কি, তাহা জানেন না, তিনি নিজেকে স্বর্গীয় জ্ঞানের অবতরণকারী বলিয়া প্রকাশ করেন!” এবং এক্ষণে, এই যুগের ধর্মাচার্যগণের প্রতি লক্ষ্য করিয়া দেখুন, যেহেতু তাহারা তাঁহার নামের দ্বারা সম্মানিত হইয়াছে এবং যেহেতু তাহাদের পিতৃ-পুরুষেরা তাঁহার অবতীর্ণ বাণীর সত্যতা স্বীকার করিয়াছে, সেইহেতু তাহারাও অন্ধের ন্যায় তাঁহার সত্য স্বীকার করিয়া লইয়াছে। লক্ষ্য করিয়া দেখুন, এই সকল লোক যদি অদ্যকার দিনে এইরূপ উত্তর পাইত, তাহা হইলে তাহারা তৎক্ষণাৎ তাহাদিগকে প্রত্যাখ্যান করিত ও গালি দিত—শুধু তাহাই নহে, তাহারা পুনরায় সেইরূপই আপত্তি করিত, যেমন তাহারা অদ্যকার দিনেও একই রূপ গালি উচ্চারণ করিয়াছে। এইরূপই ঘটিয়াছে ও ঘটিতে থাকিবে, যদিও সত্তার এই সকল সারাৎসার এইরূপ কাল্পনিক প্রতিমা-সদৃশ ধারণাসমূহ হইতে অনেক মহিমান্বিত এবং এই সকল অলস বাক্যের বহু ঊর্ধে অবস্থিত এবং উপলব্ধি সম্পন্ন অন্তরের বোধগম্যতার অপরিমেয় রূপে উচ্চ মহিমান্বিত। তাহাদের তথাকথিত বিদ্যা ঐ জ্ঞানের তুলনায় সম্পূর্ণ মিথ্যা পদবাচ্য এবং তাঁহাদের সকল উপলব্ধি সত্যই ভ্রান্তি বৈ আর কিছু নহে। শুধু ইহাই নহে, এই সকল স্বর্গীয় বিজ্ঞতার খনি ও অনাদি-অনন্ত জ্ঞানের ভান্ডার হইতে যাহা কিছু নির্গত হয়, তাহা সত্য এবং সত্য বৈ আর কিছুই নহে। এই বাক্যঃ “জ্ঞান একটি বিন্দু, যাহা মূর্খ লোকেরা বহুগুণে বৃদ্ধি করিয়াছে”, আমাদের বক্তব্যের একটি প্রমাণ এবং এই হাদীস ঃ “ জ্ঞান একটি আলোক, যাহা আল্লাহ্ যাহার অন্তরে চাহেন প্রতিক্ষেপ করেন”, আমাদের বাক্য সপ্রমাণ করে।
যেহেতু তাহারা প্রকৃত জ্ঞানের অর্থ হৃদয়ঙ্গম করে নাই এবং তাহাদের ঐরূপ কল্পনাপ্রসূত ঐ সকল প্রতিমাকে ঐ নামে অভিহিত করিয়াছে, যাহা অজ্ঞতার ধারণা হইতে উৎপন্ন হইয়াছে; সুতরাং তাহারা জ্ঞানের উৎসের প্রতি সেই গালি বর্ষণ করিয়াছে বা শাস্তি প্রদান করিয়াছে, যাহা আপনি শুনিয়াছেন ও দেখিতে পাইয়াছেন।
একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া হইতেছে। কোনও এক ব্যক্তি (নাম, হাজী মির্জা করিম খান), যে তাহার বিদ্যা ও বিদ্যাবত্তার জন্য খ্যাত এবং যে নিজেকে তাহার লোকদের একজন প্রধান নেতা মনে করিয়া তাহার গ্রন্থে সত্য-জ্ঞানের সকল ব্যাখ্যাদাতাকে গালি দিয়াছে ও ভয় প্রদর্শন করিয়াছে। গ্রন্থের সর্বত্র তাহার পরিষ্কার বর্ণনা ও ইঙ্গিত হইতে ইহা প্রচুর পরিমাণে সুস্পষ্ট হয়। আমরা বার বার তাহার নাম শ্রবণ করায় তাহার কতিপয় পুস্তক পড়িবার ইচ্ছা করিয়াছিলাম, যদিও আমরা অন্য লোকের লেখা পড়িতে ইচ্ছুক নহি, তত্রাচ কতিপয় লোক তাহার সম্বন্ধে আমাদিগকে প্রশ্ন করায় যেন আমরা জ্ঞান ও বুদ্ধির সহিত প্রশ্নকর্তাগণকে উত্তর দিতে পারি, তজ্জন্য আমরা তাহার পুস্তকের প্রতি ইঙ্গিত করিতে বাধ্য হইলাম। তাহার আরবী ভাষায় লিখিত পুস্তক পাওয়া যায় নাই, অবশেষে একজন লোক আমাদিগকে তাহার একটি লেখা সম্বন্ধে অবগত করাইল। ইহার নাম ‘এশাদুল আ’ওয়াম’ (অজ্ঞলোকদের পথ-প্রদর্শন) এবং ইহা শহরে পাওয়া যাইবে। আমরা পুস্তকের নাম হইতে লোকটির আত্মাভিমান ও বৃথা গর্বের গন্ধ পাইলাম, কারণ সে নিজেকে একজন শিক্ষিত ও অবশিষ্ট লোককে অজ্ঞ মনে করিয়াছিল। তাহার গুণাগুণ তাহার পুস্তকের নাম-করণ হইতে অবগত হওয়া গেল। ইহা পরিষ্কারভাবে উপলব্ধি হইল যে, প্রন্থকার নিজের স্বার্থ ও বাসনার পথ অনুসরণ করিতেছিল এবং অজ্ঞতার ও মূর্খতার মরুভূমিতে পথ হারাইয়া ফেলিয়াছিল। বোধ হয়, সে বিখ্যাত হাদীস ভুলিয়া গিয়াছে, যাহাতে বলা হইয়াছে, “জ্ঞান উহাই, যাহা জানিতে পারা যায়; এবং শক্তি ও ক্ষমতা, সকলই সৃষ্ট। ইহা সত্ত্বেও আমরা পুস্তকটি আনাইয়া লইলাম এবং কিছুদিন আমাদের সঙ্গে রাখিয়াছিলাম। খুব সম্ভব ইহার প্রতি দুইবার ইঙ্গিত করা হইয়াছে। দ্বিতীয়বার, ঘটনাক্রমে আমরা হজরত মোহাম্মদ (সঃ)-র মি’রাজ সম্বন্ধে গল্প সেখানে উল্লিখিত দেখিতে পাইলাম, যাঁহার সম্বন্ধে বলা হইয়াছে ঃ “তুমি না হইলে, আমি ম-লাদি সৃষ্টি করিতাম না।” আমরা দেখিতে পাইলাম, মি’রাজের রহস্য উপলব্ধি করিবার জন্য সে বিশটি বা ততোধিক বিজ্ঞানের একান্ত প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে উল্লেখ করিয়াছে। তাহার বর্ণনা হইতে আমরা বুঝিতে পারিলাম যে, একজন লোক সমুদয় বিজ্ঞান শাস্ত্রে সুপন্ডিত না হইলে তাহার পক্ষে এইরূপ একটি সর্বশ্রেষ্ঠ ও অত্যুচ্চ বিষয়ের সঠিক জ্ঞানলাভ কখনও সম্ভবপর হইতে পারে না। বিশেষভাবে উল্লিখিত বিজ্ঞানসমূহের মধ্যে মনো-বিজ্ঞান সম্বন্ধীয় সূক্ষ্ম জ্ঞান-বিজ্ঞান, কিমিয়া বা রসায়ন-বিজ্ঞান, এবং প্রকৃতিক ইন্দ্রজাল বিদ্যা রহিয়াছে। এইরূপ অকেজো ও পরিত্যক্ত বিদ্যাবত্তাকে এই লোকটি স্বর্গীয় জ্ঞানের পবিত্র ও চিরস্থায়ী রহস্যাবলীকে উপলব্ধির জন্য পূর্বাবশ্যকীয় বিষয়াদি বলিয়া মনে করিয়াছে।
মহিমাময় আল্লাহ্! তাঁহার জ্ঞান-বুদ্ধির মাপকাঠি এইরূপই। তত্রাচ, দেখুন কতই-না মিথ্যা বাদানুবাদ ও মিথ্যা অপবাদ সে আল্লাহর অনন্ত-অসীম জ্ঞানের ঐসকল আধারের উপর স্তূপাকারে বর্ষণ করিয়াছে। কত উত্তম ও কত সত্য এই বাক্যঃ “ তুমি কি তোমার মিথ্যা অপবাদসমূহ তাঁহাদেরই আননের উপর নিক্ষেপ কর, যাঁহাদিগকে একমাত্র স্বয়ং আল্লাহ্ তাঁহার সপ্তম স্বর্গম-লের ধনাগারসমূহের বিশ্বস্ত কোষাধ্যক্ষ নিযুক্ত করিয়াছেন ? উপলব্ধি সম্পন্ন একটি অন্তর বা মনও, জ্ঞানবান ও শিক্ষিত লোকদের মধ্যে একজন লোকও এই অসম্ভব বর্ণনাদির প্রতি লক্ষ্য করে নাই। অথচ প্রত্যেক তীক্ষè দৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তির পক্ষে ইহা কতই পরিষ্কার ও সুস্পষ্ট যে, এই প্রকারের তথাকথিত বিষয় সর্বদাই একমাত্র আল্লাহ্ কর্তৃক পরিত্যক্ত হইয়া আসিয়াছে। এই সমস্ত বিজ্ঞানের জ্ঞান, যাহা প্রকৃত শিক্ষিত ব্যক্তিদের চক্ষে অত্যন্ত ঘৃণার্হ, যখন মি’রাজের প্রভূ স্বয়ং এই সকল সীমাবদ্ধ ও অস্পষ্ট বিদ্যার একটিমাত্র অক্ষরের জ্ঞানেও ভারাক্রান্ত ছিলেন না, এবং এই সকল কল্পিত ভ্রান্ত ধারণা কখনও তাঁহার অন্তর কলুষিত করে নাই, তখন মি’রাজের রহস্যাবলী উপলব্ধির কার্যে কি রূপে এইগুলিকে অত্যাবশ্যকীয় বলিয়া বিবেচনা করা যাইতে পারে ? তিনি কত সত্য কথাই না বলিয়াছেনঃ “মনুষ্য-লব্ধ সকল জ্ঞান একটি খঞ্জ গর্ধবের পৃষ্ঠের উপরেই সওয়ার হইয়া চলে; কিন্তু সত্য বাতাসের উপর আরোহণ করিয়া তীরবেগে দূরবর্তী স্থান অতিক্রম করে।” আল্লাহর ন্যায়পরায়ণতার শপথ! যে-কেহ এই মি’রাজের রহস্য ভেদ করিতে ইচ্ছা করে, এবং এই মহাসাগর হইতে একটিমাত্র জলবিন্দু পান করিতে বাসনা করে, যদি এই সমস্ত বিদ্যার ধুলি দ্বারা তাহার অন্তর ইতিপূর্বে অন্ধকারাচ্ছন্ন হইয়া থকে, তাহা হইলে এই রহস্যের আলোক তাহাতে প্রতিফলিত হওয়ার পূর্বে তাহাকে নিশ্চয়ই ইহা পরিষ্কার ও পবিত্র করিতে হইবে।
বর্তমানে যাঁহারা পুরাতন ঐশী জ্ঞান-সমুদ্রের মধ্যে নিমজ্জিত আছেন এবং স্বর্গীয় বিজ্ঞতার তরণীর মধ্যে বাস করেন, তাঁহারা জনগণকে এই সকল অলস কার্যাদি করিতে নিষেধ করিয়াছেন। আল্লাহ্ প্রশংসাময়! তাঁহাদের উজ্জ্বল বক্ষসমূহ সেই প্রকার বিদ্যার প্রত্যেক রেখা হইতে পবিত্র এইরূপ সাংঘাতিক পদাসমূহের ঊর্দ্ধে অবস্থিত। আমরা প্রেমাস্পদের প্রেমের অগ্নি সর্বাপেক্ষা গাঢ়তম যবনিকা দগ্ধ করিয়া ফেলিয়াছি—এই বাক্যে এই যবনিকা সম্বন্ধে ইঙ্গিত করা হইয়াছেঃ “জ্ঞানের যবনিকা সর্ব প্রকার যবনিকার মধ্যে সর্বাপেক্ষা মারাত্মক।” ইহারই ভস্মের উপর আমরা স্বর্গীয় জ্ঞানের মন্দির প্রতিষ্ঠা করিয়াছি। আল্লাহ্ প্রশংসিত হউন! প্রিয়তম প্রেমাস্পদের সুষমার অনল দ্বারা আমরা “প্রভার অন্তরালসমূহ” দগ্ধ করিয়াছি। যিনি সমস্ত পৃথিবীর মানুষের একমাত্র অভিপ্রেত এবং তন্মধ্যস্থ একমাত্র বিভূতি, আমরা মানুষের অন্তর হইতে তাঁহাকে ব্যতীত আর সমস্ত-কিছুই দূরীভূত করিয়াছি। আমরা তাঁহার স্বর্গীয় জ্ঞান ব্যতীত অন্য কোনও জ্ঞানের দিকে আকৃষ্ট হই না এবং তাঁহার দীপ্তিমান প্রভাসমূহের আলোক ব্যতীত অন্য কিছুরই উপর আমাদের অন্তঃকরণ ন্যস্ত করি না।
যখন আমরা বুঝিতে পারিলাম যে, তাহার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে ইহা জানাইয়া দেওয়া যে, সে এই সমুদয় জ্ঞানের অধিকারী ছিল, তখন আমরা আশ্চর্যান্বিত হইলাম। এবং তত্রাচ, আমি আল্লাহর শপথ করিয়া বলিতেছি যে, স্বর্গীয় জ্ঞানের উদ্যান হইতে বায়ুর একটিমাত্র নিঃশ্বাসও তাহার আত্মার উপর দিয়া প্রবাহিত হয় নাই, আর, সে পুরাতন জ্ঞানের একটিমাত্র রহস্যও কখনও ভেদ করিতে পারে নাই। শুধু ইহাই নহে। যদি সত্য জ্ঞানের অর্থ কখনও তাহার নিকট ব্যাখ্যা করা হয়, তাহা হইলে আতঙ্কে তাহার অন্তর পরিপূর্ণ হইবে এবং তাহার সমস্ত অস্তিত্বের ভিত্তিমূল পর্যন্ত প্রকম্পিত হইবে। তাহার এই হেয় অর্থহীন বর্ণনা সত্ত্বেও, দেখুন, তাহার দাবি কতখানি শীর্ষস্থানে পৌঁছিয়াছে।
আল্লাহ্ মহিমময়! কি ভাবে জনসাধারণ তাহার চতুর্দিকে একত্রিত হইয়াছে এবং তাহার ব্যক্তিত্বের প্রতি বশ্যতা স্বীকার করিয়াছে, তদ্দৃষ্টে আমরা অতীব বিস্মিত হইয়াছি। ক্ষণস্থায়ী নগণ্য ধুলার প্রতি সন্তুষ্ট হইয়া এই সকল লোক তাহার দিকে মুখ ফিরাইয়াছে এবং যিনি প্রভূগণের মহাপ্রভূ, তাঁহার প্রতি পৃষ্ঠ প্রদর্শন করিয়াছে। কাকের ধ্বনিতে সন্তুষ্ট হইয়া এবং কৃষ্ণবর্ণ কাকের চেহারা দৃষ্টে মুগ্ধ হইয়া তাহারা বুল্বুল্ পক্ষীর সুমধুর গান ও গোলাপ পুষ্পের মোহ পরিত্যাগ করিয়াছে। এই ভ্রান্ত দাবিপূর্ণ পুস্তক পাঠে কত অবাচ্য কুতর্কই-না প্রকাশিত হইয়াছে—লেখনীর সাহায্যে প্রকাশ করার পক্ষে উহা সম্পূর্ণ অযোগ্য এবং উহা এত নীচ যে, এক মূহুর্তের জন্যও তৎপ্রতি মনোযোগ দেওয়া যায় না। যাহা হউক, যদি একটি কষ্টি-পাথর পাওয়া যাইত, তাহা হইলে ইহা তৎক্ষণাৎ মিথ্যা হইতে সত্যকে, অন্ধকার হইতে আলোককে এবং ছায়া হইতে সূর্যকে পৃথক করিয়া লইত।
এই প্রতারক ব্যক্তি বিজ্ঞান ভান্ডারের মধ্য হইতে যে-বিজ্ঞানটিকে অত্যাবশ্যক বলিয়া স্বীকার করিয়াছে, তাহা হইল রসায়ন-বিজ্ঞান। আমরা এই আশা পোষণ করি, যেন কোন রাজা বা একজন অতি ক্ষমতাশালী ব্যক্তি তাহাকে আদেশ প্রদান করেন যে, সে যেন এই বিজ্ঞানটিকে কল্পনার রাজ্য হইতে বাস্তব রাজ্যে এবং ভ্রান্ত দাবির ক্ষেত্র হইতে বাস্তব কৃতকার্যতার উদ্যানে লইয়া আসে। এই অশিক্ষিত ও বিনীত ঐশী সেবক, যে কখনও এইরূপ বিষয়াদির কোনও দাবি করে নাই এবং এতৎসমূহকে সত্যজ্ঞানের মানদ- বলিয়া কখনও মনে করে নাই, সেই কার্যের ভার লইতে প্রস্তুত আছে, যাহাতে সত্যকে জানিতে পারা যায় এবং মিথ্যা হইতে ইহাকে পৃথক করিতে পারা যায়। তাহা হইলে ইহাতে কি লাভ হইবে। বর্তমান কালের মানুষ আমাদের যাহা কিছু দিতে পারিয়াছে, তাহা হইল, তাহাদের বর্শার আঘাত এবং একমাত্র পানপাত্র যাহা ইহারা আমাদের অধরের জন্য প্রস্তাব করিয়াছে, তাহা হইল গরলের পাত্র। আমাদের গ্রীবা এখনও পর্যন্ত শৃঙ্খলের ক্ষত-চিহ্ন বহন করিতেছে এবং আমাদের শরীরে কঠোর নিষ্ঠুরতার প্রমাণসমূহ সুস্পষ্টভাবে মুদ্রিত রহিয়াছে।
এবং এই ব্যক্তির অর্জিত বিদ্যা, তাহার অজ্ঞতা, উপলব্ধি ও বিশ্বাস সম্বন্ধে, সেই গ্রন্থ, যাহাতে সকল-কিছুই আছে, দেখুন কি অবতীর্ণ করিয়াছেঃ “নিশ্চয়ই যক্কুম বৃক্ষ (নরকের কণ্টক বৃক্ষ) ‘আসিমের’ (পাপী ব্যক্তির) খাদ্য হইবে।” (ক্বোরআন ৪৪।৪৩-৪৪)। এবং তৎপর কয়েকটি আয়াত উল্লিখিত আছে, অবশেষে তিনি বলেনঃ “ইহা আস্বাদন কর; কারণ তুমি নিশ্চয়ই শক্তিশালী ‘করিম’।” (ক্বোরআন ৪৪।৪৯)। বিবেচনা করিয়া দেখুন, কত পরিষ্কার ও সুস্পষ্টভাবে তাহার সম্বন্ধে অক্ষয় অভ্রান্ত গ্রন্থে বর্ণিত হইয়াছে। যাহা হউক, এই ব্যক্তি বিনয়ের ভান করিয়া, নিজের পুস্তকে নিজেকে “আসিম-দাস” রূপে ইঙ্গিত করিয়াছে। আল্লাহর গ্রন্থে সে হইল “আসিম” এর সাধারণ লোকের মধ্যে “শক্তিশালী” এবং “করিম” (সম্মানার্হ) কীর্তিমান নামে!
