Return   Facebook   Zip File

মানবজাতির ক্রমবিকাশে বার্তাবাহকদের প্রভাব

1
বিশ্ব প্রকৃতি এক সার্বজনীন নিয়মের দ্বারা পরিচালিত

প্রকৃতি হচ্ছে সেই অবস্থা, সেই বাস্তবতা, যা বাহ্যত; জীবন ও মৃত্যুতে, বা অন্য কথায়, পদার্থসমূহের সংযোজন ও বিয়োজনে নিহিত।

এই প্রকৃতি একটি অপরিবর্তনীয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, নির্ধারিত নিয়ম, পূর্ণাঙ্গ শৃঙ্খলা ও সুসম্পাদিত পরিকল্পনার অধীন, যা থেকে এটা কখনই স্বতন্ত্র ও স্বাধীন হতে পারে না। বস্তুতঃ এটা এতই নিয়মাধীন যে, যদি মনোযোগ পূর্বক ও সুদৃষ্টি সহকারে ক্ষুদ্রতম অণু-পরমাণু থেকে আরম্ভ করে সূর্যমণ্ডল বা অপর কোন বিশাল তারকামণ্ডল ও জ্যোতিমণ্ডল প্রভৃতি অস্তিত্ব জগতের বৃহদাকার পিন্ডসমূহ নিরীক্ষণ করা হয়, এমনকি তাদের শৃঙ্খলা সংযোজন, আকার অথবা সঞ্চরণ পর্যবেক্ষণ করলে দেখতে পাওয়া যায় এরা সকলেই সর্বোচ্চ সু-শৃঙ্খলায় সন্নিবিষ্ট এবং একই নিয়মের অধীন, যা থেকে এরা কেউ কখনো স্বাধীন হতে পারে না।

কিন্তু তুমি যখন জড় প্রকৃতির দিকে দৃষ্টিপাত কর, তখন তুমি দেখতে পাও যে, এর কোন জ্ঞান নেই, এর কোন ইচ্ছা শক্তি নেই। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে যে, অগ্নির প্রকৃতি হচ্ছে দহন করা এটা ইচ্ছা কিংবা জ্ঞান ব্যতীত দহন করে; জলের প্রকৃতি প্রবাহিত হওয়া, এটা ইচ্ছা কিংবা জ্ঞান বিহীন প্রবাহিত হয়; সূর্যের প্রকৃতি উজ্জ্বল হওয়া, এটা ইচ্ছা কিংবা জ্ঞান ব্যতীত উজ্জ্বল কিরণ বিতরণ করে; বাষ্পের প্রকৃতি উপরের দিকে উত্থিত হওয়া, এটা ইচ্ছা কিংবা জ্ঞান ব্যতীতই উর্ধ্বে উত্থিত হয়। তাহলে এটা সুস্পষ্ট হর যে বস্তু জগতের স্বাভাবিকত গতিবিধি বাধ্যতামূলকভাবে হয়ে থাকে। জীব সাধারণ, বিশেষতঃ মানুষ ব্যতীত অপর কোন বস্তুরই বিচরণে স্বাধীনতা নেই। কেবলমাত্র মানুষই প্রকৃতিকে প্রতিরোধ করতে পারে এবং এর প্রতিকূলতা করতে সক্ষম, কারণ মানুষ সকর বস্তুর গঠন প্রণালী আবিষ্কার করতে পারে, এবং এই আবিষ্কারের মাধমে প্রকৃতির শক্তিসমূহের উপর আধিপত্য করে; সে যে সমুদয় নতুন আবিষ্কার করেছে, বস্তুতঃ বস্তুসমূহের উপাদান নিয়েই সেটা সম্ভবপর হয়েছে। এর একটি দৃষ্টান্ত দিয়ে বলা যায়, সে টেলিগ্রাম আবিষ্কার করেছে, এটা দ্বারা পূর্ব-পশ্চিম দেশসমূহের মধ্যে সংবাদ বিনিময়ের উপায় হয়েছে। সুতরাং এটা সুস্পষ্ট হল যে মানুষ প্রকৃতির উপর আধিপত্য করে।

এখন, যখন তুমি সৃষ্ট জগতে এরূপ শৃঙ্খলা, বিধিব্যবস্থা ও নিয়মবিধি অবলোকন কর, তখন কি তুমি এটা বলতে পার যে, এই সকলই প্রকৃতির প্রভাবে রয়েছে? যদিও প্রকৃতির কোন জ্ঞান বা উপলব্ধি শক্তি নেই। যদি তা না হয়, তাহলে এটা প্রমাণিত হল যে, এই প্রকৃতি, যার কোন উপলব্ধি বা বোধ শক্তি নেই, এটা সেই সর্বশক্তিমান আল্লাহরই আজ্ঞাধীন, যিনি প্রকৃতি জগতের শাসনকর্তা; বা তাঁর ইচ্ছা, প্রকৃতি দ্বারাই তিনি তা করিয়ে নেন।

এই অস্তিত্ব জগতে যা কিছুই আবির্ভূত হয়েছে, তার মধ্যে একটির জন্য প্রকৃতির বিশেষ আবশ্যকতা রয়েছে, সেটা হচ্ছে মানব জীবন। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা কররে দেখা যায় যে, মানুষ শাখা বিশেষ, আর প্রকৃতি মূল বা শিকড়; তাহলে, যে ইচ্ছা শক্তি, বোধ শক্তি এবং পূর্ণতা শাখাতে রয়েছে, সেটা কি মূলে বা শিকড়ে না থাকতে পারে?

সুতরাং সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত হল যে, প্রকৃতি তার স্বীয় স্বভাবে ঐশী মুক্তির আয়ত্বাধীন, যিনি সর্বশক্তিমান সনাতন প্রভু। তিনি প্রকৃতিকে সঠিক বিধি-ব্যবস্থা ও নিয়মের অধীনে ধারণ করে তার উপর আধিপত্য করেন।

2
আল্লাহ্র অস্তিত্বের প্রমাণ ও সাক্ষ্যসমূহ

মানুষ যে নিজেকে নিজে সৃষ্টি করি নাই, শুধু তাই নয়, তার সৃষ্টিকর্তা ও তার পরিকল্পনাকারী সে নিজে ব্যতীত আর একজন, এটাই আল্লাহর অস্তিত্বের একটি প্রমাণ ও নিদর্শন।

এটা নিশ্চিত ও অবধারিত যে, মানুষের সৃষ্টিকর্তা মানুষের সদৃশ নয়, কারণ একজন শক্তিহীন সৃষ্ট জীব আর একটি জীবের সৃষ্টি করতে পারে না। সৃষ্টিকারী তথা সৃষ্টিকর্তাকে সকল সর্ম্পণূতার অধিকারী হতে হবে, যাতে সে সৃষ্টি করতে পারে।

এটা কি হতে পারে যে, সৃষ্টি পূর্ণাঙ্গ সম্পন্ন এবং সৃষ্টিকর্তা অপূর্ণাঙ্গ তথা অসম্পূর্ণ? এটা কি সম্ভব হতে পারে যে, একটি চিত্র নৈপুণ্যে সর্বোৎকৃষ্ট এবং চিত্রকর তার শিল্পে অনিপুণ? অধিকন্তু, চিত্র-চিত্রকরের ন্যায় হতে পারে না, কেননা তাহলে চিত্র নিজেকে নিজে সৃষ্টি করতে পারত। একটি চিত্র যতই সম্পূর্ণ হোক না কেন, চিত্রকরের তুলনায় এটা অসম্পূর্ণতার চূড়ান্ত অবশেষ।

কোন কিছু ঘটবার সম্ভবনা সাপেক্ষ পৃথিবী অসম্পূর্ণতার উৎপত্তি স্থল। আল্লাহ্ সম্পূর্ণতার আদি কারণ। এই জড় জগতের অসম্পূর্ণতাই আল্লাহর পূর্ণতার নিদর্শন।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, যখন তুমি মানুষের দিকে লক্ষ্য কর, তখন তুমি বুঝতে পার যে সে সহায়হীন-দুর্বল। এই অসমর্থ জীবের দুর্বলতাই সর্বশক্তিমান শাশ্বত এক আল্লাহর শক্তি সামর্থের প্রমাণ। কারণ যদি সামর্থ না থাকতো, তাহলে দুর্বলতাই কল্পনা করা যেত না। সুতরাং সৃষ্ট জীবের দুর্বলতা, ঐশী শক্তির এক নিদর্শন। কারণ যদি শক্তি না থাকতো, তাহলে সমর্থহীনতাও থাকতো না। সুতরাং এই শক্তিহীনতা থেকে এটা প্রমাণিত হয় যে, জগতে শক্তি বিরাজ করছে। পুনশ্চঃ এই পার্থিব জগতে দরিদ্র আছে, সুতরাং অপরিহার্যরূপে সম্পদও রয়েছে; জ্ঞানও অপরিহার্যরূপে বিদ্যমান, যেহেতু অজ্ঞতা দৃষ্ট হয়; কারণ যদি কোন জ্ঞান না থাকতো, অজ্ঞতাও থাকতো না। জ্ঞানের অনস্তিত্বই অজ্ঞতা এবং যদি অস্তিত্ব না থাকতো, তবে অনস্তিত্বের উপলব্ধি হত না।

এটা অনিশ্চিত যে, সমগ্র সাপেক্ষ বিশ্ব জগত একই বিধান, একই নিয়মের দ্বারা পরিচালিত, যা এটা কখনো লঙ্ঘণ করতে পারে না; এমনকি মানুষও মৃত্যু, নিদ্রা ও অন্যান্য অবস্থার নিকট আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়; অর্থাৎ মানুষও কোন কোন বিশেষ বিষয়ে শাসিত হয় এবং শাসিতের জন্য একজন শাসনকর্তা অপরিহার্য। কারণ অধীনতা সৃষ্ট জীবের একটি বিশেষ লক্ষণ এবং এই অধীনতা এর একটি অপরিহার্য প্রয়োজনীয় শর্ত। সুতরাং এরূপ এক স্বাধীন সত্ত্বা হতে হবে, যার স্বাধীনতাও আবশ্যক। অনুরূপভাবে একজন পীড়িত লোককে দেখে বুঝতে পারা যায় যে একজন স্বাস্থ্যবান লোক নিশ্চয়ই আছে; কারণ যদি একজন স্বাস্থ্যবান না থাকতো তবে তার পীড়া প্রমাণ করা যেত না।

অতএব এটা অবগত হওয়া গেল যে, এক অদ্বিতীয় সর্বশক্তিমান শাশ্বত পুরুষ বিদ্যমান, যিনি সকল পূর্ণতার অধিকারী; কারণ তিনি যদি পূর্ণতার অধিকারী না হন, তাহলে তাঁকে তাঁর সৃষ্ট জীবের সমতুল্য হতে হবে।

অস্তিত্ব জগতের সর্বত্রই এই একই নিয়ম; ক্ষুদ্রতম সৃষ্ট বস্তু প্রমাণ করে যে, এর একজন স্রষ্টা রয়েছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ এই রুটিখণ্ড প্রমাণ করে যে, এর একজন প্রস্তুতকারী আছে।

প্রশংসা আল্লাহর! ক্ষুদ্রতম বস্তুর অনস্থার সামান্য পরিবর্তনেও এর নির্মাণকারীর অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়। অতএব এই বিশাল অস্তিত্ব জগত, যা অন্তহীন, তা কি নিজে নিজেই সৃষ্ট এবং পদার্থ ও পরমাণু ও উপাদাসমূহের কার্যক্রমে, অস্তিত্বে সমাগত হতে পারে? এরূপ অনুমান কতই না A™¢z` ভ্রান্তিপূর্ণ।

এই সমুদয় সুস্পষ্ট বিতর্ক দুর্বল চিত্তের জন্য উপস্থাপিত করা হয়; কিন্তু যদি তার আভ্যন্তরীণ পরমাত্মার উপলব্ধি খুলে যায়, তাহলে শত সহস্র সুস্পষ্ট প্রমাণ পরিলক্ষিত হয়। এইরূপে যখন মানুষ তার আত্মস্থ পরমাত্মাকে উপলব্ধি করে, তখন পরমাত্মার অস্তিত্বের প্রমাণের কোন আবশ্যকতা থাকে না। কিন্তু যারা পবিত্র পরমাত্মার প্রসাদ থেকে বঞ্চিত, বাহ্যিক যুক্তি তর্কের প্রয়োজন হয়ে থাকে।

3
একজন শিক্ষাদাতার প্রয়োজন

যখন আমরা অস্তিত্ব জগতের দিকে দৃষ্টিপাত করি, তখন আমরা বুঝতে পারি যে, খনিজ-উদ্ভিদ, প্রাণী-জগত ও মানব জগত, সকলেরই তাদের জন্য একজন শিক্ষাদাতার প্রয়োজন রয়েছে।

যদি জমি কর্ষিত না হয়, তবে তা জঙ্গলে পরিণত হয়ে অনাবশ্যক আগাছা উৎপাদন করে; কিন্তু যখন একজন বকৃষক এই জমি কর্ষণ করে, তখন এতে শষ্য উৎপাদিত হয়, যা জীব-জন্তুকে খাদ্যদানে পরিপুষ্ট করে। সুতরাং এতে সুস্পষ্ট বুঝতে পারা গেল যে, জমির চাষের জন্য একজন কৃষকের প্রয়োজন আছে। বৃক্ষগুলির দিকে লক্ষ্য কর যদি সেগুলির একজন তত্ত্বাবধায়ক (বা কৃষক) না থাকে তবে সেগুলি ফলবিহীন হবে এবং ফলবিহীন বৃক্ষ নিরর্থক; কিন্তু যদি সেগুলি একজন উদ্যানপালের যত্ন প্রাপ্ত হয়, তবে এই সমস্ত ফলহীন বৃক্ষ ফল প্রদায়ী বৃক্ষে পরিণত হয়, এবং কর্ষণ, সারযোগে উর্বরতা সাধন, কলম করে চাষ করলে তিক্ত ফলদায়ী বৃক্ষও মিষ্ট ফল ধারণ করে। এগুলি যুক্তিসঙ্গত প্রমাণ। এই যুগের লোকেরা যৌক্তিক প্রমাণেরই পক্ষপাতী।

জীব-জন্তু সম্বন্ধেও ঐ একই সত্য প্রযোজ্য। লক্ষ্য করে দেখ, পশুকে শিক্ষা দিলে পোষ মানে এবং মানুষকে যদি অশিক্ষিত রাখা হয়, তাহলে তার স্বভাব পশুবৎ হয় এবং যদি প্রকৃতির নিয়মাধীন রাখা হয়, তার স্বভাব পশু অপেক্ষাও ইতর হয়; পক্ষান্তরে শিক্ষার প্রভাবে সে স্বর্গীয় দূতে পরিণত হয়। কারণ অধিকাংশ পশু তাদের স্বজাতীকে ভক্ষণ করে না; কিন্তু মানবজাতির মধ্যে আফ্রিকার নিগ্রো জাতির লোকেরা তাদের পরস্পরকে হত্যা করে ভক্ষণ করে।

এখন ভেবে দেখ, শিক্ষাই পূর্ব ও পশ্চিমকে মানুষের আয়ত্বাধীনে এনেছে। শিক্ষাই অভাবনীয় শ্রমশিল্প উৎপাদন করে, শিক্ষাই গৌরবময় বিজ্ঞান ও শিল্পসমূহ বিস্তার করে; শিক্ষাই নতুন নতুন আবিষ্কার ও নব নব নিয়মাবলী প্রকাশ করে। মানুষের যদি কোন শিক্ষাদাতা না থাকতো তার সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, সভ্যতা, সুযোগ-সুবিধা, বা মানবতা কিছুই থাকতো না। যদি কোন মানুষকে বনভূমিতে একাকী ছেড়ে দেওয়া হয়, যেখানে সে নিজের জাতের কাউকে দেখতে পায় না; তাহলে এটা নিঃসন্দেহ যে, সে শুধু একটি পশুতেই পরিণত হবে। অতএব এটা সুস্পষ্ট যে, একজন শিক্ষাদাতার একান্ত প্রয়োজন রয়েছে।

কিন্তু শিক্ষা তিন প্রকারের: (১) ভৌতিক (২) মানবিক (৩) আধ্যাত্মিক। দেহের ক্রমবৃদ্ধি ও উন্নতি বিধায়ক শিক্ষাই হচ্ছে ভৌতিক শিক্ষা, যা দেহ রক্ষার উপজীবিকা, দৈহিক সুখ-স্বচ্ছন্দ্যে উপায় করে দেয়। এই শিক্ষা পশু ও মানুষ উভয়ের জন্য প্রয়োজনীয়।

মানবিক শিক্ষা মানব সভ্যতা ও প্রগতিকে বুঝায়: অর্থাৎ রাষ্ট্র শাসন, রাষ্ট্র পরিচালনা, দাতব্য কার্যাবলী, ব্যবসায়-বাণিজ্য, কলা বিদ্যা, হস্তশিল্প, বিজ্ঞান, প্রাকৃতিক নিয়মাবলীর উদ্ভাবন ও আবিষ্কার-এইসব প্রয়োজনীয় কার্যকলাপ পশু থেকে মানুষের বিশেষত্ব জ্ঞাপন করে থাকে।

আধ্যাত্মিক শিক্ষা হচ্ছে ঐশী পরম রাজ্যের শিক্ষা, যাতে স্বর্গীয় পরিপূর্ণতার গুণাবলী অর্জিত হয়, এটাই প্রকৃত শিক্ষা; কারণ এর দ্বারার মানুষ স্বর্গীয় আবির্ভাবের কেন্দ্রে পরিণত হয়- স্বয়ং “আমি মানুষকে আমার স্বরূপ ও সাদৃশ্যে স্বজন করিব”এই বাক্যের অভিব্যক্তি প্রাপ্ত হয়। মানব জগতের এটাই সর্বোচ্চ লক্ষ্য।

এখন আমাদের একজন শিক্ষাদাতার প্রয়োজন, যিনি একাধারে ভৌতিক, মানবিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষাদাতা হবেন, এবং যার কর্তৃত্ব সর্বাবস্থায় কার্যকরী হবে। সুতরাং যদি কোন লোক এরূপ বলেন, আমি পূর্ণধীশক্তি ও বোধশক্তির অধিকারী এবং ঐরূপ কোন শিক্ষাদাতার প্রয়োজন নেই তাহলে তিনি এই সুস্পষ্ট সত্য অস্বীকার করেন এবং এমন একজন বালকের মত কাজ করেন, যে বলে, “আমার কোন শিক্ষকের প্রয়োজন নেই, আমি আমার বিবেক বুদ্ধি ও বোধশক্তি অনুযায়ী কাজ করব, এইরূপে আমার অস্তিত্ব জীবনের পূর্ণতা লাভ করব; অথবা তিনি এইরূপ একটি অন্ধ লোকের সদৃশ বলতে পারে, “আমার দৃষ্টিশক্তির প্রয়োজন নেই, কেননা অনেক অন্ধ ব্যক্তি আছে যারা অনায়াসে বিনা কষ্টে জীবন-যাপন করছে।”

সুতরাং এটা সুস্পষ্ট প্রতীয়মান হল যে, একজন শিক্ষাদাতা তথা তত্ত্বাবধায়কের প্রয়োজন রয়েছে এবং এই শিক্ষাদাতাকে নিশ্চিত ও নিঃসন্দেহরূপে সর্ব বিষয়ে পূর্ণতাসম্পন্ন ও সর্বোপরি বিশেষ বৈশিষ্ট্যে ভূষিত হতে হবে। কেননা তা না হলে তিনি তাদের শিক্ষাদাতা হতে পারেন না এবং বিশেষভাবে তাঁকে একাধারে ভৌতিক, মানবিক এবং আধ্যাত্মিক শিক্ষাদাতা হতে হবে। অর্থাৎ তিনি মানুষের বাহ্য-বিষয়াদি সংগঠন ও সম্পাদন করতে ও জীবনে সাহায্য-সহযোগিতা প্রতিষ্ঠাকল্পে সমাজের বিন্যাস প্রণালী নিয়ন্ত্রণ করে শিক্ষা দেবেন, যাতে পার্থিব বিষয় কর্ম সর্বাবস্থায় সুব্যবস্থিত ও সুনিয়ন্ত্রিত হতে পারে। এই একই প্রকারে তিনি মানবিক শিক্ষাও প্রতিষ্ঠিত করবেন; অর্থাৎ মানবের বোধশক্তি ও চিন্তা-ধারাকে এইরূপ শিক্ষা দ্বারা প্রভাবায়িত করবেন, যাতে এটা পরিপূর্ণরূপে পরিবর্তিত হয়, যেন জ্ঞান-বিজ্ঞান উন্নতি লাভ করে, জগতের বাস্তব সত্যের তথ্য, প্রাণী জগতের রহস্যাবলী এবং অস্তিত্ব জগতের গুণ-ধর্মাবলী আবিষ্কৃত হয়; যেন শিক্ষা-দীক্ষা, উদ্ভাবন, আইন-কানুন দিন দিন বৃদ্ধি পেতে পারে। এবং যেন মানব শক্তি ইন্দ্রিয়ানুভূতি থেকে বিবেক-বুদ্ধির দিকে অগ্রবর্তী হয়ে সত্য সিদ্ধান্তে উপনিত হতে পারে।

তাঁকে আধ্যাত্মিক শিক্ষাদাতা হতে হবে, যাতে মানুষের ধীশক্তি ও বোধ শক্তি অধি বিদ্যার জগতের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে পারে এবং বস্তু জগতের উর্ধ্বে উঠতে পারে এবং পবিত্র পরমাত্মার পবিত্রকারী সমিরণ থেকে ঐশী বদান্যতা লাভ করতে পারে এবং সর্বোচ্চ জনমণ্ডলীর সহিত সম্পর্কযুক্ত হতে পারে। তিনি মানবের অন্তর্নিহিত সত্ত্বাকে এরূপভাবে শিক্ষিত করবেন, যেন এটা স্বর্গীয় আবির্ভাবের কেন্দ্র হয়- এই পরিমাণে হয় যেন এর মুকুটে ঐশী নাম এবং গুণাবলী দীপ্তিমান হয় এবং “আমি মানবকে আমার স্বরূপ ও সদৃশ্যে স্বজন করিব”এই পবিত্র শ্লোক বাস্তবে পরিণত হয়।

এটা সুস্পষ্ট সত্য যে, মানব শক্তি এরূপ একটি মহান কার্যভার গ্রহণ করতে পারে না এবং শুধু বিবেক বুদ্ধি এই গুরুত্বপূর্ণ কার্যের দায়িত্ব গ্রহণে অক্ষম। কিরুপে এক ব্যক্তি একাকী, নিঃসহায় ও নিঃসম্বল, এইরূপ মহন সর্বোচ্চ ভিত্তির প্রতিষ্ঠা করতে পারেন? নিশ্চয়ই এইরূপ মহান কার্যের সমাধানে তাঁকে আধ্যাত্মিক ও ঐশী শক্তির সাহায্যের উপর নির্ভর করতে হবে। এক পবিত্র আত্মা পুরুষ মানব জগতে প্রাণদান করেন, পার্থিব জগতের যাবতীয় অবস্থার পরিবর্তন করেন, বোধশক্তির উন্নতি বিধান করেন, জীবাত্মাকে সঞ্জীবিত করেন, এক অভিনব জীবন ধারার ভিত্তি স্থাপন করেন, এক বিস্ময়কর (অলৌকিক) সৃষ্টির বুনিয়াদ স্থাপন করেন (এক নব বিধান প্রবর্তিত করেন), পৃথিবীকে সুব্যবস্থিত করেন, জাতি ও ধর্মসমূহকে একই পতাকার ছায়াতলে সম্মিলিত করেন, অসম্পূর্ণ (ÎæwU wewkó)দোষদুষ্ট সংসারের বন্ধন হইতে মানবগণকে উদ্ধার করেন এবং তাদের স্বাভাবিক ও চেষ্টাসাধ্য পূর্ণতা অর্জনের প্রয়োজনীয়তা ও আগ্রহের দ্বারা তাদেরকে অনুপ্রাণিত করেন। নিশ্চয়ই ঐশী শক্তি ব্যতীরেকে অন্য কোন উপায়ে এরূপ মহান কার্য সম্পাদিত হতে পারে না। ন্যায় বিচার সহকারে আমাদের এই বিষয় বিবেচনা করা উচিত, কারণ এটাই ন্যায়বিচারের কাজ। একটি ধর্ম, যা পৃথিবীর সকল শাসনযন্ত্র তথা সরকার এবং জাতিসমূহ তাদের সমগ্র শক্তি ও সেনাবাহিনী সহকারে প্রচার ও বিস্তার করতে অসমর্থ, এক পবিত্র পুনাত্মা-পুরুষ, নিঃসম্বল, নিঃসহায়ভাবে সেটা করতে সক্ষম। এটা কি কখনো মানবীয় শক্তিতে সম্ভব? আল্লাহ্র নামে শপথ করে বলছি এটা কখনো সম্ভব নয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যেতে পারে, যীশুখ্রিষ্ট নিঃসঙ্গ ও একাকী, ন্যায়পরতা ও শান্তির পতাকা উত্তেলন করেছিরেন যা পরাক্রান্ত রাষ্ট্রগুলি তাদের বিশাল সেনাবাহিনী সহকারে সম্পন্ন করতে অসমর্থ ছিল। ভেবে দেখ, কতই না বিভিন্ন জাতি ও রাষ্ট্র ছিল, যেমন- রোমীয় সাম্রাজ্য, ফ্রান্স, জার্মান, রুশ, ইংরেজ ও অপরাপর জাতি। তাদের সকলেই একই পটমণ্ডপের ছায়াতলে সমবেত হয়েছিল; অর্থাৎ যীশুখ্রিষ্টের আবির্ভাবে এই সমুদয় বিভিন্ন জাতির মধ্যে একতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তাদের মধ্যে কতক খ্রিষ্টান ধর্মের প্রভাবে পরস্পরের মধ্যে এইরূপ একতাবদ্ধ হয়েছিল যে, তারা একে অন্যের জন্য জীবন ও সর্বস্য উৎসর্গ করেছিল। খ্রিষ্টধর্মের প্রধান নায়ক কনস্টাইনের মৃত্যুর পরে তাদের মধ্যে দলাদলি সৃষ্টি হয়েছিল। আমি এটাই বলতে চাচ্ছি যে, যীশুখ্রিষ্ট এমন একটি মহৎ কার্য সম্পাদন করেছেন যা পৃথিবীর সম্রাটগণ সম্মিলিতভাবে করতে সমর্থ হয় নাই। তিনি সকল ধর্মসম্প্রদায়কে সম্মিলিত করেছেন এবং পুরাতন প্রথাসমূহের সংস্কার সাধন করেছেন। ভেবে দেখ, রোমীয়, গ্রীক, সিরীয়, মিসরীয়, ফিনিসীয়, ইসরায়েলদের এবং ইউরোপের অন্যান্য জাতির মধ্যে কত ভেদাভেদ বিদ্যমান ছিল। যীশুখ্রিষ্ট এই সকল ভেদ-বিভেদ বিদূরীত করেছিলেন এবং এইসকল ধর্মসম্প্রদায়ের মধ্যে প্রেম-প্রীতির কারণ হয়েছিলেন, কিন্তু যীশুখ্রিষ্টের কর্তব্য-কাজ পূর্বেই সম্পাদিত হয়েছিল।

অত্রএব এই সার্বজনীন শিক্ষাদাতা শুধু ঐহিক বিষয়ে শিক্ষাদাতা হবেন- এরূপ নয়, তাঁকে সঙ্গে সঙ্গে মানবিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষাদাতা হতে হবে; এবং তাঁকে অলৌকিক শক্তির অধিকারী হতে হবে, যেন তিনি স্বর্গীয় শিক্ষাদাতার পদবী ধারণ করতে পারেন। যদি তিনি এরূপ পবিত্র শক্তি প্রদান করতে অক্ষম হন, তাহলে তিনি শিক্ষা দিতে সমর্থ হবেন না, কারণ তিনি যদি পূর্ণতাবিহীন হন, তাহলে কিরূপে তিনি পূর্ণ শিক্ষাদান করবেন? যদি তিনি নিজে অজ্ঞ হন তাহলে কিরূপে তিনি অপরকে জ্ঞানবান করবেন? তিনি যদি অন্যায়কারী হন, তবে কিরূপে তিনি অন্য লোককে ন্যায়পরায়ণ করবেন? তিনি যদি সংসারাক্ত না হন তবে কিরূপে তিনি স্বর্গীয় লোকে পরিণত করবেন?

এখন আমাদের ন্যায়সঙ্গতভাবে বিবেচনা করতে হবে: যে সমস্ত ঐশী প্রকাশগণ পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছেন, তাদের সকলেই কি এই সমুদয় গুণাবলীর অধিকারী ছিলেন কি না? তারা যদি এই সকল গুণাবলী ও পরিপূর্ণতার অধিকারী না হয়ে থাকেন, তাহলে তারা প্রকৃত শিক্ষাদাতা ছিলেন না।

সুতরাং এটা আমাদের অবশ্য কর্তব্য হবে, যেন আমরা চিন্তাশীল ব্যক্তিগণের নিকট যুক্তিতর্ক সহকারে মুসা, যীশুখ্রিষ্ট, ও অন্যান্য ঐশী প্রকাশগণের প্রেরিত তত্ত্বের সত্যতা প্রমাণ করি এবং সাক্ষ্য প্রমাণ, যা আমরা উপস্থিত করব তার ভিত্তি হবে বিবেক বুদ্ধি অনুমোদিত যুক্তি তর্ক, কিম্বদন্তীর উপর নির্ভরশীল হবেন।

এখন বিবেক বুদ্ধি দ্বারা এটা প্রমাণিত হর যে, এই অস্তিত্ব জগতে একজন শিক্ষাদাতার প্রয়োজন রয়েছে এবং যে শিক্ষাই তিনি প্রদান করেন সেটা ঐশী শক্তি সহকারে সম্পন্ন হয়ে থাকে। এতে কোন সন্দেহ নাই যে এই পবিত্র ঐশী শক্তি প্রেরণামূলক এবং মানবীয় শক্তির অতীত এই পবিত্র ঐশী শক্তির দ্বারাই মানব জাতিকে শিক্ষা দিতে হবে।

4
ইব্রাহিম

যারা এই সমস্ত শক্তির অধিকারী ছিলেন এবং পবিত্র ঐশী শক্তির সাহায্য প্রাপ্ত হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন ইব্রাহিম। তিনি দুই নদীর মধ্যবর্তী দেশে এবং যে পরিবারের লোকেরা আল্লাহ্র একত্ব সম্বন্ধে অজ্ঞ ছিল, সেই পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি তাঁর জাতির এবং লোকজনদের এমনকি তাঁর নিজের পরিবারের লোকদের- সবার দেব-দেবীর প্রত্যাখ্যান করে তাদের বিরোধিতা করেন। বিনা সাহায্যে একাকী তিনি এক শক্তিশালী জাতিকে বাধা দেন- যে কাজ ছিল না সাধারণ, না ছিল সহজ,। এটা যেন এই যুগে বাইবেল এ অনুরক্ত একদর খ্রিষ্টান লোকদের কাছে কেউ যেয়ে অস্বীকার করছে; অথবা আমি আল্লাহ্র কাছে ক্ষমা চাচ্ছি, পোপের দরবারে এইরূপ কেউ জনগণের বিরোধী হয়ে প্রচণ্ডভাবে যিশুর বিরুদ্ধে নিন্দাবাদ উচ্চারণ করছে- এইরূপ মারাত্মক ধরনের কাজের সামিল।

এই সমস্ত লোক “এক আল্লাহ্”বিশ্বাস করতো না কিন্তু বহু দেবতায় বিশ্বাসী ছিল। দেবতাদের উপর তারা অলৌকিকত্ব আরোপ করতো; সুতরাং তারা সকলেই তাঁর বিরুদ্ধে রুখে দাড়াল, তাঁর ভাইয়ের ছেলে লুত ও অন্যান্য দুই একজন গুরুত্ববিহীন লোক ছাড়া আর কেউ তাঁকে সমর্থন করল না। তাঁর kÎæ‡`i বিরোধীতার চরমভাবে পর্যুদস্ত হয়ে অবশেষে তিনি স্বদেশভূমি ত্যাগ করতে বাধ্য হলেন। পকৃতপক্ষে তাঁকে তারা নির্বাসিত করল যাতে তিনি ছিন্নভিন্ন অথবা ধ্বংস হয়ে যান, যাতে তাঁর কোন নাম-নিশানা না থাকে।

ইব্রাহিম তখন পবিত্রভূমির জনপথে এলেন। তাঁর kÎæiv মনে মনে ভাবল যে তাঁর এই নির্বাসন তাঁবে ধ্বংস ও বিনাশের দিকে নিয়ে যাবে, কারণ ধরে নেওয়া যায় যে, চারদিক থেকে নির্যাতিত, অধিকার থেকে বঞ্চিত, স্বদেশ থেকে নির্বাসিত এক ব্যক্তি- তিনি যদি রাজাও হন, তাহলেও তার ধ্বংস অনিবার্য। কিন্তু ইব্রাহিম শক্ত হয়ে দাড়ালেন এবং অলৌকিক দৃঢ়তা প্রদর্শন করলেন এবং আল্লাহ তাঁর এই নির্বাসনকে তাঁর শাশ্বত সম্মানস্বরূপ করলেন, কারণ বহু দেবশাসক বংশধরদের মধ্যে তিনি আল্লাহর একত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর নির্বাসনের ফলস্বরূপ ইব্রাহিমের বংশধরগণ খুব শক্তিশালী হয়েছিলেন এবং উক্ত পবিত্রভূমি তাদেরকে দেওয়া হয়েছিল। ফলে ইব্রাহিমের ধর্মীয় শিক্ষা বিদেশে প্রসার লাভ করে, তাঁর ভাবীবংশে ইয়াকুবের ন্যায় ঐশীপুরুষ আবির্ভূত হন এবং তাঁর esk™¢z` ইউসুফ মিশরের শাসনকর্তা হন। তাঁর নির্বাসনের ফলস্বরূপ তাঁর ভাবীবংশে মুসা, যিশুখ্রিষ্টের মত পুরুষ আবির্ভূত হন এবং উক্ত বংশে হাজরা থেকে ইসমাইল জন্মগ্রহণ করেন, যার বংশধরদের একজন ছিলেন মুহাম্মদ। তাঁর নির্বাসনের ফলস্বরূপ তাঁর ভাবী বংশ থেকে বা’ব আবির্ভূত হন এবং ইসরায়েলের পয়গম্বরগণ ইব্রাহিমের বংশধরদের অন্তর্ভূক্ত এবং এইভাবে এটা বরাবর চলতে থাকবে। ভেবে দেখ, কি সেই শক্তি যা এইরূপ শিক্ষা-দীক্ষা প্রচার করতে, এইরূপ ধর্ম প্রতিষ্ঠা করতে , এইরূপ একটা পরিবারকে প্রতিষ্ঠা করতে- নিজের দেশ থেকে পলাতক এক ব্যক্তিকেব সমর্থ করেছিল? কেউ কি বলতে পারে যে এটা দৈবক্রমে ঘটেছিল? আমাদের অবশ্যই ন্যায়পরায়ণ হতে হবে। এই ব্যক্তি কি একজন শিক্ষাদাতা ছিলেন কি ছিলেন না? সিরিয়ার উর থেকে আলেপ্প পর্যন্ত ইব্রাহিমের নির্বাসন এই ফল দান করেছিল। আমাদের অবশ্যই ভেবে দেখতে হেব, তেহরান থেকে বাগদাদ, সেখান থেকে কনস্টান্টিনোপলে, রুমালিয়ায় এবং পবিত্রভূমিতে বাহা’উল্লাহ্র পর্যায়ক্রমিক কয়েকবার নির্বাসনের ফল কি হবে ?

ভেবে দেখ কি পরিপূর্ণ তথা পূর্ণাঙ্গ শিক্ষাদাতা ছিলেন ইব্রাহিম।

5
মুসা

বহুদিন যাবত মুসা ছিলেন মরুভূমিতে একজন মেষপালক। বাহ্যিকভাবে বিবেচনা করলে দেখা যায় তিনি এক অত্যাচারী পরিবারে লালিত-পালিত এক ব্যক্তি এবং জনসমক্ষে একজন খুনিরূপে চিহ্নিত। সরকার এবং ফেরাউনের লোকজন তাঁকে খুবই ঘৃণা করতেন।

এইরূপ এক ব্যক্তিই বন্দীত্বের শৃঙ্খল থেকে এক মহান জাতিকে মুক্ত করে তাদেরকে পরিতৃপ্ত করেন, মিশর থেকে বের করে আনেন, এবং তাদেরকে পবিত্র ভূমিতে পরিচালনা করেন। এই জনসমষ্টি অধঃপতনের অতল গহ্বর থেকে মুক্ত হয়ে গৌরবের উচ্চ শিখরে উন্নীত হয়। তারা ছিল বন্দী, তারা হল মুক্ত, জনমণ্ডলীর মধ্যে তারা ছিল সর্বাপেক্ষা অজ্ঞ, তারা হল সর্বাপেক্ষা বিজ্ঞ। মুসা তাদের যে বিধি-ব্যবস্থা প্রদান করেছিলেন , তার ফলে তারা এমন এক সামাজিক পদমর্যাদা লাভ করে যা সমগ্র জাতিসমূহের মধ্যে তাদেরকে সম্মানের অধিকারী করে এবং তাদের সুনাম সমগ্র দেশে ছড়িয়ে পড়ে। বাস্তবিকই তাদের খ্যাতি এইরূপ পরিমাণে বিস্তার লাভ করে যে, চতুর্দিকস্থ জাতিসমূহের মধ্যে যদি কেউ কোন লোককে প্রশংসা করতে ইচ্ছা করতো তবে বলতো “সত্যিই সে একজন ইসরায়েল”মুসা ধর্মীয় আইন ও দেওয়ানী আইন প্রনয়ণ করেন। এইগুলিই ইসরায়েলের জনগণের জীবন দান করে এবং তাদেরকে সেই সময়ে সভ্যতার সর্বোচ্চ স্তরে পরিচালনা করে।

এইরূপ উন্নতি তারা লাভ করল যে, গ্রীসের সুবিজ্ঞ ব্যক্তিগণ, ইসরায়েলের প্রসিদ্ধ ব্যক্তিদের পূর্ণতার নমনাস্বরূপ বিবেচনা করতেন। এইরূপ একজন ছিলেন সক্রেটিস, যিনি সিরিয়া দর্শন করতে আসেন এবং ইসরায়েলী সন্তানদের কাছ থেকে আল্লাহ্র একত্ব ও আত্মার অমরত্মের শিক্ষা লাভ করেন। গ্রীসে প্রত্যাবর্তনের পর তিনি এই শিক্ষা-বাণী ঘোষণা করেন। পরবর্তীকালে গ্রীসের জনগণ তার বিরুদ্ধে রুখে দাড়ায়, অধর্মের অবিযোগে অভিযুক্ত করে, বিচারের জন্য তাকে এ্যারিও পেগাসের সম্মুখে হাজির করে এবং বিষ প্রয়োগে মৃত্যুদন্ডে দণ্ডিত করে।

এখন কেমন করে একটা লোক, যিনি তোতলা ছিলেন, যিনি ফেরাউনের ঘরে লালিত-পালিত হয়েছিলেন, যিনি জনমণ্ডলীর মধ্যে খুনি বলে চিহ্নিত ছিলেন, যিনি ভয়ে বহুদিন ধরে লুকিয়ে ছিলেন এবং যিনি একজন মেষপালন ছিলেন- এইরূপ একটি মহান ধর্ম প্রতিষ্ঠা করেন। যখন বিশ্বের বিজ্ঞতম দার্শনিকেরা এই ক্ষমতার হাজার ভাগের এক ভাগও দর্শন করতে পারেন নাই। এটা বাস্তবিকই একটি অলৌকিক ব্যাপার।

তোতলামো-রসনা বিশিষ্ট একটি লোক যিনি শুদ্ধরূপে কথাবার্তা বলতে পারতেন না এরূপ একটি বিরাট ধর্ম প্রতিষ্ঠায় কৃতকার্য হলেন। যদি তিনি স্বর্গীয় শক্তি দ্বারা সাহায্যপ্রাপ্ত না হয়ে থাকতেন, তাহলে তিনি কিছুতেই এই বিরাট কাজ সাধন করতে পারতেন না। এই ঘটনাবলী অনস্বীকার্য। বিজ্ঞানীগণ, গ্রীক দার্শনিকগণ, রোমের বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ পৃথিবীতে খ্যাতি লাভ করেছিলেন, তাদের প্রত্যেকে জ্ঞানের মাত্র একটি শাখায় বিশেষজ্ঞ ছিলেন। এ মতে গ্যালেন ও হিপোক্রিটস চিকিৎসা বিদ্যায়, এ্যারিষ্টটেল যুক্তি বিদ্যায় এবং প্লাটো নীতিশাস্ত্র ও ধর্মতত্ত্বে ব্যুৎপত্তি হয়েছিলেন। কি করে এটা সম্ভব যে একজন মেষপালক এই জ্ঞানের সবগুলি আয়ত্ব করতে পেরেছিলেন, নিঃসন্দেহে তিনি একজন সর্বশক্তিমানের শক্তি দ্বারা সাহায্যপ্রাপ্ত হয়ে থাকবেন।

গভীরভাবে আরো চিন্তা কর, মানুষের দুঃখ-কষ্টের উদ্ভব হয়েছিল কি নিদারুণ। wbôziZvi একটি কাজ প্রতিহত করতে মুসা একজন মিশরীয়কে আঘাত করেন এবং পরে তিনি জনমণ্ডলীর মধ্যে খুনি বলে চিহিৃত হন; বলতে কি খুনীরূপ অধিকতর প্রসিদ্ধ লাভ করেন, কেননা যে লোকটিকে তিনি হত্যা করেন, তিনি ছিলেন শাসক জাতির অন্তর্ভূক্ত। অতঃপর তিনি পলায়ন করেন এবং এরপর তিনি বার্তাবাহকের পদে উন্নীত হন।

এই কুখ্যায়িত সত্ত্বেও কি বিস্ময়কভাবে তাঁর মহান প্রতিষ্ঠানসমূহ ও আইন কানুন প্রতিষ্ঠায় অলৌকিক শক্তির দ্বারা পরিচালিত হয়েছিলেন।

6
যীশুখ্রিষ্ট

পরবর্তীকালে যীশুখ্রিষ্ট এসে বললেন, “আমি পবিত্র আত্মা দ্বারা জন্মগ্রহণ করেছি।”যদিও এখন খ্রিষ্টানদের পক্ষে এই উক্তি বিশ্বাস করা সহজ, কিন্তু সেই সময় এটা বিশ্বাস করা খুবই সু-কঠিন ব্যাপার ছিল। সু-সমাচারের মূল গ্রন্থ অনুযায়ী ফরিশিওগণ বলে, “এই নয় কি নাজারেথের যোশেফের পুত্র, যাকে আমরা চিনি? তাহলে সে কেমন করে বলতে পারে ‘আমি স্বর্গ থেকে এসছি”?

সংক্ষেপে বলতে গেলে, বাহ্যতঃ এবং সকলের দৃষ্টিতে এই ব্যক্তি ছিলেন নীচ। তিনি এইরূপ প্রচণ্ড শক্তি সহকারে আবির্ভূত হয়েছিলেন যে, তিনি দেড় হাজার বছরের অস্তিত্ববান ধর্মকে রহিত করে দিলেন- এমনই এক সময়ে, যখন এই ধর্ম থেকে বিন্দুতম বিচ্যুত-দোষী ব্যক্তিকে মৃত্যুর –বিপদের সম্মুখীন করতো। অধিকন্তু, যীশুখ্রিষ্টের দিনগুলিতে সমগ্র বিশ্বের রীতি-নীতি, নৈতিক চরিত্র ও ইসরায়েলীদের অবস্থা সম্পূর্ণরূপে বিশৃঙ্খল ও নীতিহীন দোষে দুষ্ট হয়ে পড়ে এবং ইসরাইলীরা চরম অধপতন, দুরাবস্থা ও দাসত্বের অবস্থায় পতিত হয়। এক সময় তারা ক্যালডিও অধিবাসী ও পারস্যবাসী কর্তৃক বন্দী হয়, অন্য এক সময় তারা আসারীওয়াবাসী কর্তৃক চরম দ্বাসত্বে পরিণত হয় অতঃপর তারা গ্রীকদের প্রজা ও ভৃত্যে পরিণত হয় এবং যীশুখ্রিষ্টের আগমনের সময় রোমবাসীদের দ্বারা শাসিত ও ঘৃণিত হয়।

অলৌকিক শক্তি পুষ্ট হয়ে, এই যুবক যীশুখ্রিষ্ট প্রাচীন মুসাই আইন বাতিল করেন এবং সাধারণ রীতি নীতির সংস্কার করেন এবং পুনরায় ইসরায়েলিদের জন্য শাশ্বত গৌরবের ভিত্তি স্থাপন করেন। অধিকন্তু, তিনি মানব জাতির জন্য সার্বজনীন শান্তির আনন্দ সংবাদ নিতে আসেন এবং বিদেশে এমন শিক্ষা-দীক্ষা বিস্তার করেন, যা শুধু ইসরায়েলীদের জন্য নহে, বরং সমগ্র মানব জাতির সাধারণ সুখ শান্তির জন্য উপযোগী।

সর্বপ্রথম তাকে যারা নির্মূল করতে উঠে পড়ে চেষ্টা করে, তারা হল ইস্রায়েলীরা ও তাঁর আত্মীয় স্বজনেরা। আপাতদৃষ্টিতে তারা তাঁকে পরাভূত করে এবং চরমতম দুঃখ-দুর্দশাগ্রস্থ করে এবং অবশেষে তারা তাঁকে কাঁটার মুকুট পরিয়ে µzkwe× করে হত্যা করে। কিন্তু যীশুখ্রিষ্ট যখন স্পষ্টরূপে গভীরতম দুঃখ- কষ্টে নিপতিত, তখন তিনি ঘোষণা করেনঃ “এই সূর্য দীপ্তিশীল হইবে, এই আলো জ্বলজ্বল করিবে, আমার কৃপা সমগ্র বিশ্বকে বেষ্টন করিবে, এবং আমার সমস্ত kÎæ‡`i হীনাবস্থায় পর্যুদস্ত করা হইবে।” তিনি যেমনটি বলেছিলেন, ঠিক তেমটিই হয়েছিল; কারণ পৃথিবীর সমস্ত রাজন্যবর্গ তাঁকে প্রতিরোধ করতে সমর্থ হয় নাই। শুধু তাই নয়, তাদের সমস্ত ধ্বজা নিক্ষিপ্ত হয়েছে, পক্ষান্তরে সেই অত্যাচারিত ব্যক্তির ধ্বজা খ্যাতি ও গৌরবের উচ্চ শিখরে উত্তলিত হয়েছে।

কিন্তু এটা মনুষ্য যুক্তির সমগ্র নিয়মের পরিপন্থি। তাহলে এটা পরিস্কার ও সুস্পষ্ট যে, এই গৌরবমণ্ডিত পুরুষ মানব জগতের একজন প্রকৃত শিক্ষাদাতা ছিলেন এবং তিনি ঐশ্বরীক শক্তি দ্বারা সাহায্যপুষ্ট ও অনুমোদিত।

7
মুহাম্মদ (সঃ)

এখন আমরা মুহাম্মদ প্রসঙ্গে বলছি। আমেরিকা ও ইউরোপবাসীরা আলোচ্য বার্তাবাহক সম্বন্ধে বিশ কিছু সংখ্যক কেচ্ছাকাহিনী শুনেছে, যেগুলি তারা সত্য বলে মনে করেছে, যদিও কাহিনীকারগণ হয় অজ্ঞ অথবা বিরুদ্ধ ভাবাপন্ন ছিল। তাদের অধিকাংশই ছিল যাজক; অন্যরা ছিল অজ্ঞ মুসলামান, যারা মুহম্মদ সম্বন্ধে ভিত্তিহীন কিম্বদন্তী আওড়াতো, যেটা তারা অজ্ঞতা বশতই তাঁর প্রশংসা কীর্তন বলে বিশ্বাস করতো।

এমতে কোন কোন মানসিক বা নৈতিক অন্ধকার সমাচ্ছন্ন মুসলামান তাঁর বহু বিবাহকে তাদের প্রশংসাসমূহের মূল্যধার করে এবং এটাকে অলৌকিকস্বরূপ বিবেচনায় A™¢z` ঘটনা বলে ধরে নেয়। এবং অধিকাংশ ইউরোপীয় ঐতিহাসিকগণ এই সমস্ত অজ্ঞ লোকেদের পালগল্পের উপর নির্ভর করে।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, একজন নির্বোধ লোক একজন পাদরীকে বলল যে, মহত্ত্বের প্রকৃত নিদর্শন হচ্ছে সাহস তথা বীরত্ব ও রক্তপাত ঘটানো এবং সেহেতু একদিন রণক্ষেত্রে মুহাম্মদ এর একজন অনুসারী একশত লোকের মস্তক কেটে ফেলল। এই বর্ণনা উক্ত পাদরীকে ভুল ধারণার বর্শবর্তী করল যে, হত্যাই মুহাম্মদের উপর বিশ্বাস স্থাপনের পথ হিসেবে বিবেচিত, অথচ এটা কল্পনা প্রসূত মাত্র। মুহাম্মদের সাময়িক অভিযানগুলি সর্বদাই আত্মরক্ষামূলক তৎপরতা ছিল। এর প্রমাণ এই যে, তের বছর যাবত মক্কায় তিনি ও তাঁর শিষ্যগণ সর্বাপেক্ষা প্রচণ্ড নির্যাতন-নিপীড়ন সহ্য করেন। এই সময় তারা ঘৃণার তীরসমূহের লক্ষ্য বস্তুতে পরিণত হয়েছিলেনঃ তাঁর কতিপয় সঙ্গীদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হল। তাদের হত্যা করা হল অন্যান্যরা বিদেশে পালিয়ে গেল। যে কোরেশরা তাঁকে শেষ পর্যন্ত হত্যা করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়, তাদের দ্বারা চরমভাবে উৎপীড়িত হওয়ার পর মুহাম্মদ স্বয়ং মধ্যরাতে মদিনায় পলায়ন করেন। এমনকি কখনও তাঁর kÎæiv তাদের উৎপীড়ণ-নিপীড়ণ বন্ধ করে নাই, মদিনা পর্যন্ত তাঁর এবং তাঁর শিষ্যদের এমনকি আবিসিনিয়া পর্যন্ত পশ্চাদ্ধাবন করে।

এই আরব উপজাতিগুলি অসভ্যতা ও বর্বরতা তথা wbôziZvi অতলতম গহ্বরে নেমে গিয়েছিল এবং তাদের তুলনায় আফ্রিকা ও আমেরিকার বন্য ইন্ডিয়ান বর্বর মানুষেরাও চিন্তাধারায় একজন প্লেটোর ন্যায় অগ্রসর। সম্মানজনক কাজ করতে পারার গৌরববোধে এই আরব উপজাতিগুলি যেভাবে তাদের কন্যাদের জীবন্ত কবর দিত, আমেরিকার বর্বর লোকগুলি তাদের শিশুদের জীবন্ত কবর দেয় না। এইভাবে অনেক লোকই তাদের স্ত্রীদের এই বলে ভীতি প্রদর্শন করতো “যদি তোমার কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করে তাহলে আমি তোমাকে খুন করবো।”এমনকি বর্তমান সময়ে আরবীয়রা তাদের কন্যাদের ঘৃণা করে। অধিকন্তু একজন লোককে এক হাজার নারী গ্রহণের অনুমতি দেওয়া হত এবং অধিকাংশ স্বামীর দশটিরও বেশি স্ত্রী তার সংসারে থাকতো। যখন এই উপজাতিগুলি যুদ্ধ করতো বিজয়ী জাতি পরাজিত জাতির নারী ও শিশুদের বন্দী করতো এবং তাদেরতে দাসস্বরূপ ব্যবহার করতো।

দশ স্ত্রীর স্বামী যখন মারা যেত, তখন এই সমস্ত রমনীদের পুত্ররা একে অপরের মাতাদের দখল তরতো ; এবং কোন পুত্র যদি তার গাত্রাবরণ তার পিতার স্ত্রীর উপর নিক্ষেপ করতো এবং চিৎকার করে বলে উঠতো “এই নারী আমার বৈধ সম্পত্তি।”তৎক্ষণাৎ সেই হতভাগ্য নারী তার বন্দিনী ও কৃতদাস হয়ে যেত, এই নারীর সহিত যা খুশী তাই সে করতে পারত। সে তাকে হত্যা করতে , কুপের মধ্যে বন্দী করতে অথবা প্রহার করতে, অভিশাপ দিতে পারত এবং যে পর্যন্ত না মৃত্যু তাকে মুক্ত করতো সেই পর্যন্ত তাকে অত্যাচার করতে পারতো। আরব্য রীতি-নীতি অনুযায়ী সে সইে নারীর প্রভু। এটা সুস্পষ্ট যে এক পরবিারের ছেরে মেয়ে ও স্ত্রীদের মধ্যে হিংসা, দ্বেষ, দ্বন্দ্ব, ঘৃণা বিদ্যমান অবশ্যই থাকতো, অতএব এ বিষয়ে সবিস্তারে বলা বাহুল্য। আবার ভেবে দেখ, এই সমস্ত অত্যাচারিত রমনীদের অবস্থা ও জীবন কি ছিল। অধিকন্তু যে উপায়ে এই সমস্ত আরবীয় উপজাতিগুলি জীবিকা নির্বাহ করতো, সে উপায় ছির লুণ্ঠন ও ডাকাতির মধ্যে নিহিত। ফলে একে অন্যকে হত্যা করে, একে অন্যের সম্পত্তি লুণ্ঠন ও ধ্বংস করে, নারী ও শিশুদের বন্দী করে, যাদেরকে তারা বিদেশীদের কাছে বিক্রি করে দিত, তারা অবিচ্ছিন্নভাবে যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত থাকতো। নএটা এত পুনঃ পুনঃ সংঘটিত হত যে, যে আমীর তাঁর কন্যা ও পুত্রদের দিনগুলিতে ছিনালী ও চরম বিলাসীতার রজনীতে পরিবর্তন করতেন, সেই পুত্র কন্যাগুলি তাদের রজনীগুরিকে ভীষণ লজ্জা, দারিদ্রতা, বন্দীত্বের প্রভাবসমূহে রূপান্তরিত হতে দেখতে পেত। গতকাল তারা ছিল আমীর, আর আজ তারা সব বন্দী; গতকাল তারা ছিল শ্রদ্ধেয় মহিলা , আর আজ তারা ক্রীতদাসী।

মুহাম্মদ এই উপজাতিগুলির মধ্যে প্রতিপালিত হন এবং তের বছর যাবত নির্যাতন ভোগ করার পর তিনি তাদের থেকে পালিয়ে যান। কিন্তু এই সমস্ত লোক অত্যাচার করা থেকে বিরত হয় নাই। তাঁকে ও তাঁর অনুসারীদের নির্মূল করার জন্য তারা সংঘবদ্ধ হয়। ঠিক এইরূপ অবস্থায় মুহাম্মদ অস্ত্র ধারণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। এটাই আসল সত্য; ব্যক্তিগতভাবে আমরা সংকীর্ণচেতা ও গোঁড়া নই এবং তাঁকে সমর্থন করতে চাই না, কিন্তু আমরা ন্যায়পর এবং আমরা যা বলছি সেটা ঠিক। ন্যায়পরতার সহিত এটাকে বিচার করা। স্বয়ং যীশুখ্রিষ্ট যদি এইরূপ অবস্থায় এইরূপ অত্যাচারী ও বর্বর উপজাতিদের খপ্পরে পতিত হতেন এবং তের বছর যাবত তিনি তাঁর শিষ্যবর্গসহ ধৈর্য সহকারে এই সমস্ত দুঃখ কষ্ট ভোগ করতেন এবং শেষ পর্যন্ত নিজের দেশ থেকে পলায়ন করতেন- এতদস যদিওত্ত্বেও এই যথেচ্ছাচারী উপজাতিগুলি তাঁর পশ্চাদ্ধাবন করে থাকতো, লোকজন হত্যা করতে, তাদের সম্পত্তি লুটপাট করতে, নারী শিশুদের বলপূর্বক বন্দী করতে থাকতো, তাদের ব্যাপারে তখন যীশুখ্রিষ্টের আচরণ কি হত? এই অত্যাচার যদি শুধু ব্যক্তিগতভাবে তাঁর উপর করা হত, তাহলে তিনি তাদের ক্ষমা করতেন এবং এরূপ ক্ষমার কাজ সর্বোত্মক প্রশংসাযোগ্য হত; কিন্তু যদি তিনি দেখতেন যে, এই নিষ্ঠুর ও রক্তপিপাসু খুনীরা এই সমস্ত অত্যাচারীত ব্যক্তিদের খুন-জখম করতে লুণ্ঠন করতে, নারী শিশুদের বন্দী করতে আকঙ্খী, তাহলে এটা সত্য যে, তিনি তাদের রক্ষা করতেন এবং অত্যাচারিদের প্রতিহত করতেন। তাহলে মুহাম্মদের কাজের কি প্রতিবাদ করা যেতে পারে? এটাই কি সঙ্গত নয় যে, তিনি তাঁর অনুসারীগণ এবং তাদের নারী-শিশুসহ এই বর্বর উপজাতিদের কাছে আত্মসমর্পণ করেন নাই। এই উপজাতিগুলিকে তাদের রক্ত লোলুপতা থেকে মুক্ত করাই ছিল সর্বাপেক্ষা বিরাট অনুগ্রহ এবং তাদের প্রতিহত করা ও বাধ্য করাই ছিল প্রকৃত কৃপা। বিষের পেয়ালা হস্তে ধারণকারী একটি লোকের মত ছিল তারা- এই বিষ যখন পান করতে উদ্যত তখন এক বন্ধু সে পেয়ালা ভেঙ্গে দিচ্ছেন এবং এইভাবে তাকে রক্ষা করছেন। যীশুখ্রিষ্ট যদি এই একই অবস্থায় নিপতিত হতেন, এটা সুনিশ্চিত যে, তিনি বিজয়ী শক্তি সহকারে এই সমস্ত রক্ত পিপাসু নেকড়ে বাঘের থাবা থেকে উক্ত নর-নারী ও শিশুদিগকে মুক্ত করতেন।

মুহম্মদ কখনো খ্রিষ্টানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন নাই পক্ষান্তরে তিনি তাদের সাথে সদয় ব্যবহার করেন, তাদের পূর্ণ স্বাধীনতা দান করেন। নাজরানে খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের লোকেরা বাস করতেন। তারা সম্পূর্ণ তাঁর আশ্রয় ও রক্ষণাধীন ছিলেন। মুহম্মদ বলেন, “যদি কেহ তাহাদের আধিকারসমূহ হস্তক্ষেপ করেন, আমি স্বয়ং তার kÎæ হইব এবং আল্লাহর সম্মুখে তাহার বিরুদ্ধে অবিযোগ আনিব।”যে অনুশাসন আজ্ঞাসমূহ তিনি ঘোষণা করেন, তাতে সুস্পষ্টভাবে বিবৃত রয়েছে যে, খ্রিষ্টান ও ইহুদীদের জীবন, সম্পত্তি তথা মালামাল আল্লাহ্র রক্ষণাবেক্ষণাধীন রয়েছে এবং যদি কোন মুসলমান, কোন খ্রিষ্টান রমনীকে বিয়ে করে, তাকে গীর্জায় গমনা-গমনে বাধা দিতে পারবে না, তাকে বোরখা পরিধান করতে বাধ্য করতে পারবে না, এবং যদি সে মারা যায়, তবে তার মৃতদেহ খ্রিষ্টান পাদরীর হস্তে সমর্পণ করতে হবে। খ্রিষ্টানরা যদি কোন গীর্জা নির্মাণ করতে ইচ্ছা করে, তবে ইসলামের উচিত তাদের সাহায্য করা। ইসলাম ও তাঁর kÎæদের মধ্যে যুদ্ধের ব্যাপারে যুদ্ধ করার বাধ্যবাধকতা থেকে খ্রিষ্টানদের রেহাই দিতে হবে- যদি না তরা ইসলামের পক্ষ সমর্থনে সেচ্ছায় রাজী থাকে , কেননা তারা ইসলামের আশ্রয়ে রয়েছে। কিন্তু যুদ্ধ করার বাধ্যবাধকতা থেকে রেহাই পাওয়ার প্রতিদানস্বরূপ তাদের বাৎসরিক সামান্য কিছু টাকা দিতে হবে। উপসংহারে এই বিষয়ে সাতটি নির্দেশনামা বিস্তারিতভাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে। এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য এবং এটা আমার সত্যাপনের উপর নির্ভরশীল নয়। দ্বিতীয় খলিফার ফারমান তথা আদেশ নামা, জেরুজালেমের গোঁড়া উর্ধ্বতন ধর্ম যাজকদের জিম্মায় এখনো বিদ্যমান রয়েছে এবং এতে কোন সন্দেহ নাই।

এতদসত্ত্বেও একটি নির্দিষ্ট সময়ের পরে এবং মুসলামান ও খ্রিষ্টান উভয়েরই এটাকে লঙ্ঘণ করার মধ্য দিয়ে তাদের মধ্যে ঘৃণা ও kÎæতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। নিরপেক্ষভাবে এই ঘটনা তথা তথ্য ছাড়া মুসলামান , খ্রিষ্টান এবং অন্যান্যদের সমস্ত বিবরণ মিথ্যা উদ্ভাবন মাত্র, যার মূলে রয়েছে গোঁড়ামী, ধর্মান্ধতা অথবা অজ্ঞতা।

উদাহরণস্বরূপ, মুসলমানেরা বলে যে, মুহাম্মদ চন্দ্রকে বিভক্ত করেছিলেন এবং এটা মক্কার পাহাড়ের উপর পড়েছিল। তারা মনে করে যে, চন্দ্র একটি ক্ষুদ্র বস্তু যা মুহাম্মদ দুইভাবে বিভক্ত করেন এবং এক অংশ এই পাহাড়ের উপর নিক্ষেপ করেছিলেন এবং অপর অংশ অন্য পাহাড়ে।

এইরূপ কেচ্ছা-কাহিনী নিছক গোঁড়ামী। অধিকন্তু, ধর্মাচার্যরা যে কিম্বদন্তী D×…Z করেন এবং যে ঘটনাগুলিতে তারা দোষ ধরেন, তার সবগুলি সম্পূর্ণরূপে ভিত্তিহীন না হলেও সমস্তই অতিরঞ্জিত।

সংক্ষেপে মুহাম্মদ আরব্য উপদ্বীপে অবস্থিত হেজারের মরুভূমিতে আবির্ভূত হন, যে উপদ্বীপ ছিল জনশূন্য, অনুর্বর বিজন প্রদেশ, বালুকাময় বসতিহীন; কিছু কিছু অংশ মক্কা ও মদিনার মত অত্যন্ত গরম; মরু বাসিন্দাদের রীতিনীতি চালচলনে অব্যস্ত এই লোকগুলি যাযাবর, এবং সম্পূর্ণ জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষা-দীক্ষায় বঞ্চিত। মুহাম্মদ স্বয়ং ছিলেন নিরক্ষর এবং কোরান মূলতঃ ভেরার চওড়া হাড়ে অথবা তালপত্রসমূহের উপর লিখিত হয়েছিল। এই সমস্ত বর্ণনা, মুহাম্মদকে যাদের কাছে প্রেরণ করা হয়েছিল, সেই লোকদের অবস্থার আভাস দেয়। তিনি প্রথম যে প্রশ্ন তাদের কাছে করেছিলেন; সেটা এইঃ “তোমরা বাইবেলের প্রথম পাঁচখানা বই ও সুসমাচার সত্য বলে গ্রহণ কর না কেন? কেন তোমরা যীশুখ্রিষ্ট ও মুসাকে মান না?” এই প্রশ্ন তাদেরকে মুশকিলে ফেলে দিল এবং তারা যুক্তি প্রদর্শন করল, “আমাদের পূর্ব পুরুষরা বাইবেলের প্রথম পাঁচখানা বই ও মুসাকে মানে নাই। আমাদের বল, কেন এটা হয়েছিল? তিনি উত্তর দিলেন, “ তারা ভ্রান্ত পথে পরিচালিত হয়েছিল। তোমাদের উচিত ছিল তাদের মত প্রত্যাখ্যান করা, যারা বাইবেলের প্রথম পাঁচখানা বই ও সুসমাচার মানে না, যদিও তারা তোমাদের পিতা ও পূর্ব পুরুষ।”

এইরূপ এক দেশে, এইরূপ বর্বর উপজাতিদের মধ্যে এক নিরক্ষর ব্যক্তি এইরূপ গ্রন্থ উপস্থিত করেন, যার মধ্যে তিনি অনুপম ও বাগ্মী ভাষায়, তিনি স্বর্গীয় গ্রণাবলী, পরোৎকর্ষতা, আল্লাহ্র বার্তাবাহকদের দৌত্য, স্বর্গীয় আইন-বানুন ও কতিপয় বৈজ্ঞানিক তথ্যবলী ব্যাখ্যা করেছিলেন।

এইভাবে, তোমরা জান যে, আধুনিক কালের প্রকৃতি পর্যবেক্ষণের পূর্বে অর্থাৎ খ্রিস্ট বর্ষের প্রথম শতাব্দীসমূহ থেকে পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত পৃথিবীর সমস্ত গণিতবিদগণ একমত হন যে, পৃথিবী বিশ্ব ব্রক্ষ্মাণ্ডের কেন্দ্রস্থল এবং সূর্য ঘোড়ে। নতুন মতবাদের নেতা প্রখ্যাত জ্যোতিবিদ কোপার নিকাশ আবিষ্কার করেন যে, পৃথিবী ঘোরে, সূর্য স্থির। তার সময়ের পূর্বে পৃথিবীর সমস্ত জ্যোতিবিদও দার্শনিকগণ টলেমীর পদ্ধতী অনুসরণ করতেন এবং যে কেউ এর বিরুদ্ধে বলতেন, তাকে অজ্ঞ বলে বিবেচনা করা হত। যদিও পিথাগোরাস এবং প্লাটো তাঁর জীবনের শেষের দিকে এই মতবাদ গ্রহণ করেন যে, রাশিচক্রের চতুর্দিকে সূর্যের বার্ষিক গতি সূর্য থেকে উৎপন্ন হয় না, বরং সূর্যের চতুর্দিকে পৃথিবী থেকে সেটা হয়। এই মতবাদ সম্পূর্ণরূপে ভুলে যাওয়া হয় এবং সমস্ত গণিতবিদ কর্তৃক টলেমীর পদ্ধতি সত্য বলে গৃহিত হয়। কিন্তু টলেমীর মতবাদের পরিপন্থী কোরানে কতিপয় শ্লোক প্রকাশিত হয়। সেগুলির মধ্যে একটি হচ্ছে “ সূর্য একটি নির্ধারিত স্থানের মধ্যে ঘোরে।”যা সূর্যের স্থিরতা এবং একটি মেরুরেখা তথা অক্ষের চতুর্দিকে চলাচল বুঝায়। পুনরায় অপর একটি শ্লোকে “এবং প্রতি নক্ষত্র এবং নিজের আকাশে ঘোরে”এইরূপে সূর্য, চন্দ্র, পৃথিবী ও অন্যান্য নক্ষত্রসমূহের ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কোরান যখন অবতারিত হল, সমস্ত গণিতবিদ এই বিবরণসমূহকে উপহাস করে এবং এই মতবাদের প্রতি অজ্ঞতা আরোপ করা হল। এমনকি ইসলামী পণ্ডিতগণও যখন এই শ্লোকগুলিকে টলেমীর পদ্ধতীর গ্রহিত তথ্যের পরিপন্থী বলে দেখতে পেলেন, তারাও এগুলিকে (শ্লোক) ব্যাখ্যা করে উড়িয়ে দিলেন।

খ্রিস্ট বর্ষের এয়োদশ শতাব্দীর পর, মুহাম্মদের প্রায় নয়শত বছর পর একজন বিখ্যাত জ্যোতবিদ গ্যালিলও নতুন পর্যবেক্ষণ করেন এবং যে টেলিস্কোপ তিনি উদ্ভাবন করেছিলেন, তার সাহায্যে তিনি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার করেন। পৃথিবীর আবর্তন , সূর্যের স্থিরতা, এবং একটি মরুরেখার চতুর্দিকে এদের ঘুর্ণনও আবিষ্কৃত হয়। এটা সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত হয় যে, কোরানের শ্লোকগুলি বিদ্যমান তথ্যাবলীর সহিত সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং টলেমী মতবাদ কাল্পনিক।

সংক্ষেপে, অনেক প্রাচ্য জাতি, তের শতাব্দী যাবত মুহাম্মদের ধর্মের ছায়াতলে প্রতিপালিত হয়েছে। মধ্য যুগসমূহে ইউরোপ যখন বর্বরতার নিম্নতম গহ্বরে বিরাজ করছিল, তখন শিক্ষায়, কলায়, গণিতে, সভ্যতায়, সরকার গঠনে এবং অন্যান্য বিজ্ঞানে আরব জনমণ্ডলী অন্যান্য জাতি অপেক্ষা উৎকৃষ্ট ছিল। এই সমস্ত আরব উপজাতিগুলির জ্ঞানদাতা ও শিক্ষাদাতা ও বিভিন্ন শ্রেণী বংশ ও জাতির মধ্যে মানবতার পরোৎকর্ষতা ও সভ্যতার জনক ছিলেন একজন নিরক্ষর ব্যক্তি- মুহাম্মদ। এই মহান ব্যক্তি কি একজন শিক্ষাদাতা ছিলেন কি ছিলেন না? ন্যায় বিচার আবশ্যক।

8
বা’ব

বা’ব এর - আমার আত্মা তাঁর জন্য উৎসর্গকৃত হউক- বিষয়ে বলতে গেলে, যৌবন বয়সে, অর্থাৎ যখন তিনি তাঁর আশীর্বাদপুষ্ট জীবনের পচিশ বছরে পদার্পণ করেন, তখন তিনি তাঁর ধর্ম ঘোষণার জন্য দণ্ডায়মান হন। শিয়াদের সার্বজনীন স্বীকৃত মত এটাই ছিল যে তিনি কোন বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন নাই, কোন শিক্ষকোর কাছে থেকে কোন জ্ঞান আহরণ করেন নাই। শিরাজের সমগ্র জনমণ্ডলী এই কথার সাক্ষা দেয়। এতদসত্ত্বেও, সর্বোৎকৃষ্ট পূর্ণজ্ঞানে ভূষিত হয়ে তিনি হঠাৎ জনসমক্ষে আবির্ভূত হলেন। যদিও তিনি মাত্র একজন বণিক ছিলেন, তিনি পারস্যের সমস্ত উলেমাদের (আলেম) হতবুদ্ধি করে ছেড়েছিলেন। পরিকল্পনার পরপারে সম্পূর্ণ একাকী তিনি পারস্যবাসীদের সম্মুখে ধর্মবাণী তুলে ধরেন- যে পারস্যবাসীরা ধর্মীয় গোঁড়ামীর জন্য খ্যাত ছিলেন। এই মহান আত্মা-ব্যক্তি এমন প্রচণ্ড শক্তি সহকারে গাত্রোত্থান করলেন যে, তিনি পারস্যের ধর্ম, রীতি নীতি, অবস্থা, অভ্যাস, চালচলে ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিলেন এবং নতুন নিয়ম কানুন, আইন ও ধর্ম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যদিও পাস্যের বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ, প্রায় সমস্ত ধর্মাচার্যগণ, জনসাধারণ তাঁকে ধ্বংস তথা নির্মূল করার জন্য উঠেপড়ে লেগে গেলেন, তবুও তিনি একাকী তাদের প্রতিরোধ করেন এবং সমগ্র পারস্যকে নাড়িয়ে দেন। অনেক আলেমা এবং জনসাধারণ ও অন্যান্য ব্যক্তিবর্গ তাঁর ধর্মের জন্য আনন্দ সহকারে তাদের জীবন উৎসর্গ করেন এবং শহীদদের যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুর ময়দানে দ্রুত গমন করেন।

সরকার, জাতি, খোদাইত্বের- পণ্ডিতেরা এবং বিখ্যাত বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ তাঁর আলো নির্বাপিত করতে ইচ্ছা করেছিল, কিন্তু তারা তা পারেন নাই। অবশেষে তাঁর চন্দ্র উদয় হল. তাঁর পতাকা ঝিকমিক করলো, তাঁর ভিত্তিসমূহ শক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত হল এবং তাঁর উদয় স্থল দীপ্তিশীল হল। এক অজ্ঞ জনমণ্ডলীকে তিনি স্বর্গীয় শিক্ষাদান করলেন এবং পারস্যবাসীর চিন্তাধারা. রীতিনীতি এবং অবস্থার উপর বিস্ময়কর ফল উৎপাদন করলেন। তিনি তাঁর অনুসারীদের কাছে বাহা’র সূর্য প্রকাশের আনন্দ সংবাদ ঘোষণা করলেন এবং এটা বিশ্বাস করতে তাদের প্রস্তুত করলেন।

একজন যুবক বণিকের দ্বারা এইরূপ বিস্ময়কর নিদের্শনাবলী ও বিরাট ফলোৎপাটনের ক্ষমতা, জনমণ্ডলীর মনের উপর উৎপাদিত প্রবাব, অতি প্রচলিত ধ্যানধারণার পরিবর্তন; উন্নতির ভিতসমূহের প্রতিষ্ঠা, সাফল্য ও সৌভাগ্যের নীতিমালার সংগঠিত বিষয়বস্তু বৃহত্তম প্রমাণ প্রদর্শন করে যে, তিনি ছিলেন একজন পূর্ণতাপ্রাপ্ত শিক্ষাদাতা, ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি এটা বিশ্বাস করতে কখনও ইতঃস্তত করবে না।

9
বাহা’উল্লাহ্

বাহা’উল্লাহ্ এমন এক সময় আবির্ভূত হন, যখন পারস্য সাম্রাজ্য জ্ঞান, সংস্কৃতি, সংস্কারের পরিপন্থি প্রগাঢ় মতবাদে ও অজ্ঞতায় নিমজ্জিত ও অন্ধ ধর্মান্ধতায় আচ্ছন্ন ছিল।

নিশ্চয়ই তোমরা ইউরোপীয় ইতিহাসসমূহে পারস্যবাসীদের বিগত ধ্যান ধারণা, রীতিনীতি, আচার আচরণ সম্বন্ধে বিস্তারিত বিবরণ পাঠ করেছ। সেগুলির পুনরুল্লেখ নিস্প্রয়োজন। সংক্ষেপে আমরা অবশ্যই বলব যে, পারস্য এত অধঃপতনে গিয়েছিল যে সমস্ত বিদেশী পর্যটকদের কাছে এটা ছিল পরিতাপের বিষয় যে, যে দেশ পূর্ববর্তী সময়কালে এত গৌরবময় ও সভ্য ছিল, এখন সেটা এত ক্ষরিষ্ণু, ধ্বংসপ্রাপ্ত, বিপর্যস্ত এবং এর জনমণ্ডলী তাদের মর্যাদা হারিয়েছে।

এমন সময়ই বাহা’উল্লাহ্ আবির্ভূত হয়েছিলেন। তাঁর পিতা ছিলেন মন্ত্রীদের একজন, উলেমাদের কেউ নন। যেহেতু পারস্যের লোকজন জানে যে, তিনি কখনও কোন বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন নাই, উলেমাদের সঙ্গেও মেলামেশা করেন নাই অথবা শিক্ষিত লোকদের সঙ্গেও মেশেন নাই। তাঁর জীবনের প্রথমভাগ সবচেয়ে সুখের ভিতর দিয়ে অতিক্রম করে। তাঁর সঙ্গী সাথীরা ছিলেন উচ্চপদস্থ ব্যক্তিবর্গের অন্তর্ভূক্ত, কিন্তু শিক্ষিত লোকদের অন্তর্ভূক্ত নন।

বা’ব প্রকাশিত হওয়া মাত্রই, বাহা’উল্লাহ্ বলেন, “এই মহান ব্যক্তি ধার্মিকদের প্রভু এবং তাঁর উপর বিশ্বাস স্থাপন করা সকলের অপরিহার্য কর্তব্য।”এবং রাষ্ট্রীয় ধর্মের উলেমাগণ তাঁকে প্রতিরোধ করার জন্য বাধ্য করে এবং উপরন্তু তাঁর অনুসারীদের বেপরোয়া হত্যা, নির্যাতন, লুণ্ঠন ও বিতাড়নের আদেশ জাড়ি করার ঘটনা বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও, বাহা’উল্লাহ্ তাঁকে সাহায্য করার জন্য গাত্রোত্থান করেন এবং তাঁর ধর্মের স্বপক্ষে অনেক প্রমাণ ও চূড়ান্ত সাক্ষ্য দেন। সমগ্র প্রদেশেই তারা ধমান্তরিতদের হত্যা করতে, জ্বালিয়ে পুড়িয়ে, লুণ্ঠন করতে শুরু করলো এমনকি তারা নারী ও শিশুদের প্রচণ্ড আক্রমণ করলো। এসব গ্রাহ্য না করে, বাহা’উল্লাহ্ চরম দৃঢ়তা শক্তি সহকারে বা’বের বাণী ঘোষণা করতে রুখে দাড়ালেন। এক মুহূর্তের জন্যও তিনি গোপনীয়তা অবলম্বন করেন নাই; তিনি খোলাখুলিভাবেই kÎæদের সঙ্গে মিশতেন। তিনি সাক্ষ্য প্রমাণাদি প্রদর্শনে ব্যস্ত থাকতেন এবং আল্লাহর বাণীর অগ্রদূতস্বরূপ স্বীকৃত হন। তিনি বহু ঘটনাচক্রে দুঃখ কষ্ট ভোগ করেন এবং প্রতি মুহূর্তে শহীদদের যন্ত্রণাদায়ক মুক্তির ঝুকি নেন।

তাঁকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হল এবং ভূগর্ভস্থ কারাগারে বন্দী করা হল। তাঁর বিরাট সম্পত্তি ও উত্তরাধিকার লুণ্ঠন ও বাজেয়াপ্ত করা হল। চার বার তাঁকে স্থান থেকে স্থানান্তর করা হয় এবং “মহত্তম কারাগারে”এর বিরতি ঘটল।”

এতদসত্ত্বেও, আল্লাহ্র ধর্মের মহত্ব ঘোষণা থেকে এক মুহূর্ত ক্ষান্ত হন নাই তিনি এইরূপ গুণ, জ্ঞান ও পরোৎকর্ষতা প্রকাশ করলেন যে, সমগ্র পারস্যবাসীর কাছে তিনি এক বিস্ময়ের বস্তু হয়ে উঠলেন। এতে অধিক পরিমাণে যে, তেহরান, বাগদাদ, কনস্টান্টিনোপল, লুমেনিয়া, এমনকি আক্কার জ্ঞানী বিজ্ঞানীদের প্রত্যেকেই বন্ধু হোক অথবা kÎæ হোক- যে কেউ তাঁর উপস্থিতিতে তথা সম্মুখে হাজির হত, যেকোন উপস্থাপিত প্রশ্নের সন্দেহহীন যথেষ্ট উত্তর পেতে সে ব্যর্থ হত না। সর্ব ব্যক্তিই পুনঃ পুনঃ স্বীকার করেছে যে, মাত্র তিনিই ছিলেন সর্বোৎকর্ষতায় অনুপম তথা অসাধারণ।

প্রায়ই এইরূপ ঘটতো যে, বাগদাদে কতিপয় মুসলামান আলেম, ইহুদি পুরোহিত ও খ্রিষ্টান কয়েকজন পণ্ডিতসহ এক আশীর্বাদপুষ্ট পুন-মিলনে একত্রিত হতেন। প্রত্যেকেই কিছু প্রশ্ন রাখতেন, যদিও তারা বিভিন্ন কৃষ্টি সংস্কৃতিভূক্ত ছিলেন, তবুও প্রত্যেকে যথেষ্ট সন্দেহবিহীন উত্তর শ্রবণ করতেন এবং সন্তুষ্ট হয়ে ফিরতেন। এমনকি কারবালা ও নাজাফস্থিত পার্সী আলেমগণ এক বিজ্ঞ ব্যক্তিকে বেছে নেন এবং দৌত্য কার্যে বাহা’উল্লাহ্র কাছে প্রেরণ করেন। তার নাম মুসা হাসান আমু। তিনি পবিত্র উপস্থিতিতে আগমন করেন এবং আলেমের তরফ থেকে কতিপয় প্রশ্ন রাখেন- যার উত্তর বাহা’উল্লাহ্ দিলেন। তখন হাসান আমু বলেন: “উলেমাগণ বাহা’উল্লাহ্র জ্ঞান ও গুণ বিনা দ্বিধায় স্বীকৃতি দেন ও মেনে নেন। তারা সর্বসম্মতিক্রমে স্বীকার করেন যে, সমগ্র শিক্ষায় বাহা’উল্লাহ্র কোন সমকক্ষ নাই; এবং এটাও সুস্পষ্ট যে, তিনি কখনও লেখাপড়া করেন নাই ও এই শিক্ষা অর্জন করেন নাই। কিন্তু তবুও উলেমাগণ বললেন, “আমরা এতে পরিতৃপ্ত নই, আমরা তাঁর বিজ্ঞতা ও ধর্মপ্রাণতার বুনিয়াদে তাঁর দৌত্যকার্যের বাস্তবতা স্বীকার করতে পারি না। অতএব আমাদের হৃদয় ও মন সন্তুষ্ট ও শান্ত করনার্থে তাঁকে অলৌকিক ব্যাপার প্রদর্শন করতে আমরা অনুরোধ করছি।”

বাহা’উল্লাহ্ উত্তর দিলেন: “ যদিও এটা চাওয়ার কোন অধিকার তোমাদের নেই, কেননা আল্লাহ্ তাঁর সৃষ্ট প্রাণীদের পরীক্ষা করেন, তারা আল্লাহ্কে পরীক্ষা করে না; তবুও আমি এই অনুরোধ রাখছি। কিন্তু আল্লাহ্র ধর্ম নাট্যশালা সম্বন্ধীয় প্রদর্শনী নহে, যা প্রতি ঘণ্টায় দেখানো হয়, যার মধ্যে প্রত্যেক দিনে কিছু নতুন চিত্ত বিনোদনের আবেদন জানানো হয়। যদি এরূপ হত তাহলে আল্লাহ্র ধর্ম শিশুদের খেলায় পরিণত হত।

উলোমাদের অবশ্যই একত্রিত হতে হবে এবং একক সম্মতিতে একটি অলৌকিক বিষয় বেছে নিতে হবে এবং লিখে দিতে হবে যে, এই অলৌকিক বিষয় প্রদর্শনীর পর তারা আমার সম্বন্ধে আর কোন সন্দেহ পোষণ করবে না এবং আমার ধর্মের সত্যতা সবাইকে স্বীকার করতে ও মেনে নিতে হবে। তারা এই কাগজ সীলমোহর করুক ও আমার কাছে নিয়ে আসুক। এইটাই গৃহিত মানদন্ড হবে। যদি অলৌকিক বিষয় প্রদর্শিত হয় তাদের পক্ষে সন্দেহ করার আর কোন অবশিষ্ট থাকবে না; যদি প্রদর্শিত না হয়, আমরা ভণ্ড বলে দোষী সাব্যস্ত হব।”উক্ত জ্ঞানী ব্যক্তি হাসান আমু উঠে দাড়ালেন এবং উত্তর দিলেন, “আর কিছু বলার প্রয়োজন নাই।”তিনি তখন বাহা’উল্লাহ্র জানুসন্ধি চুম্বন করলেন, যদিও তিনি একজন বিশ্বাসী ছিলেন না, এবং প্রস্থান করলেন। তারা একত্রে আলোচনা করলেন এবং পবিত্র বাণী দান করলেন। তারা একত্রে আলোচনা করলেন এবং বললেন, “এই লোকটি একটি যাদুকর। হয়তো তিনি একটি যাদু প্রদর্শন করবেন, তখন আমাদের আর কিছুই বলার থাকবে না।”এই বিশ্বাস অনুযায়ী তারা এই বিষয়ে অগ্রসর হতে সাহস করলেন না।

এই হাসান আমু এই ঘটনা বহু সভায় উল্লেখ করেন। কারবালা পরিত্যাগের পর তিনি কিরমানশাহ্ ও তেহরানে গমন করেন এবং প্রত্যেক জায়গায় এর বিস্তারিত বিবরণ দেন। তিনি উলেমাদের ভীতি ও তাদের প্রত্যাহারের কথা জোড় দিয়ে বলেন।

সংক্ষেপে, প্রাচ্যদেশীয় তাঁর সমস্ত প্রতিদ্বন্দ্বীরা তাঁর মহত্ব, তাঁর উচ্চভাব, তাঁর জ্ঞান ও গুণ স্বীকার করেন এবং যদিও তারা তাঁর শত্রু ছিলেন, তবুও তারা সব সময়েই তাঁর কথা বলতেন, “প্রখ্যাত বাহা’উল্লাহ্।”

যে সময় এই মহান আরো সহসা পারস্যের দিকচক্রবালের উপর উদ্ভাসিত হল , সমস্ত লোক, মন্ত্রীবর্গ, আলেমগণ ও অন্যান্য শ্রেণীর লোকেরা তাঁর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াল। বৃহত্তম বৈরিতাসহ তারা তাঁর পশ্চাদ্ধাবন করে চলর এই দাবী করে যে, “এই ব্যক্তি ধর্মকে দমন ও ধ্বংস করছেন-আইন, জাতি ও সাম্রাজ্য ধ্বংস করছেন।”যীশুখ্রিষ্টের সম্বন্ধেও ঐ একই কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু বাহা’উল্লাহ্ আদৌ কোন দুর্বলতা না দেখিয়ে একাকি বিনা সমর্থনে তাদের প্রতিহত করেন। অবশেষে তারা বলে: “যতক্ষণ এই লোক পারস্যে অবস্থান করবেন, ততক্ষণ এখানে কোন সুখ শান্তি থাকবে না; আমাদের তাঁকে নির্বাসন দিতে হবে, যাতে পারস্য শান্ত অবস্থায় ফিরে আসে।”

পারস্য ত্যাগ করার অনুমতি প্রার্থনা করবার জন্য তাঁকে বাধ্য করতে , তাঁর উপর বল প্রয়োগ করতে তারা অগ্রসর হয়- এই ধাণায় যে এই উপায়ে তাঁর সত্যের আলো নির্বাপিত হবে, কিন্তু ফল সম্পূর্ণ বিপরীত হল। সর্বপ্রথম এটা শুধুমাত্র সমগ্র পারস্যে বিস্তার লাভ করে , কিন্তু বাহা’উল্লাহ্র ধর্ম মহিমা-মণ্ডিত হল এবং এর শিখা তীব্রতর হল। নির্বাসনে অন্যান্য দেশের সর্বত্র ধর্মের পরিব্যপ্তি ঘটালো। পরবর্তীকালে তাঁর শত্ররা বলল, “ইরাক-আরাবি”পারস্য থেকে খুব বেশি দূরে নয়, আমরা তাকে অবশ্যই আরো দূরবর্তী রাজ্যে প্রেরণ করব।”এই কারণেই পারস্য সরকার বাহা’উল্লাহ্কে ইরাক থেকে কনস্টান্টিনোপলে প্রেরণ করতে স্থির করেন। আবার এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, উক্ত ধর্ম আদৌ দুর্বল নয়; পুনরায় তারা বলল, “কনস্টান্টিনোপল হচ্ছে যাতায়াতের পথ, বিভিন্ন জাতি ও লোকদের অল্পক্ষণের প্রবাসী স্থল, যাদের মধ্যে অনেক পারস্যবাসী রয়েছে।”এই কারণেই তারা তাঁকে পুনরায় রুমেলিয়ায় নির্বাসন করল। কিন্তু অগ্নিশিখা সেখানে আরো শক্তিশালী হল এবং ধর্ম আরো সমুন্নত হল। অবশেষে পারস্যবাসীরা বলল, “এই সমস্ত জায়গায় কোনটাই তাঁর প্রভাব থেকে নিরাপদ নয়, আমরা তাঁকে এমন এক জায়গায় প্রেরণ করব যে, সে শক্তিহীনতায় পর্যবসিত হয়ে পড়বে এবং তাঁর পরিবারবর্গ ও অনুসারীরা নিদারুণতম দুঃখকষ্টের কাছে বশ্যতা স্বীকার করবে। ” সুতরাং তারা আক্কার কারাগার বেছে নিল, যে কারাগারে বিশেষভাবে খুনী, চোর, রাজপথ ডাকাতদের জন্য সংরক্ষিত; এবং প্রকৃতপক্ষে তারা তাঁকে তাদের শ্রেণীভুক্ত করল। কিন্তু খোদাই শক্তি সুস্পষ্ট হল; তাঁর বাণী প্রচারিত তথা ঘোষিত হল এবং তখন বাহা’উল্লাহ্র মহত্ব সুস্পষ্ট হল, যেহেতু এই কারাগার থেকেই এবং এইরূপ অবস্থা থেকেই তিনি পারস্যকে জ্ঞান থেকে জ্ঞানে অগ্রসর করেছিলেন। তিনি তাঁর সমস্ত শত্রুকে পরাভূত করেন এবং তাদের কাছে প্রমাণ করেন যে, তারা ধর্মকে বাধা দিতে অক্ষম। তাঁর পবিত্র শিক্ষাসমূহ সমগ্র জনপদে প্রবেশ করল এবং তাঁর ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হল।

বস্তুতঃ পারস্যের সমগ্র অংশে তাঁর শত্রুরা, তাঁর ধর্মান্তরিত লোকদের প্রচণ্ডতম ঘৃণা, কারারুদ্ধকরণ, হত্যা ও প্রহার; এবং হাজার হাজার বাসগৃহ অগ্নি সংযোগ ও ধুলিসাৎকরণ এবং উক্ত ধর্মকে নির্মুলকরণের যে কোন প্রচেষ্টাসহ তাঁর বিরুদ্ধে গাত্রোত্থান করল। এতদসত্ত্বেও খুনী, রাজপদ ডাকাত এবং চোরদের কারাগার থেকে উক্ত ধর্ম সমুন্নত হল। তাঁর শিক্ষাসমূহ বিদেশে বিস্তার লাভ করল এবং উপদেশসমূহ অধিকাংশ লোককেই প্রভাবান্বিত করে এবং তাদেরকে দৃঢ় বিশ্বাসী করে, এমনকি পারস্য সরকার স্বয়ং সজাগ হল এবং উলেমাদের ত্রুটির মাধ্যমে এইসব যা কিছু হয়েছে তার দুঃখ করল।

বাহা’উল্লাহ্ যখন পবিত্র ভূমিতে এই কারাগারে আগমন করেন, তখন বিজ্ঞজনেরা হৃয়ঙ্গম করেছিলেন যে, দুই অথবা তিন হাজার বছর আগে যে আনন্দ সংবাদ আল্লাহ্ বার্তাবাহকদের রসনার মাধ্যমে দিয়েছিলেন, পুনরায় তা প্রকাশিত হয়েছে এবং আল্লাহ্ তাঁর প্রতিশ্রুতি পালনে বিশ্বস্ত; যেহেতু কতিপয় বার্তাবাহকদের কাছে তিনি প্রকাশ করেছিলেন এবং সুসংবাদ দিয়েছিলেন যে, “স্বর্গীয় সেনাদলের প্রভু পবিত্রভূমিতে প্রকাশিত হবেন।”এই সমস্ত প্রতিশ্রুতি পরিপূর্ণ হয়েছিল এবং এটা বুঝে ওঠা কষ্টকর যে, কেমন করে বাহা’উল্লাহ্ তাঁর শত্দের উৎপীড়ন, তাঁর নির্বাসন ও স্বদেশ থেকে বিতাড়ন ব্যতীরেকে পারস্য ত্যাগ করতে ও এই পবিত্রভূমিতে তাঁর তাবু খাটাতে পারতেন। তাঁর শত্রুরা ইচ্ছা করেছিল যে, তাঁর কারাবরণ স্বর্গীয় ধর্মকে সম্পূর্ণভাবে নির্মুল ও ধ্বংস করে দেবে; কিন্তু এই কারাগারেই প্রকৃতপক্ষে সর্বাপেক্ষা বড় সহায় স্থল হয়েছে এবং ধর্ম বিকাশের উপায়স্বরূপ হয়েছে। বাহা’উল্লাহ্র স্বর্গীয় খ্যাতি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দেশে পৌছেছিল ও সত্যের সূর্যরশ্মি সমগ্র পৃথিবীকে আলোকিত করেছে। প্রশংসা অল্লাহ্র। যদিও তিনি একজন কয়েদী ছিলেন, তবু তাঁর তাবু কার্মেল পর্বতের উপর উত্তেলিত হয় এবং তিনি বৃহত্তম মর্যাদাসহ বিদেশে অগ্রসর হন। প্রতিটি লোক বন্ধু অথবা বিদেশী যে কেউ তাঁর উপস্থিতিতে আগমন করতো, সে বলতো, “ইনি একজন সম্রাট, বন্দী নন।”

তিনি এই কারাগারে আগমনের সঙ্গে সঙ্গেই, নেপোলিয়নকে সম্বোধন করে এক ফলকলিপি লেখেন, যা তিনি ফরাসী রাষ্ট্রদূতের মারফৎ প্রেরণ করেন। এটার সংক্ষিপ্তসার এইরূপ ছিলঃ “জিজ্ঞাসা করুন আমাদের অপরাধ কি, এবং কেন আমরা এই কারাগারে ও এই ভূগর্ভস্থ জেলখানায় আবদ্ধ।” নেপোলিয়ান কোন উত্তর দেন নাই। অতঃপর দ্বিতীয় ফলকলিপি প্রকাশ করা হল, যা “সুরাতুল হাইকল” এর অন্তর্ভূক্ত ছিল। এর সংক্ষিপ্তসার এই , “ওহে নেপোলিয়ান, যেহেতু তুমি আমার ঘোষণা শ্রবণ কর নাই এবং যেহেতু তুমি এর উত্তর দাও নাই, অনতিবিলম্বে তোমার রাজ্য তোমার কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হবে, এবং তুমি শোচনীয়ভাবে বিনাশপ্রাপ্ত হবে।”এই ফলকলিপি ডাকযোগে প্রেরণ করা হয় সিজার কেটাফাগুর তত্ত্বাবধানে যিনি তাঁর নির্বাসনের সমস্ত বন্ধুর পরিচিত ছিলেন। এই সতর্কবাণীর মূল বচন পারস্যের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে, কারণ সেই সময় “কিতাবুল মুহিন”পারস্যে প্রচার করা হয়েছিল এই ফলকলিপি এই পুস্তকের মধ্যে ছিল। এটা ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে ঘটে, এবং যেহেতু সুরাতুল হাইকল পারস্যে ও ভারতে প্রচারিত হয় এবং সমস্ত বিশ্বাসীদের হস্তগত ছিল, তারা সবাই কি ঘটে দেখবার জন্য অপেক্ষা করছিল। ১৮৭০ সালের বেশি পরে নয়, জার্মানী ও ফ্রান্সের মধ্যে যুদ্ধ বেধে গেল। এবং সেই সময় কেউই জার্মানীর বিজয় আশা করতে পারে নাই, নেপোলিয়ান পরাজিত ও অসম্মাানীত হলেন। তিনি শত্রুদের কাছে আত্মসমর্পণ করলেন এবং তার যশ খ্যাতি গভীর হীনাবস্থায় পরিবর্তিত হল।

অন্যান্য রাজন্যবর্গের কাছেও ফলকলিপি প্রেরিত হয়েছিল এবং তাদের মধ্যে ছিলেন মহামান্য নাসির উদ্দিন শাহ্। উক্ত ফললিপিতে বাহা’উল্লাহ্ বলেন, “আমাকে আহ্বান করা হোক, উলেমাদের একত্র করুন, এবং যুক্তি প্রমাণ তলব করুন, যাতে সত্য ও মিথ্যা জানা যেতে পারে। মহামান্য নাসির উদ্দিন শাহ্ উক্ত ফলকলিপি উলেমাদের কাছে প্রেরণ করলেন এবং তাদের কাছে প্রস্তাব দিলেন যে, এই আহŸান তাদের মোকাবেলা করা উচিৎ। কিন্তু তারা কেউ ঐরূপ সাহস করে নাই। তখন তিনি তাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত সাতজনকে উক্ত আহুত বিষয়ের উত্তর লিখে পাঠাতে বলেন। কিছুক্ষণ পর তারা পত্রটি ফেরত দিল, এই বলে, “এই লোকটি ধর্মের বাধাপ্রদানকারী এবং শাহ্ এর শত্রু।” পারস্যের মহামন্য শাহ্ খুব বিরক্ত হলেন এবং বললেন, “এটা যুক্তি তর্কের প্রশ্ন এবং সত্য ও মিথ্যার প্রশ্ন; সরকারের সঙ্গে এর শত্রুতার কি আছে? আহা! কতই না এই আলেমাদের আমরা শ্রদ্ধা করতাম- যারা এই ফলকলিপিটির উত্তর দিতেও পারে না।”

সংক্ষেপে, ফলকলিপিতে রাজন্যবর্গের কাছে যা কিছু লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল, তার সবকিছুই পূর্ণ হচ্ছে। যদি ১৮৭০ থেকে যেসমস্ত ঘটনা সংঘটিত হয়েছে, তার সঙ্গে তুলনা করি, তাহলে আমরা অবশ্যই দেখতে পাব যে ভবিষ্যদ্বাণীকৃত প্রায় সবগুলিই ঘটেছে; শুধুমাত্র তার কিছু বাকী আছে যা পরবর্তীকালে প্রকাশিত হবে।

এইরূপ বিদেশী জ্ঞাতীবর্গ ও অন্যান্য সম্প্রদায়, যারা বাহা’উল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতেন না, তারা বাহা’উল্লাহ্র প্রতি অনেক বিস্ময়কর বস্তু আরোপ করেছেন। কেউ কেউ বিশ্বাস করতেন যে, তিনি একজন সাধু ছিলেন, কেউ কেউ তাঁর সম্বন্ধে রচনা করেছেন। তাদের মধ্যে একজন বাগদাদের সুন্নী পণ্ডিত সৈয়দ দাউদী একটি সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধ লেখেন, যার মধ্যে তিনি কতিপয় অলৌকিক কার্যাবলী লিপিবদ্ধ করেন। এমনকি এখনো প্রাচ্যের সমগ্র অংশে অনেক লোক আছে, যারা যদিও বাহা’উল্লাহ্র প্রত্যাদেশ ধর্মে বিশ্বাস করে না, তবুও তাঁকে একজন সিদ্ধ পুরুষরূপে বিশ্বাস করে এবং অলৌকিকত্বে বিশ্বাস করে।

সংক্ষেপে, তাঁর শত্রুগণ ও তাঁর পক্ষাভুক্ত লোকেরা এবং যাদের পবিত্র স্থান সমাদার করা হয়েছিল, সকলেই বাহা’উল্লাহ্র মহত্ব স্বীকার করেন ও এ বিষয়ে সাক্ষ্য দেন - যদিও তারা তাঁর উপর বিশ্বাস স্থাপন করেন নাই, তবু তারা তাঁর উচ্চভাব স্বীকার করতেন, পবিত্র স্থানে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই বাহা’উল্লাহ্র উপস্থিতি তাদের অধিকাংশের উপর এমনভাবে প্রভাব বিস্তার করতো যে, তারা কোন বাক্যই উচ্চারণ করতে পারতেন না। কতবার এটা ঘটেছে যে, তাঁর একজন ভীষণ শত্রু নিজের মধ্যে দ্রবীভূত হয়ে যেতেন, “আমি এই এই কথা বলব, যখন আমি তাঁর উপস্থিতিতে হাজির হব এবং আমি তাঁর সঙ্গে এইভাবে বাদানুবাদ ও যুক্তির অবতারণা করব।”কিন্তু যখন তিনি তাঁর পবিত্র উপস্থিতিতে প্রবেশ করতেন, তিনি বিস্মিত ও হতবুদ্ধি হয়ে পড়তেন ও নির্বাক থাকতেন।

বাহা’উল্লাহ্ কখনো আরবী পড়েন নাই, তাঁর কোন শিক্ষক ছিল না, তিনি কোন বিদ্যালয়েও প্রবেশ করেন নাই। এতদসত্তে¡ও আরবী প্রকাশ ভঙ্গিতে ও আরবী রচনাবলীতে তাঁর অনুপম ব্যাখ্যার বাগ্মীতা ও প্রাঞ্জলতা অধিকাংশ আরবীয় পণ্ডিতদের বিস্মিত ও বুদ্ধিভ্রংশ করে তুলতো এবং সকলেই স্বীকার করতেন ও ঘোষণা করতেন যে, তিনি তুলনাবিহীন।

যদি আমরা বাইবেলের মূল বচন সতর্কতার সহিত পরীক্ষা করি, আমরা দেখবো যে, স্বর্গীয় প্রকাশকে তথা বার্তাবাহককে যারা অস্বীকার করেছে, তাদের কখনো বলেন নাই, “যে কোন অলৌকিক বিষয় তোমরা কামনা কর, আমি সেটা ঘটাতে প্রস্তুত এবং তোমরা যে কোন পরীক্ষার প্রস্তাব করবে আমি সেটা দিতে প্রস্তুত।”কিন্তু শাহ্ এর কাছে প্রেরিত ফলকলিপিতে বাহা’উল্লাহ্ পরিষ্কারভাবে বলেন, “আলেমদের একত্র করুন ও আমাকে আহ্বন করুন, যাতে সাক্ষ্য-প্রমাণাদি প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।”

পঞ্চাশ বছর যাবত বাহা’উল্লাহ্ পাহাড়ের শত্রুদের মোকাবেলা করেন; সকলেই তাঁকে ধ্বংস করতে ও তাঁর বিনাশ কামনা করেছিল। হাজারবার তাঁকে ক্রুশে বিদ্ধ করে ধ্বংস করার পরিকল্পনা করে এবং এই পঞ্চাশ বছর যাবত তিনি স্থায়ী ভীতির মধ্যে অবস্থান করেন।

এই দিনে পারস্য এইরূপ অবক্ষয় ও ধ্বংস অবস্থায় বিরাজ করছে যে সকল বৃদ্ধিমান ব্যক্তি- পারস্যবাসী হউক অথবা বিদেশী হউক, যারা সত্য বিষয় অনুধাবন করে, তারা স্বীকার করে যে, এর প্রগতি, এর সভ্যতা এবং এর পুনর্গঠন এই মহাপুরুষের শিক্ষা-উপদেশাবলীর উপর ও মতবাদসমূহের উন্নয়নের উপর নির্ভর করে।

যীশুখ্রিষ্ট তাঁর আশীর্বাদপুষ্ট দিনগুলিতে প্রকৃতপক্ষে মাত্র এগারোজন লোককে শিক্ষা দিয়েছিলেন; তাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত ছিলেন পিটার, এতদসত্তে¡ও যখন তাকে পরীক্ষা করা হর, তিনি তিনবার খ্রিষ্টকে অস্বীকার করেন। এতদসত্ত্বেও যীশুখ্রিষ্টের এই ধর্ম পরবর্তীকালে সমগ্র পৃথিবীর মধ্যে অনুপ্রবেশ করে। বর্তমানযুগে বাহা’উল্লাহ্ হাজার হাজার লোককে শিক্ষা দিয়ে গড়ে তুলেছেন, যারা তরবারীর ভীতির সময় “ইয়া বাহা’উল্লাহ্ আব্হা”ধ্বনি সর্বোচ্চ স্বর্গে উত্তোলন করে এবং অগ্নিপরীক্ষার সময় তাদের মুখ-মণ্ডল স্বর্ণের আলোকচ্ছটায় পরিবর্তিত হয়। তাহলে চিন্তা কর ভবিষ্যতে কি ঘটবে।

উপসংহারে আমাদের অবশ্যই ন্যায়পর হতে হবে এবং স্বীকার করতে হবে, এই গৌরবমণ্ডিত মহাপুরুষ কত বড় শিক্ষাদাতা ছিলেন, কি বিস্ময়কর নির্দেশনাবলী তাঁর মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।

10
আধ্যাত্মিক প্রমাণসমূহ

এই জড়জগতে কালচক্র রয়েছে; পালাক্রমিক ঋতুসমূহের মাধ্যমে স্থানসমূহ পরিবর্তিত হয় এবং আত্মার জন্য রয়েছে উন্নতি, পশ্চাদ্ধাগমন তথা গুণের হ্রাস ও শিক্ষা কোন সময় বসন্ত ঋতু, কোন সময় শরৎ ঋতু, আবার কোন সময় গ্রীষ্ম ঋতু অথবা শীতকাল। বসন্তকালে আকাশে মেঘ দেখা দেয় যা মূল্যবান বারি বর্ষণ করে, কস্তুরী ঘ্রাণযুক্ত ও জীবনপ্রদায়ী মৃদুমন্দ সমীরণসমূহ প্রবাহিত করে; বায়ু সম্পূর্ণরূপে নাতিশীতোষ্ণ, বৃষ্টি পড়ে, সূর্য কিরণ বর্ষণ করে, ফলোৎপাদক প্রবাহমান বায়ু মেঘের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়, পৃথিবী নবরূপ লাভ করে, জীবনপ্রদায়ী শ্বাস-প্রশ্বাস উদ্ভিদ, প্রাণী ও মানুষের মধ্যে সঞ্চারিত হয়। পার্থিব বস্তুসমূহ এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থাপ্রাপ্ত হয়, সমস্ত বস্তুই নব সজ্জায় সজ্জিত হয় এবং কৃষ্ণ পৃথিবী যাবতীয় ঔষধীতে আবৃত হয়, পাহাড়-পর্বত ও সমতল ভূমিসমূহ সবুজ উদ্ভিদাদিতে সজ্জিত হয়, বৃক্ষরাজী, পত্রপুষ্প ও পুষ্পমুকুল ধারণ করে। উদ্যানসমূহ পুষ্প ও সুগন্ধি ঔষধি উৎপন্ন করে। বসুন্ধরা অন্য বসুন্ধরায় পরিবর্তিত হয় এটা জীবনপ্রদায়ী শক্তি লাভ করে। পৃথিবী ছিল নির্জিব দেহ; এটা লাভ করল একটি নতুন শক্তি এবং উৎপন্ন করলো সীমাহীন সৌন্দর্য, লাবন্য ও সতেজতা। এইরূপে বসন্ত হচ্ছে নবজীবনের কারণ এর নতুন তেজ অনুপ্রবিষ্ট করে।

এরপর আসে গ্রীষ্মকাল। তখন উত্তপ বৃদ্ধি পায় এবং ক্রমিক বৃদ্ধি ও সম্প্রসারণ তাদের সর্বোচ্চ শক্তিলাব করে। উদ্ভিদরাজ্যে জীবনশক্তি পূর্ণতার ধাপে পৌঁছায়, ফল দেখা দেয় এবং শষ্য সংগ্রহের কাল পূর্ণ হয়। একটি বীজ একটি শষ্যের আঁটিতে পরিবর্তিত হয় এবং শীতকালের জন্য খাদ্য সঞ্চয় করা হয়। পরবর্তীকালে আসে প্রচণ্ড শরৎকাল, যখন অস্বাস্থ্যকর ও অনুর্বর বায়ু প্রবাহিত হয়। এটা পীড়ার ঋতু, যখন সমগ্র বস্তু শুকিয়ে যায় এবং উপশমকারক বায়ু দূষিত হয়। বসন্তের মৃদুমন্দ সমীরণ শরৎকালের বায়ুতে পরিবর্তিত হয়, উর্বর সবুজ বৃক্ষরাজি শুকিয়ে নগ্ন হয়ে পড়ে, বৃক্ষরাজি ও সুগন্ধি ঔষধীসমূহ ম্লান হয়ে যায়, সুন্দর উদ্যানগুলি ধুলি স্তুপে পরিণত হয়। এরপর আসে শীতঋতু -শীত ও ঝড়ো বাতাসসহ। তখন তুষারপাত হয়, বৃষ্টি পড়ে, শিলাবৃষ্টি হয়, ঝড় ওঠে, বিদ্যুৎ চমকায়, বজ্রপাত হয়, শীতে জমে যায় এবং ঠাÐায় জমাট বাধে; উদ্ভিদগুল্ম সব মরে যায়, জীব জন্তু অবসন্ন ও দুর্দশাগ্রস্ত হয়।

যখন এইরূপ অবস্থায় পৌঁছে, পুনরায় জীবনপ্রদায়ী বসন্তকাল আগমন করে এবং কালচক্র নবায়িত হয়। বসন্তকাল বিরাট জাকজমকের সঙ্গে তার সতেজতা ও সৌন্দর্যের সেনাবাহিনীসহ পাহাড় পর্বতের উপর তার তাবু খাটায়। দ্বিতীয়বার প্রাণীকুলের আকৃতি নবায়িত হয় এবং অস্তিত্বের সৃষ্টি নতুন করে শুরু হয়; দেহ বৃদ্ধি ও বিকাশপ্রাপ্ত হয়, সমতল ভূমিসমূহ ও বীজন প্রদেশ সবুজ ও উর্বর হয়, বৃক্ষরাজি পুষ্পমুকুলে শোভিত হয় এবং গত বছরের বসন্তকাল চূড়ান্ত পূর্ণতা ও গৌরবের সঙ্গে প্রত্যাবর্তন করে। এইরূপই হয় এবং হয়ে থাকে কালচক্র ও অস্তিত্বের অনুক্রমধারী; এইরকমই হচ্ছে জড়-জগতের কালচক্র ও বিবর্তন।

বার্তাবাহকদের আধ্যাত্মিক কালচক্রসমূহ হচ্ছে ঐ একই রকমের। অর্থাৎ পবিত্র প্রকাশগণের (বার্কাবাহকদের) অবির্ভাবের দিনই হচ্ছে আধ্যাত্মিক বসন্তকাল- এটা ঐশ্বরীয় দীপ্তি, এটা স্বর্গীয় বদান্যতা, জীবনের মৃদুমন্দ সমীরণ, বাস্তবতার সূর্যোদয়। প্রকৃতি উজ্জীবিত হয়, অন্তঃকরণ সতেজ ও প্রাণবন্ত হয়, আত্মাসমূহ ভাল হয়, অস্তিত্ব গতিশীল হয়, মানবিক সত্তাগুলি আনন্দিত হয় এবং সুগুণাবলীও পূর্ণতাসমূহ তথা পরোৎকর্ষতার বৃদ্ধি ও বিকাশ লাভ করে। সার্বজনীন উন্নতি ঘটে এবং পুনরুত্থান ও বিলাপ ঘটে, যেহেতু এটাই বিচারের দিন তথা হাঙ্গামা ও দুঃখ-দুর্দশার সময় এবং যুগপৎ এটা আনন্দের, সুখের এবং সম্পূর্ণ আকর্ষণের ঋতু।

অতঃপর জীবনপ্রদায়ী বসন্তকাল, ফলোৎপাদী গ্রীষ্মকালে বিলীন হয়, আল্লাহ্র বাণী সমুন্নত হয়, আল্লাহ্র আইন বিঘোষিত হয়; সমস্ত জিনিস পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয়। স্বর্গীয় টেবিল বিস্তার করা হয়, পবিত্র মৃদুমন্দ বায়ু পূর্ব ও পশ্চিমকে সুবাসিত করে, আল্লাহ্র শিক্ষা-দীক্ষা পৃথিবী জয় করে, জনমণ্ডলী শিক্ষাপ্রাপ্ত হয়, প্রশংসনীয় ফল উৎপাদিত হয়, মানব জগতে সার্বজনীন উন্নতি দৃষ্টিগোচর হয় এবং স্বর্গীয় বদান্যতাসমূহ সমগ্র বস্তুকে বেষ্টন করে। বাস্তবতার সূর্য বৃহত্তম শক্তি ও উত্তাপসহকারে স্বর্গীয় রাজ্যের দিগন্ত থেকে উদিত হয়। যখন এটা চরম সীমায় পৌঁছায়, তখন এটা হ্রাস পেতে শুরু করবে এবং নেমে আসবে এবং আধ্যাত্মিক গ্রীষ্মকাল, শরৎকাল, তথা অবনতির সূচনাকাল দ্বারা অনুসারিত হবে এবং ক্রম বৃদ্ধি ও বিকাশ ধৃত হবে। মৃদুমন্দ সমীরণসমূহ অনিষ্টকর প্রভাব বিস্তারকারী প্রবাহমান বায়ুতে পরিবর্তিত হবে, এবং অস্বাস্থ্যকর ঋতু উদ্যানসমূহের সমতল ভূমি ও নিকুঞ্জসমূহের সৌন্দর্য ও সতেজতা হানি করে। অর্থাৎ আকর্ষণ ও শুভেচ্ছা থাকে না, স্বর্গীয় গুণাবলী পরিবর্তিত হয়, অন্তঃকরণসমূহের ঔজ্জল্য স্তিমিত হয়, আত্মাসমূহের আধ্যাত্মিকতা পরিবর্তিত হয়, পুণ্যাবলী পাপসমূহের দ্বারা অপসারিত হয়, পবিত্রতা ও শুদ্ধতা অদৃশ্য হয়ে যায়। শুধুমাত্র আল্লাহ্র ধর্মের নামটি বিদ্যমান থাকে এবং স্বর্গীয় শিক্ষাসমূহের বাহ্যিক খোলস তথা আকৃতিসমূহ টিকে থাকে। আল্লাহ্র ধর্মের ভিত্তিসমূহ ধ্বংস ও বিনাশপ্রাপ্ত হয়, বাহ্যিক আকৃতি ও রীতিনীতি এবং আচার অনুষ্ঠান ছাড়া আর কিছুই বিদ্যমান থাকে না। বিভাগসমূহ দেখা দেয়, দৃঢ়তা অস্থিরতায় পরিবর্তিত হয়, নৈতিক তেজশক্তি মৃতবৎ হয়; অন্তঃকরণসমূহ অবসন্ন হয়, আত্মাসমূহ অসার হয়ে পড়ে, এবং শীত ঋতুর আবির্ভাব হয়; অজ্ঞতার শীতলতা পৃথিবীকে আচ্ছন্ন করে, মানুষ ভ্রান্তির অন্ধকারে বিরাজ করে। এরপর আসে ঔদান্য, অবাধ্যতা, অবিবেচকতা, আলস্য, নীচতা, পশু প্রবৃত্তিসমূহ এবং পাথরের শীতদলতা ও অনুভূতিহীনতা। এটা শীত ঋতুর মত, যখন ভূমণ্ডল সূর্যতাপ থেকে বঞ্চিত হয়ে জনশূন্য ও বিষন্ন হয়ে পড়ে, বৃদ্ধি ও চিন্তার জগত যখন এই অবস্থায় পৌঁছে, তখন শুধুমাত্র ক্রমাগত মৃত্যু এবং চিরস্থায়ী অস্তিত্বহীনতা বিদ্যমান থাকে।

যখন শীত ঋতুর প্রভাব থকে, তখন পুনরায় আধ্যাত্মিক বসন্তকাল প্রত্যাবর্তন করে এবং একটি নতুন কালচক্র (যুগ) আবির্ভূত হয়। আধ্যাত্মিক মৃদুমন্দ সমীরণসমূহ প্রবাহিত হয়, উজ্জ্বল প্রভাত আলোক দান করে, স্বর্গীয় মেঘমালা বারি দান করে, বাস্তবতার সূর্যরশ্মি কিরণ বর্ষণ করে ঘটনপটিয়সী পৃথিবী নবজীবন লাভ করে ও বিস্ময়কর পর্যায় ভূষিত হয়। বিগত বসন্তকালের সমস্ত নির্দেশনাবলী ও উপসংহার পুনরায় উপস্থিত হয়- এমনকি এই নতুন ঋতুতে হয়তো বৃহত্তর দীপ্তিসহকারে উপস্থিত হয়।

বাস্তবতার সূর্যের আধ্যাত্মিক কালচক্রসমূহ জড় সূর্যের কালচক্রের অনুরূপ; এটা সর্বদাই বৃত্তাকারে ঘুরছে এবং নবায়িত হচ্ছে। জড় সূর্যের ন্যায় বাস্তবতার সূর্যের বহু উদয় ও প্রভাত স্থান আছে একদিন এটা কর্কট ক্রান্তির রাশিচক্র সংক্রান্ত চিহ্ন থেকে উদিত হয়, অন্য একদিন তুলা রাশির চিহ্ন থেকে উদয় হয়। আর একদিন মেষ রাশির চিহ্ন থেকে উদয় হয় এবং কিরণ পরিব্যপ্ত করে। কিন্তু সূর্য একটাই এবং একই বাস্তব সত্য, জ্ঞানী ব্যক্তিরা সূর্যের প্রেমিক এবং ্টরে উদয় ওপ্রভাতিক স্থানসমূহের দ্বারা মুগ্ধ হয় না। জ্ঞানী ও অনুভূতিসম্পন্ন লোকেরা সত্যানুসন্ধানী, এটার আবির্ভারের স্থানসমূহের অথবা এটার প্রভাতিক বিন্দুসমূহের অনুসন্ধানী নয়। অতএব তারা সূর্যকে ভালোবাসবে- তা সেটা রাশিচক্রের যে কোন বিন্দু থেকে আবিভর্‚ত হোক না কেন এবং তারা উক্ত বাস্তবতা অনুসন্ধান করবে সেই পবিত্র আত্মা ব্যক্তির মধ্যে যে এটাকে প্রকাশ করে। এইরূপ ব্যক্তিবর্গ সর্বদাই সত্য লাভ করে এবং স্বর্গীয় জগতের সূর্য থেকে পর্দাচ্ছাদিত হয় না। অতএব সূর্যের প্রেমিক ও আলোক অনুসন্ধানী সর্বদাই সূর্যের দিকে ফিরবে, তা সেটা মেষ রাশির চিহ্ন থেকে কিরণ দান করুক অথবা কর্কট রাশির দিক থেকে এর বদান্যতা দান করুক অথবা এটা মিথুন রাশির বিন্দু থেকে আলো বিকীর্ণ করুক; কিন্তু অজ্ঞ ও অশিক্ষিত ব্যক্তিবর্গ রাশিচক্রের চিহ্নসমূহের প্রেমিক এবং উদয়স্থানসমূহের দ্বারা মুগ্ধ হয়, সূর্যের দ্বারা নয়। যখন এটা কর্কট রাশির চিহ্নে বিদ্যমান ছিল, তখন তারা এটার দিকে মুখ ফিরিয়াছিল, যদিও পরে উক্ত সূর্য তুলারাশির চিহ্নে উদিত হয়েছিল; যেহেতু তারা ছিল চিহ্নের প্রেমিক, সেহেতু তারা এই চিহ্নে দিকে ফিরেছিল এবং নিজেদেরকে সেই চিহ্নের প্রতি সংযুক্ত রাখলো এবং তারা সূর্যের প্রভাবসমূহ থেকে বঞ্চিত রইল- শুধুমাত্র সূর্য তার স্থান পরিবর্তন করেছিল এই কারণে। উদাহরণস্বরূপ একদা বাস্তবতার সূর্য ইব্রাহিমের চিহ্ন থেকে তার কিরণ বর্ষণ করেছিল এবং অতঃপর এটা মুসার চিহ্ন থেকে উদয় হল এবং দিকচক্রাবাল আলোকিত করল; পরবর্তীকালে এটা বৃহত্তম শক্তি ও ঔজ্জ্বল্য তথা দীপ্তিসহকারে যীশুখ্রিষ্টের নিদর্শন থেকে উদিত হল; যারা বাস্তবতার অনুসন্ধানী ছিল , তারা এটার উপাসনা করল- যেখান থেকেই তারা এটা দেখুক না কেন; কিন্তু যারা ইব্রাহিমের প্রতি আসক্ত ছিল তারা এটার প্রভাবসমূহ থেকে বঞ্চিত হল -যখন এটা সিনাই এর উপর বিকীর্ণ হল এবং মুসার বাস্তবতা আলোকিত করল। যারা মুসার প্রতি দৃঢ় সংকল্প থাকলো- যখন বাস্তবতার সূর্য অত্যন্ত প্রভা ও দীপ্তিসহকারে যীশুখ্রিষ্ট থেকে কিরণ বর্ষণ করলো, তারাও পর্দাচ্ছাদিত থাকলো এবং এইভাবেই হয়ে আসছে।

অতএব মানুষকে অবশ্যই বাস্তবতার অনুসন্ধানী হতে হবে এবং সে ঐ বাস্তবতা উক্ত পবিত্র আত্মা-ব্যক্তিগুলির প্রত্যেকের মধ্যে নিহিত দেখবে। সে অবশ্যই স্বর্গীয় বদান্যতার প্রতি মৃগ্ধ, অত্যন্ত আহ্লাদিত ও আকর্ষিত থাকবে; তাকে প্রজাপতি সদৃশ হতে হবে, যে আলোর প্রেমিক - তা সে আলো যে প্রদীপ থেকেই বিকীর্ণ হোক না কেন এবং তাকে বুলবুল পক্ষী সদৃশ হতে হবে, যে গোলাপ ফুলের প্রেমিক, তা সে গোলাপ যে উদ্যানে প্রস্ফুটিত হোক না না কেন।

সূর্যকে পশ্চিমে উদিত হতে হলেও, তবুও এটা সূর্য; এটার উদয়স্থলের কারণে কোন লোকের এটাকে প্রত্যাখ্যান করা উচিত নয়। এটাকে তথা পশ্চিমকে সর্বদাই সূর্যাস্তের স্থান বলে গন্য করাও উচিত নয়। অনুরূপভাবে কোন লোককে স্বর্গীয় বদান্যতাসমূহের অনুসন্ধান করতে হবে এবং স্বর্গীয় ঊষাকালের অনুসন্ধান করতে হবে। যে কোন স্থানে এটা আবির্ভূত হোক, মানুষকে তার উন্মুক্ত প্রায় প্রেমিক হতে হবে। মনে মনে গভীরভাবে বিবেচনা কর, যদি ইহুদিরা মুসার দিগন্তের দিকে ফিরে থাকায় বহাল না থাকতো এবং শুধু যদি বাস্তবতার সূর্যকে গণ্য করতো, নিঃসন্দেহে তারা যীশুখ্রিষ্টের বাস্তবতার প্রভাতিক স্থানে সূর্যকে চিনতে পারতো তথা মেনে নিত - যা সর্বাপেক্ষা বৃহত্তম স্বর্গীয় দীপ্তিসহকারে বিকীর্ণ হয়েছিল্ কিন্তু ধিক! হাজার ধিক! মুসার বহির্দিকের বাণীর প্রতি নিজেদের সংযুক্ত রাখলো। তারা স্বর্গীয় বদান্যসমূহ ও জমকালো দীপ্তিসমূহ থেকে বঞ্চিত হল।

11
প্রকৃত ধন

প্রত্যেক অস্তিত্বশীল বস্তুর সম্মান ও মর্যাদায় উন্নতি সাধন, কারণ ও অবস্থার উপর নির্ভর করে। পৃথিবীর চরম উৎকর্ষতা, সৌন্দর্য সম্পাদন ও পূর্ণতা হচ্ছে বসন্তকালীন মেঘমালার বদান্যতার মাধ্যমে হরিৎ ও উর্বর হওয়া। উদ্ভিদ জন্মে পুষ্প ও সুগন্ধি ঔষধি গজিয়ে ওঠে, ফলদায়ী বৃক্ষরাজি পুষ্পমুকুলে পরিপূর্ণ হয়ে উঠে, তাজা ও নতুন ফল ধরে, উদ্যানসমূহ মনোহর হয়, তৃণবহুল প্রান্তর সুসজ্জিত হয়; পর্বত ও উন্মুক্ত প্রান্তরসমূহ সবুজ পোশাকে সজ্জিত হয় এবং বাগান, মাঠ, গ্রাম ও শহরগুলি সজ্জিত হয় এই হচ্ছে খনিজ জগতের সৌন্দর্য।

মর্যাদায় উন্নতি ও উদ্ভিদ জগতের পূর্ণতার সর্বোচ্চ মাত্রা এই যে, এতটি বৃক্ষ একটি বিশুদ্ধ জলস্রোতের কিনারে উৎপন্ন হোক, মৃদুমন্দ সমীরণ এটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হোক, রৌদ্রের উষ্ণতা এ্র উপর ঝিকমিক করুক, একজন উদ্যানপাল এটার তত্ত্বাবধান করুক এবং দিনে দিনে এটা বৃদ্ধি লাভ করুক এবং ফল প্রসব করুক। কিন্তু এটার প্রকৃত উন্নতি হচ্ছে প্রাণী ও মানব জগতের মধ্যে উন্নতি করা এবং যা কিছু মনুষ্য ও প্রাণী দেহে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে সেটা পুনঃস্থাপিত করা।

জীবজগতের উন্নতি লাভ হচ্ছে পূর্ণ অঙ্গ-প্রতঙ্গ, দেহযন্ত্র ও শক্তির অধিকারী হওয়া এবং প্রয়োজনীয় সবকিছুর সরবরাহ লাভ করা। এটাই এর প্রধান গৌরব, এর মান ও মর্যাদায় উন্নতি সাধন। সুতরায় একটি প্রাণীর সর্বোচ্চ সুখ হচ্ছে একটি সবুজ ও উর্বর প্রান্তর, সম্পূর্ণরূপে প্রবহমান বিশুদ্ধ জল এবং একটি মনোরোম হরিৎ জঙ্গলের অধিকার লাভ করা। যতি এইগুলি একে যোগান দেওয়া হয়, তাহলে এর চেয়ে বৃহত্তর আর কোন সৌভাগ্য বা উন্নতি কল্পনা করা যেতে পারে না। উদাহরণস্বরূপ যদি একটি পাখি একটি সবুজ ও ফলপূর্ণ জঙ্গলে একটি সুন্দর উচু জায়গায়, শক্ত গাছের উপর সুউচ্চ শাখায় তার বাসা তৈরী করে এবং এটা যদি তার প্রয়োজনীয় সমস্ত খাদ্য-বীজ ও জল প্রাপ্ত হয়, এটাই তার পূর্ণাঙ্গ সৌভাগ্য তথা উন্নতি ।

কিন্তু জীবের পক্ষে সৌভাগ্য প্রাণী জগত থেকে মনুষ্য জগতে অবস্থা-স্তরের মধ্যে নিহিত- ঠিক ক্ষুদ্রাণুক্ষুদ্র অস্তিত্বশীল বস্তুর মত, যা জল ও বায়ুর মাধ্যমে মানুষের মধ্যে প্রবেশ করে ও পরিপাক হয়ে রক্ত মাংসে মিশে যায় এবং যা কিছু তার শরীরে বা দেহে ক্ষয় হচ্ছে সেটা পুনঃস্থাপতি করে। এটা প্রাণী জগতের পক্ষে বড় সম্মান ও সৌভাগ্য; এর পক্ষে আর কোন বৃহত্তর সম্মান কল্পনা করা যায় না।

অতএব এটা পরিষ্কার এবং সুম্পষ্ট যে, এই সম্পদ, এই সাচ্ছন্দ, এবং জড় প্রাচুর্য, খনিজ, উদ্ভিদ ও প্রাণীর ধন-সৌভাগ্য গঠন করে। জড় জগতের কোন ধন, সম্পদ, সাচ্ছন্দ ও আরাম একটি পাখির ধনের সমান নহে; এই উন্মুক্ত প্রান্তরগুলির ও পর্বতসমূহের সমগ্র এলাকা এর বাসস্থান এবং সমস্ত বীজ ও ফসল এর খাদ্য ও সম্পদ এবং সমগ্র জমি, গ্রাম, তৃণবহুল প্রান্তর, চারণ ভূমি, জঙ্গল এবং বিজন প্রদেশ এর সম্পদ। এখন প্রশ্ন, কে ধনী? এই পাখিটি, অথবা সর্বাপেক্ষা ধনী ব্যক্তি? কারণ, যত বেশি বীজ এই পাখি ভক্ষণ করুক অথবা দান করুক, এর সম্পদ কমছে না।

তাহলে এটা পরিষ্কার যে, মানুষের সম্মান ও মর্যাদায় উন্নতি, পার্থিব ধনের চেয়ে বেশি কোন কিছু অবশ্যই আছে, পার্থিব স্বাচ্ছন্দ একটি শাখা মাত্র, কিন্তু মানুষের মর্যাদায় উন্নতি হচ্ছে সৎ গুণাবলী ও পূণ্য যা তার সত্ত্বার ভূষণ। এইগুলিই ঐশ্বরিক আবির্ভাব, স্বর্গীয় বদন্যতা, মহৎ আবেগ, আল্লাহ্র প্রেম ও জ্ঞান; সার্বিক বিজ্ঞতা, সদবৃদ্ধি সম্পন্ন অনুভূতি, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, ন্যায়পরতা, নিরপেক্ষতা, সত্যবাদিতা, উপকার করার ইচ্ছা, স্বাভাবিক সাহস, সহজাত সহিষ্ণুতা, অধিকার ও যুক্তি রক্ষার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, সর্বাবস্থায় সাধুতা, সকল লোকের মঙ্গলের জন্য কারুর নিজের জীবন উৎসর্গকরণ, সর্বজাতির প্রতি দয়া ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন; আল্লাহ্র শিক্ষাদীক্ষার প্রতি অনুগত্য, স্বর্গীয় জগতে সেবাদান, জনমণ্ডলীকে পধপ্রদর্শন, জাতি-উপজাতির শিক্ষা। এটাই মনুষ্য জগতের সৌভাগ্য তথা সাফল্য! এটাই পৃথিবীতে মানুষের মর্যাদার উন্নতি সাধন! এটাই শাশ্বত জীবন ও স্বর্গীয় সম্মান।

আল্লাহ্র শক্তির এবং স্বর্গীয় শিক্ষাসমূহের মাধ্যমে ব্যতীত, এই গুণাবলী মানুষের সত্ত্বা থেকে আবির্ভূত হয় না, কারণ এই গুলির প্রকাশের জন্য অলৌকিক শক্তির প্রয়োজন। এটা হতে পারে যে, প্রকৃতি জগতে এই পূর্ণতাসমূহের নিদর্শন দৃষ্টিগোচর হয়; কিন্তু সেগুলি প্রতিষ্ঠিত এবং স্থায়ী নয়; সেগুলি দেওয়ালের উপর সূর্যরশ্মি সদৃশ।

সহানুভূতিসম্পন্ন আল্লাহ এরূপ বিস্ময়কর মুকুট মানুষের মস্তকের উপর স্থাপন করেছেন। মানুষের উচিত কঠোর চেষ্টা করা যাতে এর দীপ্তিশীল রত্মসমূহ পৃথিবীতে দৃষ্টিগোচর হতে পারে।

খ্রিষ্টীয় বিষয়ে কিছু

12
বুদ্ধিবৃত্তি সংক্রান্ত ধারণা জ্ঞাপন করতে বাহ্যাকার ও প্রতীকসমূহ অবশ্যই ব্যবহৃত হয়ে থাকে

যে সমস্ত প্রশ্নের আমরা উল্লেখ করেছি এবং অন্যান্যগুলির সম্বন্ধে আমরা যা বলতে উদ্যত হয়েছি, এগুলি বুঝতে পারার জন্য একটি বিষয় অপরিহার্য- যাতে দুর্বোধ্য বিষয়গুলির উপাদান বা মূলাধার সম্বন্ধে জ্ঞাত হওয়া যেতে পারে- সেটা এই যে,ঃ মানুষের জ্ঞান দুই প্রকার। একটি হচ্ছে ইন্দ্রিয়ানুভ‚তির আহরিত জ্ঞান, অর্থাৎ চক্ষু, কর্ণ অথবা ঘ্রাণ শক্তি অথবা আস্বাদন অথবা স্পর্শ যে বস্তু নিজেকে অনুভব করতে পারে। এগুলি বস্তুগত বা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বলা হয়। যেহেতু সূর্যকে দেখা যায় সেহেতু এটা বস্তুগত; এবং অনুরূপভাবে শব্দসমূহ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য, যেহেতু কর্ণ সেগুলি শুনতে পায়; সুগন্ধিসমূহ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য, কারণ সেগুলি ঘ্রাণ শ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করা যায় এবং ঘ্রাণেন্দ্রিয় সেগুলিকে অনুভব করতে পারে; খাদ্য খাদক ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য, কারণ তালু তথা আস্বাদন সেগুলির মিষ্টত্ব, অম্লত্ব অথবা লবণক্ততা অনুভব শক্তি এগুলি অনুভব করে। এইগুলিকেই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বাস্তবতা তথা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বাস্তব পদার্থ বলে।

অন্যপ্রকার মনুষ্য জ্ঞান হচ্ছে বৃদ্ধিবৃত্তি সম্পন্ন অর্থাৎ চিন্তাশক্তি বাস্তবতা তথা বাস্তব সত্য। এটার কোন বাহ্যাকার এবং কোন স্থান নেই এবং এটা ইন্দিয়গ্রাহ্য নয়। উদাহরণস্বরূপ চিন্তাশক্তি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়; মানুষের আভ্যন্তরীণ গুণাবলীর কোনটাই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু নয়; পক্ষান্তরে সেগুলি বুদ্ধিবৃত্তি সম্পন্ন বাস্তবতা তথা বাস্তব সত্য। সুতরাং প্রেম একটি মানসিক বাস্তবসত্ত্বা, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, যেহেতু এই বাস্তব সত্ত্বা কর্ণ শ্রবণ করে না, চক্ষু দর্শন করে না, ঘ্রাণশক্তি অনুভব করে না, আস্বাদন শক্তি অনুভব করে না, স্পর্শ শক্তি অনুভব করে না। এমনকি অতি সুক্ষ্মপদার্থ, যার শক্তিকে পদার্থ বিদ্যায় উত্তাপ, আলো, বিদ্যুৎ এবং চুম্বক ধর্ম বলা হয়েছে, সেটা একটা বৃদ্ধিবৃত্তি সম্পন্ন বাস্তবতা, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়। অনুরূপভাবে প্রকৃতিও এর সারৎসার অস্তিত্বে, একটি বৃদ্ধিবৃত্তি সম্পন্ন বাস্তবতা, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, মনুষ্য চেতনা বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বাস্তবতা নয়। এই বুদ্ধিবৃত্তি সম্পন্ন বাস্তবতাগুলির যে কোন ব্যাখ্যার লোক এগুলিকে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য আকৃতিতে প্রকাশ করতে বাধ্য হয়। কারণ বাহ্য অস্তিত্বে এমন কোন কিছুই নাই যা জড় নয়। অতএব চেতনার বাস্তবতা, এর অবস্থা, এর অবস্থান ব্যাখ্যা করতে, মানুষ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুর আকারসমূহে এটার ব্যাখ্যা দিতে বাধ্য হয়, যেহেতু বাহ্য জগতে যা কিছু বিদ্যমান আছে, সবই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য । উদাহরণস্বরূপ, দুঃখ ও সুখ বুদ্ধিবৃত্তি সম্পন্ন জিনিস; যখন তুমি ঐ সমস্ত অশরীরি উপলব্ধিগুলি প্রকাশ করতে ইচ্ছা কর, তখন তুমি বলে থাকো, “আমার অন্তরে আঘাত দেওয়া হয়েছে; আমার অন্তর স্ফীত হয়েছে,।”যদিও মানুষের অন্তর আঘাত প্রাপ্ত ও স্ফীত হয় না। এটা একটা আধ্যাত্মিক তথা অশরীরি অথবা বুদ্ধিবৃত্তি সম্পন্ন অবস্থা, যা ব্যাখ্যা করতে তুমি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য আকৃতিসমূহের আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়ে থাক। অন্য উদাহরণ; তুমি বলে থাক “ এইরূপ এক ব্যক্তি বিরাট উন্নতি করেছিল।”যদিও সে একই স্থানে অবস্থান করছে; অথবা আবার বলে থাক, “এইরূপ একজনের পদমর্যাদা উন্নত হয়েছিল,” যদিও আরও ব্যক্তির ন্যায় সে পৃথিবীর উপর দিয়ে চলাফেরা করছে। এই মর্যাদা এই উন্নতি আধ্যাত্মিক তথা অশরিরী অবস্থা এবং বুদ্ধিবৃত্তি সম্পন্ন বাস্তবতা; কিন্তু সেগুলির ব্যাখ্যায় তুমি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য আকৃতির আশ্রয় নিতে বাধ্য হও, কারণ বাহ্য জগতে এমন কিছুই নাই যা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়।

অত্রএব জ্ঞানের প্রতীক আলো, এবং অজ্ঞতার প্রতীক অন্ধকার; কিন্তু গভীরভাবে চিন্তা কর জ্ঞান কি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য আলো এবং অজ্ঞতা কি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অন্ধকার? না এগুলি প্রতীক মাত্র। এগুলি বুদ্ধিবৃত্তি সম্পন্ন অবস্থা, কিন্তু তুমি যখন এগুলিকে বাহ্যিকভাবে প্রকাশ করতে ইচ্ছা কর, তখন তুমি জ্ঞানকে আলো বলে থাক এবং অজ্ঞতাকে অন্ধকার বলে থাক। তুমি বলে থাক, “আমার অন্তর বিষন্ন ছিল এবং আলোক উদ্ভাসিত হয়েছে।”এখন, উক্ত জ্ঞানের আলোক এবং অজ্ঞাতার বুদ্ধিবৃত্তি সম্পন্ন বাস্তবতা, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়; কিন্তু যখন আমরা বাহ্যিক জগতে এগুলি ব্যাখ্যা দিতে চেষ্টা করি, আমরা এগুলির ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য আকার দিতে বাধ্য হই।

তাহলে এটা সুস্পষ্ট, যে পায়রা যিশুখ্রিষ্টের উপর অবতরণ করেছিলেন সেটা জড় পায়রা ছিল কি না, কিন্তু এটা ছিল আধ্যাত্মিক অশরীরি অবস্থা, যা বোধগম্যের সাপেক্ষে, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য আকার দ্বারা প্রকাশ করা হয়েছিল। এইরূপে পুরাতন নিয়মে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ্ অগ্নিস্তম্ভে আবির্ভূত হয়েছিলেন; এতে জড় আকার বুঝায় না, এটা বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পন্ন বাস্তবতা, যা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য আকার প্রকাশ করা হয়েছে।

যিশুখ্রিষ্ট বলেন, “পিতা পুত্রের মধ্যে আছেন এবং পুত্র পিতার মধ্যে আছে।”যিশুই কি আল্লাহ্র মধ্যে ছিলেন, অথবা আল্লাহ্ খ্রিষ্টের মধ্যে ছিলেন? না, আল্লাহ্র শপথ! পক্ষান্তরে, এটা একটি বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পন্ন অবস্থা, যা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য আকারে প্রকাশ করা হয়েছে।

আমরা বাহা’উল্লাহ্র কথার ব্যাখ্যায় আসছি, যখন তিনি বলেনঃ “হে রাজন, সত্য সত্যই আমি অন্যান্য লোকদের ন্যায় নিজের শয্যায় ঘুমিয়ে ছিলাম; মহা গৌরবমণ্ডিত পরম পুরুষের মৃদুমন্দ সমীরণ আমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হল এবং যা কিছু বিদ্যমান আছে, তার সম্বন্ধে আমাকে জ্ঞান শিক্ষা দিল। এটা আমার নিকট থেকে নয়, এটা শক্তিমান ও বিজ্ঞের কাছ থেকে।”এটা প্রকাশের তথা অভিব্যক্তির অবস্থা, এটা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, এটা বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পন্ন বাস্তবতা, যা সময়, অতীত, ভবিষ্যত, বর্তমান তথা কালের বন্ধন থেকে মুক্ত; এটা একটা ব্যাখ্যা, উপমা, রূপক-উপমা এবং এটাকে আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করা যাবে না। এটা এমন অবস্থা নয় যা মানুষ হৃদয়ঙ্গম করতে পারে। নিদ্র ও জাগরণ হচ্ছে এক অবস্থা থেকে অপর এক অবস্থা প্রাপ্তি। নিদ্রা হচ্ছে বিশ্রামের অবস্থা, জাগরণ হচ্ছে নড়া-চড়ার অবস্থা; নিদ্রা হচ্ছে মৌনতার অবস্থা, জাগরণ হচ্ছে কথা-বার্তার অবস্থা; নিদ্রা হচ্ছে রহস্য, জাগরণ হচ্ছে প্রকাশ বা অভিব্যক্তির অবস্থা।

উদাহরণস্বরূপ “পৃথিবী ঘুমন্ত ছিল এবং বসন্ত এলো ও এটা জেগে উঠলো; অথবা পৃথিবী মৃত ছিল এবং বসন্ত এলো ও এটা পুনরুজ্জীবিত হল”- একটা পার্সী ও আরবীয় বাগধারা। এই অভিব্যক্তিগুলি অর্থের তাৎপর্য জগতে রূপক, উপমা, গূঢ় ব্যাখ্যা।

সংক্ষেপে, পবিত্র প্রকাশগণ (বার্তাবাহকগণ) চিরকালই উজ্জ্বল বাস্তবতা আছেন এবং থাকবেন; তাঁদের সারৎসার অস্তিত্বে কোন পরিবর্তন ঘটে না। তাঁদের প্রকাশ ঘোষণার পূর্বে, তাঁরা একজন ঘুমন্ত লোকের ন্যায় নীরব ও শান্ত থাকেন এবং তাদের প্রকাশের পর তাঁরা কথা বলেন ও আলোক উদ্ভাসিত হন- ঠিক একজন জাগ্রত ব্যক্তির ন্যায়।

13
পূর্ব নির্ধারিত অদৃষ্ট

(সৃষ্টির সময় থেকেই আল্লাহ্ সবকিছুর ভাগ্য নির্ধারণ করেছেন- এই মতবাদ)

প্রশ্ন: কোন লোকের দ্বারা কোন কাজ ভবিষ্যতে সম্পাদিত হবে এবং আল্লাহর যদি সে জ্ঞান থাকে এবং যদি সেটা ভাগ্যের ফলকলিপিতে লিখিত থাকে, তাহলে কি সেটা প্রতিহত করা সম্ভব?