পবিত্র আয়াতটি সম্বন্ধে গভীরভাবে চিন্তা করিয়া দেখুন, যেন পবিত্র ক্বোরআনের এই সকল বাক্যের অর্থঃ “সুস্পষ্ট গ্রন্থে বর্ণিত হওয়া ভিন্ন পৃথিবীতে কোনও সবুজ ও শুষ্ক দ্রব্য নাই,” (ক্বোরআন ৬।৫৯), ইহা আপনার অন্তর-ফলকে মুদ্রিত থাকিতে পারে। ইহা সত্ত্বেও বহু সংখ্যক লোক তাহার বশ্যতা স্বীকার করিয়াছে। তাহারা জ্ঞান ও ন্যায়-বিচার-সম্পন্ন মূসা (আঃ)-কে পরিত্যাগ করিয়া অজ্ঞতার সামেলীকে (যাদুকরকে) আঁকড়াইয়া ধরিয়া রহিয়াছে। সত্যের সূর্য, যাহা স্বর্গীয় চিরস্থায়ী আকাশে উজ্জ্বলভাবে জ্বলিতেছে, তাহা হইতে তাহারা তাহাদের চক্ষু ফিরাইয়া লইয়াছে, এবং ইহার উজ্জ্বলতাকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করিয়াছে।
হে ভ্রাতঃ! একটি স্বর্গীয় খনিই কেবল স্বর্গীয় রতœাবলী প্রদান করিতে পারে এবং আধ্যাত্মিক পুষ্পের সৌরভ কেবল স্বর্গীয় আদর্শ উদ্যানেই উপভোগ করিতে পারা যায় এবং একটি নিষ্কলঙ্ক পবিত্র অন্তর-নগর ব্যতীত প্রাচীন বিজ্ঞতার কুমুদ পুষ্পরাজি অন্য কোথাও প্রস্ফুটিত হয় না। “একটি উৎকৃষ্ট উর্বর ভূমিতে উহার প্রভূর আদেশে প্রচুর পরিমাণে শ্যামল ফসল উৎপন্ন হয়, এবং যে-ভূমি নিকৃষ্ট, তাহাতে অপ্রচুর ফসল ব্যতীত কিছুই উৎপন্ন হয় না।” (ক্বোরআন ৭।৫৭)।
যেহেতু ইহা পরিষ্কারভাবে প্রদর্শিত হইয়াছে যে, যাহারা স্বর্গীয় রহস্যাবলীতে দীক্ষিত হইয়াছে, একমাত্র তাহারাই স্বর্গের বিহঙ্গম কর্তৃক উচ্চারিত সুমধুর গীতিসমূহ উপলব্ধি করিতে পারে; অতএব, আলোকোজ্জ্বল অন্তঃকরণ হইতে এবং স্বর্গীয় রহস্যাবলীর ধন-ভান্ডার হইতে আলোক অনুসন্ধান করা প্রত্যেক ব্যক্তির পক্ষেই আবশ্যক, যাহাতে সে আল্লাহর ধর্মের জটিল সমস্যাদি এবং পবিত্রতার প্রভাতসমূহের উচ্চারিত বাক্যাবলীর দুর্বোধ্য ইঙ্গিতাদি উপলব্ধি করিতে পারে। এই প্রকারেই, সমস্ত অর্জিত বিদ্যার সাহায্যে নহে; বরং একমাত্র আল্লাহরই সাহায্যে এবং তাঁহার অনুকম্পার প্রচুর বর্ষণে এই সমস্ত রহস্য ভেদ করা যাইবে। “অতএব, যদি তোমরা না জান, তাহা হইলে যাহাদের নিকট ধর্ম-গ্রন্থাদি আছে, তাহাদের কাছে জিজ্ঞাসা কর।” (ক্বোরআন ১৬।৪৩)।
কিন্তু, হে ভ্রাতঃ! যদি একজন সত্যান্বেষী ঐ পথ, যাহা তাহাকে অনাদি-অনন্ত সত্তার জ্ঞানের পথে লইয়া যাইবে, তাহা অনুসন্ধান করিবার জন্য অগ্রসর হইতে সংকল্প করে, তাহা হইলে তাহাকে সর্বাগ্রে তাহার অন্তরকে —যাহা আল্লাহর আভ্যন্তরীণ রহস্যসমূহের অবতরণের স্থান—তাহার অর্জিত জ্ঞানের অন্ধকারময় ধূলা হইতে এবং শয়তানী কল্পনা সম্বলিত ইঙ্গিতসমূহ হইতে পরিষ্কার ও পবিত্র করিতে হইবে। তাহার বক্ষস্থলকে—যাহা প্রেমাস্পদের চিরস্থায়ী প্রেমের পবিত্র মন্দির, নিশ্চয়ই সর্বপ্রকার অপবিত্রতা হইতে পরিষ্কার করিতে হইবে এবং তাহার আত্মাকে জল ও কর্দমাক্ত সকল কিছু হইতে ও সকল ছায়াচ্ছন্ন ও ক্ষণস্থায়ী কামনাদি হইতে পবিত্র করিতে হইবে। তাহার অন্তরকে অবশ্যই এইরূপভাবে পরিস্কৃত করিতে হইবে, যেন ভালবাসা বা ঘৃণার কোনও অংশ তাহাতে অবশিষ্ট না থাকে, পাছে সেই ভালবাসা তাহাকে অন্ধের ন্যায় ভ্রান্তির দিকে টানিয়া লয় বা সেই ঘৃণা তাহাকে সত্য হইতে দূরে নিক্ষেপ করে। বর্তমান কালে যেমন আপনি দেখিতে পাইতেছেন, কিরূপে অধিকাংশ লোক, এইরূপ ভালবাসা বা ঘৃণার কারণে সেই অবিনশ্বর আনন হইতে বিমুখ হইয়াছে, স্বর্গীয় রহস্যাবলীর প্রতিরূপ হইতে অনেক দূরে চলিয়া গিয়াছে এবং রক্ষকবিহীন অবস্থায় বিস্মৃতি ও ভ্রান্তির মরু-জঙ্গলে ভ্রমণ করিতেছে। সেই অনুসন্ধানকারী সব সময়ে নিশ্চয় আল্লাহর উপর নির্ভরশীল হইবে, পৃথিবীর সকল লোককে পরিত্যাগ করিবে, ধূলিময় পৃথিবী হইতে নিজেকে পৃথক রাখিবে এবং যিনি প্রভূদের প্রভূ, তাঁহারই দিকে আকৃষ্ট থাকিবে। সে কখনও নিজেকে অপর অপেক্ষা উন্নততর মনে করিতে চাহিবে না, তাহার অন্তর-ফলক হইতে সর্ব প্রকারের অহঙ্কার ও বৃথা গর্বের প্রত্যেকটি রেখা মুছিয়া ফেলিবে, সে নিশ্চয়ই সহিষ্ণুতা ও আত্মসমর্পণকে আঁকড়াইয়া ধরিবে, মৌনতা অবলম্বন করিবে এবং নিরর্থক বাক্য বলা হইতে ক্ষান্ত থাকিবে। কারণ জিহ্বা একটি প্রধূমিত অগ্নি এবং অতিরিক্ত কথা বলা একটি মারাত্মক বিষ। জড়-অগ্নি শরীর নষ্ট করে, অন্য পক্ষে, জিহ্বার অগ্নি অন্তর ও আত্মা উভয়কে গ্রাস করে। প্রথমটির প্রভাব অল্পকাল স্থায়ী; কিন্তু পরবর্তীটির ফল শতাব্দীকাল যাবৎ স্থায়ী হয়।
সেই সত্যান্বেষণকারী পরোক্ষ নিন্দাকেও একটি সাংঘাতিক ভ্রান্তি বলিয়া মনে করিবে এবং ইহার পরাক্রম হইতে নিজেকে দূরে রাখিবে, কেন না, পরোক্ষ নিন্দা অন্তরের আলোক নির্বাপিত করে এবং আত্মার প্রাণ হরণ করে। তাহাকে অল্পে সন্তুষ্ট থাকিতে হইবে এবং সর্বপ্রকার অপরিমিত বাসনা হইতে মুক্ত হইতে হইবে । যাহারা বস্তুলিপ্সাহীন, তাহাদের সঙ্গ মূল্যবান সম্পদ মনে করিতে হইবে এবং অহঙ্কারী ও সংসারী লোকের সঙ্গ ত্যাগ করা একটি বহু মূল্যবান লাভ বলিয়া মনে করিতে হইবে। প্রত্যহ প্রাতঃকালে আল্লাহর ধ্যান-উপাসনা করিতে হইবে এবং সর্বান্তঃকরণে তাঁহার প্রেমাস্পদের অনুসন্ধানে যতœবান হইতে হইবে। তাঁহার প্রেমপূর্ণ স্মরণের অগ্নি-শিখা দ্বারা সর্বপ্রকার অবাধ্য চিন্তাকে বিনষ্ট করিতে হইবে এবং বিদ্যুতের ন্যায় তিনি ব্যতীত আর সকলকে অতিক্রম করিতে হইবে। সে অধিকার চ্যুত ব্যক্তিকে সাহায্য করিবে এবং অভাবগ্রস্তকে তাহার অনুগ্রহ হইতে বঞ্চিত করিবে না। জীবজন্তুদের প্রতি তাহার দয়া প্রদর্শন করা উচিত, সুতরাং বাকশক্তিসম্পন্ন তাহার সম-শ্রেণীর লোকদিগকে তাহার পক্ষে অধিকতর সাহায্য করা উচিত। তাহার প্রেমাস্পদের জন্য তাহার জীবন বলি দিতে তাহার ইতস্ততঃ করা উচিত নহে এবং লোকনিন্দা তাহাকে সত্য হইতে দূরে রাখিতে সমর্থ হইবে না। সে নিজের জন্য যাহা পছন্দ করে না, অপরের জন্য তাহা কামনা করা তাহার পক্ষে উচিত হইবে না এবং যাহা সে পূরণ করিতে পারে না, তাহার জন্য প্রতিজ্ঞা করা তাহার উচিত নহে। সত্যানুসন্ধানকারী সর্বান্তঃকরণে দুষ্কর্মা লোকদের সঙ্গ ত্যাগ করিবে এবং তাহাদের পাপের ক্ষমার জন্য প্রার্থনা করিবে। সে পাপীকে ক্ষমা করিবে এবং তাহার দৈন্যাবস্থাকে ঘৃণা করিবে না; কারণ কেহই জানে না, তাহার নিজের পরিণতি কিরূপ হইবে। পাপী কত অধিক বার মৃত্যুর সময় বিশ্বাসের মৌলিক উপাদান প্রাপ্ত হইয়াছে এবং অমর পানপাত্র হইতে পর্যাপ্ত পরিমাণে পান করিয়া স্বর্গীয় মহীয়ান্ জনতার দিকে উড্ডয়ন করিয়াছে এবং কতই অধিক বার একজন ভক্ত বিশ্বাসী তাহার আত্মার উর্দ্ধগমনের সময় এইরূপ পরিবর্তিত হইয়াছে যে, সে নিম্নতম নরকাগ্নিতে পতিত হইয়াছে। এই সমস্ত প্রত্যয়কারী ও গুরুত্বপূর্ণ বাক্যাবলী প্রকাশ করিবার আমাদের উদ্দেশ্য হইল, সত্যান্বেষণকারীর মনে গাঢ়রূপে এই বিষয়ের ছাপ দেওয়া, যেন সে আল্লাহ ব্যতীত আর সকলকে অস্থায়ী বলিয়া মনে করে এবং তিনি ব্যতীত—যিনি সকল প্রকারের অর্চনার মুখ্য উদ্দেশ্য, আর সকলই সম্পূর্ণ অস্তিত্বহীন বলিয়া মনে করে।
উন্নতমনাদের গুণাবলীর মধ্য হইতে এইগুলি কতিপয় গুণমাত্র এবং এইগুলিই আধ্যাত্মিক ভাবসম্পন্ন মানুষের পরিচয়-চিহ্ন। যে সকল পথিক সত্য-জ্ঞান লাভের পথে পদ-বিক্ষেপ করে, তাহাদের প্রয়োজনীয় বিষয়সমূহ উল্লেখ করার সম্পর্কে এইগুলি ইতিপূর্বে বলা হইয়াছে। যখন একাগ্রচিত্ত পথিক এবং অকপট সত্যান্বেষী এই সকল অত্যাবশ্যকীয় শর্ত পূরণ করে, একমাত্র তখনই তাহাকে প্রকৃত সত্যান্বেষী বলিয়া অভিহিত করিতে পারা যায়। যখন সে এই আয়াতে উল্লিখিত শর্তাদি পূরণ করে ঃ “যাহারা আমাদের উদ্দেশ্যে প্রচেষ্টা করে”, তখন এই সকল বাক্য দ্বারা যে আশীষ প্রদান করা হয়, তাহা সে ভোগ করিবে, “নিশ্চয়ই আমরা তাহাদিগকে আমাদের সুপথসমূহ প্রদর্শন করিব।’ (ক্বোরআন ২৯।৬৯)।
কেবলমাত্র যখনই সত্যান্বেষণকারীর অন্তরে অনুসন্ধানের একাগ্র উদ্যম, তীব্র আকাঙ্খা, অত্যুগ্র আরাধনা, উল্লাস ও অত্যন্ত আহ্লাদের প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত করিয়া তোলা হয় এবং তাঁহার প্রেমপূর্ণ দয়ার মৃদু সমীরণ তাহার আত্মার উপর দিয়া প্রবাহিত হয়, তখনই ভ্রান্তির অন্ধকার দূরীভূত হইবে, সন্দেহ ও অবিশ্বাসের কুজ্ঝটিকাসমূহ ইতস্ততঃ বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িবে এবং জ্ঞান ও নিশ্চয়তার আলোকসমূহ তাহার সত্তাকে আবৃত করিবে। সেই সময়েই আধ্যাত্মিক অগ্রদূত পরমাত্মার আনন্দ-সংবাদ বহন করিয়া প্রভাতকালীন উজ্জ্বলতা সহকারে আল্লাহর নগরী হইতে আলোক বিকিরণ করিবে এবং জ্ঞানের তূর্য-নিনাদের মধ্য দিয়া অন্তর, আত্মা ও আধ্যাত্মাকে অলসতার তন্দ্র হইতে জাগ্রত করিবে। তখন পবিত্র অনাদি-অনন্ত পরমাত্মার নানাবিধ মঙ্গলাশীষ এবং বর্ষণশীল অনুকম্পা সত্যান্বেষীকে এইরূপ নূতন জীবন প্রদান করিবে, যাহাতে সে দেখিতে পাইবে যে, তাহাকে একটি নতুন চক্ষু, নূতন কর্ণ, নূতন অন্তর এবং নূতন মন দ্বারা বিভূষিত করা হইয়াছে। সে বিশ্বের সুস্পষ্ট নিদর্শনাদি সম্বন্ধে গভীরভাবে চিন্তা করিবে এবং আত্মার নিহিত রহস্যাবলী ভেদ করিবে। আল্লাহর চক্ষু দ্বারা এক দৃষ্টিতে তাকাইয়া সে প্রত্যেক পরমাণুতে এমন একটি দ্বার দেখিতে পাইবে, যাহা তাহাকে অব্যর্থ, পূর্ণ নিশ্চয়তার পদবীসমূহের দিকে লইয়া যাইবে। প্রত্যেক বস্তুতেই সে স্বর্গীয় অবতরণের রহস্যাবলী এবং একটি অনন্ত প্রকাশের প্রমাণসমূহ আবিষ্কার করিবে।
আমি আল্লাহর শপথ করিয়া বলিতেছি! যে-ব্যক্তি সুপথ প্রাপ্তির পথে পদ-বিক্ষেপ করে এবং এই মহিমান্বিত ও পরম পদ পাওয়ার জন্য ন্যায়পরায়ণতার উচ্চস্থানে আরোহণ করিতে চাহে, সে সহস্র সহস্র ক্রোশ দূর হইতে আল্লাহর সৌরভ উপভোগ করিবে এবং সে এক স্বর্গীয় পথ-প্রদর্শকের উজ্জ্বল প্রভাত কালকে সর্ব প্রকারের দ্রব্যাদির অভ্যুদয়ের উপরে উঠিতে দেখিবে। যতই ক্ষুদ্র হউক না কেন, প্রত্যেকটি দ্রব্য তাহার নিকট এমন একটি প্রকাশরূপে প্রতিভাত হইবে; যিনি তাহার অনুসন্ধানের একমাত্র লক্ষ্যস্থল, উহা তাহাকে তাহার প্রেমাস্পদের নিকট লইয়া যাইবে। এই অন্বেষণকারীর দৃষ্টি এইরূপ সুতীক্ষè হইবে, যাহার ফলে সে সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য এমনভাবে অনুধাবন করিতে সমর্থ হইবে, যেমন ভাবে সূর্য ও ছায়ার পার্থক্য অনুধাবন করা যায়। যদি পৃথিবীর পূর্বতম প্রান্তে আল্লাহর সৌরভ রাশি প্রবাহিত হয় এবং সে পৃথিবীর সর্ব পশ্চিমবর্তী স্থানে বসবাস করে, তাহা হইলেও সে নিশ্চয়ই সেই সৌরভ অনুধাবন করিতে পারিবে এবং তাহা উপভোগ করিতে সমর্থ হইবে। অধিকন্তু সে আল্লাহর যাবতীয় নিদর্শন, তাঁহার আশ্চর্যজনক উক্তিসমূহ, তাঁহার মহৎ কার্যসমূহ এবং শক্তিশালী কর্মাবলী মানুষের কর্ম, বাক্য ও পন্থাসমূহ হইতে এমন পরিষ্কারভাবে পার্থক্য অনুধাবন করিতে সমর্থ হইবে, যেমন মণিকার মণিকে প্রস্তর হইতে, অথবা যেমন, মানুষ বসন্তকালকে শরৎ কাল হইতে এবং গ্রীষ্ম কালকে শীত কাল হইতে পৃথকভাবে অনুধাবন করিয়া থাকে। যখন মানুষের আত্মার প্রবাহের প্রণালী সকল প্রকার পার্থিব ও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী অনুরাগাদি হইতে পরিস্কৃত হয়, ইহা অব্যর্থভাবে অপরিমিত দূরত্ব হইতে প্রেমাষ্পদের নিঃশ্বাস অনুভব করিবে এবং ইহার সৌরভে পরিচালিত হইয়া নিশ্চয়তার নগরে পৌঁছিবে এবং তথায় প্রবেশ-লাভ করিবে। সেখানে সে তাহার সনাতন বিজ্ঞতার আশ্চর্য বিষয়াদি নিরীক্ষণ করিবে এবং সেই নগরে বর্ধিত স্বর্গীয় বৃক্ষের পত্রাদির র্মর্ম শব্দ হইতে রহস্যপূর্ণ নিহিত উপদেশাবলী অনুভব করিতে সমর্থ হইবে। তাহার আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক কর্ণ দ্বারা ইহার ধূলিকণা হইতে প্রভূদের প্রভূর দিকে আরোহণকারী মহিমা ও প্রশংসার স্তুতিগানসমূহ সে শ্রবণ করিতে পাইবে। এবং তাহার অন্তর-চক্ষু দ্বারা “প্রত্যাবর্তন” ও “নবজীবন লাভের” রহস্যাবলী আবিষ্কার করিতে পারিবে। তিনি, যিনি নামাবলী ও গুণাবলীর সম্রাট, সেই নগরের জন্য যে সকল নিদর্শন, লক্ষণ, প্রকাশ ও ঔজ্জ্বল্য অবধারিত করিয়া রাখিয়াছেন, সেইগুলি কতই অনির্বচনীয় রূপে মহিমময়। এই নগর-প্রাপ্তি জল বিনা তৃষ্ণা নিবারণ করে এবং অগ্নি বিনা ঐশী প্রেম প্রজ্জ্বলিত করে। ঘাসের প্রত্যেক পাতার মধ্যে একটি অজ্ঞেয় বিজ্ঞতার রহস্য সুরক্ষিত আছে এবং প্রত্যেক গোলাপ-কুঞ্জের সহস্র সহস্র বুল্বুল্ আনন্দপূর্ণ উল্লাসে তাহাদের সুমধুর গীতি বর্ষণ করে। ইহার আশ্চর্যজনক পুষ্পিত বৃক্ষাদি ‘প্রজ্বলিত কুঞ্জের’ রহস্য প্রকাশ করে এবং ইহার পবিত্রতার সুমধুর সৌরভসমূহ মসীহ্র পরমাত্মার সৌরভ ছড়াইয়া দেয়। ইহাই স্বর্ণহীন ধনৈশ্বর্য বিতরণ করে এবং মৃত্যুহীন অমরত্ব প্রদান করে। ইহার প্রত্যেক পত্রে অবর্ণনীয় আনন্দ রাশি সঞ্চিত আছে এবং প্রত্যেক প্রকোষ্ঠে অসংখ্য রহস্যাবলী নিহিত আছে।
যাহারা সাহসের সহিত আল্লাহর ইচ্ছার অনুসন্ধানে পরিশ্রম করে, তাহারা, যখন একবার তাঁহাকে ব্যতীত সব-কিছুই ত্যাগ করিয়াছে, সেই শহরের দিকে এমনভাবে আকৃষ্ট ও আকর্ষিত হইবে যে, ইহা হইতে এক মূহুর্তের জন্যও বিচ্ছেদ তাহাদের পক্ষে অচিন্তনীয় হইবে। তাহারা সেই আধ্যাত্মিক সাহচর্যের সুন্দর “রক্তিম পুষ্প” হইতে অভ্রান্ত প্রমাণসমূহ শুনিতে পাইবে এবং ইহার গোলাপ পুষ্পের সৌন্দর্য হইতে নিশ্চিত প্রমাণসমূহ প্রাপ্ত হইবে এবং ইহার বুল্বুলের সুমধুর গীতি শুনিতে পাইবে। এক সহস্র বৎসরে এই “নগরী” পুনরায় নূতন ভাবে নির্মিত এবং পুনঃ সজ্জিত করা হইবে।
অতএব, হে বন্ধু! সেই ‘নগরে’ পৌঁছিবার জন্য আমাদের যথাসাধ্য উদ্যম প্রয়োগ করা এবং আল্লাহর অনুকম্পায় এবং তাঁহার প্রেমপূর্ণ দয়ার সাহায্যে “প্রভার অন্তরালসমূহ” বিদীর্ণ করা আমাদের একান্ত কর্তব্য, যাহাতে অনমনীয় দৃঢ়তার সহিত আমরা নূতন প্রেমাষ্পদের পথে আমাদের অবসন্ন আত্মা উৎসর্গ করিতে পারি। অশ্রু-ভারাক্রান্ত লোচনে, আগ্রহ সহকারে ও পুনঃ পুনঃ তাঁহার নিকট আমাদের প্রার্থনা করা উচিত, যেন তিনি সেই অনুকম্পা দানে আমাদিগকে অনুগৃহীত করেন। সেই ‘নগর’ আল্লাহর বাণী ব্যতীত আর কিছুই নহে, যাহা প্রত্যেক যুগে ও ধর্ম-বিধান কালে অবতীর্ণ হয়। মূসা (আঃ)-র দিবসসমূহে ইহা ছিল তৌরিত; যীশুর সময়ে ইহা ছিল ইঞ্জিল; রসুলুল্লাহ হজরত মোহাম্মদ (সঃ)-র দিবস সমূহে ইহা ছিল ক্বোরআন গ্রন্থ; এই দিবসে ইহা ‘বয়ান’ গ্রন্থ; এবং “যাঁহাকে আল্লাহ্ প্রকাশ করিবেন,” তাঁহার ধর্ম-বিধান, তাঁহার নিজ গ্রন্থ—যে গ্রন্থে পূর্ববর্তী ধর্ম-বিধানসমূহের সমুদয় গ্রন্থের ইঙ্গিত অবশ্যই থাকিবে, যে-গ্রন্থ ঐ সকল গ্রন্থের মধ্যে সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ও সর্বপ্রধান। এই নগরসমূহে আধ্যাত্মিক উপজীবিকা বদান্যরূপে সঞ্চিত রাখা হইয়াছে এবং অক্ষয় আনন্দরাজি তাহাতে সুব্যবস্থিত আছে। তাহারা যে-খাদ্য পরিবেশন করে, তাহা স্বর্গীয় খাদ্য এবং তাহারা যে-আধ্যত্মিক তেজস্বিতা প্রদান করে, তাহা আল্লাহর অবিনশ্বর আশীষ। তাহারা সর্বত্যাগী আত্মাবিশিষ্টগণকে ঐশী একতার দানে সমৃদ্ধ করে, অভাবগ্রস্তকে সমৃদ্ধশালী করে এবং যাহারা অজ্ঞতার জঙ্গলে পরিভ্রমণ করে, তাহাদিগকে জ্ঞানের পানপাত্র যাচ্ঞা করে। যে-সমস্ত সুপথ-প্রদর্শন, আশীর্বাদ, বিদ্যা, উপলব্ধি, বিশ্বাস ও নিশ্চয়তা, স্বর্গ ও মর্ত্যস্থ সকলকেই দান করা হয়, তাহার সকলই এই নগরসমূহে নিহিত ও সুরক্ষিত আছে।
দৃষ্টান্তস্বরূপ, হজরত মোহাম্মদ (সঃ)-র অনুসারীদিগের পক্ষে পবিত্র ক্বোরআন একটি দুর্ভেদ্য দুর্গ ছিল। তাঁহার সময়ে যাহারাই তন্মধ্যে প্রবেশ লাভ করিয়াছে, তাহারা শয়তানি আক্রমনাদি, ভীতিপ্রদ বর্শাসমূহ, আত্মা গ্রাসকারী সন্দেহ ও আল্লাহর অবজ্ঞা ও নিন্দাসূচক শত্রুর কানাকানি হইতে সুরক্ষিত ছিল। তাঁহার উপর স্বর্গীয় বৃক্ষ হইতে অনন্ত কাল স্থায়ী ও বিজ্ঞতার ফলসমূহের একটি অংশও দান করা হইয়াছিল। তাঁহাকে জ্ঞানের নদীর অক্ষয় জল পান করিতে এবং একতার রহস্যসমূহের মদিরার সুস্বাদ গ্রহণ করিতে শক্তি প্রদান করা হইয়াছিল।
হজরত মোহাম্মদ (সঃ)-র ধর্ম সম্বন্ধে ও তাঁহার বিধান সম্বন্ধে মানুষের জন্য যে সকল বিষয়ের প্রয়োজন ছিল, তাহার সব-কিছুই এই উজ্জ্বল মহিমান্বিত স্বর্গীয় ‘রেজওয়ান’-উদ্যানে অবতীর্ণ ও প্রকাশিত অবস্থায় পাওয়া যাইবে। হজরত মোহাম্মদ (সঃ)-র মৃত্যুর পর সেই গ্রন্থ জনসাধারণের পক্ষে একটি স্থায়ী দলিল, কারণ ইহার আদেশসমূহ নিঃসন্দিগ্ধ এবং ইহার প্রতিশ্রুতি অব্যর্থ। সকল লোককেই সেই গ্রন্থের আজ্ঞাসমূহ “ষাট বৎসর” (হজরত বা’ব-এর ঘোষণার বৎসর ১২৬০ হিজরী) পর্যন্ত অনুসরণ করার জন্য নির্দেশ দান করা হইয়াছে—এই বৎসরটি আল্লাহর অতীব আশ্চর্যজনক প্রকাশের অভ্যুত্থানেরই বৎসর। ইহা ঐ গ্রন্থ, যাহা নির্ভুলভাবে সত্যান্বেষণকারীকে স্বর্গীয় সাক্ষাৎকার লাভের স্বর্গীয় ‘রেজওয়ান’-উদ্যানের দিকে চালিত করিয়া লইয়া যায়, এবং যে-ব্যক্তি স্বদেশ পরিত্যাগ করিয়া অনুসন্ধানকারীর পথে পরিভ্রমণ করে, তাহাকে চিরস্থায়ী পুনর্মিলনের মন্দিরে প্রবেশ লাভ করিতে সহায়তা করে। ইহার পথপ্রদর্শন কখনও ভ্রান্তিপূর্ণ নহে, অন্য কোনও সাক্ষ্য-প্রমাণ ইহার সাক্ষ্য-প্রমাণকে অতিক্রম করিতে পারে না। অন্য সব হাদীস, যাবতীয় গ্রন্থ এবং লিখিত বাক্যাবলী এইরূপ গুরুত্বহীন, যেহেতু, উভয়ই—হাদীসসমূহ এবং তাঁহারা, যাহারা এই সকল হাদীস বলিয়াছেন তাঁহাদের বাক্যের সত্যতা, সেই গ্রন্থের মূল বাক্য দ্বারা কেবল সমর্থিত ও প্রমাণিত হয়। অধিকন্তু, হাদীসসমূহের পরস্পরের মধ্যে সাংঘাতিক পার্থক্য আছে এবং তাহাদের অস্পষ্টতা অনেক বেশী।
হজরত মোহাম্মদ (সঃ) স্বয়ং যখন তাঁহার দৌত্যকার্যের কাল অবসান হইয়া আসিতেছিল, তখন এই সকল বাক্য বলিয়াছেন ঃ “নিশ্চিতরূপে জানিয়া রাখ, আমি তোমাদের মধ্যে আমার দুইট গুরুত্বপূর্ণ দলিল রাখিয়া যাইতেছি—তাহা হইল আল্লাহর গ্রন্থ এবং আমার পরিবারবর্গ।” যদিও অনেক হাদীস পয়গম্বরীর পদবী প্রাপ্ত সেই উৎস ও স্বর্গীয় পথ-প্রদর্শনের খনি দ্বারা অবতীর্ণ হইয়াছে, তত্রাচ তিনি কেবল ঐ গ্রন্থেরই উল্লেখ করিয়াছিলেন এবং তদ্দদ্বারা তিনি এই গ্রন্থকে অনুসন্ধানকারীদের জন্য একটি সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী ও নিশ্চিত দলিল রূপে নির্দিষ্ট করিয়াছিলেন; ইহাই কেয়ামত পর্যন্ত মানুষের জন্য একটি পথ-নির্দেশিকা।
অটল দৃষ্টি, পবিত্র অন্তঃকরণ এবং পূত পবিত্র আত্মা সহকারে, মনোযোগের সহিত বিবেচনা করুন, আল্লাহ্ তাঁহার মনুষ্যগণের জন্য, তাঁহার গ্রন্থে, যাহা ছোট-বড় সকলেই প্রকৃত সত্য বলিয়া মানিয়া লইয়াছে, তাঁহাদের পথ-প্রদর্শনের সাক্ষ্য-প্রমাণ স্বরূপ তাহা স্থিরীকৃত করিয়া রাখিয়াছিলেন। আমরা উভয়ে এবং পৃথিবীর যাবতীয় মানুষ এই সাক্ষ্য-প্রমাণকেই আঁকড়াইয়া ধরিয়া থাকিব, যাহাতে ইহার আলোকের সাহায্যে আমরা সত্য ও মিথ্যা, সুপথ ও ভ্রান্তপথ চিনিয়া লইতে ও পার্থক্য নিরূপণ করিতে পারি। যেহেতু হজরত মোহাম্মদ (সঃ) তাঁহার সাক্ষ্য-প্রমাণাদি তাঁহার গ্রন্থ ও তাঁহার পরিবারেই সীমাবদ্ধ রাখিয়াছেন এবং যেহেতু শেষোক্তটি শেষ হইয়া গিয়াছে, সুতরাং মানুষের মধ্যে তাঁহার প্রমাণ স্বরূপ কেবল তাঁহার গ্রন্থই অবশিষ্ট রহিল।
তাঁহার গ্রন্থের প্রারম্ভে তিনি বলেনঃ “আলিফ, লাম, মিম। এই গ্রন্থ সম্বন্ধে কোনও সন্দেহ নাইঃ আল্লাহ্কে যাহারা ভয় করে তাহাদের জন্য ইহা একটি পথ-প্রদর্শিকা।” (ক্বোরআন ২।১)। ক্বোরআনের এই অসংলগ্ন বর্ণসমূহে ঐশী সারবত্তার রহস্যসমূহ সঞ্চিত আছে। স্থানাভাবে সেইগুলি আমরা এখন বর্ণনা করিব না। উহারা এই সকল বাহ্যতঃ স্বয়ং হজরত মোহাম্মদ (সঃ)-র দিকে ইঙ্গিত করে, যাহাকে আল্লাহ্ সম্বোধন করিয়া বলিতেছেন! “হে মোহাম্মদঃ এই গ্রন্থ সম্বন্ধে কোন সন্দেহ বা অনিশ্চয়তা নাই, এবং ইহা স্বর্গীয় একতার ঊর্দ্ধলোক হইতে নিম্নে অবতীর্ণ হইয়াছে। ইহার মধ্যে তাহাদের জন্য সুপথ প্রদর্শিত হইয়াছে, যাহারা আল্লাহকে ভয় করে।” দেখুন, তিনি এই একই গ্রন্থকে, পবিত্র ক্বোরআনকে, স্বর্গ-মর্ত্যস্থ সকলের জন্য কিরূপ একটি পথ প্রদর্শিকারূপে নির্ধারিত করিয়া প্রত্যাদেশ দান করিয়াছেন। তিনি, সেই স্বর্গীয় সত্তা ও অজ্ঞেয় সারাৎসার স্বয়ং সাক্ষ্য দিয়াছেন যে, এই গ্রন্থ, যাহা সকল প্রকার সন্দেহ ও অনিশ্চয়তার অতীত, পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত সকল মানব জাতির জন্য পথ-প্রদর্শনকারী। এবং এক্ষণে, আমরা জিজ্ঞাসা করি, এই অতীব গুরুত্বসম্পন্ন সাক্ষ্য-প্রমাণ—যাহার স্বর্গীয় উৎপত্তি সম্বন্ধে আল্লাহ্ স্বয়ং ঘোষণা করিয়াছেন, এবং যাহাকে সত্যেরই অবয়ব-আকৃতি বলিয়া ব্যক্ত করিয়াছেন, ইহাকে সন্দেহ ও অবিশ্বাসের সহিত লক্ষ্য করা কি ন্যায্য হইবে ? জ্ঞানের উচ্চতম চূড়ায় আরোহণ করিবার জন্য যাহাকে তিনি সুপথ-প্রাপ্তির পরম অস্ত্ররূপে নির্দিষ্ট করিয়াছেন, তাহা হইতে মুখ ফিরাইয়া লইয়া তাহা ব্যতীত অন্য-কিছু অনুসন্ধান করা তাহাদের পক্ষে কি উচিত ? কিরূপে তাহারা মানুষের অসঙ্গত ও নির্বোধ বাক্যাবলী তাহাদের মনে অবিশ্বাসের বীজ বপন করিতে দিতে পারে ? তাহারা কি প্রকারে আরও অনর্থক প্রতিবাদ করিতে পারে যে, কোনও এক ব্যক্তি ইহা বলিয়াছে বা উহা বলিয়াছে, অথবা কোনও একটি নিশ্চিত ব্যাপার ঘটে নাই ? আল্লাহর গ্রন্থ ব্যতীত যদি অন্য কিছু থাকা সম্ভবপর হইত, যাহা অধিকতর শক্তিশালী একটি অস্ত্র, এবং মানবজাতির পক্ষে একটি নিশ্চিত পথ-প্রদর্শক বলিয়া প্রমাণিত হইত, তবে তিনি কি সেই আয়াতে ইহা অবতীর্ণ করিতে অসমর্থ ছিলেন ?