উত্তর: কোন বিষয়ের পূর্বজ্ঞান, সেই বিষয় কার্যে পরিণত হওয়ার কারণ নহে; কারণ আল্লাহ্র অপরিহার্য জ্ঞান, অনুরূপভাবে বস্তু বা বিষয়সমূহের বাস্তবতাকে তথা বাস্তব সত্ত¡াকে তাদের অস্তিত্বের পূর্বে ও পরে উভয় সময়কেই বেষ্টন করে রয়েছে এবং এটা তাদের অস্তিত্বের কারণ হয় না। এটাই আল্লাহর পূর্ণতা তথা পরোৎকর্ষতা। কিন্তু বাইবেলের প্রতিশ্রুত পুরুষের আবির্ভাব সম্বন্ধে যা কিছু আল্লাহ্র অনুপ্রেরণার দ্বারা বার্তাবাহকদের রসনার মাধ্যমে ভবিষদ্বাণী করা হয়েছিল, সেইটাই যীশুখ্রিষ্টের প্রকাশের কারণ ছিল না।

ভবিষ্যতের নিহিত গুপ্ত রহস্য বার্তাবাহকদের নিকট প্রকাশ করা হয়েছিল এবং এইরূপেই তাঁরা ভবিষ্যত ঘটনাবলীর সহিত পরিচিত হয়েছিলেন এবং সেটাই তাঁরা ঘোষণা করেছিলেন। এই জ্ঞান, এই ভবিষ্যতদ্বাণীসমূহ ঘটনা সংঘটনের কারণ নহে। উদাহরণস্বরূপ, অদ্য রজনী সবাই জানে যে, সাত ঘণ্টা পরা সূর্য উদিত হবে কিন্তু এই সাধারণ পূর্ব জ্ঞান সূর্যের উদয় এবং আবির্ভাব ঘটায় না।

সুতরাং সম্ভাব্য ক্ষেত্রে আল্লাহ্র জ্ঞান বস্তুনিচয়ের আকারসমূহ উৎপন্ন করে না; পক্ষান্তরে এই জ্ঞান অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত থেকে পূত-পবিত্র। এটা বস্তুনিশ্চয়ের তথা বিষয়সমূহের বাস্তবতার তথা বাস্তব সত্ত্বার সহিত অভিন্ন; এটা তাঁদের সংঘটনের কারণ নয়।

অনুরূপভাবে পুস্তকে কোন বস্তু বা বিষয়ের উল্লেখ এবং লেখা উক্ত পুস্তকের কারণ হয় না। বার্তাবাহকগণ স্বর্গীয় অনুপ্রেরণার মাধ্যমে জানতেন ভবিষ্যতে কি ঘটবে। উদাহরণস্বরূপ, ঐশ্বরীক অনুপ্রেরণার মাধ্যমে তাঁরা জানতেন যে, যিশুখ্রিষ্ট শহীদ হবেন এবং তাঁরা এটা ঘোষণা করেছিলেন, এক্ষণে তাঁদের জ্ঞান ও তথা যীশুখ্রিষ্টের শহীদ হওয়ার কারণ কি ছিল? না, এই জ্ঞান হচ্ছে বার্তাবাহকদের পূর্ণতা তথা পরোৎকর্ষতা এবং এটা শহীদের মৃত্যু ঘটায় নাই।

জ্যোতিশ্চাস্ত্রীয় গণনার দ্বারা গণিতবিদরা জানেন যে, একটি নির্দিষ্ট সময়ে চন্দ্রগ্রহণ অথবা সূর্যগ্রহণ দেখা যাবে। নিশ্চয়ই এই আবিষ্কার চন্দ্রগ্রহণ ঘটায় না। এটা অবশ্য শুধুমাত্র আংশিক মিল বা সাদৃশ্য, আসল সাদৃশ্য নয়।

ঐশী প্রকাশগণের শক্তি ও অবস্থাগুলি সম্বন্ধে

14
আত্মার পাঁচটি দিক

জেনে রাখ যে, সাধারণতঃ বলতে গেলে আত্মার পাঁচটি বিভাগ আছে। প্রথম উদ্ভিদ আত্মা; এটা একটা শক্তি বিশেষ যা ঐশী শক্তি আদেশক্রমে পরমাণুর (মৌলিক পদার্থসমূহের) সংযোগ ও পদার্থসমূহের সংমিশ্রণ এবং অপরাপর অস্তিত্বের শক্তি, গুণ ও সম্পর্ক থেকে উৎপন্ন হয়। যখন ঐ সকল পদার্থ ও পরমাণু পরস্পর থেকে পৃথক করা হয়, তখন এদের বর্ধিত হওয়ার শক্তিও রহিত হয়ে যায়। সুতরায় আর এক প্রকার অলঙ্কারপূর্ণ ভাষায় বলতে হয় যে, পরমাণুসমূহের সংযোগে তড়িৎশক্তি উৎপন্ন হয় এবং যখন এই সকল পরমাণু পৃথক করা হয়, তখন তড়িৎ শক্তি বিক্ষিপ্ত ও নষ্ট হয়ে যায়। উদ্ভিদ আত্মা এইরূপই। এর পরই জীবাত্মা, এটাও পরমাণু সংযোগ ও সংমিশ্রণে থেকে উৎপন্ন হয়; কিন্তু এই সংমিশ্রণ অধিকতর পূর্ণ ও সর্বশক্তিমান প্রভুর অনুজ্ঞাক্রমে একটি পূর্ণাঙ্গ সংমিশ্রণ সাধিত হয় এবং জীবাত্মা, অন্য কথায়, ইন্দ্রিয়গণের শক্তি উৎপাদিত হয়। যা দৃষ্ট ও প্রত্যক্ষ, শ্রুত, ভক্ষা, স্পর্শযোগ্য ও ঘ্রাণযোগ্য তা থেকে এটা বস্তুসমূহের বাস্তবতা তথা বাস্তব সত্তা¡ উপলব্ধি করে। সংযুক্ত পরমাণুসমূহের বিযুক্ততা ও বিয়োজনের পরে, এই আত্মাও স্বভাবতঃ অদৃশ্য হয়। এ্টা এই প্রদীপের ন্যায়, যা তুমি দেখছ; যখন তেল, শলিতা, অগ্নি একত্র করা হয় তখন আলোকই হয় তার ফল; কিন্তু যখন তেল শেষ হয়ে যায় এবং শলিতা ক্ষয়প্রাপ্ত হয় তখন অলোকও অদৃশ্য হয় ও বিনষ্ট হয়।

মানবীয় আত্মাকে স্ফটকের উপর দীপ্তিমান সূর্যের উদারতার সহিত তুলনা করা যেতে পারে। মানব দেহ মৌলিক পদার্থসমূহ থেকে প্রস্তুত। এটা অতি পূর্ণ গঠনে সংযুক্ত সংমিশ্রিত; এটা অতি নিরেট নির্মাণ, শ্রেষ্ঠতম সংযোগ, অতি পূর্ণাঙ্গ অস্তিত্ব। এটা জীবাত্মার মাধ্যমে জন্মে ও বিকশিত হয়। এই পূর্ণকৃত দেহকে স্ফটকের সহিত তুলনা করা যেতে পারে এবং এই মানবীয় আত্মাকে সূর্যের সহিত তুলনা করা যেতে পারে। তবুও যদি স্ফটকটি ভেঙ্গে যায়, সূর্যের দান চলতে থাকবে এবং যদি স্ফটিক বিনষ্ট হয় বা এর অস্তিত্ব লোপ পায়, সূর্যের দানের কোন ক্ষতি ঘটে না, কারণ এটা চিরস্থায়ী। এই আত্মা আবিষ্কারের ক্ষমতা রাখে, এটা সকল বস্তুকে পরিবেষ্টন করে। এই সমুদয় আশ্চর্যজনক নিদর্শন, এই সমুদয় বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, অসমসাহসিক কাজ, এবং সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনাসমূহ যা আমরা জানি, সমস্তই এর কারণ হয়েছে। অদৃশ্য ও গুপ্ত রাজ্য থেকে আধ্যাত্মিক শক্তি সহকারে এটা তাদেরকে দৃশ্যমান জগতে এনেছে। এইরূপে মানুষ যদিও ধরাবক্ষে বিচরণ করে, তবুও সে নভোমণ্ডলে আবিষ্কার কার্য চালায়। জ্ঞাত ও দৃষ্ট তথা প্রত্যক্ষ বস্তুসমূহ থেকে অজ্ঞাত বস্তুসমূহ আবিষ্কার করে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, মানুষ এই অর্ধগোলকে বিদ্যমান আছে কিন্তু কলম্বসোর ন্যায় তার বিচার শক্তির বলে সে আর একটি অর্ধগোলক আবিষ্কার করে অর্থাৎ আমেরিকা, যা তখনও পর্যন্ত অজ্ঞাত ছিল তার দেহ ভারী, কিন্তু তার উদ্ভাবিত যন্ত্রের সাহায্যে সে ঊর্ধ্ব আকাশে উড়তে সক্ষম। তার গতি মন্থর, কিন্তু তার উদ্ভাবিত যন্ত্রের সাহায্যে সে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে পূর্ব-পশ্চিম দেশসমূহে পরিভ্রমণ করে। সংক্ষেপে এই শক্তি সকল বস্তুকে অন্তর্ভূক্ত করে।

কিন্তু মানব আত্মার দুটি দিক আছেঃ একটি ঐশী, আরেকটি শয়তানী তথা পাশবিক অর্থাৎ এটা পরম পূর্ণতা অর্জনে সমর্থ অথবা চরম অপূর্ণতা অর্জনে সমর্থ। যদি এটা সৎ গুণাবলী অর্জন করে, তাহেলে এটা সজীব প্রাণীদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ এবং যদি এটা পাপ অর্জন করে তকে এটা নিকৃষ্টতম অস্তিত্বে পরিণত হয়।

আত্মার চতুর্থ সোপান হচ্ছে “স্বর্গীয় আত্মা”এটা বিশ্বাসের আত্মা এবং আল্লাহ্র দান; এটা পবিত্র আত্মার নিঃশ্বাস থেকে এসে থাকে এবং ঐশী শক্তির সাহায্যে এটা চিরস্থায়ী জীবনের কারণ হয়। এটা ঐ শক্তি যা সংসারাশক্ত মানবকে স্বর্গীয় মানবে পরিণত করে এবং অসম্পূর্ণ মানবকে সম্পূর্ণ মানবে পরিণত করে। এটা অপবিত্রকে পবিত্র করে, এটা বাগশূন্যকে বাগপটু করে; যারা কামাদি রিপুর বন্দী হয়েছে, তাদেরকে এটা বিশুদ্ধ, পূত-পবিত্র করে; এটা অজ্ঞ ব্যক্তিকে বিজ্ঞ করে।

আত্মার পঞ্চম সোপান হচ্ছে “পবিত্র আত্মা।” এই পবিত্র আত্মাই আল্লাহর ও তাঁর সৃষ্ট জীবদের মধ্যে একজন মধ্যবর্তী পুরুষ। এটা সূর্যের অভিমুখী একটি দর্পনের ন্যায়। যেমন একটি পরিষ্কার দর্পন সূর্য থেকে আলোক গ্রহণ করে এবং এই দান অন্যের দিকে পরিচালিত করে, তেমনই পবিত্র আত্মা বাস্তবতার সূর্য থেকে পবিত্র আলোকের মধ্যবর্তী পুরুষ, যা এটা পবিত্র বাস্তবতা তথা বাস্তব সত্ত্বার তথ্যসমূহ প্রদান করে। এটা সমুদয় ঐশী পূর্ণতায় অলংকৃত। প্রত্যেকবার এটা যখন প্রকাশিত তথা আবির্ভূত হয়, তখন পৃথিবী নবায়িত হয় এবং একটি সব যুগের (নতুন ঐশী প্রকাশের) ভিত্তি স্থাপিত হয়। মানবজগতের দেহ একটি নতুন পরিচ্ছদ পরিধান করে। এটাকে বসন্ত ঋতুর সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে, যখন এটার আগমন হয়, পৃথিবী এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় পরিবর্তিত হয়। বসন্ত ঋতুর সমাগমে কৃষ্ণবর্ণ মৃত্তিকা, ময়দান ও মরুভূমিগুলি হরিদ্বর্ণবিশিষ্ট ও লাবণ্যযুক্ত হবে এবং সকল প্রকারের পুষ্প ও সুভাসিত উদ্ভিদ উৎপন্ন হবে; বৃক্ষরাজি নবজীবন লাভ করবে এবং নতুন ফল প্রসব করবে এবং এক নতুন কালচক্র (যুগ) প্রতিষ্ঠিত হবে। পবিত্র পরমাত্মার আর্বিভাব এরই ন্যায়। যখন এর আবির্ভাব হয় তখন এটা মানব জগতকে নবায়িত করে এবং মানবীয় বাস্তবতাকে নবজীবনীশক্তি প্রদান করে, এটা অস্তিত্ব জগতকে এক প্রশংসনীয় পরিচ্ছদে সজ্জিত করে; এটা অজ্ঞতার অন্ধকার বিদূরিত করে এবং পূর্ণতাসমূহের আলোকের বিকীরণ সৃষ্টি করে। যীশুখ্রিষ্ট শক্তি বলে এই কালচক্র নবায়িত করেছেন; স্বর্গীয় বসন্তকাল চরম নবীনত্ব ও মাধুর্যসহকারে মানব জগতে এটার শিবির বিস্তার করেছে এবং জীবনপ্রদ মৃদু সমীরণ জ্ঞানাদীপ্ত ব্যক্তিগণের নাসারন্ধ সুবাসিত করেছে। সেই একই নিয়মে বাহা’উল্লাহ্র আবির্ভাব এক নব বসন্তকালের আগমন সদৃশ ছিল, যা পবিত্র মৃদুমন্দ বায়ুসহকারে চিরস্থায়ী জীবনের বাহিনীগণের সঙ্গে এবং স্বর্গীয় শক্তি নিয়ে উপস্থিত হয়েছিল। এটা পৃথিবীর কেন্দ্রস্থলে স্বর্গীয় রাজ্যের সিংহাসন স্থাপিত করেছিল এবং পবিত্র পরমাত্মার শক্তিবলে আত্মাগণকে পুনঃজীবিত করেছিল এবং এক নতুন যুগের প্রতিষ্ঠা করেছিল।

15
একমাত্র ঐশী প্রকাশগণের মাধ্যমেই ঐশীত্ব বোধগম্য হয়ে থাকে

(আল্লাহ্কে জানতে পারা যায়)

প্রশ্ন : মহৎ উদয় স্থানসমূহের ও স্বর্গীয় প্রভাত বিন্দুসমূহের (বার্তাবাহকদের) সঙ্গে ঐশীত্বের (খোদাইত্বের) বাস্তব সত্ত্বার কি সংযোগ রয়েছে?

উত্তরঃ জেনে রাখ যে, ঐশীত্বের বাস্তব সত্ত্বা বা একত্বের সারৎসারের অস্তিত্ব হচ্ছে অবিমিশ্র পবিত্রতা ও শর্তশূন্য পবিত্রতা অর্থাৎ এটা পবিত্রকৃত ও সকল প্রশংসা থেকে মুক্ত। এই স্তর (ঐশীত্ব) সম্পর্কে অস্তিত্বের স্তরগুলির সর্বোচ্চ গুণাবলীর সমস্তই কল্পনা মাত্র। এটা অদৃশ্য, অবোধ্য, অগম্য, এক পবিত্র সারবস্তু যা বর্ণনা করা যায় না, কারণ ঐশী সারবস্তু তথা স্বর্গীয় অস্তিত্ব সকল বস্তুকে পরিবেশন করে। নিশ্চয়ই যা পরিবেষ্টন করে, তা পরিবেষ্টিত থেকে উৎকৃষ্টতর এবং বেষ্টিত কিছু এটা ধারণ করতে পারে না যা দ্বারা এটা পরিবেষ্টিত এবং এটার বাস্তব সত্ত্বা উপলব্ধি করতে পারে না। মন যতই অগ্রসর হোক না কেন, যদিও এটা উপলব্ধির শেষপ্রান্তে ও বোধগম্যের শেষ সীমায় পৌঁছে, তথা এটা কেবল সৃষ্টি জগতেই স্বর্গীয় নিদর্শনাবলী ও গুণাবলী দেখতে পায়, ঐশী জগতে নয়। কারণ একতার প্রভুর সারৎসার ও বিশেষ গুণাবলী পবিত্রতার উচ্চ শিখরে রয়েছে এবং মন ও বোধশক্তিগুলির জন্য সেই অবস্থানের সমীপবর্তী হওয়ার কোন পথই নাই্ “পথ অর্গলবদ্ধ এবং অনুসন্ধান নিষিদ্ধ।”

এটা সুস্পষ্ট যে, মানবীয় বোধশক্তি মানবের অস্তিত্বের একটি গুণ এবং মানব একটি ঐশী নিদর্শন। নিদর্শনের গুণ কিরুপে নিদর্শনের সুষ্টিকর্তাকে বেষ্টন করতে ( উপলব্ধি) পারে? অর্থাৎ ধীশক্তি যা মানব অস্তিত্বের একটি শক্তি, সেটা কিরুপে আল্লাহ্কে বুঝতে পারে? সুতরাং ঐশী বাস্তবতা সর্বপ্রকার অনুভ‚তি থেকে গুপ্ত এবং সকল মানুষের মন থেকে লুকায়িত। সেই স্তরে অরোহণ করা সম্পূর্ণরূপে অসম্ভব। আমরা দেখতে পাই যে, নিম্নস্তরের বস্তু, উচ্চ স্তরের বস্তুকে উপলব্ধি করতে অক্ষম। এমতে প্রস্তর, মৃত্তিকা, বৃক্ষ এরা যত বেশিই বিবর্তিত হোক না কেন মনুষ্য বাস্তবতা বুঝতে পারে না এবং এরা দৃষ্টি, শ্রবণ ও অপর ইন্দ্রিয়গুলির শক্তির কল্পনা তথা ধারণা করতে পারে না, যদিও তারা সবাই সমভাবে সৃষ্ট হয়েছে। সুতরাং কিরুপে এই সৃষ্ট মানুষ, সৃষ্টিকর্তার পবিত্র অস্তিত্বের বাস্তবতা বুঝতে পারে? এই স্তর বুদ্ধিশক্তির অনধিগম্য, এর অনুভূতির জন্য কোন ব্যাখ্যাও যথেষ্ট নয় এবং এটা প্রকাশ করতে পারে এমন কোন শক্তি নাই। ধুলির একইি পরমাণুর পক্ষে পবিত্র জগতের কি করার আছে এবং এই সীমাবদ্ধ মন ও অসীম জগতের মধ্যে সম্পর্ক কি রয়েছে? মন আল্লাহকে উপলব্ধি করতে অক্ষম এবং আত্মা তাঁকে ব্যাখ্যা করতে যেয়ে বিহ্বল হয়ে পড়ে। “চক্ষু তাঁকে দেখতে পায় না, কিন্তু তিনি চক্ষুকে দেখতে পান। তিনি সর্বজ্ঞানী, সর্বজ্ঞ।”

অতএব, অস্তিত্বের এই স্তর সম্বন্ধে প্রত্যেক ব্যাক্যা ও বর্ণনা অসম্পূর্ণ, সকল প্রশংসা ও সকল বিবরণ অযোগ্য, প্রত্যেক দারণা নিরর্থক এবং প্রত্যেক চিন্তা (ধ্যান) অসার। কিন্তু অস্তিত্বসমূহের এই অস্তিত্ব, সত্যসমূহের এই সত্য, রহস্যসমূহের এই রসহ্যের জন্য অস্তিত্ব জগতে প্রতিফলন, ঊষাকাল, আবির্ভাব এবং দীপ্তিসমূহ রয়েছে। এই সমুদয় উজ্জ্বলতার (জ্যোতির) আবির্ভাব তথা প্রকাশ স্থান এবং এই সকল ঐশী প্রকাশের আবির্ভাব হচ্ছে পবিত্র প্রকাশ স্থল (পবিত্র ঐশী প্রকাশগণ) সার্বজনীন বাস্তবতা ও স্বর্গীয় মহাপুরুষ, যারা আল্লাহ্র পবিত্র সারৎসারের দর্শন। সামগ্রিক পূর্ণতা, বদান্যতা, উজ্জ্বলতা যা আল্লাহ্র নিকট থেকে আসে, তা পবিত্র ঐশী প্রকাশগণের বাস্তব সত্ত্বার দৃষ্ট ও সুস্পষ্ট, এটা সূর্য সদৃশ, যা একটি স্বচ্ছ দর্পনে এর সকল পূর্ণতা ও বদান্যতাসহ প্রতিফলিত ও উজ্জ্বল হয়। যদি এটা বলা যায় যে, দর্পনগুলি সূর্যের প্রকাশগণ এবং উদয়মান নক্ষত্রের বিকাশ স্থানসমূহ, এতে এই বুঝায় না যে, সূর্য তার পবিত্র উচ্চ শিখর থেকে অবতরণ করেছে এবং দর্পনের মধ্যে দেহ ধারণ করেছে, কিংবা এটাও বুঝাও না যে, অসীম বাস্তবতা প্রকাশের এই স্থানে আবদ্ধ হয়ে রয়েছে। আল্লাহ্ না করুক! এটাইত অবতারবাদীগণের (যারা আল্লাহ্র প্রতি মানবীয় রূপ-প্রকৃতি আরোপ করে তাদের) বিশ্বাস। না; সকল প্রশংসা, বর্ণনা ও গৌরব, পবিত্র ঐশী প্রকাশগণের প্রতিই আরোপ করা হয়। অর্থাৎ সমুদয়, বিবরণ, গুণাবলী, নামাবলী ও বিশেষণগুলি, যা আমরা বর্ণনা করি, তা সকলই ঐশী প্রকাশগণের নিকট প্রত্যাগমন করে; কিন্তু যখন কেউই ঐশীত্বের সারৎসারের (অস্তিত্বের) বাস্তবতায় পৌঁছাতে পারে নাই, থখন কেউই এর বর্ণনা, ব্যাখ্যা, প্রশংসা ও যশকীর্তন করতে সক্ষম নং। সুতরাং মানবীয় বস্তু সত্ত্বা, আল্লাহর নামাবলী, গুণাবলী ও পূর্ণতাসমূহ সম্বন্ধে সবাই যা কিছু জানে, আবিষ্কার করে এবং উপলব্ধি করে তার সবকিছুই এই সকল পবিত্র ঐশী প্রকাশগণের সম্বন্ধে প্রযোজ্য। এছাড়া অন্য কিছুতে প্রবেশাধিকার নেই; “পথরূদ্ধ এবং অনুসন্ধান নিষিদ্ধ।”

এতদসত্ত্বেও আমরা ঐশী বাস্তবতার নামাবলী, গুণাবলীর কথা বলে থাকে এবং তাঁর প্রতি দৃষ্টিশক্তি, জীবন ও জ্ঞান আরোহণ করে তাঁর প্রশংসা করে থাকি। আল্লাহর পূর্ণতা প্রমাণ করার জন্য আমরা তাঁর সম্বন্ধে এই সকল নামাবলী ও গুণাবলী নিশ্চয় বলি না, বরং এটা অস্বীকার করার জন্য যে, তিনি অস্পূর্ণতা দোষের অধিকারী। যখন আমরা বিদ্যমান জগতের দিকে দৃষ্টিপাত করি, আমরা দেখতে পাই যে, অজ্ঞতাই অস্পূর্ণতা এবং জ্ঞানই পূর্ণতা, সুতরাং আমরা বলে থাকি যে, আল্লাহ্র পবিত্র অস্তিত্বের সারৎসারই বিজ্ঞতা। দুর্বলতাই অসম্পূর্ণতা এবং শক্তিই পূর্ণতা। অতএব আমরা বলে থাকি যে, আল্লাহ্র পবিত্র অস্তিত্বের সারৎসার আল্লাহ্র শক্তির সর্বোচ্চ সীমা। এটা এই নয় যে, আমরা তাঁর জ্ঞানের, তাঁর দৃষ্টি শক্তির, তাঁর সামথের জীবনের সম্বন্ধে উপলব্ধি করতে পারি, কারণ এটা আমাদের উপলব্ধির সীমার বাইরে, কারণ আল্লাহ্র মৌলিক সত্য সম্বন্ধীয় নামাবলী ও গুণাবলী তাঁর অস্তিত্বের সারৎসারের সহিত অভিন্ন এবং তাঁর অস্তিত্বের সারৎসার বোধগম্যের ঊর্ধ্বে। যদি গুণাবলী ঐশী অস্তিত্বের সারৎসারের সহিত অভিন্ন না হয়, তাহলে পূর্ববর্তী সত্ত্বাসমূহের বদান্যতার নিশ্চয়ই সংখ্যার বহুত্বও হতে হবে এবং গুণাবলী ও ঐশী সারৎসার অস্তিত্বের মধ্যে বিভিন্নতাসমূহও বিরাজমান থাকবে এবং যখন পূর্ববর্থী সত্ত্বা অত্যাবশ্যকীয় সুতরাং পূর্ববর্তী সত্ত্বাসমূহের পর্যায়ক্রমও অসংখ্য হবে, এটা একটি সুস্পষ্ট ভ্রান্তি।

তদানুসারে এই সমুদয় নামাবলী, গুণাবলী প্রশংসা ও স্তুতিবাদ ঐশী প্রকাশ স্থানসমূহের প্রতি প্রয়োগ করা হয় এবং এইসকল ব্যতীত অপর যেসকল বিষয় আমরা কল্পনা ও অনুমান করি, তা কেবলই কল্পনা, কারণ যা অদৃশ্য ও অগম্য, তা উপলব্ধি করার আমাদের কোন উপায় নেই। এই জন্যই বলা হয়ে থাকেঃ “তোমার কুট মানসীক কাল্পনিক চিত্রসমূহে তোমার কল্পনার বিভ্রান্তির মধ্য দিয়ে যা কিছুই তুমি পার্থক্য করেছ. এটা তোমর নিজের সদৃশেরই একটি সৃষ্টি মাত্র এবং এটা তোমরই নিকট প্রত্যাবর্তন করে।”(একটি হাদিস বাণী)। এটা সুস্পষ্ট যে, যদি আমরা ঐশীত্বের (অর্থাৎ আল্লাহ্র) বাস্তবতাকে (অস্তিত্ব) কল্পনা করতে ইচ্ছা করি, তাহলে এই কল্পনা বেষ্টিত এবং আমরা পরিবেষ্টিত এবং এটা সুনিশ্চিত যে, যে পরিবেষ্টন করে, সে পরিবেষ্টিত অপেক্ষা বুহত্তর। এটা থেকে এটাই সঠিক ও সুস্পষ্ট হল যে, যদি আমরা ঐশী প্রকাশগণের বাইরে ঐশী সভ্যতার কল্পনা করি, তাহলে এটা কল্পনা বই বাস্তব কিছুই নয়; কারণ ঐশীত্বের বাস্তব সত্ত্বা বা বাস্তবতার দিকে অগ্রবর্তী হওয়ার কোন পথ নেই, যে বাস্তবতা আমাদের কাছে বিচ্ছিন্ন করা হয় নাই এবং আমরা যা কিছু কল্পনা করি, তা অনুমান বই আর কিছুই নহে।

সুতরাং গভীরভাবে চিন্তা করে দেখ যে, পৃথিবীর বিভিন্ন জাতির লোকেরা কল্পনাসমূহের চতুর্দিকেই আবর্তমান রয়েছে এবং চিন্তাধারা ও অনুমানসমূহের মূর্তির পূজক মাত্র। তারা এটা অবগতও নয়; তারা তাদের কল্পনাসমূহকে বাস্তব সত্যতা (ঐশী অস্তিত্ব) বলে মনে করে- যে বাস্তব সত্যতা তথা ঐশী অস্তিত্বকে সকল প্রকার উপলব্ধি থেকে সরিয়ে রাখা হয়েছে এবং সকল প্রকার বর্ণনা থেকে পবিত্র ও মুক্ত করা হয়েছে। তারা নিজেদেরকে একত্বের বা এক অদ্বিতীয় আল্লাহর লোক বলে ধারণা করে এবং অন্য লোকদের মূর্তিপূজক বলে মনে করে; কিন্তু প্রতিমাগুলির অন্তত একটি ধাতব অস্তিত্ব রয়েছে, পক্ষান্তরে মানুষের কল্পনা ও অনুসমূহের প্রতিমাগুলি অলীক কল্পনা ব্যতীত আর কিছুই নয়, তাদের এমনকি একটি ধাতব অস্তিত্বও নাই। “ সতর্ক হও, হে বোধশক্তি সম্পন্ন ব্যক্তিগণ।”

জেনে রাখ যে, পূর্ণতার গুণাবলী, স্বর্গীয় বদান্যতার ঔজ্জল্য, অনুপ্রেরণার আলোকসমূহ, সকল ঐশী প্রকাশগণের মধ্যে দৃষ্ট ও সুস্পষ্ট; কিন্তু উজ্জল ঐশী বাক্য, যীশুখ্রিষ্ট এবং মহীয়ান নাম, বাহা’উল্লাহ্ হচ্ছেন ঐশীপ্রকাশ ও সাক্ষ্য প্রমাণ, যা কল্পনার অতীত; কারণ তাঁরা পূর্ববর্তী ঐশী প্রকাশগণের সকল পূর্ণতার অধিকারী এবং তদতিরিক্ত তাঁরা এইরূপ কতক পূর্ণতার অধিকারী যা অন্য ঐশী প্রকাশগণকে তাঁদের উপর নির্ভরশীল করে। এইরূপে ইসরায়েল বংশের সকল পয়গম্বর অনুপ্রেরণার কেন্দ্রস্বরূপ ছিলেন; যিশুখ্রিষ্টও ঐশী প্রেরণা লাভ করেছিলেন; কিন্তু ঐশী বাক্যের (যীশুখ্রিষ্টের) ঐশীপ্রেরণা এবং ইসাইয়াহ্ যারিমিয়াহ্ ও ইলাইজার প্রত্যাদেশ বাণীসমূহের মধ্যে কতই অধিক পার্থক্য রয়েছে।

অনুধাবন কর যে, আলোক সুক্ষ্ম ঈথার পদার্থের স্পন্দনের প্রকাশ মাত্র। এই সকল প্রকম্পন দ্বারা চক্ষু প্রভাবান্বিত হয় এবং দৃষ্টিশক্তি উৎপন্ন হয়। ঈথার পদার্থের স্পন্দনের মধ্য দিয়েই প্রদীপের আলোর অস্তিত্ব, সেইরূপ সূর্যের অস্তিত্বেরও অস্তিত্ব; কিন্তু সূর্যের আলোক ও তারকাপুঞ্জও প্রদীপের আলোর মধ্যে কত বড় পার্থক্য বিদ্যমান।

মানবীয় আত্মা ভ্রূণাবস্থায় প্রকাশিত ও সুস্পষ্ট হয় এবং বাল্যবস্থায় ও পূর্ণবয়স্ক অবস্থায়ও হয় এবং এটা পরিপূর্ণ অবস্থায় উজ্জ্বল ও সুস্পষ্ট হয়। আত্মা একই, কিন্তু ভ্রূণাবস্থায় দৃষ্টি ও শ্রবনশক্তির অভাব থাকে। পরিণত ও পূর্ণবয়স্কের অবস্থায় এটা পরম উজ্জ্বলতা ও প্রভাসহকারে প্রকাশ পায়। সেই প্রকারে, বীজ প্রথমে পাতায় পরিবর্তিত হয় এবং সেই স্থান যেখানে উদ্ভিদ আত্মা প্রকাশ পায়। ফলের অবস্থায় সেই একই (উদ্ভিদ) আত্মা প্রকাশিত হয়, অর্থাৎ বন্ধন শক্তি চরম পূর্ণতা সহকারে প্রকাশ পায়; কিন্তু পত্রের ও ফলের অবস্থার মধ্যে কতবড় পার্থক্য! কারণ ফল থেকে শত সহস্র পত্র প্রকাশ পায়, যদিও তারা সকলেই সেই একই উদ্ভিদ আত্মার মধ্য দিয়ে জন্মে ও বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। যীশুখ্রিষ্টের গুণাবলী ও পূর্ণতাসমূহ এবং বাহা’উল্লাহ্র উজ্জ্বলতা ও দীপ্তি-প্রভা এবং ইসরায়েল বংশের ইযিকীয়েল বা সেমুয়েল প্রভৃতি নবীগণের (ভাববাদীদের) গুণাবলীর মধ্যে পার্থক্য লক্ষ্য কর। সকলেই ঐশী প্রেরণার বিকাশকারী ছিলেন, কিন্তু তাঁদের মধ্যে অসীম পার্থক্য ছিল। অসংখ্য অভিবাদন।

16
ঐশী প্রকাশগণের (বার্তাবাহকদের) তিনটি অবস্থা

জেনে রাখ যে, যদিও ঐশী প্রকাশগণের অন্তহীন পরিপূর্ণতার ধাপ বা সোপানসমূহ রয়েছে, তত্রাচ সাধারণভাবে বলতে গেরে তাঁদের তিনটি অবস্থা রয়েছে। প্রথমটি হচ্ছে শারীরিক, দ্বিতীয় অবস্থা হচ্ছে মানবীয় অর্থাৎ জ্ঞান শক্তিসম্পন্ন আত্মার অবস্তা, তৃতীয় অবস্থা হচ্ছে ঐশী প্রকাশ ও স্বর্গীয় প্রভার অবস্থা।

শারীরিক পদবী হচ্ছে (দৃশ্যমান বিশ্বে) ঘটমান ব্যাপার সম্বলিত এটা মৌলিক উপাদানে সংমিশ্রিত; সুতরাং সকল সংমিশ্রিত দ্রব্যই বিনাশপ্রাপ্ত হয়। এটা সম্ভব নয় যে, একটি সংমিশ্রণ বিশ্লিষ্ট হবে না।

দ্বিতীয় পদবী হচ্ছে জ্ঞানশক্তি সম্বন্ধীয় আত্মার পদবী- সেটা মানবীয় সভ্যতা; এটাও দৃষ্টির বিষয়াভ‚ত এবং পবিত্র ঐশী প্রকাশগণ সকল মানবগণের ন্যায় এর অংশভাগী হয়।

জেনে রাখ, যদিও মানবীয় আত্মা এই বিশ্বে সুদীর্ঘ কাল ও যুগ যুগব্যাপী পৃথিবীতে অবস্থান করেছে, তবুও এটা (এর জন্মকালে ) দৃষ্টির বিষয়ীভূত ব্যাপার। যেহেতু এটা একটি স্বর্গীয় নিদর্শন, যখন এটা একবার অস্তিত্বে আগমন করেছে, এটা চিরস্থায়ী। মানবাত্মার প্রারম্ভ অছে, এর কোন অন্ত নেই। এটা চিরস্থায়ীরূপে চলতে থাকে। সেই একই নিয়মে, এই ধরাপৃষ্ঠে অবস্থিত বিভিন্ন শ্রেণীর প্রজাতিসমূহও দৃষ্টির বিষয়ীভ‚ত ঘটমান ব্যাপার, কারণ এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, এইরূপ সময়ও ছিল যখন এই পৃথিবীতে এই সকল বিভিন্ন প্রজাতির অস্তিত্ব ছিল না। অধিকন্তু, এই পৃথিবী সকল সময়ে বিদ্যমান ছিল না। কিন্তু অস্তিত্বের জগত সর্বদাই বিদ্যমান রয়েছে, কারণ এই বিশ্ব এই ভূমণ্ডল সীমাবদ্ধ নয়। এর অর্থ এই যে, যদিও মানুষের আত্মাগুলি সৃষ্টির বিষয়ীভূত, তবুও তারা অবিনশ্বর, চিরস্থায়ী ও নিত্য, কারণ মানব জগতের তুলনায় বস্তু জগত অপূর্ণতার জগত এবং বস্তু জগতের তুলনায় মানব জগত পূর্ণতার জগত। যখন অপূর্ণতাগুলি পূর্ণতার পদবীতে পৌঁছে, তখন তারা চিরস্থায়ী হয়। এটা এইরূপই একটি দৃষ্টান্ত যার অর্থ তোমাদিগকে বুঝে নিতে হবে।

তৃতীয় পদবী হচ্ছে ঐশী প্রকাশ ও স্বর্গীয় প্রভার পদবী। এটা ঐশী বাক্য, চিরস্থায়ী দান, পবিত্র পরমাত্মা। এটার আদিও নেই, অন্তও নেই, কারণ এই সমুদয় পার্থিব সম্ভাব্য আকস্মিক ঘটনাবলীর সম্পর্কযুক্ত এবং ঐশী জগতের নহে। কারণ আল্লাহ্র পক্ষে, প্রারম্ভের ন্যায়, অন্তও একই বস্তু। এমতে দিন, সপ্তাহ, মাস, বছর, গতকল্য ও অন্তকার দিনের গণনা এই ভূমণ্ডলের সহিত সম্পর্কিত; কিন্তু সূর্য মণ্ডলে এইরূপ কিছুই নেই, যেখানে গতকল্য, অন্ত, আগামীকাল, মাস, বছর কিছুই নেই, সমস্তই সমান। সেই একই নিয়মে আল্লাহ্র বাক্য এই সমুদয় অবস্থা থেকে পবিত্র এবং এই সম্ভাব্য ঘটনাপূর্ণ পৃথিবীর সীমা নিয়ম ও সীমান্তসমূহ থেকে মুক্ত। সুতরাং ঐশী প্রকাশগণের পদবীর বাস্তবতা, যা কিছুই আল্লাহ্র বাক্য এবং ঐশীত্বের প্রকাশের পূর্ণ অবস্থা, তার কোন প্রারম্ভ ছিল না এবং কোন অন্তও থাকবে না। এর অভু্ত্থান অন্যান্য সকল থেকে বিভিন্ন এবং সূর্যের উত্থানের ন্যায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, যীশুখ্রিষ্টের নিদর্শনে ঐশী প্রকাশের অভুত্থান, পরম উজ্জ্বলতা ও প্রভাসহকারে হয়েছিল এবং এটা শাশ্বত ও চিরস্থায়ী। দেখ কত দীপ্তিজয়ী সম্রাট, কত রাজনীতি বিশারদ ও রাজপুত্র, কত শক্তিশালী ষংগঠন, সকলেই অন্তহীন হয়ে গেছে, পক্ষান্তরে যীশুখ্রিষ্টর মৃদুমন্দ সমীরণ এখনও প্রভাহিত হচ্ছে, তার আলোকে এখনও উজ্জ্বলভাবে দীপ্তি দান করছে, তাঁর স্বর্গীয় সঙ্গীতের সুর এখনও প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, তাঁর পতাকা এখনও আন্দোলিত হচ্ছে, তাঁর বিদ্যুৎ এখনও চমক দিচ্ছে, তাঁর উজ্জ্বল প্রভা এখনও উজ্জল আলোক বিকীরণ করছে।

অতএব এটা সুস্পষ্ট যে, ঐশী প্রকাশগণের তিনটি অবস্থা আছে। প্রথমটি হচ্ছে শারীরিক অবস্থা। দ্বিতীয়টি হচ্ছে বিচারবুদ্ধি সম্বন্ধীয় আত্মার অবস্থা। তৃতীয়টি হচ্ছে ঐশী প্রকাশ ও স্বর্গীয় প্রভার অবস্থা। শারীরিক অবস্থা নিশ্চয়ই বিশ্লিষ্ট হয়ে যাবে, কিন্তু জ্ঞান শক্তির আত্মার অবস্থা এই হবে যে যদিও এর প্রারম্ভ আছে কিন্তু কোন অন্ত নেই; না, এটাকে অনন্ত জীবন প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু পবিত্র সত্যতা, যার সম্বন্ধে যিশুখ্রিষ্ট বলেনঃ “পিতা পুত্রতেই আছেন।”এর আদিও নেই, অন্তও নেই। যখন প্রারম্ভের কথা বলা হয়, তখন এটা প্রকাশিত হওয়ার অবস্থাই বুঝায়; এবং প্রতীকভাবে, নিস্তব্ধতার অবস্থাকে নিদ্রার সহিত তুলনা করা হয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ একজন লোক নিদ্রা যাচ্ছে, যখন সে কথা বলতে আরম্ভ করে তখন সে জাগ্রত হয়Ñ কিন্তু সে সর্বদাই সেই একই ব্যক্তি- তাই সে নিদ্রিত হোক বা জাগ্রত হোক তার পদবীতে, উন্নীতাবস্থায়, তার গৌরবে, তার বাস্তবতায়, বা তার প্রকৃতিতে কোন পার্থক্যই ঘটে নাই। নীরবতার অবস্থাকে নিদ্রার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে এবং প্রকাশ (বা অভ্যূত্থান) কে জাগ্রতবস্থার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। একজন লোক নিদ্রিত হোক বা জাগ্রত হোক, সেই একই ব্যক্তি; নিদ্রা এক অবস্থা এবং জাগ্রতাবস্থা তা থেকে ভিন্ন। নীরবতার সময়কে নিদ্রার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে এবং অভূত্থান ও পথ প্রদর্শনকে জাগ্রতাবস্থার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।

গসপেলে (যীশুর সুসমাচারে) বলা হয়েছে: “আদিতে বাক্য ছিল এবং বাক্য আল্লাহ্র সঙ্গে ছিল।”তাহলে এটা পরিষ্কার ও সুস্পষ্ট যে, যীশুখ্রিষ্ট পবিত্র বারিধারা অভিসিঞ্চনের সময় যখন পবিত্র আত্মা একই কপোতের বেশে তাঁর উপর অবতরণ করে, মসীহত্বের (ত্রাণকর্তার) ও মসীহত্বের পূর্ণতাসমূহের পদমর্যাদায় পৌঁছাননি। না, আল্লাহর বাক্য অনন্তকাল সর্বদাই পবিত্রকরণের উচ্চ স্থানে ছিল ও থাকবে।

17
ঐশী প্রকাশগণের মানবীয় ও আধ্যাত্মিক অবস্থা

আমরা বলেছি যে, ঐশী প্রকাশগণের তিনটি স্তর আছে। প্রথমটি হচ্ছে শারীরিক সত্যতা (বাস্তবতা) যা দেহের উপর নির্ভর করে, দ্বিতীয়টি হচ্ছে ব্যক্তিগত বাস্তবতা, অর্থাৎ জ্ঞান শক্তিসম্পন্ন আত্মা এবং তৃতীয়টি হচ্ছে ঐশী আবির্ভাব। এটাই ঐশী পূর্ণতা সম্পূর্ণ, প্রাণ অস্তিত্বের, আত্মার শিক্ষার জনসাধারণের পথ প্রদর্শনের এবং সম্ভাব্য পৃথিবীর আলোক প্রাপ্তির কারণ।

শারীরিক অবস্থা হচ্ছে মানবীয় অবস্থা, যা বিনাশপ্রাপ্ত হবে। কারণ এটা উপাদানসমূহ থেকে প্রস্তুত এবং উপাদানসমূহ যা প্রস্তুত হয়েছে, তা অবশ্যই বিশ্লিষ্ট ও বিক্ষিপ্ত হবে।

কিন্তু ঐশী প্রকাশগণের ব্যক্তিগত বাস্তবতা একটি পবিত্র বাস্তবতা এবং যেহেতু এটা পবিত্র এবং এর প্রকৃতি ও গুণ সংশ্লিষ্ট যা কিছু সবই অন্যান্য বস্তু থেকে স্বতন্ত্র। এটা সূর্য সদৃশ, যা এর অত্যাবশ্যকীয় প্রকুতি দ্বারা আলোক উৎপাদন করে। এবং চন্দ্রের সঙ্গে এর তুলনা করা যেতে পারে নাÑ ঠিক যেমন সূর্যমÐল প্রস্তুতকারী পরমাণুর সঙ্গে চন্দ্র প্রস্তুতকারী পরমাণুর তুলনা হতে পারে না। পূর্বোক্তটি পরমাণু ও শৃঙ্খলা আলোক উৎপাদন করে, পরবর্তীটি অর্থাৎ চন্দ্র যে সকল উপাদানে গঠিত তা কিরণ প্রদান করে না, কিন্তু আলোক ধার করার আবশ্যক হয়। সুতরাং অন্যান্য মানবীয় সত্যতা তথা বাস্তবতাসমূহ হচ্ছে ঐ সমুদয় আত্মা, যারা চন্দ্রের ন্যায় সূর্য থেকে আলোক গ্রহণ করে; কিন্তু পবিত্র বাস্তবতা (ঐশী প্রকাশ) আপনা দ্বারা আপনি উজ্জ্বল।

সেই ঐশী পরম পুরুষের তৃতীয় ধাপ তথা স্তর হচ্ছে ঐশী বদান্যতা, র্প্বূ অস্তিত্বশীল সৌন্দর্যের প্রভা এবং সর্বশক্তিমানের আলোর উজ্জলতা ঐশী প্রকাশগণের প্রতিবিম্ব (স্বতন্ত্র) সত্ত্বাসমূহ ঐশী বদান্যতা ও মহিমান্বিত বিরাট প্রভা থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। অনুরূপভাবে আলোক থেকে সূর্য গোলকের কোন পার্থক্য নেই। সুতরাং এটা বলা যেতে পারে যে, পবিত্র ঐশী প্রকাশের স্বর্গারোহন মাত্র এই ভৌতিক দেহ পরিত্যাগ করা বুঝায়। দৃষ্টান্তস্বরূপ, যদি একটি প্রদীপ এই কুলুঙ্গের কোন্টিকে আলোকিত করে এবং যদি এর আলোক একে আলোকিত করতে বিরত হয়, কারণ কুলুঙ্গটিকে ধ্বংস করা হয়েছে, তাহলেও প্রদীপের দান বিচ্ছিন্ন হয় না সংক্ষেপে, পবিত্র ঐশী প্রকাশগণের পূর্ব থেকে বিদ্যমান বদান্যতা আলোকের ন্যায়, তাঁদের ব্যক্তি স্বাতন্ত্রতা কাঁচের গোলকে দ্বারা প্রকাশিত হয় এবং মানব দেহ কুলুঙ্গের ন্যায়; যদি কুলুঙ্গ বিনষ্ট হয়, প্রদীপটি জ্বলতে থাকে ঐশী প্রকাশগণ ভিন্ন ভিন্ন দর্পনের ন্যায়, কারণ তাঁদের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব আছে, কিন্তু দর্পনসমূহে যা প্রতিফলিত হয়, তা মাত্র একটি সূর্য। এটা সুস্পষ্ট যে, যীশুখ্রিষ্টের ব্যক্তিত্ব, মুসার ব্যক্তিত্ব থেকে ভিন্ন।

সত্যসত্যই সেই পবিত্র বাস্তবতা (ঐশী প্রকাশ) প্রারম্ভ থেকে অস্তিত্বের রহস্য সম্বন্ধে অবগত আছেন এবং শৈশবকাল তেকে তাঁর মধ্যে মহত্বের নিদর্শনাবলী প্রকাশ ও দৃষ্ট হয়। সুতরাং এটা কেমন করে হতে পারে যে, এই সমুদয় বদান্যতা ও পূর্ণতা থাকা সত্ত্বেও তাঁর কোন আত্ম জ্ঞান থাকবে না।

আমরা উল্লেখ করেছি যে, ঐশী প্রকাশগণের তিনটি অবস্থা আছে, যথা: শারীরিক অবস্থা, ব্যক্তিগত অবস্থা এবং পূর্ণতার প্রকাশের কেন্দ্র। এটা সূর্যের ন্যায় এর তাপ ও এর আলো সদৃশ। অন্যান্য ব্যক্তিবর্গের অবস্থান হচ্ছে শারীরিক স্তরে, জ্ঞান শক্তিসম্পন্ন আত্মার স্তরে তথা আত্মা ও মনে। সুতরাং “আমি নিদ্রিত ছিলাম এবং ঐশী মৃদুমন্দ বায়ু আমার উপর দিয়া প্রবাহিত হল এবং আমি জাগ্রত হইলাম।”এই বাক্য যীশুখ্রিষ্টের এই বাক্যের ন্যায়ঃ “দেহ বিষন্ন, আত্মা আনন্দিত”এবং “আমি পীড়িত, আমি সুস্থির এবং আমি উপদ্রুত।

এইসব শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে বলা হয়েছে, ব্যক্তিগত বাস্তবতা ও ঐশী প্রকাশগণের স্বর্গীয় সত্যতার সম্বন্ধে নয়। বাহা’উল্লাহ্র পূর্বোক্ত বাক্যে শরীরের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।

আল্লাহ্র জগতে কোন অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নেই। সবই এক। যখন যিশুখ্রিষ্ট বললেনঃ “প্রথমে বাক্য ছিল”এর অর্থ ছিল, আছে, হবে।” কারণ আল্লাহ্ জগতে কোন সময় নেই। সময়ের কর্তৃত্ব কেবল সৃষ্টজগতের উপর, আল্লাহ্র উপর নয়। প্রার্থনায় বলা হয় “তোমার নাম পবিত্র হউক।”এর অর্থ হচ্ছে: “তোমার নাম পবিত্র আছে এবং ভবিষতেও পবিত্র থাকবে।”এবং মধ্যাহ্ন ও সন্ধ্যাকাল এই পৃথিবীরই সঙ্গে সম্পর্কিত কিন্তু সূর্যে কোন প্রাতঃকাল, মধ্যাহ্নকাল ও সন্ধ্যাকাল নেই।

18
ঐশী প্রকাশগণের জ্ঞান

প্রশ্ন: ঐশী প্রকাশগুলির শক্তির মধ্যে জ্ঞান একটি শক্তি; এই জ্ঞান কি পরিমাণে সীমাবদ্ধ?

উত্তর: জ্ঞান দুই প্রকার: একটি মানসিক জ্ঞান অপরটি হচ্ছে বাহ্যিক জ্ঞান, অর্থাৎ স্বভাবসিদ্ধ বা উপলব্ধ জ্ঞান ও ইন্দ্রিয় দ্বারা উপলব্ধ জ্ঞান।

মানবমণ্ডলীর বস্তু সম্বন্ধে সার্বজনীনভাবে যে জ্ঞানের অধিকারী হয়, সেটা ধ্যান ধারণা বা প্রমাণের দ্বারা অর্জিত হয় অর্থাৎ মানসিক শক্তি দ্বারা বস্তু সম্বন্ধে একটি ধারণা জন্মে বা একটি বস্তু দর্শনের ফলে অন্তর দর্পনে তার একটি আকৃতি উৎপন্ন হয়। এই জ্ঞানের পরিধি অত্যন্ত সীমাবদ্ধ, কারণ এটা চেষ্টা-উদ্যম ও সাফল্যের উপর নির্ভর করে।

কিন্তু দ্বিতীয় প্রকার জ্ঞান, যা অস্তিত্বের জ্ঞান, এটা স্বভাবসিদ্ধ জ্ঞান, এটা প্রত্যক্ষ জ্ঞান ও আত্ম-জ্ঞানের ন্যায় যা মানুষের নিজের সম্বন্ধে আছে।

দৃষ্টান্তস্বরূপ, মানুষের মন ও আত্মা দেহের বিভিন্ন অঙ্গের ও প্রত্যঙ্গসমূহের ও গুণ সম্বন্ধে অবগত থাকে এবং সেই প্রকারে তাদের শক্তি, অনুভ‚তি ও আধ্যত্মিক অবস্থা সম্বন্ধে অবগত আছে। এটাই অস্তিত্বের জ্ঞান , যা মানুষ হৃদয়ঙ্গম করে ও দেখতে পায়; কারণ আত্মা দেহকে বেষ্টন করে এবং এর অনুভূতি ও শক্তিসমূহ সম্বন্ধে অবগত আছে। এই জ্ঞান চেষ্টা ও অধ্যয়নের জ্ঞান নয়। এটা একটি বিদ্যমান বস্তু; এটা একটি পূর্ণ উপহার।

যেহেতু পবিত্রীকৃত ঐশী বাস্তবতাসমূহ, সার্বজনীন ঐশী প্রকাশগণ জীবের অস্তিত্ব ও গুণাবলীকে বেষ্টন করে, বিদ্যমান বাস্তবতাসমূহ অতিক্রম ও অন্তভর্‚ক্ত করে এবং সকল বিষয় বুঝতে পারে; সুতরাং তাঁদের জ্ঞান ঐশী জ্ঞান। এটা অর্জিত জ্ঞান নয়; অর্থাৎ এটা পবিত্র দান, এটা একটা পবিত্র প্রত্যাদেশ।

আমরা একটি দৃষ্টান্তের উল্লেখ করব এই বিষয় সুস্পষ্টভাবে অনুধাবন করার নিমিত্তে। মানুষই হচ্ছে এই পৃখিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ অস্তিত্বশীল প্রাণী। সে জীব, উদ্ভিদ ও ধাতু রাজাসমূহ তার অন্তর্ভূক্ত করে। অর্থাৎ এই সমস্ত অবস্থা তার মধ্যে এরূপভাবে এইপরিমাণে রয়েছে যে, যেন এই সকল অবস্থা ও গুণাবলীর অধিকারী। সে তাদের রহস্য ও অস্তিতের গূঢ় তত্ত্বজ্ঞান সম্বন্ধে জ্ঞাত। সংক্ষেপে, সার্বজনীন ঐশী প্রকাশগণ প্রাণীগণের রহস্যসমূহের সত্যতা অবগত আছেন, সুতরাং তাঁরা বিধি-নিয়মের প্রতিষ্ঠা করেন- যা মানব জগতের অবস্থার উপযুক্ত ও উপযোগী। কারণ ধর্মই আবশ্যকীয় সম্পর্ক যা বস্তুর বাস্তবতাসমূহ থেকে উৎপন্ন হয়। ঐশী প্রকাশ অর্থাৎ পবিত্র আইন-দাতা যদি প্রাণীকুলের বাস্তবতা সম্বন্ধে অবগত না হন, তাহলে তিনি সেই আবশ্যকীয় সম্পর্ক উপলব্ধি করতে পারবেন না, যা প্রাণীকুলের বাস্তব সত্যতা থেকে উৎপন্ন হয় এবং তিনি নিশ্চয়ই এইরূপ একটি ধর্ম প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবেন না, যা বাস্তব সত্যতা ও অবস্থাদির উপযোগী ও উপযুক্ত হবে।

ঐশী প্রত্যাদিষ্ট পুরুষগণ, সার্বজনীন ঐশী প্রকাশগণ নিপুণ চিকিৎসকগণের ন্যায় এবং সম্ভাব্য ঘটনা সাপেক্ষ সংসার মানবদেহ সদৃশ; স্বর্গীয় আইন-কানুন হচ্ছে প্রতিকার ও ব্যবস্থা। সুতরাং চিকিৎসককে রোগীর শরীরে গঠন, সমুদয় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সর্বাংশের তথ্য জানতে হবে, যাতে তিনি উপাদেয় ঔষধের ব্যবস্থা করতে পারেন।

চিকিৎসকের পক্ষে সকল প্রকার পীড়া, সকল প্রকার ঔষুধ ও প্রতিকার সম্বন্ধে পূর্ণজ্ঞান থাকা আবশ্যক, যেন তিনি উপযুক্ত ঔষুধের ব্যবস্থা দিতে পারেন।

অতএব ধর্ম একটি অত্যাবশ্যক যোগসূত্র যা দ্রব্য ও প্রাণীকুলের বাস্তব সত্যতা থেকে উৎপন্ন হয়; এবং যেহেতু সার্বজনীন ঐশী প্রকাশগণ প্রাণীকুলের ভেদ ও রহস্যসমূহ সম্বন্ধে অবগত আছেন, সেহেতু তাঁরা এই অত্যাবশ্যকীয় সম্পর্ক উপলব্ধি করতে পারেন এবং এই জ্ঞান দ্বারা আল্লাহর আইন-কানুন প্রতিষ্ঠা করেন।

19
সার্বজনীন যুগচক্র

প্রশ্ন: অস্তিত্ব জগতে যে কালচক্র সংঘটিত হয় তার প্রকৃত ব্যাখ্যা কি?

উত্তর: এই অসীম গগনমÐলে উজ্জল জ্যোতিস্কসমূহের প্রত্যেকেরই পরিক্রমণের কালচক্র রয়েছে, যে পরিক্রমণ বিভিন্ন স্থিতিকালের হয়ে থাকে এবং প্রত্যেকেই তার নিজের বৃত্তে আবর্তিত হয় এবং পুনরায় একটি নতুন কালচক্র শুরু করে। সুতরাং পৃথিবী প্রতি তিনশত পয়ষট্টি দিন, পাঁচ ঘণ্টা, আটচল্লিশ মিনিট ও এক ভগ্নাংশ সময়ে এক পরিক্রমণ তথা আবর্তন কাল সম্পূর্ণ করে, অতপর এটা একটি নব কালচক্র শুরু করে, অর্থাৎ প্রথম, কালচক্র পুনরায় নবায়িত হয়। অনুরূপভাবে সমগ্র বিশ্ব-ব্রক্ষ্মাণ্ডের জন্য নভোমণ্ডল হোক অথবা মানবকুলের জন্য হোক বিরাট ঘটনাবলীর, গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাবলীর ও সংঘটনসমূহের কালচক্র রয়েছে। যখন একটি কালচক্র শেষ হয়ে যায়, তখন একটি নতুন যুগচক্র শুরু হয়ে যায় এবং বিরাট ঘটনাবলীর সংঘটনের কারণে পুরোনো কালচক্রটি সম্পূর্ণরূপে বিস্মৃত হয়ে যায় এবং এর কোন নথি অথবা চিহ্ন থাকবে না। যেমন তোমরা দেখছো বিশ হাজার বছর পূবের কোন নথি আমাদের কাছে নেই, যদিও যুক্তি তর্কের দ্বারা আমরা পূর্বের প্রমাণ করেছি যে, পৃথিবীর জীবন অতি প্রাচীন। এটা একশত অথবা দুইশত সহস্র, অথবা দশ লক্ষ অথবা বিশ লক্ষ বছর প্রাচীন নয়; এটা খুব প্রাচীন এবং প্রাচীন নথিপত্র ও চিহ্নসমূহ সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়েছে। ঐশী প্রকাশগণের প্রত্যেকের অনুরূপভাবে একটি যুগচক্র আছে এবং উক্ত যুগচক্রে তাঁর আইনকানুন, আদেশসমূহ প্রচলিত ও প্রতিপালিত হয়। যখন তাঁর কালচক্র একটি নতুন ঐশী প্রকাশের আবির্ভাবের দ্বারা সম্পূর্ণ হয়, তখন একটি নতুন কালচক্র শরু হয়। এইভাবে কালচক্রসমূহ শুরু হয়, শেষ হয় ও নবায়িত হয়- যাবত না পৃথিবীতে একটি সার্বজনীন কালচক্র পরিপূর্ণ হয় যখন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী এবং বিরাট সংঘটনসমূহ ঘটবে যা অতীতের প্রতিটি চিহ্ন ও নথি সম্পূর্ণরূপে মুছে ফেলবে; অতঃপর একটি নতুন সার্বজনীন কালচক্র এই পৃথিবীতে ঘটে, কারণ এই বিশ্ব ব্রক্ষ্মোণ্ডের কোন শুরু বা আরম্ভ নেই। এই বিষয়ে আমরা পূর্বেই প্রমাণ ও সাক্ষ্য দিয়েছি; পুনরাবৃত্তির প্রয়োজন নেই।

সংক্ষেপে আমরা বলছি, অস্তিত্ব জগতে একটি সার্বজনীন যুগচক্র, একটি দীর্ঘ স্থিতিকাল এবং অগণিত ও অসংখ্য যুগ ও কালকে বুঝায়। এইরূপ একটি কালচক্রে ঐশী প্রকাশগণ দৃশ্যমান রাজ্যে দীপ্তিসহকারে আবির্ভূত হতে থাকেন, যে পর্যন্ত না এক মহান ও সার্বজনীন ঐশী প্রকাশ পৃথিবীকে তাঁর দীপ্তির কেন্দ্র করেন। তাঁর আবির্ভাব পৃথিবীকে পরিপক্কতায় পৌঁছে এবং তাঁর কালচক্রের বিস্তৃতি খুব বিরাট। পরবর্তীকালে অন্যান্য ঐশী প্রকাশগণ তাঁর ছায়ায় গাত্রোত্থান করবেন, যারা তাঁর ছায়ায় থাকাকালীন যুগের প্রয়োজন অনুসারে জাগতিক বিষয়াদিতে আদেশ তথা বিধিনিষেধের নবায়ন করবেন।

আমরা সেই যুগচক্রেই অবস্থান করছি, যা আদমের সহিত শুরু হয়েছিল এবং এর সার্বজনীন ঐশী প্রকাশ হচ্ছেন বাহা’উল্লাহ্।

20
ঐশী প্রকাশগণের শক্তি ও প্রভাব

প্রশ্ন: বাস্তবতার সিংহাসনাধিকারী ঐশী প্রকাশগণের শক্তি ও পূর্ণতার পরিমাণ কি এবং তাঁদের প্রভাবের সীমা কি?

উত্তর: অস্তিত্ব জগতের অর্থাৎ জড় বস্তুর জগতের বিষয় বিবেচনা কর। সৌরজগত অন্ধকারময় ও অস্পষ্ট এবং এর মধ্যে সূর্য আলোক কেন্দ্র এবং সূর্যমণ্ডলের সকল গ্রহ সৌর শক্তির চতৃর্দিকে আবর্তন করে এর বদান্যতার অংশ গ্রহণ করে। সূর্য সৌর জগতের সকল প্রাণীর জীবন ও উজ্জলতার কারণ এবং তাদের জন্ম ও পরিবর্দ্ধনের উপায়; কারণ সূর্যের দান ব্যতীত কোন প্রাণী জীবন ধারণ করে থাকতে পারে না; সবই অন্ধকারময় ও ধ্বংস হয়ে যাবে। অতএব এটা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হল যে, সূর্যই হচ্ছে আলোকের কেন্দ্র এবং সৌর জগতের প্রাণীসমূহের জীবন ধারেণের কারণ।

এই একই প্রকারে, ঐশী প্রকাশগণ বাস্তব সত্যতাসমূহের আলোকের কেন্দ্র এবং ঐশী প্রেমের বদান্যতাসমূহের কেন্দ্র ও রহস্যসমূহের উৎসের কেন্দ্র। তাঁরা অন্তর ও চিন্তা জগতের দেদীপ্যমান এবং আত্মা জগতের অবিনশ্বর কৃপা বর্ষণ করে; তাঁরা আ্যধাত্মিক জীবন দান করেন এবং তাঁর বাস্তব সত্যতাসমূহের ও তাৎপর্যের আলোকে দীপ্তিমান। চিন্তাজগতের আলোক সম্পাত এই সমুদয় আলোক কেন্দ্র ও রহস্যসমূহের উৎস স্থল থেকে আগমন করে। এই সমুদয় পবিত্র পুরুষের উজ্জলতার দান ও তাঁদের উপদেশাবলী ব্যতীত আত্মার ও চিন্তা জগৎ তমোময় (ছায়াময়) অন্ধকারে পূর্ণ হবে। রহস্যসমূহের ঐ সকল উৎপত্তি স্থানের অখণ্ডনীয় শিক্ষাসমূহ ছাড়া মানব জগৎ পশুর ক্ষুধা স্পৃহার ও প্রবৃত্তির বিচরণ ভূমি হয়ে যেত, প্রত্যেক বস্তুর অস্তিত্ব অসত্য হতো এবং কোন প্রকৃত জীবনই হতো না। এ জন্যই সুসমাচারে (বাইবেলে) বলা হয়েছে: “আদিতে বাক্য ছিল”এর অর্থ এই যে, এটা সকল জীবনের কারণ হয়েছিল।

এক্ষণ, জগতের প্রাণীকুলের উপর সূর্যের প্রভাব বিবেচনা করে দেখ। এর উত্থান, এর অন্তগমন, এটার নৈকট্য ও দূরত্বের নিদর্শনাবলী ও ফল ও প্রভাবসমূহ অবলোকন কর।

অনুরূপভাবে ঐশী প্রকাশ যিনি তাঁর সৃষ্টি জগতের সূর্য, যখন তিনি আত্মা জগতের, চিন্তা জগতের ও হৃদয় জগতের উপর উজ্জল কিরণ দান করেন, তখন পৃথিবীতে আধ্যাত্মিক বসন্তকাল ও নবজীবনের আবির্ভাব হয়। তুমি লক্ষ্য করা থাকবে, প্রত্যেক ঐশী প্রকাশের আবির্ভাবকালে, মন, চিন্তা, আত্মা জগতে অসাধারণ উন্নতি সাধিত হয়েছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ এটা ঐশী যুগে মানসিক ও চিন্তা জগতে কিরূপ উন্নতি সাধিত হয়েছে এবং এটা এখন আরম্ভকাল মাত্র। অনতিবিলম্বে নতুন দানসমূহ ও স্বর্গীয় শিক্ষা-দীক্ষা দেখতে পাবে। সেই সমস্ত শিক্ষা দীক্ষা এই অন্ধকারময় পৃথিবীকে উজ্জল করবে এবং এই সমুদয় বিষাদময় স্থানসমূহকে শান্তিপূর্ণ ও মনোরম স্বর্গোদ্যানে পরিণত করবে।

যদি আমরা প্রত্যেক ঐশী প্রকাশের সময়কালীন করুণাসমূহ ও নিদর্শনাবলী ব্যাখ্যা করি, তাহলে অনেক সুদীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হবে। এই সম্বন্ধে গভীরভাবে চিন্তা ও মনে মনে তোলপাড় কর, তাহলে তুমি এই বিষয়ে সত্যে উপনীত হতে পারবে।

21
বার্তাবাহকদের দুইটি শ্রেণী

প্রশ্ন: কত প্রকারের বার্তাবাহক আছেন?

উত্তর: সাধারণভাবে দুই শ্রেণীর বার্তাবাহক বা পয়গম্বর আছেন। এক শ্রেণী হচ্ছেন স্বাধীন পয়গম্বর। যাদেরকে অনুসরণ করা হয়। অপর তথা দ্বিতীয় শ্রেণী হচ্ছেন যারা স্বাধীন নহেন, তাঁরা স্বয়ং স্বাধীন বার্তাবাহকদের অনুসরণকারী।

স্বাধীন পয়গম্বরগণ আইনদাতা ও একটি নবযুগের প্রবর্তক। তাঁদের মাধ্যমে পৃথিবী একটি নতুন পোশাক পরিধান করে, একটি ধর্ম স্থাপিত হয়, এবং একটি নতুন গ্রন্থ অবতীর্ণ হয়। কোন মধ্যবর্তী ব্যতীত দাঁরা ঐশী সত্যতা তেকে বদান্যতা প্রাপ্ত হন এবং তাঁদের উজ্জলতা একটি অপরিহার্য উজ্জ্বলতা। তাঁরা সূর্য সদৃশ, যা আপন থেকে আলোকিত হয়। আলোক এর অপরিহার্য মূল সত্য। এটা অন্য কোন নক্ষত্র থেকে আলো গ্রহণ করে না। এটা সমুদয় ঐশী বদান্যতার উৎস ও ঐশী সত্যতার সারভাগের দর্পসমূহ।

অন্যান্য প্রত্যাদিষ্ট পুরুষগণ (বার্তাবাহকগণ) অনুসরণকারী ও উন্নতি প্রদানকারী, কারণ তাঁরা শাখা মাত্র এবং স্বাধীন নহেন; তাঁরা স্বাধীন বার্তাবাহকগণের বদান্যতা গ্রহণ করেন, এবং সার্বজনীন প্রত্যাদিষ্ট পুরুষগণের পথপদর্শনের আলোকপ্রাপ্ত হয়ে তাঁরা উপকৃত হন। তারা চন্দ্র সদৃশ, যা নিজের আলোকে আলোকিত ও উজ্জ্বল হয় না; সূর্য থেকে আলোকপ্রাপ্ত হয়।

উদাহরণস্বরূপ যারয সার্বজনীন পয়গম্বরের প্রকাশরূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে আছেন ইব্রাহিম, মুসা, যীশুখ্রিষ্ট, মুহাম্মদ, বা’ব এবং বাহা’উল্লাহ। কিন্তু যারা স্বধীন পয়গম্বরদের অনুসারী, শ্রী-বৃদ্ধিকারী, তাঁরা হচ্ছেন সোলায়মান, দাউদ, ইসরায়েল, জারিমাহ্ ও ইজীকিয়েল। যেহেতু স্বাধীন পয়গম্বরগণ নতুন ধর্ম প্রতিষ্ঠাতা, সেহেতু তাঁরা মানুষকে নতুন সৃষ্টজীবে পরিণত করেন। তাঁরা সাধারণ রীতি নীতি পরিবর্তন করেন, নতুন রীতিনীতি প্রবর্তন করেন, কালচক্র ও আইন নবায়ন করেন। তাঁদেরঅ আবির্ভাব বসন্ত ঋতুর আগমনের ন্যায়, যা পৃথিবীকে নতুন বেশ ভূষায় সজ্জিত করে ও নতুন জীবন দান করে।

দ্বিতীয় প্রকারের প্রত্যাদিষ্ট পুরুষগণ, যারা অনুসারূ ঐশী আইনের উন্নতি সাধন করেন, আল্লাহ্র ধর্ম প্রচার করেন ও আল্লাহ্র বাণী ঘোষণা করেন। তাঁদের নিজেদের কোন শক্তি সামর্থ নেই, তাঁরা স্বাধীন প্রত্যাদিষ্ট পুরুষগণের শক্তি ও ক্ষমতা গ্রহণ করেন।

22
প্রশ্ন: বুদ্ধ ও কনফিউসিয়াচ কোন শ্রেণীভুক্ত?

উত্তর: বুদ্ধ একটি নতুন ধর্ম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং কনফিউসিয়াচ রীতিনীতি ও প্রাচীন নৈতিক উৎকর্ষসমূহ নবায়ন কেেরছিলেন, কিন্তু তাদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ সম্পূর্ণরূপে বিনাশপ্রাপ্ত হয়েছে। বুদ্ধ ও কনফিউসিয়াচের ধর্মীয় বিশ্বাস ও রীতিনীতি তাঁদের মৌলিক শিক্ষানুযায়ী স্থায়ী হয় নাই। বুদ্ধধর্মের প্রতিষ্ঠাতা একজন বিস্ময়কর ব্যক্তি ছিলেন। তিনি আল্লাহ্র একত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, কিন্তু পরবর্তীকালে তাঁর মতবাদের মৌলিক নীতিমালা ক্রমে ক্রমে তিরোহিত হয়ে যায় এবং অজ্ঞতা প্রকাশক রীতি নীতি ও আচার-অনুষ্ঠান মাথাচাড়া দিয়ে উঠে ও বৃদ্ধি পায় অবশেষে মূর্তি ও প্রতিমূর্তি পূজায় পর্যবসিত হয়েছে।

এক্ষনে মনে মনে গভীরভাবে চিন্তা কর, যিশুখ্রিষ্ট বারবার বলতেন যে, তৌরীতের দশ আদেশাবলী অনুসরণ করতে হবে এবং মেনে চলার উপর জোর দিতে হবে। দশটি আদেশের মধ্যে একটি ছিল “কোন চিত্র বা প্রতিমূর্তির পূজা করিও না।”বর্তমান সময়ে খ্রিষ্টানদের কোন কোন গীর্জায় অনেক চিত্র ও প্রতিমূর্তি বিদ্যমান। সুতরাং এতে বুঝা যায় আল্লাহর ধর্ম লোকের মধ্যে এর মূলনীতিসমূহ রক্ষা করতে পারে না। এইসব ক্রমে ক্রমে পরিবর্তিত ও বিকৃত হয়ে সম্পূর্ণরূপে লোপপ্রাপ্ত হয়। এই কারণেই পুনঃ পুনঃ ঐশী প্রকাশের আবির্ভাব হয়ে থাকে এবং নতুন ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হয়। যদি ধর্মসমূহ পরিবর্তিত না হত তাহলে ধর্মের পুনঃ নবায়নের কোন প্রয়োজন হত না।

প্রারম্ভে বৃক্ষটি সর্বসৌন্দর্যে, পুষ্পমুকুল ও ফলে পরিপূর্ণ ছিল, অবশেষে এটা বৃদ্ধ হল এবং সম্পূর্ণরূপে ফলশূন্য হয়ে পড়লো এবং বৃক্ষটি শুষ্ক ও ক্ষয়প্রাপ্ত হল। এই জন্য একজন প্রকৃত উদ্যানপাল পুনরায় একই রকম ও একই প্রজাতির একটি অনুপম চারাগাছ রোপন করেন যা দিন দিন বৃদ্ধি ও বিকশিত হয় এবং স্বর্গীয় উদ্যানে সুদূর প্রসারী ছায়া বিস্তার করে এবং প্রশংসনীয় ফল প্রদান করে। ধর্মসমূহের অবস্থা এই একই; কালের প্রবাহে ধর্মগুলি তাদের মৌলিক ভিত থেকে রূপান্তর গ্রহণ করে, আল্লাহর ধর্মের প্রতিষ্ঠিত নীতি সম্পূর্ণরূপে প্রস্থান করে এবং এর তেজ টিকে থাকে না; প্রচলিত ধর্মমতের বিরূদ্ধ মতসমূহ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে এবং এটা আত্মাবিহীন দেহে পরিণত হয়। এই জন্যই এটার পুনঃ প্রবর্তন অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ে।

এর অর্থ এই যে, বৌদ্ধরা ও কনফিউসিয়াচ পন্থীরা এখন মূর্তি ও প্রর্তিমূর্তি পূজা করে। তারা সম্পূর্ণরূপে আল্লাহ্র একত্বে অমনোযোগী এবং প্রাচীন গ্রীকদের ন্যায় কাল্পনিক দেবতাসমূহে বিশ্বাসী। কিন্তু শুরুতে এরূপ ছিল না; অন্য নীতিমালা ও জরুরী বিধি বিধান প্রচলিত ছিল।

পুনরায় মনে মনে গভীরভাবে চিন্তা করে দেখ, যীশুখ্রিষ্টের নীতিমালা কি পরিমাণে অবহেলিত হয়েছে এবং প্রচলিত ধর্মমতের মত-বিরুদ্ধ মত আবির্ভূত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, যিশুখ্রিষ্ট প্রতিশোধ ও সীমা লংঘণ নিষেধ করেছিলেন। অধিকন্তু ক্ষয়ক্ষতি ও অনিষ্টের বিনিময়ে দয়া ও বদান্যতা প্রদর্শনের আদেশ দিয়েছিলেন। এখন মনে মনে গভীরভাবে চিন্তা কর, খ্রিষ্টান জাতিদের মধ্যে কত রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ-বিগ্রহ সংঘটিত হয়েছে এবং কত উৎপীড়ন, নিষ্ঠুরতা, প্রবল লালসা, রক্ত লোলুপতার উদ্ভব হয়েছে। ঐ সমস্ত যুদ্ধ বিগ্রহের অনেকগুলি পোপের আদেশ অনুযায়ী চালানো হয়েছে। তাহলে এটা সুস্পষ্ট যে, কালের প্রবাহে ধর্মসমূহ সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তিত হয়। এই জন্যই ধর্মসমূহ পুনঃ প্রবর্তনের প্রয়োজন হয়।

23
আল্লাহ্ কর্তৃক বার্তাবাহকদের প্রতি কঠোর ভর্ৎসনার ব্যাখ্যা

প্রশ্ন: পবিত্র ধর্মসমূহে পয়গম্বরদের উদ্দেশ্য করে কিছু নিন্দা ও কঠোর ভর্ৎসনা বাক্য বিদ্যমান। কাকে সম্বোধন করে এটা বলা হয়েছে এবং কার জন্য এই ভর্ৎসনা?

উত্তর: ভর্ৎসনা অন্তর্ভূক্ত সমুদয় স্বর্গীয় ধর্ম বিষয়ক উপদেশাবলী, যদিও স্পষ্টরূপে বার্তাবাহকদের সম্বোধন করে বলা হয়েছে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বিজ্ঞতার মাধ্যমে জনমণ্ডলীকেই উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে, যে বিজ্ঞতা হচ্ছে সুনিশ্চিত অনুগ্রহ, যাতে জনমণ্ডলী নিরুৎসাহী ও হতাশাগ্রস্ত না হয়। সুতরাং এই সমস্ত ভর্ৎসনা পয়গম্বরদের সম্বোধন করে বলা হয়েছে বলে মনে হয়; কিন্তু যদিও বাহ্যত পয়গম্বরদের জন্য এগুলি মনে হয় বস্তুতঃ এগুলি জনমণ্ডলীর জন্য, পয়গম্বরদের জন্য নয়।

অধিকন্তু পরাক্রমশালী ও স্বাধীন নরপতি তাঁর দেশে প্রতিনিধিত্ব করেন। তিনি যা কিছু বলেন তা সকলের কথা এবং প্রতিটি চুক্তি যা তিনি করে থাকেন, তা সকলেরই চুক্তি, যেহেতু তার সমুদয় প্রজ্ঞাবর্গের আশা আকাঙ্খা তাঁর আশা-আকাঙ্খার অন্তর্ভূক্ত। অনুরূপভাবে প্রত্যেক বার্তাবাহক সমগ্র জনমÐলীর প্রতিনিধি। সুতরাং তাঁর প্রতি উদ্দেশ্য করে উচ্চারিত আল্লাহ্র প্রতিশ্রুতি ও কথিত বাক্য, সমুদয় লোকের প্রতি প্রযোজ্য। সাধারণত নিন্দা ভর্ৎসনা বাক্য মানবকুলের জন্য অতিশয় ভয়ঙ্কর এবং তাদের জন্য হৃদয় বিদারক হয়ে থাকে। অতএব নির্ভুল বিজ্ঞতা প্রভাষণের এই ধাঁচ ব্যবহার করে, বাইবেলেই সুস্পষ্টভাবে সেটা দেখানো হয়েছে; উদাহরণস্বরূপ ইসরায়েলের সন্তানেরা বিদ্রোহপূর্বক মুসাকে বলে “আমরা অমালেকাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারব না, যেহেতু তারা পরাক্রমশালী. ক্ষমতাবান ও সাহসী। ”

আল্লাহ্ যখন মুসা ও হারুনকে তিরস্কার করেন, যদিও মুসা পূর্ণ আনুগত্যে বহাল ছিলেন এবং বিদ্রোহ করেন নাই। নিশ্চিতই এইরূপ মহান ব্যক্তি যিনি স্বর্গীয় বদান্যতার মধ্যস্থ ব্যক্তি এবং আইন উদ্ধারকর্তা, তিনি অপরিহার্যভাবে আল্লাহ্র আদেশ পালন করেন। এইরূপ পবিত্র আত্মার ব্যক্তিগণ একটি বৃক্ষের পত্রবলীর ন্যায় যে পত্রবলী বায়ু প্রবাহে আন্দোলিত হয়, নিজেদের কামনার তাড়নায় নয়; যেহেতু তাঁরা আল্লাহ্র প্রেমের মৃদুমন্দ সমীরণে আকর্ষিত হন, তাঁদের ইচ্ছা সম্পূর্ণরূপে অনুগত। তাঁদের বাক্য আল্লাহ্র বাক্য, তাঁদের আদেশ আল্লাহ্র আদেশ, তাঁদের নিষেধ আল্লাহ্র নিষেধ। তাঁরা কাঁচের গোলকের ন্যায় যা প্রদীপ থেকে আলো গ্রহণ করে। যদিও আলো কাঁচ থেকে নির্গত হয়ে আবির্ভুত হয়, বস্তুতঃ এটা প্রদীপ থেকে বিকীর্ণ হয়। অনুরূপভাবে আল্লাহর বার্তাবাহকগণ তথা প্রকাশের কেন্দ্রসমূহ, তাদের চালচলন ও বিশ্রাম ঐশী প্রেরণা থেকে আগমন করে, মনুষ্য ভাবাবেগ থেকে নয়। যতি তা না হত, কেমন করে বার্তাবাহক বিশ্বাসযোগ্য হত এবং কেমন করে তিনি আল্লাহ্র আদেশ নিষেধ দানকারীর আল্লাহ্র বার্তাবাহক হতে পারতেন? ঐশী প্রকাশগণ সম্বন্ধে প্রবিত্র গ্রন্থাবলীতে যে সমস্ত ক্রটি-বিচ্যুতির উল্লেখ আছে সেগুলি এই ধরনের প্রশ্ন সংশ্লিষ্ট।

প্রশংসা আল্লাহর যে তোমরা এখানে এসেছো এবং আল্লাহর সেবকদের সঙ্গে সাক্ষাত করেছ! আল্লাহর সন্তুষ্টি ব্যতীত আর কোন কিছু কি তোমরা অনুভব করেছ? বাস্তবিকই না, তোমাদের নিজেদের চোখে তোমরা দেখছ যে, তাঁরা দিবারাত্র কঠোর চেষ্টা করে এবং আল্লাহর বাণীর উন্নতি জনমণ্ডলীর শিক্ষা, সর্বসাধারণের উন্নতি, আধ্যাত্মিক উন্নতি, সার্বজনীন শান্তির ঘোষণা, মানবজাতির প্রতি শুভেচ্ছা, সমুদয় জাতির প্রতি দয়া প্রদর্শন ব্যতীত তাঁদের কোন লক্ষ্য নেই। মানবজাতির কল্যাণার্থে নিজেদেরকে উৎসর্গ করে, তাঁরা পার্থিব সুযোগ সুবিধা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছেন এবং মানবজাতিকে নৈতিক উৎকর্ষ দান করতে পরিশ্রম করেছেন।

যাক, আমাদের বিষয়ে আমরা ফিরে আসি। উদাহরণস্বরূপ, পুরাতন নিয়মে ইসাইয়াহ্র গ্রন্থে ৪৮ অধ্যায়ের ১২ শ্লোকে বলা হয়েছে: “ হে ইয়াকুব ও ইসরায়েল, আমার অভিহিত, আমার কথা শোন, আমিই তিনি; আমিই প্রথম, আমিই শেষও।”এটা সুস্পষ্ট যে, এটা ইয়াকুবকে বোঝাচ্ছে না, যিনি ইসরায়েল ছিলেন এবং ইসরায়েলের জনমণ্ডলীকে বুঝাচ্ছে। ইসাইয়াহর গ্রন্থেও ৪৩ অধ্যায়ের প্রথম শ্লোকে বলা হয়েছে: “এবং এখন প্রভু এইভাবে বলছেন যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছিলেন, হে ইয়াকুব এবং যিনি তোমাকে গঠন করেছিলেন, হে ইসরায়েল, ভয় করো না; যেহেতু আমি তোমাকে মুক্ত করেছি, আমি তোমাকে নাম ধরে ডেকেছি; তুমি আমার।”

অধিকন্তু, গীতি সংহিতায় বিশ অধ্যায়ে, বত্রিশ শ্লোকে বলা হয়েছে “ ইঙ্গোমভূমির উপকূলের পার্শ্ববর্তী তুর পর্বতে প্রভু মুসা হারুন কে বলেন, হারুনকে তাঁর জনমণ্ডলীর কাছে একত্র করা হবে; যেহেতু সে এই ভূমিতে প্রবেশ করতে পারবে না, যা আমি ইসরায়েলের সন্তানদের দান করেছি; কারণ তোমরা মারিবাহ্ সমূদ্রে আমার কথার বিরুদ্ধাচরণ করেছিলে।”এবং ১৩ শ্লোকে “এটাই মারিবাহ্ এর জলাধার; কারণ ইসরায়েলের সন্তানরা প্রভুর সহিত বিবাদ করেছিল এবং তিনি তাদের মধ্যে পূত হয়েছিলেন।”

লক্ষ্য কর, ইসরায়েলের জনমণ্ডলী বিদ্রোহ করেছিল, কিন্তু সুস্পষ্টরূপে ভৎর্সনা মুসা ও হারুনকে করা হয়েছিল। ডিউটারনমি গ্রন্থের তিন অধ্যায়ে ছাব্বিশ শ্লোকে বলা হয়েছে, “কিন্তু পরম প্রভু তোমাদের কারণে আমাদের প্রতি কুপিত হয়েছেন এবং আমার কথা শুনবেন না; এবং পরম প্রভু আমাকে বললেন, এটা তোমার জন্য যথেষ্ট হোক, এই বিষয়ে আমাকে আর কিছু বলবে না।”

এখন এই কথোপকথন এবং ভৎর্সনা বাক্য বাস্তবিকই ইসরায়েল সন্তানদের প্রতি আরোপ করে, যারা আল্লাহর আদেশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের জন্য জর্ডানের অপর পার্শ্বে শুষ্ক মরুভূমিতে বহুদিন যাবত বন্দী ছিলÑ যতদিন না যশুয়ার সময় আগত হল। যশুয়ার প্রতি সালাম। এই সম্বোধন ও ভৎর্সনা বাক্য মুসা ও হারুনের প্রতি প্রয়োগ্য বলে মনে হয়, কিন্তু পকৃতপক্ষে এগুলি ইসরায়েলের জনমণ্ডলীর উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে।

অনুরূপভাবে কোরানে মুহাম্মদকে বলা হয়েছে: “আমরা তোমাকে সুস্পষ্ট বিরাজমান করেছি, যাতে আল্লাহ্ তোমার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী পাপ ক্ষমা করতে পারেন।”কোরন, সুরা-৪৮ । এই সম্বোধন যদিও সুস্পষ্টরূপে মুহাম্মদের প্রতি নির্দেশিত, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সমগ্র জনমণ্ডলীর প্রতি এটা নির্দেশিত। এই প্রকারের সম্বোধন যেরূপ পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, আল্লাহর পূর্ণাঙ্গ বিজ্ঞতায় ব্যবহৃত হয়েছে, যাতে মানবকুলের অন্তঃকরণ বিরত, উদ্বিগ্ন, উৎপীড়িত না হয়।

কতবারই না আল্লাহ্র বার্তাবাহকগণ এবং তাঁর সার্বজনীন প্রকাশগণ তাঁদের প্রার্থনায় তাঁদের পাপ ও ভূলের কথা স্বীকার করেন। এটা শুধু অন্যান্য লোকদের উপদেশ দিতে, উৎসাহিত করতে, তাদের বিনমুতায় উদ্দীপ্ত করতে এবং তাদের পাপ ও ত্রুটি স্বীকার করতে প্রবৃত্ত হতে উৎসাহ দেওয়ার জন্য। যেহেতু এই সমস্ত পূত পবিত্র সুষমাগুলি সর্বপ্রকার পাপ থেকে পবিত্র এবং ভূল থেকে পবিত্রকৃত। সুসমাচারে (গসপেলে) বলা হয়েছে যে, একটি লোক যীশুখ্রিষ্টের কাছে এসে তাঁকে “উত্তম প্রভু”বলে সম্ভাষণ করেন। যিশুখ্রিষ্ট উত্তর দিলেন, “কেন তুমি আমাকে উত্তম বলছ? আল্লাহ্ ব্যতীত আর কেউ উত্তম নেই।” এর অর্থ নয়- আল্লাহ ক্ষমা করুন- যে যীশুখ্রিষ্ট একজন পাপী ছিলেন; কিন্তু উদ্দেশ্য ছিল, যে লোকটির সঙ্গে তিনি কথা করছিলেন তাকে বিনম্রতা, আনুগত্য, শালীনতা শিক্ষা দেওয়া। এই পবিত্র পুরুষগণ হচ্ছেন আলোক, এবং আলোক অন্ধকারের সহিত একতাবদ্ধ হয় না। তাঁরা হচ্ছেন জীবন, এবং জীবন ও মৃত্যু মিশ্রিত হয় না; তাঁরা হচ্ছেন পথ নির্দেশনা এবং পধ নির্দেশনা ও কর্তব্যচ্যুতি এক হতে পারে না, তাঁরা হচ্ছেন আনুগত্যের সারভাগ এবং আনুগত্য বিদ্রোহের সঙ্গে অস্তিত্ববান হতে পারে না তথা সহ অবস্থান করতে পারে না।

উপসংহারে পবিত্র গ্রন্থসমূহে ভৎর্সনার আকারে সম্বোধনসমূহ যদিও সুস্পষ্টরূপে পয়গম্বরগণের প্রতি নির্দেশিত, অর্থাৎ আল্লাহর প্রকাশগণের উদ্দেশ্যে বলা হয়ে থাকে, কিন্তু বস্তুতঃ এগুলি জনমণ্ডলীর প্রতি অভিপ্রেত। এটা তোমার কাছে পরিস্কার ও সুষ্পষ্ট হবে যখন তুমি পরিশ্রম সহকারে পবিত্র গ্রন্থাবলী পরীক্ষা করবে।

তোমার উপর অভিবাদন।

24
কিতাবুল আক্বদাসের “সর্বোচ্চ পাপহীনতায় ঐশী প্রকাশের প্রভাত স্থানের সঙ্গী তথা অংশীদার নাই” শ্লোকের ব্যাখ্যা

পবিত্র শ্লোকে বলা হয়েছে, “সর্বোচ্চ পাপহীনতায় ঐশী প্রকাশের প্রভাত স্থানের সঙ্গী তথা অংশীদার নাই।” প্রকৃতপক্ষে তিনি সৃষ্ট রাজ্যে “যা ইচ্ছা তাই তিনি করেন”এই প্রবচনের প্রকাশক। সত্য সত্যই আল্লাহ্ এই পদ মর্যাদা নিজের জন্য সংরক্ষিত করেছেন এবং এই অলংঘণীয় শর্তের অংশ কাউকে দেন নাই।

জেনে রাখ, পাপহীনতা দুই প্রকারের: অপরিহার্য পাপহীনতা এবং অর্জিত পাপহীনতা। অনুরূপভাবে অপরিহার্য তথা অত্যাবশ্যক জ্ঞান ও অর্জিত জ্ঞান বিদ্যমান রয়েছে এবং অন্যান্য নাবলী ও গুণাবলীর একই অবস্থা। অপরিহার্য তথা অত্যাবশ্যক পাপহীনতা সার্বজনীন ঐশী প্রকাশের নিজস্ব, যেহেতু এটা তার অত্যাবশ্যক প্রয়োজন এবং একটি অত্যাবশ্যক প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট বস্তু থেকে হতে বিচ্ছিন্ন হতে পারে না। রশ্মিসমূহ সূর্যের অত্যাবশ্যক প্রয়োজন এবং সেটা তার থেকে অবিচ্ছেদ্য। শক্তি আল্লাহর অপরিহার্য প্রয়োজন এবং সেটা তাঁর থেকে বিচ্ছন্ন হতে পারে না। এটা যদি তাঁর থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারত, তাহলে তিনি আল্লাহ্ হতে পারতেন না। যদি রশ্মিসমূহ সূর্য থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারত, তাহলে সূর্য- সূর্য হতে পারত না। সুতরাং যদি কেউ সার্বজনীন ঐশী প্রকাশ থেকে সর্বোচ্চ পাপহীনতা বিচ্ছেদ কল্পনা করে, তাহলে তিনি সার্বজনীন ঐশী প্রকাশ হতে পারবেন না এবং তিনি অত্যাবশ্যক পূর্ণতার প্রভাব দোষে দুষ্ট হবেন।

কিন্তু অর্জিত পাপহীনতা স্বাভাবিক প্রয়োজন নয়; পক্ষান্তরে এটা পাপহীনতার বদান্যতার একটি রশ্মি, যা বাস্তবতার সূর্য থেকে অন্তঃকরণসমূহের উপর কিরণ বর্ষণ করে এবং আত্মাসমূহকে এর একটা অংশ ও পরিমাণ দান করে। যদিও এই আত্মাগুলির অত্যাবশ্যকীয় পাপহীনতা নেই তবুও তারা আল্লাহর আশ্রয়াধীন থাকে; অর্থাৎ পাপ থেকে আল্লাহ তাদের রক্ষা করেন। এইরূপে পবিত্র পুরুষদের অনেকে, যারা সর্বোচ্চ পাপহীনতার প্রভাত বিন্দুসমূহ ছিলেন না, আল্লাহর রক্ষণাবেক্ষণেও অভিভাবকত্বের ছায়ায় পাপ থেকে সংরক্ষিত হয়েছিল, কারণ তারা ছিলেন আল্লাহ ও মানুষের মধ্যে অনুকম্পার মধ্যস্থ ব্যক্তি। যদি আল্লাহ তাঁদের ভ্রান্তি তথা পাপ থেকে রক্ষা না করতেন, তাহলে তাঁদের পাপ বিশ্বাসী আত্মাব্যক্তিদের পাপে পতন ঘটাতো এবং এইরূপে আল্লাহ ধর্মের ভিত উল্টে যেত, যা আল্লাহর পক্ষে উপযুক্ত হত না।

সংক্ষেপে বলতে গেলে, অত্যাবশ্যক পাপহীনতা বিশেষভাবে সার্বজনীন ঐশী প্রকাশগণের অধিকারভূক্ত এবং অর্জিত পাপহীনতা প্রত্যেক পবিত্র আত্মাকে দেওয়া হয়ে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, সাধারণ ন্যায়বিচারালয়, যদি এটা সমুদয় জনমণ্ডলী থেকে নির্বাচিত সদস্যসমূহসহ প্রয়োজনীয় শর্তধীনে প্রতিষ্ঠিত হয় তবে সইে ন্যায় বিচারালয় আল্লাহর রক্ষণাবেক্ষণ ও অভিভাবকের অধীন হবে। যদি সেই ন্যায় বিচার গৃহ, ধর্মগ্রন্থে উল্লেখিত নেই এমন কোন বিষয়ের উপর সম্মতিক্রমে অথবা সংখ্যারিষ্ঠের মতানুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, তবে সেই সিদ্ধান্ত ও সেই আদেশ ভ্রান্তি থেকে রক্ষিত হবে। এখন উক্ত বিচারালয়ের সদস্যদের ব্যক্তিগত অত্যাবশ্যক পাপহীনতা নেই, কিন্তু উক্ত বিচার গৃহের সদস্যদের সমষ্টি আল্লাহর আশ্রয়াধীন, একেই অর্পিত অভ্রন্ততা বলে।

সংক্ষেপে, কথিত আছে যে, “ঐশী প্রকাশের উদয়স্থল”এই কথাগুলির অভিব্যক্তি “তিনি যা খুশি তাই করেন”; এই অবস্থা উক্ত পবিত্র পুরুষদের নিজস্ব ক্ষমতাভূক্ত এবং অন্যান্যদের এই অত্যাবশ্যক পূর্ণতার অংশ নেই। অর্থাৎ সার্বজনীন প্রকাশহগণ নিশ্চিতরূপে অত্যাবশ্যক পাপহীনতার অধিকারী, অতএব যা কিছু তাদের থেকে নির্গথ হত তা সত্যের সহিত অভিন্ন তথা এক এবং বাস্তবতার অনুরূপ। তারা পূর্বের আইন কানুনের ছায়াধীন নন। যা কিছুই তাঁরা বলেন তা আল্লাহর বাণী এবং যা কিছুই তারা সম্পাদন করেন তা ন্যায় কার্য। কোন বিশ্বাসীর সমালোচনা করার কোন অধিকার নেই; তাঁর অবস্থা হবে নিষ্কলুষ আনুগত্যের মধ্যে একটি, কারণ ঐশী প্রকাশ পূর্ণ বিজ্ঞতা সহকারে আবির্ভূত হন।

সুতরাং যা কিছু সার্বজনীন ঐশী প্রকাশ বলেন ও করেন, তা বিজ্ঞতা এবং যা সত্যতা তথা বাস্তবতা অনুসারে হয়ে থাকে। যদি কোন কোন লোক তাঁর আদেশাবলীর কোনটির গ্রপ্ত রহস্য রা বুঝতে পারে, তাহলে তাদের এতে আপত্তি করা উচিত নয়, যেহেতু সার্বজনীন ঐশী প্রকাশ যা ইচ্ছা তা করেন। কতবারই না এইরূপ ঘটেছে যে, যখন কোন কাজ কোন বিজ্ঞ পূর্ণ বুদ্ধিমান ব্যক্তি দ্বারা সম্পন্ন হয়েছে, যা অন্যান্যরা তার বিজ্ঞতা অনুধাবনে অসমর্থ হয়েছে, তখন তারা তাতে আপত্তি উত্থাপন করেছে, এবং বিস্মিত হয়েছে এইভেবে যে, এই বিজ্ঞ ব্যক্তি এরূপ বলতে বা করতে পারল। এই আপত্তি তাদের অজ্ঞতা থেকে আসে এবং ঋষি ব্যক্তিদের বিজ্ঞতা পাপ তেকে মুক্ত ও পবিত্র। অনুরূপভাবে সুনিপুণ চিকিৎসক রোগীর চিকিৎসায় “যা তিনি ইচ্ছা করেন, তাই তিনি করেন”এবং রোগীর আপত্তি করার কোন অধিকার নেই, চিকিৎসক যা বলেন বা করেন তাই সঠিক। সকলেই তাঁকে “যা ইচ্ছা তাই তিনি করেন, যা ইচ্ছা তাই তিনি আদেশ করেন” এই প্রবচনগুলির অভিব্যক্তি বিবেচনা করা উচিত। এটা সুনিশ্চিত যে, চিকিৎসক অন্য লোকদের ধারণার পরিপন্থি কিছু ঔষধ ব্যবহার করেন; এখন, বিজ্ঞান ও ডাক্তারী শাস্ত্রের উপর যাদের প্রাধান্য নইে তাদের আপত্তি প্রহণযোগ্য নয়। না, আল্লাহর নামে বলছি! পক্ষান্তরে উক্ত বিজ্ঞ চিকিৎসক যা কিছু বলেন সেটা সম্পাদন করা ও তার প্রতি অনুগত থাকা সকলের কর্তব্য। সুতরাং উক্ত নিপুণ চিকিৎসক “যা ইচ্ছা করেন” এবং রোগীদের এই অধিকারে কোন অংশ নেই। চিকিৎসকের নৈপুণ্য প্রথমেই নিরুপণ করতে হবে; কিন্তু চিকিৎসকের নৈপুণ্য একবার নিরুপিত হলে “তিনি যা ইচ্ছা করেন, তাই করেন।”

অনুরূপভাবে যখন সেনাবাহিনীর প্রধান যুদ্ধ বিদ্যায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী হন তখন তিনি যা বলেন ও আদেশ দেন তাতে “তিনি যা ইচ্ছা তাই করেন।” যখন জাহাজের কাপ্তান নৌ চালন বিদ্যায় দক্ষ হন, তখন যা কিছু তিনি বলেন ও আদেশ দেন. তাতে “তিনি যা ইচ্ছা করেন”; এবং যেহেতু প্রকৃত শিক্ষাদাতা পূর্ণ পুরুষ, যা কিছু তিনি বলেন এবং আদেশ করেন, তাতে “তিনি যা কিছু ইচ্ছা করেন, তাই তিনি করেন।”

সংক্ষেপে, “তিনি যা ইচ্ছা করেন তাই করেন”এর অর্থ হচ্ছে যদি ঐশী প্রকাশ কিছু বলেন অথবা কোন আদেশ দেন, অথবা কোন কার্য সম্পাদন করেন এবং বিশ্বাসীগণ এর বিজ্ঞতা নাও বুঝতে পারেন, তবুও কেন তিনি এটা বললেন, অথবা কেন তিনি এরূপ কাজ করলেন - এটা জানবার সামান্য চিন্তার দ্বারাও মনে আপত্তির স্থান দেওয়া উচিত নয়। অন্যান্য আত্মাসমূহ যারা সার্বজনীন ঐশী প্রকাশগণের ছায়াধীন, তারা আল্লাহ্র আইনের প্রতি অনুগত, এরা চুল পরিমাণও এর থেকে বিচ্যুত হন না; আল্লাহ্র আইন মোতাবেক তারা তাদের কার্যাবলী ও বাক্যাবলীর মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করেন। যদি তাঁরা এর থেকে বিচ্যুত হয়, তাহলে তাঁরা আল্লাহ্র সমক্ষে দায়ী ও তিরষ্কৃত হন। এটা নিশ্চিত যে “ তিনি যা ইচ্ছা করেন, তাই তিনি করেন”এই প্রবচনে তাঁর কোন অংশে অনুমতি নেই, কারণ এটা সার্বজনীন ঐশী প্রকাশগণের নিজস্ব অবস্থা বা শর্ত।

অত্রএব যিশুখ্রিষ্ট তাঁর প্রতি আমার আত্মা উৎস্বর্গকৃত হোক- এই বাক্যাবলীর অভিব্যক্তি ছিলেন, “তিনি যা ইচ্ছা করেন, তাই তিনি করেন”কিন্তু শিষ্যগণ এই অবস্থার অংশীদার ছিলেন না; যেহেতু তাঁরা ছিলেন যিশুখ্রিষ্টের ছায়াধীন, তারা তাঁর আদেশ ও ইচ্ছা থেকে বিচ্যুত হতে পারতেন না।

মানুষের উৎপত্তি, শক্তিসমূহ ও অবস্থানসমূহ

25
প্রজাতিসমূহের পরিবর্তিত আকার

আমরা এখন প্রজাতিসমূহের আকার পরিবর্তন ও আঙ্গিক ক্রম বিকাশের প্রশ্নে উপনীত হয়েছি। অর্থাৎ অনুসন্ধানের পশ্নে উপনীত হয়েছি যে, পশু থেকে মানুষের উৎপত্তি কি না।

এই মতবাদ কতিপয় ইউরোপীয় দার্শনিকদের মনে স্থান পেয়েছে এবং এখন এটায় অমূলকত্ব বোঝান সুকঠিন হয়ে দাড়িয়েছে; কিন্তু ভবিষতে এটা পরিষ্কার ও সুস্পষ্ট হবে এবং ইউরোপীয় দার্শনিকগণ নিজেরাই এর অসত্যতা হৃদয়ঙ্গম করবেন। কারণ সত্যসত্যই এটা সুস্পষ্ট ভ্রান্তি। মানুষ যখন তীক্ষ্ম স্থিরদৃষ্টি সহকারে ব্যক্তি বা বস্তুর গঠন বা প্রকৃতির দিকে দৃষ্টিপাত করবে এবং অস্তিত্বসমূহের অবস্থা মনোযোগ সহকারে পরীক্ষা নিরীক্ষা করবে এবং যখন সে পৃথিবীর অবস্থা, সংগঠন ও পূর্ণতা লক্ষ্য করবে তখন সে প্রমাণ প্রয়োগে আত্ম প্রত্যয়ী হবে যে, সম্ভাব্য পৃথিবীতে যা কিছু অস্তিত্বশীল আছে, তার চেয়ে বেশী বিস্ময়কর কোন কিছু নেই। যেহেতু সমুদয় অস্তিত্বশীল বস্তু পার্থিব ও নভোমণ্ডলীর এবং সীমাহীন মহাশূন্য এবং যা কিছু এর মধ্যে আছে সব কিছুই ঠিক যেরূপ হওয়া উচিত সেইরূপই স্পষ্ট ও সংগঠিত, সুবিন্যস্ত, সুসজ্জিত ও পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয়েছে। বিশ্ব ব্রক্ষ্মাণ্ডের অপূর্ণতা নেই; সুতরাং যদি সমুদয় অস্তিত্বশীল বস্তু বিশুদ্ধ বুদ্ধিমত্তায় পরিণত হত এবং অবিরত পূর্ণভাবে বিবেচনা করতো, তবুও এটা অসম্ভব যে, যা কিছু অস্তিত্বশীল আছে, তদপেক্ষা তারা উত্তম কোন কিছু কল্পনা করতে পারতো।

কিন্তু যদি অতীতে সৃষ্ট চরম পূর্ণতায় সজ্জিত না হয়ে থাকে তাহলে অস্তিত্ব অসম্পূর্ণ ও অর্থহীন হয়ে পড়তো এবং এই বিষয়ে সৃষ্টি অসম্পূর্ণ হয়ে পড়তো। এই প্রশ্ন সর্বাপেক্ষা গুরুত্ব ও চিন্তা সহকারে বিচার করার প্রয়োজন রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ কল্পনা কর যে, সম্ভাবনার জগত অর্থাৎ অস্তিত্বের জগত সাধারণভাবে একটি মানব দেহের অনুরূপ। যদি এই সংযুক্তি সংগঠন, পূর্ণতা, সৌন্দর্য এবং সম্পূর্ণতা যা এখন মানব দেহে বিদ্যমান আছে, তা যদি অন্য প্রকার হত তাহলে এটা সম্পূর্ণ অপূর্ণতা দোষে দুষ্ট হবে। এখন যদি আমরা একটা সময়ের কল্পনা করি, যখন মানুষ প্রাণী জগতের অন্তর্ভূক্ত ছিল অথবা যখন সে একটি পশু ছিল, তাহলে আমরা দেখতে পাব যে, অস্তিত্ব অসম্পূর্ণ ছিল; অর্থাৎ মানুষের অস্তিত্ব ছিল না এবং এই প্রধান সদস্য যা পৃথিবীর দেহে মানুষের মধ্যে নিহিত মস্তিষ্ক ও মন সদৃশ, এই প্রধান সদস্য নিরুদ্দিষ্ট। তাহলে পৃথিবী সম্পূর্ণ অপূর্ণ ছিল। তাহলে প্রমাণিত হচ্ছে যে যদি এমন একটি সময় থেকে থাকে যখন মানুষ পশু জগতে অস্তিত্ববান ছিল, তাহলে অস্তিত্বের পূর্ণতা তথা পূর্ণাঙ্গতা বিনষ্ট হতে বাধ্য; কারণ মানুষ হচ্ছে এই বিশ্ব চরাচরের সর্বশ্রেষ্ঠ সদস্য এবং যদি দেহটি এই প্রধান সদস্য বিহীন হয় তাহলে নিশ্চিতই এটা একটা অপূর্ণতা দোষে দুষ্ট হবে। আমরা মানুষকে শ্রেষ্ঠতম সদস্য বলে বিবেচনা করি, প্রাণী কুলের মধ্যে সমুদয় অস্তিত্বশীল পূর্ণতাসমূহের মধ্যে সেই চূড়ান্ত সমষ্টি। যখন আমরা মানুষের কথা বলি তখন আমরা পূর্ণাঙ্গ কাউকে তথা পৃথিবীর সর্বোত্তম বা শীর্ষস্থানীয় একটি প্রাণধারীকে বুঝে থাকি যে প্রাণধারী জীব অস্তিত্বশীলদের মধ্যে সূর্যসম। তাহলে কল্পনা কর যে এক সময় সূর্যের অস্তিত্ব ছিল না, কিন্তু ওটা একটা গ্রহ ছিল- তাহলে নিশ্চয়ই এইরূপ সময় অস্তিত্বের সম্পর্কসমূহ বিশৃঙ্খল হত। কেমন করে এইরূপ ব্যাপার কল্পনা করা যেত পারে? যে ব্যক্তি সম্বন্ধে পরীক্ষা নীরিক্ষা করে, তাকে আমরা যা বলেছি সেটাই যথেষ্ট।

এর চেয়েও আরো সুক্ষ্ম প্রমাণ রয়েছে: এই সমস্ত অশেষ অস্তিত্বশীল প্রাণীকুল যা পৃথিবীতে বসবাস করছে, তা মানুষ, জীব, উদ্ভিদ, খনিজ যা কিছুই হোক না কেন নিশ্চিতই তারা প্রত্যেকেই উপাদান দ্বারা গঠিত। সন্দেহ নেই যে, সমুদয় অস্তিত্বশীল জীব জন্তুর মধ্যে নিহিত এই পরোৎকর্ষতা সুবিন্যাস্তকারী উপাদানসমূহের যথোপযুক্ত মিশ্রণ ও সমানুপাতিক পরিমাণ, উপাদানসমূহের সংযুক্তির আকার এবং অপরাপর অস্তিত্ববান বস্তুসমূহের প্রভাব থেকে আল্লাহর সৃষ্টি দ্বারা এটা সম্ভব হয়েছে। যেহেতু সমুদয় অস্তিত্বসমূহ একটি শিকলের ন্যায় পারস্পারিক সাহায্য সহযোগিতা ও প্রভাবের যোগসূত্রে একত্রে সংযুক্ত বস্তুসমূহের গুণের অংশভূক্ত, সেহেতু সৃষ্টি অস্তিত্ববান জীব জন্তুর অস্তিত্ব বিকাশ ও বৃদ্ধির কারণ। সাক্ষ্য প্রমাণবিলীর মাধ্যমে এটা নিশ্চিত যে প্রত্যেক অস্তিত্বশীল কোন কিছু হয় সম্পূর্ণরূপে অথবা সম্মেলনের মাধম্যে সার্বজনীনভাবে অন্যান্য অস্তিত্বসমূহ অনুসারে কার্য করে। উপসংহারে প্রত্যেক স্বতন্ত্র অস্তিত্বে পূর্ণতা অর্থাৎ যে পূর্ণতা তুমি এখন মানুষের মধ্যে দেখতে পাও অথবা মানুষ ছাড়া তাদের পরমাণুসমূহ, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অথবা শক্তিসমূহ সম্বন্ধে যে পূর্ণতা তুমি দেখতে পাও এটা উপাদানসমূহের সংযুক্তি, উপাদানের নির্ধারিত পরিমাণ, ভারসাম্য, সম্মেলন এবং পারস্পারিক প্রভাবের কারণে হয়েছে। যখন এইগুলি একত্রিত হয় তখন মানুষ অস্তিত্ববান হয়।

যেহেতু মানুষের পরোৎকর্ষতা সম্পূর্ণরূপে উপাদানসমূহের অনু পরমাণুর সংযুক্তি, এর নির্ধারিত পরিমাণ, এর সম্মিলণের পদ্ধতি এবং বিভিন্ন অস্তিত্বশীল বস্তুর পারস্পারিক কার্য সম্পাদনের ও প্রভাবের কারণ হয়েছে- যেহেতু দশ অথবা একশত হাজার পূর্বে মানুষ এই সমস্ত পার্থিব উপাদান দ্বারা একই নির্ধারিত পরিমাণ ও ভারসাম্য, মিশ্রণ সংযুক্তির একই পদ্ধতি এবং অন্যান্য অস্তিত্বসমূহের একই প্রভাবে উৎপাদিত হয়েছিলÑ সেহেতু অবিকল সেই একই মানুষ অন্ধকার মানুষের ন্যায় তখনও অস্তিত্ববান ছিল। এটা সুস্পষ্ট ও বির্তক সাপেক্ষ নয়। এখন থেকে হাজার মিলিয়ন বছর পূর্বে যদি মানুষের এই উপাদানগুলি একত্রিত করা হয় এবং এই বিশেষ অনুপাতে বিন্যাস করা হয় এবং যদি একই পদ্ধতিতে সম্মিলিত করা হয় এবং যদি অন্যান্য অস্তিত্বসমূহের দ্বারা প্রভাবিত করা হয় তাহলে সেই একই মানুষ অস্তিত্ব লাভ করবে। উদাহরণস্বরূপ যদি শত হাজার বছর পর তেল, আগুন, শলিতা, প্রদীপ ও প্রদীপ জ্বালানোর যন্ত্র থাকে সংক্ষেপে যদি অত্যাবশ্যকীয় বস্তু থাকে যা এখন বিদ্যমান তাহলে অবিকল সেই একই প্রদীপ লাভ করা যাবে।

এইগুলিই চূড়ান্ত ও সুস্পষ্ট তথ্য। কিন্তু যে যুক্তিতর্ক এই ইউরোপীয় দার্শনিকগণ উত্থাপন করেছেন তা সন্দেহপূর্ণ প্রমাণ এবং সিদ্ধান্তমূলক নয়।

26
বিশ্ব-ব্রক্ষ্মাণ্ড আরম্ভবিহীন (মানুষের উৎপত্তি)

জেনে রাখ যে, নিগূঢ় আধ্যাত্মিক সত্যসমূহের মধ্যে একটি হচ্ছে এই যে, অস্তিত্ব জগতের অর্থাৎ এই অসীম বিশ্ব ব্রক্ষ্মাণ্ডের কোন আরম্ভ নেই।

আমরা ইতিমধ্যেই ব্যাখ্যা করেছি যে খোদাইত্বের (ঈশ্বরত্বের) নামাবলী ও গুণাবলী অস্তিত্ব বিদ্যমানতা আবশ্যকবোধ করে। যদিও এই বিষয় বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা হয়েছে, তবু আমরা পুনরায় এই বিষয়ে বলব। জেনে রাখ যে ছাত্রবিহীন একজন শিক্ষাদাতা কল্পনা করা যেতে পারে না, প্রজা সাধারণ বিহীন একজন সম্রাটের অস্তিত্ব থাকতে পারে না, শিক্ষার্থী ব্যতীত একজন শিক্ষক নিযুক্ত হতে পারে না, সৃষ্টি বস্তু বিহীন একজন স্রষ্টা অসম্ভব, যোগান প্রদত্ত বস্তু ব্যতীত যোগানদাতার কল্পনা করা যেতে পারে না; সেহেতু সমুদয় স্বর্গীয় নামাবলী ও গুণাবলী অস্তিত্বসমূহের বিদ্যমানতা দাবী করে। আমরা যদি এরূপ এক সময়ের কল্পনা করি যখন কোন অস্তিত্বশীল কোন কিছুর অস্তিত্ব ছিল না, তাহলে এই কল্পনা খোদার খোদাইত্বের (ঈশ্বরের ঈশ্বরত্ব) অস্বীকার করা হবে। অধিকন্তু সম্পূর্ণ অনস্তিত্ব অস্তিত্বে পরিণত হতে পারে না। যদি অস্তিত্বসমূহ সম্পূর্ণরূপে অবিদ্যমান তথা অস্তিত্বহীন থাকতো, অস্তিত্ব প্রাণবন্ত হতে পারতো না। অতএব, একত্বের অর্থাৎ অদ্বিতীয়ত্বের সারৎসার অর্থাৎ আল্লাহর অস্তিত্ব শাশ্বত ও চিরস্থায়ী অর্থাৎ এর আরম্ভও নেই শেষও নেই। এটা নিশ্চিত যে এই অস্তিত্ব জগত এই সীমাহীন তথা বিশ্ব ব্রক্ষ্মাণ্ডের আরম্ভও নেই শেষও নেই। হ্যা, উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে এটা হতে পারে যে, বিশ্ব ব্রক্ষ্মাণ্ডের কোন এক অংশ ভূগোলকের কোন অংশ অস্তিত্ব আসতে পারে, অথবা বিয়োজিত হতে তথা সংসক্তি হারাতে পারে; কিন্তু তবুও অন্যান্য অশেষ ভ‚ গোলক তখনও বিদ্যমান থাকছে। বিশ্বব্রক্ষ্মাণ্ডের বিশৃঙ্খল অথবা বিনাশ প্রাপ্ত হবে না; পক্ষান্তরে অস্তিত্ব শাশ্বত ও চিরস্থায়ী। যেহেতু প্রত্যেক ভূগোলকের আরম্ভ আছে সেহেতু অপরিহার্যরূপে এর শেষও আছে, কারণ প্রত্যেক সমষ্টিগত অথবা নির্দিষ্ট মিশ্রণ তথা সংযুক্ত অপরিহার্যরূপে বিশ্লিষ্ট হতে বাধ্য। শুধুমাত্র পার্থক্য এই যে, কেহ কেহ বা কতকগুলি তাড়াতাড়ি বিশ্লিষ্ট হয় এবং অপর কেউ কেউ বা কতকগুলি বেশ দেরীতে বিশ্লিষ্ট হয়; কিন্তু এটা অসম্ভব যে একটা সংযোজিত তথা সুবিন্যাস্ত বস্তু অবশেষে বিশ্লিষ্ট হবে না।

অতএব এটা অত্যাবশ্যক যে, আমাদের জানা উচিত যে, গুরুত্বপূর্ণ অস্তিত্বসমূহের প্রত্যেকটি আরম্ভে কি ছিলÑ কারণ সন্দেহ নেই যে আরম্ভে উৎপত্তি (জন্ম) ছিল একক; সমুদয় সংখ্যার উৎপত্তি তথা মূল হচ্ছে একÑ দুই নয়। তাহলে এটা সুস্পষ্ট যে আরম্ভে পদার্থ তথা জড় বস্তু ছিল এক, এবং সেই একক পদার্থ প্রত্যেক উপাদানে বিভিন্ন আকৃতিতে আবির্ভূত হয়। এইভাবে বিভিন্ন আকার উৎপন্ন হয়; এবং এই বিভিন্ন আকৃতিগুলি যেভাবে উৎপন্ন হয়েছিল, সেইভাবেই স্থায়ী হল এবং প্রত্যেক উপাদান স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে বিশিষ্ট হল। কিন্তু এই স্থায়ীত্ব নির্দিষ্ট ছিল না এবং দীর্ঘকাল পার ছাড়া বাস্তবায়ন ও পূর্ণ অস্তিত্বলাভ করে নাই। অতঃপর এই উপাদানগুলি অনন্ত অসীম আকারসমূহে সংযোজিত তথা সুবিন্যাস্ত এবং সংগঠিত ও সম্মিলিত হল; অথবা বরং এই উপাদানগুলির সংযুক্তি ও সম্মিলন থেকে অগণিত অস্তিত্বসমূহ আবির্ভূত হল।

এই সংযুক্তি ও সুবিন্যাস্ত ব্যবস্থা আল্লাহ্র বিজ্ঞতা ও পূর্বাহ্নেই বিদ্যমান শক্তিমত্তার মাধ্যমে একক স্বাভাবিক সংগঠন থেকে উৎপাদিত হয়ে ছিল- যা (যে সংগঠন) বৃহত্তম শক্তি, বিজ্ঞতানুরূপ ও এক সার্বজনীন আইন দ্বারা সংযুক্ত ও সম্মিলিত। এর থেকে এটাই সুস্পষ্ট যে এটা আল্লাহ্র সুষ্টি কোন আকস্মিক সংযুক্তি বা বিন্যাস ব্যবস্থা নয়। এই জন্যই প্রত্যেক স্বাভাবিক সংযুক্তি থেকে একটা অস্তিত্ব জন্মলাভ করে। উদাহরণস্বরূপ যদি কোন লোক তার নিজের জ্ঞান, মন ও বুদ্ধি দ্বারা কতিপয় উপাদান সংগ্রহ করে ও এগুলি মিশ্রিত করে তাহলে একটি জীবন্ত অস্তিত্ববান কোন কিছু জন্মগ্রহণ করবে না, যেহেতু পদ্ধতিটি অস্বাভাবিক। অনুমতি প্রশ্নে উত্তর এই যে, যতি উপাদানসমূহের সংযুক্তি ও সম্মিলনের দ্বারা অস্তিত্বশীল জীবন কোন কিছু সৃষ্ট হয়, তাহলে উপাদাসমূহ একত্রে মিশ্রণপূর্বক কেন আমাদের পক্ষে জীবন্ত অস্তিত্ব বা জীবন কোন কিছু সৃষ্টি করা সম্ভব হয় না? এটা একটি ভ্রান্ত অনুমান, কারণ এই সংযুক্তির মূল তথা উৎপত্তি আল্লাহ থেকে হয়ে থাকে। আল্লাহই সংযুক্তি বা সংমিশ্রণ করেন এবং যেহেতু এটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়ানুযায়ী হয়, সেহেতু প্রত্যেক সংযুক্তি তথা সংমিশ্রণ থেকে একটি তথা একক অস্তিত্ব উৎপন্ন হয় এবং একটি অস্তিত্ব বাস্তবায়ন হয়। নমুনা সৃষ্ট সংমিশ্রণ কিছুই উৎপাদন করে না, কারণ মানুষ সৃষ্টি করতে পারে না।

সংক্ষেপে আমরা বলছি যে, উপাদানসমূহের সংমিশ্রণ ও সম্মিলন থেকে এবং এই সমস্ত উপাদানের বিয়োজন তথা বিশ্লেষণ থেকে এইগুলির সঠিক পরিমাণ থেকে, এইগুলির উপর অন্যান্য অস্তিত্বের প্রভাব থেকে আকারসমূহ, অশেষ সত্ত্বাসমূহ এবং অগণিত জীবন সত্ত্বাসমূহ উৎপত্তি লাভ করেছিল। কিন্তু এটা পরিষ্কার যে এই পার্থিব ভূগোলক এর বর্তমান আকারে রহস্য অস্তিত্বে আসে নাই; কিন্তু এই সার্বিক অস্তিত্ব ক্রমে ক্রমে বিভিন্ন ক্রমোন্নতি পক্রিয়ার ধাপের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করতে থাকে, যে পর্যন্ত না এটা এর বর্তমান পূর্ণতায় সজ্জিত হয়। সার্বজনীন অস্তিত্বসমূহ অনুরূপ হয় এবং নির্দিষ্ট অস্তিত্বসমূহের সহিত তুলনা করা যেতে পারে, কারণ উভয়ই একক সাধারণ পদ্ধতি, একক সার্বজনীন আইন ও স্বর্গীয় সংগঠনের মুখাপেক্ষী। সুতরাং তুমি দেখবে সার্বজনীন নিয়মবদ্ধ রীতিতে ক্ষুদ্রতম অনুসমূহ বিশ্ব ব্রক্ষ্মাণ্ডের বৃহত্তম অস্তিত্বের অনুরূপ। এটা সুস্পষ্ট যে, এই সমস্ত অস্তিত্ব একক সার্বজনীন আইন ও একক স্বাভাবিক পদ্ধতির অধীন শক্তির একক পরীক্ষাগার থেকে অস্তিত্বপ্রাপ্ত হয়েছে; অতএব এদের একে অন্যের সহিত তুলনা করা যেতে পারে। এইভাবে মাতৃগর্ভে মানুষের ভ্রূণ বৃদ্ধি ও বিকাশপ্রাপ্ত হয় এবং বিভিন্ন আকার ও অবস্থায় প্রকাশিত হয়- যে পর্যন্ত না পূর্ণ সৌন্দর্যের পর্যায় এটা পূর্ণপরিণতিতে পৌঁছায় এবং পরম লাবন্যসহকারে পূর্ণ আকৃতিতে আবির্ভূত হয় এবং অনুরূপভাবে এই ফুলের বীজ যা তুমি দেখছ, এটা শুরুতে তথা আরম্ভে ছিল একটি অকিঞ্চিতকর বস্তু এবং অতি ক্ষুদ্র এবং ভূগর্ভে বৃদ্ধি পেল ও বিকশিত হল এবং বিভিন্ন আকারে প্রকাশিত হওয়ার পর পূর্ণ সতেজতা ও লাবণ্য সহকারে এই অবস্থায় এসেছে। অনুরূপভাবে এটা সুস্পষ্ট যে, এই পার্থিব ভূগোলক একদা অস্তিত্বে এসে বিশ্ব ব্রক্ষ্মাণ্ডের গর্ভে বৃদ্ধি ও বিকাশ লাভ করলো এবং বিভিন্ন আকার ও অবস্থা পেতে থাকলো - যে পর্যন্ত না এটা ক্রমে ক্রমে এই বিদ্যমান পূর্ণতাপ্রাপ্ত হল এবং অগণিত অস্তিত্ব সহকারে সজ্জিত হল এবং একটি সমাপ্তি সংগঠনস্বরূপ আবির্ভূত হল।

তাহলে এটা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত যে, মৌলিক তথা প্রাথমিক পদার্থ বা ভ্রূণ বা মৌলিক অবস্থায় বিদ্যমান এবং মিশ্রিত ও সংযুক্ত উপাদানসমূহ যা সর্ব প্রারম্ভিক আকারে বিদ্যমান ছিল, তা বহু যুগ ও কালচক্রব্যাপী এক আকার আকৃতি থেকে অপর আকার আকৃতি অতিক্রমপূর্বক ক্রমে ক্রমোবৃদ্ধি ও বিকশিত হতে থাকেÑ যে পর্যন্ত না সেগুলি আল্লাহর সর্বোচ্চ বিজ্ঞতার মাধ্যমে এই পরোৎকর্ষতা, এই পদ্ধতি, এই সংগঠন ও এই স্থায়ী প্রতিষ্ঠায় আবির্ভূত হয়।

এসো আমরা আমাদের আলোচ্য বিষয়ে ফিরে যাই যে, মানুষ মাতৃগর্ভে ভ্রূণের ন্যায়, তার অস্তিত্বের আরম্ভে ধরাগর্ভে ক্রমে ক্রমে বৃদ্ধি ও ক্রমবিকাশ লাভ করে এবং এক আকার থেকে অন্য আকৃতিতে অতিক্রম করতে থাকে- যে পর্যন্ত না সে এই সৌন্দর্য ও পরোৎকর্ষতা, এই ক্ষমতা, এই শক্তিসহকারে আবির্ভূত হয়েছিল। এ্টা সুনিশ্চিত যে আরম্ভে তার এই সৌন্দর্যই লাবন্য ও নমনীয়তা ছিল না এবং সে শুধুমাত্র ক্রমিকধারায় এই আকার আকৃতি, এই সৌন্দর্য ও এই লাবন্য লাভ করে। সন্দেহ নাই যে, মনুষ্য ভ্রূণ অবিলম্বে এই আকারে দৃষ্টিগোচর হয় নাই, এই বাক্যাবলীর প্রকাশও ঘটে নাই, “প্রশংসা আল্লাহ্র, যিনি সৃষ্টিকর্তার সর্বোত্তম।” ক্রমশঃ এটা বিভিন্ন অবস্থা ও বিভিন্ন আকৃতির মধ্য দিয়া অতিক্রম করতে থাকেÑ যে পর্যন্ত না এটা এই আকার ও সৌন্দর্য, এই পরোৎকর্ষতা,লাবন্য ও নমনীয়তা লাভ করে। এ মেত এটা প্রমাণিত ও সুনিশ্চিত হয় যে এই পৃথিবীতে মানুষের ক্রমোন্নতি ও বৃদ্ধি যে পর্যন্ত না সে দতার বর্তমান পরোৎকর্ষতায় পৌঁছায়- মাতৃগর্ভে ভ্রূণের বৃদ্ধি ও ক্রমবিকাশের অনুরূপ হয়েছিল; ক্রমে ক্রমে এটা অবস্থা থেকে অবস্থান্তরে, আকার থেকে আকারে, এক গঠন থেকে অন্য গঠনে অবস্থান্তরপ্রাপ্ত হয়, কারণ এটা সার্বজনীন পদ্ধতি ও স্বর্গীয় আইন অনুযায়ী হয়েছিল।

অর্থাৎ আলোচ্য åæY বিভিন্ন অবস্থার মধ্য দিয়ে বিচরণ করে এবং অসংখ্য পর্যায়ে তথা এম অতিক্রম করে- যে পর্যন্ত না এটা এইরূপ আকারে পৌঁছায়, যাতে এই কথাগুলি প্রকাশ করে “ সৃষ্টিকর্তাদের সর্বোত্তম আল্লাহ্র প্রশংসা”যে পর্যন্ত না পরিণতি ও যুক্তির নিদর্শনাবলী দৃষ্টিগোচর হয় এবং অনুরূপভাবে আরম্ভ থেকে যে পর্যন্ত না এটা এই অবস্থায় পৌঁছায়, এই পৃথিবীতে মানুষের অস্তিত্ব, আকার এবং অবস্থা অপরিহার্য ফলস্বরূপ দীর্ঘকাল টিকে থাকে এবং বহু পর্যায়ের তথা ক্রমের মধ্য দিয়ে চলতে থাকে, যে পর্যন্ত না এটা এই অবস্থায় পৌঁছায়। কিন্তু মানুষের অস্তিত্বের শুরু থেকে সে একটি সুস্পষ্ট প্রজাতি, অনুরূপভাবে মাতৃগর্ভে মানুষের ভ্রূণ প্রথমে একটি অদ্ভূত আকারে বিদ্যমান ছিল; অতঃপর এই দেহ গঠন থেকে গঠনে, আকার থেকে আকারে, অবস্থা থেকে অবস্থায় স্থানান্তরপ্রাপ্ত হয়Ñ যে পর্যন্ত না চরম সৌন্দর্যে ও পরোৎকর্ষতায় দৃষ্টিগোচর হয়। কিন্তু এমনকি তার বর্তমান আকৃতি ও মূর্তি থেকে সম্পূর্ণ পৃথক, যখন মাতৃগর্ভে এই অদ্ভুত আকারে সে বিদ্যমান ছিল, সে উৎকৃষ্ট প্রজাতির ভ্রূণ ছিল- পশুর ভ্রূণ নয়; তার প্রজাতি ও সারৎসার তথা উপাদানের কোনই পরিবর্তন হয় নাই। ক্ষেণ ধরে নিলেও যে যে সমস্ত অঙ্গের চিহ্নসমূহ অদৃশ্য হয়েছে, সেগুলি প্রকৃতপক্ষে বিদ্যমান রয়েছে, এটা প্রজাতির অস্থায়ীত্ব ও অ-মৌলিকত্বের প্রমাণ নয়। এটা বড়জোর প্রমাণ করে যে, আকার ও গঠন এবং মানুষের দেহযন্ত্র উন্নতি লাভ করেছে। মানুষ সর্বদাই একটি সুস্পষ্ট প্রজাতি “মানুষ” ছিল, পশু নয়। সুতরাং যদি মানুষের ভ্রূণ মাতৃগর্ভে এক আকার আকৃতি থেকে অন্য আকার আকৃতিতে অবস্থান্তরিত হয় তাহলে এটা কি একটি প্রমাণ যে প্রজাতি পরিবর্তিত হয়েছে? এটা কি একটি প্রমাণ যে, এটা প্রথমে একটি পশু ছিল এবং এর দেহ যন্ত্র উন্নতি ও ক্রমবিকাশ লাভ করেছে এবং অবশেষে মানুষে পরিণত হয়েছে? নিশ্চয়ই তা নয়! কতই না ছেলেমী ও ভিত্তিহীন এই ধারণা ও এই চিন্তা! কারণ মনুষ্য প্রজাতির মৌলিকত্ব ও মানব প্রকৃতির স্থায়ীত্বের প্রমাণ সুস্পষ্ট ও প্রমাণিত।

27
মানুষ ও পশুর মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্ক

ইতিমধ্যে আমরা আত্মার বিষয়ে একবার কি দুইবার আলোচনা করেছি, কিন্তু আমাদের কথা লিপিবদ্ধ হয় নাই।

জেনে রাখ জনমণ্ডলী দুই শ্রেণীর অন্তর্ভূক্ত অর্থাৎ তারা দুইটি দল গঠন করেছে। একদল আত্মার অস্তিত্ব অস্বীকার করছে এবং বলছে যে মানুষও জন্তুর প্রজাতি; কারণ তারা বলছে, আমরা কি লক্ষ্য করি না যে মানুষ ও পশু একই শক্তি ও ইন্দ্রিয়ানুভূতির অংশীদার? এই একমাত্র অবিমিশ্র উপাদানসমূহ যা মহাশূন্য পূণ্য করছে, তা অবিরত তথা অবিরামভাবে সম্মিলিত এবং এই সম্মিলনসমূহের প্রত্যেকটি থেকে অস্তিত্বসমূহের একটি উৎপাদন করা হয়েছে। এই অস্তিত্বসমূহের মধ্যেই হচ্ছে আত্মার শক্তিসমূহের ও চেতনাসমূহের মালিক। সংযুক্তি তথা সম্মিলন যতই নিখুত হবে অস্তিত্ববান বস্তু ততই চমৎকার হবে। যেকোন অস্তিত্বশীল বস্তুর সংমিশ্রণ অপেক্ষা মানব দেহের উপাদাসমূহের সংযুক্তি অধিকতর পরোৎকর্ষতা প্রাপ্ত; এটা চূড়ান্ত তথা সম্পূর্ণ সাম্যাবস্থার (সমতার) মিশ্রিত, সুতরাং অপেক্ষাকৃত বেশি চমৎকার ও বেশি নিখুত। তারা বলে “এ নয় যে তার (মানুষের) বিশেষ একটা শক্তি ও চেতনা (আত্মা) আছে- যা প্রাণীকুলের মধ্যে নেই। পশুকুল সংবেদনশীল দেহের অধিকারী, কিন্তু কতিপয় শক্তিতে মানুষের অধিকতর সংবেদন (অনুভূতি) রয়েছে যদিও বাহ্য ইন্দ্রিয়ানুভূতি সংশ্লিষ্ট যথা- শ্রবণ শক্তি, দর্শন শক্তি, আস্বাদন শক্তি, ঘ্রাণ শক্তি, স্পর্শ এমনকি কতিপয় আভ্যন্তরীণ শক্তিতে যথা স্মৃতি শক্তিতে মানুষ অপেক্ষা পশু অধিক পরিমাণে গুণে ভূষিত।” তারা বলে, “পশুদেরও বুব্ধিমত্তা ও অনুভূতি শক্তি রয়েছে।” তারা যা সত্য বলে স্বীকার করে সেটা হচ্ছে মানুষের বৃদ্ধিমত্তা বৃহত্তর।

বর্তমান অবস্থার দার্শনিকগণ হচ্ছেন এই; এই তাঁদের বক্তব্য, এই তাঁদের অনুমান এবং এইভাবে তাঁদের কল্পনা নিস্পত্তি করে। সুতরাং শক্তিশালী যুক্তিতর্ক ও প্রমাণাবলীর দ্বারা মানুষের বংশকে তারা পশুর কাছে পরিচালনা করান এবং বলেন যে, এমন এক সময় ছিল যখন মানুষ পশু ছিল; অতঃপর প্রজাতি পরিবর্তিত হয়, ধীরে ধীরে উন্নতি করতে থাকে, অবশেষে বর্তমান অবস্থায় পৌঁছে।

কিন্তু ধর্মতত্ত্ববিদগণ বলেন, “ না, এরূপ নয়; যদিও পশুর শক্তিমত্তা ও বাহ্য ইন্দ্রিয়ানুভূতি মানুষের শক্তিমত্তা ও বাহ্য ইন্দ্রিয়ানুভূতির সমান, তবুও এক অসাধারণ শক্তি মানুষের মধ্যে বিদ্যমান, যা থেকে প্রাণীকুল বঞ্চিত রয়েছে। বিজ্ঞানসমূহ, শিল্পকলা, উদ্ভাবন, ব্যবসায় বাণিজ্য, বাস্তব সত্যের আবিষ্কারÑ এ সবগুলিই আধ্যাত্মিক শক্তির ফল। এটা সেই শক্তি যা সমগ্র বস্তুকে বেষ্টন করে, বস্তুসমূহের বাস্তব মত্য অনুধাবন করে, অস্তিত্বের গুপ্ত রহস্যাবলী আবিষ্কার করে এবং এই জ্ঞানের মাধ্যমে সেগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করে। এমনকি এই শক্তি বাহ্যতঃ যার অস্তিত্ব নেই সেটাও অনুভব করে; অর্থাৎ বৃদ্ধিবৃত্তি সংক্রান্ত বাস্তবতা যা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয় এবং যার বাহ্যাকৃতি নেই, যেহেতু তা অদৃশ্য; সুতরাং এটা মন, আত্মা, গুণাবলী, চরিত্রসমূহ, মানুষের প্রেম ও দুঃখ হৃদয়ঙ্গম করে থাকে- কারণ এগুলি বুদ্ধিবৃত্তি সংক্রান্ত বাস্তবতা। এই বিদ্যমান বিজ্ঞানসমূহ, শিল্পকলা, আইনকানুন এবং মানুষের অবিচ্ছিন্ন উদ্ভাবনসমূহ এক সময় অদৃশ্য, রহস্যাময় ও গুপ্ত ছিল। শুধুমাত্র মানুষের সর্ব বেষ্টনকারী শক্তি এগুলি আবিষ্কার করেছে এবং অদৃশ্যের স্তর থেকে দৃশ্যমান স্তরে টেনে এনেছে। সুতরাং দূরালাপনী, সাংকেতিক লিপি বিদ্যা, আলোক চিত্র গ্রহণ বিদ্যা এবং এরূপ সমস্বত উদ্ভাবনসমূহও বিস্ময়কর শিল্পকলা এক সময় গুপ্ত রহস্যাবলীতে নিহিত ছিল। মনুষ্য বাস্তবসত্ত্বা এগুলি আবিষ্কার করে এবং অদৃশ্য স্তর থেকে দৃশ্য মান স্তরে টেনে আনে। এমনও এক সময় ছিল যখন লোহা, তুমি যা দেখছো, এর গুণাবলী তথা সমুদয় ধাতুর গুণাবলী গুপ্ত রহস্যের অন্তরাল ছিল। মানুষ এই ধাতু আবিষ্কার করে এবং শিল্প সংশ্লিষ্ট চাহিদার আকারে এটা পরিশ্রম সহকারে গঠন করে। মানুষের অন্যান্য আবিষ্কার ও উদ্ভাবনসমূহের বিষয় এই একই। এগুলি অগণিত।

এটা আমরা অস্বীকার করতে পারি না। যদি আমরা বলি যে এগুলি শক্তির ফল যা পশুকুলেরও আছে এবং দৈহিক ইন্দ্রিয়ানুভূতিসমূহের শক্তির ফল, তাহলে আমরা সুস্পষ্টরূপে দেখতে পাই যে এই শক্তিগুলির বিষয়ে পশুকুল মানুষ অপেক্ষা উৎকৃষ্ট। উদাহরণস্বরূপ, প্রাণীকুলের দৃষ্টিশক্তি মানুষের দৃষ্টিশক্তি অপেক্ষা অধিকতর তীক্ষ্ম, তাদের ঘ্রাণ ও আস্বাদন শক্তিও ঐরূপ। সংক্ষেপে, শক্তিসমূহের ক্ষেত্রে মানুষ ও পশু সমান, পশু প্রায়ই অধিকতর শক্তিশালী। উদাহরণস্বরূপ, এসো আমারা স্মৃতিশক্তির কথা ধরি; যদি তুমি একটা কবুতর এখান থেকে একটি দূরবর্তী দেশে নিয়ে যাও এবং সেখানে তাকে মুক্ত করে দাও তাহলে এটা ফিরে আসবে, কারণ এটা রাস্তা স্মরণ রেখেছে। একটা কুকুর এখান থেকে এশিয়ার কেন্দ্রস্থলে নিয়ে যাও, সেখানে তাকে মুক্ত করে দাও, দেখবে, সে এখানে ফিরে এসেছে, একবারও রাস্তা হরোয় নি। অনুরূপভাবে অন্যান্য শক্তিসমূহ যথা: শ্রবণ শক্তি, দৃষ্টি শক্তি, ঘ্রাণ শক্তি, আস্বাদন শক্তি ও স্পর্শয়ানুভূতির অধিকারী। এ মতে এটা পরিষ্কার যে, যদি পশুদের ঐ শক্তিসমূহের কোনটি থেকে আলাদা কোন শক্তি মানুষের মধ্যে নিহিত না থাকতো, তাহলে উদ্ভাবন ও আবিষ্কার ও বাস্তবতার অনুধাবনে মানুষ অপেক্ষা পশু উৎকৃষ্টতর হতো। অতএব এটা সুস্পষ্ট যে মানুষ একটি উপহার লাভ করেছে, যা পশুকুলের অধিকার নেই।

এখন, পশু ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু অনুভব করতে পারে কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তি সংক্রান্ত বাস্তবতাসমূহ উপলব্ধি করতে পারে না। উদাহরণস্বরূপ যা কিছু এর দৃষ্টি সীমার নাগালের মধ্যে থাকে, পশু তা দেখে থাকে, কিন্তু যা কিছু দৃষ্টিসীমার পরপারে, তার পক্ষে এটা উপলব্ধি করা অসম্ভব এবং পশু তা কল্পনা করতে পারে না। সুতরাং এটা পশুর পক্ষে বুঝে ওঠা সম্ভব নয় যে পৃথিবীর গোলকের আকার রয়েছে। কিন্তু জ্ঞাত বস্তু থেকে মানুষ অজ্ঞাত বস্তুসমূহ প্রমাণ করতে পারে এবং অজ্ঞাত তথ্যাবলী আবিষ্কার করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ মানুষ দিগন্তের বক্ররেখা দর্শন করে এবং এর থেকে সে পৃথিবীর গোলাকারত্ব অনুমান করে। উদাহরণস্বরূপ আক্কায় ধ্রূব নক্ষত্র ৩৩ ডিগ্রী অর্থাৎ দিগন্তের ৩৩ ডিগ্রী উপরে। যখন একটি লোক সুমেরুর দিকে গমন করে তখন যে দূরত্ব সে গমন করে, সেই দূরত্বের প্রত্যেক ডিগ্রীর জন্য ধ্রূব নক্ষত্র এক ডিগ্রী উপরে ওঠে, অর্থাৎ ধ্রূব নক্ষত্রের উচ্চতা হবে ৩৪ ডিগ্রী, অতঃপর ৪০ ডিগ্রী, অতঃপর ৫০ ডিগ্রী, অতঃপর ৬০ ডিগ্রী, অতঃপর ৭০ ডিগ্রী। যদি সে সুমেরুতে পৌঁছায় তাহলে ধ্রূব নক্ষত্রের উচ্চতা হবে ৯০ ডিগ্রী অথবা খমধ্য পৌঁছাতে পারে, অর্থাৎ সরাসরি মাথার উপর হবে। এই ধ্রূব নক্ষত্র এবং এর আরোহণ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়। যতই কেউ কুমেরুর দিকে গমন করে, ততই ধ্রূব নক্ষত্র মাথার উপরে ওঠে। এই দুইটি জ্ঞাত সত্য থেকে একটি অজ্ঞাত জিনিস আবিস্কৃত হয়েছে, সেটা এই যে দিকচক্রবাল বক্রÑ অর্থ হচ্ছে পৃথিবীর প্রত্যেক ডিগ্রীর দিগন্ত অন্য ডিগ্রীর দিগন্ত থেকে আলাদা দিগন্ত। মানুষ এটা উপলব্ধি করে এবং এর থেকে একটি অদৃশ্য বিষয় প্রমাণ করে সেটা হচ্ছে পৃথিবীর গোলাকারত্ব। পশুর পক্ষে এটা উপলব্ধি করা অসম্ভব। অনুরূপভাবে ইতর প্রাণী বুঝতে পারে না যে সূর্য হচ্ছে কেন্দ্র এবং পুথিবী এর চতুর্দিকে ঘোরে। ইতর প্রাণী ইন্দ্রিয়ের বন্দী এবং ইন্দ্রিয়সমূহের দ্বারা কারারূদ্ধ; যা কিছু ইন্দ্রিয়ানুভূতির পরপারে, যে সমস্ত বস্তু ইন্দ্রিয়সমূহ নিয়ন্ত্রণ করে না, ইতর প্রাণী কখনোই তা বুঝে উঠতে পারে না; যদিও বাহ্য ইন্দ্রিয়ানুভূতিতে সে মানুষ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। অতএব এটা প্রমাণিত ও পরিক্ষীত যে মানুষের মধ্যে আবিষ্কারের একটি শক্তি আছে যা দ্বারা সে ইতর প্রাণী থেকে পৃথক বৈশিষ্ট্যে ভূষিত এবং এটাই মানুষের শক্তি তথা আত্মা।

প্রশংসা আল্লাহ্র“ মানুষ সর্বদাই সর্বোচ্চতার দিকে ঝোক প্রবণ এবং তার আকাঙ্খা সুউচ্চ; যে জগতে সে আছে তার থেকে উচ্চতর তথা বৃহত্তর জগতে পৌঁছাতে সে সর্বদাই আকাঙ্খা করে এবং যে গোলকে সে আছে এব চেয়ে উচ্চতর গোলকে আরোহণ করতে সে ইচ্ছুক। আমি বিস্মিত যে আমেরিকা ও ইউরোপের নির্দিষ্ট দার্শনিকগণ ক্রমে ক্রমে ইতর প্রাণী জগতের তুলা হতে সন্তুষ্ট এবং নিম্নগামী হতে চান; কারণ অস্তিত্বের প্রবণতা উন্নতির দিকে হয়ে থাকে। যা হোক, তুমি যদি তাদের কাউকে বলতে, আপনি একটি ইতর প্রাণী- তাহলে সে সাংঘাতিক মর্মাহত ও ক্রদ্ধ হতেন।

মনুষ্য জগত ও ইতর প্রাণী জগতের মধ্যে; মানুষের উন্নত অবস্থা পশুর জীবনাবস্থার মধ্যে; মানুষের পরিাৎকর্ষতা ও প্রাণীকুলের অজ্ঞতার মধ্যে, মানুষের জ্ঞানালোক ও প্রাণীর অন্ধকারময়তার মধ্যে; মানুষের গৌরব তথা জাঁকজমক ও প্রাণীকুলের অবনয়নের মধ্যে কতই না পার্থক্য বিরাজ করছে! দশ বছরের একটি আরব শিশু মরুভূমিতে দুই তিন শত উট নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এবং তার কণ্ঠস্বরের সাহায্যে তাদেরকে সামনে বা পশ্চাতে পরিচালনা করতে পারে। একজন দুর্বল হিন্দু ঐভাবে এক বিরাট হস্তী নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, যেন হস্তীটি ভৃত্যদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা অনুগত ভৃত্য। মানুষের মধ্যেই সমস্ত বস্তু পরাভূত হয়; সে প্রকৃতিকে প্রতিহত করতে পারে, পক্ষান্তরে অন্যান্য জীব জন্তু প্রকৃতির বন্দী, প্রকৃতির দাবী থেকে কেউ বিচ্ছিন্ন হতে পারে না। কেবল মানুষই প্রকৃতিকে বাধা দিতে পারে। প্রকৃতি দেহ বা পদার্থ পৃথিবীর কেন্দ্রের দিকে আকর্ষণ করে; মানুষ যান্ত্রিক উপায়ে এর থেকে দূরে চলে যায় এবং আকাশে উড্ডয়ণ করে। প্রকৃতি মানুষকে সমূদ্র পাড়ি দিতে বাধা দেয়, মানুষ জাহাজ নির্মাণ করে এবং মহাসাগর পাড়ি দিয়ে ভ্রমণ করে এবং ইত্যাদি ইত্যাদি; আলোচ্য বিষয় অসীম। উদাহরণস্বরূপ মানুষ পাহাড় পর্বতের উপর ও বিজন প্রদেশসমূহের ভিতর দিয়ে ইঞ্জিন চালায় এবং এক স্থান থেকে প্রাচ্য-পশ্চাত্যের ঘটনাবলীর সংবাদ সংগ্রহ করে। এ সমস্তই প্রকৃতির পরিপন্থী। সমূদ্র তার বিশালত্বসহ এক অণুপরমাণু পরিমাণ প্রকৃতির আইন থেকে বিচ্যুত হইতে পারে না; সূর্য তার সমগ্র জাকালত্বে প্রকৃতির আইন থেকে সুচাগ্র পরিমাণও বিচ্যুত হতে পারে না এবং কখনো মানুষের অবস্থা, মর্যাদা, গুণাবলী, চালচলন ও মানব প্রকৃতি অনুধাবন করতে পারে না।

তাহলে মানুষের এই ক্ষুদে দেহের মধ্যে কি সেই শক্তি যা এই সব কিছুকেই বেষ্টন করছে? কি এই প্রভুত্বকারী শক্তি যা দ্বারা সে সমগ্র বস্তুকে পরাভূত করছে?