আল্লাহর অনিবার্য আদেশ এবং নির্ধারিত অনুজ্ঞা, যাহা পূর্বে উল্লিখিত আয়াতে অবতীর্ণ হইয়াছে, আমাদের অবশ্য কর্তব্য হইতেছে তাহা হইতে বিচ্যুত না হওয়া। পবিত্র ও অতীব আশ্চর্য ধর্মগ্রন্থসমূহ স্বীকার করা আমাদের উচিত, কারণ ইহা না করাতেই আমরা এই পবিত্র আয়াতের সত্যতা স্বীকার করিতে অসমর্থ হইয়াছি। কারণ, ইহা সুস্পষ্ট যে, যে-ব্যক্তি পবিত্র ক্বোরআনের সত্যতা স্বীকার করিতে অসমর্থ হইয়াছে, সে বাস্তবিক পক্ষে পূর্ববর্তী ধর্ম-গ্রন্থসমূহের সত্যতা স্বীকার করিতে অপারগ হইয়াছে। ইহাই এই আয়াতের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত। আমরা যদি ইহার আভ্যন্তরীণ তাৎপর্য ব্যাখ্যা করি এবং অন্তর্নিহিত রহস্যসমূহ প্রকাশ করিতে ইচ্ছা করি, তাহা হইলে অনাদি-অনন্ত কালেও উহাদের অর্থ শেষ হইবে না, আর বিশ্বাসীরাও তাহা শুনিতে সমর্থ হইবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ আমাদের বাক্যের সত্যতার সাক্ষ্য দান করেন।
অন্য এক স্থানে তিনি এইরূপই বলিয়াছেনঃ “এবং আমি আমার সেবকের প্রতি যাহা অবতীর্ণ করিয়াছি, যদি তোমরা তাহাতে সন্দেহ কর, তবে সেইরূপ একটি ‘সুরাহ্’ আনয়ন কর, এবং যদি তোমরা সত্যবাদী হও, তবে আল্লাহ্ ব্যতীত তোমাদের সাক্ষীগণকে আহ্বান কর”। (ক্বোরআন ২।২৩)। দেখুন, এই সকল আয়াতের মর্যাদা কতই মহান এবং ইহাদের গুণ কতই স্বয়ংসম্পূর্ণ, যাহাকে তিনি তাঁহাদের নিশ্চিত সাক্ষ্য, তাঁহার অভ্রান্ত প্রমাণ, তাঁহার সর্ব-দমনকারী শক্তির নিদর্শন এবং তাঁহার ইচ্ছার পরাক্রমের প্রকাশ বলিয়া ঘোষণা করিয়াছেন। তিনি, স্বর্গীয় সম্রাট, তাঁহার সত্য প্রমাণকারী অপর সকল দ্রব্যের উপর তাঁহার গ্রন্থের আয়াতাদির অবিসম্বাদিত প্রাধান্য ঘোষণা করিয়াছেন। কারণ, অন্য সকল প্রমাণ ও নিদর্শনের তুলনায় স্বর্গীয় অবতীর্ণ আয়াত সূর্যের ন্যায় উজ্জ্বল কিরণ প্রকাশ করে, আর অন্য সকলই তারকা-সদৃশ। পৃথিবীর মনুষ্যগণের নিকট সেইগুলি আদর্শ সম্রাটের স্থায়ী সাক্ষ্য, অকাট্য প্রমাণ ও উজ্জ্বল আলোক। তাহাদের মহিমা অপ্রতিদ্বন্দ্বি, কিছুই তাহাদের গুণ অতিক্রম করিতে পারে না। তাহারা স্বর্গীয় মুক্তাবলীর ভান্ডার ও স্বর্গীয় রহস্যাবলীর ধনাগার। তাহারা অচ্ছেদ্য বন্ধন, সুদৃঢ় রজ্জু, প্রবল হাতল, অনির্বচনীয় স্বর্গীয় আলোক। তাহাদেরই মধ্য দিয়া স্বর্গীয় জ্ঞানের নদী প্রবাহিত হয় এবং তাঁহার পরিপূর্ণ ও সনাতন বিজ্ঞতার অনল উজ্জ্বলভাবে জ্বলিতে থাকে। ইহা ঐ অনল যাহা একই সময়ে বিশ্বাসীদের অন্তরে প্রেমের অগ্নিশিখা প্রজ্জ্বলিত করে এবং শত্রুর অন্তরে অসাবধানতার শৈত্যের উদ্রেক করে।
হে বন্ধু! আল্লাহর আদেশ অমান্য করা আমাদের উচিত নহে, বরং তিনি যাহা স্বর্গীয় প্রমাণরূপে নির্ধারিত করিয়াছেন, তাহাতে সম্মত হওয়া ও আত্মসমর্পণ করা উচিত। এই আয়াতটি এতই গুরুত্বপূর্ণ ও ভাবার্থপূর্ণ যে, এই দুর্দশাগ্রস্ত আত্মার পক্ষে তাহা প্রদর্শন ও ব্যাখ্যা করা এক প্রকার অসম্ভব। আল্লাহ্ সত্য কথাই বলেন ও সুপথ প্রদর্শন করেন। তিনি সমগ্র মানব জাতির উপরই মহৎ ও মহীয়ান; তিনি শক্তিশালী ও কৃপাশীল।
এইরূপে, তিনি বলেনঃ “আল্লাহর আয়াত এইরূপই; আমরা সত্যের সহিত তোমার নিকট সে-গুলি আবৃত্তি করি; কিন্তু যদি তাহারা আল্লাহ্ ও তাঁহার আয়াতগুলি অগ্রাহ্য করে; তবে কোন্ অবতরণ তাহারা বিশ্বাস করিবে ?” (ক্বোরআন ৪৫।৫)। যদি আপনি এই আয়াতের ইঙ্গিত উপলব্ধি করেন, তাহা হইলে আপনি এই সত্য চিনিয়া লইতে পারিবেন যে, আল্লাহর পয়গম্বরগণ ব্যতীত কোনও বড় প্রকাশ এযাবৎ হয় নাই, এবং তাঁহাদের প্রতি অবতীর্ণ আয়াতাদির সাক্ষ্য ব্যতীত অধিকতর শক্তিশালী সাক্ষ্য-প্রমাণ পৃথিবীতে এ-পর্যন্ত আবির্ভূত হয় নাই। না, কখনও অন্য কোন প্রকার প্রমাণ এই প্রমাণকে অতিক্রম করিতে পারে না, তবে আপনার প্রভূ আল্লাহর ইচ্ছাই সর্বথা বলবৎ।
আর এক স্থানে তিনি বলেনঃ “মিথ্যাবাদী পাপীর জন্য আফসোস যে, আল্লাহর অবতীর্ণ আয়াতাদি সে শ্রবণ করে এবং তৎপর অহঙ্কার পূর্বক ঘৃণা করিয়া থাকে, যেন সে সে-গুলি শুনে নাই। তাহাকে কষ্টদায়ক শাস্তির সংবাদ প্রদান কর।” (ক্বোরআন ৪৫।৬)। যদি মানব জাতি তাহাদের প্রভূর অবতীর্ণ আয়াতগুলির মর্ম অনুধাবন করিত, তাহা হইলে এই আয়াতের অন্তর্গত একটি মাত্র ইঙ্গিতই স্বর্গ-মর্ত্যরে সকলেরই জন্য যথেষ্ট। কারণ বর্তমান কালে আপনি শুনিতে পাইতেছেন, মানব জাতি কিরূপ ঘৃণাভরে স্বর্গীয় অবতীর্ণ আয়াতাদির জ্ঞান অস্বীকার করে, যেন এইগুলি সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট। এবং তত্রাচ, এই সকল আয়াত অপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ আর কিছুই কখনও আবির্ভূত হয় নাই এবং আর কখনও এই পৃথিবীতে প্রকাশিত হইবেও না। তাহাদিগকে বলুনঃ “ হে অমনোযোগী মনুষ্যগণ! অতীত কালে তোমাদের পিতৃ-পুরুষগণ যাহা বলিয়াছে, তোমরা তাহারই পুনরুক্তি করিতেছ। তাহাদের অবিশ্বাসের বৃক্ষ হইতে তাহারা যে-ফল সংগ্রহ করিয়াছে, তোমরাও কেবল তাহাই সংগ্রহ করিবে। অচিরে তোমরা তোমাদের পিতৃ-পুরুষদের সহিত মিলিত হইবে এবং তাহাদের সহিত তোমরা নরকাগ্নিতে বাস করিবে! ইহা একটি নিকৃষ্ট স্থান, ইহা অত্যাচারী মানুষেরই আবাসস্থল। ”
এবং আর এক স্থানে তিনি বলেনঃ “ এবং যখন সে আয়াতাদির সম্বন্ধে অবগত হয়, সে ইহাদিগকে বিদ্রƒপ করে। তাহাদের জন্য লজ্জাজনক শাস্তি রহিয়াছে।” (ক্বোরআন ৪৫।৮)। জনগণ ব্যঙ্গ করিয়া বলিয়াছেঃ “ আর একটি অলৌকিক ক্রীড়া দেখাও, এবং আমাদিগকে আর একটি নিদর্শন প্রদর্শন কর।’ এক জন বলিবেঃ ‘তবে আকাশের একাংশ আমাদের উপর নিক্ষেপ কর’।” (ক্বোরআন ২৬।১৮৭)। এবং আর একজন বলিবেঃ “ যদি ইহা তোমার সন্নিধান হইতে খাঁটি সত্য হয়, তবে আমাদের উপর আকাশ হইতে প্রস্তর বর্ষণ কর।” (ক্বোরআন ৮।৩২)। এমন কি, হজরত মূসা (আঃ)-র সময়ে ইসরাইল বংশের লোকেরা এই পৃথিবীর জঘন্য জিনিষের ভোগের বিনিময়ে স্বর্গীয় খাদ্য পরিত্যাগ করিয়াছিল; সেইরূপ এই সকল লোকও তাহাদের কদর্য, নীচ ও অলস প্রকৃতির বাসনাগুলির জন্য স্বর্গীয় অবতীর্ণ আয়াতাদির বিনিময় করিতে চাহিয়াছিল। এই প্রকারে বর্তমানে আপনি দেখিতে পাইতেছেন যে, যদিও সর্ব অস্তিত্বের প্রভূর আদেশে জীবন-সমুদ্রাদি অন্তরের ‘রেজওয়ান’-উদ্যানস্থ নদীর জলে তরঙ্গায়িত হইতেছে, তত্রাচ এই সকল লোক ঔদারিক কুকুরের ন্যায় পচা গলিত মাংসের চতুর্দিকে একত্রিত হইয়াছে, এবং একটি লবনাক্ত হ্রদের আবদ্ধ জলাদিতে সন্তুষ্ট রহিয়াছে। করুণাময় আল্লাহ্! এই সমস্ত মানুষের আচরণ কতই অদ্ভূত। তাহারা পথ প্রদর্শনের জন্য গোলমাল করে, অথচ যিনি সকলকে পথ প্রদর্শন করেন, তাঁহার পতাকাসমূহ পূর্বেই উত্তোলিত করা হইয়াছে। তাহারা জ্ঞানের অস্পষ্ট জটিলতাসমূহের দিকে ঝুঁকিয়া রহিয়াছে, যখন তিনি, যিনি সকল জ্ঞানের অভিপ্রেত, সূর্যের ন্যায় জ্বলিতেছেন। তাহারা নিজেদের চক্ষে সূর্য দর্শন করে, তথাপি সেই অত্যুজ্জ্বল গোলাকার গ্রহকে ইহারা আলোক সম্বন্ধে প্রশ্ন করে। তাহারা বসন্ত কালীন বারি-ধারার বর্ষণাদি তাহাদের উপর অবতীর্ণ হইতে দেখে, অথচ সেই অনুকম্পার প্রমাণ অনুসন্ধান করে। সূর্যের প্রমাণ হইতেছে ইহার আলোক, যাহা উজ্জ্বলভাবে কিরণ দেয় এবং সকল দ্রব্যকে আবৃত করিয়া ফেলে। বারি-ধারার প্রমাণ হইতেছে ইহার বদান্যতা-বর্ষণ, যদ্দদ্বারা পৃথিবী নূতনত্ব প্রাপ্ত হয় ও প্রাণ-পরিচ্ছদে ভূষিত হয়। হ্যাঁ, অন্ধ লোক সূর্য হইতে ইহার তাপ ব্যতীত আর কিছুই অনুভব করে না এবং শুষ্ক মৃত্তিকা করুণার বর্ষণের কোনও অংশ পায় না। “অবিশ্বাসী যদি পবিত্র ক্বোরআনে কেবল অক্ষরের রেখা ব্যতীত আর কিছুই দেখে না, তাহাতে আশ্চর্যান্বিত হইও না, কারণ অন্ধ লোক সূর্যের তাপ ব্যতীত কিছুই পায় না।”
অন্য এক স্থানে তিনি বলেন ঃ “যখন আমাদের সুস্পষ্ট আয়াতাদি তাহাদের সমক্ষে পঠিত হয়, তাহাদের একমাত্র বিকর্ত হইতেছে এই উক্তিটিঃ “যদি তুমি সত্য কথা বল, তবে আমাদের পিতৃ-পুরুষদের লইয়া আইস’।” (ক্বোরআন ৪৫।২৪)। দেখুন, সেই সর্ব-পরিবেষ্টনকারী অনুকম্পার সাক্ষাৎ প্রতিনিধিগণ হইতে তাহারা কি প্রকার মূর্খতাসূচক প্রমাণাদি অনুসন্ধান করিয়াছিল! এই আয়াতাদির প্রতি তাহারা অবজ্ঞা প্রদর্শন করিল, যাহার একটিমাত্র অক্ষর আকাশম-ল ও ভূম-ল-সৃষ্টি অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতর এবং যাহা বিশ্বাসের তেজ দ্বারা স্বার্থ ও বাসনার উপত্যকাস্থ মৃত ব্যক্তিগণকে পুনর্জীবিত করে; এবং তাহারা চিৎকার করিয়া বলিয়াছিলঃ “আমাদের পিতৃ-পুরুষগণকে তাহাদের সমাধিসমূহ হইতে দ্রুততর উত্তোলন কর।” সেই সমস্ত মানুষের একগুঁয়েমি অহঙ্কার এইরূপই ছিল! এই সকল আয়াতের প্রত্যেকটিই এই পৃথিবীর সকল মানুষের নিকট তাঁহার সত্যের একটি অব্যর্থ প্রমাণ এবং একটি উজ্জ্বল নিদর্শন। প্রত্যেকটিই মানব জাতির জন্য নিশ্চয়ই যথেষ্ট, যদি আপনি আল্লাহর এই সকল আয়াতের অনুধাবন করিতে পারেন। উপরোক্ত আয়াতটিতেও রহস্যাবলীর মুক্তাসমূহ নিহিত রহিয়াছে। রোগ যাহাই হউক না কেন, ইহা যে প্রতিকার ব্যবস্থা করিতেছে, তাহা কখনও ব্যর্থ হইতে পারে না।
ঐ সকল লোকের অলস বিবদমান উক্তির প্রতি কর্ণপাত করিবেন না, যাহারা বলে যে, ঐশী গ্রন্থ ও তদীয় আয়াতাদি কখনও সাধারণ লোকের নিকট প্রমাণস্বরূপ হইতে পারে না, কারণ তাহারা উহাদের অর্থও উপলব্ধি করিতে পারে না এবং উহাদের প্রকৃত মূল্যও নির্ধারণ করিতে পারে না। এবং তত্রাচ, পূর্ব ও পশ্চিম দেশের লোকের জন্য একমাত্র অব্যর্থ প্রমাণ হইতেছে ক্বোরআন—অন্য কিছু নহে। যদি ইহা মানুষের বুদ্ধির অগম্য হইত, তবে কি প্রকারে ইহা সকল লোকের নিকট একটি সার্বজনীন প্রমাণ বলিয়া ঘোষণা করা যাইত ? যদি তাহাদের বিতর্ক সত্য হইত, তবে আল্লাহ্কে অবগত হওয়া কাহারও কর্তব্য বলিয়া নির্ধারিত হইত না, এবং তাহাদের জন্য ইহার প্রয়োজনও হইত না, যেহেতু স্বর্গীয় সত্তার জ্ঞান-লাভ তাঁহার গ্রন্থের জ্ঞান-লাভ অপেক্ষা কত উত্তম এবং সর্বসাধারণের পক্ষে উহা উপলব্ধি করিবার শক্তিও থাকিত না।
এই প্রকার বিতর্ক সম্পূর্ণরূপে ভ্রমাত্মক ও অগ্রাহ্য। ইহা কেবল ঔদ্ধত্য ও গর্ব-প্রণোদিত। ইহার উদ্দেশ্য হইতেছে মানুষকে স্বর্গীয় সন্তোষের ‘রেজওয়ান’-উদ্যানের দিক হইতে বিপথগামী করা এবং মানুষের উপর তাহাদের কর্তৃত্বের বল্গা সুদৃঢ় করা। এবং তত্রাচ, আল্লাহর দৃষ্টিতে, এই সকল সাধারণ লোক তাহাদের এই সকল ধর্ম-নেতা অপেক্ষা অত্যধিক পরিমাণে শ্রেষ্ঠ ও উন্নত, কারণ তাহারা একমাত্র সত্য আল্লাহর নিকট হইতে দূরে চলিয়া গিয়াছে। তাঁহার বাক্যাবলী উপলব্ধি করা এবং স্বর্গীয় বিহঙ্গমের উচ্চারিত বাণী বুঝিতে পারা কোনও অংশে মানবীয় বিদ্যার উপর নির্ভর করে না। ইহা নির্ভর করে কেবল মাত্র অন্তরের পবিত্রতা, আত্মার বিশুদ্ধতা ও স্বভাবের স্বাধীনতার উপর। অদ্যকার দিনে, ঐসকল লোকই ইহার সাক্ষ্য দিতেছে, যাহারা সর্বসাধারণের স্বীকৃত বিদ্যার মানের একটিমাত্র অক্ষরের অধিকারী না হইয়া জ্ঞানের উচ্চতম আসনসমূহ অধিকার করিতেছে; এবং তাহাদের অন্তরের উদ্যান স্বর্গীয় অনুকম্পার বর্ষণের মাধ্যমে বিজ্ঞতার গোলাপ পুষ্পসমূহে ও উপলব্ধির পুষ্পবৃক্ষে সুসজ্জিত। সরল অন্তঃকরণ বিশিষ্টদের জন্য মহান্ দিবসের আলোকের অংশ কতই উত্তম!
এবং তিনি আরও বলেনঃ “এবং যাহারা আল্লাহর অবতীর্ণ আয়াতাদি অথবা তাঁহার সহিত সাক্ষাৎকার অবিশ্বাস করে, তাহারাই আমার অনুগ্রহ হইতে নিরাশ হইয়া থাকে এবং তাহাদের জন্যই যন্ত্রণাপ্রদ শাস্তি রহিয়াছে।” (ক্বোরআন ২৯।২৩)। অধিকন্তু “এবং তাহারা বলেঃ ‘একজন উন্মাদনাগ্রস্ত কবির জন্য কি আমরা আমাদের দেবতাগণকে পরিত্যাগ করিব’ ?” (ক্বোরআন ৩৭।৩৬)। এই আয়াতটির ইঙ্গিত সুস্পষ্ট। দেখুন আয়াতগুলি অবতরণের পর তাহারা কি মত প্রকাশ করিয়াছিল। তাহারা তাঁহাকে কবি আখ্যা দিয়াছিল, আল্লাহর অবতীর্ণ আয়াতাদির প্রতি উপহাস প্রদর্শন করিয়াছিল এবং এই বলিয়া চিৎকার করিয়াছিলঃ “তাঁহার এই বাক্যগুলি কেবল অতীত কালের কাহিনী।” ইহা দ্বারা তাহারা এই অর্থ করিয়াছিল যে, পুরাতন কালের লোকেরা যাহা বলিয়াছিল, হজরত মোহাম্মদ (সঃ) সেইগুলি সংগ্রহ করিয়াছিলেন এবং সেই সমস্তকে আল্লাহর বাণী বলিয়া প্রচার করিয়াছিলেন।
এই প্রকারে, বর্তমান কালে আপনি শুনিতে পাইয়াছেন, জনগণ এই যুগের অবতীর্ণ বাণী সম্বন্ধে মিথ্যা বাক্য আরোপ করিয়া বলেঃ “তিনি পুরাতন কালের কথিত বাক্যাদি হইতে এই সকল বাক্য সঙ্কলন করিয়াছিলেন, বা এই সমুদয় বাক্য কৃত্রিম।” তাহাদের বাক্য কতই অনর্থক ও গর্বপূর্ণ, তাহাদের অবস্থা ও পদ কতই নীচ!