আরও একটা কথা থেকে যাচ্ছে: আধুনিক দার্শনিকগণ করছেন, “আমরা মানুষের মধ্যে কখনো আত্মা দেখতে পাই নি, মুনষ্য দেহের রহস্যাবলীর পরীক্ষা নিরীক্ষা সত্ত্বেও আমরা কোন আত্মিক শক্তি উপলব্ধি করি নাই। কেমন করে আমরা এমন শক্তির কল্পনা করব যা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়?” ধর্মতত্ত্ববিদগণ উত্তর দেন, “ইতর প্রাণীর আত্মাও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয় এবং এর শারীরিক শক্তির মাধ্যমে এটা উপলব্ধি করা যেতে পারে না। কিসের দ্বারা তোমরা ইতর প্রাণীর আত্মার অস্তিত্ব প্রমাণ কর? সন্দেহ নেই যে এর ক্ষমতা থেকে তোমরা প্রমাণ কর যে, ইতর প্রাণীর মধ্যে একটি শক্তি আছে যা উদ্ভিদে নাই এবং এটাই ইন্দ্রিয়সমূহের শক্তি এবং এইগুলি থেকে তোমরা অনুমান কর যে, পশু আত্মা বিদ্যমান রয়েছে। একইভাবে প্রমাণাবলী ও নিদর্শনাবলী থেকে আমরা উল্লেখ করেছি, আমরা যুক্তি প্রদর্শন করছি যে, মানবাত্মা বিদ্যমান। যেহেতু ইতর প্রাণীর মধ্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে, যা উদ্ভিদে নেই, তোমরা বলছ এই ইন্দ্রিয়ানুভূতির শক্তিই হচ্ছে জীবাত্মার ধর্ম বা গুণ; তোমরা দেখেছ মানুষের মধ্যে এমন নিদর্শনাবলী, শক্তিমত্তা এবং পরোৎকর্ষতাসমূহ রয়েছে, যা প্রাণীকুলের মধ্যে বিদ্যমান নেই; সুতরাং তোমরা অনুমান কর যে, মানুষের মধ্যে এমন শক্তি রয়েছে যা প্রাণীকুলের নেই।”

যা কিছু ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, তা যদি আমরা অস্বীকার করি তাহলে আমাদের বাস্তবতাসমূহকে অবশ্যই অস্বীকার করতে হবে যে বাস্তবতাসমূহ (প্রকৃত বাস্তবতাসমূহ) প্রশ্নাতীতভাবে বিদ্যমান রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, অতি সুক্ষ্ম (ঈথার) পদার্থ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, যদিও এর নিঃসন্দেহী অস্তিত্ব রয়েছে। আকর্ষণের শক্তি ইন্দ্রিয়গগ্রাহ্য নয়, যদিও নিশ্চিতই এটা বিদ্যমান। কিসের থেকে এই অস্তিত্বগুলিকে আমরা সত্য বলে স্বীকার করি? এগুলির নির্দেশনাবলী তেকে। এ মতে এই আলো হচ্ছে সেই সু² পদার্থের স্পন্দন এবং এই স্পন্দনথেকে আমরা ঈথারের অস্তিত্ব অনুমান করি।

28
মানব জাতির ক্রমবৃদ্ধি ও উন্নয়ন

প্রশ্ন: অস্তিত্বসমূহের ক্রমবিকাশ ও উন্নয়ন সম্বন্ধে কতিপয় ইউরোপীয় দার্শনিক পোষিত মতবাদসমূহ সম্বন্ধে আপনি কি বলেন?

উত্তর: এই বিষয়ে সেদিন বক্তব্য রাখা হয়েছিল, কিন্তু পুনরায় এ সম্বন্ধে আলোচনা করব। সংক্ষেপে এই বিষয় মিমাংসা হবে এই কথা নির্ধারণের দ্বারা যে প্রজাতি মৌলিক কি না? অর্থাৎ মানুষের প্রজাতি কি এর মূল থেকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, অথবা ইতর প্রাণীসমূহ থেকে পরে এটা উৎপন্ন হয়েছে?

কতিপয় ইউরোপীয় দার্শনিক একমত যে, প্রজাতি ক্রমবৃদ্ধিপ্রাপ্ত ও বিকশিত হয় এবং এমনকি পরিবর্তন ও পর্যায়ক্রমও সম্ভব। এই মতবাদের পক্ষে তারা একটি প্রমাণ দিয়ে থাকেন যে, ভূতত্ত্ব বিজ্ঞানের মনোযোগী অধ্যয়ন ও সত্য প্রতিপাদনের মাধ্যমে এটা সুস্পষ্ট হয়েছে যে, উদ্ভিদের অস্তিত্ব প্রাণীকুলের অস্তিত্বের পূর্ববর্তী হয়েছে এবং প্রাণীকুলের অস্তিত্ব মানবকুলের অস্তিত্বের পূর্বগামী হয়েছে। তারা স্বীকার করেন যে, উদ্ভিদ ও প্রাণী উভয়ের প্রজাতি পরিবর্তিত হয়েছে, কারণ মৃত্তিকার কয়েক স্তরে তারা উদ্ভিদসমূহ আবিষ্কার করেছেন, যা অতীতে বিদ্যমান ছিল এবং এখন লুপ্ত হয়েছে; তারা (উদ্ভিদসমূহর) উন্নতি করেছে; শক্তিসহকারে বৃদ্ধি পেয়েছে, তাদের আকার ও আকৃতি পরিবর্তিত হয়েছে, অতএব প্রজাতি পর্যায়ক্রমিক গতি প্রাপ্ত হয়েছে। অনুরূপভাবে মৃত্তিকার স্তরে জীব জন্তুর কিছু প্রজাতি আছে যা পরিবর্তিত হয়েছে ও রূপান্তরিত হয়েছে। এই প্রাণীগুলির একটি হচ্ছে সর্প। নিদর্শনাবলী বিদ্যমান হয়েছে যে, এক সময় সর্পের পা ছিল; কিন্তু সময় অতিক্রমেরর মাধমে ঐ অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলি অদৃশ্য হয়েছে। অনুরূপভাবে মানুষের মেরুদন্ডে একটি নিদর্শন রয়েছে যা প্রমাণ দেয় যে, অন্যান্য প্রাণীর ন্যায় তারও একটি লেজ ছিল। এক সময় ঐ অঙ্গ সদস্য প্রয়োজনীয় ছিল, কিন্তু মানুষ যখন ক্রমবিকাশপ্রাপ্ত হল, তখন এটার আর প্রয়োজন ছিল না; সুতরাং ক্রমশঃ এটা তিরোহিত হল। যেহেতু সর্প ভূগর্ভে আশ্রয় নিত এবং বুকে হেটে চলা প্রাণীতে পরিণত হয়েছিল, সেহেতু এর পায়ের আর কোন প্রয়োজন ছিল না, সুতরাং পাগুলি অদৃশ্য হল; কিন্তু তাদের (পায়ের) চিহ্ন বিদ্যমান। প্রধান যুক্তি হচ্ছে এই: অঙ্গ প্রত্যঙ্গের নিদর্শনাবলীর অস্তিত্ব প্রমাণ করে সেগুলি এক সময় বিদ্যমান ছিল এবং যেহেতু সেগুলির এখন আর কোন দরকার নেই, সেহেতু সেগুলি ক্রমশঃ বিলুপ্ত হয়েছে। অত্রএব যখন পূর্ণাঙ্গ ও অত্যাবশ্যক অঙ্গ প্রত্যঙ্গ রয়েছে, তখন সেগুলি অনাবশ্যক, সেগুলি প্রজাতির কিঞ্চিৎ পরিবর্তনের মাধ্যমেক্রমশঃ বিলুপ্ত হয়েছে কিন্তু সেগুলির চিহ্ন স্থায়ী রয়েছে।

এই যুক্তির প্রথম উত্তর হচ্ছে এই যে, ইতর প্রাণী মানুষের পূর্ববর্তী হওয়া, বিবর্তন, পরিবর্তন ও প্রজাতির পরিবর্তনের প্রমাণ নয়, এটাও প্রমাণ নয় যে, মানুষ ইতর প্রাণীর জগত থেকে মনুষ্য জগদে উন্নীত হয়েছে। কারণ যখন এই সমস্ত বিভিন্ন অস্তিত্বের (অস্তিত্ববান বস্তুর) জন্য জাত তথা ব্যক্তিগত তথ্য নিজস্ব আকার প্রকার নির্দিষ্ট এটা সম্ভব যে মানুষ ইতর প্রাণীর পরে অস্তিত্বলাভ করেছে। সুতরাং যখন আমরা উদ্ভিদরাজ্য পরীক্ষা করি, তখন আমরা দেখি যে, বিভিন্ন গাছের ফলসমূহ একই সময় পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয় না; পক্ষান্তরে কোন কোন ফল পূর্বে আসে এবং অন্যান্য ফল পরে আসে। এই অগ্রগন্যতা তথা পূর্ববর্তিতা প্রমাণ করে না যে, এক গাছের পরবর্তী আগত ফল অপর এক গাছের পূর্ববর্তী আগত ফল থেকে উৎপন্ন হয়েছে।

দ্বিতীয়তঃ অঙ্গ প্রত্যঙ্গের সামান্য নিদর্শনাবলী ও চিহ্নের হয়ত কোন বিরাট কারণ আছে, যে কারণ সম্বন্ধে মন এখনও জ্ঞাত নয়। কত বস্তুই না আছে যার কথা জানি না, অথচ কারণ জানি। সুতরাং শরীরতত্তে¡র বিজ্ঞান অর্থাৎ অঙ্গ প্রত্যঙ্গের সংযুক্তির জ্ঞান লিপিবদ্ধ করেছে যে, জীব জন্তুর গায়ের রং এর পার্থক্য, মানব মণ্ডলীর চুল, ঠোটের রক্তিমাভা, পক্ষীকুলের রংয়ের বৈচিত্রের কারণ এখনও অজ্ঞাত; এটা গুপ্ত ওরহস্যের অন্তরালে রয়েছে। কিন্তু এটা জানা যায় যে, চক্ষুর তারা কালো, এটা সূর্যের রশ্মিকে আর্কষণ করার জন্য ঐরূপ হয়েছে; কারণ এটা যদি অন্য রং হত অর্থাৎ একই ধরনের সাদা, তাহলে সূর্য রশ্মি আকর্ষণ করতে পারত না। অতএব যে সমস্ত বস্তুর কারণ অজ্ঞাত রয়েছে বলে আমরা উল্লেখ করেছি, এটা সম্ভব যে, অঙ্গ প্রত্যঙ্গের এই নিদর্শনাসমূহের কারণ ও বিজ্ঞতা, যে নিদর্শন মানুষের মধ্যে থাকুক অথবা ইতর প্রাণীর মধ্যে থাকুক, সেটা ঐ একইভাবে অজ্ঞাত রর্য়েছে। নিশ্চয়ই একটা কারণ আছে, যদিও এটা জানা যায় নাই।

তৃতীয়তঃ ধরে নেওয়া যাক যে এমন এক সময় ছিল, যখন কতিপয় ইতর প্রাণীর অথবা এমনকি মানুষেরও কিছু অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ছিল যা এখন বিলুপ্ত হয়েছে; কিন্তু এটা প্রজাতির পরিবর্তন ও ক্রমবিবর্তনের যথেষ্ট প্রমাণ নয়। যেহেতু ভ্রূণাবস্থায় সময়ের আরম্ভ থেকে মানুষ যে পর্যন্ত না পরিণতির ধাপে পৌঁছেছে, সে পর্যন্ত সে বিভিন্ন আকার ও আকৃতিকের মধ্য দিয়ে বিচরণ করেছে। তার আকার অকৃতি, হাব ভাব ও রং পরিবর্তিথ হয়েছে; সে এক আকার থেকে অন্য আকারে অবস্থান্তরিত হয়েছে এবং এক চেহারা থেকে অন্য চেহারায় রূপান্তর লাভ করেছে। এতদসত্তে¡ ভ্রূণাবস্থার সময় থেকে সে মানুষের প্রজাতির অন্তর্ভূক্ত ছিল; অর্থাৎ মানুষের ভ্রূণ ইতর প্রাণীর ভ্রূণ নয়। কিন্তু প্রথমে এটা স্পষ্ট ছিল না। পরবর্তীতে এটা দৃশ্যমান হয়েছে এবং সুস্পষ্ট হয়। উদাহরণস্বরূপ ধরে নওেয়া যাক যে মানুষ এক সময় ইতর প্রাণী সদৃশ ছিল এবং এবং এখন সে উন্নতি করেছে ও পরিবর্তিত হয়েছে; এটা ধরে নিলেও এটা এখনও প্রজাতির পরিবর্তনের একটা কারণ নয়। না, এর কারণ আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি। এটা শুধুমাত্র মানুষের ভ্রূণের পরিবর্তন ও এক অবস্থা থেকে অপর অবস্থান্তর প্রাপ্তির ন্যায়Ñ যে পর্যন্ত না এটা সংগতি ও পূর্ণতার ধাপে পৌঁছায়। এটা আমরা আরো পরিষ্কারভাবে বলছি: ধর, আমরা মেনে নেই যে এমন এক সময় ছিল যখন মানুষ হাত-পায়ের উপর ভর দিয়ে হাটতো, অথবা তার একটা লেজ ছিল; এই পরিবর্তন ও অবস্থান্তর মাতৃগর্ভে ভ্রূণের পরিবর্তন ও অবস্থান্তরের ন্যায়; যদিও এটা সর্বদাই পরিবর্তিত হয়, ক্রমবৃদ্ধি ও ক্রমবিকাশ ঘটি যে পর্যন্ত না এটা পূর্ণাকৃতিতে পৌঁছে; তবুও আরম্ভ থেকে এট একটি বিশেষ প্রজাতি। উদ্ভিদ জগতে আমরা দেখতে পাই যে, মহা জাতির (কয়েকটি জাতি সমবায়) মূল প্রজাতি পরিবর্তিত হয় না, কিন্তু আকার, রং, আয়তন পরিবর্তিত ও অবস্থান্তরিত হবে, এমনকি উন্নতিও লাভ করবে।

সংক্ষেপে পুনরাবৃত্তি করছিঃ মাতৃগর্ভে মানুষ যেমন এক আকার থেকে অন্য আকার, এক গঠন থেকে অন্য গঠনে বিচরণ করে, পরিবর্তিত ও ক্রম বিকশিত হয় এবং তবুও ভ্রূণাবস্থার সময়র আরম্ভ থেকে সে মানুষ প্রজাতি থাকেÑ অনুরূপভাবে মানুষ পৃথিবী গর্ভে তার অস্তিত্বের আরম্ভ থেকে. সে একটি সুস্পষ্ট প্রজাতি, অর্থাৎ মানুষ থাকে এবং ক্রমে ক্রমে এক আকার থেকে অন্য আকারে বিকশিত হয়। অতএব আকৃতি প্রকৃতির এই পরিবর্তন, অঙ্গ প্রত্যঙ্গের এই বিকাশ, এই ক্রমবিকাশ ও ক্রমবৃদ্ধি এমনকি আমরা স্বীকার করি যে মানুষ পূর্বে চতুর্ষ্পদ জন্তু ছিল ও তার একটি লেজ ছিল, তবু এটা উক্ত প্রজাতির মৌলিকত্বে প্রতিবন্ধক হতে পারে না। আরম্ভ থেকেই মানুষ এই পরিাৎকর্ষ আকার ও গঠনে বিদ্যমান ছিল এবং পার্থিব ও আধ্যাত্মিক পরোৎকর্ষতাসমূহ ধারণ ক্ষমতা ও অর্জনের ঝোক প্রবণ ছিল এবং এই বাক্যের প্রকাশ ছিল “আমরা মানুষকে আমাদের প্রতিরূপ ও সাদৃশ্য করিব। সে শুধু আরো মনোরম, আরো সুন্দর এবং আরো লাবন্যময় হয়েছে। তার বন্য অবস্থা থেকে সভ্যতা তাকে বের করে এনেছে, অবিকল বন্য ফলসমূহের ন্যায়- যা একজন উদ্যানপাল কর্তৃক কর্ষিত হয় এবং সেগুলি আরো মিষ্ট হয়, আরো সতেজতা ও মাধুর্য অর্জন করে।

মানব জগতের উদ্যানপাল হচ্ছেন আল্লাহর বার্তাবাহকগণ।

29
মানুষের উৎপত্তির আধ্যাত্মিক প্রমাণাবলী

মানুষের উৎপত্তির সহিত সম্বন্ধযুক্ত যে সমস্ত প্রমাণ আমরা উদ্ধৃত করেছি, সেগুলি ছিল যুক্তিশাস্ত্র সংগত প্রমাণ; এখন আমরা আধ্যাত্মিক প্রমাণ দেব, যা অত্যাবশ্যকীয়। কারণ যেহেতু আমরা যুক্তি শাস্ত্রীয় তর্কের দ্বারা খোদাইত্বের (ঈশ্বরত্ব) প্রমাণ করেছি এবং যুক্তিশাস্ত্রীয় আরো প্রমাণ দিয়েছি যে মানুষ তার মূল ও ভিত্তি থেকেই মানুষস্বরূপ বিদ্যমান এবং তার প্রজাতি অনন্তকাল থেকেই বিদ্যমান রয়েছে, এখন আমরা আধ্যাত্মিক প্রমাণাবলী প্রতিষ্ঠা করব যে, মানব অস্তিত্ব অর্থাৎ মানব প্রজাতিÑ একটা অপরিহার্য অস্তিত্ব ও প্রমাণ করব্ যে মানুষ ব্যতীত খোদাইত্বের (ঈশ্বরত্ব) পরোৎকর্ষতাসমূহ প্রকাশ পেত না। কিন্তু এগুলি আধ্যাত্মিক প্রমাণ, যুক্তিশাস্ত্রীয় প্রমাণ নয়।

আমরা অনেকবার নিশ্চিত প্রমাণ দিয়েছি ও প্রতিষ্ঠা করেছি যে, মানুষ অস্তিত্বসমূহের মধ্যে মহত্তম অস্তিত্ব তথা পরোৎকর্ষতাসমূহের সমষ্টি এবং আরো প্রমাণ ও প্রতিষ্ঠা করেছি যে, সমুদয় অস্তিত্ব ও জীবনসমূহ হচ্ছে কেন্দ্র যা থেকে আল্লাহরগৌরব জ্যোতি প্রতিফলিত হয়, বস্তুসমূহের ও প্রাণীকুলের বাস্তবতাসমূহে (বাস্তব সত্ত্বা) আল্লাহর আল্লাহত্বের (ঈশ্বরত্বের) নিদর্শনাবলী সুস্পষ্ট রয়েছে। ঠিক যেমন পার্থিব ভূমণ্ডল একটি স্থান, যেখানে সূর্যরশ্মি প্রতিফলিত হয়- যেরূপ এর আলো, এর উত্তাপ এবং এর প্রভাব পৃথিবীর সমুদয় অণুপরমাণুর মধ্যে সুস্পষ্ট ও দৃশ্যমান, ঠিক সেই একইভাবে, এই অসীম মহাশূন্যে অস্তিত্বসমূহের অণুপরমাণুতে একটি স্বর্গীয় পরোৎকর্ষতা ঘোষণা করছে ও প্রমাণ দিচ্ছে। কোন কিছুই এর উপকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে না; এটা হয়ত আল্লাহ্র অনুগ্রহের একটি নিদর্শন, অথবা তাঁর শক্তির, তাঁর মহত্ত্বের, তাঁর ন্যায়পরতার প্রভুত্বের একটা নিদর্শন যা শিক্ষাদান করছে; অথবা এটা আল্লাহর উদারতার, তাঁর দর্শন শক্তির, তাঁর শ্রবণ শক্তির, তাঁর জ্ঞানের, তাঁর অনুকম্প ইত্যাদি ইত্যাদি একটি নিদর্শন।

নিসন্দেহেঃ প্রতিটি অস্তিত্ব আল্লাহর গৌরব জ্যোতির কিরণ বর্ষণে এর কেন্দ্রসমূহ অর্থাৎ আল্লাহ্র পূর্ণতাসমূহের তথা পরোৎকর্ষতা এর থেকে আবির্ভূত হয় ও এর মধ্যে সমুজ্জল হয়। এটা সূর্য সদৃশ যা মরুভ‚মিতে, সমূদ্রপরিবক্ষে, ফলসমূহে ও পুষ্পমুকুলে এবং সমুদয় পার্থিব বস্তুসমূহে সমুজ্জল হয়। বিশ্ব ব্রক্ষ্মাণ্ডের বস্তুতঃ প্রতিটি অস্তিত্ব প্রাণী আমাদের কাছে আল্লাহ্র নানাবলীর একটি ঘোষণা করে, কিন্তু মানুষের বাস্তবতা (বাস্তব সত্ত্বা) হচ্ছে সমষ্টিগত বাস্তবতা, সেই সাধারণ বাস্তবতা এবং সেই কেন্দ্র যেখানে আল্লাহরসমস্ত পরোৎকর্ষতার গৌরব জ্যোতি কিরণ বর্ষণ করে। অর্থাৎ প্রত্যেক নাম, প্রত্যেক গুণ, প্রত্যেক পূর্ণতার পক্ষে আল্লাহর সম্বন্ধে তথা আল্লাহ্র কথা যা আমরা নিশ্চিরূপে স্বীকতার করি, মানুষের মধ্যে এর একটা নিদর্শন আছে; যদি এরূপ না থাকতো তাহলে মানুষ এই পরোৎকর্ষতাগুলি কামনা করতে পারতো না। এবং সেগুলি বুঝতেও পার না। সেহেতু আমরা বলে থাকি যে, আল্লাহ দর্শক এবং চক্ষু হচ্ছে তাঁর দর্শন শক্তির নিদর্শন; যদি এই দৃষ্টিশক্তি মানুষের মধ্যে না থাকতো কেমন করে সে আল্লাহর দর্শন শক্তি কল্পনা করতো? যেহেতু অন্ধরা অর্থাৎ একজন জন্মান্ধ দৃষ্টিশক্তি কল্পনা করতে পারে না; এবং বধিরেরা অর্থাৎ জন্ম থেকে যে বধির, সে শ্রবণ শক্তি কল্পনা করতে পারে না; মৃতব্যক্তিরা (আধ্যত্মিকভাবে মৃত) জীবন উপলব্ধি করতে পারে না। অতএব খোদার খোদাইত্ব (ঈশ্বরত্ব) যা সমুদয় পরোৎকর্ষতার সমষ্টি, এটা স্বয়ং মানুষের বাস্তব সত্ত্বায় প্রতিফলিত হয়, অর্থাৎ একত্বের সারৎসার (সার উপাদান) হচ্ছে সমগ্র পরোৎকর্ষতার জমায়েত এবং এই অদ্বিতীয় থেকে তিনি মানবের বাস্তবসত্ত্বার উপর প্রতিফলন নিক্ষেপ করেন। মানুষ তখন সত্যের সূর্যমুখী নিখুঁত দর্পন হয়ে যায় এবং আলোক বিকিরণের কেন্দ্র হয়, সত্যের সূর্য দর্পনে কিরণ বর্ষণ করে। র্স্বীয় পরোৎকর্ষতাসমূহের প্রতিফলন মানুষের বাস্তবতায় (বাস্তব সত্ত্বায়) প্রতিভাত হয়; সুতরাং সে আল্লাহর প্রতিনিধি তথা আল্লাহর বার্তাবাহক হয়। যদি মানুষ না থাকতো তাহলে এই বিশ্ব চরাচর নিষ্ফল হত, কারণ অস্তিত্বের লক্ষ্য হচ্ছে আল্লাহরপূর্ণতাসমূহের আবির্ভাব।

অতএব এটা বলা যাবে না যে এমন একত সময় ছিল যখন মানুষ ছিল না। যতদুর আমরা বলতে পারি সেটা এই যে এক সময় এই ভূ গোলক ছিল না এবং এটার শুরুতে মানুষ এর উপর আবির্ভূত হয় নাই। কিন্তু যে আদির আদি নেই, যে অন্তের অন্ত নেই অর্থাৎ আদিহীন আদি থেকে অন্তহীন অন্ত পর্যন্ত এক পূর্ণ প্রকাশ সর্বদাই বিদ্যমান। যে মানুষের কথা আমরা বলছি, সবাই সেই মানুষ নয়; আমরা পূর্ণ মানুষকে বুঝাচ্ছি। কারণ বৃক্ষের উৎকৃষ্টতম অংশ হচ্ছে ফল, যা এটার অস্তিত্বের কারণ; যদি বৃক্ষের ফল না থাকে, তকে এটার কোন অর্থও হবে না। অতএব এটা কল্পনা করা যেতে পারে না যে অস্তিত্বের জগতসমূহ নক্ষত্ররাজি হউক অথবা এই বিশ্বচরাচর হোক, এক সময় গাধা, গরু, ইদুর এবং বিড়াল অধ্যুসিত ছিল এবং মনুষ্যবিহীন ছিল। এই অনুসিদ্ধান্ত মিথ্যা ও অর্থহীন। আল্লাহ্র কথা সূর্যসম পরিষ্কার। এটা একটা আধ্যাত্মিক প্রমাণ, কিন্তু এমন একটা প্রমাণ যা আমরা জড়বাদীদের উপকারের জন্য প্রথমে ব্যাখ্যা করতে পারে না। প্রথমে আমাদের যুক্তি শাস্ত্রীয় প্রমাণাবলীর কথা বলতে হবে। পরে আধ্যাত্মিক প্রমাণ।

30
মানুষের আত্মা ও মন শুরু থেকেই অস্তিত্ব লাভ করেছে

প্রশ্ন; মানুষ কি প্রথম থেকেই আত্মা ও মন ছিল, অথবা মন ও আত্মা তার বিবর্তনের ফল?

উত্তর: এই ভূগোলকে মানুষের অস্তিত্বের আরম্ভ মাতৃগর্ভে তার গটনের অনুরূপ। মাতুগর্ভে ভ্রূণ ক্রমে ক্রমে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত ও ক্রমবিকশিত হয়, যে পর্যন্ত না সে জন্ম গ্রহণ করে, অতঃপর এটা বৃদ্ধি ও বিকশিত হতে থাকে, যে পর্যন্ত না এটা স্ববিবেক ও সাবালকত্বের বয়সে পৌঁছায়। যদিও শৈশবকালে মন আত্মার নিদর্শনাবলী দৃষ্টিগোচর হয়, তবু তারা পরোৎকর্ষতার ধাপে পৌঁছায় না; তারা অস্পূর্ণ। শুধুমাত্র মানুষ যখন সাবালকত্বে পৌঁছায়, শুধু তখনই মন ও আত্মার আবির্ভাব ঘটে এবং পরম পূর্ণতায় সুস্পষ্ট হয়।

সুতরাং বিশ্ব গর্ভে মানুষের গঠর ও আরম্ভে ছিল ভ্রূণ সদৃশ; অতঃপর সে ক্রমশঃ পূর্ণতায় উন্নতি লাভ করল এবং বৃদ্ধি পেল ও ক্রম বিকশিত হতে থাকলো, যে পর্যন্ত না সে পূর্ণ পরিণতিতে পৌঁছাল, অতঃপর মান আত্মা বৃহত্তম শক্তিতে দৃশ্যমান হল। তার সংগঠনের শুরুতে মন ও আত্মা ও বিদ্যমান চিল, কিন্তু তারা ছিল গুপ্ত, পরে তারা প্রকাশিত হল। বিশ্ব গর্ভে মন, আত্মা ও ভ্রূণের মধ্যে অস্তিত্বশীল ছিল, কিন্তু তখন তারা গুপ্ত ছিল; পরবর্তীকালে তারা আবির্ভূত হল। যেমন বীজের মধ্যে বৃক্ষ বিদ্যমান থাকে, কিন্তু এটা গুপ্ত ও সুপ্ত থাকে; যখন উক্ত বীজ ক্রমবিকাশ লাভ করে ও বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়, তখস পূর্ণাঙ্গ বৃক্ষ দৃষ্টিগোচর হয়। একইভাবে সমমুদয় অস্তিত্বশীল বস্তুর ক্রমবৃদ্ধি ও ক্রমবিকাম ক্রমান্বয়ে হয়ে থাকে; এটাই সার্বজনীন স্বর্গীয় সংগঠন এবং স্বাভাবিক রীতি পদ্ধতি। বীজ সহসা বৃক্ষে পরিণত হয় না, ভ্রূণ অবিলম্বে মানুষে পরিণত হয় না, খনিজ পদার্থ সহসা একটি প্রস্তরে পরিণত হয় না। না, এরা ক্রমে কমে বৃদ্ধি ও বিকশিত হয় এবং পূর্ণতার সীমায় পৌঁছায়।

সমুদয় অস্তিত্ব ক্ষুদ্র হোক অথবা বৃহৎ হোক প্রথম থেকেই পূর্ণ ও নিখুত সৃষ্ট হয়েছে। আল্লাহ্র সংগঠন এক তথা একক; অস্তিত্বে ক্রমবিকাশ এক তথা একক; স্বর্গীয় রীতি পদ্ধতি একক। অস্তিত্বসমূহ ক্ষুদ্র হোক অথবা বৃহৎ হোব সবাই এক আইন ও রীতি পদ্ধতির অধীন তথা মুখাপেক্ষী। প্রত্যেক বীজের মধ্যে প্রথম থেকেই রয়েছে সমুদয় উদ্ভিজ্জ পূর্ণতা। উহাহরণস্বরূপ প্রত্যেক বীজের মধ্যে প্রথম থেকেই সমুদয় উদ্ভিজ্জ পূর্ণতা বিদ্যমান রয়েছে, কিন্তু সেটা প্রতীয়মানভাবে নেই; পরবর্তীকালে অল্প অল্প করে সেগুলি প্রকাশ পায়। এমতে প্রথমে বীজ তেকে অংকুর প্রকাশ পায়, অতঃপর শাখা প্রশাখা, পত্রগুচ্ছ, পুষ্প মুকুল এবং ফল; কিন্তু এর অস্তিত্বের প্রথম থেকেই এইগুলি বীজের মধ্যে প্রচ্ছন্নভাবে নিহিত ছিল- যদিও দৃশতঃ ছিল না।

অনুরূপভাবে ভ্রূণ প্রথম থেকেই সমুদয় সপূর্ণতার অধিকারী হয়- যথা: আত্মা, মন, দৃষ্টি শক্তি, ঘ্রাণশক্তি, আস্বাদন শক্তি এক কথায় সমস্ত শক্তি কিন্তু সেগুলি দৃশ্যমান নয় এবং দৃশ্যমান হয় শুধুমাত্র ক্রমে ক্রমে।

অনুরূপভাবে প্রথম থেকেই এই ভূগোলক এর সমস্ত পদার্থ, উপাদান, খনিজ দ্রব্য, অণুপরমাণূ এবং যান্ত্রিক গঠনসহ সৃষ্টি হয়েছিল; কিন্তু এগুলি শুধু ক্রমশঃ আবির্ভূত হয়েছে। প্রথমে খনিজ দ্রব্য তারপরে উদ্ভিদ, পরবর্তী কালে জীব অবশেষে মানুষ। কিন্তু প্রথম থেকেই এই সমস্ত প্রকার ও প্রজাতি বিদ্যমান ছিল কিন্তু এগুলি গোরকে অনুন্নত ছিল, কিন্তু যখন প্রকাশিত হল শুধুমাত্র ক্রমবিকাশ পদ্ধতিতে। কারণ আল্লাহ্র সর্বোৎকৃষ্ট সংগঠন এবং সার্বজনীন স্বাভাবিক রীতি পদ্ধতি সমুদয় অস্তিত্বকে বেষ্টন করে এবং সকলেই এই আইনের মুখাপেক্ষী। যখন তুমি এই সার্বজনীন পদ্ধতির কথা মনে মনে গভীরভাবে বিবেচনা কর তখন তুমি দেখতে পাও যে, অস্তিত্বসমূহের কোন একটিও অস্তিত্বে আসার সঙ্গে সঙ্গেই পূর্ণতার সীমায় পৌছায় নাই। না, অস্তিত্বসমূহ ক্রমশঃ বৃদ্ধি পায়, বিকাশপ্রাপ্ত হয় এবং পরে পূর্ণতার মাত্রায় পৌঁছে।

31
দেহমধ্যে আত্মার আবির্ভাব

প্রশ্ন দেহমধ্যে আত্মার আবির্ভাবের বিজ্ঞতা কি?

উত্তর: দেহমধ্যে আত্মার আবির্ভাবের বিজ্ঞতা এই: মানব আত্মা একটি স্বর্গীয় ন্যস্ত জিম্মা এবং একে সমস্ত পারিপার্শ্বিক অবস্থা অতিক্রম করতে হবে; কারণ অস্তিত্বের পরিবেশের মধ্য দিয়ে পথ ও গতি হবে এর পরোৎকর্ষতাসমূহ অর্জনের উপায়। সুতরাং যখন একজন লোক নিয়ম প্রণালীসহ বিভিন্ন জসপদ ওঅনেক দেশের মধ্য দিয়ে ভ্রমণ ও অতিক্রম করে তখন নিশ্চিতই এটা তার প্রকৃষ্ট গুণ বা জ্ঞান অর্জনের উপায় হয়; কারণ সে বিভিন্ন স্থান, দৃশ্যাবলী ও দেশসমূহ দেখতে পারে যা থেকে সে অন্যান্য জোতিসমূহের পরিবেশ ও অবস্থা আবিষ্কার করবে। এইভাবে সে দেশবিদেশের ভূগোলের সঙ্গে এবং তাদের আশ্চর্য বস্তুসমূহ ও শিল্পকলার সহিত পরিচিত হবে; সে জাতিসমূহের রীতিনীতি, আচার, অভ্যাসের সহিত নিজেকে পরিচিত করবে; সে সভ্যতা ও যুগের উন্নতি সাধন করবে; সে প্রত্যেক দেশের শক্তি ও ধারণক্ষমতা এবং সরকারসমূহের কার্যধারা সম্বন্ধে অবগত হবে। এই একই ব্যাপার মানবাত্মা যখন অস্তিত্বের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে; এটা প্রত্যেক ধাপ তথা পর্যায়ের ও অবস্থানের মালিক হবে। এমনকি দেহের অবস্থায় এটা নিশ্চিতই উৎকর্ষতাসমূহ অর্জন করবে।

এছাড়াও এটা অত্যাবশ্যক যে, আত্মার উৎকর্ষতার নিদর্শনাবলী এই পৃথিবীতে সুস্পষ্ট হবে, যাতে সৃষ্টি জগত অসীম ফল লাভ করতে পারে, এবং এই দেহ জীবন লাভ করতে পারে এবং স্বর্গীয় বদান্যতা প্রকাশ করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ সূর্যের রশ্মিসমূহ অবশ্যই ধরা বক্ষে বিকীর্ণ হবে এবং সৌর উত্তাপ পার্থিব প্রাণীদের উন্নতি ঘটাবে। যদি সূর্য রশ্মি ও সূর্যের উত্তাপ পৃথিবীর উপর বর্ধিত না হত তাহলে পৃথিবী বসতিহীন, অর্থহীন হত এবং এর উন্নতি ব্যহত হত। অনুরূপভাবে যদি আত্মার পরাকাষ্ঠা এই পৃথিবীতে প্রকাশ না পেত, এই পৃথিবী অশিক্ষিত ও সম্পূর্ণরূপে পশুবৎ বর্বর হত। শারীরিক আকারে আত্মার আবির্ভাবের দ্বারা এই বিশ্ব সংষার শিক্ষিত তথা সৃষ্টি সম্পন্ন হয়। মানুষের আত্মা যেমন দেহের জীবনের কারণ, সেরূপ বিশ্ব সংসার দেহের অবস্থায় বিদ্যমান এবং মানুষ আত্মার অবস্থায় বিদ্যমান। যদি মানুষ না থাকতো আত্মার পরাকাষ্ঠা প্রকাশ পেত না এবং মনের আলো এই বিশ্ব সংসারে দীপ্তিশীল হতো না। এই বিশ্ব সংষার আত্মাবিহীন দেহ তুল্য হত।

এই বিশ্ব সংসারও একটি ফল বৃক্ষের অবস্থায় বিদ্যমান এবং মানুষ সেই ফল সদৃশ; ফলবিহীন বৃক্ষ অকেজো।

অধিকন্তু এই অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলি, এই উপাদানগুলি, এই সংমিশ্রণ যা মানুষের যান্ত্রিক গঠনে সৃষ্ট হয়, এইসবই আত্মার পক্ষে একটি আকর্ষণ ও চুম্বক; এটা নিশ্চিত যে আত্মা এর মধ্যে আবির্র্ভূত হবে। সুতরাং পরিষ্কার দর্পন নিশ্চিতভাবেই সূর্যরশ্মি আকর্ষণ করবে। এটা আলোকময় হবে এবং বিস্ময়কর প্রতিবিম্বসমূহ এর মধ্যে আবির্ভূত হবে। অর্থাৎ যখন এই বিদ্যমান উপাদানসমূহ স্বাভাবিক বিন্যাস পদ্ধতি অনুসারে ও নির্ভুল শক্তি সহকারে একত্রিত হয় তখন এগুলি আত্মার জন্য একটি চুম্বকে পরিণত হয় এবং আত্মা এগুলির মধ্যে আত্মার সর্ব পরাকাষ্ঠা সহকারে প্রকাশিত হবে।

এমতাবস্থায় এটা বলা যাবে না “সূর্যরশ্মির দর্পনের উপর অবতরণ করার কি আবশ্যকতা রয়েছে? কারণ আথ্যাত্মিক হোক বা জড় হোক বস্তুসমূহের বাস্তবতার (বাস্তব সত্ত্বার) যে সংযোগ বিদ্যমান রয়েছে সেটা দাবী করে যে, যখন উক্ত দর্পন পরিষ্কার থাকে ও সূর্যমুখী হয় তখন সূর্যের আলো অবশ্যই এর মধ্যে দৃশ্যমান হবে। অনুরূপভাবে যখন উপাদানসমূহ সর্বোৎকৃষ্ট রীতি পদ্ধতি, সংগঠন ও ধরণে সুবিন্যস্ত ও সম্মিলিত হবে, তখন মানবাত্মা এগুলির মধ্যে আবির্ভূত হবে ও সুস্পষ্ট হবে। সর্বশক্তিমান ও সুবিজ্ঞের এটাই বিধান।

32
আল্লাহ্ ও সৃষ্ট বস্তু বা প্রাণীর মধ্যে সম্বন্ধ

প্রশ্ন: আল্লাহ্ ও সৃষ্ট প্রাণী বা বস্তুর মধ্যে সংযোগের প্রকৃতি কি? অর্থাৎ মহোচ্চ -স্বাধীন ও অন্যান্য অস্তিত্বসমূহের মধ্যে সংযোগের প্রকৃতি কি?

উত্তর: আল্লাহ্ ও অন্যান্য বস্তুর মধ্যে সম্পর্ক হচ্ছে সৃষ্টির প্রতি স্রষ্টার সম্পর্ক; এটা হচ্ছে সূর্য ও সাপেক্ষ অস্তিত্বসমূহের অন্ধকার দেহসমূহের মধ্যে সসম্পর্কেণ ন্যায় এবং স্রষ্টা ও যে যে বস্তু তিনি সৃষ্টি করেছিল তার মধ্যে সম্পর্কের ন্যায়। সূর্য তার নিজস্ব আস্তিত্ব সারভাগে- যে সমস্ত বস্তু আলোকিত করে তা থেকে সে স্বাধীন; কারণ এর আলো নিজের মধ্যেই পার্থিব গোলক থেকে স্বাধীন ও মুক্ত, সুতরাং পৃথিবী সূর্যের প্রভাবের মুখাপেক্ষী এবং সূর্য থেকে আলোক প্রাপ্ত হয়; পক্ষান্তরে সূর্য ও এর রশ্মি সম্পূর্ণ পৃথিবী থেকে স্বাধীন। কিন্তু যদি সূর্য না থাকতো তাহলে পৃথিবী ও সমগ্র পার্থিব অস্তিত্বশীল বস্তু প্রাণী বিদ্যমান থাকতে পারত না।

সৃষ্ট বস্তুসমূহের মধ্য দিয়ে আল্লাহ্র নির্ভরশীলতা হচ্ছে নির্গমনের তথা নিঃসরণের নির্ভরশীলতা; সৃষ্ট জীব বস্তু আল্লাহ থেকে নির্গত হয়, সৃষ্ট জীব বস্তু আল্লাহকে প্রকাশ করে না। উক্ত সম্পর্ক হচ্ছে নির্গমনের সম্পর্ক, প্রকাশের সম্পর্ক নয়। সূর্যালোক সূর্য থেকে নির্গত হয়, এটা সূর্যকে প্রকাশ করে না। নির্গমনের মাধমে আবির্ভাব হচ্ছে বিশ্ব ব্রক্ষ্মাণ্ডের দিগন্তসমূহের জ্যোতিষ্ক থেকে আলোক রেখাসমূহের আবিষ্কারের ন্যায়; অর্থাৎ সত্যের সূর্যের পবিত্র অস্তিত্ব বিভক্ত হয় না এবং সৃষ্ট জীব বস্তুর অবস্থায় অবতরণ করে না। অনুরূপভাবে সূর্য গোলক বিভক্ত হয় না এবং পৃথিবীতে অবতরণ করে না; না, সূর্য রশ্মি, যা সূর্যের বদান্যতা, তা সূর্য থেকে নির্গত হয় এবং অন্ধকার বস্তুগুলিকে আলোকিত করে।

কিন্তু প্রকাশের মাধ্যমে আবির্ভাব হচ্ছে বীজ থেকে শাখা, পত্র, পুষ্প মুকুল ও ফলসমূহের প্রকাশ; কারণ বীজ তার নিজস্ব সারৎসারে (সার পদার্থ) শাখা ও ফলসমূহে এবং এর বাস্তবতায় (বাস্তব সত্ত্বা) শাখা, পত্র ও ফলসমূহে প্রবেশ করে। প্রকাশের মাধ্যমে আবির্ভাব মহোচ্চ আল্লাহ্র পক্ষে মৌলিক সম্পূর্ণতা হবে এবং এটা সম্পূর্ণ অসম্ভব; কারণ ভাবার্থ হবে যে, সম্পূর্ণ পূর্ব থেকে বর্তমান তথা বিদ্যমান অস্তিত্ব ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু সম্বন্ধীয় গুণাবলীতে বিশেষিত বা সীমাবদ্ধ; কিন্তু এটা যদি তাই হত তাহলে অবিমিশ্র নির্ভরশীলতা হবে নিছক গুণের অভাব এবং প্রকৃত অস্তিত্ব হয়ে উঠবে অস্তিত্বহীনতা বা অবিদ্যমানতা, কিন্তু এটা অসম্ভব।

অতএব সমুদয় সৃষ্ট জীব বস্তু আল্লাহ থেকে নির্গত হয়; অর্থাৎ আল্লাহর দ্বারাই সমুদয় বস্তু বাস্তবে পরিণত হয় এবং তাঁর দ্বারাই সমুদয় অস্তিত্ব, অস্তিত্ব লাভ করেছে। আল্লাহ্ থেকে প্রথম যে বস্তু নির্গত হয়েছিল সেটা হচ্ছে সার্বজনীন বাস্তবতা (প্রকৃত সত্ত্বা) যাকে প্রাচীন দার্শনিকেরা “প্রথম মন”নামে অভিহিত করেন এবং যাকে বাহার জনমণ্ডলী “প্রথম ইচ্ছা শক্তি”নামে অভিহিত করছে। আল্লাহর জগতে যে কোন কিছুর মধ্যে এই নির্গমনের ফল বা কার্য সংশ্লিষ্ট করে বা করুক না কেন, এই নির্গমন স্থান ও কালের দ্বারা সীমাবদ্ধ; এর আরম্ভ নেই, শেষও নেই। আল্লাহ সম্পর্কে আরম্ভ ও শেষ এক। আল্লাহর পূর্ব থেকে বিদ্যমানতা হচ্ছে অস্তিত্বে পূর্ব বিদ্যমানতা ও সময়ের পূর্ব বিদ্যমানতাও এবং দেব তথা সম্ভাব্য ঘটনার প্রপঞ্চময়তা। (ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য। এবং অত্যাবশ্যক এবং সময় সংক্রান্ত নয় (পার্থিব) যা আমরা খাবার টেবিলেই একদিন ব্যাখ্যা করেছি।

যদিও “প্রথম মন”আদিহীন তবু এটা আল্লাহর পূর্ব থেকে বিদ্যমানতায় শরিক হয় না; কারণ আল্লাহ্র অস্তিত্বের সহিত সম্পর্কে সার্বজনীন বাস্তবতার (বাস্তব সত্ত্বা) অস্তিত্ব হচ্ছে শূন্যগর্ভতা (অনিস্তিত্ব) এবং এর আল্লাহর অংশীদার হওয়ার ও পূর্ব থেকে অস্তিত্বে তাঁর সমকক্ষ হওয়ার ক্ষমতা নেই। পূর্বে এই বিষয়ে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

জীবন্ত জীব বস্তুর অস্তিত্বকে মিশ্রণ তথা সংযুক্তি এবং তাদের মৃত্যুকে বিয়োজন বা বিশ্রেষণ বুঝায়। কিন্তু সার্বজনীন পদার্থ ও উপাদাসমূহ সম্পূর্ণরূপে বিনাশ ও ধ্বংস হয় না; না, তাদের অনস্তিত্ব হচ্ছে কেবল রূপান্তর তথা সার বস্তুর পরিবর্তন। উদাহরণস্বরূপ যখন মানুষ সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, তখন সে ধুলিতে পরিণত হয়, কিন্তু সে সম্পূর্ণরূপে অস্তিত্বহীন হয় না; সে তখনও ধুলির আকারে বিদ্যমান থাকে; কিন্তু রূপান্তর ঘটেছে এবং এই মিশ্রণ তথা সংযুক্তি দৈবক্রমে বিশ্লিষ্ট হয়েছে। অন্যান্য অস্তিত্বসমূহের ধ্বংসপ্রাপ্তি এই একই, কারণ অস্তিত্ব সম্পূর্ণরূপে অস্তিত্ববিহীন হয় না এবং সম্পূর্ণ অনস্তিত্ব অস্তিত্বে পরিণত হয় না।

33
আল্লাহ্ থেকে মানব আত্মার নির্গত হওয়া সম্বন্ধে

প্রশ্ন; বাইবেলে বলা হয়েছে যে মানব দেহে আল্লাহ্র আত্মা ফুৎকার করেছেন ( সঞ্চারিত করেছেন) এই শ্লোকের অর্থ কি?

উত্তর: জেনে রাখ নির্গত হওয়া দুই প্রকারের, নির্গমনের মধ্য দিয়ে উৎপন্ন ও আবির্ভাব এবং প্রকাশের মাধ্যমে উৎপন্ন ও আবির্ভাব। নির্গমনে মধ্য দিয়ে উৎপন্ন হওয়া অর্থ হচ্ছে কর্তার (যিনি কাজ করেন) কাজ থেকে উৎপন্ন হওয়া বা বের হয়ে আসার ন্যায়, লেখক থেকে লিখন বা লিখিত বিষয় বের হয়ে আসার ন্যায়। এক্ষন লেখক থেকে লিখিত বিষয় নির্গত হয়, বক্তা হতে বক্তব্য তথা বক্তৃতা বের হয়ে আসে এবং অনুরূপভাবে আল্লাহ হতে আত্মা নির্গমন করে। এটা ঠিক নয় যে, এটা (আত্মা) আল্লাহকে প্রকাশ করে- অর্থাৎ: স্বর্গীয় বাস্তবতা (বাস্তব সত্ত্বা) থেকে কোন অংশই বিছিন্ন হয়ে মানব দেহে প্রবেশ করে না। না, যেমন বক্তা হতে বক্তৃতা নির্গত হয়, তেমনি মানব দেহে আত্মা আবির্ভূত হয়।

কিন্তু প্রকাশের মাধ্যমে উৎপন্ন বা আবির্ভাব হচ্ছে অন্যান্য আকারে একটি বস্তুর বাস্তবতায় প্রকাশ, বৃক্ষের বীজ থেকে এই বৃক্ষ উৎপন্ন হওয়া বা বের হয়ে আসার ন্যায়’ কারণ বীজ নিজেই শাখা প্রশাখা, পত্রগুচ্ছ ও পুষ্পসমূহের আকারে আবির্ভূত হয় বা প্রকাশ পায়। একেই প্রকাশের মধ্য দিয়ে উৎপন্ন বা নির্গমন বলা হয়। মানবমÐলীর আত্মাসমূহের আল্লাহ সম্পর্কে নির্গমনের মাধমে নির্ভরতা আছে; ঠিক যেমন বক্তা থেকে বক্তব্য বের হয়, ও লেখক থেকে লিখন বা লিখিত বিষয় বের হয়; অর্থাৎ বক্তা স্বয়ং বক্তব্যে পরিণত হয় না, লেখক স্বয়ং লিখন বা লিখিত বিষয়ে পরিণত হয় না। না, বরং তারা নির্গমনের অভিব্যক্তি বা প্রকাশপ্রাপ্ত হয়। বক্তার অনুপম যোগ্যতা ও শক্তি আছে এবং বক্তব্য তার থেকে নির্গথ হয় বা বেরিয়ে আসে, যেমন কর্তা হতে কর্ম বেরিয়ে আসে। একত্বে সারৎসার (সারবস্তু) সেই বাস্তব বক্তা সর্বদাই একক অবস্থায় বিদ্যমান আছেন যে অবস্থা পরিবর্তিত হয় না, রূপান্তরও গ্রহণ করে না, ভাগ্য বিপর্যয়ের সম্মুখীনও হয় না। তিনি অনন্ত, চিরস্থায়ী ও অমর। অতএব আল্লাহ্ থেকে মানব আত্মাসমূহের উৎপন্ন বা আগমন বা আবির্ভাব হচ্ছে নির্গমনের মাধ্যমে। যখন বাইবেলে বলা হয় যে আল্লাহ মানুসের মধ্যে তাঁর আত্মাকে ফুঁকে বা ফুৎকার করলেন, তখন এই আত্মা হচ্ছে সেই আত্মা যা মানুষের বাস্তবতায় কার্যকরী বাস্তব বক্তার থেকে নির্গত বক্তব্যের ন্যায়।

কিন্তু প্রকাশের মধ্য দিয়ে আগমন বা উৎপন্ন (যদি এর দ্বারা স্বর্গীয় আবির্ভাব বুঝায় এবং খণ্ডে খণ্ডে বিভক্তি নয়) আমরা বলেছি, এই আগমন বা উৎপন্ন হচ্ছে পবিত্র আত্মা ও আল্লাহর বাক্য থেকে আগমন বা উৎপত্তি। যেমন যোহনের সুমাচারে বলা হয়েছে, “আদিতে বাক্য ছিল এবং বাক্য আল্লাহ্র কাছে ছিল।” তাহলে পবিত্র আত্মা ও বাক্য হচ্ছে আল্লাহর আবির্ভাব। উক্ত আত্মা ও বাক্য অর্থ হচ্ছে স্বর্গীয় পরোৎকর্ষ বা পূর্ণতাসমূহ যা যীশুখ্রিষ্টের বাস্তবতায় (বাস্তব সত্ত্বা) আবির্ভূত হয়েছিল এবং এই পূর্ণতাগুলি আল্লাহ্র কাছে ছিল; সুতরাং সূর্য তার সমুদয় দীপ্তি দর্পনে প্রকাশ করে, কারণ বাক্য যীশুখ্রিষ্টের দেহকে বুঝায় না; না, বরং স্বর্গীয় পরোৎকর্ষতাসমূহ তাঁর মধ্যে প্রতিভাত হয়েছিল, কারণ যিশুখ্রিষ্ট ছিলেন বাস্তবতার সূর্যমুখী পরিষ্কার দর্পনস্বরূপ এবং বাস্তবতার সূর্যের পরোৎকর্ষতাসমূহ অর্থাৎ এর আলোক ও উত্তপ এই দর্পনে দৃশ্যমান ও সুস্পষ্ট ছিল।

যদি আমরা দর্পনে খোজ করি, তাহলে আমরা সূর্য দেখতে পাই ও বলি, “এই যে সূর্য।”অতএব বাক্য ও পবিত্র আত্মা, যা আল্লাহ্র পরোৎকর্ষতাসমূহকে বুঝায়, তাকে ঈশ্বরের আবির্ভাব বলে। এটাই হচ্ছে সুমাচারে বর্ণিত শ্লোকের অর্থ যে সুমাচার (গসপেল) বলছে, “বাক্যআল্লাহরসাথে ছিল এবং বাক্য আল্লাহ্ ছিলেন।”কারণ স্বর্গীয় পরোৎকর্ষতাসমূহ একত্বের সারৎসার থেকে পৃথক নয়। যিশুখ্রিষ্টের পরোৎকর্ষতাসমূহকে বাক্য বলা হয়, কারণ সমুদয় অস্তিত্ব অক্ষরসমূহের অবস্থায় বিদ্যমান এবং একটি অক্ষরের পরিপূর্ণ অর্থ নাই; পক্ষান্তরে যীশুখ্রিষ্টের পরোৎকর্ষতাসমূহের বাক্যের ক্ষমতা আছে, কারণ একটি অক্ষর থেকে পরিপূর্ণ বা পূর্ণ অর্থ অনুমান করা যেতে পারে। যেহেতু যীশুখ্রিষ্টের বাস্তবতা ছিল স্বর্গীয় পরোৎকর্ষসমূহের প্রকাশ, সেহেতু এটা ছিল বাক্যের ন্যায়। কিন্তু কেন? কারণ তিনি হচ্ছেন পূর্ণ অর্থসমূহের সমষ্টি। এই জন্যই তিনি বাক্য নামে অভিহিত। এবং জেনে রাখ যে, আল্লাহ্ হতে বাক্য ও পবিত্র আত্মার নির্গমন - যা হচ্ছে প্রকাশের আবির্ভাব ও নির্গমন একে এই বুঝা যাবে না যে খোদাইত্বের (ঈশ্বরত্বের) বাস্তবতা (বাস্তব সত্ত্বা) খণ্ডে খণ্ডে বিভক্ত হয়েছে অথবা বহু সংখ্যায় বর্ধিত হয়েছে, পুত পবিত্রতার মহোচ্চতা থেকে অবতরণ করেছে, খোদা না করুক! যদি একটি খাটি, চমৎকার দর্পন সূর্যমুখী হয় তাহলে সূর্যের আলো ও উত্তাপ, আকার ও প্রতিবিম্ব এইরূপ অভিব্যক্তির সহিত এটা সমুজ্জ্বল হবে যে, যদি একজন দর্শক উক্ত দর্পনে দৃশ্যমান ও উজ্জ্বল সূর্যের কথা বলে “এটাই সূর্য”তাহলে এটা সত্য। কিন্তু তবুও উক্ত দর্পন - দর্পনই এবং সূর্য - সূর্যই। উক্ত একক সূর্য যদি অসংখ্য দর্পনেও প্রকাশিত হয়, তবু সূর্য ঐ একটাই। এই অবস্থা না স্থায়ী, না প্রবেশকরণের, না মিশ্রণের, না অবতরণের অবস্থা; কারণ প্রবেশ করণ, স্থায়ী হওন, অবতরণ, বহির্গত হওন ও মিশ্রন হচ্ছে দেহসমূহের অত্যাবশ্যক প্রয়োজন ও চরিত্র বৈশিষ্ট্য, আত্মাসমূহের নয়; তাহলে আল্লাহর পূত পবিত্র বাস্তবতার সঙ্গে এদের (উল্লেখিত বিষয়ের) কোন সংশ্রব নাই। যা কিছু তাঁর পবিত্রতা এবং তাঁর সমুন্নত শুদ্ধচারিতা অনুযায়ী নয়, তা হতে আল্লাহ দূরে অবস্থান করেন।

আমরা বলছি বাস্তবতার অর্থ সর্ব সময়েই একক অবস্থায় বিদ্যমান; এর কোন পরিবর্তন নেই, পরিবর্ধন নেই, রূপান্তর নেই এবং ভাগ্য বিপর্যয় নেই। এটা শাশ্বত ও চিরস্থায়ী। কিন্তু আল্লাহ্র বাক্যের পবিত্র বাস্তবতা (বাস্তব সত্ত্বা) খাটি, সুন্দর ও উজ্জ্বল দর্পনের অবস্থায় বিদ্যমান, এবং উত্তাপ, আলো, প্রতিবিম্ব ও সাদৃশ্যতা অর্থাৎ বাস্তবতার সূর্যের পরোৎকর্ষতাসমূহ এই দর্পনে দৃষ্ট হয় তথা প্রতিভাত হয়। এই জন্যই গসপেলে (সুমাচারে) যীশু খ্রিষ্ট বলেন “পিতা পুত্রের মধ্যে আছে” অর্থাৎ বাস্তবতার সূর্য দর্পনে আবির্ভূত হয়। প্রশংসা তাঁরই যিনি এই পবিত্র বাস্তবতার উপর কিরণ বর্ষণ করেছেন- যিনি অস্তিত্বসমূহের মধ্যে পবিত্রকৃত।

34
বিচার বুদ্ধি সম্পন্ন আত্মা, আত্মা, ও মন

প্রশ্ন: মন, আত্মা ও বিচার বুদ্ধি সম্পন্ন আত্মার মধ্যে প্রভেদ কি?

উত্তর: পূর্বেই ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে, আত্মা সার্বজনীনভাবে পাঁচ শ্রেণীতে বিভক্ত; যথা: উদ্ভিদ আত্মা, জীবাত্মা, মানব আত্মা, বিশ্বাসের আত্মা ও পবিত্র আত্মা।

উদ্ভিদ আত্মা হচ্ছে বৃদ্ধির শক্তি যা অন্যান্য অস্তিত্বসমূহের প্রভাবের মাধ্যমে বীজে ঘটানো হয়।

জীবাত্মা হচ্ছে সমগ্র ইন্দ্রিয়ানুভূতির শক্তি যা উপাদানসমূহের সংযোজন ও মিশ্রণ থেকে বাস্তবায়িত করা হয়, যখন এই সংযোজন ও মিশ্রণ বিশ্লিষ্ট হয়, তখন উক্ত শক্তি বিনাশ ও ধ্বংস প্রাপ্ত হয়। এটা এই প্রদীপের সমতুল্য বা সদৃশ হতে পারে; যখন তেল, শলিতা ও অগ্নি একত্রে সংযুক্ত হয়, তখন এটা আলোকিত হয় এবং যখন এই সংযুক্তি ভেঙ্গে দেওয়া হয় অর্থাৎ যখন সংযুক্ত অংশগুলি একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়, তখন প্রদীপও নির্বাপিত হয়। মানবাত্মা যা মানুষকে পশু থেকে পার্থক্য নির্দেশ করে, সেটা হচ্ছে বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন আত্মা এবং এর দুটি নাম- মানবাত্মা ও বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন আত্মা- একটিকেই নির্দেশ করে। দার্শনিকদের পরিভাষায় এই বিচার বুদ্ধি সম্পন্ন আত্মা সমুদয় অস্তিত্বকে অন্তর্ভূক্ত করে এবং মানুষের যোগ্যতায় যতদুর কুলায়, বস্তুসমূহের বাস্তবতা (বাস্তব সত্ত্বা) আবিষ্কার করে, ঐ সমস্ত বস্তুর বৈশিষ্ট্যসমূহ ও ফলাফল এবং অস্তিত্বসমূহের গুণাবলী ও ধর্ম সম্বন্ধে জ্ঞাত হয়। কিন্তু বিশ্বাসের আত্মা দ্বারা সাহায্যপুষ্ট না হলে মানবাত্মা স্বর্গীয় রহস্যাবলী ও বাস্তবতাসমূহের সহিত পরিচিত হয় না। এই আত্মা স্বচ্ছ, ঝকঝকে ও উজ্জ্বর দর্পনতুল্য, কিন্তু তবু তার আলোক প্রয়োজন। যাবৎ না এর উপর সূর্য রশ্মি প্রতিফলিত হয়, তাবৎ এটা স্বর্গীয় রহস্যাবলী আবিষ্কার করতে পারে না। কিন্তু মনে হচ্ছে মানবাত্মার শক্তি। আত্মা হচ্ছে প্রদীপ এবং মন হচ্ছে আলো যা প্রদীপ থেকে বিকীর্ণ হয়। আত্মা হচ্ছে বৃক্ষ এবং মন হচ্ছে ফল। মন হচ্ছে আত্মার পূর্ণতা এবং এর অত্যাবশ্যক গুণ, যেমন সূর্য রশ্মি হচ্ছে সূর্যের অত্যাবশ্যক প্রয়োজনীয় বস্তু।

এই বাক্য যদিও সংক্ষিপ্ত, তবু সম্পূর্ণ; অতএব এ সম্বন্ধে গভীরভাবে চিন্তা কর এবং খোদার মর্জি হলে তুমি বিশেষভাবে জানতে পারবে।

35
শারীরক শক্তি ও বুদ্ধি বৃত্তি সংক্রান্ত শক্তি

মানুষের মধ্যে পাঁচটি বহিস্থ শক্তি বিদ্যমান, যেগুলি হচ্ছে- উপলব্ধির মাধ্যম, অর্থাৎ এই পাঁচ শক্তির মাধ্যমে মানুষ জড় অস্তিত্বসমূহ অনুভব তথা উপলব্ধি করে। এগুলি হচ্ছে দৃষ্টিশক্তি, যা দৃশ্যমান আকারসমূহ উপলব্ধি করে; শ্রবণ শক্তি, যা শ্রবণযোগ্য শব্দসমূহ উপলব্ধি করে; ঘ্রাণমক্তি, যা ঘ্রাণসমূহ উপলব্ধি করে; আস্বাদন শক্তি যা খাদ্য দ্রব্যের স্বদ উপলব্ধি করে এবং অনুভূতি শক্তি, যা সমগ্র দেহের সমগ্র অংশে বিরাজ করছে এবং স্পর্শনীয় বস্তুসমূহ অনুভব করে। এই পাঁচটি শক্তি বাহ্যিক অস্তিত্বসমূহ অনুভব বা উপলব্ধি করে।

মানুষের আধ্যাত্মিক শক্তিও আছে; কল্পনা শক্তি, যা বস্তুসমূহ বা বিষয়সমূহ সম্বন্ধে কল্পনা করে; চিন্তা শক্তি, যা বাস্তবতাসমূহ সম্বন্ধে চিন্তা ভাবনা করে; বোধশক্তি, যা বাস্তবতাসমূহ হৃদয়ঙ্গম করে, স্মৃতি শক্তি, যা কিছু মানুষ কল্পনা করে, চিন্তা করে ও হৃদয়ঙ্গম করে, স্মৃতি শক্তি সেগুলি ধারণ করে উক্ত বাহ্যিক পঞ্চশক্তি ও মানসিক শক্তির মধ্যবর্তী হচ্ছে জ্ঞানেন্দ্রিয় তথা বিচার শক্তি, যে বিচার শক্তি তাদের সবার সমান অধিকারে বিদ্যমান অর্থাৎ উক্ত বিচার শক্তি তথা জ্ঞানেন্দ্রিয়, যা বহিস্থ ও আভ্যন্তরীণ শক্তিসমূহের মধ্যে কাজ করেÑ উক্ত বহিস্থ শক্তিসমূহ যা কিছু উপলব্ধি করে, জ্ঞানেন্দ্রিয় তা আভ্যন্তরীণ শক্তিসমূহের কাছে বহন করে। এটা সাধারণ ধীশক্তি বা ইন্দ্রিয়বৃত্তি নামে অভিহিত, কারণ এটা বহিস্থ ও আভ্যন্তরীণ শক্তির সাধারণ অধিকারভূক্ত।

উদাহরণস্বরূপ বহিস্থ শক্তিসমূহের মধ্যে একটি হচ্ছে দৃষ্টি শক্তি; এটা এই ফুলটিকে দেখছে এবং মনোমধ্যে গ্রহণ করছে এবং আভ্যন্তরীণ শক্তির কাছে এই উপলব্ধি সমর্পণ করছে। আভ্যন্তরীণ শক্তি তথা সর্বসাধারণ ইন্দ্রিয়বৃত্তি এই উপলব্ধি বোধকে কল্পনা শক্তির কাঝে প্রেরণ করছে। কল্পনা শক্তি পর্যায়ক্রমে কল্পনা করছে এবং এই প্রতিমূর্তির আকার গঠন করছে এবং চিন্তা শক্তির কাছে প্রেরণ করছে। চিন্তাশক্তি পূর্ণভাবে বিবেচনা করছে এবং উক্ত বাস্তবতা অনুধাবনপূর্বক বোধ শক্তির কাছে সমর্পণ করছে; বোধ শক্তি এটাকে হৃদয়ঙ্গম করার পর জ্ঞেয় বিষয়বস্তু তথা উপলব্ধ বস্তুর প্রতিমূর্তি স্মৃতি শক্তির কাছে সমর্পণ করছে এবং স্মৃতি শক্তি সেটাকে স্মৃতির ভাণ্ডারে সংরক্ষণ করছে।

বহিস্থ শক্তি পাঁচটি, যথা: দৃষ্টি শক্তি, শ্রবণ শক্তি, আস্বাদন শক্তি, ঘ্রাণ শক্তি ও অনুভব শক্তি।

আভ্যরীণ শক্তিও পাঁচটি, যথা; সর্বসাধারণের ইন্দ্রিয়বৃত্তি তথা ধীশক্তি, কল্পনা শক্তি, চিন্তা শক্তি, বোধ শক্তি ও স্মৃতি শক্তি।

36
মানবমণ্ডলীর চরিত্র বৈশিষ্ট্যের মধ্যে পার্থক্যের কারণ

প্রশ্ন: মানুষের কত প্রকার চরিত্র আছে? মানুষের মধ্যে পার্থক্য ও বৈশিষ্ট্যের কারণ কি?

উত্তর: মানুষের সহজাত চরিত্র উত্তরাধিকার সূত্রে লব্ধ চরিত্র ও অর্জিত চরিত্র যা শিক্ষা দ্বারা লাভ করা হয়।

সহজাত চরিত্র সম্বন্ধে বলতে গেলে, যদিও স্বর্গীয় সৃষ্টি সম্পূর্ণরূপে ভাল; তবুও মানুষের মধ্যে স্বাভাবিক গুণাবলীর চরিত্র ধাপ বা পরিমাণের পার্থক্য থেকে আসে বা বর্তায়; সমুদয় গুণাবলীই চমৎকার, কিন্তু কম বেশি চমৎকারÑ ধাপ বা পরিমাণ অনুযায়ী। সুতরাং সমগ্র মানবজাতি বুদ্ধিমত্তা ও ধারণ শক্তির অধিকারী, কিন্তু মানবমণ্ডলীর বুদ্ধিমত্তা, ধারণ শক্তি ও যোগ্যতা বিভিন্ন। এটা সুস্পষ্ট।

উদাহরণস্বরূপ, একই পাঠধ্যৈায়নে লিপ্ত, একই পোষাক পরিচ্ছদে ভূষিত, একই আবহাওয়্যায়, একই অন্নে প্রতিপালিত, একই স্থানের , একই বিদ্যালয়ের একই শিক্ষক দ্বারা, একই পরিবারের কিছু সংখ্যক শিশুর কথা ধরÑ এটা নিশ্চিত যে এই শিশুগুলির মধ্যে কতক বিজ্ঞানে নিপুণ হবে, কতক হবে গড়পড়তা (সাধারণ) যোগ্যতা সম্পন্ন এবং কতক হবে নির্বোধ। অতএব এটা পরিষ্কার যে, মৌলিক প্রকৃতিতে ধাপ তথা পরিমাণের পার্থক্য ও যোগ্যতা ও ধারণ শক্তির বৈচিত্রসমূহ বিদ্যমান রয়েছে। এই পার্থক্য ভাল অথবা মন্দ বুঝায় না, তবে এটা ধাপ তথা পরিমাণের পার্থক্য মাত্র। বারুর কাছে সর্বোচ্চ ধাপ তথা মাত্রা, কারুর কাছে মধ্যম ধাপ তথা মাত্রা এবং অন্য কারুর কাছে সর্বনিম্ন মাত্রা। সুতরাং মানুষ আছে, ইতর প্রাণী, উদ্ভিদ এবং খনিজ পদার্থও আছে- কিন্তু এই চারটির অস্তিত্বের ধাপে পার্থক্য রয়েছে। মানুষ ও প্রাণীকুলের অস্তিত্বের মধ্যে কতই না পার্থক্য! কিন্তু উভয়ই অস্তিত্ব। এটা সুস্পষ্ট যে অস্তিত্বের মধ্যে ধাপের পার্থক্য বিদ্যমান।

উত্তরাধিকারসূত্রে লব্ধ গুণাবলী ধাতের শক্তি ও দুর্বলতা থেকে আসে; অর্থাৎ যদি পিতা মাতা দুর্বল হয়, শিশুরাও দুর্বল হবে; যদি তারা বলবান হয়, শিশুরাও বলিষ্ঠ হবে। অনুরূপভাবে রক্তের শুদ্ধতা তথা পবিত্রতার বিরাট প্রভাব রয়েছে; কারণ বিশুদ্ধ জীব উৎকৃষ্টতর গোত্রের ন্যায়, যা উদ্ভিদ ও ইতর প্রাণীর মধ্যে বিদ্যমান। উদাহরণস্বরূপ তুমি দেখে থাক যে, ক্ষীণ ও দুর্বল মাতা পিতা থেকে জাত শিশুরা স্বভাবতই দুর্বল ধাত ও ক্ষীণ স্নায়বিক অবস্থা প্রাপ্ত হয়; তারা রোগে পীড়িত হয়ে থাকে, তাদের না থাকে ধৈয্য, না থাকে সহিষ্ণুতা, না থাকে স্থিরতা, না থাকে ঐকান্তিকতা এবং তারা হঠকারী হয়ে থাকে। কারণ শিশুরা উত্তরাধিকার সূত্রে তাদের মাতা পিতার দুর্বলতা ও নিস্তেজতা প্রাপ্ত হয়ে থাকে।

এছাড়াও কতক পরিবার ও বংশধরদের উপর বিশেষ আশীর্বাদ বর্ষিত হয়ে থাকে। এমতে এটা একটি বিশেষ আশীর্বাদ তথা আল্লাহ্র দান যে ইব্রাহিমের বংশধরদের মধ্য হতে ইসরায়েল সন্তানদের পয়গম্বর এনে থাকবেন। এটা একটা অশীর্বাদ যে আল্লাহ্ এই বংশকে দান করেছেন; “মাতা পিতার হতে মুসাকে, মাতার বংশ হতে যিশুখ্রিষ্টকে মুহাম্মদ ও বা’বকেও এবং ইসরায়েল এর সমুদয় পয়গম্বর ও পবিত্র ঐশী প্রকাশদেরকে।

অতএব এটা সুস্পষ্ট যে, উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত (পৈতৃক) চরিত্রও বিদ্যমান থাকে এবং এমন পরিমাণে বিদ্যমান থাকে যে, যদি উক্ত চরিত্রসমূহ তাদের মূলের সামঞ্জস্যপূর্ণ না হয়, যদিও উক্ত চরিত্রগুলি শারীরিকভাবে সেই বংশের অন্তর্ভূক্ত, তবুও আধ্যাত্মিকভাবে তারা উক্ত পরিবারের সদস্যরূপে বিবেচিত হয় না; যেমন কানানকে নূহএর বংশের লোক বলে গণ্য করা হয় না।

কিন্তু কৃষ্টি সম্পর্কে গুণাবলীর পার্থক্য বিরাট; কারণ শিক্ষার বিরাট প্রভাব রয়েছে। শিক্ষার মাধ্যমে অজ্ঞজনেরা বিজ্ঞ তথা কৃষ্টি সম্পন্ন হয়, ভীরুরা সাহসী হয়; অনুশীলনের মাধ্যমে বক্র শাখা সোজা হয়, পাহাড় জঙ্গলের টক ও তিক্ত ফল শিষ্ট ও উপাদেয় হয় এবং পঞ্চ পাপড়ি বিশিস্ট পুষ্প শত পাপড়ি বিশিষ্ট ফুলে পরিণত হয়। শিক্ষা প্রাপ্তির মাধ্যমে বর্বর জাতি সুসভ্য জাতিতে পরিণত হয়, এমনকি ইতর প্রাণীকুলও ঘরকুনো হয়ে যায়। বিদ্যা শিক্ষা সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হবে; কারণ যেহেতু বিশ্ব সংসারে দেহসমূহের রোগ পীড়া সাংঘাতিকভাবে সংক্রামক, সেহেতু অনুরূপভাবে আত্মা ও মনের গুণাবলীও সাংঘাতিকভাবে সংক্রামক। শিক্ষায় একটি সার্বজনীন প্রভাব রয়েছে এবং এর দ্বারা সংঘঠিত পার্থক্য বিরাট।

হয়তো কতক লোক বলবে যে, যেহেতু মানুষের ধারণ শক্তি ও যোগ্যতায় পার্থক্য রয়েছে; সেহেতু ধারণ শক্তির পার্থক্য নিশ্চিতরূপেই চরিত্র বৈশিষ্ট্যের পার্থক্য ঘটায়।

কিন্তু এটা সত্য নয়; কারণ ধারণ শক্তি দুই প্রকারের; স্বাভাবিক ধারণ শক্তি ও অর্জিত ধারণ শক্তি। প্রথমটি আল্লাহ্র সৃষ্টি এবং এটা সম্পূর্ণরূপে উত্তম- আল্লাহর সৃষ্টিতে মন্দ তথা অমঙ্গল নেই; কিন্তু অর্জিত ধারণ শক্তি অমঙ্গল তথা মন্দের আবির্ভাবের কারণ হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ আল্লাহ্ সমগ্র মানব কুলকে এমনভাবে সৃষ্টি করেছেন এবং তাদেরকে এমন ধাত তথা গঠন ও এমন ধারণ শক্তি দিয়েছেন যে তদারা চিনি ও মধুর দ্বারা উপকৃত হয়ে থাকে এবং বিষের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত ও ধ্বংস প্রাপ্ত হয়ে থাকে। এই প্রকৃতি ও ধাত তথা গঠন হচ্ছে সহজাত এবং আল্লাহ এটা সমগ্র মানব জাতিকে সমভাবে দান করেছেন। কিন্তু মানুষ প্রতিদিন অল্প অল্প পরিমাণে গ্রহণপূর্বক, অল্প অল্প করে সে বিষে অব্যস্ত হয়ে পড়ে এবং ক্রমে ক্রমে এটার পরিমাণ বৃদ্ধির দ্বারা এমন এক অবস্থায় পৌঁছে যে প্রতিদিন তার একগ্রাম আফিম ছাড়া চলে না। এইভাবে স্বাভাবিক চরিত্র সম্পূর্ণরূপে বিকৃত হয়ে যায়। লক্ষ্য কর কি পরিমাণে স্বাভাবিত চরিত্র ও ধাত পরিবর্তিত হয়ে যায়, অবশেষে বিভিন্ন অভ্যাস ও প্রশিক্ষণের দ্বারা এই চরিত্র সম্পূর্ণরূপে বিকৃত হয়ে যায়। কোন লোক, লম্পট লোকদের তাদের সহজাত স্বভাব ও চরিত্রের কারণে সমালোচনা করে না, কিন্তু তাদের অর্জিত স্বভাব চরিত্রের জন্য সমালোচনা করে।

সৃষ্টির মধ্যে কোন অমঙ্গল বা মন্দ নেই; সবকিছুই ভাল বা মঙ্গল। কতক লোকের মধ্যে কতিপয় সহজাত বৈশিষ্ট্য ও স্বভাব দৃশ্যতঃ নিন্দনীয়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা নয়। উদাহরণস্বরূপ শুরু থেকেই একটি দুগ্ধপোষ্য শিশুর মধ্যে ইচ্ছা, ক্রোধ ও মেজাজের লক্ষণসমূহ তুমি দেখতে পাও। তাহলে এটা বলা যেতে পারে ভাল ও মন্দ মানুষের সত্ত্বায় সহজাত এবং এটা প্রকৃতি ও সৃষ্টির অবিমিশ্র উৎকর্ষের পরিপন্থী। এর উত্তর এই যে, ইচ্ছা তথা আকাঙ্খা, যা আরো বেশি কিছু চাওয়ার জন্য হয়ে থাকে, এটা একটা প্রশংসনীয় গুণ যদি এটা যথযথোভাবে প্রয়োগ করা হয়। সুতরাং যদি একজন লোকের জ্ঞান বা বিজ্ঞান ইচ্ছা বা আকাঙ্খা থাকে, অথবা সহানুভূতিশীল, উদার ও ন্যায়পর হতে ইচ্ছা বা আকাঙ্খা করে, তবে এটা খুবই প্রশংসনীয়। যদি সে হিংস্র পশু সদৃশ কোন রক্ত পিপাসু সেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে তার ক্রোধ প্রয়োগ করে, তাহলে এটা খুবই প্রশংসনীয়; কিন্তু সে যদি এই গুণাবলী সঠিকভাবে ব্যবহার না করে, তাহলে এই গুণাবলী দূষণীয়।

তাহলে এটা সুস্পষ্ট যে সৃষ্টি ও প্রকৃতির মন্দ বা অমঙ্গল মোটেই নেই; কিন্তু যখন মানুষের স্বাভাবিক গুণাবলী অন্যায়ভাবে বা অন্যায় পধে প্রয়োগ করা হয়, তখন এগুলি দূষণীয় বা নিন্দনীয়। সুতরাং যদি একজন ধনী ও উদার ব্যক্তি একজন দরিদ্র ব্যক্তিকে তার নিজের অত্যাবশ্যক প্রয়োজন মিটাবার জন্য কিছু টাকা দান করেন এবং যদি উক্ত দরিদ্র ব্যক্তি সেই টাকা অবৈধ বস্তু ক্রয়ে খরচ করে, তাহলে সেটা নিন্দনীয়। মানুষের সমস্ত স্বাভাবিক গুণাবলীর ব্যাপার ঐ একই - যা জীবনের মুলধন গঠন করে, যদি সেগুলি (গুণাবলী) অবৈধ পথে ব্যবহার ও ফলানো হয় ত্হালে তা নিন্দনীয়। অতএব এটা পরিষ্কার যে সৃষ্টি বস্তু সর্ম্পূর্ণরূপে উত্তম। চিন্তা কর যে গুণাবলীর মধ্যে জঘন্নতম ও বৈশিষ্ট্যসমূহের মধ্যে ঘৃণ্যতম- যা সমুদয় মন্দ বা অমঙ্গলের ভিত- সেটা হচ্ছে মিথ্যা কথন। এর চেয়ে আর কোন খারাপ গুণ কল্পনা করা যেতে পারে না; এটাই সমস্ত মনুষ্য পরোৎকর্ষতাসমূহের বিনাশকারী এবং অগণ্য পাপের কারণ। এর অপেক্ষা নিকৃষ্ট কোন চরিত্র বৈশিষ্ট্য নেই। এটাই সমুদয় অমঙ্গলের ভিত। এসব কিছু সত্ত্বও যদি কোন চিকিৎসক কোন রুগ্ন ব্যক্তিকে এই বলে সান্তনা দেয়: “আল্লাহ্কে ধন্যবাদ, তুমি অনেকটা সুস্থ্য, তোমার আরগ্যের আশা আছে।’’ যদিও এই কথাগুলি সত্যের পরিপন্থী, তবু এই কথাগুলি উক্ত পীড়িত ব্যক্তির সান্তনামূলক এবং পীড়ার অবস্থা পরিবর্তনের সহায়ক হতে পারে। এটা নিন্দনীয় নয়।

এই প্রশ্ন এখন পরিষ্কারভাবে বিষদ ব্যাখ্যা করা হয়েছে। সালাম--

37
মানুষ ও ঐশী প্রকাশগণের অধিকারভূক্ত জ্ঞানের ধাপ বা পরিমাণ

প্রশ্ন: মনুষ্য জগতের বুদ্ধিমত্তার পরিমাণ কি? এর সীমা কি?

উত্তর: জেনে রাখ যে বুদ্ধিমত্তা কম বেশি আছে; ইতর প্রাণীদের বুদ্ধিমত্তার পরিমাণ সর্বাপেক্ষা কম, অর্থাৎ যে স্বাভাবিক অনুভূতি যা জ্ঞানেন্দ্রিয়সমূহের শক্তির মাধ্যমে প্রকাশ পায়- একেই অনুভূতি বলে। এতে মানবকুল ও প্রাণীকুল অংশীদার; অধিকন্তু উক্ত ইন্দ্রিয়ানুভূতির ক্ষেত্রে মানুষের চেয়ে ইতর প্রাণীর ইন্দ্রিয়ানুভূতি অধিকতর শক্তিশালী। কিন্তু মানুষের বিভিন্ন অবস্থা অনুযায়ী মানুষের মধ্যে বুদ্ধিমত্তার পার্থক্য বা কম বেশি হয়ে থাকে।

প্রকৃতি জগতে বুদ্ধিমত্তার প্রথম শ্রেণী হচ্ছে বিচার বুদ্ধিসম্পন্ন আত্মার বুদ্ধিমত্তা। এই বুদ্ধিবৃত্তিতে ও এই শক্তিতেই সমুদয় মানুষই অংশীদার- তাই তারা অমনোযোগী হোক অথবা সতর্ক হোক, বিশ্বাসী হোক অথবা অস্বীকারকারী হোক। এই বিচার বুদ্ধি সম্পন্ন আত্মা আল্লাহ্র সৃষ্ট বস্তু; এই আত্মা অন্যান্য সমুদয় সৃষ্ট প্রাণীকে অন্তর্ভূক্ত করে ও অতিক্রম করে; কারণ এটা অধিকতর মহৎ ও বিশেষ বৈশিষ্ট্যে ভূষিত, এটা বস্তুসমূহকে অন্তর্ভূক্ত করে। এই বিচার বুদ্ধিসম্পন্ন আত্মার ক্ষমতা বা শক্তি বস্তুসমূহের বাস্তবতা (প্রকৃত সত্ত্বা) আবিষ্কার করতে পারে, অস্তিত্বসমূহের বৈশিষ্ট্যগুলি হৃদয়ঙ্গম করতে পারে; অস্তিত্বসমূহের রহস্যাবলী ভেদ করতে পারে। সমুদয় বিজ্ঞান, জ্ঞান, চারুশিল্প, প্রতিষ্ঠান, আবিষ্কার, অসম সাহসিক কর্মোদ্যম বিচার বুদ্ধিসম্পন্ন আত্মার বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ থেকে বেরিয়ে আসে। এক সময় ঐগুলি অজ্ঞাত সংরক্ষিত রহস্যাবলী ও গুপ্ত অজানা বস্তু ছিল, বিচার বুদ্ধি সম্পন্ন আত্মা এগুলিকে আবিষ্কার করে এবং অদৃশ্য ও গুপ্ত স্তর থেকে টেনে দৃশ্যমান রাজ্যে নিয়ে আসে। প্রাকৃতিক জগতে এটাই বুদ্ধিমত্তার সর্বশ্রেষ্ট শক্তি, যা এর সর্বোচ্চ ও সর্ব ঊর্ধ্বে উড্ডয়নে সাপেক্ষ অস্তিত্বসমূহের বাস্তবতা, গুণাগুণ ও ফলাফল হৃদয়ঙ্গম করে।

কিন্তু সার্বজনীন স্বর্গীয় মন, বা প্রকৃতির পরপারে, সেটা হচ্ছে পূর্ব থেকে অস্তিত্ববান শক্তির বদান্যতা বা দান। এই সার্বজনীন মন হচ্ছে স্বর্গীয়; এটা অস্তিত্বমান বাস্তবতাসমূহকে বেষ্টন করে এবং আল্লাহ্র রহস্যাবলীর আলো গ্রহণ করে। এটা একটা সচেতন শক্তি; গবেষণা ও পরীক্ষা নিরীক্ষার শক্তি নয়। প্রকৃতি জগতের বৃদ্ধিবৃত্তি সংক্রান্ত শক্তি গবেষণার শক্তি এবং এর গবেষণার দ্বারা এটা অস্তিত্বসমূহের বাস্তবতা ও অস্তিত্বসমূহের গুণাবলী আবিষ্কার করে; কিন্তু স্বর্গীয় বুদ্ধিবৃত্তি সংক্রান্ত শক্তি যা প্রকৃতির পরপারে, তা বস্তুসমূহকে বেষ্টন করে এবং বিষয়বস্তু সম্বন্ধে জ্ঞাত হয়, সেগুলিকে চেনে, বুঝে, রহস্যাবলী, বাস্তবতাসমূহ ও স্বর্গীয় তাৎপর্য সম্বন্ধে জ্ঞাত হয় এবং স্বর্গ রাজ্যের গুপ্ত বৈচিত্রের আবিষ্কার হয়। এই স্বর্গীয় বুদ্ধিবৃত্তি সংক্রান্ত শক্তি হচ্ছে পবিত্র ঐশী প্রকাশসমূহের ও পয়গম্বরত্বের প্রভাত স্থানসমূহের বিশেষ গুণ; এই আলোক রশ্মি ধার্মিকগণের অন্তঃকরণের দর্পনসমূহের উপর পতিত হয় এবং এই শক্তির এক ভাগ ও এক অংশ পবিত্র ঐশী প্রকাশগণের মাধ্যমে তাঁদের কাছে আাগমন করে।

পবিত্র ঐশী প্রকাশগণের তিনটি অবস্থা আছে। একটি শারীরিক অবস্থা; একটি বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন আত্মার অবস্থা; এবং একটি পরোৎকর্ষের ও রাজকীয় দীপ্তির অবস্থা। দেহ শারীরিক জগতে এর যোগ্যতার ধাপ বা পরিমাণ অনুসারে বস্তুসমূহ হৃদয়ঙ্গম করে অতএব নির্দিষ্ট বিষয়ে এটা শারীরিক দুর্বলতা প্রকাশ করে। উদাহরণস্বরূপ “আমি ঘুমন্ত ও অচেতন ছিলাম, আল্লাহর মৃদুমন্দ সমীরণ আমার উপর দিয়া প্রভাহিত হইল এবং আমাকে জাগ্রত করিল এবং এই বাণী ঘোষণার জন্য আমাকে আদেশ করিল।”অথবা যখন ত্রিশ (৩০) বছরে যীশখ্রিষ্টকে দীক্ষা দেওয়া হল এবং পবিত্র আত্মা তাঁর উপর অবতরণ করলো; পবিত্র আত্মা তাঁর উপর অবতরণ করে, এর পূর্বে উক্ত পবিত্র আত্মা তাঁর মধ্যে প্রকাশিত হয় নাই। এই সমস্ত জিনিস ঐশী প্রকাশদের দৈহিক অবস্থা নির্দেশ করে, কিন্তু তাদের স্বর্গীয় অবস্থা সমগ্র বস্তুকে বেষ্টন করে, সমস্ত রহস্যাবলী জ্ঞাত হয়, সমুদয় নিদর্শনাবলী আবিষ্কার করে এবং সমস্ত বস্তুর উপর আধিপত্য, পূর্বে এবং তাঁদের দৌত কর্মের পরেও ঐ একই ব্যাপার। এই জন্যই যীশুখ্রিষ্ট বলেছেন, “আমিই আদি, আমিই অন্ত, প্রথম ও শেষ।” অর্থাৎ পূর্বে কখনও এবং ভবিষ্যতেই আমার মধ্যে কোন পরিবর্তন হবে না।

38
আল্লাহ সম্বন্ধে মানুষের জ্ঞান

প্রশ্ন: মানুষের ধীশক্তি কি পরিমাণে আল্লাহকে হৃদয়ঙ্গম করতে পারে?

উত্তর: এই বিষয়ে বহু সময়ের প্রয়োজন এবং খাবার টেবিলে বসে এইভাবে এর ব্যাখ্যা করাও সহজ নয়, তবুও এ বিষয়ে আমরা সংক্ষেপে বক্তব্য রাখব।

জেনে রাখ যে, দুই প্রকারের জ্ঞান বিদ্যমান, বস্তুর অস্তিত্ব বা উপাদান সম্বন্ধে জ্ঞান এবং এর গুণাবলীর জ্ঞান। কোন বস্তুর উপাদান তার গুণাবলীর মাধ্যমে জানা যায় অন্যথায় এটা অজ্ঞাত ও গুপ্ত থাকে।

যেহেতু বস্তুসমূহ সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান- এমনকি সৃষ্ট ও সীমাবদ্ধ বস্তুসমূহেরও জ্ঞান হচ্ছে বস্তুসমূহের গুণাবলী সম্বন্ধে জ্ঞান উপাদানের নয়, সেহেতু কেমন করে স্বর্গীয় বাস্তবতাকে (প্রকৃত সত্ত্বা) এর উপাদানে তথা এর অস্তিত্বে হৃদয়ঙ্গম করা সম্ভব? যে স্বর্গীয় বাস্তবতা সীমাহীন তথা অসীম? কারণ যে কোন বস্তুর উপাদানের তথা অস্তিত্বের সারৎসার হৃদয়ঙ্গম করা যায় না শুধুমাত্র তার গুণাবলী ছাড়া। উদাহরণস্বরূপ সূর্যের সারবস্তু অজ্ঞাত কিন্তু এর গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্যের দ্বারা জানা যায় যে বৈশিষ্ট্য হচ্ছে উত্তাপ ও আলো। মানুষের উপাদানের সারবস্তু অজ্ঞাত এবং সুস্পষ্ট নয়, কিন্তু এর বৈশিষ্ট্যসমূহের দ্বারা এটাকে চিহ্নিত করা ও জানা যায়। এমতে প্রত্যেক বস্তুই এর গুণাবলী বা বৈশিষ্ট্যসমূহের দ্বারা জানা যায়, কিন্তু এর সারবস্তু দ্বারা নয়। যদিও মন সমুদয় বস্তুবে বেষ্টন করে এবং মন বাহ্য অস্তিত্বসমূহ নিজের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত করে, তবুও এই সমস্ত অস্তিত্বের সারবস্তু মনের কাছে অজ্ঞাত থাকে; অস্তিত্বগুলির শুধুমাত্র গুণাবলী বা বৈশিষ্ট্য দ্বারাই এগুলিকে জানা যায়।

তাহলে কেমন করে শাশ্বত চিরস্থায়ী পরম প্রভুকে, যিনি বোধ শক্তি ও চিন্তাশক্তি থেকে পূত পবিত্র, তাঁর অস্তিত্বের সারৎসার দ্বারা জানা যাবে? অর্থাৎ বস্তুসমূহের শুধুমাত্র গুণাবলী তথা বৈশিষ্ট্যসমূহের দ্বারা যদি বস্তুকে জানা যায় বস্তুর সারৎসার দ্বারা নয়- তাহলে এটা নিশ্চিত যে, স্বর্গীয় বাস্তবতার (প্রকৃত সত্ত্বা) অস্তিত্ব তথা সারৎসার সম্বন্ধে জানা যেতে পারে না, তবে এর গুণাবলী তথা বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে জানা যায়। অধিকন্তু কেমন করে প্রপঞ্চময় (ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু সম্বন্ধীয়) বাস্তবতা (বস্তা সত্ত্বা) পূর্ব থেকে অস্তিত্ববান বাস্তবতাকে অনুধাবন করতে পারে? কারণ বোধশক্তি হচ্ছে বেষ্টনের অপরিহর্যিরূপে অন্তর্ভূক্তির বোধশক্তির আওতাধীন বস্তুর ফল এবং একত্বের সারৎসার সর্ব বস্তুতে বেষ্টন করে এবং বেষ্টিত হয় না।

অস্তিত্ব জগতে অবস্থাসমূহের পার্থক্য ও বোধশক্তির একটা প্রতিবন্ধক। উদাহরণস্বরূপ এই খনিজ দ্রব্য খনিজ জগতের অন্তর্ভূক্ত; এটা যতই উন্নতি করুক না কেন, এটা কখনই বৃদ্ধির শক্তি সম্বন্ধে হৃদয়ঙ্গম করতে পারে না। উদ্ভিগগুলি, বৃক্ষরাজি যতই উন্নতি করুক না কেন, এরা দৃষ্টি শক্তি বা অন্যান্য ইন্দ্রিয়ানুভূতির কল্পনা করতে পারে না এবং ইতর প্রাণী মানুষের অবস্থা কল্পনা করতে পারে না, অর্থাৎ তার আধ্যাত্মিক শক্তি কল্পনা করতে পারে না। অবস্থার পার্থক্য, জ্ঞানের প্রতিবন্ধকস্বরূপ হয়ে দাঁড়ায়; অকিঞ্চিতকর তথা নিকৃষ্টতম উৎকৃষ্ট পরিমাণকে হৃদয়ঙ্গম করতে পারে না। তাহলে কেমন করে প্রপঞ্চ তথা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু সম্বন্ধীয় বাস্তবতা (প্রকৃত সত্ত্বা) পূর্ব থেকে অস্তিত্ববান বাস্তবতাকে হৃদয়ঙ্গম করতে পারে? আল্লাহ্কে জানা অর্থ তাঁর গুণাবলী তথা বৈশিষ্ট্যসমূহের জ্ঞান থাকা বুঝায় কিন্তু তাই বলে তার বাস্তবতার (প্রকৃত সত্ত্বা) জ্ঞান সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা বুঝ্যায় না। গুণাবলীর জ্ঞান মানুষের ধারণক্ষমতা ও শক্তির সমানুপাতিক হয়ে থাকে; সম্পূর্ণ বা অবিমিশ্র নয়। মানুষের ধারণ ক্ষমতা ও শক্তি অনুযায়ী বস্তুসমূহ যেভাবে বিদ্যমান আছে সেইভাবে বাস্তবতার অনুধাবনের মধ্যে দর্শন নিহিত। কারণ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু সম্বন্ধীয় বাস্তবতা, শুধুমাত্র মনুষ্য ধারণ ক্ষমতার পরিমাণানুযায়ী, পূর্ব থেকে অস্তিত্বাবন গুণাবলী তথা বৈশিষ্ট্যসমূহ হৃদয়ঙ্গম করতে পারে। খোদাইত্বের (ঈশ্বরত্বের) গুপ্ত রহস্য অস্তিত্ববান কোন কিছুর বোধ শক্তির আওতা থেকে পূত পবিত্র, কারণ যা কিছু কল্পনায় আসে সেটা হচ্ছে মানুষ যা বুঝে ওঠে তাই এবং মানুষের বুঝ শক্তি স্বর্গীয় সারৎসারের বাস্তবতা তার মনো মধ্যে ধারণ প্রেরণ করতে পারে না। মানুষ যা কিছু হৃদয়ঙ্গম করতে সক্ষম তা হচ্ছে খোদাইত্বের গুণাবলী, যার দীপ্তি আত্মা জগতে আবির্ভূত ও দৃশ্যমান হয়।

যখন আমরা জগতসমূহ ও আত্ম,াসমূহের দিকে তাকাই, তখন আমরা স্বর্গীয় পরোৎকর্ষতাসমূহের বিস্ময়কর নিদর্শনাবলী দেখি যে পরোৎকর্ষতাসমূহ সুস্পষ্ট ও আপাত প্রতীয়মান; বস্তুসমূহের বাস্তবতা, সার্বজনীন বাস্তবতা প্রমাণ করে। খোদাইত্বের বাস্তবতা সূর্যের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে, যে সূর্য তার অপরিমেয় উচ্চতা থেকে সমুদয় দিগন্তের উপর কিরণ বর্ষণ করে এবং প্রতিটি দিগন্ত এবং প্রত্যেক আত্মা তার (সূর্যের) দীপ্তিতে অংশগ্রহণ করে। যদি এই আলো এবং এই রশ্মিগুলি না থাকতো কোন কিছুর অস্তিত্ব থাকতো না। সমস্ত অস্তিত্ব কিছু ভাষায় ব্যক্ত করে এবং এই আলোর কিছু রশ্মি ও অংশ গ্রহণ করে। আল্লাহ্র পরোকর্ষসমূহ, বদান্যতাসমূহ ও গুণ বৈশিষ্ট্যসমূহের দীপ্তি পূর্ণ মানবের বাস্তবতা থেকে কিরণ বর্ষণ করে ও দীপ্তি পায় অর্থাৎ অসামান্য পুরুষ তথা আল্লাহর সার্বজনীন প্রকাশ থেকে কিরণ বর্ষণ করে ও দীপ্তি পায়। অন্যান্য অস্তিত্বসমূহ শুধুমাত্র রশ্মি পায়, কিন্তু সার্বজনীন ঐশী প্রকাশ হচ্ছে এই সূর্যের দর্পন, যে সূর্য তার সমস্ত পরোৎকর্ষ, গুণাবলী, নিদর্শন ও বিস্ময়কর বস্তুসমূহ সহকারে এই দর্পনে আবির্ভূত ও সুস্পষ্ট হয়।

খোদাইত্বের প্রকৃত সত্ত্বা সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ অসম্ভব ও দুর্লভ, কিন্তু আল্লাহ্র প্রকাশগণের (বার্তাবাহকদের) সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ হচ্ছে আল্লাহ সম্বন্ধে জ্ঞান লাভের তুল্য, কারণ বদান্যতা, দীপ্তি ও স্বর্গীয় গুণাবলী তাদের মধ্যে সুস্পষ্ট। অতএব মানুষ যদি ঐশী প্রকাশগণের সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করে, তাহলে সে আল্লাহ্ সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করবে; এবং যদি সে পবিত্র ঐশী প্রকাশের জ্ঞান লাভে অমনোযোগী হয়, তাহলে আল্লাহ্ সম্বন্ধে জ্ঞান থেকে সে বঞ্চিত হবে। তাহলে এটা নিরূপিত ও প্রমাণিত হল যে, পবিত্র ঐশী প্রকাশগণ হচ্ছেন আল্লাহ্র বদান্যতা, নিদর্শন ও পরোৎকর্ষসমূহের কেন্দ্র। আশীর্বাদপুষ্ট তারাই যারা কৃষ্টি সম্পন্ন প্রভাত বিন্দুসমূহ থেকে স্বর্গীয় বদান্যতাসমূহের আলো গ্রহণ করে।

আমরা আশা করি যে, আকর্ষণীয় শক্তির মত আল্লাহর বন্ধুগণ স্বয়ং উৎস থেকেই এই বদান্যতাগুলি গ্রহণ করবেন এবং তারা এরূপ উজ্জ্বলতা ও নিদর্শনাবলীর সঙ্গে গাত্রোত্থান করবেন যে তাঁরা বাস্তবতার সূর্যের সুস্পষ্ট নিদর্শন হবেন।

39
আত্মার অমরত্ব - ১

মানুষের আত্মা জীবিত থাকে, এটা প্রমাণ করবো, আমরা এর অমরত্ম প্রমাণ করবো।

পবিত্র ধর্মগ্রন্থসমূহে আত্মার অমরত্বের কথা উল্লেখ রয়েছে; এটাই স্বর্গীয় ধর্মসমূহের মৌলিক ভিত। এখন দুই প্রকারের শাস্তি ও পুরস্কারের কথা বলা হয়েছে। প্রথমতঃ ইহ জগতের পুরস্কার ও শান্তি, দ্বিতীয়তঃ পর জগতের শান্তি ও পুরস্কার। কিন্তু ইহ জগতে হোক বা আধ্যাত্মিক স্বর্গীয় জগতসমূহের হোক, অস্তিত্বের স্বর্গ ও নরক আল্লাহ্র সমস্ত জগতসমূহ দেখা যায়। এই সমস্ত পুরস্কার লাভ হচ্ছে অনন্ত জীবন প্রাপ্তি বা জীবন লাভ। এই জন্যই যীশুখ্রিষ্ট বলেন, “এমনভাবে কর্ম কর, যাতে তুমি অনন্ত জীবন পেতে পার এবং যাতে তুমি পানি ও আত্মা দ্বারা জন্ম প্রাপ্ত হও, যাতে তুমি স্বর্গ রাজ্যে প্রবেশ করতে পার।”

ইহ জীবনের পুস্কারসমূহ হচ্ছে, পূণ্য ও পরোৎকর্ষসমূহ যা মানুষের বাস্তবতাকে (প্রকৃত সত্ত্বা) সজ্জিত করে। উদাহরণস্বরূপ সে অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল এবং আলোকময় হল, সে অজ্ঞ ছিল এবং বিজ্ঞ হল, সে অমনোযোগী ছিল এবং সতর্ক হল, সে ঘুমন্ত ছিল এবং জাগ্রত হল, সে মৃত ছিল এবং প্রাণবন্ত হল, সে অন্ধ ছিল এবং দর্শক হল, সে বধির ছিল এবং শ্রবণকারী হল, সে সাংসারিক ছিল এবং স্বর্গীয় হল, সে জড়বাদী ছিল এবং আধ্যাত্মিক হল। এই পুরস্কারসমূহের মাধ্যমে সে আধ্যাত্মিক জন্ম লাভ করে এবং নতুন সৃষ্টিতে পরিণত হয়। সে সুসমাচারে (গসপেলে) বর্ণিত এই শ্লোকের প্রকাশ হয়, যেখানে শিশুদের কথা বলা হয়েছে, যে তারা রক্ত থেকে জাত নয়, দৈহিক ইচ্ছার থেকেও জাত নয়Ñ তাঁরা আল্লাহ থেকে জাত; (যোহন ১, ১৩) অর্থাৎ তারা পাশব বৈশিষ্ট্যসমূহ ও পাশব ধর্ম থেকে মুক্ত- যে বৈশিষ্ট্যসমূহ ও ধর্ম হচ্ছে মানব প্রকৃতির বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলী এবং এগুলি স্বর্গীয় বৈশিষ্ট্যসমূহ দ্বারা বিশেষিত- যা আল্লাহ্র বদান্যতা; দ্বিতীয় জন্ম প্রাপ্তির অর্থ এটাই। কারণ এরূপ লোকদের পক্ষে আল্লাহ থেকে পর্দান্তরাল হওয়া ছাড়া আর কোন বৃহত্তর যন্ত্রণা নেই এবং ইন্দ্রিয় সেবাপরায়ণ পাপসমূহ, অন্ধকারময় বৈশিষ্টসমূহ, স্বভাবের নীচতা ও পার্থিব কামনা বাসনায় নিমগ্ন হওয়া অপেক্ষা আর কোন সাংঘাতিক শাস্তি নেই। যখন তারা এই সমস্ত পাপের অন্ধকার থেকে, বিশ্বাসের আলোর মাধ্যমে মুক্তিপ্রাপ্ত হয় এবং বাস্তবতার সূর্যের দীপ্তিসহ আলোকিত হয় এবং সমস্ত পূণ্য গুণে উদ্ভাসিত হয়, তখন তারা একে বৃহত্তম পুরস্কার বলে মনে করে এবং তারা একে প্রকৃত স্বর্গ বলে বিবেচনা করে। অনুরূপভাবে তারা বিবেচনা করে যে, আধ্যাত্মিক শাস্তি, অর্থাৎ অস্তিত্বের যন্ত্রণা ও শাস্তি হচ্ছে প্রকৃতি জগতের অধীন হওয়া, আল্লাহ্ থেকে পর্দান্তরাল হওয়া, যথা- মিথ্যাচার, অত্যাচার, নিষ্ঠুরতা, জাগতিক কাজকর্মে আসক্তি ও শয়তানী ভাব ধারণায় নিমজ্জিত হওয়া; তাদের পক্ষে এইগুলিই বৃহত্তম শাস্তি ও যন্ত্রণা।

অনুরূপভাবে পর জগতের পুরস্কারসমূহ হচ্ছে শাশ্বত জীবনÑ যে জীবনের কথা সমস্ত পবেত্র ধর্মগ্রন্থে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছেÑ এই সনাতন জীবনই হচ্ছে স্বর্গীয় পরোৎকর্ষ, সনাতন অনুকম্পা ও চিরস্থায়ী সুখ। পর জগতের পুরস্কারসমূহ হচ্ছে ই্হজগত ত্যাগের পর আধ্যাত্মিক জগতসমূহে প্রাপ্ত পরোৎকর্ষতাসমূহ ও শান্তি; পক্ষান্তরে ইহজীবনের পুরস্কার হচ্ছে উজ্জ্বল পরোৎকর্ষসমূহ যা ইহজগতে অর্জিত হয়ে থাকে এবং যা হচ্ছে সনাতন জীবনের কারণ, কারণ এগুলিই হচ্ছে অস্তিত্বের উন্নতি। এটা হচ্ছে সেই ব্যক্তির ন্যায় যে ভ্রæণ জগত থেকে পূর্ণতার অবস্থায় অবস্থান্তর প্রাপ্ত হচ্ছে এবং এই কথাগুলির প্রকাশ হচ্ছে, “স্রষ্টাদের শ্রেষ্ঠতম আল্লাহ্ পবিত্র হউন।”পরজগতের পুরস্কারসমূহ হচ্ছে শান্তি, আধ্যাত্মিক অনুগ্রহ, আল্লাহ্র স্বর্গ রাজ্যে আল্লাহ্র নানাবিধ পুরস্কার, অন্তর ও আত্মার আকাঙ্খার বস্তুসমূহ লাভ এবং অনন্ত জগতে আল্লাহ্র সাক্ষাত প্রাপ্তি। অনুরূপভাবে পর জগতের শাস্তিসমূহ অর্থাৎ পর জগতের যন্ত্রণা হচ্ছে বিশেষ স্বর্গীয় আশীর্বাদ ও দান ও সম্পূর্ণ বদান্যতাসমূহ থেকে বঞ্চিত হওয়ার মধ্যে নিহিত এবং অস্তিত্বের সর্বনিম্ন স্তরে পতিত হওয়া। যে এই সমস্ত স্বর্গীয় অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হয় যদিও সে মৃত্যুর পরেও অস্তিত্বে বহাল থাকে, তবুও সে সত্যের জনমণ্ডলী দ্বারা মৃত বিবেচিত হয়।

আত্মার অমরত্মের যুক্তি সংগত প্রমাণ হচ্ছে এই যে- কোন অস্তিত্ববিহীন বস্তু থেকে কোন নিদর্শন আসে না; অর্থাৎ এটা অসম্ভব যে সম্পূর্ণ অনস্তিত্ব থেকে নিদর্শনাবলী আবির্ভূত বা দৃষ্টিগোচর হবে। কারণ নিদর্শনাবলী হচ্ছে অস্তিত্বের ফল এবং ফল অস্তিত্ব নীতির উপর নির্ভর করে। সুতরাং অস্তিত্ববিহীন একটি সূর্য থেকে কোন আলো বিকীর্ণ হতে পারে না, একটি অস্তিত্ববিহীন সমূদ্র থেকে কোন ঢেউই দৃষ্টিগোচর হতে পারে না, অস্তিত্ববিহীন মেঘ থেকে কোন বৃষ্টিপাত হয় না; অস্তিত্ববিহীন বৃক্ষ কোন ফল দান করে না; অস্তিত্বহীন লোক কোন কিছু প্রকাশ করে না, কোন কেছু উৎপন্নও করে না। অতএব যাবৎ অস্তিত্বের নিদর্শনাবলী দৃষ্টিগোচর হয়, যাবৎ সেইগুলিই একটা প্রমাণ যে নিদর্শনের কর্তা জীবিত।

মনে মনে চিন্তা কর আজ যিশুখ্রিষ্টের ঐশী রাজ্য বিদ্যমান; একটি অস্তিত্ব বিহীন রাজা থেকে কেমনভাবে এরূপ বিরাট রাজ্য প্রকাশিত হতে পারে? কেমন করে একটি অস্তিত্বহীন সমূদ্র থেকে ঊর্মিমালা এত উপরে উঠতে পারে? একটি অস্তিত্বহীন উদ্যান থেকে কেমনভাবে এরূপ সুগন্ধিযুক্ত মৃদু-মন্দ সমীরণ প্রবাহিত হতে পারে? মনে মনে গভীরভাবে তোলপার কর যে খনিজ হউক অথবা উদ্ভিদ হউক অথবা প্রাণী হোক কোন অস্তিত্বের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ছিন্ন-ভিন্ন হওয়ায় ও তার উপাদানসমূহ বিশ্লিষ্ট তথা পচিয়া গলিয়া যাওয়ার পর তার কোন ফল, কোন চিহৃ, কোন প্রভাব থাকে না। শুধু মাত্র মনুষ্য বাস্তবতা (প্রকৃত সত্ত্বা) ও মানব আত্মা, তার অঙ্গ প্রতঙ্গের বিশ্লেষণের পরও তার অণু-পরমাণু ছিন্ন-ভিন্ন ও দেহ গঠন সংযুক্তি ধ্বংস হওয়ার পরও জীবিত থাকে এবং কাজ করতে ও শক্তি পেতে থাকে।

এই প্রশ্ন অতি জটিল, মনোযোগ সহকারে এটা চিন্তা কর। এটাই যুক্তি সংগত প্রামা, যা আমরা দিচ্ছি, যাতে জ্ঞানী গুনীরা এটাকে যুক্তি ও বিচারের মানদণ্ডের ওজন করেন। কিন্তু যদি মানব আত্মা আনন্দসহকারে ঐশী রাজ্যের দিকে আকর্ষিত হয়, যদি অন্তর্দৃষ্টি উন্মুক্ত হয় এবং আধ্যাত্মিক শ্রবণ শক্তি শক্তিশালী হয় এবং আধ্যাত্মিক অনুভূতিসমূহ প্রবল হয়, তাহলে সে আত্মার অমরত্ব এরূপ সুস্পষ্টভাবে দেখবে, যেমন সে সূর্যকে দেখে থাকে এবং আল্লাহ্র সুসমাচারসমূহ ও নির্দশনাবলী তাকে বেষ্টন করবে।

আগামীকল্য আমরা অন্যান্য প্রমাণ দেব।

40
আত্মার অমরত্ম- ২

গতকাল আমরা আত্মার অমরত্ম নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। জেনে রাখ যে, মানব আত্মার শক্তি ও বোধ শক্তি দুই প্রকারের; অর্থাৎ আত্মার শক্তি ও বোধ শক্তি দুইটি ভিন্ন ধরণে কাজ করে ও উপলব্ধি করে। একটি হচ্ছে দেহ যন্ত্রের মাধ্যমে; এমতে এই চক্ষু দ্বারা সে দর্শন করে এই কর্ণ দ্বারা সে শ্রবণ করে, এই রসনা দ্বারা সে কথা বলে। দেহ যন্ত্রের সাহায্যে এইরূপই হচ্ছে আত্মার কাজ ও মানুষের বাস্তবতার উপলব্ধি। অর্থাৎ আত্মার চক্ষুর মাধ্যমে দর্শনকারী; আত্মা কর্ণের মাধ্যমে শ্রবণকারী; আত্মা রসনার মাধ্যমে বক্তা।

দেহ যন্ত্র ছাড়াও আতদ্মার শক্তিসমূহের ও কার্যাবলীর অন্যান্য প্রকাশ বিদ্যমান। উদাহরণস্বরূপ নিদ্রিতাবস্থায় চক্ষু ব্যতীরেকে সে দর্শন করে, কর্ণ ব্যতীত সে শ্রবণ করে, রসনা ব্যতীত সে কথা বলে, চরণ ব্যতীত সে দৌড়ায়। সংক্ষেপে অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ও দেহ যন্ত্রের সাহায্য ছাড়াই সে এই সমস্ত কার্য সাধন করে। কতবারই না এইরূপ ঘটে যে, সে নিদ্রা জগতে স্বপ্ন দেখে এবং দুই বছর পর অনুরূপ ঘটনাবলীতে উক্ত স্বপ্নের তাৎপর্য সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে অনুরূপভাবে কতবারই না এইরূপ ঘটে যে, কোন লোক জাগ্রতবস্থায় যে প্রশ্নর সমাধান করতে পারে না, স্বপ্নসমূহের জগতে সে তার সমাধানপ্রাপ্ত হয়। জাগ্রতাবস্থায় চক্ষুমাত্র অল্প দূরত্ব দৃষ্টিসীমায় আনতে পারে, কিন্তু প্রাচ্য দেশের নিদ্রিত ব্যক্তি স্বপ্নে প্রাচ্য দেশ দর্শন করে; জাগ্রতবস্থায় সে বর্তমান দর্শন করে, কিন্তু নিদ্রায় সে ভবিষ্যত দর্শন করে। জাগ্রতবস্থায় দ্রুত সে বড়জোড় ঘণ্টায় একশত বিশ কিলোমিটার ভ্রমণ করতে পারে, নিদ্রায় চোখর নিমিষে সে পূর্ব ও পশ্চিম ভ্রমণ করে। কারণ আত্মা দুই বিভিন্ন উপায়ে ভ্রমণ করে; কোন কিছুর সাহায্য ব্যতিরেকে যা হচ্ছে আধ্যাত্মিক ভ্রমণ এবং কোন কিছুর সাহায্যে, যা হচ্ছে জড় ভ্রমণ তথা পার্থিব ভ্রমণ; যা পাখিরা ওড়ে এবং যেগুলি বয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।

ঘুমের সময় এই দেহ মৃতবৎ; এটা দেখেও না, শোনেও না, অনুভবও করে না, এর কোন চেতনা নেই, কোন অনুভ‚তি নেই; অর্থাৎ মানুষের সমস্ত শক্তি অকেজো হয়ে পড়ে, কিন্তু আত্মা সক্রিয় থাকে। শুধু তাই নয় এর সু²তা বৃদ্ধি পায়, এর উড্ডয়ণ উচ্চতর হয় এবং এর বুদ্ধিমত্তা প্রখরতর হয়। দেহের মৃত্যুর পর আত্মা বিনাশপ্রাপ্ত হয়- এই কথা বিবেচনা করা- কোন খাঁচার মধ্যে অবস্থিত পাখিরা খাঁচা ভেঙ্গে গেলে পাখির বিনাশ প্রাপ্তির কল্পনা করার সমান- যদিও খাঁচার বিনাশপ্রাপ্তিতে পাখির ভয় করার কিছু নেই। আমাদের দেহ খাঁচা সদৃশ এবং আত্মা পাখি তুল্য। আমরা দেখি যে, খাঁচা ব্যতীত এই পাখি নিদ্রা জগতে উড়ে যায়; অতএব যতি অত্র খাঁচা ভেঙ্গে যায়, পাখিটি অস্তিত্বে বহাল থাকবে ও বেঁচে থাকবে; এর অনুভূতিসমূহ অধিকতর শীক্তশালী হবে; এর উপলব্ধি জ্ঞান আরো বৃদ্ধি পাবে এবং এর সুখও বৃদ্ধি পাবে। বস্তুতঃ নরক থেকে এটা আনন্দের স্বর্গে পোঁছায়, কারণ কৃতজ্ঞ পক্ষীসমূহের পক্ষে, খাঁচা থেকে মুক্ত হওয়া অপেক্ষা বৃহত্তর কোন স্বর্গ নেই, এই কারণে পরমানন্দ ও পরম সুখ সহকারে শহীদগণ আত্মবলীদানের ভূমির দিকে তরান্বিত করে তথা ধাবমান হয়।

জাগ্রতাবস্থায় মানব চক্ষু বড়জোড় এক ঘণ্টার দূরত্বের বস্তু দেখতে পায়, কারণ দেহের কর্তৃত্বের মাধ্যমে আত্মার শক্তি এইভাবে নির্ধারিত হয়; কিন্তু অন্তর তথা মানব চক্ষু দ্বারা সে আমেরিকা দেখে এবং যা কিছু সেখানে আছে তা উপলব্ধি করতে পারে এবং বিষয় বস্তুসমূহের অবস্থা আবিষ্কতার করে এবং সাধারণ কাজ কর্মের সংগঠন করে। তখন যদি আত্মা দেহের মত একই হত, তাহলে এটা অপরিহার্য হয়ে দাড়াত যে আভ্যন্তরীক দৃষ্টির শক্তিকেও সমানুপাতিক হতে হত।অতএব এটা সুস্পষ্ট যে এই আত্মা দেহ থেকে পৃথক এবং পাখি খাঁচা থেকে পৃথক এবং আত্মার শক্তি বিচক্ষণতা দেহের মাধ্যম ব্যতিরেকে অধিকতর শক্তিশালী। এখন যদি যন্ত্র তথা মাধ্যম পরিত্যক্ত হয় তবে যন্ত্র বা মালিক কাজ করতে থাকে, উদাহরণস্বরূপ যদি লেখনী তথা কলম পরিত্যক্ত হয় অথবা ভেঙ্গে যায়, তবুও লেখক জীবন্ত ও বিদ্যমান থাকে; যদি গৃহ ধ্বংস প্রাপ্ত হয় গৃহস্বামী জীবিত ও বিদ্যমান থাকে। আত্মার অমরত্মের প্রমাণগুলির মধ্যে এটা একটি যুক্তি সংগত প্রমাণ।

এছাড়াও অন্য প্রমাণ বিদ্যমান; এই দেহ দুর্বল অথবা ভারী অথবা রুগ্ন অথবা স্বাস্থবান হয়; এই দেহ ক্লান্ত অথবা প্রশান্ত হয় কখন কখন হাত অথবা পা কর্তিত হয় অথবা শারীরিক শক্তি রহিত হয়ে যায়; অন্ধ অথবা বধির অথবা বোবা হয় এর অঙ্গ প্রত্যঙ্গ পক্ষাঘাতগ্রস্ত হতে পারে; সংক্ষেপে দেহ সমস্ত রকমের অর্পূণতা লাভ করতে পারে। এতদসত্ত্বেও আত্মা তার মৌলিক অবস্থায় তার নিজের আধ্যাত্মিক উপলব্ধিতে শাশ্বত ও চিরস্থায়ী থাকবে।

এটার (আত্মার) অঙ্গহানীও হবে না, এটা পঙ্গুও হবে না কিন্তু দেহ যখন সম্পূর্ণরূপে রোগ ও দুঃখ দৈন্যের অধীন হয়ে পড়ে, তখন এটা আত্মার বদান্যতা থেকে বঞ্চিত হয়; দর্পনের ন্যায় এটা যখন ভেঙ্গে যায় ধুলী মলিন হয়, তখন এটা সূর্যের রশ্মিসমূহ প্রতিফলিত করতে পারে না, সূর্যের বদান্যতাও প্রদর্শন করতে পারে না।

আমরা ইতিপূর্বেই ব্যাখ্যা করেছি যে, মানব আত্মা শরীরে নিহিত নয়, কারণ এটা প্রবেশ ও প্রস্থান থেকে মুক্ত ও পবিত্রকৃত- যে প্রবেশ ও প্রস্থান হচ্ছে শারীরিক অবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। দেহের সঙ্গে আত্মার সম্পর্ক হচ্ছে দর্পনের সঙ্গে সূর্যের সম্পর্ক তুল্য। সংক্ষেপে মানবাত্মা একক অবস্থায় বিদ্যমান, এটা দেহের রোগসমূহ থেকে পীড়িতও হয় না, এর স্বাস্থের দ্বারা আরোগ্য প্রাপ্তও হয় না; এটা রুগ্নও হয় না, দুর্বলও হয় না, নিঃস্বও হয় না, দরিদ্রও হয় না, হালকাও হয় না, ক্ষুদ্রও হয় না অর্থাৎ দৈহিক দৌর্বলের কারণে এটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না এবং কোন ফল বা প্রভাবই দেখা যাবে নাÑ এমনকি যদি দেহ দুর্বল অথবা হস্ত, পদ ও রসনা কর্তিত হয় অথবা যদি এটা দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবণ শক্তি হারিয়ে ফেলে। অতএব এটা সুস্পষ্ট ও সুনিশ্চিত যে, আত্মা দেহ থেকে স্বাধীন এক সত্ত্বা এবং এর স্থায়ীত্ব দেহের স্থায়ীত্ব থেকে স্বাধীন তথা মুক্ত; পক্ষান্তরে আত্মা সর্বাপেক্ষা মহত্ব বিরাটত্ব সহকারে দেহ জগতে শাসন করে এবং দর্পনে সূর্যের বদান্যতার ন্যায় এর শক্তি ও প্রভাব সুস্পষ্ট ও বিদ্যমান। কিন্তু দপূন যখন ধুলিময় হয়ে পড়ে ও ভেঙ্গে যায় তখন এটা সূর্য রশ্মিসমূহ প্রতিফলিত করা থেকে ক্ষান্ত হয়।

41
পরোৎকর্ষসমূহ সীমাহীন

জেনে রাখ যে অস্তিত্বের অবস্থাসমূহ (শর্তসমূহ) ক্রীতদাসত্বের, পয়গম্বরত্বের এবং খোদাইত্বের (ঈশ্বরত্বের) অবস্থায় সীমাবদ্ধ; কিন্তু স্বর্গীয় ও সাপেক্ষ তথা সম্ভাব্য পরোৎকর্ষসমূহ সীমাহীন। যখন তুমি গভীরভাবে চিন্তা করবে তুমি তেখবে যে, বাহ্যতঃ ও অস্তিত্বের পরোৎকর্ষসমূহ অসীম, কারণ তুমি কোন অস্তিত্ব (বস্তু) এমন নিখুঁত দেখতে পাও না যে, তার থেকে উৎকৃষ্টতর আর কিছু কল্পনা করতে পার না। উদাহরণস্বরূপ খনিজ রাজ্যে তুমি একটি পদ্মরাগ মণি উদ্ভিদ রাজ্যে একটি গোলাপ ফুল, অথবা প্রাণী রাজ্যে একটি বুলবুল পক্ষী দর্শন করে এরূপ কল্পনা করতে পার না, যে, এর অপেক্ষা উত্তম নমুনা নেই। স্বর্গীয় বদান্যতাসমূহ যেরূপ অসীম, মনুষ্য পরোৎকর্ষসমূহ তেমনি অসীম। পূর্ণতা তথা পরোৎকর্ষের একটা সীমায় যদি পোঁছানো সম্ভব হত, তাহলে অস্তিত্বসমূহের বাস্তবতার (প্রকৃত সত্ত্বা) একটি আল্লাহ থেকে স্বাধীন হওয়ার অবস্থায় পোঁছাতে পারতো এবং সাপেক্ষ তথা সম্ভাব্য (শর্তসূচক) বাস্তবতা শর্ত শূন্য অবস্থা লাভ করতো। কিন্তু প্রত্যেক অস্তিত্বের জন্য এমন একত্রি মাত্র আছে যা সে অতিক্রম করতে পারে না; অর্থাৎ যে ক্রীতদাসত্বের অবস্থায় আছে, সীমাহীন পরোৎকর্ষসমূহ অর্জন যতই উন্নতি করুক না কেন, সে কখনাই খোদাইত্বের (ঈশ্বরত্বের) অবস্থায় পৌঁছাবে না। অন্যান্য অস্তিত্বসমূহের ঐ একই অবস্থা; একটি খনিজ পদার্থ, উদ্ভিদ রাজ্যে যতদূরই উন্নতি করুক না কেন, এটা উদ্ভিদ শক্তি লাভ করতে পারে না; উদ্ভিদ রাজ্যে যতদূরই উন্নতি করুক না কেন, একটি ফুলের মধ্যে ইন্দ্রয়সমূহের কোন শক্তি আবিভর্‚ত হবে না। সুতরাং এই রৌপ্য খনিজ শ্রবণ শক্তি অথবা দৃষ্টি শক্তি লাভ করতে পারে না; এটা শুধু এর নিজের অবস্থায় উন্নতি করতে পারে এবং এটা একটি পূর্ণাঙ্গ খনিজ পদার্থে পরিণত হতে পারে, কিন্তু এটা বৃদ্ধি লাভের শক্তি অর্জন করতে অথবা সংবেদনশীলতার শক্তি অথবা জীবনী শক্তি অর্জন করতে পারে না; এটা শুধু এর অবস্থার মধ্যে উন্নতি করতে পারবে।

উদাহরণস্বরূপ পিটার কখনো যিশু খ্রিষ্ট হতে পারে না। সে যা কিছু করতে পারে সেটা হচ্ছে ত্রীতদাসত্বের অবস্থা সে সীমাহীন পূর্ণতা লাভ করতে পারে; কারণ প্রত্যেক জীবিত অস্তিত্ব উন্নতি করতে সমর্থ। যেমন মানব আত্মার এই জড় আকৃতি পরিত্যাগের পর চিরস্থায়ী জীবন আছে, তাহলে নিশ্চিতই যে কোন জীবিত অস্তিত্ব উন্নতি করতে সমর্থ; অতএব কোন লোকের মৃত্যুর পর তার উন্নতি, ক্ষমা, দয়া,. অনুগ্রহ ও আশীর্বাদ প্রার্থনা করা অনুমোদনীয়, কারণ অস্তিত্ব উন্নতি করতে সমর্থ । এই জন্যই যারা মারা গিয়াছে, তাদের জন্য বাহা’উল্লাহ্র প্রার্থনাসমূহে ক্ষমা ও পাপসমূহ থেকে মুক্তির প্রার্থনা করা হয়ে থাকে। অধিকন্তু ইহ জগতেও লোকের যেমন আল্লাহর প্রয়োজন হয়, তেমনি পর জগতেও তাদের আল্লাহর প্রয়োজন হবে। সৃষ্ট প্রাণীকুল সর্বদাই অভাবগ্রস্ত এবং ইহজগতে হোক আর পরজগতে হোক আল্লাহ সম্পূর্ণরূপে স্বাধীন।

পরজগতের ধন সম্পদ হচ্ছে আল্লাহ্র নৈকট্য। অতএব এটা নিশ্চিত যে, যারা স্বর্গীয় প্রাঙ্গণের নিকটে, তাদের মধ্যস্থতা তথা কারুর পক্ষ সমর্থন করতে দেওয়া হয় এবং এই মধ্যস্থতা তথা পক্ষ সমর্থন আল্লাহ্ কর্তৃক অনুমোদিত। কিন্তু পরজগতে মধ্যস্থতা ইহজগতে মধ্যস্থতার মত নয়; এটা এমন এক ব্যাপার, এমর এক বাস্তবতা, যা ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না।

মৃত্যুর সময় যদি কোন ধনবান ব্যক্তি গরীব দুঃখীদের কোন দানপত্র সম্পাদন করে যান এবং তার ধন সম্পদ থেকে তাদের জন্য একটা অংশ খরচের জন্য দেন তাহলে হয়তো এই কাজ তার ক্ষমা ও মুক্তি ও স্বর্গরাজ্যে তার উন্নতির কারণ হতে পারে।

মাতা-পিতা ও তাদের সন্তানদের জন্য বৃহত্তম দুঃখ কষ্ট সহ্য করে থাকেন এবং প্রায়ই ছেলে মেয়েরা যখন পূর্ণ বয়স প্রাপ্ত হয়, মাতা পিতা তখন পরোলোক গমন করেন। কদাচিৎ এরূপ ঘটে যে, মাতা পিতা তাদের ছেলে মেয়েদের জন্য যে তত্ত¡াবধানের ধকল ও কষ্ট সহ্য করে থাকেন তার পুরষ্কার ইহজগতে পেয়ে তাকেন। অতএব এই তত্ত্বাবধান ও কষ্টের প্রতিদানে ছেলে মেয়েরা দান ও পরোপকারীতার আশ্রয়ে তাদের পিতা মাতার মুক্তি ও ক্ষমার জন্য অনুনয় বিনয় করবে। সুতরাং তোমার পিতা কর্তৃক তোমার প্রতি স্নেহ ও দয়া প্রদর্শনের বিনিময়ে তোমাকে অবশ্যই তার খাতিরে গরীবদের দান করতে হবে এবং পরম আনুগত্য ও বিনয় সহকারে পাপ মুক্তির জন্য ক্ষমা ভিক্ষা ও সর্বোচ্চ অনুগ্রহ প্রার্থনা করতে হবে।

এমনকি এটাও সম্ভব যে, যারা পাপ ও অবিশ্বাসের মধ্যে মৃত্যুবরণ করেছে, তাদের অবস্থাও পরিবর্তিত হতে পারে; অর্থাৎ তারা আল্লাহর বদান্যতার মাধ্যমে ক্ষমার পাত্র হতে পারেন- ন্যায় বিচারের মাধ্যমে নয়; কারণ দোষ-গুণের বিচার না করে অনুকম্পা দেখানো হয়ে থাকে এবং ন্যায় বিচার হচ্ছে বিচারের মাধ্যমে উপযুক্ত পাওনা দান করা। এখানে এমন এই সমস্ত আত্মার জন্য আমাদের প্রার্থনা করার ক্ষমতা আছে, অনুরূপভাবে পরজগতে আমরা ঐ একই শক্তির অধিকারী হব- যে পরজগত হচ্ছে ঐশী রাজ্য। সেই জগতেও কি জনমণ্ডলী আল্লাহর সৃষ্ট জীব নয়? অতএব সেই জগতেও তারা উন্নতি করতে পারে। এখানে যেমন তারা অনুনয় বিনয়মূলক প্রার্থনার দ্বারা আলো পেতে পারে, সেখানেও তারা ক্ষমা প্রার্থনা করতে পারে এবং অনুনয় বিনয়ের মাধ্যমে আলো পেতে পারে। এমতে সাধু ব্যক্তিদের অনুনয় বিনয়মূলক আবেদন, অনুরোধ ও প্রার্থনাসমূহের সাহায্যের ম্যাধমে যেমন আত্মাসমূহ উন্নতি লাভ করতে পারে; মৃত্যুর পরও এই একই ব্যাপার। তাদের নিজের অনুনয় বিনয়মূলক আবেদন ও প্রার্থনার মাধ্যমেও তারা উন্নতি করতে পারে; বিশেষভাবে যখন তারা ঐশী প্রকাশগণের (বার্তাবাহকদের) মধ্যস্থতার পাত্র হয়।

42
পরজগতে মানুষের ক্রমবিকাশ

জেনে রাখ যে, জীবিত কোন কিছুই বিশ্রাম অবস্থায় থাকে না, অর্থাৎ সমস্ত জীব বস্তুই গতিশীল থাকে। প্রত্যেক জিনিসই হয় বৃদ্ধি প্রাপ্ত হচ্ছে, অথবা কমে যাচ্ছে, প্রত্যেক বস্তুই হয় অস্তিত্ব বিহীন থেকে অস্তিত্বে ফিরে আসছে অথবা অস্তিত্ব থেকে অনস্তিত্বে যাচ্ছে। সুতরাং এই পুষ্পটি, এই কচুরিপানাটি, কিছু সময়ের জন্য অনস্তিত্ব জগত থেকে অস্তিত্ব জগতে এসেছিল এবং এখন অস্তিত্ব থেকে অনস্তিতে প্রবেশ করছে। গতির এই অবস্থা অত্যাবশ্যক বলে কথিত অর্থাৎ স্বাভাবিক অস্তিত্বসমূহ থেকে এটাকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না, কারণ এটা তাদের অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজন; যেমন অগ্নি অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজন হচ্ছে প্রজ্বলিত হওয়া।