তাহারা যে সকল অস্বীকৃতি ও ভীতি-প্রদর্শক বাক্য উচ্চারণ করিয়াছিল এবং যে সকলের প্রতি আমরা ইঙ্গিত করিয়াছি, তৎপর তাহারা এই বলিয়া প্রতিবাদ করিলঃ “আমাদের ধর্মগ্রন্থাদির শিক্ষানুসারে হজরত মূসা (আঃ) ও যীশুর ঐশী অবতীর্ণ ধর্ম-বিধান রহিত করিবার জন্য অন্য কোন স্বাধীন পয়গম্বর উত্থিত হইবে না। শুধু তাহাই নহে, এমন কি, যিনি ভবিষ্যতে প্রকাশিত হইবেন, তাঁহাকে নিশ্চয়ই পূর্ব প্রদত্ত ধর্ম-বিধান সম্পূর্ণ করিতে হইবে।” তৎপর এই আয়াত অবতীর্ণ হইয়াছিল, যাহা স্বর্গীয় সকল বিষয়ের মূল সূত্র প্রকাশ করে এবং ইহা এই সম্বন্ধে সাক্ষ্য দেয় যে, সর্ব দয়াশীলের অনুকম্পার প্রবাহ কখনো ক্ষান্ত হইতে পারে নাঃ “এবং নিশ্চয়ই ইতিপূর্বে ইউসুফ প্রকাশ্য নিদর্শনাবলী সহ তোমাদের নিকট আসিয়াছিলেন, কিন্তু তিনি যে-সংবাদ লইয়া আসিয়াছিলেন, সে সম্বন্ধে তোমরা সন্দেহ হইতে বিরত ছিলে না, অবশেষে তিনি যখন মৃত্যুমুখে পতিত হইলেন, তখন তোমরা বলিয়াছিলেনঃ “আল্লাহর তাঁহার পর আর কখনও কোনও রসুল উত্থিত করিবেন না। এই প্রকারে আল্লাহ্ উল্লঙ্ঘনকারী সন্দেহকারীকে বিপথগামী করিয়া থাকেন।” (ক্বোরআন ৪০।৩৪)। অতএব, এই আয়াত হইতে উপলব্ধি করুন এবং নিশ্চয় করিয়া জানিয়া লউন যে, প্রত্যেক যুগে মনুষ্যগণ ধর্মগ্রন্থের একটি আয়াতকে আঁকড়াইয়া ধরিয়া এইরূপ কতকগুলি নিরর্থক ও অসঙ্গত বাক্য উচ্চারণ করিয়াছে যে, পুনরায় এই পৃথিবীতে আর কোনও পয়গম্বর প্রকাশিত হইবেন না। এমন কি, খ্রীস্টান ধর্মাচার্যগণ ইঞ্জিলের একটি শ্লোককে, যাহা ইতিপূর্বে উল্লিখিত হইয়াছে, দৃঢ়ভাবে আঁকড়াইয়া ধরিয়া ইহা ব্যাখ্যা করিতে চেষ্টা করিয়াছে যে, ইঞ্জিলের বিধান ভবিষ্যতে কখনও রহিত করা হইবে না এবং ভবিষ্যতে কোনও স্বাধীন পয়গম্বর প্রকাশিত হইবেন না—যদি না তিনি ইঞ্জিলের বিধানকে মানিয়া লয়েন। অধিকাংশ লোক এইরূপ আধ্যাত্মিক পীড়াগ্রস্ত।
এমন কি, আপনি যেরূপ এখন দেখিতে পাইতেছেন, কিরূপে ক্বোরআন গ্রন্থধারী লোকেরা অতীত কালের ন্যায় “নবীগণের সীল-মোহর” শব্দগুলিকে তাহাদের চক্ষুর পর্দান্তরাল স্বরূপ করিয়া লইয়াছে এবং তত্রাচ, তাহারা নিজেরাই এই আয়াতটি সাক্ষ্য দিতেছে ঃ “আল্লাহ্ ভিন্ন কেহই ইহার মর্মার্থ জানে না, এবং তাহারা, যাহারা ‘গভীর জ্ঞানে সুপ্রতিষ্ঠিত’।” (ক্বোরআন ৩।৭)। এবং তিনি, যিনি গভীর জ্ঞানে সুপ্রতিষ্ঠিত, যিনি মাতৃসদৃশ, পরমাত্মা, নিহিত ও সারাৎসার, এইরূপ আয়াত অবতীর্ণ করেন, যাহা তাহাদের বাসনার সম্পূর্ণ বিপরীত, তাহারা ভয়ানকভাবে তাঁহার বিরোধিতা করে এবং নির্লজ্জভাবে তাঁহাকে অস্বীকার করে। এই সকল আপনি ইতিপূর্বে শুনিয়াছেন ও দেখিয়াছেন। এইরূপ কার্য ও বাক্যাবলীর উত্তেজনা কেবল মাত্র ধর্ম-নেতাগণ কর্র্তৃক উত্থাপিত হইয়াছে, যাহারা কেবল তাহাদের বাসনা ব্যতীত অন্য কোনও আল্লাহর অর্চনা করে না, যাহারা স্বর্গ ব্যতীত আর কিছুরই প্রতি বশ্যতা স্বীকার করে না, যাহারা বিদ্যার অত্যন্ত গাঢ় পর্দা দ্বারা আবৃত এবং যাহারা ইহার অস্পষ্টতাসমূহের ফাঁদে আবদ্ধ হইয়া ভ্রান্তির জঙ্গলাদিতে পথভ্রষ্ট হয়। এমন কি, অস্তিত্বের প্রভূ পরিষ্কারভাবে প্রকাশ করিয়া দিয়াছেনঃ “তুমি কি মনে করিতেছ ? যে-ব্যক্তি তাহার বাসনাসমূহকে একজন উপাস্য বলিয়া মনে করিয়াছে এবং যাহাকে আল্লাহর জ্ঞানের মধ্য দিয়া ভ্রান্তপথে পরিচালিত করিয়াছে এবং যাহার কর্ণদ্বয় ও যাহার অন্তরকে তিনি মোহরাঙ্কিত করিয়াছেন এবং যাহার দৃষ্টিশক্তির উপর তিনি যবনিকা নিক্ষেপ করিয়াছেন, আল্লাহ্ কর্তৃক তাহার পরিত্যক্ত হওয়ার পর কে এইরূপ একজনকে পথ প্রদর্শন করিবে ? তুমি কি অতঃপর সতর্ক হইবে না ?” (ক্বোরআন ৪৫।২২)।
যদিও “আল্লাহ্ যাহাকে জ্ঞানের মধ্য দিয়া ভ্রান্তপথে চালিত করিয়াছেন” শব্দাদির বাহ্যিক অর্থ যাহা অবতীর্ণ করা হইয়াছে তাহাই, তত্রাচ, আমাদের নিকট ইহার তাৎপর্য হইতেছে, সমসাময়িক যুগের ঐ সকল ধর্ম-নেতা, যাহারা আল্লাহর সুষমা হইতে মুখ ফিরাইয়া লইয়াছে এবং যাহারা নিজেদের কল্পনা ও বাসনাসমূহ দ্বারা গঠিত তাহাদের নিজ নিজ বিদ্যাকে আঁকড়াইয়া ধরিয়া আল্লাহর স্বর্গীয় সুসংবাদ এবং অবতীর্ণ বাণীর প্রতি ভয় প্রদর্শন করিয়া উহা ত্যাগ করিয়াছে। “বলঃ ‘ইহা একটি গুরুত্বপূর্ণ সুসংবাদ, যাহা হইতে তোমরা মুখ ফিরাইয়া লইতেছ’।” (ক্বোরআন ৩৮।৬৭)। এইরূপেই তিনি বলেনঃ “এবং যখন আমাদের সুস্পষ্ট আয়াতাদি তাহাদের নিকট আবৃত্তি করা হয়, তাহারা বলে ঃ ‘ সে একজন মানব মাত্র, যে তোমাদিগকে ঐ উপাস্য হইতে বিপথগামী করিতে চাহে, তোমাদের পিতৃ-পুরুষেরা যাহার উপাসনা করিত।’ এবং তাহারা বলেঃ ‘ ইহা একটি কৃত্রিম মিথ্যা বাক্য বৈ আর কিছুই নহে’।” (ক্বোরআন ৩৪।৪৩)।
আল্লাহর পবিত্র আহ্বান শ্রবণ করুন এবং তাঁহার সুমধুর ও অমর গীতির প্রতি মন সন্নিবেশ করুন। দেখুন, তিনি কতই গাম্ভীর্যের সহিত আল্লাহর আয়াতাদি প্রত্যাখ্যানকারীকে সাবধান করিয়াছেন এবং তাঁহার পবিত্র বাক্যাবলী অস্বীকারকারীকে প্রত্যাখ্যান করিয়াছেন। দেখুন, মনুষ্যগণ স্বর্গীয় সাক্ষাৎকার লাভের কাওসার-উৎস হইতে কত দূরে চলিয়া গিয়াছে এবং সুষমার সম্মুখে আধ্যাত্মিকতা শূন্য লোকদের অবিশ্বাস ও ঔদ্ধত্য কি রূপ সাংঘাতিক হইয়াছে। যদিও সেই প্রেমপূর্ণ দয়া ও বদান্যতার সারাৎসার ঐসকল নশ্বর জীবকে অমর রাজ্যে পদক্ষেপ করাইয়াছিলেন এবং ঐসকল দীনহীন আত্মাকে সম্পদের পবিত্র নদীর দিকে পরিচালিত করিয়াছিলেন, তত্রাচ কতক লোক তাঁহাকে “সকল সৃষ্ট জীবের প্রভূ আল্লাহর একজন অপবাদকারী” বলিয়া ভয় প্রদর্শন করিয়াছিল, আর কতক লোক তাঁহাকে এই অপবাদের জন্য অপরাধী করিয়াছিল, “তিনি মনুষ্যগণকে ধর্মের ও সত্য-বিশ্বাসের পথ হইতে ফিরাইয়া রাখেন” এবং আরও অন্যান্য লোক এখনও পর্যন্ত তাঁহাকে “একজন উন্মত্ততাগ্রস্ত লোক” এবং তদ্রƒপ আখ্যা দান করিয়া থাকে।
এই প্রকারে, আপনি বর্তমান কালে দেখিতেছেন, কত হীন অপবাদ দ্বারা তাহারা ঐ অবিনশ্বর রতœকে আক্রমণ করিয়াছে এবং কিরূপ অকথ্য ভাষায় এই পবিত্রতার উৎসের উপর ধর্মীয় আইন লঙ্ঘনকারী প্রভৃতি অপবাদ স্তূপীকৃত করিয়াছে। যদিও আল্লাহ্ তাঁহার গ্রন্থের সর্বত্র এবং তাঁহার পবিত্র ও অমর ফলক-লিপিতে, তাহাদিগকে, যাহারা অবতীর্ণ আয়াতাদি অস্বীকার করে ও প্রত্যাহার করে, সাবধান করিয়া দিয়াছেন এবং যাহারা তৎসমুদয়কে গ্রহণ করে, তাহাদের প্রতি তাঁহার অনুকম্পা ঘোষণা করিয়াছেন, তত্রাচ দেখুন, আল্লাহর অনাদি-অনন্ত পবিত্রতার নূতন স্বর্গ হইতে যে-সমস্ত আয়াত অবতীর্ণ করা হইয়াছে, তৎ সমুদয়ের বিরুদ্ধে কত অসংখ্য প্রতিবাদ তাহারা উত্থাপন করিয়াছে! তাহারা ইহা করিয়াছে, যদিও ইহা একটি অতি সত্য ব্যাপার যে, এইরূপ বদান্যতার এত প্রচুর বর্ষণ কোনও চক্ষু কখনও দেখে নাই, আর এইরূপ স্নেহপূর্ণ দয়ার অবতরণ কোনও কর্ণ শুনে নাই। এইরূপ বদান্যতা ও ঐশী বাণী অবতরণ সুপ্রকাশিত হইয়াছে যে, অবতীর্ণ আয়াতাদি সর্ব-বদান্যের করুণা-রপ মেঘমালা হইতে যেন বসন্ত-কালীন বারি-ধারার ন্যায় বর্ষণ করিয়াছে। পয়গম্বরগণের, যাঁহারা “অটলতা-গুণে বিভূষিত” যাঁহাদের উচ্চ পদবী ও মহিমা সূর্যের ন্যায় উজ্জ্বলভাবে প্রজ্বলিত, তাঁহাদের প্রত্যেককে একটি স্বর্গীয় গ্রন্থ প্রদান করা হইয়াছে, যাহা সকলেই দেখিতে পাইয়াছে এবং যাহার আয়াতাদির সংখ্যাও সঠিকভাবে নির্দিষ্ট করা হইয়াছে। পক্ষান্তরে, এই স্বর্গীয় করুণার মেঘ হইতে যে-সকল আয়াত বৃষ্টি-ধারার ন্যায় বর্ষিত হইয়াছে, তাহা এত প্রচুর যে, কেহই এ পর্যন্ত তাহার সংখ্যা গণনা করিয়া ঠিক করিতে পারে নাই। এখন পর্যন্ত বিশটি গ্রন্থ পাওয়া গিয়াছে। আরও অধিক সংখ্যক গ্রন্থ এখনও পর্যন্ত আমাদের আয়ত্বের বাহিরে! কত অধিক সংখ্যক গ্রন্থ লুণ্ঠিত হইয়াছে এবং কত অধিক শত্রুর হস্তে পতিত হইয়াছে, ইহাদের ভাগ্য সম্বন্ধে কেহই অবগত নহে!
হে ভ্রাতঃ! আমাদের চক্ষু উন্মুক্ত করা উচিত, তাঁহার বাণী সম্বন্ধে আমাদের চিন্তা করা উচিত, এবং আল্লাহর প্রকাশগণের আশ্রয়দানকারী ছায়া অনুসন্ধান করা উচিত, যেন হয়ত, আমরা স্বর্গীয় অভ্রান্ত উপদেশসমূহের দ্বারা সতর্কতা লাভ করিতে পারি এবং পবিত্র ফলকাদিতে যে উপদেশসমূহ লিপিবদ্ধ করা হইয়াছে, তৎপ্রতি মনোযোগ দিতে পারি; যেন আমরা আয়াতাদির অবতরণকারীকে অপবাদ দিতে না পারি, যেন আমরা নিজেরা সম্পূর্ণরূপে তাঁহার ধর্মে আত্মসমর্পণ করিতে পারি এবং সর্বান্তঃকরণে তাঁহার ধর্ম-বিধান গ্রহণ করিতে পারি, যেন হয়ত, আমরা তাঁহার করুণার দরবারে প্রবেশলাভ করিতে পারি এবং তাঁহার অনুকম্পার সমুদ্র-তটে বাস করিতে পারি। নিশ্চয়ই তিনি করুণাময় এবং তাঁহার সেবকগণের প্রতি তিনি ক্ষমাশীল।
এবং এই প্রকারে, তিনি বলেনঃ “বল, হে গ্রন্থানুগামীগণ, তোমরা কি কেবল এইজন্যই আমাদিগকে অস্বীকার কর যে, আমরা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করি এবং আমাদের প্রতি ও আমাদের পূর্বে যাহা অবতীর্ণ হইয়াছে, তৎপ্রতি বিশ্বাস স্থাপন করি এবং তোমাদের মধ্যে অধিকাংশই দুষ্কার্যকারী ?” (ক্বোরআন ৫।৫৯-৬২)। কত পরিষ্কারভাবে এই আয়াত আমাদের উদ্দেশ্য প্রকাশ করিতেছে এবং কত সুষ্পষ্টভাবে আল্লাহর আয়াতাদির সাক্ষ্যের সত্যতা প্রমাণ করিতেছে! যখন ইসলাম ধর্ম অবিশ্বাসী লোকগণ কর্তৃক আক্রান্ত হইয়াছিল এবং ইহার অনুগামীরা অবিশ্বাসী বলিয়া অভিযুক্ত হইয়াছিল, যখন হজরত মোহাম্মদ (সঃ)-র সঙ্গিগণকে আল্লাহর অস্বীকারকারী এবং একজন মিথ্যাবাদী যাদুকরের অনুসরণকারী বলিয়া ভীতি প্রদর্শন করিয়াছিল, তখনই এই আয়াতটি অবতীর্ণ হইয়াছিল। ইসলাম ধর্ম ইহার প্রাথমিক দিবসসমূহে, যখন বাহ্যদৃষ্টিতে প্রাধান্য ও শক্তিহীন বলিয়া বোধ হইতেছিল এবং পয়গম্বর হজরত মোহাম্মদ (সঃ)-র বন্ধুগণ, যাঁহারা আল্লাহর দিকে তাঁহাদের মুখ ফিরাইয়াছিলেন, তাঁহারা যেখানেই যাইতেন, নিগৃহীত, অত্যাচারিত, প্রস্তর নিক্ষপ্ত ও ভীতি-প্রদর্শিত হইতেন। এইরূপ সময়েই এই পবিত্র আয়াত ঐশী প্রত্যাদেশের স্বর্গ হইতে অবতীর্ণ হইয়াছিল। ইহা একটি অকাট্য প্রমাণ এবং অভ্রান্ত সুপথ প্রদর্শনকারী আলোক অবতরণ করিয়াছিল। ইহা হজরত মোহাম্মদ (সঃ)-র সঙ্গিগণকে ঐ সকল অবিশ্বাসী ও মূর্তিপূজকের নিকট নিম্নলিখিত এই বাক্য ঘোষণা করিতে শিক্ষা দিয়াছিল ঃ “তোমরা আমাদের উপর অত্যাচার কর, এবং আমাদিগকে ব্যতিব্যস্ত কর, তত্রাচ আমরা ইহা ব্যতীত আর অন্য কিছুই করি নাই যে, আমরা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করিয়াছি এবং যে-সমস্ত পবিত্র আয়াত হজরত মোহাম্মদ (সঃ)-র মাধ্যমে আমাদের নিকট অবতীর্ণ হইয়াছে এবং যে-সকল আয়াত পুরাতন কালের পয়গম্বরগণের নিকট অবতীর্ণ হইয়াছিল, তাহাতে বিশ্বাস স্থাপন করিয়াছি ?” ইহা দ্বারা এই অর্থ করা যায় যে, তাঁহাদের একমাত্র অপরাধ এই ছিল যে, তাঁহারা চিনিতে পারিয়াছিলেন যে, হজরত মোহাম্মদ (সঃ)-র উপর আল্লাহর যে সকল নূতন ও অতীব আশ্চর্যজনক আয়াত অবতীর্ণ হইয়াছিল এবং পূর্ববর্তী কালের পয়গম্বরগণের নিকট যাহা অবতীর্ণ হইয়াছিল, সকলই আল্লাহর নিকট হইতে আসিয়াছিল; এবং তাঁহারা উহাদের সত্যতা স্বীকার ও গ্রহণ করিয়াছিলেন। এই সাক্ষ্যই স্বর্গীয় সম্রাট তাঁহার সেবকগণকে শিক্ষা দিয়াছেন।
এই হেতুতে এই লোকগণের পক্ষে, সকল নব অবতীর্ণ আয়াত, যাহা পূর্ব ও পশ্চিম বেষ্টন করিয়াছে, তাহা প্রত্যাখ্যান করা এবং নিজেদের সত্য-বিশ্বসী বলিয়া মনে করা কি ন্যায়সঙ্গত ? বরং যিনি এই সকল আয়াত অবতীর্ণ করিয়াছেন, তাঁহার প্রতি বিশ্বাস করা কি তাহাদের উচিত নহে ? তিনি স্বয়ং যে-প্রমাণ স্থাপন করিয়াছেন, তাহা বিবেচনা করিলে তাহারা—যাহারা ইহার সত্যতা স্বীকার করিয়াছে, তাহাদিগকে সত্য-বিশ্বাসী বলিয়া তিনি কি রূপে গণ্য করিবেন না ? ইহা তাঁহার নিকট হইতে অনেক দূরে নহে কি যে, তিনি তাহাদিগকে তাঁহার অনুকম্পার দ্বার হইতে ফিরাইয়া দিবেন, যাহারা তাঁহার আয়াতাদির দিকে ফিরিয়াছে এবং তৎসমুদয় গ্রহণ করিয়াছে, অথবা, যাহারা তাঁহার সুনিশ্চিত সাক্ষ্য-প্রমাণকে আঁকড়াইয়া ধরিয়া রহিয়াছে, তাহাদিগকে ভয় প্রদর্শন করিবেন ? তিনি সত্যই তাঁহার আয়াতসমূহের মধ্য দিয়া সত্য স্থাপিত করেন এবং তাঁহার বাক্যাবলীর মধ্য সত্য স্থাপিত করেন এবং তাঁহার বাক্যাবলীর দ্বারা তাঁহার প্রত্যাদেশ সুদৃঢ় করেন। তিনি নিশ্চয়ই শক্তিশালী, বিপদে সহায়তাকারী সর্বশক্তিমান।
এবং এইরূপে তিনি বলেনঃ “এবং যদি আমরা তোমার প্রতি কাগজে লিখিত গ্রন্থ প্রেরণ করিতাম, তবে নিশ্চয়ই তাহারা স্বীয় হস্ত দ্বারা উহা স্পর্শ করিত, এবং অবিশ্বাসীরা বলিতঃ “ইহা ত একটি প্রকাশ্য যাদু মাত্র’।” (ক্বোরআন ৬।৭)। ক্বোরআনের অধিকাংশ আয়াতই এই মর্মসূচক। সংক্ষেপ করিবার উদ্দেশ্যে আমরা মাত্র এই কয়েকটি আয়াতের উল্লেখ করিয়াছি। বিবেচনা করিয়া দেখুন, তাঁহার সুষমার প্রকাশগণকে স্বীকার করিয়া লইবার নিদর্শনরূপে যাবতীয় ঐশী গ্রন্থের আয়াতসমূহ ব্যতীত আর কিছুই কি নির্দিষ্ট করা হইয়াছে, যাহাতে মনুষ্যগণ তাহা আঁকড়াইয়া ধরিয়া থাকিবে এবং আল্লাহর প্রকাশগণকে প্রত্যাখ্যান করিবে ? পক্ষান্তরে, প্রত্যেক দৃষ্টান্তে, যাহারা তাঁহার আয়াতাদি অস্বীকার করিবে ও বিদ্রুপ করিবে, তাহাদিগকে তিনি নরকাগ্নির ভয় প্রদর্শন করিয়াছেন, যেমন ইতিপূর্বে প্রদর্শিত হইয়াছে।
অতএব, যদি এইরূপ একজন লোক অভ্যুত্থিত হন এবং সহস্র সহস্র আয়াত, কথোপকথন, ফলক-লিপি ও প্রার্থনাবলী উচ্চারণ করেন, যাহার কোনটিই অর্জিত বিদ্যালব্ধ নহে, যাহারা এই সকলকে প্রত্যাখ্যান করে এবং নিজেকে উহার অনুকম্পার শক্তি হইতে বঞ্চিত করে, তাহাদের কি সম্ভাব্য আপত্তি তাহাদের কাজের যথার্থতা প্রমাণ করিতে পারে ? একবার যখন তাহাদের আত্মা ইহার অন্ধকারাচ্ছন্ন দেহ-মন্দির হইতে প্রস্থান করিয়া উর্দ্ধে উঠিয়া যায়, তখন তাহারা কি প্রত্যুত্তর দিতে পারে ? তাহারা এই বলিয়া কি তাহাদের কার্যের সমর্থন করিতে পারেঃ “আমরা কোনও একটি হাদিসকে আঁকড়াইয়া ধরিয়াছিলাম; কিন্তু তাহার আক্ষরিক পূর্ণতা দেখিতে না পাওয়ায় আমরা স্বর্গীয় প্রত্যাদেশের সাক্ষাৎ প্রতিনিধিগণের বিরুদ্ধে এইরূপ প্রতিবাদসমূহ উত্থাপন করিয়াছি এবং আল্লাহর বিধান হইতে দূরে রহিয়াছি ? আপনি কি এই কথা শ্রবণ করেন নাই, কেন পয়গম্বরগণের মধ্যে কয়েকজনকে “অটলতা-গুণে বিভূষিত” পয়গম্বর, এই আখ্যা প্রদান করা হইয়াছে এবং এই সকল কারণের মধ্যে তাঁহাদের নিকট একটি স্বর্গীয় গ্রন্থ অবতীর্ণ হওয়া একটি কারণ ছিল ? এবং তত্রাচ, এই সমস্ত মানুষ ন্যায়তঃ কি প্রকারে তাঁহাকে প্রত্যাখ্যান করিতে পারে—যিনি আয়াতাদি সমন্বিত এতগুলি গ্রন্থ অবতারণ করিয়াছেন এবং যিনি এতগুলি গ্রন্থের কর্তা এবং ঐরূপ ব্যক্তির বাক্যাদি অনুসরণ করিতে পারে, যে মূর্খ লোকের ন্যায় মানুষের অন্তরে সন্দেহের বীজাদি বপন করিয়াছে, এবং যে শয়তানের ন্যায় মনুষ্যগণকে ধ্বংস ও ভ্রান্তির পথে চালাইয়া লইয়া যাওয়ার জন্য উত্থিত হইয়াছে ? স্বর্গীয় বদান্যতা-সূর্যের আলোক হইতে নিজেকে বঞ্চিত করিবার জন্য তাহারা কিরূপে এই সকল অন্যায় কার্য সংঘটিত হওয়ার অনুমতি দিতে পারে ? এই সকল বিষয় বাদ দিলেও, এই সকল লোক যদি এইরূপ একটি স্বর্গীয় আত্মা, এইরূপ পবিত্র প্রাণদাতাকে ত্যাগ ও অস্বীকার করে, আমাদের নিকট ইহা আশ্চর্য বোধ হয়, তাহা হইলে তাহারা কাহাকে আঁকড়াইয়া ধরিয়া থাকিবে, এবং তাঁহার মুখ-সুষমার দিকে ব্যতীত আর কাহার মুখের দিকে তাহারা ফিরিতে পারে ? হ্যাঁ! “প্রত্যেকের জন্য একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যস্থল আছে, সে সেইদিকে মুখ ফিরায়।” (ক্বোরআন ২।১৪৮)। আমরা তোমাদিগকে এই দুইটি পথ প্রদর্শন করিয়াছি; তুমি যাহা পছন্দ কর, সেই পথে চল। ইহাই বাস্তব সত্য এবং সত্যের পর ভ্রান্তি ব্যতীত আর কিছুই নাই।
যে সমস্ত প্রমাণ এই অবতীর্ণ প্রত্যাদেশের সত্যতা সপ্রমাণ করে, তাহাদের মধ্যে একটি এই—প্রত্যেক ধর্ম-যুগে এবং ধর্ম-বিধানকালে, যখন অদৃশ্য সারাৎসার তাঁহার প্রকাশের ব্যক্তিত্বের মাধ্যমে প্রকাশিত হইতেন, তখন কতিপয় অজ্ঞাত ও যাবতীয় পার্থিব সম্পর্কাদি হইতে বিচ্ছিন্ন পবিত্র আত্মা, পয়গম্বররূপ সূর্য ও স্বর্গীয় পথ-প্রদর্শক-রূপ চন্দ্র হইতে আলোক অন্বেষণ করিতেন এবং স্বর্গীয় সাক্ষাৎকার লাভ করিতেন। এই কারণে সমসাময়িক যুগের ধর্মাচার্যগণ ও নেতৃস্থানীয় মনুষ্যগণ এই সকল ব্যক্তিকে ঘৃণা ও উপহাস করিত। যেমন তাহাদের সম্বন্ধে, যাহারা ঐরূপ বিপথগামী হইয়াছিল, তিনি অবতীর্ণ করিয়াছেনঃ “তৎপর তাঁহার সম্প্রদায়ের অবিশ্বাসী প্রধান ব্যক্তিরা বলিয়াছিলঃ ‘আমরা তোমাকে আমাদেরই মত একজন মানবরূপে দেখিতে পাইতেছি, এবং আরও দেখিতেছি যে, আমাদের মধ্যস্থ চঞ্চল প্রকৃতিবিশিষ্ট, অধম ব্যক্তিগণ ব্যতীত আর কেহ তোমার অনুসরণ করে নাই, আর আমাদের উপর তোমাদের কোনও শ্রেষ্ঠত্ব লক্ষ্য করিতেছি না; বরং আমরা তোমাদিগকে মিথ্যাবাদী বলিয়া ধারণা করি’।” (ক্বোরআন ১১।২৭)। তাহারা এই সকল পবিত্র প্রকাশের প্রতি অকারণ আপত্তি উত্থাপন করিয়াছিল এবং প্রতিবাদ করিয়া বলিয়াছিল ঃ “আমাদের মধ্যস্থ ইতর ব্যক্তিগণ ব্যতীত আর কেহ তোমাদের অনুসরণ করে নাই, আর তাহারা ঐ সমস্ত লোক, যাহারা কোনও শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী নহে।” তাহাদের উদ্দেশ্য ছিল ইহাই প্রদর্শন করা যে, শিক্ষিত, ধনী ও খ্যাতিসম্পন্ন লোকদের মধ্য হইতে কেহই তাঁহাদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে নাই। ইহা এবং এই প্রকারের প্রমাণ দ্বারা, যিনি সত্য ব্যতীত অন্য কিছুই বলেন না, তাহারা তাঁহাকেই মিথ্যাবাদী বলিয়া প্রমাণ করিতে চাহিয়াছিল।
এই অতীব উজ্জ্বল ধর্ম-বিধানের, এই পরম শক্তিশালী পূর্ণাধিপত্যের অভ্যুদয় কালে, কিছু সংখ্যক আলোকসম্পন্ন ধর্ম-নেতা, কতিপয় পূর্ণ বিদ্যার অধিকারী ব্যক্তি, এবং পরিপক্ক বিজ্ঞতাসম্পন্ন ধর্ম-শাস্ত্রবিদ্ জ্ঞানী লোক তাঁহার দরবারে প্রবেশাধিকার লাভ করিয়াছেন, তাঁহার স্বর্গীয় সাক্ষাৎ-লাভের পানপাত্র ভোগ করিয়াছেন এবং তাঁহার অত্যুৎকৃষ্ট অনুকম্পার সম্মানে বিভূষিত হইয়াছেন। প্রেমাস্পদের জন্য তাঁহারা পৃথিবী ও তন্মধ্যস্থ সকল কিছুই পরিত্যাগ করিয়াছেন। আমরা কেবল কয়েকজনের নাম উল্লেখ করিব, যাহাতেঃ ইহা দুর্বল চিত্তবিশিষ্টকে সবল করিতে পারে এবং ভীরু লোককে উৎসাহিত করিতে পারে।
তাঁহাদের মধ্যে ছিলেন মোল্লা হোসেইন, যিনি স্বর্গীয় প্রত্যাদেশ-সূর্যের দীপ্তিমান প্রভার গ্রহণকর্তা হইয়াছিলেন। তিনি না হইলে আল্লাহ্ তাঁহার করুণার সিংহাসনে সমাসীন হইতেন না এবং অনাদি-অনন্ত প্রভার সিংহাসনে আরোহণ করিতেন না। তাঁহাদের মধ্যে আরও ছিলেন সৈয়দ য়্যাহ্য়্যা, তাঁহার সমসাময়িক যুগের একজন অদ্বিতীয় ও অতুলনীয় ব্যক্তি, মোল্লা মোহাম্মদ আলী জন্জানী, মোল্লা আলী বোস্তামী, মোল্লা স’য়ীদ বারফিরোশী ( মোল্লা সৈয়দ মোহাম্মদ ‘আলী কুদ্দুস), মোল্লা নে’মতুল্লাহ মাযেন্দরানী, মোল্লা ইউসুফ আর্দেবিলী, মোল্লা মেহ্দী খূ’য়ী, সৈয়দ হোসেন তুর্শিযী, মোল্লা মেহ্দী কন্দী, মোল্লা বাকের, মোল্লাহ ‘আব্দুল খালেক ইয়ায্দী, মোল্লা ‘আলী বরক্বানী এবং অন্য প্রায় চারি মত ব্যক্তি, যাঁহাদের নাম আল্লাহর “সংরক্ষিত ফলক-লিপিতে” খোদিত আছে।
ইঁহারা সকলেই সেই স্বর্গীয় প্রত্যাদেশ সূর্যের আলোক দ্বারা পথ-প্রদর্শিত হইয়াছিলেন, তাঁহারা সকলেই তাঁহার সত্যতা স্বীকার করিয়াছিলেন ও তাঁহাকে গ্রহণ করিয়াছিলেন। তাঁহাদের বিশ্বাস এইরূপ ছিল যে, তাঁহাদের অধিকাংশ লোক নিজ নিজ ধন-সম্পদ ও জ্ঞাতিবর্গকে পরিত্যাগ করিয়াছিলেন। এবং সর্ব প্রভাময়ের সন্তোষ লাভকেই আঁকড়াইয়া ধরিয়া রহিয়াছিলেন। তাঁহাদের প্রেমাস্পদের জন্য তাঁহারা তাঁহাদের জীবন বিসর্জন দিয়াছিলেন এবং তাঁহারই পথে তাঁহারা তাঁহাদের সর্বস্ব সমর্পণ করিয়াছিলেন। তাঁহাদের বক্ষস্থল শত্রুর লক্ষ্যস্থল হইয়াছিল এবং তাঁহাদের মস্তকসমূহ অবিশ্বাসীদের বল্লম অলঙ্কৃত করিয়াছিল। এমন কোনও স্থান ছিল না, যাহা এই আদর্শস্থানীয় সংসার ত্যাগী ব্যক্তিদের রক্ত পান করে নাই এবং এমন কোনও তরবারি ছিল না, যাহা তাঁহাদের গ্রীবা নিষ্পেষিত করে নাই। তাঁহাদের কার্যাবলীই তাঁহাদের বাক্যের সত্যতার সাক্ষ্য দেয়। এই সমস্ত পবিত্র আত্মা, যাঁহারা তাঁহাদের প্রেমাস্পদের জন্য এইরূপ মর্যাদাপূর্ণভাবে তাঁহাদের জীবন উৎসর্গ করিতে দন্ডায়মান হইয়াছিলেন, তাঁহাদের সাক্ষ্য কি অদ্যকার দিনের জন্য যথেষ্ট নহে ? অথচ, সমস্ত পৃথিবীর মানুষ তখনকার দিনে তাঁহাদের এইরূপ আত্মোৎসর্গ লক্ষ্য করিয়া অতীব আশ্চর্যান্বিত হইয়াছিল। ইহা কি ঐ সমস্ত লোকের অবিশ্বস্ততার বিরুদ্ধে যথেষ্ট প্রমাণ নহে, যাহারা সামান্য স্বার্থের জন্য তাহাদের ধর্ম সম্বন্ধে বিশ্বাসঘাতকতা করিয়াছিল, যাহারা লবনাক্ত প্রস্রবণের জন্য স্বর্গীয় সাক্ষাৎকার লাভের কাওসার-উৎস পরিত্যাগ করিয়াছিল এবং যাহাদের জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল, অন্য লোকের সম্পত্তি অন্যায়ভাবে আত্মসাৎ করা ? আপনি যেমন দেখিতেছেন, কিরূপে তাহারা সকলেই এই পৃথিবীর এই মিথ্যা গর্বাদিতে নিজেক প্রমত্ত করিয়াছে এবং যিনি মহিমময়, অত্যুচ্চ প্রভূ, তাঁহার নিকট হইতে দূরে চলিয়া গিয়াছে।
ন্যায়বান হউন ঃ যে সকল লোকের কার্যাবলী তাঁহাদের বাক্যের সহিত সামঞ্জস্য পূর্ণ, যাঁহাদের বাহ্যিক ব্যবহার তাঁহাদের আভ্যন্তরীণ জীবনের সহিত সাদৃশ্য রক্ষা করে, তাঁহাদের সাক্ষ্য কি গ্রহণীয় ও মনোযোগ প্রদর্শনের যোগ্য ? তাঁহাদের কার্যাবলী দৃষ্টে মন বিহ্বল হয় এবং তাঁহাদের সহিষ্ণুতা ও শারিরিক সহ্যগুণ দেখিয়া অন্তর বিস্ময়ে বিমুগ্ধ হয়। অথবা, এই সকল বিশ্বাসহীন আত্মা, যাহারা শুধু স্বার্থপর বাসনার নিঃশ্বাসই ত্যাগ করে এবং যাহারা তাহাদের অলস কল্পনার পিঞ্জরে আবদ্ধ, তাহাদের সাক্ষ্য কি গ্রহণযোগ্য ? অন্ধকারের বাদুড়ের ন্যায় তাহারা শয্যা হইতে তাহাদের মস্তক উত্তোলন করে একমাত্র পার্থিব অস্থায়ী বিষয়ের অনুসরণেরই জন্য এবং তাহাদের জীবনের হীন উদ্দেশ্যাদির উন্নতি বিধানের কার্যে নিযুক্ত থাকা ব্যতীত রাত্রিতে বিশ্রাম লাভ করে না। তাহাদের স্বার্থপর উদ্দেশ্যসমূহে মগ্ন থাকার ফলে তাহারা স্বর্গীয় আদেশ সম্বন্ধে সম্পূর্ণরূপে বিস্মৃত। দিনের বেলা তাহারা পার্থিব উন্নতি লাভ করার জন্য সর্বান্তঃকরণে চেষ্টা করে এবং রাত্রিতে তাহাদের একমাত্র কার্য হইতেছে তাহাদের ইন্দ্রিয় বাসনাদি চরিতার্থ করা। কোন্ আইন বা নীতি অনুসারে মানুষের পক্ষে এইরূপ ক্ষুদ্রমনা আত্মাদের অস্বীকারকে আঁকড়াইয়া ধরিয়া থাকা সমর্থন করিতে পারা যায় এবং পক্ষান্তরে, যাঁহারা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তাঁহার জীবন ও উপজীবিকা, যশ ও খ্যাতি, মান ও মর্যাদা পরিত্যাগ করিয়াছিলেন, তাঁহাদের ধর্ম বিশ্বাস অবহেলা করা কি ন্যায়সঙ্গত কার্য হইবে ?
“ধর্মার্থে জীবন উৎসর্গকারিদের সম্রাট” (হজরত ইমাম হোসেইন)-এর জীবনের ঘটনাবলী যাবতীয় ঘটনার শ্রেষ্ঠ ঘটনা এবং তাঁহার সত্যের মহান সাক্ষ্য বলিয়া কি বিবেচিত হয় নাই ? অতীত কালের লোকেরা ঐ সমুদয় ঘটনাকে কি দৃষ্টান্তহীন বা তুলনাহীন বলিয়া ঘোষণা করে নাই ? তাহারা কি এইরূপ মত প্রকাশ করে নাই যে, কোনও সত্যের প্রকাশক কখনও এইরূপ অটলতা, এইরূপ সুস্পষ্ট মহিমা প্রদর্শন করে নাই ? এবং তত্রাচ তাঁহার জীবনের ঐ ঘটনা, প্রাতঃকালে আরম্ভ হইয়া সেই দিনের মধ্যভাগে শেষ হইয়াছিল। পক্ষান্তরে, এই সকল পবিত্র আলোক, আঠার বৎসর যাবৎ বীরের ন্যায় দুঃখ-কষ্টসমূহের তীর-বর্ষণ সহ্য করিয়াছিল, যাহা প্রত্যেক দিক হইতে তাঁহাদের উপর বর্ষিত হইতেছিল। তাঁহারা কতই আসক্তি, আত্মোৎসর্গ, উল্লাস ও পবিত্র পরম আনন্দের সহিত সেই সর্বমহিমান্বিতের পথে, তাঁহাদের জীবন উৎসর্গ করিয়াছিলেন। ইহার সত্যতা সম্বন্ধে সকলেই সাক্ষ্যদান করে। এবং তত্রাচ এই প্রত্যাদেশকে তাহারা কিরূপে অবমাননা করিতে পারে ? কোনও যুগ কি এইরূপ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী দেখিতে পাইয়াছে ? যদি এই সকল সঙ্গী আল্লাহর অনুসন্ধানের ও লাভের জন্য সত্য প্রচেষ্টাকারী নহেন, তাহা হইলে অন্য কাহাকে ঐ নামে অভিহিত করিতে পারা যাইত ? এই সঙ্গিগণ কি শক্তি বা মর্যাদার অনুসন্ধানকারী হইয়াছেন ? তাঁহারা কি কখনও ধন-ঐশ্বর্যের কামনা করিয়াছিলেন ? আল্লাহর সন্তুষ্টি ব্যতীত তাঁহারা কি অন্য কিছুর বাসনা পোষণ করিয়াছেন ? তাঁহাদের এই সকল আশ্চর্যজনক সাক্ষ্য-প্রমাণাদি ও চমৎকার কার্যাবলী সত্ত্বেও যদি এই সকল সঙ্গী মিথ্যাবাদী হয়েন, তাহা হইলে কে এইরূপ উপযুক্ত যে সে নিজের জন্য সত্যের দাবি করিতে পারে ? আমি আল্লাহর শপথ করিয়া বলিতেছি! তাঁহাদের কার্যাবলীই যথেষ্ট সাক্ষী এবং পৃথিবীর সমস্ত মানুষের জন্য ইহা অকাট্য প্রমাণ, যদি মানুষ স্বর্গীয় প্রত্যাদেশের রহস্যগুলি তাহাদের অন্তরে গভীরভাবে চিন্তা করিত, তাহা হইলে তাহারা ইহা অনুধাবন করিতে পারিত “এবং যাহারা অত্যাচার করে তাহারা শীঘ্রই অবগত হইবে, কিরূপ পরিণাম তাহাদের জন্য অপেক্ষা করিতেছে ?” (ক্বোরআন ২৬।২২৭)।
অধিকন্তু, সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য করার নিদর্শন স্বর্গীয় গ্রন্থে প্রদর্শিত ও নির্দিষ্ট করিয়া দেওয়া হইয়াছে। তজ্জন্য এই স্বর্গীয় নির্দেশিত কষ্টি প্রস্তর দ্বারা মানুষের দাবি-দাওয়া নিশ্চয়ই পরীক্ষা করিতে পারা যায়। যাহাতে সত্যবাদীকে প্রতারক হইতে চিহ্নিত ও পৃথক করিতে পারা যায়, এই কষ্টি-প্রস্তর এই আয়াতটি ব্যতীত আর কিছুই নয়ঃ “মৃত্যু কামনা কর, যদি তোমরা সত্যবাদী হও।” (ক্বোরআন ২।৯৪)। ধর্মার্থে এই সমস্ত আত্মোৎসর্গকারীর সন্দেহাতীত সততা সম্বন্ধে বিবেচনা করুন, যাঁহাদের সত্যতা সম্বন্ধে ক্বোরআনের পরিষ্কার মূল বাক্য সাক্ষ্য দিতেছে এবং যেরূপ আপনি দেখিতে পাইয়াছেন, তাঁহারা সকলে তাঁহাদের জীবন, তাঁহাদের উপজীবিকা, স্ত্রী-পুত্র, তাঁহাদের যথাসর্বস্ব উৎসর্গ করিয়াছেন এবং স্বর্গের উচ্চতম প্রকোষ্ঠে আরোহণ করিয়াছেন। এই সর্বশ্রেষ্ঠ ও মহিমান্বিত প্রত্যাদেশের সত্যতা সম্বন্ধে এই সকল সংসারত্যাগী ও অত্যুন্নত ব্যক্তির সাক্ষ্য প্রত্যাখ্যান করা এবং এই অত্যুজ্জ্বল আলোকের বিরুদ্ধে যে সকল ভীতি-প্রদর্শক বাক্য এই অবিশ্বাসী লোকগণ কর্তৃক উচ্চারিত হইয়াছে, যাহারা স্বর্ণ লাভ করার জন্য তাহাদের ধর্ম-বিশ্বাস ত্যাগ করিয়াছে এবং যিনি মানব জাতির প্রথম নেতা, নেতৃত্বের লোভে যাহারা তাঁহাকে প্রত্যাখ্যান করিয়াছে, তাহাদের ঐ বাক্য গ্রহণযোগ্য বলিয়া মনে করা কি ন্যায়সঙ্গত ? ইহা, অর্থাৎ তাহারা এইরূপ ভীতি প্রদর্শক বাক্যাবলী উচ্চারণ করিয়াছে, যদিও তাহাদের চরিত্র এখন সকল লোকের নিকট প্রকাশিত হইয়াছে, যাহারা তাহাদিগকে এইরূপ লোক বলিয়া চিনিয়া লইয়াছে, যাহারা কিছুতেই আল্লাহর পবিত্র ধর্মের জন্য তাহাদের ইহকালের কর্তৃত্বের বিন্দুমাত্রও ত্যাগ করিবে না, তাহাদের জীবন, উপজীবিকা ইত্যাদির কথা দূরে থাকুক।
দেখুন, কি প্রকারে স্বর্গীয় স্পর্শ-মনি, স্বর্গীয় গ্রন্থের মূল বাক্যানুসারে, সত্যকে মিথ্যা হইতে পৃথক ও চিহ্নিত করিয়াছে। ইহা সত্ত্বেও তাহারা এখনও পর্যন্ত এই সত্য বিস্মৃত হইয়া এবং অনবধানতার নিদ্রায় অভিভূত হইয়া, এই পৃথিবীর মিথ্যা আড়ম্বরাদির অনুসরণ করিতেছে এবং বৃথা পার্থিব নেতৃত্বের ভাবনা-চিন্তায় নিমগ্ন রহিয়াছে।
“ হে মনুষ্যপুত্র! তোমার উপর দিয়া অনেক দিন অতীত হইয়া গিয়াছে; কিন্তু তুমি তোমার মানসিক খেয়াল ও অলস কল্পনাসমূহ দ্বারা নিজেকে জড়িত করিয়া ফেলিয়াছ। তুমি আর কতকাল তোমার শয্যায় তন্দ্রমগ্ন থাকিবে ? তন্দ্রা হইতে তোমার মস্তক উত্তোলন কর, কারণ সূর্য মধ্যাকাশে মস্তকোপরি আসিয়া পৌঁছিয়াছে; হয়ত ইহা সুন্দর আলোকের উজ্জ্বল কিরণ তোমার উপর বর্ষণ করিবে।”
যাহা হউক, ইহা জানিয়া রাখ যে, এই সকল ধর্মাচার্য ও শাস্ত্রজ্ঞ ধর্ম-নেতা, যাহাদের সম্বন্ধে আমরা ইতিপূর্বে ইঙ্গিত করিয়াছি, তাহাদের কেহই নেতৃত্বের পদবী ও মর্যাদায় বিভূষিত ছিলেন না। কারণ খ্যাতনামা ও প্রভাবশালী ধর্ম-নেতাগণ, যাহারা কর্তৃত্বের আসন অধিকার করে এবং নেতৃত্বের কর্তব্য কার্যাদি পরিচালিত করে, অবশ্য আল্লাহব যাঁহাকে চাহেন, তিনি ব্যতীত, ইহারা কোনও ক্রমেই সত্যের অবতরণকারীর আনুগত্য স্বীকার করিতে পারে না। কিন্তু অল্প সংখ্যক মানুষ ব্যতীত ঐরূপ কখনও ঘটে নাই। “আমার সেবকগণের মধ্যে মাত্র সামান্য সংখ্যক লোকই কৃতজ্ঞ।” (ক্বোরআন ৩৪।১৩)। এমন কি, এই ধর্ম-বিধানে, খ্যাতনামা ধর্মাচার্যগণের মধ্য হইতে, যাহাদের হস্তে জনসাধারণের কর্তৃত্বের বল্গা ধৃত ছিল, তাহাদের কেহই এই ধর্ম গ্রহণ করে নাই। শুধু ইহার নহে, এমন কি, তাহারা এইরূপ ঘৃণা, দ্বেষ ও সংকল্পের সহিত ইহার বিরোধিতা করিয়াছে যে, কোনও কর্ণ এইরূপ শুনে নাই এবং কোনও চক্ষু এইরূপ দৃশ্য দেখে নাই।
হজরত বা’ব, প্রভূ, মহামহিমান্বিত—সকলের জীবন তাঁহার জন্য উৎসর্গিত হউক—প্রত্যেক নগরের ধর্মাচার্যগণের নিকট বিশেষভাবে একটি ফলক-লিপি বা পত্র অবতীর্ণ করিয়াছেন, উহাতে তিনি তাহাদের প্রত্যেকের অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যানের স্বভাব সম্পূর্ণরূপে বর্ণনা করিয়াছেন। “অতএব, হে সুতীক্ষè দৃষ্টিসম্পন্ন মনুষ্যগণ! তোমরা উত্তমরূপে মনোযোগ প্রদান কর।” (ক্বোরআন ৫৯।২)। তাহাদের বিরোধিতার প্রতি তাঁহার ইঙ্গিত দ্বারা তিনি “বয়ান গ্রন্থধারীদের” সেই সমস্ত আপত্তি খ-ন করার ইচ্ছা প্রকাশ করিয়াছিলেন, যাহা তাহারা উত্থান দিবসে “মোস্তগাছের” ( পরবর্তী ঐশী প্রকাশের) আবির্ভাবের, দিনে উত্থাপন করিতে পারে, যেহেতু “বয়ানের” ধর্ম-বিধান কালে কয়েকজন ধর্মাচার্য এই ধর্ম গ্রহণ করিয়াছিল; কিন্তু এই পরবর্তী প্রত্যাদেশ কালে তাহাদের কেহই তাঁহার দাবি স্বীকার করিয়া লয় নাই। তাঁহার উদ্দেশ্য ছিল জনসাধারণকে সাবধান করা, পাছে, আল্লাহ্ না করেন, তাহারা এইরূপ মূর্খতাপূর্ণ ধারণাদি আঁকড়াইয়া ধরিয়া থাকে এবং আপনাদিগকে স্বর্গীয় সুষমা হইতে বঞ্চিত রাখে। হ্যাঁ, আমরা যে সকল ধর্মাচার্যের প্রতি ইঙ্গিত করিয়াছি, তাহাদের অধিকাংশই ছিলেন অখ্যাত, এবং আল্লাহর অনুকম্পায় তাঁহারা সকলেই পার্থিব মিথ্যা অহঙ্কারাদি হইত পরিষ্কৃত ও নেতৃত্বের ভূষণাদি হইতে মুক্ত ছিলেন। “আল্লাহর বদান্যতা এমনই, যাহাকে ইচ্ছা তাহাকে তিনি দান করেন।”
ইহা এই প্রত্যাদেশের সত্যতার আর একটি সাক্ষ্য ও প্রমাণ, যাহা অন্য সকল প্রমাণের মধ্যে সূর্যের মত উজ্জ্বল, তাহা হইতেছে আল্লাহর ধর্ম ঘোষণায় অনাদি-অনন্ত সুষমার অটলতা। যদিও তিনি একজন অল্প বয়স্ক যুবক ছিলেন, যদিও তাঁহার প্রত্যাদেশ ধর্ম, উচ্চ ও নীচ, ধনী ও দরিদ্র, উন্নত ও অবনত, রাজা ও প্রজা প্রমুখ পৃথিবীর যাবতীয় মানুষের কামনার পরিপন্থী ছিল, তথাপি তিনি অভ্যুত্থান করিলেন এবং দৃঢ়তা সহকারে তিনি উহা ঘোষণা করিলেন। সকলেই ইহা জানিয়াছে ও শুনিয়াছে। তিনি কাহাকেও ভয় করেন নাই, তিনি কর্মের ফলের জন্য কোনও ভাবনা করিতেন না। স্বর্গীয় অবতরণের শক্তি এবং আল্লাহর অপরাজেয় ইচ্ছা-শক্তির পরাক্রম ব্যতীত এইরূপ একটি কার্য কি প্রকাশিত হইতে পারিত ? আল্লাহর ন্যায়পরায়ণতার শপথ! যদি কোনও ব্যক্তি তাহার অন্তরে এইরূপ মহান একটি প্রত্যাদেশের ধারণা পোষণ করিত, তাহা হইলে এইরূপ একটি ঘোষণার চিন্তাও তাহাকে একেবারে হতবুদ্ধি করিত! যদি সমস্ত মানুষের আত্মা তাহার আত্মার মধ্যে প্রবিষ্ট করিয়া দেওয়া হইত, তথাপি সেও এইরূপ ভয়াবহ একটি দুরূহ কার্য সাহসের সহিত আরম্ভ করিতে ইতস্ততঃ করিত। যদি তাহার অন্তরের গতি স্বর্গীয় অনুকম্পার উৎসের সহিত যুক্ত করা হইত এবং তাহার আত্মা সর্বশক্তিমানের অব্যর্থ উপজীবিকার সুনিশ্চয়তা প্রাপ্ত হইত, একমাত্র তাহা হইলেই সে আল্লাহর অনুমতি সহকারে করিতে পারিত। এইরূপ অতি বড় সাহসের কার্য তাহারা কিসের প্রতি আরোপ করে ? তাহা ভাবিয়া আশ্চর্য হই। প্রাচীন কালের পয়গম্বরগণের প্রতি তাহারা যেরূপ করিয়াছিল, তাঁহার প্রতিও কি তাহারা তদ্রƒপ মূর্খতা-দোষ আরোপ করে ? অথবা তাহারা কি এ কথা মনে করে, তাঁহার উদ্দেশ্য নেতৃত্ব লাভ করা ও পার্থিব ধন-সম্পদ অর্জন করা ব্যতীত আর কিছুই ছিল না ?
পরম দয়ালু আল্লাহ্! তাঁহার এই গ্রন্থে যাঁহাকে তিনি “কাইয়ুমুল আস্মা” (নামাবলীর আবির্ভাবকারী) আখ্যা দিয়াছেন—যাহা তাঁহার গ্রন্থসমূহের মধ্যে সর্বপ্রথম, মহান ও অত্যন্ত শক্তিশালী—তিনি তাঁহার আত্মোৎসর্গ সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী করিয়াছেন। ইহাতে এই বাক্যটি উদ্ধৃত আছে ঃ “হে আল্লাহর পরবর্তী ভবিষ্যদাগমনকারী প্রকাশ! তোমারই জন্য আমি নিজেকে সম্পূর্ণরূপে উৎসর্গ করিয়া দিয়াছি; তোমারই জন্য আমি অভিসম্পাতসমূহ স্বীকার করিয়া লইয়াছি এবং তোমারই প্রেমের পথে শহীদ হওয়া ব্যতীত আর কিছুই ঔৎসুক্য সহকারে প্রত্যাশা করি নাই। আল্লাহ্ই আমার জন্য যথেষ্ট সাক্ষী, যিনি মহীয়ান, রক্ষাকর্তা, অনাদি-অনন্ত।”
এই প্রকারে, তাহার “হা” বর্ণমালা ব্যাখ্যার কালে তিনি এই বলিয়া আত্ম-বলিদান প্রার্থনা করিয়াছিলেনঃ বোধ হইতেছে, আমি আমার অন্তরস্থ গভীর সত্তা হইতে একটি আহ্বান-ধ্বনি শুনিতে পাইলামঃ “তুমি আল্লাহর পথে উহাই উৎসর্গ কর, যাহা তুমি সর্বাপেক্ষা অধিক ভালবাস, এমন কি, যেমন হজরত হোসেইন (রাঃ) — তাঁহার উপর শান্তি বর্ষিত হউক—আমার জন্য তাঁহার জীবন দান করিয়াছিলেন! এবং যদি আমি এই অপরিহার্য রহস্যের প্রতি মনোযোগী না হইতাম, যাঁহার হস্তে আমার সত্তা রহিয়াছে, তাহার শপথ! যদি পৃথিবীর সমুদয় রাজা সংঘবদ্ধ হইত, তথাপি তাহারা আমার নিকট হইতে একটিমাত্র বর্ণও ছিনাইয়া লইতে অপারগ হইত, এই সমস্ত দাসের কথা দূরে থাকুক, যাহারা মনোযোগেরও যোগ্য নহে, এবং যাহারা নিশ্চয়ই জাতিভ্রষ্টদের মধ্যে পরিগণিত—যেন সকলেই আল্ল্হ্রা পথে আমার সহিষ্ণুতা, আত্ম-সমর্পণ ও আত্যোৎসর্গের পরিমাণ সম্বন্ধে অবগত হইতে পারে।”
এইরূপ বাক্য অবতরণকারীকে কি আল্লাহর পথ ভিন্ন অন্য কোনও পথের পথিক বলিয়া এবং তাঁহার সন্তুষ্টি ভিন্ন অন্য কিছুর জন্য ব্যকুলভাবে প্রার্থনা করিয়াছে বলিয়া মনে করিতে পারা যায় ? এই আয়াতেই সর্বস্ব ত্যাগের গন্ধ রহিয়াছে, যদি এই পৃথিবী পৃষ্ঠে সম্পূর্ণরূপে ব্যক্ত করা হয়, তাহা হইলে সকলেই তাহাদের জীবন ত্যাগ করিবে এবং তাহাদের আত্মাকে উৎসর্গ করিবে। বর্তমান কালের মানুষের ইতর ব্যবহার সম্বন্ধে চিন্তা করিয়া দেখুন এবং তাহাদের অত্যাশ্চর্য অকৃতজ্ঞতার প্রতি দৃষ্টিপাত করুন। দেখুন, তাহারা এইসব প্রভার দিকে তাহাদের চক্ষু বন্ধ করিয়াছে এবং হীনভাবে কদর্য শবসমূহ অনুসরণ করিতেছে, যাহাদের উদরসমূহ হইতে বিশ্বাসীদের গলাধঃকৃত খাদ্যদ্রব্যের চিৎকার ধ্বনি উত্থিত হয়। এবং তত্রাচ, এই স্বর্গীয় পবিত্রতার প্রভাতসমূহের প্রকাশগণের বিরুদ্ধে তাহারা কত অনুচিত মিথ্যা অপবাদাদি নিক্ষেপ করিয়াছে ? আমরা আপনার নিকট এইরূপই বর্ণনা করিতেছি, যাহা ঐ সকল অবিশ্বাসীর হস্ত সম্পাদন করিয়াছিল, যাহারা পুনরুত্থান দিবসে, স্বর্গীয় সাক্ষাৎকার লাভ হইতে তাহাদের মুখ ফিরাইয়া লইয়াছে এবং যাহাদিগকে আল্লাহ্ তাহাদের নিজেদের অবিশ্বাসের অগ্নি দ্বারা অসহ্য যন্ত্রণা দান করিয়াছেন এবং যাহাদের জন্য তিনি ভবিষ্যতে আগমনকারী পৃথিবীতে একটি দ- প্রস্তুত করিয়া রাখিয়াছেন, যাহা তাহাদের শরীর ও আত্মা, উভয়ই গ্রাস করিবে। কারণ তাহারা বলিয়াছেঃ “ আল্লাহ শক্তিহীন এবং তাঁহার করুণার হস্ত শৃঙ্খলাবদ্ধ।”
ধর্মে অটলতা সত্যের একটি সুনিশ্চিত সাক্ষ্য এবং একটি শ্রেষ্ঠ প্রমাণ। এই প্রকারে যেমন “নবীগণের সীল-মোহর” বলিয়াছেনঃ “দুইটি আয়াত আমাকে বৃদ্ধত্বে উপনীত করিয়াছে।” এই দুইটি আয়াতই আল্লাহর প্রত্যাদিষ্ট ধর্মে অটলতা প্রদর্শনসূচক আয়াত। এইরূপে যেমন তিনি বলেনঃ “তুমি যে-রূপ আদিষ্ট হইয়াছ, সেইরূপ স্থির থাক”। (ক্বোরআন ১১।১১৩)।
এবং এক্ষণে বিবেচনা করুন, আল্লাহর ‘রেজওয়ান’-উদ্যানের এই স্বর্গীয় সিদ্রা-বৃক্ষ যৌবনের প্রথম ভাগে, আল্লাহর প্রত্যাদিষ্ট ধর্ম ঘোষণা করিবার জন্য কি ভাবে দন্ডায়মান হইয়াছেন। দেখুন, আল্লাহর সেই সুষমা কিরূপ অটলতা প্রদর্শন করিয়াছেন। তাঁহাকে বাধা প্রদান করার জন্য সমস্ত পৃথিবী দন্ডায়মান হইয়াছিল, তত্রাচ ইহারা সম্পূর্ণরূপে অকৃতকার্য হইয়া গিয়াছে। স্বর্গীয় আশীষপ্রাপ্ত সেই সিদ্রা-বৃক্ষের প্রতি যত কঠোরতার নিগ্রহ প্রদান করিয়াছিল, তাঁহার অনুরাগ ততই অধিক বর্ধিত হইয়াছিল, এবং তাঁহার প্রেমের অগ্নিশিখা ততোধিক উজ্জ্বলভাবে প্রজ্বলিত হইল। এই সকলই সুস্পষ্ট এবং কেহই ইহার সত্যতা সম্বন্ধে প্রতিবাদ করিতে পারে না। অবশেষে তিনি তাঁহার আত্মা সমর্পণ করিলেন এবং উর্দ্ধরাজ্যসমূহে উড্ডীন করিলেন।
এবং তাঁহার অভ্যুত্থানের সত্যতার প্রমাণসমূহের মধ্যে ছিল তাঁহার প্রাধান্য, তাঁহার শক্তির শ্রেষ্ঠত্ব এবং তাঁহার মহত্ব, যাহা সেই সত্তার অবতরণকারী এবং পরম পূজ্যের প্রকাশ অন্যের সাহায্য ব্যতিরেকে ও একাকী সমস্ত পৃথিবীতে প্রকাশ করিয়াছেন। যখনই ষষ্টি বৎসর ( বার শত ষাইট হিজরীতে) সেই অনাদি-অনন্ত সুষমা আপনাকে শিরাজ নগরে আবির্ভূত করিলেন এবং অদৃশ্যতার অবগুণ্ঠন বিদীর্ণ করিলেন, তখনই সেই সারাৎসার সত্তা ও সাগরাদির মহাসাগর হইতে যে প্রাধান্য, শক্তি, পূর্ণাধিপত্য ও সামর্থ্যরে নিদর্শনসমূহ নির্গত হইয়াছিল, তাহা প্রত্যেক দেশে সুপ্রকাশিত হইল। ইহা এত অধিক ছিল যে, প্রত্যেক নগরী হইতে সেই স্বর্গীয় জ্যোতিষ্কের নিদর্শন, প্রমাণ, লক্ষণ এবং প্রমাণাদি প্রকাশিত হইল। কত অধিক পবিত্র ও সদয় অন্তরবিশিষ্ট মানুষ তাঁহার অনুগামীদের মধ্যে ছিলেন, যাঁহারা বিশ্বস্ততার সহিত সেই অনাদি-অনন্ত সূর্যের আলোক প্রতিফলিত করিয়াছিলেন এবং সেই স্বর্গীয় বিজ্ঞতার মহাসাগর হইতে কত বহুবিধ জ্ঞান নির্গত হইয়াছিল, যাহা সমস্ত জীবকে পরিবেষ্টন করিয়াছিল। প্রত্যেক নগরে, যাবতীয় ধর্মাচার্য ও উচ্চপদস্থ ধর্ম-নেতা তাঁহাদিগকে বাধা প্রদান ও দমন করার জন্য দন্ডায়মান হইল এবং দ্বেষ, ঈর্ষা ও অত্যাচার দ্বারা তাঁহাদিগকে দমন করিবার উদ্দেশ্যে কোমর বাঁধিয়া দাঁড়াইল। কত অধিক সংখ্যক পবিত্র আত্মা, যাঁহারা ন্যায় বিচারের অবতার ছিলেন, তাঁহারা অত্যাচারী বলিয়া অভিযুক্ত হইয়া মৃত্যু বরণ করিয়াছিলেন। কত অধিক সংখ্যক ব্যক্তি, যাঁহারা পবিত্রতার নিদর্শনস্বরূপ ছিলেন এবং যাঁহারা একমাত্র সত্য জ্ঞান ও নিষ্কলঙ্ক কার্যাবলীই প্রদর্শন করিয়াছিলেন, তাঁহাদিগকে যন্ত্রণাপ্রদ মৃত্যুদ- ভোগ করিতে হইয়াছিল। এতদসত্ত্বেও এই সকল পবিত্র সত্তার প্রত্যেকে মৃত্যুর পূর্ব মূহুর্ত পর্যন্ত আল্লাহর নাম স্মরণ করিয়াছিলেন এবং আত্মত্যাগ ও আত্মসমর্পণের রাজ্যে উড্ডীন করিয়াছিলেন। তিনি তাঁহাদের উপর এইরূপ শক্তি ও পরিবর্তনশীল প্রভাব বিস্তার করিয়াছিলেন যে, তাঁহারা তাঁহার ইচ্ছা ব্যতীত অন্য কোন বাসনা পোষণ করেন নাই এবং তাঁহারই স্মৃতির সহিত তাঁহাদের আত্মা সংযুক্ত করিয়া দিয়াছিলেন।
চিন্তা করিয়া দেখুনঃ এই পৃথিবীতে এমন কে আছে যে, এইরূপ অতীব শ্রেষ্ঠ শক্তি এবং অত্যন্ত প্রবল প্রভাব প্রকাশ করিতে সক্ষম ? এই সকল নিষ্কলঙ্ক অন্তরবিশিষ্ট ব্যক্তি ও পবিত্র আত্মা পূর্ণ আহূতির সহিত তাঁহারই আহ্বানের প্রত্যুত্তর দানস্বরূপ দন্ডায়মান হইয়াছিলেন। অভিযোগ করা দূরে থাকুক, তাঁহারা বরং আল্লাহর শোকর করিয়াছিলেন এবং তাঁহাদের অত্যধিক যন্ত্রণার অন্ধকারের মধ্যেও তাঁহারা তাঁহার ইচ্ছার প্রতি দীপ্তিমান সম্মতি প্রকাশ করিয়াছিলেন। ইহা অতি সুস্পষ্ট, এই সকল সঙ্গীর প্রতি পৃথিবীর সকল লোকের ঈর্ষা কত অধিক ছিল, তাহাদের দ্বেষ ও শত্রুতা কতই তিক্ত ছিল। এই সকল পবিত্র ও আধ্যাত্মিক সত্তার প্রতি যে নিগ্রহ ও যন্ত্রণা তাহারা প্রদান করিয়াছিল, তাহাই তাঁহারা তাঁহাদের মুক্তি, মঙ্গল ও চিরস্থায়ী কৃতকার্যতার উপায় বলিয়া মনে করিয়াছিলেন। হজরত আদম (আঃ)-র সময় হইতে বর্তমান কাল পর্যন্ত পৃথিবী কি এইরূপ আন্দোলন, এইরূপ প্রবল উত্তেজনা দেখিতে পাইয়াছে ? এই সকল ভোগ করা এবং এই সকল যন্ত্রণা সহ্য করা সত্ত্বেও, তাঁহারা সাবজনীন তিরস্কার ও অভিশাপের পাত্র হইয়াছিলেন। মনে হয়, একমাত্র তাঁহাদের সহ্য-গুণের কারণেই সহিষ্ণুতা অবতীর্ণ হইয়াছিল এবং একমাত্র তাঁহাদের সাহসিকতাপূর্ণ কার্যাবলীর জন্যই বিশ্বস্ততা শব্দের জন্ম-দান করা হইয়াছিল।
আপনি আপনার অন্তরে এই সকল গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সম্বন্ধে গভীরভাবে অনুধাবন করুন, যাহাতে আপনি এই প্রত্যাদেশের মহত্ত্ব অনুধাবন করিতে পারেন এবং ইহা বিস্ময়কর প্রভা অনুভব করিতে পারেন। তাহা হইলেই করুণাময়ের অনুকম্পায় বিশ্বাসের আত্মা আপনার সত্তার মধ্যে প্রবেশ লাভ করিবে এবং আপনি স্থিতিত্ব লাভ করিবেন এবং নিশ্চয়তার আসনে অবস্থিতি করিবেন। একমাত্র আল্লাহ্ই আমার সাক্ষী! যদি আপনি কিয়ৎকালের জন্য গভীরভাবে চিন্তা করেন, তাহা হইলে আপনি দেখিতে পাইবেন যে, এই সকল প্রমাণিত সত্য এবং পূর্বোল্লিখিত প্রমাণসমূহ ব্যতীত পৃথিবীর মনুষ্যগণের উচ্চারিত প্রত্যাখ্যান, অভিশাপ ও অভিসম্পাত স্বয়ং আত্মসমর্পণ ও ত্যাগের ক্ষেত্রে এই সকল বীর পুরুষের সত্যের সম্বন্ধে প্রবলতম প্রমাণ ও সুনিশ্চিত সাক্ষ্য। ধর্মাচার্যগণ শিক্ষিত হউক বা অজ্ঞ হউক, তাহাদের সকলের উচ্চারিত প্রতিবাদসমূহ সম্বন্ধে যখনই আপনি চিন্তা করিবেন, আপনার বিশ্বাস তখন দৃঢ়তর ও অধিকতর মজবুত হইবে। কারণ যাহা কিছু ঘটিয়াছে, সেই সকলেরই সম্বন্ধে, যাঁহারা স্বর্গীয় জ্ঞানের খনি এবং আল্লাহর চিরস্থায়ী আইনের গ্রহণকারী, তাঁহাদেরই দ্বারা ভবিষ্যদ্বাণী করা হইয়াছে।
যদিও আমরা অতীত কালের হাদীসসমূহের উল্লেখ করার ইচ্ছা করি নাই, তত্রাচ, আপনার প্রতি আমাদের ভালবাসার কারণে, যে-গুলি আমাদের বিতর্কের পরিপোষক আমরা তাহার কতকগুলির উল্লেখ করিব। যাহা হউক, আমরা অবশ্য সেগুলির তেমন প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি না, কারণ আমরা ইতিপূর্বে যে-সকল বিষয় উল্লেখ করিয়াছি, তাহা পৃথিবী ও তন্মধ্যস্থ সকলের পক্ষেই যথেষ্ট। বাস্তবিক পক্ষে, সকল ধর্ম-গ্রন্থ ও তাহাদের মধ্যে যে-সকল রহস্য নিহিত আছে, সকলই এই সংক্ষিপ্ত বিবরণীতে সংক্ষিপ্ত আকারে প্রদান করা হইয়াছে। ইহা পরিমাণে এত অধিক যে, যদি এক ব্যক্তি কিয়ৎকালের জন্য তাহার মনে ইহা অনুধাবন করে, তাহা হইলে, যাহা বলা হইয়াছে তাহা হইতে সে আল্লাহর বাণীসমূহের রহস্যাদি আবিষ্কার করিতে পারিবে এবং সেই আদর্শ সম্রাটের দ্বারা যাহা প্রকাশ করা হইয়াছে, তাহার অর্থ হৃদয়ঙ্গম করিতে সক্ষম হইবে। জনসাধারণের বোধশক্তি ও পদবীতে পার্থক্য আছে, এই কারণে আমরা কেবল অল্প কয়েকটি হাদীসের উল্লেখ করিব, যেন এই সকল ইতস্ততকারী আত্মাকে স্থিরতা প্রদান করিতে পারে এবং দুঃখপূর্ণ অন্তরে শান্তি আনয়ন করিতে পারে। তদ্দদ্বারা জনসাধারণের নিকট, তাহারা ছোট হউক বা বড় হউক, আল্লাহর সাক্ষ্য পূর্ণ ও যথার্থ হইবে।
উহাদের মধ্যে এই হাদীস আছেঃ “যখন সত্যের পতাকা সুপ্রকাশিত হইবে, পূর্ব ও পশ্চিম দেশের লোক ইহাকে অভিসম্পাত করিবে।” সর্বস্ব ত্যাগের মদিরার পানপাত্র নিশ্চয়ই প্রচুর পরিমাণে পান করিতে হইবে, সর্বত্যাগীর উচ্চ চূড়ায় আরোহণ করিতে হইবে এবং এই বাক্যসমূহের যে-সাধনার কথা ইঙ্গিত করা হইয়াছে, তাহা নিশ্চয়ই পালন করিতে হইবেঃ “এক ঘণ্টা সময়ের ধ্যান, নিষ্ঠার সহিত সত্তর বৎসর কালের উপাসনা অপেক্ষা শ্রেয়ঃ”, যেন ঐ সকল হতভাগ্য লোকের ঘৃণ্য ব্যবহারের রহস্য আবিষ্কৃত হইতে পারে, যাহারা, যে-সত্য তাহারা স্বীকার করে সে-সত্যের প্রতি তাহাদের ভালবাসা ও ব্যাকুলতা থাকা সত্ত্বেও যখনই সেই ঐশী সত্য একবার প্রকাশিত হইয়া থাকেন, তখনই স্বর্গীয় সত্যের অনুসারিগণকে তাহারা অভিশাপ দান করে। পূর্বোল্লিখিত হাদীস এই সত্যের সাক্ষ্য প্রদান করিতেছে। ইহা সুস্পষ্ট যে, এইরূপ আচরণের কারণ ইহা ব্যতীত আর কিছুই নহে যে, ঐ সমস্ত বিধান, রীতি-নীতি, অভ্যাস ও ধর্ম-সম্বন্ধীয় আচার-ব্যবহার, যাহা এ-যাবৎ তাহারা পালন করিয়া আসিয়াছে, তাহা রহিত করা হইয়াছে। পক্ষান্তরে, যদি পরম করুণাময়ের সুষমা ঐ সমস্ত রীতি-নীতি, যাহা জনসাধারণের মধ্যে প্রচলিত ছিল, তাহাতে যদি তিনি সম্মত হইতেন এবং যদি সেই সকল পালন করিবার জন্য তিনি তাহাদিগকে অনুমতি প্রদান করিতেন, তাহা হইলে এইরূপ বিবাদ-বিসম্বাদ পৃথিবীতে কিছুতেই দেখিতে পাওয়া যাইত না। এই সকল বাক্য, যাহা তিনি ক্বোরআন গ্রন্থে অবতীর্ণ করিয়াছেন, তাহার সাক্ষ্য দান করে ও তাহা প্রমাণ ও সমর্থন করিতেছেঃ “যেইদিন ঐশী আহ্বানকারী একটি কঠিন বিষয়ের দিকে আহ্বান করিবেন।” (ক্বোরআন ৫৪।৬)।
প্রভার অন্তরাল হইতে স্বর্গীয় অগ্রদূতের ঐশী আহ্বান-ধ্বনি যাহা মানব জাতিকে ঐ সমস্ত বিষয় সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করিবার জন্য আহ্বান করে, যাহা তাহারা এতদিন যাবৎ পালন করিয়া আসিতেছিল, এই আহ্বান নিশ্চয়ই তাহাদের বাসনার বিপরীত হইয়াছে এবং এই কারণেই এই সকল অতিশয় তিক্ত পরীক্ষা ও ভয়াবহ আন্দোলন সংঘটিত হইয়াছে। জনসাধারণের আচরণ সম্বন্ধে চিন্তা করিয়া দেখুন। তাহারা এই সকল সুদৃঢ় ভিত্তিসম্পন্ন হাদীস পরিত্যাগ করে, অথচ এই সকল হাদীস সত্য প্রমাণিত হইয়া গিয়াছে এবং তাহারা সন্দেহযুক্ত দুর্বল প্রমাণসম্পন্ন বাক্যসমূহকে আঁকড়াইয়া ধরিয়া থাকে এবং তাহারা জিজ্ঞাসা করেঃ “কেন ইহা পূর্ণ হয় নাই ? এবং তত্রাচ, ঐ সকল বিষয় যাহা তাহাদের নিকট সম্ভাবনার অতীত ছিল, সেইগুলি প্রকাশিত হইয়া গিয়াছে। সত্যের নিদর্শন ও লক্ষণসমূহ, এমন কি, মধ্যাহ্ন সূর্যের ন্যায় উজ্জ্বলরূপে প্রতিভাত হইতেছে এবং তত্রাচ জনসাধারণ অজ্ঞতা ও মূর্খতার মরু-জঙ্গলে উদ্দেশ্যহীনভাবে, হতভম্বের ন্যায় ইতস্ততঃ ভ্রমণ করিতেছে। পবিত্র ক্বোরআনের সকল আয়াত এবং অনুসৃত ও স্বীকৃত হাদীসসমূহ থাকা সত্ত্বেও যাহাদের সব কয়টিই একটি নূতন ধর্ম-বিশ্বাস, একটি নূতন বিধান এবং নূতন ধর্ম-গ্রন্থ অবতরণের সূচনা করে, এই যুগের জনসাধারণ এখনও পর্যন্ত এমন একজন প্রতিশ্রুত মানবের সন্দর্শনের আশায় প্রতীক্ষা করিয়া রহিয়াছে, যিনি হজরত মোহাম্মদ (সঃ)-র ধর্ম-বিধান, আইন-কানুন রক্ষা করিবেন। ইহুদীগণ ও খ্রীস্টানগণও এইরূপে একই প্রকারের আপত্তি সমর্থন করিতেছে।
যে সমস্ত উচ্চারিত হাদীস একটি নূতন ধর্ম-বিধান ও এক নূতন অভ্যুত্থান ও অবতরণ সম্বন্ধে ভাবষ্যদ্বাণী করে, তন্মধ্যে “নোদবার প্রার্থনা”র (হজরত আলী (রাঃ) কর্তৃক উচ্চারিত) বাক্যাবলী এইরূপ ঃ “তিনি কোথায়, যাঁহাকে সংরক্ষিত করিয়া রাখা হইয়াছে, যেন তিনি বিধান ও আইন-ব্যবস্থাসমূহ নূতন সূত্রে পুণঃ প্রবর্তন করিতে পারেন ? তিনি কোথায়, যিনি ধর্ম ও ধর্মানুসরণকারিগণকে পরিবর্তন করিবার শক্তি সমন্বিত ?” তিনি আরও “যীয়ারতে” অবতীর্ণ করিয়াছেন ঃ “নূতন অভ্যুত্থানকারী সত্যের উপর শান্তি বর্ষিত হউক।” আবু আব্দুল্লাহ যখন মেহ্দীর চরিত্র সম্বন্ধে জিজ্ঞাসিত হইয়াছিলেন, তখন বলিয়াছিলেনঃ “আল্লাহর রসুল হজরত মোহাম্মদ (সঃ) যাহা সম্পাদন করিয়াছেন, তিনি তাহা সম্পাদন করিবেন, এবং তিনি তাহা ধ্বংস বা রহিত করিবেন, যাহা তাঁহার পূর্বে ছিল, ঠিক ঐরূপ যে-রূপ আল্লাহর রসুল তাঁহার পূর্ববর্তী জনসাধারণের নিয়ম-কানুনাদি ধ্বংস করিয়াছিলেন।
দেখুন, এই সমস্ত ও এইরূপ আরও অনেক হাদীস থাকা সত্ত্বেও তাহারা এই প্রতিবাদ করে যে, পূর্বে অবতীর্ণ বিধানসমূহ কোনও প্রকারেই পরিবর্তিত হইবে না। এবং তত্রাচ, প্রত্যেক ধর্মের অবতরণের উদ্দেশ্য কি মানব জাতির চরিত্রের আমূল পরিবর্তন সাধন নহে, যে-পরিবর্তন আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিকভাবে, উভয় প্রকারে নিজেকে প্রকাশিত করিবে, যাহা ভিতর ও বাহির, উভয় প্রকারের অবস্থাদির উপর প্রভাব বিস্তার করিবে ? কারণ, যদি মানব জাতির চরিত্র পরিবর্তিত না হয়, তাহা হইলে আল্লাহর সার্বজনীনতার প্রকাশের নিরর্থকতাই স্পষ্ট হইবে। “আওয়ালিম,” যাহা একটি প্রামাণ্য ও বিখ্যাত হাদীস-গ্রন্থ, তাহাতে লিখিত আছেঃ “হাশেম বংশ হইতে একজন যুবক অভ্যুত্থান করিবেন, যিনি একটি নূতন ঐশী গ্রন্থ অবতীর্ণ করিবেন, এবং একটি ধর্ম-বিধান প্রবর্তন করিবেন,” তৎপর এই সকল বাক্য লিপিবদ্ধ করা হইয়াছেঃ “ধর্মাচার্যগণের অধিকাংশই তাঁহার শত্রু হইবে। আর এক স্থানে মোহাম্মদ (রাঃ)-র পুত্র সাদেক হইতে বর্ণিত হইয়াছে যে, তিনি এই উদ্ধৃত বাক্য বলিয়াছেনঃ “হাশেম বংশ হইতে একজন যুবক প্রকাশিত হইবেন, যিনি জনসাধারণকে তাঁহার প্রতি আনুগত্য স্বীকার করার জন্য আদেশ দান করিবেন। তাঁহার গ্রন্থ হইবে একটি নূতন গ্রন্থ, যাহার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করিবার জন্য তিনি যাবতীয় মনুষ্যকে আহ্বান করিবেন। আরব জাতির নিকট তাঁহার প্রতি অবতীর্ণ গ্রন্থ-বাণী কঠোর হইবে। যদি তোমরা তাঁহার সম্বন্ধে শুনিতে পাও, তাহা হইলে তাঁহার দিকে দ্রুত অগ্রসর হও।” ধর্মের ইমামগণের এবং সুনিশ্চয়তার প্রদীপমালার আদেশ-উপদেশাদি কত ভালরূপেই না তাহারা অনুসরণ করিয়াছে! যদিও ইহা পরিষ্কারভাবে বর্ণিত হইয়াছেঃ “যদি তোমরা শুনিতে পাও যে, হাশেম বংশ হইতে একজন যুবক আবির্ভূত হইয়াছেন, যিনি মনুষ্যগণকে একটি নূতন স্বর্গীয় গ্রন্থের দিকে এবং একটি নূতন স্বর্গীয় বিধানের দিকে আহ্বান করিতেছেন, তাহা হইলে তাঁহার দিকে দ্রুতগতিতে অগ্রবর্তী হও,” তথাপি, তাহারা সকলেই সেই অস্তিত্বের প্রভূকে একজন অবিশ্বাসী বলিয়া অভিমত প্রকাশ করিয়াছে, এবং তাঁহাকে একজন ধর্মদ্রোহী বলিয়া অভিমত প্রকাশ করিয়াছে। তাহারা হস্ত নিষ্কোষিত অসি ও হিংসা-দ্বেষ পরিপূর্ণ অন্তর ব্যতীত সেই নহাশেমী আলোক ও সেই স্বর্গীয় প্রকাশের প্রতি দ্রুত অগ্রসর হয় নাই। অধিকন্তু, দেখুন, ধর্মাচার্যগণের শত্রুতা সম্বন্ধে কতই সুস্পষ্টভাবে গ্রন্থসমূহে উল্লেখ করা হইয়াছে। এই সকল সুস্পষ্ট ও অর্থপূর্ণ হাদীস এবং এই সকল নির্ভুল ও অবিসম্বাদিত ইঙ্গিত সত্ত্বেও জনসাধারণ জ্ঞানের ও পবিত্র উচ্চারিত বাণীর এই নির্দোষ নিষ্কলঙ্ক সার সত্তাকে প্রত্যাখ্যান করিয়াছে, এবং বিদ্রোহ ও ভ্রান্তির পরিপোষণকারী ব্যাখ্যাকর্তাদের প্রতি মুখ ফিরাইয়াছে। এই সকল লিপিবদ্ধ হাদীস ও অবতীর্ণ আয়াত সত্ত্বেও, তাহারা কেবল তাহাদের নিজেদের স্বার্থ-প্রণোদিত বাক্যই বলিয়া থাকে। এবং যদি সত্যের সারাৎসার তাহাদের ইচ্ছা ও প্রবৃত্তিসমূহের বিপরীত কিছু অবতীর্ণ করেন, তাহা হইলে তাহারা তখন তখনই তাঁহাকে একজন অবিশ্বাসী বলিয়া ভয় প্রদর্শন করিবে এবং এই বলিয়া প্রতিবাদ করিবে ঃ “এই সকলই ধর্মের ইমামগণের ও ধর্মের অত্যুজ্জ্বল আলোকসম্পন্ন ব্যক্তিগণের বাক্যাবলীর বিপরীত বাক্য। আমাদের অলঙ্ঘনীয় ধর্ম-বিধান আইনে এইরূপ কোনও ব্যবস্থা করা হয় নাই” ঠিক এইরূপে, এমন কি, বর্তমান সময়ে এই সকল হতভাগা নশ্বর মানব কর্তৃক এই প্রকার নিরর্থক বাক্যাদি কথিত হইয়াছে ও হইতেছে।
এবং এক্ষণে, অন্য একটি হাদীস সম্বন্ধে বিবেচনা করুন এবং লক্ষ্য করিয়া দেখুন, কিরূপে এই সকল বিষয় সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী করা হইয়াছে। “র্আবা’ইন” হাদীস-গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছেঃ “হাশেম বংশ হইতে একজন যুবক আবির্ভূত হইবেন, যিনি নূতন ধর্ম-বিধান অবতরণ করিবেন। তিনি জনগণকে তাঁহার দিকে আহ্বান করিবেন; কিন্তু কেহই তাঁহার আহ্বানে কর্ণপাত করিবে না। তাঁহার শত্রুদের মধ্যে অধিক সংখ্যক লোক হইবে ধর্ম-নেতা। তাঁহার আদেশ তাহারা মানিয়া লইবে না; বরং এই বলিয়া তাহারা প্রতিবাদ করিবেঃ “ধর্মের ইমামগণের নিকট হইতে আমরা যাহা ক্রমান্বয়ে পাইয়া আসিয়াছি, ইহা তাহার বিপরীত।” বর্তমান সময়ে সকলেই এই একই প্রকারের বাক্যাবলীর পুনরুল্লেখ করিতেছে, অথচ তাহারা ইহা সম্পূর্ণরূপে অজ্ঞাত যে, “যাহা তিনি চাহেন, তাহা তিনি করেন”, এই সিংহাসনেরই উপর তিনি উপবিষ্ট, এবং “যাহা তিনি ইচ্ছা করেন, তিনি তাহার ব্যবস্থার আদেশ দান করিয়া থাকেন”, এই আসনেই তিনি অবস্থিত আছেন।
মানবের কোনও উপলব্ধি তাঁহার অবতীর্ণ প্রত্যাদেশ-বাণীর সত্য প্রকৃতি হৃদয়ঙ্গম করিতে সক্ষম নহে এবং কোনও প্রকার জ্ঞান তাঁহার ধর্ম-বিশ্বাসের সঠিক পরিপূর্ণতা বুঝিয়া লইতে সমর্থ নহে। সকল বাক্যই তাঁহার মঞ্জুরীর উপর নির্ভরশীল এবং সকল কিছুই তাঁহার প্রত্যাদেশ ধর্মের আবশ্যকতা রাখে। তিনি ব্যতীত আর সকলই তাঁহার আদেশের সৃষ্ট এবং তাঁহার ধর্ম-বিধানের মধ্য দিয়াই তাহাদের গতিবিধি ও অস্তিত্ব। তিনি স্বর্গীয় রহস্যাবলীর প্রকাশ ও অবতরণকারী এবং তিনি নিহিত ও আদিম বিজ্ঞতার ব্যাখ্যাকারী। “বেহারুল্-আন্ওয়ার” (বিখ্যাত সুবৃহৎ শী’য়া হাদীস-গ্রন্থ), “আওয়ালিম” (শী’য়া হাদীস-গ্রন্থ), “য়্যান্বু‘উ” (শী’য়া হাদীস গ্রন্থ), এই সকল হাদীস-গ্রন্থে, এইরূপ বর্ণিত আছে যে, ইমাম মোহাম্মদ বাক্কেরের পুত্র ইমাম জা’ফর সাদেক এই সকল বাক্য বলিয়াছেনঃ “জ্ঞানের মোট সাতাইশটি বর্ণমালা আছে। তাহাদের মধ্য হইতে যাবতীয় পয়গম্বর মাত্র দুইটি বর্ণের জ্ঞানই অবতরণ করিয়াছেন। কোনও মানব এই পর্যন্ত এই দুই বর্ণের জ্ঞান অপেক্ষা অধিকতর কিছুরই জ্ঞান অবগত হন নাই। কিন্তু যখন ক্বায়েম আবির্ভূত হইবেন, তখন তিনি অবশিষ্ট পঁচিশটি বর্ণের জ্ঞান প্রকাশ করিবেন। ” বিবেচনা করিয়া দেখুন, তিনি প্রকাশ করিয়াছেন পূর্ণ সত্য সাতাইশটি বর্ণের সমষ্টি, এবং হজরত আদম হইতে “সীল-মোহর” হজরত মোহাম্মদ (সঃ) পর্যন্ত সকল পয়গম্বর ঐ সাতাইশটি বর্ণের মধ্য হইতে মাত্র দুইটি বর্ণেরই ব্যাখ্যাকারী ছিলেন এবং এই দুইটি বর্ণেরই সহিত তাঁহারা প্রেরিত হইয়াছিলেন বলিয়া তিনি বিবেচনা করিয়াছেন। তিনি আরও বলিয়াছেন যে, “ক্বায়েম” (মেহ্দী) অবশিষ্ট পঁচিশটি বর্ণের সকলগুলিই অবতীর্ণ করিবেন। এই উচ্চারিত বাক্য হইতে লক্ষ্য করিয়া দেখুন, তাঁহার পদবী কতই মহান ও উচ্চ! তাঁহার মর্যাদা, সকল পয়গম্বরের মর্যাদা অপেক্ষা অতি উচ্চ, এবং তাঁহার অবতীর্ণ প্রত্যাদেশ-বাণী তাঁহাদের মনোনীত সকলের বোধগম্যতা ও উপলব্ধির অনেক উর্দ্ধে অবস্থিত। এমন একটি প্রত্যাদেশ যাহার সম্বন্ধে আল্লাহর পয়গম্বর, তাঁহার পবিত্রাত্মাগণ, এবং তাঁহার মনোনীতগণকে হয়ত অবগত করান হয় নাই, অথবা আল্লাহর অজ্ঞেয় মীমাংসাক্রমে, যাহা তাঁহারা প্রকাশ করেন নাই—এই প্রকারের একটি প্রত্যাদেশ-বাণী এই সকল নীচ প্রকৃতিবিশিষ্ট ও দুশ্চরিত্র লোক তাহাদের নিজেদের দুর্বল মন, দুর্বল বিদ্যা ও বুদ্ধি দ্বারা উপলব্ধি করিতে চাহিয়াছিল। ইহা যদি তাহাদের আদর্শগুলির অনুকূল না হয়, তাহারা তৎক্ষণাৎ তাহা পরিত্যাগ করে। “তুমি কি মনে কর যে, তাহাদের অধিকাংশ লোক শুনিতে পায় বা বুঝিতে পারে ? তাহারা, এমন কি, পশুরই ন্যায়, এবং তাহারা প্রকৃত পথ হইতে বিপথগামী হইয়া আরও অধিক দূরে চলিয়া গিয়াছে।” (ক্বোরআন ২৫।৪৪)।
আমরা আশ্চর্য বোধ করিতেছি, পূর্বোল্লিখিত হাদীসটি তাহারা কিরূপ ভাবে ব্যাখ্যা করে, যে-হাদীস তাঁহার দিনে যে সকল দুর্জ্ঞেয় বিষয়াদি অবতীর্ণ হইবে, এবং নূতন ও অত্যাশ্চর্যজনক ঘটনাটি ঘটিবে, সে সকল সম্বন্ধে নির্ভুলভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করিতেছে ? এইরূপ অতীব আশ্চর্যজনক ঘটনাসমূহ জনসাধারণের মধ্যে এইরূপে বিবাদ-বিসম্বাদের অগ্নি প্রজ্বলিত করে যে, সকল ধর্মাচার্য ও আইনজ্ঞ ধর্ম-নেতা, তাঁহার ও তাঁহার সঙ্গীগণের প্রতি মৃত্যুদন্ডাজ্ঞা প্রদান করে এবং পৃথিবীর সকল জাতির লোক তাঁহার প্রতিকূলে দন্ডায়মান হয়। হজরত ক্বায়েমের চরিত্র সম্বন্ধে “কাফীতে” জাবেরের হাদীস বাক্যে, এবং “ফাতেমার ফলক-লিপিতে” এইরূপই লিপিবদ্ধ করা হইয়াছেঃ “তিনি মূসার সম্পূর্ণতা, যীশুর উজ্জ্বলতা এবং আইয়ুবের সহিষ্ণুতা প্রকাশ করিবেন। তাঁহার দিনে তাঁহার মনোনীতগণ অপমানিত হইবেন। তুর্কী ও দায়লেমীদের মস্তকসমূহ যেরূপ উপঢৌকনস্বরূপ প্রদত্ত হয়, ঠিক সেইরূপ ভাবে তাঁহাদের মস্তকসমূহও উপঢৌকনস্বরূপ প্রদান করা হইবে। তাঁহাদিগকে হত্যা করা হইবে এবং জ্বালাইয়া দেওয়া হইবে। ভয় তাঁহাদিগকে আক্রমণ করিবে, আতঙ্ক ও ভীতি তাঁহাদের অন্তরসমূহকে আলোড়িত করিবে। তাঁহাদের রক্তে পৃথিবী রঞ্জিত হইবে। তাঁহাদের স্ত্রীলোকেরা শোক ও বিলাপ করিবে। ইঁহারা সত্য সত্যই আমার বন্ধু!” বিবেচনা করিয়া দেখুন, এই হাদীসের একটি বর্ণও অপূর্ণ রহে নাই। প্রায় অধিকাংশ স্থানে তাঁহাদের রক্তপাত করা হইয়াছে; প্রত্যেক নগরে তাঁহাদিগকে কয়েদ করা হইয়াছে, তাঁহাদিগকে প্রদেশের সর্বত্র প্রকাশ্য রাস্তায় জনসাধারণের সম্মুখে প্রদর্শন করা হইয়াছে; কয়েকজনকে অগ্নি সংযোগে জ্বালাইয়া দেওয়া হইয়াছে। এবং তত্রাচ, কোনও একজন লোকও ইহা চিন্তা করিবার জন্য থামে নাই যে, যদি প্রতিশ্রুত ক্বায়েম পূর্বতন একটি ধর্ম-বিধানের আইন-কানুন ও আদেশসমূহ অবতীর্ণ করিবেন, তাহা হইলে এইরূপ হাদীসসমূহ কেন লিপিবদ্ধ করা হইল এবং তাহা হইলে কেন এইরূপ বাদ-বিসম্বাদ উত্থিত হইল যে, জনসাধারণ এই সকল সঙ্গীকে হত্যা করা তাহাদের উপর অর্পিত একটি কর্তব্য কার্য বলিয়া মনে করিল, এবং এই সকল পবিত্র আত্মাকে নির্যাতিত করা উচ্চতম অনুগ্রহ প্রাপ্তির উপায় বলিয়া মনে করিল ?
অধিকন্তু, লক্ষ্য করিয়া দেখুন, ঐ সমস্ত ঘটনা যাহা ঘটিয়াছে এবং ঐ সমুদয় কার্য যাহা করা হইয়াছে, ইহাদের সকলই কিরূপে পূর্ববর্তী হাদীসসমূহে অবিকল উল্লেখ করা হইয়াছে। “যওরা” সম্বন্ধে “রওজীয়ে-কাফী”তে ঠিক এইরূপ উল্লিখিত হইয়াছে। “রওজীয়ে-কাফীতে” ওহ্হাবের পুত্র মোওয়াবিয়া কর্তৃক বর্ণিত হইয়াছে যে, আবু আবদুল্লাহ্ বলিয়াছেন ঃ (হে মোওয়াবিয়া)! তুমি “যওরা” চিন কি ? আমি বলিলাম ঃ “আপনার জন্য আমার জীবন উৎসর্গীকৃত হউক! তাহারা বলে ইহা বাগদাদ।” “না, তাহা নহে,” তিনি উত্তর করিলেন। এবং তৎপর তিনি বলিলেনঃ “তুমি রায়য্ নগরে (একটি পুরাতন নগর যাহার নিকটে ত্বেহরাণ নগর নির্মিত হইয়াছে) প্রবেশ করিয়াছ কি ?” তদুত্তরে আমি বলিলামঃ “ হ্যাঁ, আমি তথায় প্রবেশ করিয়াছি।” তৎপর তিনি জিজ্ঞাসা করিলেনঃ “ তুমি কি গো-হাটে প্রবেশ করিয়াছ ?” আমি বলিলামঃ “হ্যাঁ”। তিনি বলিলেনঃ “তুমি কি রাস্তার পার্শ্বের কালা পাহাড় দেখিয়াছ ? ইহাই ‘যওরা’। সেই স্থানে আশি জন লোককে হত্যা করা হইবে, যাঁহাদের প্রত্যেকেই ‘খলিফা’ হইবার যোগ্য। আমি জিজ্ঞাসা করিলামঃ “কে তাঁহাদিগকে হত্যা করিবে ?” তিনি উত্তরে বলিলেনঃ “পারস্য দেশেরই লোকেরা।”
এইরূপই ছিল তাঁহার সঙ্গিগণের অবস্থা ও ভাগ্য, যে-সম্বন্ধে পূর্ববর্তী সময়ে ভবিষ্যদ্বাণী করা হইয়াছে। এক্ষণে লক্ষ্য করুন, হাদীসানুসারে “যওরা” “রায়্য়” দেশ ব্যতীত অন্য কোনও স্থান নহে। সেই স্থানেই তাঁহার অধিকাংশ সঙ্গিগণকে অত্যধিক যন্ত্রণা সহকারে হত্যা করা হইয়াছে এবং এই সকল পবিত্র ব্যক্তি পারস্য দেশবাসীর হস্তেই তাঁহাদের জীবন বলিদান করিয়াছেন, যে-রূপ হাদীসটিতে লিপিবদ্ধ রহিয়াছে। ইহা আপনি শুনিতে পাইয়াছেন, এবং এই বিষয়ে সকলেই সাক্ষ্য দিতেছে। তবে কেন এই সকল নীচ প্রকৃতির কীটবৎ লোক এই সকল হাদীস সম্বন্ধে চিন্তা করিবার জন্য থামে না, অথচ সকল হাদীস মধ্যাহ্নকালীন প্রভাসম্পন্ন সূর্যের ন্যায় প্রকাশমান ? কি কারণে তাহারা সত্য গ্রহণ করিতে অস্বীকার করে এবং অন্য কতকগুলি হাদীস যাহাদের মর্ম তাহারা উপলব্ধি করিতে পারে নাই, সেইগুলিকে আল্লাহর প্রত্যাদেশ ও তাঁহার সুষমাকে চিনিয়া লওয়ার ও স্বীকার করার পথে প্রতিবন্ধকতাস্বরূপ দাঁড়াইতে দেয় এবং ইহার ফল-স্বরূপ তাহারা নিজেদের নরকের অতলস্পর্শ খাদে নিক্ষেপ করিয়া দেয় ? সমসাময়িক যুগের ধর্মাচার্য ও ধর্ম-নেতাদের বিশ্বাসহীনতার কারণেই কেবল এই সকল সংঘটিত হইয়া থাকে। ইহাদের সম্বন্ধে মোহাম্মদের পুত্র সাদেক বলিয়াছেন ঃ “সেই যুগের ধর্ম-শাস্ত্রবিদ পন্ডিতেরা আকাশের ছায়ার নীচে যে সকল ধর্মাচার্য ও ধর্ম-নেতা বাস করে তাহাদের মধ্যে অধিকতর দুষ্ট প্রকৃতিবিশিষ্ট হইবে। তাহাদেরই নিকট হইতে ক্ষতিজনক কার্যের উদ্ভব হইয়াছে এবং তাহাদেরই নিকট ইহা প্রত্যাবর্তন করিবে।”
আমরা বয়ান-গ্রন্থধারী শিক্ষিত লোকদের অনুনয় করিতেছি, যেন তাহারা সেই পথ অনুসরণ না করে, যেন মোস্তগাছের সময় তাঁহার প্রতি সেইরূপ কষ্ট দেওয়া না হয়, যিনি স্বর্গীয় সারাৎসার, স্বর্গীয় আলোক-প্রভা, যিনি অসীম-অনাদি-অনন্ত, যিনি অদৃশ্য সত্তার প্রকাশের আদি ও অন্ত, যেরূপ কষ্ট এই দিবসে তাঁহার প্রতি প্রদত্ত হইয়াছে। আমরা তাহাদের নিকট এই প্রার্থনা করিতেছি, যেন তাহারা তাহাদের বুদ্ধি, জ্ঞান ও বিদ্যার উপর নির্ভর না করে এবং স্বর্গীয় ও অনন্ত জ্ঞানের প্রকাশ ও অবতরণকারীর সহিত বিবাদ না করে। এবং তত্রাচ, আমাদের এই সকল সাবধানতাসূচক সদুপদেশ সত্ত্বেও আমরা দেখিতে পাইতেছি যে, ভবিষ্যতে একজন এক চক্ষু বিশিষ্ট ব্যক্তি, যে স্বয়ং জনসাধারণের প্রধান ব্যক্তি, সে চরম ঈর্ষাপরায়ণতার সহিত আমাদের বিরুদ্ধে উত্থিত হইতেছে। আমরা দেখিতে পাইতেছি, ভবিষ্যতে প্রত্যেক নগরে জনগণ এই পরম পবিত্র সুষমাকে দমন করিবার জন্য দন্ডায়মান হইবে এবং সেই অস্তিত্বের প্রভূর ও সকল মানবের চরম অভিলষিত মহীয়ান ব্যক্তির সঙ্গিগণ এই অত্যাচারীর সম্মুখ হইতে পলায়ন করিবে, এবং জঙ্গলে আশ্রয় গ্রহণ করিবে, পক্ষান্তরে, অন্য লোকেরা আত্মসমর্পণ করিবে এবং পরম ত্যাগ সহকারে তাঁহারই পথে আত্ম-বলিদান করিবে। বোধ হইতেছে, আমরা পূর্ব হইতে সুস্পষ্টরূপে দেখিতে পাইতেছি, এমন এক ব্যক্তি, যে এইরূপ ভক্তি ও নিষ্ঠার জন্য বিখ্যাত যে, জনসাধারণ তাঁহাকে মান্য করা কর্তব্য বলিয়া মনে করিবে এবং তাঁহার আদেশ স্বীকার করিয়া লওয়া প্রয়োজন বলিয়া মনে করিবে, সেই ব্যক্তি স্বর্গীয় বৃক্ষের মূল শিকড় আক্রমণ করিবার জন্য দন্ডায়মান হইবে এবং তাহার সম্পূর্ণ শক্তি সহকারে তাঁহাকে বাধা দেওয়ার জন্য ও তাঁহার প্রতিবাদ করার জন্য চেষ্টা করিতে থাকিবে। মানুষের স্বভাব এইরূপই!
আমরা অতি আনন্দের সহিত আশা করি যে, বয়ান-গ্রন্থ অনুসরণকারী লোকেরা আলোকপ্রাপ্ত হইবে, আত্মার রাজ্যে উড্ডীন করিবে এবং তথায় অবস্থান করিবে, সত্য অবলোকন করিবে, এবং অন্তর্দৃষ্টি সহকারে প্রতারণাপূর্ণ মিথ্যাকে চিনিয়া লইতে পারিবে। যাহা হউক, বর্তমান কালে ঈর্ষার এইরূপ দুর্গন্ধ চতুর্দিকে বিস্তৃত হইয়া পড়িয়াছে যে—আমি দৃশ্য ও অদৃশ্য, সকলেরই পরম শিক্ষাদাতার শপথ করিয়া বলিতেছি—পৃথিবীর ভিত্তির প্রারম্ভ কাল হইতে, যদিও ইহার কোনও প্রারম্ভ নাই—বর্তমান সময় পর্যন্ত, এইরূপ দ্বেষ, ঈর্ষা ও হিংসা, কোনও প্রকারে দেখিতে পাওয়া যায় নাই এবং ভবিষ্যতেও আর কখনও দেখিতে পাওয়া যাইবে না। কারণ, কতকগুলি লোক যাহারা কখনও ন্যায়-বিচারের সৌরভের সুঘ্রাণ ভোগ করে নাই, তাহারা বিদ্রোহের পতাকা উত্তোলন করিয়াছে এবং আমাদের বিরুদ্ধে দলবদ্ধ হইয়াছে। প্রত্যেক দিকে আমরা তাহাদের বর্শসমূহের ভীতি প্রদর্শন দেখিতে পাইতেছি এবং সকল দিকেই আমরা তাহাদের তীরসমূহের ফলকগুলি লক্ষ্য করিতেছি। এইসবই আমাদের জন্য উদ্যত করিয়া রাখা হইয়াছে, যদিও আমরা কোনও কিছুতেই গর্ব অনুভব করি নাই, এবং কোনও আত্মার উপর আমাদের শ্রেষ্ঠত্ব বোধ করি নাই। প্রত্যেকেরই নিকট আমরা একজন অত্যন্ত সদয় সখা হইয়াছি, একজন অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও স্নেহময় বন্ধু হইয়াছি। দরিদ্র লোকদের দলে আমরা তাহাদের সংসর্গই চাহিয়াছি এবং উন্নত ও শিক্ষিত লোকদের মধ্যে আমরা নম্র ও ত্যাগী হইয়াছি। আমি একমাত্র সত্য আল্লাহর শপথ করিয়া বলিতেছি, শত্রু ও গ্রন্থধারী লোকদের হস্ত যে-সকল দুঃখ ও কষ্ট আমাদের উপর বর্ষণ করিয়াছে, সেইগুলি যদিও দুঃসহ, তত্রাচ এই সকল অতি অকিঞ্চিৎকরে পরিণত হয়, যখন সেইগুলিকে, যাহারা আমাদের বন্ধু বলিয়া স্বীকার করে, তাহাদের নিকট হইতে আমাদের উপর যাহা পতিত হইয়াছে, তাহার সহিত তুলনা করা যায়।
আমরা অধিক আর কি বলিব ? যদি এই বিশ্ব-জগৎ ন্যায়ের চক্ষে দৃষ্টিপাত করে, তাহা হইলে ইহা এই উচ্চারিত বাক্যের ভার বহন করিতে অসমর্থ হইবে। এই স্থানে আসিয়া পৌঁছার প্রাথমিক দিবসসমূহে, যখন আমরা ভবিষ্যতের অবশ্যম্ভাবী ঘটনাসমূহের লক্ষণাদি উপলব্ধি করিলাম, তখন ঐ সকল ঘটিবার পূর্বেই আমরা সেখান হইতে প্রস্থান করিবার সঙ্কল্প করিলাম। আমরা জঙ্গলে আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিলাম এবং সেখানে সংসার হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া একাকী দুই বৎসর কাল সম্পূর্ণ নির্জনতার জীবন যাপন করিলাম। আমাদের চক্ষুদ্বয় হইতে অত্যধিক বেদনার অশ্রু-বারি বর্ষিত হইতেছিল এবং আমাদের রক্তাক্ত হৃদয়ে ক্লেশের যাতনা-সমুদ্র উদ্বেলিত ও তরঙ্গায়িত হইতেছিল। অনেক রাত্রি আমাদের জীবন-ধারণের উপযোগী খাদ্যের অভাব ঘটিয়াছিল এবং অনেক দিন যাবৎ আমাদের শরীর বিশ্রাম লাভ করে নাই। যাঁহার হস্তদ্বয়ের মধ্যে আমার আত্মা ন্যস্ত, তাঁহার শপথ! দুঃখ-কষ্ট ও অবিশ্রান্ত বিপৎপাতের এই সকল উপর্যুপরি বর্ষণ সত্ত্বেও আমাদের আত্মা পরম সুখ ও আনন্দে মগ্ন ছিল এবং আমাদের জীবন বর্ণনাতীত হর্ষে পরিপূর্ণ ছিল। কারণ আমাদের নির্জন বাসকালে কোন আত্মার ইষ্টানিষ্ট, স্বাস্থ্য বা পীড়া সম্বন্ধে আমরা অবগত ছিলাম না। আমরা একাকী পৃথিবী ও তন্মধ্যস্থ সকল কিছু হইতে বিস্মৃত হইয়া আমাদেরই আত্মার সহিত আলাপনে নিযুক্ত ছিলাম। যাহা হউক, আমরা জানিতাম না যে, স্বর্গীয় নির্দেশিত ভাগ্যজাল মানব পরিকল্পনার অপরিসীম বিস্তৃিত অতিক্রম করে এবং তাঁহার আদেশের বর্শা অত্যধিক সাহস সম্পন্ন মানবের অভিপ্রায়কে পরাজিত করে। যে সকল জাল তিনি নিক্ষেপ করেন, কেহই সেগুলি এড়াইতে পারে না এবং তাঁহার ইচ্ছার প্রতি সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ ব্যতীত কোনও আত্মা মুক্তিলাভ করিতে পারে না। আল্লাহর ন্যায়পরায়ণতার শপথ করিয়া বলিতেছি! আমাদের এই স্বেচ্ছাকৃত নির্বাসন হইতে প্রত্যাবর্তন করিবার অভিপ্রায় ছিল না এবং আমাদের ত্যাগের পর পুনর্মিলনের আশাও ছিল না। আমাদের নির্জন বাসের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল, যেন আমরা বিশ্বাসীদের মধ্যে কলহের কারণ, যেন আমাদের সঙ্গিদের মধ্যে গোলযোগের কারণ, কোনও আত্মার প্রতি কোনও আঘাতের কারণ বা কাহারও অন্তরের প্রতি মনঃকষ্টের কারণ না হই। এই সকল ব্যতীত আমাদের অন্য কোনও উদ্দেশ্য ছিল না এবং ঐ সকল ব্যতীত আমাদের অন্য কোনও লক্ষ্য ছিল না। এবং তত্রাচ, প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের অভিরুচি অনুসারে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল এবং নিজ নিজ অলস প্রবৃত্তির অনুসরণ করিতেছিল; অবশেষে সেই নিগূঢ় আধ্যাত্মিক উৎস আল্লাহর সকাশ হইতে প্রত্যাগমন করিবার আদেশ নিঃসৃত হইল। তাঁহারই ইচ্ছার উপর আত্মসমর্পণ করিয়া তাঁহারই আদেশ শিরোধার্য করিলাম এবং প্রত্যাগমন করিলাম।
আমাদের প্রত্যাগমনের পর যাহা কিছু আমরা দেখিতে পাইলাম, কোন্ লেখনী তাহা বর্ণনা করিতে সক্ষম! দুই বৎসর যাবৎ আমাদের শত্রুগণ আমাদিগকে সমূলে ধবংস করিবার জন্য অনবরত যথাসাধ্য চেষ্টা করিয়াছিল, ইহা সকলেরই নিকট বিদিত। এই সকল সত্ত্বেও বিশ্বাসিগণের মধ্যে কেহই আমাদের কোন সাহায্যের জন্য দন্ডায়মান হয় নাই এবং কেহই আমাদের উদ্ধারের জন্য সাহায্য করিতে ইচ্ছুক হয় নাই। শুধু ইহাই নহে, সাহায্য করা দূরে থাকুক, তাহাদের বাক্যাবলী ও কার্যাবলী আমাদের আত্মার উপর অনবরত দুঃখের ধারাসমূহ বর্ষণ করিয়াছে। এই সকলের মধ্যেও আমরা আমাদের প্রাণ ধৃত করিয়া আল্লাহর ইচ্ছার উপর সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করিয়া দন্ডায়মান রহিলাম, যেন হয়ত আল্লাহর স্নেহপূর্ণ দয়া ও অনুকম্পার সাহায্যে এই অবতীর্ণ ও প্রকাশিত বর্ণ সেই আদি-বিন্দু অত্যন্ত মহীয়ান বাণীর পথে নিজের জীবন বলিদান দ্বারা উৎসর্গ করিতে পারেন। তাঁহার শপথ করিয়া বলিতেছি, যাঁহার আদেশে পরমাত্মা বাক্যোচ্চারণ করিয়াছে, আমাদের আত্মার এই অত্যুগ্র বাসনা না থাকিলে আমরা এক মূহুর্তের জন্য আর এই নগরে অপেক্ষা করিতাম না। “আল্লাহ্ আমাদের জন্য যথেষ্ট সাক্ষী।” আমরা এই বাক্যাবলীর সহিত আমাদের বিতর্ক শেষ করিতেছিঃ “একমাত্র আল্লাহর নিকট ব্যতীত কোনও শক্তি ও সামর্থ্য নাই।” “আমরা আল্লাহরই, এবং তাঁহারই নিকট আমরা প্রত্যাবর্তন করিব।”
যাহাদের নিকট উপলব্ধি করিবার অন্তর আছে, যাহারা যথেষ্ট পরিমাণে প্রেমের মদিরা পান করিয়াছে, যাহারা এক মূহুর্তের জন্যও নিজেদের স্বার্থপর বাসনা চরিতার্থ করে নাই, তাহারা ঐ সমুদয় নিদর্শন, সাক্ষ্য ও প্রমাণাদি যাহা এই অত্যাশ্চর্যজনক প্রত্যাদেশ, এই অতীব মহিমান্বিত স্বর্গীয় ধর্ম-বিশ্বাসের সাক্ষ্য প্রদান করে, তাঁহাদিগকে মধ্যাহ্নকালীন সূর্যের মহিমার ন্যায় অত্যুজ্জ্বল অবলোকন করিবে। চিন্তা করিয়া দেখুন, কিরূপে জনসাধারণ আল্লাহর সুষমাকে ত্যাগ করিয়াছে এবং তাহাদের লোভপূর্ণ বাসনাসমূহের প্রতি আসক্ত হইয়া রহিয়াছে। এই সকল পরিপূর্ণতাপ্রাপ্ত আয়াত, এই নির্ভুল সঙ্কেতাদি, যাহা এই “অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যাদেশ বাণী”তে অবতীর্ণ হইয়াছে, যাহা মানুষের মধ্যে আল্লাহর ন্যস্ত গচ্ছিত সম্পদ, এবং এই সকল সুস্পষ্ট প্রামাণ্য হাদীস সত্ত্বেও যাঁহাদের প্রত্যেকে অপরটি অপেক্ষা অধিকতর সুস্পষ্ট, মানুষ ইঁহাদের সত্য অস্বীকার করিয়াছে এবং তাঁহাদিগকে প্রত্যাখ্যান করিয়াছে এবং এইরূপ কতকগুলি হাদীসের আক্ষরিক অর্থের প্রতি আকৃষ্ট হইয়া রহিয়াছে, যাহা তাহাদের উপলব্ধি মতে, তাহারা তাহাদের প্রত্যাশার সহিত অসঙ্গতি প্রাপ্ত হইয়াছে এবং যাহাদের অর্থ তাহারা উপলব্ধি করিতে সক্ষম হয় নাই। এইরূপে তাহারা প্রত্যেক আশা ছিন্নভিন্ন করিয়াছে এবং তাহারা নিজেদের সেই সর্ব-প্রভাময়ের সুপবিত্র মদিরা হইতে এবং অমর সুষমার সুনির্মল ও অক্ষয় সলিল-ধারা হইতে বঞ্চিত করিয়াছে।
বিবেচনা করিয়া দেখুন যে, এমন কি, যে বৎসর সেই আলোকের সারাৎসার আবির্ভূত হইবেন, তাহাও হাদীসসমূহে বিশেষভাবে লিপিবদ্ধ করিয়া দেওয়া হইয়াছে, তত্রাচ তাহারা এখনও পর্যন্ত অমনোযোগী রহিয়াছে, এবং এক মূহুর্তের জন্যও তাহারা তাহাদের স্বার্থপর বাসনাসমূহ অনুসরণ করা হইতে ক্ষান্ত হয় নাই। হাদীস অনুসারে মুফজ্জল হজরত সাদেককে এই বলিয়া প্রশ্ন করিলেনঃ “ হে আমার প্রভূ, তাঁহার অভ্যুত্থানের নিদর্শন কি ?” তিনি উত্তর করিলেনঃ “ষাইট বৎসরে তাঁহার ধর্মাদেশ প্রকাশিত হইবে, এবং তাঁহার নাম ঘোষিত হইবে।”
ইহা কত আশ্চর্যের বিষয়! এই সকল সুপরিষ্কার ও সুস্পষ্ট ইঙ্গিত সত্ত্বেও এই সকল লোক সত্যকে পরিত্যাগ করিয়াছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, সেই স্বর্গীয় গুণের সারাৎসারের দুঃখ-দুর্দশার, তাঁহার কারারুদ্ধ হওয়া ও তাঁহার প্রতি যে সকল যন্ত্রণা প্রদত্ত হইয়াছিল, এই সকলেরই পূর্ববর্তী হাদীসসমূহে উল্লেখ করা হইয়াছে। “বিহার” এ ইহা লিপিবদ্ধ আছে ঃ আমাদের ক্বায়েমের হজরত মূসা (আঃ), যীশু, ইউসুফ (আঃ) ও হজরত মোহাম্মদ (সঃ) এই চারিজন ভবিষ্যদ্বক্তা হইতে চারিটি লক্ষণ থাকিবে। ভীতি ও প্রতীক্ষা হইবে হজরত মূসা (আঃ) হইতে প্রাপ্ত লক্ষণ; হজরত ঈসা (আঃ) হইতে প্রাপ্ত লক্ষণ হইবে তাঁহার সম্বন্ধে যাহা কথিত হইয়াছিল; হজরত ইউসুফ (আঃ) হইতে প্রাপ্ত লক্ষণ হইবে, কারাবরোধ ও প্রতারণা; হজরত মোহাম্মদ (সঃ) হইতে প্রাপ্ত লক্ষণ হইবে, পবিত্র ক্বোরআনের ন্যায় একটি স্বর্গীয় গ্রন্থের অবতারণ। এইরূপ একটি অকাট্য, সিদ্ধান্তমূলক হাদীস থাকা সত্ত্বেও যাহা এইরূপ নির্ভুল ভাষায় বর্তমান সময়ের সংঘটিত ঘটনাবলীর ভবিষ্যদ্বাণী করিয়াছে, ইহার ভবিষ্যদ্বাণীর প্রতি মনোযোগ দিয়াছে, এইরূপ একজন লোকও পাওয়া যায় নাই এবং বোধ হইতেছে, আল্লাহর ইচ্ছা না হইলে, কেহই ভবিষ্যতে ইহার প্রতি মনোযোগ প্রদান করিবে না। “আল্লাহ্ নিশ্চয় যাহাকে ইচ্ছা শ্রবণ করাইবেন; কিন্তু যাহারা তাহাদের সমাধিসমূহে সমাহিত আছে, আমরা তাহাদিগকে শ্রবণ করাইতে পারি না।”
আপনার নিকট ইহা সুস্পষ্ট যে, স্বর্গের বিহঙ্গমসমূহ ও অনাদি-অনন্তের রাজ্যের কপোতসমূহ দুই ভাষায় বাক্য বলিয়া থাকেন। একটি ভাষা, যাহা বহিঃস্থিত ভাষা, ইহাতে কোনও ইঙ্গিত নাই, ইহা গুপ্ত নহে, ইহা অবগুণ্ঠনমুক্ত; যেন ইহা একটি পথ-প্রদর্শক প্রদীপ ও আলোক নিদর্শনকারী বাতি-ঘর হইতে পারে, যদ্দ্বারা পথিকেরা পবিত্রতার উচ্চ শৃঙ্গসমূহে পৌঁছিতে পারে, এবং সত্য অনুসন্ধানকারীরা চিরস্থায়ী পুনর্মিলনের রাজ্যে অগ্রবর্তী হইতে পারে। পূর্বে উল্লিখিত আবরণমুক্ত হাদীসসমূহ ও সুস্পষ্ট আয়াতসমূহ এই রূপই। অন্যরূপ ভাষা হইতেছে আবরণযুক্ত ও নিহিত, যেন ঈর্ষাপরায়ণ জনসাধারণের অন্তরে যাহা গোপন করিয়া রাখা হইয়াছে, তাহা প্রকাশিত হইতে পারে এবং তাহাদের গুহ্যতম মর্মার্থ ব্যক্ত করিতে পারা যায়। এইরূপে, মোহাম্মদের পুত্র সাদেক বলিয়াছেনঃ “নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তাহাদিগকে পরীক্ষা করিবেন এবং চালুনী দ্বারা চালিয়া পৃথক করিয়া লইবেন।” ইহাই স্বর্গীয় মাপ-কাঠির নমুনা, ইহাই আল্লাহর স্পর্শমণি, যদ্দদ্বারা তিনি তাঁহার সেবকগণকে পরীক্ষা করেন। কেহই এই সকল উচ্চারিত বাণীর অর্থ উপলব্ধি করিতে পারে না, কেবল তাহারা ব্যতীত, যাহাদের অন্তর নিশ্চয়তাপূর্ণ, যাহাদের আত্মা আল্লাহর অনুগ্রহপ্রাপ্ত হইয়াছে এবং যাহাদের মন তিনি ব্যতীত অন্য সকল হইতে বিচ্ছিন্ন। এইরূপে উচ্চারিত বাণীসমূহের আক্ষরিক অর্থ মনস্থ করা হয় নাই, যাহা সাধারণ লোকেরা সচরাচর উপলব্ধি করিয়া থাকে। এইরূপে ইহা লিপিবদ্ধ করা হইয়াছেঃ “প্রত্যেক জ্ঞানের সত্তরটি অর্থ আছে, যাহার মধ্য হইতে জনসাধারণ কেবল একটিমাত্র অর্থ অবগত আছে। এবং যখন ক্বায়েম অভ্যুত্থান করিবেন, তিনি লোকের নিকট অবশিষ্ট অর্থগুলি প্রকাশ করিবেন।” তিনি আরও বলেনঃ “আমরা একটি বাক্য বলি, এবং তদ্দদ্বারা আমরা একাত্তরটি অর্থ প্রত্যাশা করিয়া থাকি; ইহাদের প্রত্যেকটির অর্থ আমরা ব্যাখ্যা করিতে পারি।”
এই সমুদয় বিষয় আমরা কেবল এই জন্যই উল্লেখ করিতেছি, যেন জনসাধারণ কতকগুলি হাদীস ও উচ্চারিত বাক্যের কারণে ভীত ও সন্ত্রস্ত না হয়, যে-গুলি এখনও আক্ষরিকভাবে পূর্ণ হয় নাই , যেন তাহারা তাহাদের উপলব্ধির অপারগতা এবং তাহাদের নিজেদের ব্যকুলতার প্রতি আরোপ করিতে পারে, এবং হাদীসসমূহের অন্তর্গত ভবিষ্যদ্বাণীগুলির অসম্পূর্ণতার প্রতি আরোপ না করে, কারণ, যেমন স্বয়ং হাদীসসমূহের দ্বারাও প্রমাণিত হয়, ধর্মের ইমামগণ কর্তৃক যে অর্থ অভিপ্রেত ছিল, তাহা ইহাদের জানা নাই। সুতরাং জনসাধারণের কখনও উচিত নহে যে, তাহারা এই সকল উচ্চারিত বাক্য দ্বারা আপনাদিগকে স্বর্গীয় বদান্যতাসমূহ হইতে বঞ্চিত করে, বরং তাহারা ঐ সকল ব্যক্তির নিকট হইতে আলোকপ্রাপ্তি অনুসন্ধান করিবে, যাঁহারা ইহাদের স্বীকৃত ব্যাখ্যাদাতা, যেন নিহিত রহস্যাবলীর উদ্ধার করিতে পারা যায় এবং তাহাদের নিকট সুস্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়।
যাহা হউক, পৃথিবীর জনগণের মধ্যে আমরা কাহাকেও দেখিতে পাইতেছি না, যে সত্যের জন্য সত্য সত্যই ব্যাকুল হইয়া জটিল বিষয়াদির সম্বন্ধে স্বর্গীয় প্রকাশগণের পথ-প্রদর্শন অনুসন্ধান করে। সকলেই বিস্মৃতি রাজ্যের অধিবাসী, এবং সকলেই দুষ্ট-প্রকৃতির ও বিদ্রোহী লোকদের অনুসরণকারী। আল্লাহ্ নিশ্চয়ই তাহাদের প্রতি ঐরূপ ব্যবস্থা করিবেন, যেরূপ তাহারা স্বয়ং অন্যের প্রতি ব্যবস্থা করিতেছে এবং তাহাদিগকে ভুলিয়া যাইবেন, যেরূপ তাহারা তাঁহার দিনে তাঁহার সাক্ষাৎকার লাভ অস্বীকার করিয়াছে। যাহারা তাঁহাকে অস্বীকার করিয়াছে, তাহাদের প্রতি তাঁহার এইরূপই ব্যবস্থা এবং যাহারা তাঁহার নিদর্শনসমূহ প্রত্যাখ্যান করিয়াছে, তাহাদের প্রতিও এইরূপ ব্যবস্থা হইবে।
আমরা আমাদের বিতর্ক তাঁহার এই বাক্যাবলীর সহিত পরিসমাপ্তি করিতেছি—তিনিই মহীয়ান্ঃ “যে-কেহ করুণাময়ের স্মৃতি হইতে নিজেকে ফিরাইয়া লয়, আমরা তাহার সহিত একজন শয়তানের প্রকৃতির লোককে শৃঙ্খলাবদ্ধ করিব, এবং সে তাহার অন্তরঙ্গ সঙ্গী হইবে।” (ক্বোরআন ৪৩।৩৬)। “এবং যে-কেহ আমার স্মরণ হইতে মুখ ফিরাইয়া লয়, নিশ্চয়ই তাহার জীবন দুর্দশাগ্রস্ত হইবে।” ( ক্বোরআন ২০।১২৪)।
পূর্ববর্তী সময়ে এইরূপেই অবতীর্ণ হইয়াছে। (“বা” ও “হা” অর্থ বাহা’ অর্থাৎ বাহা‘উল্লাহ)। তাহার প্রতি শান্তি বর্ষিত হউক, যে সেই সুমধুর গীতির প্রতি কর্ণপাত করে, যদ্বারা আধ্যাত্মিক বিহঙ্গম তাহাকে স্বর্গীয় সিদ্রাতুল মোন্তাহা হইতে সুমধুর সুরে আহ্বান করিতেছে। আমাদের মহামহীয়ান্ প্রভূ মহিমান্বিত হউন।
সমাপ্ত