এমতে এটা প্রতিষ্ঠিত হর যে, এই গতি অস্তিত্বের পক্ষে অপরিহার্য যে অস্তিত্ব হয় বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হচ্ছে অথবা বিনাশপ্রাপ্ত হচ্ছে। এখন আত্মা যেমন মৃত্যুর পর জীবিত থাকে, তেমনি অপরিহার্যরূপে এটা উন্নতি করে অথবা অধঃপতিত হয় এবং পরজগতে উন্নতি করতে ক্ষান্ত হওয়া অধঃপতনেরই সমান। কিন্তু আত্মা তার নিজের অবস্থা কখনো ত্যাগ করে না, সে তার অবস্থায় উন্নতি করতে থাকে। উদাহরণস্বরূপ পিটারের আত্মার বাস্তবতা (প্রকৃত সত্ত্বা) যতদূরই উন্নতি করুক না কেন, কখনো যীশুখ্রিষ্টের বাস্তবতার অবস্থায় পৌঁছাতে পারবে না, আত্মা শুধুমাত্র এর নিজের পরিবেশের উন্নতি করে। এই খনিজ পদার্থটির দিকে দৃষ্টিপাত কর, যতদূরই এটা বিকশিত হোক না কেন, এটা শুধু এর নিজের অবস্থায় বিকশিত হবে; স্ফটিক খণ্ডকে তুমি দৃষ্টিশক্তি প্রাপ্তির অবস্থায় আনতে পার না, এটা অসম্ভব। সুতরাং যে চন্দ্র আকাশে অবস্থান করছে, যতই এটা বিকশিত হোক না কেন, এটা কখনোই দীপ্তিশীল সূর্যে পরিণত হতে পারবে না; কিন্তু তার নিজস্ব অবস্থার মধ্যে, তার পৃথিবীর সবচেয়ে নিকটবর্তী কক্ষের বিন্দু আছে। শিষ্যগণ যতই উন্নতি করুক না কেন, তারা কখনই যীশুখ্রিষ্ট হতে পারে না। এটা সত্য যে কয়লা হীরায় পরিণত হতে পারে, কিন্তু উভয়েই খনিজ অবস্থার মধ্যে এবং তাদের আঙ্গীক উপাদানসমূহ একই।

43
মৃত্যুর পর মানুষের অবস্থা ও উন্নতি

দর্শনকারী দৃষ্টি সহকারে যখন আমরা অস্তিত্বসমূহের বিষয় বিবেচনা করি তখন আমরা লক্ষ্য করি যে সেগুলি তিন প্রকারে সীমাবদ্ধ; অর্থাৎ সেগুলি মোটামুটি হয় খনিজ, উদ্ভিদ অথবা প্রাণী; এই তিন প্রকারের প্রত্যেকের প্রজাতি আছে। মানুষ হচ্ছে সর্বোচ্চ প্রজাতি, কারণ সে সমস্ত শ্রেণীর পরোৎকর্ষসমূহের অধিকারী, অর্থাৎ তার একটি দেহ আছে যা বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয় এবং অনুভব করে। খনিজ, উদ্ভিদ ও জীবের পরোৎকর্ষসমূহ লাভ করার পর সে একটি বিশেষ উৎকর্ষ তথা গুণের অধিকারী যা অন্যান্য অস্তিত্বসমূহের নেই; অর্থাৎ বুদ্ধিবৃত্তি সংক্রান্ত পূর্ণতাসমূহ আর কোন অস্তিত্বের নেই। অতএব মানুষই হচ্ছে অস্তিত্বসমূহের মধ্যে মহোত্তম।

মানুষ জড়ত্বের সর্বোচ্চ মাত্রায় ও আধ্যাত্মিকতার আরম্ভে অবস্থান করছে; অর্থাৎ সে অসম্পূর্ণতার শেষ এবং পূর্ণতার আরম্ভ বা শুরু। সে অন্ধকার তথা অজ্ঞতার সর্বশেষ সীমায় ও আলোর তথা জ্ঞানের আরম্ভ সীমায় অবস্থান করছে; এই জন্যই বলা হয়েছে যে, মানুষের অবস্থা হচ্ছে নিশার অবসান ও প্রভাতের আরম্ভ, যার অর্থ হচ্ছে সে অপূর্ণতার সমস্ত মাত্রার সমষ্টি এবং পূর্ণতার মাত্রাসমূহের অধিকারী। তার পাশব দিকও আছে, দেবত্বের দিকও আছে; এবং একজন শিক্ষাদাতাকে মানবাত্মাসমূহকে এমনভাবে শিক্ষা দিতে হয়, যাতে তাদের পবিত্র দিক পাশব দিককে পরাভূত করতে পারে। তাহলে মানুষের মধ্যে স্বর্গীয় শক্তি যা হচ্ছে তার অত্যাবশ্যকীয় পূর্ণতা, যদি তা শয়তানী শক্তিকে পরাভূত করে- যে শয়তানী শক্তি হচ্ছে সম্পূর্ণ অসম্পূর্ণতা তাহলে সৃষ্ট জীবদের মধ্যে সে সর্বোৎকৃষ্ট হয়ে ওঠে; কিন্তু যদি শয়তানী শক্তি স্বর্গীয় শক্তিকে পরাভূত করে, তাহলে সে সৃষ্ট জীবদের মধ্যেূ সর্ব নিকৃষ্ট হয়ে যায়। এই জন্যই সে অসম্পূর্ণতার শেষ এবং পূর্ণতার আরম্ভ বা শুরু। অস্তিত্ব জগতের মধ্যে অন্য যে কোন প্রজাতির মধ্যে এইরূপ পার্থক্য, বৈষম্য; অসঙ্গতি নাই যেমন মানুষের প্রজাতিতে রয়েছে। এমতে স্বর্গীয় আলোকের প্রতিফলন মানুষের মধ্যে ছিল, যেমন যিশুখ্রিষ্টের মধ্যে ছিল এবং দেহ তাকে কত ভালবাসা ও সম্মান করা হয় । একই সময় আমরা মানুষকে পাথর অথবা মাটির পিণ্ড, অতবা গাছ পূজা করতে দেখতে পাই; কতই না জঘন্য সে এই বিষয়ে যে, তার পূজার লক্ষ্য বস্তু হচ্ছে সর্বাপেক্ষা নিম্নতম অস্তিত্বশীল বস্তু অর্থাৎ এক খণ্ড পাথর, অথবা আত্মা বিহীন মাটি; একটি পাহাড় একটি জঙ্গল, অথবা একটি বৃক্ষ। মানুষের পক্ষে নিম্নতম অস্তিত্বসমূহের পূজা করার চেয়ে বৃহত্তর লক্ষ্য আর কি হতে পারে? অনুরূপভাবে জ্ঞান মানুষের একটি গুণ, অজ্ঞতাও তাই; সত্যবাদীতা মানুষের একটি গুণ, মিথ্যাও তাই; বিশ্বাস এবং বিশ্বাসঘাতকতা, ন্যায়পরতা ও অন্যায় মানুষের গুণাবলী ইত্যাদি ইত্যাদি। সংক্ষেপে সমস্ত পরোৎকর্ষ তথা পূর্ণতা ও গুণাবলী বা পূণ্য এবং সমস্ত পাপ মানুষের গুণাবলী।

স্বতন্ত্র ব্যক্তিদের মধ্যে পার্থক্যসমূহ সমানভাবে বিবেচনা কর। যিশুখ্রিষ্ট মানুষের আকৃতিতে ছিলেন এবং কিয়াফাছ মানুষের আকৃতিতে ছিলেন; মুসা ও ফিরাউন, হাবিল ও কাবিল, বাহা’উল্লাহ্ ও ইয়াহ্ইয়া মানুষ ছিলেন।

মানুষকে আল্লাহর শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধিস্বরূপ বলা হয়েছে এবং সে হচ্ছে সৃষ্টির গ্রন্থ, কারণ অস্তিত্বসমূহের সমুদয় রহস্যাবলী তার মধ্যে বিদ্যমান। যদি সে প্রকৃত শিক্ষাদাতার ছায়াতলে আসে এবং সুঠকভাবে প্রিশিক্ষণ প্রাপ্ত হয়, তাহলে সে অস্তিত্বসমূহের অস্তিত্বে, আলোকসমূহের আলো, আত্মাসমূহের আত্মায় পরিণত হয়; সে স্বর্গীয় আবির্ভাবসমূহের কেন্দ্রে, আধ্যাত্মিক গুণাবলীর উৎস, স্বর্গীয় আলোকসমূহের উদয় স্থলে এবং স্বর্গীয় অনুপ্রেরণাসমূহের আধারে পরিণত হতো। যদি সে এই শিক্ষা তেকে বঞ্চিত হয়, তাহলে সে শয়তানী গুণাবলী তথা পাশব পাপসমূহের সমষ্টি এবং সমুদয় অন্ধকার অবস্থাসমূহের উৎসের প্রকাশে পরিণত হয়।

পয়গম্বরদের দৌত্য কার্যের কারণ হচ্ছে মানব মণ্ডলীদের শিক্ষা দেওয়া; যাতে এই কয়লার টুকরো হীরায় পরিণত হতে পারে এবং এই ফলহীন বৃক্ষকে কলম করা যেতে পারে এবং এটা মিষ্টতম, সর্বাপেক্ষা উপাদেয় ফল উৎপাদন করতে পারে। মানুষ যখন মানব জগতে মহত্তম অবস্থায় পৌঁছায় তখন সে পূর্ণতার অবস্থাসমূহ অধিকতর উন্নতি করতে পারেÑ কিন্তু অবস্থ্যায় নয়, কারণ এরূপ অবস্থাসমূহ সীমাবদ্ধ, কিন্তু স্বর্গীয় পূর্ণতাসমূহ সীমাহীন। ্

এই জড় আকৃতি অপসরণের পূর্বে ও পরে পূর্ণতায় উন্নতি রয়েছে, কিন্তু অবস্থায় নয়। সুতরাং অস্তিত্বসমূহ পূর্ণ মানুষে সুসম্পূর্ণ হয়। পূর্ণ মানুষ অপেক্ষা আর কোন উচ্চতর অস্তিত্ব নেই। কিন্তু মানুষ যখন সে এই অবস্থায় পৌঁছেছে, তখনও সে পরোৎকর্ষসমূহে উন্নতি করতে পারে, কিন্তু অবস্থায় নয়, কারণ পূর্ণ মানুষের অবস্থা অপেক্ষা উচ্চতর আর কোন অবস্থা নেই। সে শুধুমাত্র মনুষ্যত্বের অবস্থায় উন্নতি করতে পারে, কারণ মানবীয় পূর্ণতাসমূহ অসীম। এমতে একটি লোক যতই পণ্ডিত হোক, আমরা অন্য কাউকে তার অপেক্ষাও পণ্ডিত কল্পনা করতে পারি।

অতএব মানুষের পরোৎকর্ষসমূহ যেমন সীমাহীন, তেমনি মানুষ ইহ জগত ত্যাগ করার পরও পূর্ণতাসমূহে উন্নতি করতে পারে।

44
“কিতাবুল আকদাসে”র একটি শ্লোকের ব্যাখ্যা

প্রশ্ন; কিতাবুল আকদাসে বলা হয়েছে “সে ভ্রান্তির জনমণ্ডলীর মধ্যে, যদিও সৎকার্যবলী প্রদর্শন করে” এই শ্লোকের অর্থ কি?

উত্তর: এই পবিত্র শ্লোকের অর্থ এই যে, সাফল্য ও মুক্তির ভিত হচ্ছে আল্লাহ্ সম্বন্ধে জ্ঞান এবং আল্লাহ্র সম্বন্ধীয় জ্ঞানের ফলাফল সৎকর্ম, যা বিশ্বাসের ফলাফল।

যদি মানুষের এই জ্ঞান না থাকে তাহলে সে আল্লাহ্ থেকে বিচ্ছিন্ন হবে এবং যখন এই বিচ্ছেদ বহাল থাকে, তখন সৎকার্যাবলীর পূর্ণফল থাকে না। এই শ্লোকের অর্থ এই নয় যে আল্লাহ থেকে বিচ্ছিন্ন আত্মাসমূহ সমান- তাই তারা সৎ কাজ করুক বা অসৎ কাজ করুক। এর শুধুমাত্র অর্থ যে, ভিত হচ্ছে আল্লাহ্কে জানা এবং সৎকার্যাবলীর এই জ্ঞান থেকে উৎপন্ন হয়। তবুও এটা নিশ্চিত যে, আল্লাহ থেকে পর্দান্তরাল ব্যক্তি, যার উত্তম নীতিমালা ও চরিত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে, আল্লাহর ক্ষমা প্রাপ্তির উপযুক্ত; পক্ষান্তরে যে পাপী এবং খারাপ গুণাবলী ও খারাপ চরিত্র দোষে দুষ্ট, সে আল্লাহ্র বদান্যতা ও আশীর্বাদ থেকে বঞ্চিত; এখানেই রয়েছে পার্থক্য।

অতএব উক্ত পবিত্র শ্লোকের অর্থ এই যে, আল্লাহর জ্ঞান ব্যতীত শুধুমাত্র সৎকার্যাবলী, শাশ্বত মুক্তি, চিরস্থায়ী সাফল্য এবং সৌভাগ্য, ঐশ্বরীক রাজ্যে প্রবেশের কারণ হতে পারে না।

45
দেহের মৃত্যুর পর বিচার বুদ্ধি-সম্পন্ন আত্মার অস্তিত্ব

প্রশ্ন: দেহাবসানের এবং আত্মার স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর, কিভাবে বিচার বুদ্ধি-সম্পন্ন আত্মা বিদ্যমান থাকে? ধরা যাক যে, যে সমস্ত আত্মা পবিত্র আত্মার বদান্যতা দ্বারা সাহায্য পুষ্ট হয়, তারা প্রকৃত অস্তিত্ব ও শাশ্বত জীবন লাভ করে; কিন্তু বিচার বুদ্ধি-সম্পন্ন আত্মা কি করে? অর্থাৎ পর্দাস্তরালে আত্মাসমূহের কি হয়?

উত্তর: কোন কোন লোক মনে করে যে, দেহ হচ্ছে সারভাগ এবং আপনা আপনি টিকে থাকে এবং আত্মা আপতিক (আকস্মিক) যদিও পক্ষান্তরে, বিচারবুদ্ধি-সম্পন্ন আত্মা হচ্ছে সারভাগ এবং দেহ এর উপর নির্ভর করে। যদি দৈব, অর্থাৎ দেহ বিনাশ প্রাপ্ত হয়, উক্ত সার ভাগ, আত্মা থেকে যায়।

দ্বিতীয়ত: বিচার বুদ্ধি-সম্পন্ন আত্মা আর্থাৎ মানব আত্মা দেহের মধ্যে অবতরণ করে না; অর্থাৎ এটা দেহের মধ্যে প্রবেশ করে না, কারণ অবতরণ ও প্রবেশ হচ্ছে দেহসমূহের চরিত্র বৈশিষ্ট্য এবং বিচার বুদ্ধি আত্মা এর থেকে মুক্ত। অত্মা কখনো দেহের মধ্যে প্রবেশ করে নাই, সুতরাং দেহ ত্যাগ করায় এটার আবাসস্থলের প্রয়োজন হবে না; না আত্মা দেহের সঙ্গে সংযুক্ত, যেমন এই আলো দর্পনের সঙ্গে সংযুক্ত। যখন দর্পন স্বচ্ছ ও নিখুঁত থাকে, প্রদীপের আলো এর মধ্যে স্পষ্ট দেখা যায় এবং দর্পন যখন ধুলিতে আবৃত থাকে অথবা ভেঙ্গে যায়, আলো অদৃশ্য হয়ে যাবে।

বিচার বুদ্ধি-সম্পন্ন আত্মা, অর্থাৎ মানব আত্মা দেহের মধ্যে প্রবেশও করে নাই, এর মাধ্যমে অস্তিত্ব প্রাপ্তও হয় নাই; সুতরাং দেহের সংযুক্তির বিশ্লেষণের পর, কেমন করে এর একটা সারবস্তুর প্রয়োজন হবে যার মাধ্যমে এটা জীবিত থাকতে পারে? পক্ষান্তরে, বিচার বুদ্ধি-সম্পন্ন আত্মা হচ্ছে সারভাগ যার মাধ্যমে দেহ বেঁচে থাকে। বিচার বুদ্ধি-সম্পন্ন আত্মার ব্যক্তিত্ব তার আরম্ভ থেকেই বিদ্যমান; এটা দেহের মাধ্যমের কারণ নয়, কিন্তুবিচার বুদ্ধি-সম্পন্ন আত্মার অবস্থা ও ব্যক্তিত্ব এই জগতে শক্তিশালী হতে পারে; এটা উন্নতি করবে এবং পূর্ণতার মাত্রায় পৌঁছাবে, অথবা আল্লাহ্র নিদর্শনাবলী দর্শন করা থেকে পর্দান্তরাল ও বঞ্চিত থেকে অজ্ঞতার অতল গহ্বরে অবস্থান করে।

প্রশ্ন: কিসের মাধ্যমে মানব আত্মা. অর্থাৎ বিচার বুদ্ধি-সম্পন্ন আত্মা এই মরজগত থেকে প্রস্থানের পর উন্নতি করে?

উত্তর: ধুলির শরীরের সঙ্গে সংযুক্তি বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর স্বর্গীয় জগতে মানব আত্মার উন্নতি হচ্ছে শুধূ মাত্র পরম প্রভুর দয়া ও বদান্যতার মাধ্যমে, অথবা অন্যান্য মানব আত্মাসমূহের মাধ্যমে ও অকপট প্রার্থনাসমূহের মাধ্যমে হয়ে থাকে, অথবা দানশীলতা এবং গুরুত্বপূর্ণ সৎ কার্য যা তার নামে করা হয় তার মাধ্যমে উন্নতি করে।

46
শিশুদের অমরত্ব

প্রশ্ন: শিশুদের অবস্থা কি, যারা নাবালক অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে অথবা জন্মের নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই মারা যায়?

উত্তর: এই সমস্ত শিশু আল্লাহর অনুগ্রহের ছায়াতলে থাকে; এবং যেহেতু তারা কোন পাপ করে নাই এবং প্রকৃতি জগতের অপবিত্রতার দ্বারা কলুষিত হয় নাই, সেইহেতু বদান্যতার প্রকাশের কেন্দ্র হয় এবং অনুকম্পার চক্ষু তাদের প্রতি ফিরানো হবে।

47
শাশ্বত জীবন ও ঐশী রাজ্যে প্রবেশ

তুমি শাশ্বত জীবন ও স্বর্গরাজ্যে প্রবেশ সম্বন্ধে প্রশ্ন করেছ? স্বর্গ রাজ্যের পরিবর্তে ব্যবহৃত বাহ্যিক শব্দ হচ্ছে “স্বর্গ” কিন্তু এটা একটি তুলনা ও উপমা, বাস্তবতা বা বাস্তব তথ্য নয়; কারণ ঐশী রাজ্য একটি জড় স্থান নয়, এটা স্থান ও কাল (সময়) থেকে পবিত্রকৃত। এটা একটা আধ্যাত্মিক জগত, একটি স্বর্গীয় জগত এবং আল্লাহ্র সার্বভৌমত্বের কেন্দ্র; দেহ ও যা কিছু দৈহিক তা থেকে এটা মুক্ত এবং এটা মনুষ্য জগতের কল্পনাসমূহ থেকে পবিত্রকৃত। স্থানে সীমাবদ্ধ হওয়া দৈহিক বস্তুসমূহের গুণ, আত্মাসমূহের নয়। স্থান ও কাল (সময়) দেহকে বেষ্টন করে, মন ও আত্মাকে নয়। লক্ষ্য কর মানুষের দেহ অল্প জায়গায় গণ্ডিবদ্ধ; এটা শুধুমাত্র দুই বিঘৎ জমি আবৃত করে, কিন্তু মানুষের মন ও আত্মা দেশ দেশান্তর তথা সমস্ত দেশ ও জনপদ ভ্রমণ করে- এমনকি এটা নভোমণ্ডলের সীমাহীন মহাশূন্যের মধ্য দিয়ে ভ্রমণ করে এবং যা কিছু বিদ্যমান সবকিছুকেই বেষ্টন করে এবং মহোচ্চ গণ্ডি ও সীমাহীন র্দরত্বসমূহে আবিষ্কার করে। এটা এই জন্য যে, আত্মার কোন স্থান নেই এটা স্থানহীন; এবং আত্মার কাছে স্বর্গ মর্ত একই, যেহেতু এটা উভয়ের মধ্যেই আবিষ্কার করে। কিন্তু দেহ একটি স্থানে সীমাবদ্ধ এবং এর বাইরে যা কিছু বিদ্যমান সে তা জানে না।

কারণ দুই প্রকারের জীবন; একটি দৈহিক জীবন , আরেকটি আত্মিক জীবন। দৈহিক জীবন হচ্ছে জড় জীবন, কিন্তু আত্মিক জীবন স্বর্গরাজ্য প্রকাশ করছেÑ যে স্বর্গরাজ্য আল্লাহ্র আত্মা গ্রহণে এবং পবিত্র আত্মার শ্বাস প্রশ্বাসের দ্বারা জীবন্ত বা প্রাণবন্ত হওয়ায় নিহিত। যদিও জড় জীবনের অস্তিত্ব আছে, তবু সাধু ব্যক্তিদের পক্ষে এটা সম্পূর্ণ অনস্তিত্ব ও সম্পূর্ণ মৃত্যু। দেখ, মানুষ বেচে থাকে এবং এই প্রস্তরও জীবিত থাকে, কিন্তু মানুষ ও প্রস্তরের মধ্যে কতই না পার্থক্য। যদিও পাথর জীবিত থাকে, তবু মানুষের অস্তিত্বের তুলনায় পাথর অনস্তিত্ব।

শাশ্বত জীবনের অর্থ হচ্ছে পবিত্র আত্মার দান, ঠিক যেমন ফুল ঋতুর, বাতাসের ও বসন্তকালের মৃদুমন্দ সমীরণ এর দান গ্রহণ করে থাকে। গভীরভাবে বিবেচনা কর, প্রথমে এই ফুলের জীবন ছিল খনিজ পদার্থের জীবন সদৃশ; কিন্তু বসন্ত ঋতুর আগমনে, বসন্তকালীন মেঘমালার বদান্যতায়, উজ্জ্বল সূর্যে উত্তাপে এটা দারুন সতেজতা, মাধুর্য ও সুরভির অপর এক জীবন লাভ করে। ফুলের প্রথম জীবন, দ্বিতীয় জীবনের তুলনায় মৃত।

এর অর্থ এই যে, স্বর্গ রাজ্যের জীবন হচ্ছে আত্মার জীবন, শাশ্বত জীবন এবং এটা স্থান থেকে পবিত্রকৃত, মানুষের আত্মার ন্যায়, যার কোন স্থান নেই। কারণ যদি তুমি মানব দেহ পরীক্ষা কর, তাহলে তুমি আত্মার জন্য কোন বিশেষ বিন্দু বা স্থান দেখতে পাবে না, কারণ এটার কোন স্থান কখনো ছিল না; এটা অশরীরি। এই দর্পনের সঙ্গে সূর্যের ন্যায় দেহের সঙ্গে এর সম্পর্ক আছে। সূয দর্পনের মধ্যে নেই, কিন্তু দর্পনের সঙ্গে এর সম্পর্ক আছে।

অনুরূপভাবে চক্ষু অথবা অন্যান্য ইন্দ্রিয়সমূহের সাহায্যেÑ তথা শ্রবণ শক্তি, ঘ্রাণ শক্তি, আম্বাদন শক্তি অথবা স্পর্শ শক্তির সাহায্যে যা কিছু অনুভূত হতে পারে, তার থেকে স্বর্গ রাজ্যের জগত পবিত্রকৃত। মন, যা মানুষের মধ্যে বিদ্যমান, যার অস্তিত্বে স্বীকৃতি রয়েছে- কোথায় সেটা তার মধ্যে? চক্ষু, কর্ণ অথবা অন্যান্য ইন্দ্রিসমূহ দ্বারা যদি তুমি সেই দেহ পরীক্ষা কর, তাহলে তুমি এটা দেখবে না; তবুও এটা আছে। অতএব মনের কোন স্থান নেই, কিন্তু মস্তিষ্কের সঙ্গে এর সম্পর্ক রয়েছে। স্বর্গরাজ্যও অনুরূপ। অনুরূপভাবে ভালোবাসার কোন স্থান নেই, কিন্তু মানুষের অন্তঃকরণের সঙ্গে এর সম্পর্ক রয়েছে; সুতরাং স্বর্গরাজ্যের কোন স্থান নেই, কিন্তু মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে।

প্রেম প্রীতি, নিরাসক্তি, প্রবিত্রতা ও সূচিতা, সত্যবাদিতা, দৃঢ়তা, বিশ্বস্ততা এবং জীবন উৎসর্গের মাধ্যমে স্বর্গরাজ্যে প্রবেশ সম্ভব হয়ে থাকে।

এই সমস্ত ব্যাখ্যা প্রমাণ করছে যে, মানুষ অমর এবং চিরকাল জীবিত থাকে। কারণ যারা আল্লাহকে বিশ্বাস করে, আল্লাহর প্রতি যাদের প্রেম আছে, বিশ্বাস আছে- তাদের জীবন উৎকৃষ্ট অর্থাৎ জীবন্ অনন্ত; কিন্তু যাদের আত্মা আল্লাহর থেকে পর্দান্তরাল, যদিও তাদের জীবন আছে, তাদের কাছে জীবন অন্ধকারময় এবং বিশ্বাসীদের জীবনের তুলনায় তাদের জীবন অস্তিত্ববিহীন।

উদাহরণস্বরূপ, চক্ষু এবং নখ জীবন্ত; কিন্তু নখের জীবন চক্ষুর জীবনের সম্পর্কে অস্তিত্ববিহীন। এই প্রস্তর এবং এই মানুষ উভয়েই জীবিত; কিন্তু মানুষের অস্তিত্বের সম্পর্কে এটা অস্তিত্ববিহীন, এর অস্তিত্ব নেই; কারণ যখন মানুষ মৃত্যুবরণ করে ও তার দেহ ধ্বংস ও বিনাশ প্রাপ্ত হয়, তখন তার দেহ পাথর ও মৃত্তিকায় পরিণত হয়। তাহলে এটা সুস্পষ্ট যে, যদিও খনিজ পদার্থ জীবিত, তবুও মানুষের তুলনায় সেটা অস্তিত্ববিহীন।

অনুরূপভাবে যে সমস্ত আত্মা আল্লাহ্ থেকে পর্দান্তরাল, যদিও ইহজগতে ও পরজগতে তারা জীবিত, তবু আল্লাহ্রর স্বর্গরাজ্যের শিশুদের পবিত্র অস্তিত্বের তুলনায় তারা অস্তিত্ববিহীন এবং আল্লাহ্ থেকে পর্দান্তরাল।

48
বিধিলিপি

প্রশ্ন: পবিত্র ধর্ম গ্রন্থসমূহে উল্লেখিত ভাগ্যের পূর্ব নির্ধারণ (পূর্ব নির্ধারিত ভাগ্য) কি বিধির বিধান? যদি তাই হয়, তাহলে নেটা এড়িয়ে চলার চেষ্টা করা কি নিরর্থক নয়?

উত্তর: ভাগ্য দুই প্রকারের: একটি নির্ধারিত এবং অপরটি শর্তযুক্ত তথা সাপেক্ষ অথবা আসন্ন। নির্ধারিত ভাগ্য হচ্ছে সেটাই যা পরিবর্তিত হয় না এবং শর্তযুক্ত ভাগ্য হচ্ছে সেটাই যা ঘটতে পারে। সুতরায় এই প্রদীপের জন্য নির্ধারিত ভাগ্য হচ্ছে এটাই যে, তেল পুড়ে নিঃশেষিত হবে; অতএব এর ফলস্বরূপ সংঘঠিত নির্বাপন হচ্ছে নির্ধারিত; যা পরিবর্তন করা অসম্ভব, কারণ এটা হচ্ছে নির্ধারিত ভাগ্য। অনুরূপভাবে মানুষের দেহে একটি জীবনী শক্তি সৃষ্টি করা হয়েছে এবং এটা শেষ বা বিনাশ প্রাপ্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দেহ অবশ্যই বিনষ্ট হবে; সুতরাং যখন এই প্রদীপের তেল প্রজ্বলিত ও নিঃশেষিত হয়, প্রদীপ নিঃসন্দেহে নির্বাপিত হবে।

কিন্তু শর্তযুক্ত ভাগ্য এরূপ হতে পারে, যখন প্রদীপে তেল তখন প্রদীপের উপর দিয়া প্রবল বায়ু প্রবাহিত হল ফলে প্রদীপ নির্বাপিত হল। এটাই শতর্দযুক্ত ভাগ্য। এটাকে এড়িয়ে চলা, এ থেকে নিজেকে রক্ষা করা, সতর্ক ও পরিমাণদর্শী হওয়া বিজ্ঞতার কাজ। কিন্তু প্রদীপে তেল নিঃশেষিত হওয়ার ন্যায় নির্ধারিত ভাগ্যকে পরিবর্তন করাও যায় না, এটা বিলম্বিতও হয় না। এটা অবশ্যই ঘটবে; এটা অপরিহার্য যে প্রদীপ নির্বাপিত হবে।

49
নক্ষত্রসমূহের প্রভাব

প্রশ্ন: মানব আত্মার উপর নভোমণ্ডলের নক্ষসমূহের প্রভাব আছে কি নেই?

উত্তর: আকাশস্থ কিছু কিছু নক্ষত্রের পার্থিব গোলক ও অস্তিত্বসমূহের উপর জড় প্রভাব পরিষ্কার ও সুস্পষ্ট যার কোন ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয় না। সূর্যের কথা বিবেচনা কর- যা আল্লাহর দূরদর্শিতা ও সাহায্যের মাধ্যমে পৃথিবী ও সমূদয় পার্থিব অস্তিত্বসমূহকে বিকশিত করছে। সূর্যের আলো ও উত্তাপ ব্যতীত সমূদয় পার্থিব জীব বস্তু সম্পূর্ণরূপে অস্তিত্ব বিহীন হয়ে যেত।

নক্ষত্রসমূহের আধ্যাত্মিক প্রভাব সম্বন্ধে বলতে গেলে বলতে হয়, যদিও মানুষ জগতে নক্ষত্রসমূহের এই প্রভাবের কথা অদ্ভুত বলে মনে হতে পারে, কিন্তু তবুও যদি তুমি এই বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তুা কর, তাহলে তুমি ততবেশি বিস্মিত হবে না। কিন্তু তাই বলে আমার কথার অর্থ এই নয় যে, বিধি বিধান, যা পূর্বেকার ঐ সমস্ত জ্যোতিষগণকেরা নক্ষত্রসমূহের গতিবিধি থেকে অনুমান করতেন, তা ঘটনার অনুরূপ হত; কারণ পূর্বেকার ঐ সমস্ত জ্যোতিষগণদের বিধানসমূহ কল্পনার আকার ছিল যা ইজিপ্টবাসী (মিশরীয়), আশারীয় ও ক্যালডীর পুরোহীতগণের সৃষ্ট শুধু তাই নয়, ঐ সমস্ত বিধান হিন্দুদের কল্পনা প্রসূত ছিল, গ্রীক, রোমান ও অন্যান্য নক্ষত্র পূজারীদের পৌরাণিক কথা থেকে উদ্ভত। কিন্তু আমি বলতে চাই যে এই সীমাহীন বিশ্ব ব্রক্ষ্মাণ্ড মানব দেহের অনুরূপ, যার সমুদয় সদস্যগুলি (অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ) বৃহত্তম শক্তি সহকারে একে অন্যের তথা পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত। পরস্পরের সাহায্যের জন্য মনুষ্য দেহ যন্ত্রগুলি, সদস্যগুলি, অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলি, দেহের অংশগুলি কতই না মিশ্রিত ও সংযুক্ত এবং কতই না পরস্পরকে প্রভাবান্বিত করে। অনুরূপভাবে এই অসীম বিশ্ব ব্রক্ষ্মাণ্ডের অংশসমূহ তাদের সদস্যদের ও উপাদানসমূহকে পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত করছে এবং আধ্যাত্মিক ও জড়ভাবে পরস্পরকে প্রভাবান্বিত করছে।

উদাহরণস্বরূপ চক্ষু দর্শন করে এবং সমস্ত দেহ প্রভাবান্বিত হয়; কর্ণ শ্রবণ করে এবং দেহের সমস্ত সদস্য (অঙ্গ প্রত্যঙ্গ) বিচলিত হয়। এতে কোন সন্দেহ নেই এবং বিশ্ব ব্রক্ষ্মাণ্ড জীবিত ব্যক্তির ন্যায়। অধিকন্তু অস্তিত্বসমূহের সদস্যদের মধ্যে যে সম্বন্ধ বিদ্যমান রয়েছে, তার অপরিহার্যরূপে একটি প্রভাব ও চাপ রয়েছে- তা সে অস্তিত্ব জড় হোক অথবা আধ্যাত্মিক হোক।

যারা জড় পদার্তসমূহের উপর আধ্যাত্মিক প্রভাব অস্বীকার করে, তাদের জন্য আমরা এই সংক্ষিপ্ত উদাহরণ দিচ্ছি। বিস্ময়কর স্বর ও শব্দাবলী, মধুর স্বরসমূহ ও মনোমুগ্ধকর স্বরসমূহ হচ্ছে দুর্ঘটনা, যা বায়ুকে প্রভাবান্তি করে, কারণ শব্দ হচ্ছে বায়ু অনুকম্পনের ভাষাÑ এবং এই অনুকম্পনগুলির দ্বারা কানের পর্দার¯স্নায়ুগুলি প্রভাবান্বিত হয় এবং শ্রবণ উৎপন্ন হয়। এখন গভীরভাবে চিন্তা কর যে, বাতাসের স্পন্দন, যা একটি অকিঞ্চিতকর দুর্ঘটনা, তথা মানুষের আত্মাকে আকর্ষণ ও বিচলিত করে এবং তার উপর বিরাট প্রভাব বিস্তার করে। এটা তাকে ক্রন্দন করায় অথবা হাসায়, হয়তো এটা তাকে এরূপ পরিমাণে প্রভাবান্বিত করবে যে, সে নিজেকে বিপদের মধ্যে নিক্ষেপ করবে। অতএব বায়ুমণ্ডল সংক্রান্ত অনুকম্পন ও মানুষের আত্মার মধ্যে সম্বন্ধ দেখ। বাতাসের গতি তাকে এক অবস্থা থেকে অন্যাবস্থায় অপসারণ করায় ও সম্পূর্ণরূপে বশীভূত করার কারণ হচ্ছে। এটা তাকে শান্তি ও ধৈর্য ও শান্তি থেকে বঞ্চিত করবে। মনে মনে গভীরভাবে চিন্তা করে দেখ যে, এটা কতই না অদ্ভুত ব্যাপার যে, গায়ক থেকে কোন কিছুই বেরিয়ে আসে না, যা শ্রোতার মধ্যে প্রবেশ করে; এতদসত্ত্বেও এক বিরাট আ্যধাত্মিক প্রভাব সৃষ্টি হয়। অতএব নিশ্চিতই অস্তিত্বসমূহের মধ্যে এত বিরাট সম্বন্ধের অবশ্যই আধ্যাত্মিক প্রভাব ও ফল বিদ্যমান রয়েছে।

পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, মানুষের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ও বিভিন্ন অংশসমূহ পরস্পরকে প্রভাবান্বিত করে। উদাহরণস্বরূপ চক্ষু দর্শন করে, হৃদয় প্রভাবান্বিত হয়, কর্ণ শ্রবণ করে এবং আত্মা প্রভাবান্বিত হয়; অন্তঃকরণ বিশ্রাম গ্রহণ করে, চিন্তা ভাবনা শান্ত হয় এবং মানব দেহের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের ও সমুদয় সদস্যদের জন্য একটি সুখকর অবস্থা অনুভূত হয়। কি চমৎকার সম্বন্ধ, কি চমৎকার ব্যবস্থা এটা! যেহেতু এই সম্বন্ধ, এই আধ্যাত্মিক ফল ও প্রভাব মানব দেহের সদস্যদের মধ্যে বিদ্যমান যে মানুষ বহু সীমাবদ্ধ অস্তিত্বসমূহের মধ্যে মাত্র একটি, তাহলে নিশ্চয়ই এই বিশ্বব্রক্ষ্মাণ্ডও অসীম অস্তিত্বসমূহের মধ্যেও একটি আধ্যাত্মিক ও জড় সম্বন্ধ রয়েছে। যদিও প্রচলিত নিয়মাবলী ও প্রকৃতি বিজ্ঞানের সাহায্যে এই সমস্ত সম্পর্ক আবিষ্কার করা যাবে না, অস্তিত্বসমূহের মধ্যে তাদের প্রভাব ও অস্তিত্ব অবধারিত ও নিরঙ্কুস।

উপসংহারে: ক্ষুদ্র হোক আর মহৎ হোক, অস্তিত্বসমূহের পরস্পরের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত ও পরস্পরকে প্রভাবান্বিত করে- এটা আল্লাহ্র নিখুঁত বিজ্ঞাতার দ্বারাই হয়েছে। যদি এরূপ না হত তাহলে অস্তিত্বের সার্বজনীন পদ্ধতি ও সাধারণ বিন্যাস নিস্পত্তিতে বিশৃঙ্খলা ও অপূর্ণতা দেখা দিত। যেহেতু অস্তিত্বসমূহের বৃহত্তম শক্তি সহকারে একে অন্যের সহিত সম্বন্ধযুক্ত, সেহেতু তারা তাদের স্থানসমূহে ও পূর্ণতায় শৃঙ্খলায় বিরাজ করছে।

এই বিষয় পরীক্ষার উপযুক্ত।

50
স্বাধীন ইচ্ছা

প্রশ্ন: মানুষ কি তার কার্যাবলীতে স্বাধীন কর্মী অথবা বাধ্য কর্মী?

উত্তর: স্বর্গীয় সমস্যাবলীর মধ্যে এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল প্রশ্ন। যদি আল্লাহ ইচ্ছা করে (ইনশাল্লাহ্) অন্য একদিন আমরা মধ্যাহ্ন ভোজনের শুরুতেই এই বিষয়ের বিষদ ব্যাখ্যা করবো; এখন আমরা সংক্ষেপে এটা ব্যাখ্যা করবো - সেটা এইরূপ: কোন কোন বিষয় আছে যা মানুষের স্বাধীনর ইচ্ছাধীন, তথা ন্যাপরতা, নিরপেক্ষতা, অত্যাচার এবং অন্যায় ও ভার মন্দ কার্যাবলী; এটা সুস্পষ্ট ও পরিষ্কার যে, এই সমস্ত কার্যাবলীর বেশিরভাগই মানুষের ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল। কিন্তু কতিপয় জিনিস আছে, মানুষ যার বাধ্য; যথা- নিদ্রা, মৃত্যু, পীড়া, শক্তির পতন, অনিষ্ট এবং দুর্ভাগ্য; এগুলি মানুষের ইচ্ছাধীন নয় এবং এগুলির জন্য মানুস দায়ী নয়, কারণ মানুষ এগুলি সহ্য করতে বাধ্য। কিন্তু সৎ ও অসৎ কর্মাবলী চয়ণের বিষয়ে সে স্বাধীন এবং সে এগুলি তার ইচ্ছানুসারে করে।

উদাহরণস্বরূপ, সে যদি ইচ্ছা করে, আল্লাহ্র প্রশংসায় সে সময় কাটাতে পারে। অথবা সে অন্য চিন্তায় ব্যস্ত থাকতে পারে। আল্লাহর প্রেমের অগ্নির এবং মানব হিতৈষণার মাধ্যমে সে একটি প্রজ্বলিত আলো হতে পারে, অথবা সে মানব বিরোধী হতে পারে এবং পার্থিব বিষয় বস্তুতে সে নিমজ্জিত হতে পারে। সে ন্যায়পর হতে পারে অথবা নিষ্ঠুর হতে পারে। এই সমস্ত কর্মকাণ্ড মানুষের ইচ্ছার নিয়ন্ত্রাধীণ, ফলে সে তার জন্য দায়ী।

এখন আর একটি প্রশ্ন হচ্ছে: মানুষ সম্পূর্ণরূপে অসহায় ও নির্ভরশীল; যেহেতু শক্তি ও ক্ষমা বিশেষভাবে আল্লাহ্র অধিকারভূক্ত। মর্যদায় উন্নতি ও অবমাননা উভয়ই মহোচ্চ আল্লাহ্র শুভ সন্তুষ্টি ও ইচ্ছার উপর নির্ভর করে।

সুসমাচারে (গসপেলে) বলা হয়েছে যে, আল্লাহ একজন কুম্ভকারের ন্যায়, যিনি “সম্মানের প্রতি একটি জলপাত্র ও অসম্মানের প্রতি আরেকটি জলপাত্র এবং অসম্মানের প্রতি আরেকটি জলপাত্র তৈরী করেন।’’ এখন অসম্মানিত পানপাত্রের “ কেন তুমি আমাকে একটি মূল্যবান পেয়ালা তৈরী করলে না, যা একহাত থেকে আর এক হাত অতিক্রম করতো?” এই কথা বলে কুম্ভকারের দোষ ধরার কোন অধিকার নেই। এই শ্লোকের অর্থ এই যে, অস্তিত্বসমূহের অবস্থা বিভিন্ন। খনিজ পদার্থের মত যা কিছু অস্তিত্বের নি¤œতম অবস্থায় আছে “হে আল্লাহ , কেন তুমি আমাকে উদ্ভিদের পরোৎকর্ষসমূহ দিলে না?” এই বলে তাদের অভিযোগ করার কোন অধিকার নেই। অনুরূপভাবে উদ্ভিদের অভিযোগ করার কোন অধিকার নেই যে তাকে প্রাণী জগতের পূর্ণতা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। ইতর প্রাণীর পক্ষে মানবীয় পূর্ণতাসমূহের অভাবের অভিযোগ করা উচিৎ নয়। না, এই সমস্ত বস্তুই নিজের ধাপে সম্পূর্ণ এবং এদের নিজেদের ধাপে পরোৎকর্ষসমূহ অর্জন করতে চেণ্টা করতে হবে। আমরা ইতিমধ্যেই বলছি যে, নিকৃষ্টতর অস্তিত্বসমূহের পক্ষে উৎকৃষ্টতর পরোৎকর্ষসমূহের অবস্থায় কোন অধিকার নেই; তাদের পক্ষে উপযুক্তও নয়। না, তাদের উন্নতি তাদের নিজেদের অবস্থায় অবশ্যম্ভাবী। মানুষের কর্মতৎপরতার অভাব অথবা চলন শক্তিও আল্লাহ্র সাহায্যের উপর নির্ভর করে। যদি সে সাহায্যপুষ্ট না হয় তাহলে সে ভাল বা মন্দ করতে সক্ষম নয়। কিন্তু যখন উদার পরম প্রভু থেকে অস্তিত্বের সাহায্য আসে, তখন সে মঙ্গর ও অমঙ্গল উভয়েই করতে সক্ষম হয়; কিন্তু যদি সাহায্য কর্তন করা হয়, তাহলে সে সম্পূর্ণ অসহায় থাকে। এই জন্যই ধর্মগ্রন্থসমূহে লোকে আল্লাহ্র সাহায্যের কথা বলে। সুতরাং এই অবস্থা একটি জাহাজের অবস্থার ন্যায় - যে জাহাজ বায়ু অথবা বাষ্পীয় শক্তির সাহায্যে চলাচলা করে। যদি এই শক্তি থেমে যায়, তাহলে জাহাজ একেবারেই চলতে পারে না। এতদসত্ত্বেও জাহাজের হাল একে যে কোন দিকেই ঘোরায় এবং বকাষ্পীয় শক্তি একে ইপ্সিত দিকে চালায়। যদি একে পূর্বমুখী করা হয়, এটা পশ্চিম দিকে গমন করবে। এই গতি জাহাজ থেকে আসে না; না, এটা বায়ু অথবা বাষ্প থেকে আসে।

অনুরূপভাবে মানুষের সমুদয় কর্মক্ষমতায় ও অকর্মণ্যতায় সে আল্লাহ্র সাহায্য থেকে শক্তি পায়; কিন্তু ভাল অথবা মন্দ চয়ন মানুষের অধিকারভূক্ত। সুতরাং যদি একজন নরপতি কোন লোককে একটি শহরের শাসনকর্তারূপে নিযুক্ত করে এবং তাকে কর্তৃত্বের ক্ষমতা দান করে এবং তাকে আইন অনুযায়ী ন্যায় ও অন্যায়ের পথ প্রদর্শন করে; অতঃপর যদি এই শাসনকর্তা অন্যায় করে, যদিও সে রাজার শক্তি ও কর্তৃত্বে কার্য করে, তবুও রাজ্য উক্ত অন্যায় থেকে মুক্ত। কিন্তু যদি সে ন্যাপরতার সঙ্গে কাজ করে, এটাও সে রাজশক্তি ও কর্তৃত্বে কাজ করে- তখন রাজ সন্তুষ্ট হবে।

অর্থাৎ যদিও ভাল মন্দ চয়ন মানুষের সেচ্ছাধীন, তবুও সর্বাবস্থায় সে জীবনের প্রতিপালনকারী সাহায্যের উপর নির্ভরশীল যা আল্লাহর কাছ থেকে আসে। আল্লাহর রাজ্য বিরাট এবং সমস্ত কিছুই তাঁর শক্তি-মুষ্টিতে বন্দী। ভূত নিজের ইচ্ছা মাফিক কিছুই করতে পারে না। আল্লাহ সর্বশক্তিমান, ক্ষমতাবান এবং সর্ব অস্তিত্বের সাহায্যকারী।

এই প্রশ্ন পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। অভিবাদন!

51
দুরদৃষ্টি এবং আত্মাসমূহের সঙ্গে যোগাযোগ

প্রশ্ন: কোন কোন লোক বিশ্বাস করে যে, তারা আধ্যাত্মিক আবিষ্কার করে; অর্থাৎ তারা আত্মাসমূহের সহিত কথোপকথন করে। কে ধরণের কথোপকথন এটা?

উত্তর: আধ্যাত্মিক আবিষ্কারসমূহ দুই প্রকারের: এক প্রকার হচ্ছে কল্পনার এবং এটা শুধুমাত্র কতিপয় লোকের উক্তি; অন্য প্রকার হচ্ছে স্বর্গীয় প্রেরণা তুল্য এবং এটাই প্রকৃত- এরকম হচ্ছে ইসাহ্ইহা, জারমিযাহ্ ও সাধু যোহনের প্রত্যাদেশসমূহ। এইগুলিই আসল। মনে মনে গভীরভাবে চিন্তা কর যে, চিন্তাশক্তি দুই প্রকারের। এক প্রকার হচ্ছে সত্য- যখন এটা নির্ধারিত সত্যের সহিত সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। এরূপ ধারণাসমূহ বাহ্য জগতে বাস্তবায়িত হয়; এগুলি হচ্ছে নির্ভুল মতামত, সঠিক সিদ্ধান্ত বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও উদ্ভাবন।

অন্যপ্রকার ধারণাসমূহ, অলিক চিন্তা ও নিষ্ফল কল্পনা প্রসূত, যা কোন ফল দান করে না, যার কোন বাস্তবতা নেই; না, সেগুলি কল্পনার সমূদ্রের তরঙ্গমালার ন্যায় প্রচণ্ড বেগে ওঠানামা করে এবং সেগুলি অলস স্বপ্নের মত বিলীন হয়ে যায়।

অনুরূপভাবে দুই প্রকারের আধ্যাত্মিক আবিষ্কার বিদ্যমান। একটি হচ্ছে বার্তাবাহকদের প্রত্যাদেশ এবং নির্বাচিত ব্যক্তিদের আধ্যাত্মিক আবিষ্কার। বার্তাবাহকদের দুরদৃষ্টি স্বপ্ন নয়; এই দুরদৃষ্টি হচ্ছে আধ্যাত্মিক আবিষ্কার এবং এর বাস্তবতা আছে। উদাহরণস্বরূপ “কোন এক আকৃতিতে আমি একটি লোককে দেখলাম এবং আমি তাকে এরূপ বললাম এবং সে এরূপ একটি উত্তর দিল।”এই স্বপ্ন জাগ্রত অবস্থায়, ঘুমের অবস্থায় নয়। শুধু তাই নয়, এটা একটা আধ্যাত্মিক আবিষ্কার - যা স্বপ্নে আকারে যেন প্রকাশিত হয়েছে।

অন্যপ্রকার আধ্যাত্মিক আবিষ্কার হচ্ছে নিছক কল্পনা প্রসূত; কিন্তু এই সমস্ত কল্পনা এমন রূপ পরিগ্রহণ করেছে যে, সরল অন্তঃকরণ বিশিষ্ট লোকেরা বিশ্বাস করে যে, এগুলির বাস্তবতা আছে। পরিষ্কারভাবে যা কিছু প্রমাণিত হয়েছে, সেটা এই যে, আত্মাসমূহের এই নিয়ন্ত্রণ থেকে কখনো কোন ফল পাওয়া যায় নাই; না, কেচ্ছা কাহিনী ছাড়া সেগুলি আর কিছুই নয়।

জেনে রাখ যে, মানুষের বাস্তবতা, সমস্ত কিছুর বাস্তবতাকে বেষ্টন তথা অন্তর্ভূক্ত করে এব ংসমস্ত কিছুর সত্যতা, গুণাগুণ ও গুপ্ত রহস্যাবলী আবিষ্কার করে। এই জন্য এই সমস্ত শিল্পকলা, বিস্ময়কর বস্তুসমূহ, বিজ্ঞানসমূহ ও জ্ঞান মনুষ্য বাস্তবতা দ্বারা আবিষ্কৃত হয়েছে। এক সময় এই সমস্ত বিজ্ঞান, জ্ঞান ও বিস্ময়কর বস্তুসমূহ এবং চারু শিল্প নিহিত ও গুপ্ত রহস্য আবৃত ছিল; অতঃপর ক্রমে ক্রমে মানুষ বাস্তবতা এগুলিকে আবিষ্কার করে এবং অদৃশ্য জগত থেকে এগুলিকে দৃশ্যমান জগতে টেনে নিয়ে আসে। অতএব এটা সুস্পষ্ট যে, মানুষের বাস্তবতা সবকিছুকেই বেষ্টন করে। এমতে এই মনুষ্য বাস্তবতা ইউরোপ থেকে আমেরিকা আবিষ্কার করে; এটা পৃথিবীতে অবস্থান করে, কিন্তু নভোমণ্ডল আবিষ্কার করে। এটা সমস্ত কিছুর গুপ্ত রহস্যাবলীর প্রকাশক এবং যা কিছু অস্তিত্বশীল, তার বাস্তবতা সম্বন্ধে জ্ঞাত। বাস্তবতার অনুরূপ এই সমস্ত আবিষ্কার প্রত্যাদেশের সমকক্ষ- যে প্রত্যাদেশ হচ্ছে আধ্যাত্মিক জ্ঞান, স্বর্গীয় অনুপ্রেরণা এবং মানব আত্মাসমূহের সম্মেলন। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, পয়গম্বর বলেন, “আমি দেখলাম, আমি বললাম, আমি এইরূপ শুনেছিলাম।” অতএব এটা সুস্পষ্ট যে, পঞ্চ ইন্দ্রিয়, যথা চক্ষু অথবা কর্ণসমূহেরÑ এদের মধ্যস্থতা ছাড়াই আত্মার বিরাট জ্ঞান শক্তি বিদ্যমান। আধ্যাত্মিক আত্মাসমূহের মধ্যে রয়েছে আধ্যাত্মিক মতের আপস-নিস্পত্তি, আবিষ্কার, পরস্পর কথোপথন- যা চিন্তা ও কল্পনা থেকে পূত পবিত্র; সম্মেলন রয়েছে বা স্থান ও কাল থেকে পবিত্রকৃত। এই জন্য সুসমাচারে (গসপেলে) লিখিত আছে যে, তাবর পাহাড়ে মুসা ও ইলিয়াস যীশুখ্রিষ্টের কাছে এসেছিলেন এবং এটা সুস্পষ্ট যে এটা জড় (পার্থিব) সাক্ষাৎকার ছিল না। এটা ছিল আধ্যাত্মিক অবস্থা, যাকে দৈহিক তথা বাহ্যিক সাক্ষাৎকাররূপে প্রকাশ করা হয়েছে।

আত্মাসমূহের অন্য প্রকারের কথাবার্তা, উপস্থিতি ও যোগাযোগসমূহ কল্পনা ব্যতীথ আর কিছুই নয়Ñ যে কল্পনা নিছক সত্য বলে মনে হয়।

মানুষের মন ও চিন্তা মাঝে মাঝে সত্য তথ্য আবিষ্কার করে এবং এই চিন্তা ও আবিষ্কার থেকে নিদর্শনাবলী ও ফলাফল উৎপন্ন হয়। এই চিন্তার ভিত রয়েছে; কিন্তু মানুষের মনে অনেক চিন্তার উদয় হয়, যা কল্পনা সাগরের ঊর্মিমালার ন্যায়, এর ফল নেই এবং এর থেকে কোন ফল আসে না।

অনুরূপভাবে মানুষ নিদ্রা জগতে স্বপ্ন দেখে, যা সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয়; অন্য কোন সময়ে সে একটি স্বপ্ন দেখে যার সম্পূর্ণরূপে কোন ফল নেই।

আমরা যা বলতে চাচ্ছি, সেটা হল এই যে, এই অবস্থা, যাকে আমরা আত্মাসমূহের কথোপকথন ও যোগাযোগ বলি, এটা দুই প্রকারের। একটা হচ্ছে নিছক কল্পনা প্রসূত, অপর হচ্ছে ধর্মগ্রন্থে উল্লেখিত দুরদৃষ্টি যা স্বপ্নসমূহের ন্যায়- যথা- সাধু যোহনের ও ইসাইয়াহ্’র প্রত্যাদেশের ন্যায় এবং যিশু খ্রিষ্টের সহিত মুছা ও ইলিয়াসের সাক্ষাৎকার। এগুলি সত্য এবং মানুষের মনে ও চিন্তায় বিস্ময়কর প্রভাব বিস্তার করে এবং মানব মণ্ডলীর অন্তঃকরণসমূহকে আকর্ষণ করে।

52
আধ্যাত্মিক উপায়ে আরোগ্য লাভ

প্রশ্ন: কোন কোন লোক আধ্যাত্মিক উপায়ে রুগ্ন ব্যক্তিকে আরোগ্য করে, অর্থাৎ ওষুধ ব্যতীত আরোগ্য করে। কেমন করে এটা হয়?

উত্তর: জেনে রাখ ওষুধ ব্যতীত চার প্রকারের আরোগ্য আছে। দুটি হচ্ছে জড় কারণে এবং দুটি আধ্যাত্মিক কারণে।

দুই প্রকারের জড় আরোগ্যের মধ্যে, একটির কারণ হচ্ছে এই যে, মানুষের মধ্যে সুস্থতা ও পীড়া উভয়ই ছোঁয়াছে। রোগের স্পর্শ দ্বারা সংক্রমণ হচ্ছে ভয়ঙ্কর ও দ্রুত, পক্ষান্তরে দেহের স্পর্শ দ্বারা সংক্রমণ হচ্ছে খুবই দুর্বল ও মন্থর। যদি দুইটি দেহ পরস্পরের সংস্পর্শে আনা হয়, তাহলে এটা নিশ্চিত যে, রোগ জীবানু সংক্রান্ত অণু পরমাণু এক দেহ থেকে অন্য দেহে প্রবেশ করবে। অনুরূপভাবে সেই দ্রুত ও সাংঘাতিক সংক্রামণসহ এত দেহ থেকে অন্য দেহে অনুপ্রবেশ করে, এটা হতে পারে যে একজন স্বাস্থ্যবান লোকের বলিষ্ঠ স্বাস্থ্য একটি রুগ্ন ব্যক্তির মধ্যে খুব সামান্য রোগের উপশম করবে। অর্থাৎ রোগের স্পর্শ দ্বারা সংক্রমণ হচ্ছে প্রবল, এবং এর দ্রুত ফল আছে, পক্ষান্তরে স্বাস্থ্যের প্রভাব খুব মন্থর ও অল্প প্রভাব আছে এবং শুধুমাত্র খুব সামান্য পীড়ায় তার অত্যন্ত স্বল্প ফল বা প্রভাব রয়েছে। একটি স্বাস্থ্যবান দেহের প্রবলশক্তি একটি রুগ্ন দেহের সামান্য দুর্বলতাকে পরাজিত করতে পারে এবং স্বাস্থ্য ফলস্বরূপ দেখা দেয়। এই এক রকম আরোগ্য।

ওষুধ বিনা অন্য একরকমের আরোগ্য হচ্ছে চুম্বকধর্মী শক্তির মাধ্যমে, যে শক্তি এক দেহ থেকে অন্য দেহে কাজ করে এবং আরগ্যের কারণ হয়। এই শক্তিরও সামান্য ফল বা প্রভাব আছে। কোন কোন সময় একজন লোক একজন রুগ্ন ব্যক্তির মস্তকে অথবা হৃদপিণ্ডের উপর হাত রেখে তার উপকার করতে পারে। কেন? আকর্ষণ শক্তির ফলে এবং রুগ্ন ব্যক্তির উপর মানসিক ধারণা তথা প্রভাব সৃষ্টি হওয়ার কারণে- যে ধারণা বা প্রভাব রোগকে অদৃশ্য করায়। কিন্তু এই ফল বা প্রভাবও খুব অল্প ও দুর্বল।

আরোগ্যের অন্য দুই প্রকার হচ্ছে আধ্যাত্মিকÑ অর্থাৎ আরগ্যের উপকরণ হচ্ছে আধ্যাত্মিক শক্তিÑ এটা ফলপ্রসূ হয় একটি বলবান লোকের মনের সম্পূর্ণ একাগ্রতা একটি রুগ্ন লোকের উপর কেন্দ্রীভূতকরণ থেকে, রুগ্ন ব্যক্তি যখন তার সমগ্র ঐকান্তিক বিশ্বাসসহ আশা করে যে, উক্ত বলবান লোকের আধ্যাত্মিক শক্তি থেকে আরোগ্য কার্যকরী হবে এতে এরূপ পরিমণে ভাবের সৃষ্টি হয় যে, উক্ত বলাবান লোকটি ও রুগ্ন লোকটির মধ্যে একটি আন্তরিক সংযোগ গড়ে ওঠে। বলবান লোকটি রুগ্ন লোকটিকে রোগমুক্ত করার সর্বাত্মক চেষ্টা চালায় এবং রুগ্ন লোকটি তখন আরোগ্য পাওয়ায় নিশ্চিত হয়। এই মানসিক ধারণার ফল থেকে স্নায়ুর মধ্যে একটি উত্তেজনা সৃষ্টি হয় এবং স্নায়ুর এই চাপ ও এই উত্তেজনা উক্ত রুগ্ন ব্যক্তির রোগ মুক্তির কারণ হয়। এমতাবস্থায় যখন একটি রুগ্ন ব্যক্তির কোন কিছুর জন্য প্রবল আকাঙ্খা ও একান্ত আশা থাকে এবং হঠাৎ সেই আশা আকাঙ্খা বাস্তবায়নের সুসংবাদ শ্রবণ করে তখন ¯œায়ু প্রসূত একটি উত্তেজনা সৃষ্টি হয়, যা রোগকে সম্পূর্ণরূপে অদৃশ্য করে দেয়। অনুরূপভাবে যদি হঠাৎ একটি আতঙ্কের কারণ দেখা দেয়, তাহলে একটি শক্তিশালী লোকেরও স্নায়ুসমূহ উত্তেজনার সৃষ্টি হতে পারে, যা অনতিবিলম্বেই একটি রোগের কারণ হবে। উক্ত পীড়ার কারণ কোন জড় বস্তু নয়, কারণ উক্ত লোক কোন কিছু ভক্ষণ করে নাই, ক্ষতিকর কোন কিছুও তাকে স্পর্শ করে নাই; স্নায়ুসমূহের উত্তেজনাই একমাত্র উক্ত রোগের কারণ। ঐ একইভাবে, একটি বিশেষ আকাঙ্খার হঠাৎ বাস্তবায়ন এরূপ আনন্দ দান করবে যে, এর দ্বারা স্নায়ুসমূহ উত্তেজিত হবে এবং এই উত্তেজনা সুস্থ্যতার সৃষ্টি করতে পারে। উপসংহারে আধ্যাত্মিক চিকিৎসক ও রুগ্ন ব্যক্তির মধ্যে সম্পূর্ণ ও নিখুঁত সংযোগ অর্থাৎ এরূপ ধরণের একটি সংযোগ যা উক্ত আধ্যাত্মিক চিকিৎসক সম্পূর্ণরূপে কেন্দ্রীভূত করেন যাতে রুগ্ন ব্যক্তির সমগ্র মনোযোগ আধ্যাত্মিক চিকিৎসকের প্রতি নিবদ্ধ করা হয়- যে চিকিৎসকের কাছ থেকে সে সুস্থতা অর্জন করতে চায়- এই ধরণের কার্য় স্নায়ুসমূহের উত্তেজনা ঘটায় এবং সুস্থতা অর্জিত হয়। কিন্তু এসবকিছুর ফল খুব সামান্য এবং কোন কোন ক্ষেত্রে, সব সময় নয়। কারণ যদি কোন লোক সাংঘাতিক রোগে পীড়িত হয় অথবা ক্ষত বা আহত হয়, এই সমস্ত উপায় রোগ অপসরণ করতে পারবে না অথবা রক্ত বন্ধ অথবা ক্ষত আরোগ্য করতে পারবে না। অর্থাৎ সাংঘাতিক রোগ ব্যাধির ক্ষেত্রে এই সমস্ত উপায়ের কোন শক্তি নেই, যদি না ধাত (দেহ গঠন) সাহায্য করে, কারণ বলবান গঠন (ধাত) প্রায়ই রোগ পর্যুদস্ত করে। এটাই তৃতীয় প্রকারের আরোগ্য।

কিন্তু তৃতীয় প্রকার আরোগ্য পবিত্র আত্মার মাধ্যমে সম্পাদিত হয়। এটা সংস্পর্শ অথবা দৃষ্টি অথবা উপস্থিতির উপর নির্ভর করেন; এটা কোন অবস্থার উপর নির্ভর করে না। পীড়া সামান্য হোক অথবা সাংঘাতিক হোক, দেহসমূহের সংস্পর্শে হোক অথবা না হোক, রুগ্ন ব্যক্তি ও আরোগ্যকারীর মধ্যে ব্যক্তিগত সংযোগ প্রতিষ্ঠা হোক আর না হোক, এই আরোগ্য পবিত্র আত্মার দ্বারা ঘটে।

53
জড় উপায়ে আরোগ্য লাভ

গতকল্য ভোজনপর্ব চলাকালীন আমরা আরোগ্যমূলক চিকিৎসা ও আধ্যাত্মিক আরোগ্যলাভ সম্বন্ধে আলোচনা করেছিলাম, যার মধ্যে আধ্যাত্মিক শক্তিসমূহের মাধ্যমে রোগ চিকিৎসার কথাও নিহিত ছিল।

এখন জড় চিকিৎসার কথা আলোচনা করা যাক। চিকিৎসা বিজ্ঞান এখনো শিশু অবস্থায় বিদ্যমান; এটা পূর্ণতায় পৌঁছায়নি, যখন এটা এই অবস্থায় পৌঁছাবে, তখন এমন বস্তুসমূহের দ্বারা আরোগ্যের সমাধান হবে, যা মানুষের ঘ্রাণ ও আস্বাদনের কাছে বিরক্তিকর নয়; অর্থাৎ খাদ্য দ্রব্য, ফল ও শাকসবজি দ্বারা যা রুচিসম্মত ও যার ঘ্রাণ আছে। কারণ রোগ উৎপন্নকারী কারণ অর্থাৎ মানব দেহে রোগ প্রবেশের কারণÑ হয় শারীরিক কারণ অথবা স্নায়ুসমূহের উত্তেজনার ফল। কিন্তু রোগের প্রধান খরচ হচ্ছে শারীরিক; কারণ মানব দেহ অসংখ্য উপাদান দ্বারা গঠিত এবং এটা এক বিশেষ সাম্যবস্থা (সমতা)র পরিমাণে নির্ধারিত। যতক্ষণ এই সমস্ত রক্ষা করা যায়, ততক্ষণ মানুষ রোগ থেকে সংরক্ষিত থাকে। কিন্তু যদি এই অত্যাব্যশক ভারসাম্য- যা হচ্ছে দেহ গঠনের মূলবস্তু ব্যাহত হয়, তাহলে উক্ত গঠন (ধাত) বিকল হয়ে পড়ে এবং পীড়া এসে হাজির হয়।

উদাহরণস্বরূপ ধরা যাক মানব দেহের প্রয়োজনীয় উপাদানসমূহের কোন একটিতে ভাটা পড়ল এবং অপর একটিতে বৃদ্ধি পেল; এক্ষেত্রে সমতার অনুপাত ব্যাহত হল- তাহলে পীড়া অবশ্যম্ভাবী। উদাহরণস্বরূপ একটি উপাদানকে অবশ্যই ওজনের এক হাজার গ্রাম হতে হবে, অপরটিকে পাঁচ গ্রাম হতে হবে, যাতে সমতা রক্ষিত হতে পারে। যে অংশ এক হাজার গ্রাম তা হ্রাস পেয়ে সাতশত গ্রামে যদি আসে এবং যে অংশ পাঁচ গ্রাম সেটা যদি বৃদ্ধি পায়, তাহলে সমতার পরিমাণ ব্যাহত হল- এক্ষেত্রে রোগের উৎপত্তি অনিবার্য। প্রতিকার ও চিকিৎসার দ্বারা যখন ভারসাম্য তথা সমতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়, তখনই রোগ নির্বাসিত হয়। অতএব যদি স্ব্যাকারিণ উপাদান বৃদ্ধি পায়, তাহলে স্বাস্থ্য দুর্বল হয়ে পড়ে এবং যখন ডাক্তার মিষ্টি ও শ্বেতসারযুক্ত খাদ্য খেতে নিষেধ করেন, তখন সম্ভাকারিণ উপাদান হ্রাস পায় এবং সমতা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয় এবং রোগ বিতাড়িত হয়। এখন মানব দেহের এই উপাদানগুলির পুনঃ সমন্বয় সাধন দুই উপায়ে লাভ করা যায়- হয় ওষুধ অথবা খাদ্য দ্রব্যের দ্বারা এবং যখন উক্ত গঠন (ধাত) তার সমতা ফিরিয়ে আনতে পারে, তখন পীড়া নির্বাসিত হয়। যে সমস্ত পদার্থ তথা উপাদান মানুষের মধ্যে সংযুক্ত, তা শাক সবজির মধ্যেও বিদ্যমান রয়েছে; অতএব মানবদেহ গঠনকারী উপাদানসমূহের মধ্যে কোন একটি যদি হ্রাস পায় এবং সে যতি এমন খাদ্য গ্রহণ করে, যার মধ্যে হ্রাসপ্রাপ্ত উপাদানের যথেষ্ট পরিমাণ বিদ্যমান রয়েছে, তাহলে সমতা প্রতিষ্ঠিত হবে, তাহলে আরোগ্য লাভ করা যাবে। যতক্ষণ দেহের উপাদানসমূহের পুনঃসমন্বয় সাধন হচ্ছে লক্ষ্য, ততক্ষণ সেটা হয় ওষুধ অথবা খাদ্যের দ্বারা ফলপ্রসূ হতে পারে।

অধিকাংশ রোগই যা মানুষকে আক্রমণ করে, তা ইতর প্রাণীকেও আক্রমণ করে; কিন্তু ইতর প্রাণী ওষুধ সেবনের দ্বারা আরোগ্য প্রাপ্ত হয় না। যেমন পর্বতসমূহে, তেমনি মরুভূমিতে পশুকুলের চিকিৎসক হচ্ছে আস্বাদন ও ঘ্রাণশক্তি। রুগ্ন পশু উদ্ভিদের ঘ্রাণ নেয়- যে উদ্ভিদ মরুভ‚মিতে জন্মে , সে সেইসব উদ্ভিদকেই ভক্ষণ করে যেগুলি তার ঘ্রাণ আস্বাদের উপযোগী মিষ্ট ও সুগন্ধযুক্ত, ফলে সে আরোগ্য লাভ করে। তার আরোগ্যের কারণ হল এই। যখন তার ধাতে স্ব্যাকারিণ উপাদান হ্রাস হয়ে থাকে, তখন সে মিষ্ট জিনিসের আকাঙ্খা করে। ফলে সে মিষ্ট আস্বাদ যুক্ত গুল্ম ভক্ষণ করে, কারণ প্রকৃতি তাকে সামনের দিকে ঠেলে দেয় ও সঠিক স্থানে পরিচালনা করে। এর ঘ্রাণ ও আস্বাদ তাকে সন্তুষ্ট করে এবং সে তা ভক্ষণ করে। উক্ত স্ব্যকারিণ উপাদান তার প্রকৃতিতে বৃদ্ধি পাবে এবং তার স্বাস্থ্য পূর্বাবস্থায় ফিরে আসবে।

অতএব এটা সুস্পষ্ট যে, খাদ্য ও ফলমূলের দ্বারা আরোগ্য লাভ করা সম্ভব; কিন্তু যেহেতু আজ চিকিৎসা বিজ্ঞান অপূর্ণ রয়েছে, সেহেতু এই তথ্য এখনও সম্পূর্ণরূপে অনুধাবন করা যায় নাই। যখন চিকিৎসা বিজ্ঞান পূর্ণতা লাভ করবে, তখন খাদ্য, পরিপুষ্টি, সুগন্ধি ফল ও শাকসবজি এবং তাপমাত্রায় গরম ও ঠান্ডা বিভিন্ন পানীয় দ্বারা চিকিৎসা করা হবে।

এই আলোচনা সংক্ষিপ্ত, কিন্তু আল্লাহ যদি ইচ্ছা করেন, তবে অন্য এক সময়, উপযুক্ত উপলক্ষ্যে, এই প্রশ্ন আরো পূর্ণভাবে ব্যাখ্যা করা হবে।

বিভিন্ন বিষয়ে

54
বা অনিষ্টের অনস্তিত্ব (অনিস্তত্বহীনতা)

এই বিষয়ের প্রকৃত ব্যাখ্যা খুবই কঠিন। জেনে রাখ যে অস্তিত্বসমূহ দুই প্রকারের: জড় ও আধ্যাত্মিক তথা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অস্তিত্ব ও বুদ্ধিবৃত্তি সংক্রান্ত অস্তিত্ব।

ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুগুলি হচ্ছে সেইগুলি, যেগুলি বাহ্যিক পঞ্চ ইন্দ্রিয় দ্বারা অনুভব করা যায়; এমতে বাহ্যিক অস্তিত্বসমূহ যা চক্ষু দর্শন করে, তাকে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বলে। বুদ্ধিবৃত্তি সংক্রান্ত বস্দুসমূহ হচ্ছে সেগুলি, যার বাহ্যিক কোন অস্তিত্ব নেই, কিন্তু সেগুলি মনের ধারণা শক্তি। উদাহরণস্বরূপ মন স্বয়ংই একটা বুদ্ধিবৃত্তি সংক্রান্ত বস্তু, যার কোন বাহ্যিক অস্তিত্ব নেই, সমস্ত মানুষের চরিত্র বৈশিষ্টসমূহ ও গুণাবলী বুদ্ধিবৃত্তি সংক্রান্ত অস্তিত্বের পরিচায়ক এবং এগুলি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়।

সংক্ষেপে বুদ্ধিবৃত্তি সংক্রান্ত বাস্তবতাসমূহ (প্রকৃত সত্ত্বা) যথা মানুষের সমস্ত গুণাবলী ও পরোৎকর্ষসমূহ সম্পূর্ণরূপেই ভাল তথা মঙ্গল এবং টিকে থাকে। মন্দ হচ্ছে নিছক ঐগুলির অনসস্তিত্ব। অতএব অজ্ঞতা হচ্ছে জ্ঞানের অভাব, ভুল তথা ভ্রান্তি হচ্ছে ঠিক পথে পরিচালনের অভাব, বিস্মৃতি হচ্ছে স্মরণ শক্তির অভাব , নিবৃদ্ধিতা হচ্ছে সুবুদ্ধির অভাব। এই সমস্ত জিনিসের কোন অস্তিত্ব নেই।

অনুরূপভাবে ইন্দ্রিয়গ্রহ্যি বাস্তবতাসমূহ সম্পূর্ণরূপেই ভাল বা মঙ্গল জনক এবং উক্ত বাস্তবতাসমূহ অনস্তিত্বই হচ্ছে মন্দ বা অনিষ্ট, অর্থাৎ অন্ধত্ব হচ্ছে দৃষ্টিশক্তির অভাব, বধিরতা হচ্ছে শ্রবণ শক্তির অভাব, দারিদ্রতা হচ্ছে সম্পদের অভাব, পীড়া হচ্ছে সুস্থতার অভাব, মৃত্যু হচ্ছে জীবনের অভাব এবং দুর্বলতা হচ্ছে শক্তির অভাব।

তবুও মনের মধ্যে সন্দেহ উকি দেয়;অর্থাৎ বিচ্ছু ও সর্প বিষাক্ত। এরা কি ভাল অথবা মন্দ, কারণ এরা জীবন্ত অস্তিত্ব? হ্যা, একটি বিচ্ছু মানুষের সম্পর্কে মন্দ বা অমঙ্গল; একটি সর্প মানুষের সম্পর্কে মন্দ বা অমঙ্গল; কিন্তু তাদের নিজেদের সম্পর্কে তারা মন্দ বা অমঙ্গল নয়; কারণ তাদের বিষ তাদের অস্ত্র এবং তাদের দংশনের দ্বারা তারা নিজেদেরকে রক্ষা করে। কিন্তু যেহেতু তাদের বিষের উপাদানসমূহ আমাদের উপাদানসমূহের সহিত সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, অর্থাৎ সেহেতু এই বিভিন্ন উপাদানগুলির মধ্যে বিরুদবধতা রয়েছে, সেহেতু এই বিরুদ্ধতা মন্দ বা অমঙ্গল; কিন্তু প্রকৃত পক্ষে তাদের সম্পর্কে এগুলি উত্তম।

এই আলোচনার সংক্ষিপ্তসার হচ্ছে এই যে, একটি বস্তু অপর একটি বস্তুর সম্পর্কে মন্দ বা অনিষ্টকর হতে পারে এবং একই সময় নিজের গণ্ডীর মধ্যে এটা মন্দ বা অমঙ্গল নাও হতে পারে। তাহলে এটা প্রমাণিত হল যে, অস্তিত্বের মধ্যে মন্দ বা অমঙ্গল নেই; যা কিছু আল্লাহ্ সৃষ্টি করেছেন, তিনি উত্তম সৃষ্টি করেছেন। এই মন্দ বা অমঙ্গল অনস্তিত্ব; সুতরাং মৃত্যু হচ্ছে জীবনের অনুপস্থিতি। যখন মানুষ আর জীবন ধারণ করে না, সে মারা যায়। অন্ধকার হচ্ছে আলোর অনুপস্থিতি; যখন আলো থাকে না, তখন অন্ধকার হয়। আলো একটি জীবন্ত বস্তু, অন্ধকার অস্তিত্ববিহীন। ধন সম্পদ অস্তিত্বশীল বস্তু, কিন্তু দারিদ্রতা অস্তিত্ববিহীন।

তাহলে এটা সুস্পষ্ট যে, সমুদয় মন্দ বা অমঙ্গল, অনস্তিত্বে প্রত্যাবর্তন করে। মঙ্গল জীবিত থাকে, অমঙ্গল অস্তিত্ববিহীন।

55
দুই প্রকারের দৈহিক ও মানসিক যন্ত্রণা

জেনো রাখ যে দুই প্রকারের যন্ত্রণা বিদ্যমান; সুক্ষ্ম ও স্থুল। উদাহরণস্বরূপ অজ্ঞতা স্বয়ংই একটা যন্ত্রণা, কিন্তু এটা একটি সুক্ষ্ম যন্ত্রণা; আল্লাহর প্রতি ঔদাস্য স্বয়ংই একটা যন্ত্রণা, অনুরূপভাবে নিষ্ঠুরতা, মিথ্যাচার, এবং বিশ্বাসঘাতকতার সম্বন্ধে ঐ একই কথা। সমুদয় অপূর্ণতাই যন্ত্রণা ; কিন্তু এগুলি সুক্ষ্ম যন্ত্রণা। নিশ্চিতই একজন বুদ্ধিমান লোকের পক্ষে পাপ অপেক্ষা মৃত্যুই উত্তম এবং মিথ্যা কখন অথবা নিন্দাপবাদ দেওয়া অপেক্ষা একটি কর্তিত রসনাই উত্তম।

অন্য প্রকার যন্ত্রণা হচ্ছে স্থুল; যথা জরিমানা, কারাবরণ, প্রহার, নির্বাসন, দেশান্তর। কিন্তু আল্লাহ্র জনমণ্ডলীর পক্ষে আল্লাহ থেকে বিচ্ছেদ হচ্ছে সর্বাপেক্ষা বৃহত্তম যন্ত্রণা।

56
ন্যায় বিচার ও অল্লাহ্র কৃপা

জেনে রাখ যে ন্যায় বিচার করা হচ্ছে প্রত্যেককে তার যোগ্য পুরষ্কার বা শাস্তি অনুযায়ী পাওনা দেওয়া। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, যখন একজন শ্রমিক সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পরিশ্রম করে, তখন ন্যায় বিচারের প্রশ্ন হয়ে দাড়ায় যে তাকে তার বেতন দিতে হবে; কিন্তু যখন সে কোন কাজ করে নাই এবং কোন কষ্ট করে নাই, তখন তাকে যে দান করা হয়, এটাই বদান্যতা। যদি তুমি একজন দরিদ্র লোককে ভিক্ষা ও দান দাও, যদিও সে তোমার জন্য কোন কষ্ট করে নাই এবং এটা পাওয়ার উপযুক্ত কোন কাজও করে নাই, এটাই বদান্যতা। এমতে যীশুখ্রিষ্ট তাঁর হত্যাকারীদের জন্য ক্ষমা ভিক্ষা করেছিলেন, একেই বদান্যতা বলা হয়।

এক্ষনে কোন কিছুর ভাল অথবা মন্দের প্রশ্ন, যুক্তি অথবা আইন দ্বারা নির্ধারিত হয়। কতক লোক বিশ্বস করে যে এটা আইন দ্বারা নির্ধারিত। এরূপ লোক হচ্ছেন ইহুদীরা, যারা বাইবেলের প্রথম পাঁচখানি গ্রন্থের সমুদয় আদেশসমূহকে সম্পূর্ণরূপে বাধ্যতামূলক বলে বিশ্বাস করে, উক্ত আদেশসমূহকে আইনের বিষয়রূপে গণ্য করেন- যুক্তির বিষয় নয়। এমতে তারা বলে যে, বাইবেলের প্রথম পাঁচখণ্ডের আদেশসমূহের মধ্যে একটি হচ্ছে এই যে, মাংস ও মাখন এক সঙ্গে খাওয়া বিধি বহির্ভূত, কারণ এটা “তারেফ” এবং হিব্রূ ভাষায় “তারেফ” অর্থ “অপবিত্র”, যেমন “কোসার” অর্থ পবিত্র। তারা বলে এটা আইনের প্রশ্ন, যুক্তির নয়।

কিন্তু ধর্মতত্তবিদেরা বলেন যে, কোন কিছুর ভাল মন্দ যুক্তি ও আইন উভয়ের উপর নির্ভর করে। চৌর্যবৃত্তি, বিশ্বাসঘাতকতা, মিথ্যা কথন, ভণ্ডামী ও নিষ্ঠুরতা নিষিদ্ধকরণের প্রধান ভিত হচ্ছে যুক্তি। প্রত্যেক বুদ্ধিমান লোক হৃয়ঙ্গম করে যে, খুন, চৌর্যবৃত্তি, বিশ্বাসঘাতকতা, মিথ্যাভাষণ, কপটতা এবং নিষ্ঠুরতা মন্দ এবং নিন্দাযোগ্য, কারণ যদি তুমি কোন লোককে কণ্টক দ্বারা খোঁচা দাও, সে চিৎকার করে উঠবে, অভিযোগ করবে এবং আর্তনাত করবে। সুতরাং এটা সুস্পষ্ট যে, সে বুঝবে যে যুক্তি অনুসারে খুন মন্দ ও তিরষ্কার যোগ্য। যদি সে খুন করে তবে সে দায়ী হবে, তাই বার্তাবাহকদের খ্যাতি তার কাছে পৌছুক অথবা না পৌছুক; কারণ এটা যুক্তি বা কার্যের নিন্দাযোগ্য বৈশিষ্ট্যকে সূত্রাকারে প্রকাশ করে। মানুষ যখন এই কুকর্ম করবে, সে নিশ্চয়ই দায়ী হবে।

কিন্তু যে স্থানে বার্তাবাহকদের আদেশাবলী জানা নেই এবং যেখানে জমণ্ডলী স্বগীয় নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করে না, তথা যীশুখ্রিষ্ট নির্দেশিত অমঙ্গলের বিনিময়ে মঙ্গলের আদেশ অনুযায়ী কাজ করে না, অথচ প্রকৃতির তাগিদানুযায়ী কাজ করে অর্থাৎ যারা তাদের যন্ত্রণা দেয়, তারা তাদের যন্ত্রণা দেয়- ধর্মের দৃষ্টিকোণ থেকে তারা রেহাই প্রাপ্ত, কারণ স্বর্গীয় আদেশ নির্দেশ তাদের কাছে ঘোষণা করা হয় নাই। যদিও তারা ক্ষমা ও দয়া পাওয়ার উপযুক্ত নয়, তবু আল্লাহ্ তাদের ক্ষমা ও অনুগ্রহ করবেন।

এক্ষন যুক্তি অনুযায়ী প্রতিশোধ ও নিন্দনীয়, কারণ প্রতিশোধের মাধ্যমে প্রতিশোধ গ্রহণকারী কোন সুফল প্রাপ্ত হয় না। সুতরাং যতি একজন লোক অপর একটি লোককে আঘাত করে এবং যে আঘাতপ্রাপ্ত হয়, সে যদি পক্ষাঘাতের দ্বারা প্রতিশোধ গ্রহণ করে, তাহলে কি উপকার সে লাভ করবে? এটা কি তার ক্ষতের মলম বা যন্ত্রণার উপশমকারক কিছু হবে? না, খোদা না করুন। প্রকৃতপক্ষে দুটি কাজই এক, উভয়ই অনিষ্ট; শুধুমাত্র পার্থক্য এই যে, একটি প্রথমে ঘটেছিল এবং অপরটি পরে। এমতাবস্থায় যে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছিল, সে যদি ক্ষমা করে, শুধু তাই নয়, তার প্রতি যা করা হয়েছে, সে যদি তার বিপরীত ধরণের কাজ করে, তাহলে সেটা প্রশংসনীয়। সম্প্রদায়ের আইন প্রথম আক্রমণকারী ব্যক্তিকে শাস্তি দান করবে, কিন্তু প্রতিশোধী গ্রহণ করবে না। নিষ্ঠুরতা ও আইন লঙ্ঘণ প্রতিহত করতে, সতর্ক করতে, রক্ষা করার নিমিত্তে এই শাস্তির লক্ষ্য, যাতে অন্য লোকেরা অত্যাচারী হতে না পারে।

কিন্তু যে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে, সে যদি ক্ষমা করে, তাহলে সে সর্বাপেক্ষা বৃহত্তম দয়া প্রদর্শন করেছে। এটা প্রশংসা যোগ্য।

57
অপরাধীদের সঙ্গে আচরণের সঠিক পদ্ধতি

প্রশ্ন: একজন অপরাধীর কি শাস্তি দিতে হবে অথবা ক্ষমা করতে হবে অথবা অবজ্ঞা করতে হবে?

উত্তর: দুই প্রকারের প্রতিশোধমূলক শাস্তি আছে। একটি হচ্ছে প্রতিশোধ, অপরটি হচ্ছে সংশোধনের জন্য শাস্তি প্রদান। কিন্তু মানুষের প্রতিশোধ গ্রহণের অধিকার নেই; তবে লোক সমাজের অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার অধিকার আছে এবং এই শাস্তি হচ্ছে সতর্ক ও নিবারণ করার উদ্দেশ্যে, এই জন্য যাতে অপর কোন লোক অনুরূপ অন্যায় করতে সাহস না করে; এই শাস্তি প্রদান হচ্ছে মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য, কিন্তু এটা প্রতিশোধ গ্রহণ নয়; প্রতিশোধ এক অমঙ্গল থেকে অপর এক অমঙ্গলের প্রতিরোধের দ্বারা অন্তরের ক্রোধ তুষ্ট করে। এটা অনুমোদনযোগ্য নয়, কারণ মানুষের প্রতিশোধ গ্রহণের কোন অধিকার নেই। কিন্তু অপরাধী ব্যক্তিকে যদি একেবারে ক্ষমা করা হয় তাহলে পৃথিবীর নিয়ম শৃঙ্খলা উল্টে যাবে। সুতরাং শাস্তি প্রদান, জনসমাজের নিরাপত্তার জন অপরিহার্য একটি প্রয়োজন, কিন্তু অপরাধীর দ্বারা যে উৎপীড়িত হয়, তার প্রতিশোধ গ্রহণ করার কোন অধিকার নেই। পক্ষান্তরে অত্যাচারিত ব্যক্তির জন্য ক্ষমা করতে হবে কারণ মনুষ্য সংসারের এটাই উত্তম কাজ।

জনসমাজ অবশ্যই অত্যাচারীকে, খুনীকে, অপরাধীকে শাস্তি দান করবে; অনুরূপ অপরাধ করা থেকে অন্যদের নিবৃত্ত করা ও সতর্ক করার জন্য এটা করতে হবে। কিন্তু সর্বাপেক্ষা অপরিহার্য বস্তু হচ্ছে এই যে, জনসাধারণকে এরূপভাবে শিক্ষিত করে তুলতে হবে, যাতে কোন অপরাধই কৃত না হয়; কারণ জনসাধারণকে এরূপ সার্থকভাবে শিক্ষিত করে তোলা সম্ভব, যাতে অপরাধ করা থেকে তারা সঙ্কুচিত থাকবে ও অপরাধ এড়িয়ে চলবে, যাতে অপরাধই তাদের কাছে সর্বাপেক্ষা বৃহত্তম শাস্তি, নিন্দা ও যন্ত্রণা বলে মনে হবে। ফলে শাস্তিযোগ্য কোন অপরাধ কেউ করবে না।

আমাদের এমন কিছুর কথা বলতে হবে, যা এই পৃথিবীতে সম্পাদন করা সম্ভব। এই বিষয়ে অনেক মতবাদ ও উচ্চ পরিকল্পনা আছে যা সহজ নয়, ফলে আমাদের এমন কোন কিছুর কথা বলতে হবে, যা সহজসাধ্য।

উদাহরণস্বরূপ যদি কোন লোক অন্য কাউকে উৎপীড়ন করে, যখম করে এবং অত্যাচার করে এবং উক্ত অত্যাচারিত ব্যক্তি যদি তাকে প্রতিঘাত করে, তাহলে এটা প্রতিশোধ এবং এটা নিন্দনীয়। যদি আমরুর পুত্র হায়েদের পুত্রকে হত্যা করে, তবে আমরুর পুত্রকে হত্যা করার অধিকার জায়েদের নেই। যদি সে তা করে, তবে এটাই প্রতিশোধ। যদি আমরু জায়েদকে অপমান করে, তবে জায়েদের আমরুকে অপমান করার কোন অধিকার নেই। যদি সে তা করে তবে সেটাই প্রতিশোধ এবং এটা খুবই নিন্দনীয়। না, বরং সে অন্যায়ের বিরুদ্ধে তার প্রতি ভাল ব্যবহার করবে, এবং সে শুধুমাত্র তাকে ক্ষমা করবে না বরং যদি সম্ভব হয় তবে সে উক্ত অত্যাচারীর উপকার করবে। এই আচরণই মানুষের উপযুক্ত; কারণ প্রতিশোধ গ্রহণের দ্বারা সে কি উপকার লাভ করবে? দুইটি কাজই এক; যদি একটি কাজ নিন্দনীয় হয়, তাহলে উভয়টিই নিন্দনীয়। শুধু পার্থক্য এইটুকু যে, একটি প্রথমে করা হয়েছে আর একটি পরে করা হয়েছে।

কিন্তু জনসমাজের আত্মরক্ষা ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণের অধিকার আছে; তবে জনসমাজের খুনীর প্রতি বৈরীতা ও ঘৃণা পোষণ করার কোন অধিকার নেই। জনসমাজ তাকে কারারুদ্ধ করবে বা শাস্তি দিবে শুধুমাত্র অন্যান্য লোকদের নিরাপত্তা ও আশ্রয় প্রদানের নিমিত্তে। খুনীদের প্রতিশোধ গ্রহণের উদ্দেশ্যে নয়, শুধুমাত্র শাস্তির উদ্দেশ্যে, যাতে জনসমাজ প্রতিপালিত হতে পারে। যদি জনসমাজ ও নিহত জনের উত্তরাধীকারীরা ক্ষমা করে ও মন্দের বিনিময়ে মঙ্গল করে, তাহলে নিষ্ঠুর ব্যক্তিরা অবিরত অন্য লোকদের অত্যাচার করতে থাকবে এবং খুন-জখম অবিরত চলতে থাকবে। নেকড়ে বাঘের ন্যায় পাপিষ্ঠ তথা দুরাচার ব্যক্তিরা আল্লাহর মেষকুল ধ্বংস করবে। শাস্তি প্রয়োগ ক্ষেত্রে জনসমাজের কোন কুমতলব ও বিদ্বেষ নেই এবং জনসমাজ অন্তরের ক্রোধ উপশসের আকাঙ্খা করে না, এর উদ্দেশ্য হচ্ছে শাস্তির দ্বারা অন্যান্যদের রক্ষা করা যাতে কোন নিষ্ঠুর কার্যাবলী সংঘঠিত হতে না পারে।

এমতে যিশুখ্রিষ্ট যখন বলেন, “যে কেউ তোমার দক্ষিণ গণ্ডে চপেটাঘাত করবে, তার দিকে তোমার বাম গণ্ডও ফিরিয়ে ধরবে”ব্যক্তিগত প্রতিশোধ না নেওয়ার শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যেই এরূপ বলা হয়েছিল। এতে তিনি এটা বোঝাতে চাননি যে যদি একপাল মেষের উপর একটি নেকড়ে বাঘ পড়ে, তাহলে উক্ত নেকড়ে বাঘকে উক্ত মেষপালকে বিনাশ করবার জন্য উৎসাহিত করতে হবে। না, যদি যীশুখিষ্ট জানতেন যে, মেষ পালের মধ্যে নেকড়ে বাঘ ঢুকেছে এবং তাদের ধ্বংস করতে উদ্যত হয়েছে, তাহলে অবশ্যই তিনি এটা প্রতিহত করতেন।

করুণাময় আল্লাহর গুণাবলীর মধ্যে ক্ষমা যেমন একটি গুণ ,তেমনি পরম প্রভুর গুণাবলীর মধ্যে ন্যায়পরতাও একটি গুণ। অস্তিত্বের তাবু ন্যায়পরতার (ন্যায়বিচারের) স্তম্ভের উপর স্থাপিত, ক্ষমার উপর নয়। মানবজাতির ধারাবাহিকতা ন্যায়বিচারের উপর নির্ভর করেÑ ক্ষমার উপর নয়। সুতরাং যদি বতর্সানে সমস্ত দেশে ক্ষমার আইন চালু করা হয়, তাহলে অল্পকালের মধ্যে পৃথিবী বিশৃঙ্খলগ্রস্থ হয়ে পড়বে এবং মানব জীবনের ভিতসমূহ টুকরো টুকরো হয়ে পড়বে। উদাহরণস্বরূপ যদি ইউরোপির সরকারগুলি কুখ্যাত আট্টিল্লাকে প্রতিহত না করতেন, তাহলে সে একটিও জীবন্ত লোক রাখত না।

কোন কোন লোক রক্ত পিপাসু নেকড়ে বাঘ সদৃশ; তারা যদি আসন্ন কোন শাস্তি না দেখতে পায়, তাহলে নিছক আমোদ প্রমোদের জন্য তারা মানুষ হত্যা করবে। পারস্যের একজন সেচ্ছাচারী শাসক নিছক আনন্দোৎসব, বদ তামাসার জন্য তার গৃহ শিক্ষককে হত্যা করেছিল। আব্বাসীর বিখ্যাত খলিফা মতাওয়াক্কিল তাঁর মন্ত্রী, উপদেষ্টা ও কর্মচারীদের, তাঁর সামনে ডেকে উক্ত জমায়েতের মধ্যে একটি কিছু পূর্ণ বাক্স খুলে দেন এবং প্রত্যেককে নড়তে নিষেধ করেন। যখন উপস্থিত ব্যক্তিদের উক্ত বিচ্ছুগুলি দংশন করলো, তখন তিনি অট্টহাসিতে ফেটে পড়েন।

সংক্ষেপে পুনরায় বলছিঃ জনসমাজের সংবিধান ন্যায়বিচারের উপর নির্ভর করেÑ ক্ষমার উপর নয়। এমতে ক্ষমার কথা যিশুখ্রিষ্ট যা বলেছেন তার অর্থ এই নয় যে, কোন জাতি যখন তোমাদের আক্রমণ করবে, তোমাদের বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে দেবে, তোমাদের মালামাল লুণ্ঠণ করবে, তোমাদের স্ত্রী, শিশু সন্তানদের আত্মীয় স্বজনদের উপর প্রচণ্ড আক্রমণ করবে ও তোমাদের সন্তান হানি করবে, তখন তোমরা এই সমস্ত শত্রæদের সামনে অনুগত থাকবে এবং তাদেরকে তাদের ইচ্ছামত নিষ্ঠুরতা ও উৎপীড়ণ করতে দেবে। না, যীশুখ্রিষ্টের বাণী দুইজন লোকের পরস্পরের মধ্যে আচরণের প্রতি আরোপ করে। যদি একজন লোক অপর একজন লোককে আক্রমণ করে, তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি তাকে ক্ষমা করবে। কিন্তু জনসমাজ অবশ্যই মানুষের অধিকার রক্ষা করবে। অতএব যদি কোন লোক আমাকে আঘাত করে, যখম করে, উৎপীড়ণ করে, ক্ষতি করে, তাহলে আমি কোন বাধা দেব না, এবং আমি তাকে ক্ষমা করবো। কিন্তু যদি কোন লোক আমাদের সঙ্গে এই যে সৈয়দ মাসাদি বসে আছে, একে যদি কেউ আক্রমণ করে, তাহলে নিশ্চিতই আমি তাকে বাধা দেব। যদিও অপরাধীর পক্ষে হস্তক্ষেপ না করা দৃশ্যতঃ একটি অনুকম্পা, তবুও এটা মাসাদির প্রতি একটা অত্যাচার হবে। এই মুহূর্তে উন্মুক্ত তরবারি হাতে যদি একজন বন্য আরব এখানে তোমাকে আক্রমণ, যখম ও হত্যা মানসে প্রবেশ করে, এটা অত্যন্ত সত্য যে আমি তাকে বাধা দেব; আমি যদি তোমাকে উক্ত আরবের কাছে পরিত্যাগ করি তাহলে সেটা ন্যায়পরতা হবে না বরং অন্যায় হবে। কিন্তু সে যদি আমার ব্যক্তিগত ক্ষতি করে, আমি তাকে ক্ষমা করবো।

আরো একটি কথা বলার রয়েছে: সেটা এই যে, জন সম্প্রদায়গুলি দিবারাত্র ফৌজদারী আইন কানুন প্রণয়ণে এবং শাস্তির মাধ্যম ও উপায় প্রস্তুত ও সংগঠনে ব্যস্ত। তারা কারাগার জেলখানা নির্মাণ করে শৃঙ্খল ও পদ শৃঙ্খল তৈরী করে, নির্বাসন ও দেশান্তরের স্থানসমূহের ব্যবস্থা করে, বিভিন্ন প্রকার দুঃখ কণ্ট ও যন্ত্রণার পন্থা উদ্ভাবন করে এবং এই সমস্ত উপায়ের দ্বারা অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণের চিন্তা করে। পক্ষান্তরে বাস্তবে তারা নীতিসমূহ ধ্বংস ও চরিত্র বৈশিষ্ট্যের বিকৃতি ঘটাচ্ছে। পক্ষান্তরে জনসাধারণের উচিত দিবারাত্র জনসাধারণের শিক্ষা বিস্তারে যথাসাধ্য আগ্রহ ও চেষ্টা সহকারে কঠোর পরিশ্রম করা, দিন দিন তাদেরকে উন্নতি করতে ও জ্ঞান বিজ্ঞানে অগ্রসর হতে, গুণ অর্জন করতে, সুনীতি অনুসরণ করতে ও পাপ বর্জন করতে উদ্বুদ্ধ করা, যাতে অপরাধ না ঘটতে পারে। বর্তমান সময়ে বিপরীতটাই বিরাজ করছে; জনসমাজ সর্বদাই ফৌজদারী আইন কানুন বলবৎ, শাস্তির উপায়, মৃত্যু ও শাসনের মাধ্যম, কারারুদ্ধকরণ ও নির্বাসনের স্থানসমূহের কথা চিন্তা ভাবনা করছে; এবং তারা অপরাধ সংঘটিত হওয়ার আশা করছে। এর চরিত্রহীনকারী একটি দিক আছে।

কিন্তু যদি জনসমাজ জনসাধারণকে শিক্ষিত করে তোলার চেষ্টা করতো, তাহলে দিন দিন জ্ঞান ও বিজ্ঞান বৃদ্ধি পেত, ধীশক্তি প্রসারিত হত, অনুভূতির সুক্ষ্মতা বিকশিত হত, রীতিনীতি উত্তম হত, নৈতিক চরিত্র স্বাভাবিক হত; এক কথায় পরোৎকর্ষসমূহ এই দিকগুলিতে উন্নতি হত এবং অন্যায় প্রায় সংঘটিত হত না।

এটা নিরুপন করা হয়েছে যে, সভ্য জাতিগুলির মধ্যে অপরাধ, অসভ্য জাতিসমূহের মধ্যে সংঘটিত অপরাধ অপেক্ষা কম সংঘটিত হয় অর্থাৎ তাদের মধ্যে যারা প্রকৃত সভ্যতা অর্জন করেছে- যে সভ্যতা স্বর্গীয় সভ্যতা তথা তাদের সভ্যতা যারা সমুদয় আধ্যাত্মিক ও জড় পরোৎকর্ষসমূহকে সংযুক্ত করেছে।

অতএব অপরাধীদের কঠোর শাস্তি দেওয়া অপেক্ষা জনসমাজকে অবশ্যই অপরাধসমূহ নিবারণের কথা চিন্তা করতে হবে।

58
ধর্মঘট

তোমরা আমাকে ধর্মঘট সম্বন্ধে প্রশ্ন করেছ? এই প্রশ্ন হচ্ছে এবং বহুকাল যাবৎ একটি কঠিন বিষয় হয়ে দাড়াবে। দুই কারণে ধর্মঘট হয়ে থাকে। একটি হচ্ছে পুঁজিবাদী ও কারখানা মালিকদের চরম তীক্ষèতা ও লোলুপতা; আর একটি হচ্ছে শ্রমিক ও কারিগরদের বাড়াবাড়ি, লালসা ও কুমতলব। অতএব এই দুটি কারলেন প্রতিকার করা অপরিহার্য।

কিন্তু এই অসুবিধাগুলির প্রধান কারণ বর্তমান সভ্যতার আইন-কানুনে নিহিত রয়েছে; কারণ এই আইন-কানুনগুলি মুষ্টিমেয় ব্যক্তিকে তাদের প্রয়োজন অপেক্ষাও তুলনাবিহীন ধনসম্পদ জমানোর সুযোগ করে দেয়, পক্ণান্তরে এক বিরাট সংখ্যাক লোক নিঃস্ব, বঞ্চিত ও চরম দুঃখ দৈন্যের মধ্যে কালাতিপাতদ করে। এটা ন্যায়পরতা, মানবতা,ও ন্যায়বিচারের পরিপন্থী। এটা পাপের চরম, স্বগীয় সন্তুষ্টির পরিপন্থী।

এই বৈষম্য-প্রদর্শন মানব সংসারের নিজস্ব সৃষ্টি; অন্যান্য প্রাণী কুলের ক্ষেত্রে একটি ন্যায়পরতা ও সমতা দৃষ্ট হয়। এমতে মেষপালকের মেষপালে, হরিণদলে, বিস্তীর্ণ প্রান্তরে পক্ষীকুলের মধ্যে, তৃণ ক্ষেত্রে, পর্বতে অথবা ফলের বাগানের প্রায় প্রত্যেক ইতর প্রাণী সমতার ভিত্তিতে ঠিক অংশ লাভ করে। তাদের মধ্যে, অস্তিত্ব ধারণের উপকরণে এরূপ পার্থক্য দৃষ্ট হয় না; ফলে তারা সর্বাপেক্ষা পূর্ণ শান্তি ও আনন্দের মধ্যে বাস করে।

মনুষ্য প্রজাতির ক্ষেত্রে এটা সম্পূর্ণ বিপরীতÑ যা বৃহত্তম ভ্রন্তি ও পাপের মধ্য দিয়ে অবিরত চলে আসছে। মনে মনে বিবেচনা করে দেখ সেই ব্যক্তির কথা, যে নিজের লাভের জন্য একটি দেশকে কলোনীতে পরিণত করে ধন সম্পদের পাহাড় গড়েছে; সে অতুলনীয় সম্পদ লাভ করেছে এবং এরূপ লাভ ও আয় করেছে যা নদীর ¯্রােতের ন্যায় প্রবাহিত হয়, পক্ষান্তরে লক্ষ লক্ষ হতভাগ্য দুর্বল ও শক্তিহীন লোক এক গ্রাস খাদ্যেন অভাবে নিমজ্জিত রয়েছে। সমতাও নেই, ভ্রাতুত্ববোধও নেই। অতএব তোমরা দেখতে পাচ্ছ যে, সাধারণ শাস্তি ও আনন্দ ধ্বংসপ্রাপ্ত, মানুষের মঙ্গল আংশিকভাবে বিনাশপ্রাপ্ত, এবং সমষ্টিগত জীবন নিস্ফল হয়েছে। বস্তুতঃ ঐশ্বর্য, সম্মান, বাণিজ্য, শিল্প এগুলি সবই কতিপয় শিল্পপতির হাতে, পক্ষান্তরে অন্য লোকেরা দুঃখ কষ্ট ও সীমাহীন যন্ত্রণার সম্পূর্ণ একটি অনুক্রম সূত্রে বাধা। তাদের না আছে সুযোগ সুবিধা, না আছে লাভ, না আছে আরাম আয়েশ, না আছে শান্তি।

তাহলে কতিপয় ব্যক্তিগত মালিকানার অতিরিক্ত ধন সম্পদ নিয়ন্ত্রণের জন্য আইন কানুন প্রতিষ্ঠা করতে হবে, এবং লক্ষ লক্ষ জনগণের দুঃখ দৈন্য সীমাবদ্ধ করতে হবে; তাহলে একটি নির্দিষ্ট মিতাচারিতার সন্ধান পাওয়া যাবে। কিন্তু সম্পূর্ণ সমতা একেবারে অসম্ভব, কারণ সম্পদ, সম্মান, বাণিজ্য, কৃষি, শিল্প এই সমস্তে সম্পূর্ণ একতা একটি সাচ্ছন্দের অভাবে, নিরুৎসাহীতায়, অস্তিত্বের পথের বিশৃঙ্খলায় ও সার্বিক হতাশায় পর্যবসিত হবে। সমাজ জীবনে শৃঙ্খলা সম্পূর্ণরূপে বিনাশপ্রাপ্ত হবে। এমতে এত বিরাট বিজ্ঞতা রয়েছে যে আইন দ্বারা সমতা চাপানো হয় নাই। অতএব মিতাচারীতা বাঞ্চনীয়।প্রধান কথা হচ্ছে আইন কানুন ও নিয়ন্ত্রণের দ্বারা নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের অতিরিক্ত সম্পদ গঠনে বাধা দিতে হবে এবং সাধারণের অত্যাবশ্যক প্রয়োজন মিটাবার সুযোগ দিতে হবে। উদাহরণস্বরূপ কারখানার মালিক ও শিল্পপতিগণ প্রতিদিনই সম্পদ স্তুপ করে, এবং দরিদ্র কারিগরেরা তাদের দৈনিক উপজীবিকা পায় না। এটাই পাপের চূড়ান্ত এবং কোন ন্যায়বান ব্যক্তি এটা মেনে নিতে পারে না। এমতাবস্থায় আইন কানুন ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে যাতে শ্রমিকরা তাদের কারখানা মালিকদের কাছ থেকে তাদের বেতন কারখানার চাহিদা অনুযায়ী মুনাফার চতুর্থ বা পঞ্চমাংশের একটা অংশ পেতে পারে; অথবা অন্য উপায়ে শ্রমিক সংস্থা কারখানা মালিকেরা লাভ-মুনাফা সমানভাবে ভাগ করে নেবে। বস্তুতঃ সাধারণ কাজ কর্মের নির্দেশনা ও প্রশাসন মালিক থেকে আসে, এবং শ্রম ও কাজ শ্রমিক সংস্থা থেকে আসে। অন্য কথায় শ্রমিকদের এইরূপ বেতন পাওয়া উচিত যা তাদের যথেষ্ট ভরণ পোষণের নিশ্চয়তা দিতে পারে এবং যখন তারা দুর্বল ও শক্তিহীন হয়ে কাজ করা থেকে ক্ষান্ত হবে, তখন তারা কারখানার মালিক থেকে যথেষ্ট ভাতা পাবে। যে বেতন তারা পাবে সেটা তাদের পোষাণোর পক্ষে যথেষ্ট হওয়া প্রয়োজন, যাতে তাদের অভাব ও দুর্দিনের জন্য কিছু জমিয়ে রাখতে পারে।

কাজ কর্ম যখন এইভাবে নির্ধারিত হবে, কারখানার মালিক তখন তার প্রয়োজনের বাইরে রোজ আর সম্পদ জমাবে না (বিনা বিবেচনায় যে, সম্পদ যদি অসামঞ্জস্য হয়, তাহলে পুজিপতি ভয়াবহ ভারের বশীভূত হবে এবং সর্বাপেক্ষা দুঃখ কষ্টের মধ্যে পতিত হবে; একটি অতিরিক্ত সম্পদের প্রশাসন খুবই কষ্টকর এবং মানুষের স্বাভাবিক শক্তিকে নিঃশেষ করে) এবং শুমিক ও কারিগরেরা আর বৃহত্তম কষ্ট ও অভাবের মধ্যে থাকবে না, তাদের জীবনের শেষভাগে তারা আর জঘণ্যতম দুঃখ কষ্টের বশীভূত হবে না।

তাহলে এটা সুস্পষ্ট ও প্রমাণিত যে, গুটিকতক লোকের মধ্যে সম্পদের ভাগাভাগি, পক্ষান্তরে বৃহত্তর জনসংখ্যা দৈন্য পীড়িতÑ এটা একটা পাপ ও অন্যায়। অনুরূপভাবে সম্পূর্ণ সমতা মানুষের জীবন, মঙ্গল, শৃঙ্খল ও শান্তির প্রতি প্রতিবন্ধক। এরূপ প্রশ্নে একটি সঠিক মধ্যবর্তী মাত্রা বাঞ্চনীয়। এটা পুজিপতিদের মুনাফা অর্জনে মিতাচারী হওয়ার মধ্যে এবং নিজে ও দরিদ্রদের মঙ্গলের জন্য তাদের বিবেচনার মধ্যে নিহিত রয়েছে; অর্থাৎ শ্রসিক ও কারিগরেরা দৈনিক একটি নির্ধারিত ও স্থায়ী বেতন পাক এবং কারখানার সাধারণ মুনাফায় তাদের একটি অংশ থাকুক।

কারখানার মালিক, শ্রমিক ও কারিগরদের সামাজিক অধিকার সম্বন্ধে, কারখানার মালিকদের পরিমিত মুনাফা ভোগের এবং শ্রমিকদের ভবিষ্যতের নিরাপত্তা ও অস্তিত্বের প্রয়োজনীয় উপকরণ উল্লেখ করে আইন প্রতিষ্ঠা করা উত্তম হবে। এমতে যখন তারা দুর্বল হবে এবং কাজ করা থেকে ক্ষান্ত হবে, বৃদ্ধ ও অসহায় হবে এবং অপরিণত বয়স্ক শিশু সন্তান রেখে মৃত্যুবরণ করবে, তখন এই সমস্ত শিশু সন্তানেরা অত্যাধিক দারিদ্রায় বিনাশপ্রাপ্ত হবে না। এবং কারখানার আয় থেকেই যে কারখানায় তার হক দাবি আছে- অস্তিত্ব রক্ষার উপকরণের কিছু পাথেয় তারা পাবে।

অনুরূপভাবে ¤্রমিকরা আর বিদ্রোহ করবে না, তাদের অধিকারের বিশীও দাবি করবে না; তারা আর ধর্মঘটও করবে না; তারা অনুগত থাকবে এবং নির্লজ্জ মজুরীও চাইবে না। ন্যায় ও নিরপেক্ষ আইন প্রসূত ওদশাচার অনুযায়ী উভয় সংশ্লিষ্ট পক্ষের পারস্পারিক অধিকারসমূহ নির্ধারিত হবে। উভয় পক্ষের কেউ আইন অমান্য করলে, ন্যায় বিচারের আদালত রায় প্রদান করবে এবং ফলপ্রদ জরিমানা ধার্যের দ্বারা উক্ত আইন লঙ্ঘণের পরিসমাপ্তি ঘটাবে; এইভাবে শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে, মুস্কিল মুছিবৎ মিমাংসিত হবে। কারাখানা মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে অনিস্পন্ন দায়-বাধা বিপত্তি সরকার ও ন্যায় বিচারালয়ের মধ্যস্থতা তথা হস্তক্ষেপ বৈধ- এই কারণে যে, শ্রমিক ও কারখানা মালিকদের মধ্যে চলতি সাধারণ কাজ কর্ম, ব্যক্তিগত মানুষের মধ্যের সাধারণ কাজ কর্মের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে না যা জনসাধারণকে সংশ্লিষ্ট করে না, যা নিয়ে স্বয়ং সরকারের ব্যস্ত থাকা উচিত নয়। বস্তুতঃ যদিও এগুলি ব্যক্তিগত মানুষের মধ্যের ব্যাপার বলে মনে হয়, তবুও পৃষ্ঠপোষক ও শ্রমিকদের মধ্যে এই মুস্কিল মুছিবৎগুলি সাধারণ ক্ষতির সৃষ্টি করে, কারণ ব্যবসায় শিল্পকারখানা, কৃষি ও দেশের সাধারণ কাজ কর্ম গভীরভাবে একত্রে সংযুক্ত। এগুলির কোন একটি যদি ক্ষতিগ্রস্থ হয়, তবে উক্ত ক্ষতি সমগ্র জনমণ্ডলীকে প্রভাবান্বিত করে তথা ক্ষতিগ্রস্ত করে। এইভাবে শ্রমিক ও কারখানা মালিকদের মধ্যে অসুবিধাসমূহ সাধারণ ক্ষতির কারণ হয়।

অতএব ন্যায় বিচারালয় ও সরকারের অস্তক্ষেপের অধিকার আছে। যখন দুই ব্যক্তির মধ্যে কোন ব্যক্তিহত অধিকার নিয়ে মুস্কিল দেখা দেয়, তখন তৃতীয় জনের পক্ষে অপরিহার্য হচ্ছে সেটার মীমাংসা করে দেওয়া। এটাই সরকারের ভূমিকা। অতঃপর ধর্মঘটের প্রশ্ন- যা দেশে গোল-যোগের সৃষ্টি করে এবং পুনঃ পুনঃ শ্রমিকদের অতি মাত্রায় বিরক্তি ও কারখানা মালিকদের অর্থ লোলুপতার সঙ্গে সংযুক্ত- কেমন করে এটা অবহেলিত থাকতে পারে? সোবাহান আল্লাহ্ (প্রশংসা আল্লাহ্র)! কেমন করে এটা সম্ভব যে, একজন সহচর ব্যক্তিকে অনশন ক্লিষ্ট সবকিছু থেকে বঞ্চিত দেখে, একজন লোক তার বিলাসবহুল অট্টালিকায় বিশ্রাম ও আরামে বাস করতে পারে? যে ব্যক্তি অপর একজনকে চরম দৈন্যে নিপতিত দেখে, কেমন করে সে তার সৌভাগ্য ভোগ করে? এই জন্যই আল্লাহ্র ধর্মে এটা নির্ধারিত ও প্রতিষ্ঠিত যে, ধনী লোকেরা প্রত্যেক বছর দরিদ্র ও হতভাগ্যদের প্রতি পালনের জন্য তাদের ধনের এক নির্দিষ্ট অংশ দান করবে। এটাই আল্লাহ্র ধর্মের ভিত এবং আদেশসমূহের মধ্যে সর্বাপেক্ষা অপরিহার্য;

যদিও মানুষ এখন সরকার কর্তৃক বাধ্য নয় তবুও যদি সে তার সু হৃদয়ের স্বাভাবিত তাড়নায়, বৃহত্তম আধ্যাত্মিকতা সহকারে, গরীবদের জন্য এই খরচ করে, তাহলে এটা হবে খুবই প্রশংসনীয়, অনুমোদিত ও প্রীতিকর কাজ।

স্বর্গীয় গ্রন্থসমূহে ও ফলকলিপিতে সৎকর্মাবলী এইরূপই জচ্ছে অর্থ।

তোমাদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক।

59
বাহ্য জগতের বাস্তবতা

কোন কোন তাকিক পণ্ডিতেরা মনে করেন যে, অস্তিত্ব হচ্ছে মায়া বা বিভ্রম; প্রত্যেক অস্তিত্ব হচ্ছে সম্পূর্ণ একটি মায়া, যার কোন অস্তিত্ব নেই। অন্য কথায় বিদ্যমান বস্তুসমূহের অস্তিত্ব মরীচিকার ন্যায়, অথবা পানিতে একটি প্রতিবিম্বের প্রতিফলনের ন্যায়, বা নীতি, স্তিত, অথবা বাস্তবতাবিহীন একটি অপচ্ছায়া বা আকার মাত্র।

এই মতবাদ ভ্রমাত্মক, কারণ যদিও আল্লাহ্র অস্তিত্বের তুলনায় প্রাণী জগতের অস্তিত্ব একটি মায়া মরীচিকা, তবুও অস্তিত্বের অবস্থার এর একটা প্রকৃত ও নির্দিষ্ট অস্তিত্ব আছে। এটা অস্বীকার করা বৃথা। উদাহরণস্বরূপ মানুষের অস্তিত্বের তুলনায় খনিজ পদার্থের অস্তিত্ব হচ্ছে অনস্তিত্ব; কারণ মানুষ যখন দৃশ্যতঃ বিনাশপ্রাপ্ত হয়, তার দেহ খনিজ পদার্থে রূপান্তরিত হয়; পক্ষান্তরে খনিজ পদার্থের অস্তিত্ব খনিজ জগতে থাকে অতএব এটা সুস্পষ্ট যে, মানুষের অস্তিত্বের তুলনায় মাটির অস্তিত্ব অস্তিত্ববিহীন এবং এর অস্তিত্ব মায়াময়; পক্ষান্তরে খনিজ পদার্থের সম্পর্কে এটা এটা অস্তিত্ববান। অনুরূপভাবে আল্লাহর অস্তিত্বের তুলনায় প্রাণীসমূহের অস্তিত্ব মায়া মরীচিকা ব্যতীত আর কিছুই নয় এবং অস্তিত্ববিহীন, দর্পনে প্রতিফলিত একটি প্রতিমূর্তির ন্যায় এটা একটি অপচ্ছায়া যা আকার মাত্র। কিন্তু দর্পনে দৃষ্ট প্রতিবিম্ব যদিও একটি মায়া, তবুও উক্ত মায়াময় প্রতিবিম্বের উৎস ও বাস্তবতা হচ্ছে প্রতিফলিত ব্যক্তিত্ব; যার আনন দর্পনে আবির্ভূত হয়। সংক্ষেপে উক্ত প্রতিফলন (প্রতিবিম্ব) প্রতিফলিত ব্যক্তি সম্পর্কে একটা মায়া মরীচিকা।

তাহলে এটা প্রমাণিত যে, যদিও অস্তিত্বসমূহের, আল্লাহ্র অস্তিত্ব সম্পর্কে (অস্তিত্বের তুলনায়) কোন অস্তিত্ব নেই, কিন্তু উক্ত অস্তিত্বসমূহ দর্পনে মরীচিকা অথবা প্রতিফলন বা প্রতিবিম্বের ন্যায় কিন্তু তবুও এরা নিজেদের ধাপে অস্তিত্ববান (জীবিত)

এই জন্যই যারা আল্লাহ্র প্রতি অমনোযোগী ছিল এবং যিশুখ্রিষ্টকে অস্বীকার করতো, তাদেরকে মৃত বলা হয়েছিল, যদিও বাহ্যত তারা জীবিত ছিল; কিন্তু বিশ্বাসী ব্যক্তিদের তুলনায় তারা মৃত, অন্ধ, বধির ও বোবা ছিল। এটাই তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন- যখন তিনি বলেন “মৃত ব্যক্তিরাই তাদের মৃতদের কবরস্থ করুক (সমাহিত করুক)।”

60
প্রকৃত পূর্ব অস্তিত্ব

প্রশ্ন: কত প্রকারের পূর্ব অস্তিত্ব ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু আছে?

উত্তর: কোন কোন জ্ঞানী ব্যক্তি ও দার্শনিকরা বিশ্বাস করেন যে, দুই প্রকারের পূর্ব থেকে অস্তিত্ব বিদ্যমান আছে, যথা- অত্যাবশ্যক পূর্ব অস্তিত্ব ও কালের পূর্ব অস্তিত্ব। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুসমূহ ও দুই প্রকারের যথা অত্যাবশ্যক ইন্দ্রিয়াগ্রাহ্য বস্তু ও সময়ের তথা কালের পূর্ব ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু।

অত্যাবশ্যক পূর্ব জন্ম হচ্ছে সেই অস্তিত্ব যা কারণ দ্বারা পূর্বগামী নয়, কিন্তু অত্যাবশ্যক ইিিন্দ্রয়গ্রাহ্য বস্তু কারণ দ্বারা পূর্বগামী। সময়ের (কালের) পূর্ব অস্তিত্ব হচ্ছে আরম্ভবিহীন, কিন্তু সময়ের (কালের) দৃশ্যমান বস্তুর আরম্ভ ও শেষ আছে; কারণ প্রত্যেক বস্তুর অস্তিত্ব চারটি কারণের উপর নির্ভর করেÑ যথাযোগ্য কারণ, পদার্থ, আকার, এবং উদ্দেশ্য। উদাহরণস্বরূপ এই কেদারার চেয়রের) একজন নির্মাতা আছে যে একজন ছুতার মিস্ত্রী, একটি উপাদান আছে- কাঠ, একটি আকার আছে যা হচ্ছে চেয়ারের এবং একটা উদ্দেশ্য আছে তা হচ্ছে এটাকে একটা আসনরূপে ব্যবহার করা হবে। অতএব এই কেদারা মূলতঃ প্রবঞ্চময়, যেগেতু এটা একটা কারণ দ্বারা পূর্ববর্তী অর্থাৎ কারণের পূর্বগামী এবং এর অস্তিত্ব কারণের উপর নির্ভর করে অর্থাৎ কারণ দ্বারা একে অস্তিত্বশীল করা হয়েছে। একেই মূলতঃ ও বস্তুতঃ প্রপঞ্চময় (ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু সম্বন্ধীয়) বলা হয়।

এখন এই অস্তিত্ব জগত এর স্রষ্টার সম্পর্কে (তুলনায়) প্রকৃত ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু। যেহেতু আত্মার দ্বারা পরিপুষ্ট, সেহেতু আত্মার সম্পর্কে (তুলনায়) এটা একটা অত্যাবশ্যক দৃশ্যমান বস্তু। আত্মা দেহ থেকে স্বাধীন এবং দেহ সম্পর্কে (তুলনায়) আত্মা অত্যাবশ্যক পূর্ব অস্তিত্ব (পূর্বে জন্ম)। যদিও সূর্য রশ্মিসমূহ সর্বদাই সূর্য থেকে অবিচ্ছেদ্য, তবুও সূর্য হচ্ছে পূর্ব অস্তিত্ব (পূর্বে জন্ম) এবং রশ্মিসমূহ দৃশ্যমান বস্তু, কারণ রশ্মিসমূহের অস্তিত্ব সূর্যের অস্তিত্বের উপর নির্ভর করে; সূর্যের অস্তিত্ব লশ্মির অস্তিত্বের উপর নির্ভর করে না, কারণ সূর্য হচ্ছে দাতা এবং রশ্মি হচ্ছে দান।

দ্বিতীয় সংজ্ঞা হচ্ছে, অস্তিত্ব ও অনস্তিত্ব উভয়ই আপেক্ষিক। যদি এটা বলা হয় যে, এরূপ একটা বস্তু অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে এসেছে; এতে সম্পূর্ণ অনস্তিত্ব বুঝায় না বরং এই বুঝায় যে, এর পূর্ব অবস্থা, এর পূর্ব প্রকৃত অবস্থার সম্পর্কে (তুলনায়) অস্বিত্ববিহীন ছিল। কেননা সম্পূর্ণ অনস্তিত্ব অস্তিত্ববান হতে পারে না, যেহেতু এর অস্তিত্বের ধারণ শক্তি নেই। খনিজ পদার্থের ন্যায় মানুষ অস্তিত্ববান; কিন্তু খনিজ পদার্থের অস্তিত্ব মানুষের অস্তিত্বের তুলনায় শূন্য, কারণ মানুষের দেহ যখন বিনাশপ্রাপ্ত হয়, তখন এটা ধুলি ও খনিজ পদার্থে পরিণত হয়। কিন্তু ধুলি যখন উন্নতির মাধ্যমে মানব জগতে প্রবেশ করে এবং এই মৃত দেহ জীবন্ত হয়, মানুষ তখন অস্তিত্ববান তথা জীবিত হয়। যদিও ধুলি অর্থাৎ খনিজ পদার্থের এক নিজস্ব অবস্থায় অস্তিত্ব আছে, কিন্তু মানুষের তুলনায় এটা কিছুই না- শূন্য। উভয়ই জীবিত, কিন্তু ধুলি ও খনিজের অস্তিত্ব মানুষের তুলনায় অনস্তিত্ব এবং শূন্য; কারণ মানুষ যখন অনস্তিত্বে পরিণত হয়, তখন সে ধুলি ও খনিজ পদার্থে প্রত্যাবর্তন করে।

এমতাবস্থায় যদিও সাপেক্ষতার তথা সম্ভাব্যতার জগত বিদ্যমান আছে তবু আল্লাহ্র অস্তিত্বের তুলনায় এটা অস্তিত্ববিহীন এবং শূন্যগর্ভ। মানুষ ও ধুলি উভয়ই জীবিত, কিন্তু মানুষ ও খনিজের অস্তিত্বের মধ্যে কতই না পার্থক্য! একটির তুলনায় অপরটি কিছুই না। অনুরূপভাবে আল্লাহ্র অস্তিত্বের সম্পর্কে তথা তুলনায় সৃষ্টিজগতের অস্তিত্ব অনস্তিত্ব বা শূন্যগর্ভ। এমতে এটা পরিষ্কার ও সুস্পষ্ট যে, যদি অস্তিত্বসমূহ জীবিত, তবু আল্লাহ্ ও আল্লাহ্র বাক্যের তুলনায় ঐ সমস্ত অনস্তিত্ব। এটাই আল্লাহ্র আরম্ভ ও শেষ কথা- যিনি বলেন, “আমিই আদি ও অন্ত।” কারণ তিনিই বদান্যতার আরম্ভ ও শেষ। স্রষ্টার সব সময় একটি সৃষ্টি জগত ছিল। সূর্যের বাস্তবতা (প্রকৃত সত্ত্বা) থেকে সর্বদাই রশ্মিসমূহ বিকীর্ণ হয়েছে ও উজ্জ্বলতা দান করেছে; কারণ রশ্মি বিহনে সূর্য মলিন ও অন্ধকার হয়ে যাবে। আল্লাহর নামাবলীর ও গুণাবলীর সৃষ্ট জীবকুলের অস্তিত্বের প্রয়োজন এবং শাশ্বত বদান্যতা ক্ষান্ত হয় না; যদি তাই হত, তাহলে এটা আল্লাহর পূর্ণতাসমূহের পরিপন্থী হত না।

61
পুনর্জন্ম

প্রশ্ন: পুনর্জন্মবাদের প্রশ্ন সম্বন্ধে সত্য কি? যে পুনর্জন্ম কিছু কিছু লোক বিশ্বাস করে।

উত্তর: আমরা যে বিষযে বলতে চাচ্ছি, আমরা শুধু তার বাস্তবতার ব্যাখ্যা করব, অন্য লোকদের বিশ্বাসকে আমরা অবজ্ঞা করব না; শুধুমাত্র তথ্যাবলীর ব্যাখ্যা করব- ব্যাস আর কিছু না। আমরা অন্যের মতবাদের বিরোধিতা করি না, আমরা সমালোচনাও অনুমোদন করি না।

তাহলে জেনে রাখ যে, যারা পুনর্জন্মে বিশ্বাস করে তারা দুই শ্রেণীর। একশ্রেণী পরজগতের আধ্যাত্মিক শান্তি ও পুরষ্কার বিশ্বাস করে না বরং তারা অনুমান করে যে, এই জগত পুনর্জন্ম ও প্রত্যাবর্তনের দ্বারার মানুষ পুরষ্কার ও প্রতিদান লাভ করে। তারা বিবেচনা করে স্বর্গ ও নরক ইহজগতে সীমাবদ্ধ এবং তারা পরজগতের অস্তিত্বের কথা বলে না। এর মধ্যেও আবার দুইভাগ রয়েছে; এক ভাগ মনে করে যে সাংঘাতিক শান্তি ভোগের জন্য মানুষ সময় সময় ইতর প্রাণীর আকারে ইহজগতে প্রত্যাবর্তন করে এবং এই যন্ত্র্রণাদায়ক উৎপীড়ণ ভোগের পর, সে প্রাণী জগদ থেকে মুক্ত হবে এবং পুনরায় মনুষ্য জগতে আগমন করবে ; একই বলে পুনর্জন্ম। অন্য ভাগ মনে করে, মনুষ্য জগত থেকে লোক আবার মুনষ্য জগতে প্রত্যাবর্তন করে এবং এই প্রত্যাবর্তনের দ্বারা পূর্ব জীবনের শান্তি ও পুরষ্কার লাভ করা যায়; একেই বলে মৃত্যুর পর পুনর্জন্ম। দুই শ্রেণীর কোন শ্রেণীই ইহজগত ছাড়া পরজগতের কথা বলছে না।

দ্বিতীয় ধরনের পুনর্জন্মে বিশ্বাসীরা পরজগতের অস্তিত্বের কথা স্বীকার করছে। এবং তারা পুনর্জন্মকে পূর্ণতা প্রাপ্তির উপায়স্বরূপ বিবেচনা করে। অর্থাৎ তারা মনে করে যে, ইহজগতে যাওয়া আসার দ্বারা মানুষ ক্রমশঃ পরোৎকর্ষসমূহ অর্জন করবে। অন্য কথায় মানুষ পদার্থ ও শক্তি দ্বারা গঠিত। প্রথম কালচক্রে পদার্থ অসম্পূর্ণ থাকে, কিন্তু পুনঃ পুনঃ এই পৃথিবীতে আগমনে এটা উন্নতি করতে থাকে এবং বিশুদ্ধতা ও মাধুর্য অর্জন করে এবং অবশেষে এটা চকচকে দর্পন তুল্য হয়; এবং শক্তি (যা আত্মা ব্যতীত আর কিছুই নয়) সমুদয় পরোৎকর্ষসমূহ এর মধ্যে সংগৃহিত হয়।

যারা পুনর্জস্মে বিশ্বাসী, এই বিষয়ে এটাই তাদের উপস্থাপন। আমরা এটাকে সংক্ষেপ করছি। যদি আমরা এটার বিস্তারিত বিবরণের মধ্যে প্রবেশ করি তাহলে এতে থুব দীর্ঘ সময় লেগে যাবে। এই সংক্ষিপ্তসার যখেষ্ট। এই প্রশ্নে কোন তর্ক শাস্ত্রীয় যুক্তি ও প্রমাণাবলী দেখানো হয় নাই। অনুমান থেকে এগুলির ধারণা সৃষ্টি হয়েছে মাত্র- চূড়ান্ত তথা সিদ্ধান্তমূলক নয়। পুনর্জন্মবাদে বিশ্বাসীদের নিকট থেকে অবশ্যই প্রমাণাবলী তলব করতে হবে- ধারণা, অনুমান ও কল্পনা নয়।

কিন্তু পুনর্জন্ম যে অসম্ভবÑ তোমরা এর স্বপক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করতে বলছ। এটাই আমরা এখন ব্যাখ্যা করব। এর অসম্ভাবনার প্রথম যুক্তি হচ্ছে এই যে, বাহ্য হচ্ছে অন্তঃস্থর প্রকাশ। পৃথিবী হচ্ছে স্বর্গ নাজ্যের দর্পন। জড় জগত আধ্যাত্মিক জগতের অনুরূপ। এখন লক্ষ্য কর যে, ইন্দ্রিয়গোচর জগতে আকৃতিসমূহ পুনঃকৃত নয়, কারণ অস্তিত্বশীল কোন কিছু- কোন বিষয়েই- একটি আরেকটির অনুরূপ নয়- একই নয়। সমুদয় বস্তুতেই স্বতন্ত্রতার নিদর্শন দৃশ্যমান ও সুস্পষ্ট রয়েছে। পৃথিবীর সমস্ত শষ্যাগার যদি সরিষায় পরিপূর্ণ হত, তাহলে তুমি দুটি শষ্যকে পার্থক্য ব্যতীরেকে সম্পূর্ণ একরকম ও অভিন্ন দেখতে পেতে না।এটা নিশ্চিত যে, তাদের মধ্যে পার্থক্য ও স্বাতন্ত্রতা থাকবেই। যেহেতু সমস্ত বস্তুতেই অনুপমত্বের (অদ্বিতীয়ত্বের) প্রমাণ বিদ্যমান রয়েছে এবং সমস্ত বস্তুর বাস্তবতায় আল্লাহ্র একত্ব্ ও অদ্বিতীয়ত্ব সুস্পষ্ট, সেহেতু একটি আকৃতির পুনরাবৃত্তি (পুনঃকৃতি) সম্পূর্ণরূপে অসম্ভব। অতএব এতই আত্মার পূর্বেকার উপাদান অস্তিত্ব ও অবস্থাসহ পুনঃকৃত একই আকৃতি জগতে পুনর্জন্ম অসম্ভব ও অবাস্তবায়নযোগ্য। জড় অস্তিত্বের প্রভাবের জন্য একই আকার আকৃতির পুনঃকৃতি (পুনরাবৃত্তি) যেমন অসম্ভব ও নিষিদ্ধ, তেমনি আধ্যাত্মিক অস্তিত্বসমূহের সম্বন্ধেও ঐ একই কথা। অবতরণের বৃত্তচাপে হোক অথবা আরোহণের বৃত্তচাপে হোক, একই অবস্থার প্রত্যাবর্তন নিষিদ্ধ ও অসম্ভব, পার্থিব অপার্থিব অনুরূপ হয়।

তবুও প্রজাতি সম্বন্ধে জড় অস্তিত্বসমূহের প্রত্যাবর্তন সুস্পষ্ট; কারণ বিগত বছরে যে সমস্ত বৃক্ষ, পত্ররাজি, পুষ্পমুকুল, ফলসমূহ প্রসব করেছিল, আগামী বছরগুলিতেও সেই একই পত্রগুচ্ছ, পুষ্পমুকুল ও ফলসমূহ প্রসব করবে। একেই প্রজাতির পুনঃকৃতি বা পুনরাবৃত্তি বলে। কেউ যদি আপত্তি করে বলে যে, পাতা, পুষ্প মুকুল ও ফল বিশ্লিষ্ট হয়েছে এবং উদ্ভিদ জগত থেকে খনিজ জগতে অবতরণ করেছে এবং পুনরায় খনিজ জগত থেকে উদ্ভিদ জগতে ফিরে এসেছে। অতএব এখানে পুনঃকৃতি বা পুনরাবৃত্তি হয়েছে। এর উত্তর হচ্ছে এই যে, গত বছরের পুষ্প মুকুল, পাতা ও ফল বিশ্লিষ্ট হয়ে গিয়েছিল, এই সমস্ত সংযুক্ত উপাদানগুলি বিয়োজিত হয়েছিল তথা সংসক্তি হারিয়েছিল, এবং মহাশূন্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অন্তর্হিত হয়েছিল এবং বিশ্লেষণের পর, গত বছরের পাতা ও ফলের অণুপরমাণুগুলি আর পুনরাং সংযুক্ত হয় নাই ও প্রত্যাবর্তন করে নাই। পক্ষান্তরে নতুন উপাদানসমূহরে সংমিশ্রণের দ্বারা প্রজাতি প্রত্যাবর্তন করেছে। মানুষের দেহ সম্বন্ধে ঐ একই ব্যাপার- যা বিশ্লেষণের পর বিয়োজিত হয়ে যায় এবং যে উপাদানগুলি এটাকে গঠন করেছিল, সেগুলি ছড়ি[য়ে ছিটিয়ে অন্তর্হিত হয়। যদি অনুরূপভাবে, এই দেহ পুনরায় খনিজ অথবা উদ্ভিদ জগত থেকে প্রত্যাবর্তন করে তাহলে পূর্বের লোকের উপাদানসমূহের ঠিক একই সংযুক্তি তার থাকবে না। কারণ সেই উপাদানগুলি বিশ্লিষ্ট ও ছড়িয়ে ছিটিয়ে অন্তর্হিত হয়েছে। সেগুলি এই বিশাল মহাশূন্যে ছিন্নভিন্ন হয়ে অদৃশ্য হয়ে গেছে। পরবর্তীকালে উপাদানসমূহের অন্য অণুপরমাণু সংযুক্ত হয়েছে এবং একটি দ্বিতীয় দেহ গঠিত হয়েছে। তবে এটা হতে পারে যে, পূর্বের ব্যক্তির অণুপরমাণুর কোন একটি উত্তর পুরুষের সংযুক্তি বা অঙ্গ গঠনের মধ্যে প্রবেশ করেছে। কিন্তু এই অণুপরমাণুগুলি হ্রাস অথবা বৃদ্ধি ব্যতীরেকে অবিকল ও সম্পূর্ণ অখণ্ডরূপে সংরক্ষিত হয় নাই, যাতে সেগুলি পুনরায় একত্রে সংযুক্ত হতে পারে এবং সেই সংযুক্তি ও সংমিশ্রণ থেকে অপর এক ব্যক্তি অস্তিত্বে আসতে পারে। সুতরাং এটা প্রমাণ হতে পারে না যে এই দেহ এর সমস্ত অণুপরমাণুসহ প্রত্যাবর্তন হয়েছে, পূর্বের ব্যক্তি পরবর্তী ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছে এবং ফলতঃ পুনঃকৃতি তথা পুনরাবৃত্তি হয়েছে; এবং দেহের মত আত্মাও প্রত্যাবর্তন করেছে এবং মৃত্যুর পর এর সারৎসার অস্তিত্ব এই পৃথিবীতে ফিরে এসেছে।

যদি আমরা বলি যে, এই পুনর্জন্ম পূর্ণতাসমূহ অর্জনের জন্য, যাতে পদার্থ বিশুদ্ধ ও চমৎকার হতে পারে এবং সর্বোত্তম পূর্ণতাসহ আত্মার মধ্যে আত্মার আলো সুস্পষ্ট হতে পারে এটাও নিছক কল্পনা বই আর কিছু নয়। কারণ আমরা এই যুক্তি বিশ্বাস করলেও তবুও নবায়ন ও প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে প্রকৃতির পরিবর্তন অসম্ভব। অপূর্ণতার উপাদান প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে পূর্ণতার প্রকৃত সত্ত্বায় পরিবর্তিত হয় না; সম্পূর্ণ অন্ধকার প্রত্যাবর্তনের দ্বারা আলোর উৎস হতে পারে না। দুর্বলতার সারৎসার অস্তিত্ব প্রত্যাবর্তনের দ্বারা শক্তি ও ক্ষমতার পরিবর্তিত হতে পারে না, এবং পার্থিব প্রকৃতি স্বর্গীয় বাস্তবতায় পরিণত হতে পারে না। কোরাণে বর্ণিত যয়তুন বৃক্ষ যতবারই ফিরে আসুক না কেন, এটা সুমিষ্ট ফল উৎপন্ন করবে না এবং ভাল বৃক্ষ যতই প্রত্যবর্তন করুক না কেন, এটা তিক্ত ফল প্রসব করবে না। অতএব এটা সুস্পষ্ট যে, জড় জগতে যাতায়াত পূর্ণতার কারণ হয় না। এই মতবাদের কোন প্রমাণও নেই, সাক্ষ্যও নেই, এটা নিছক একটা কল্পনা মাত্র। না, বস্তুতঃ পূর্ণতা তথা পরোৎকর্ষসমূহ অর্জনের কারণ হচ্ছে আল্লাহ্র বদান্যতা।

ব্রক্ষ্মজ্ঞানী ব্যক্তিরা বিশ্বাস করে যে, মানুষ আরোহণের বৃত্তে বহুবার প্রত্যাবর্তন করবে, অবশেষে নর্বোচ্চ কেন্দ্রে পৌছাবে, এমতাবস্থায় পদার্থ দর্পনে পরিণত হয়, আত্মার আলো এক পূর্ণ শক্তি সহকারে, এর উপর বিকীর্ণ হবে এবং অত্যাবকশ্যক পূর্ণতা অর্জিত হবে। এখন এটা একটি প্রতিষ্ঠিত ও গভীর ধর্মতত্ত্ব সম্বন্ধীয় প্রতিজ্ঞা, যে, জড় জগ জগতসমূহ অবতরণের বৃত্তের প্রান্তভাগে সীমাবদ্ধ, এবং মানুষের অবস্থা অবতরণের বৃত্তের প্রান্তভাগে এবং আরোহণের আরম্ভভাগে অবস্থান করছে- যা সর্বোচ্চ কেন্দ্রের বিপরীত দিকে অবস্থান করছে। আরোহণ বৃত্তের আরম্ভ থেকে প্রান্তভাগ পর্যন্ত অসংখ্য আধ্যাত্মিক ধাপ বিদ্যমান রয়েছে। অবতরণ বৃত্তকে আরম্ভ বলা হয় এবং আরোহণ বৃত্তকে উন্নতি বলা হয়। অবতরণ বৃও জড়ত্বসমূহে সমাপ্ত হয় এবং আরোহণ বৃত্ত আধ্যাত্মিকসমূহে সমাপ্ত হয়। একটি বৃত্ত বর্ণনা করায় দিক নির্ণয় যন্ত্রের বিন্দু (নিদের্শক) পশ্চাৎগামী হয় না, কারণ এটা হবে স্বাভাবিক গতি ও স্বর্গীয় নিয়মের পরিপন্থী; অন্যথায় বৃত্তের সামঞ্জস্য বিনষ্ট হবে।

অধিকন্তু এই জড় জগতের কোন মূল্য নেই অথবা এমন মাধুর্য নেই, যে এই খাঁচা থেকে রেহাই পাওয়অর পর মানুষ দ্বিতীয়বার এই ফাঁদে পড়বার ইচ্ছা করবে। না, মানুষের নৈতিক মূল্য ও প্রকৃত যোগ্যতা আল্লাহ্র শাশ্বত অনুকম্পার মাধ্যমে ও অস্তিত্বের ধাপসমূহ অতিক্রমের দ্বারা সুস্পষ্ট ও দৃশ্যমান হয়Ñ প্রত্যাবর্তনের দ্বারা নয়। খোলস যখন একবার উন্মুক্ত হয়, তখন এটা সুস্পষ্ট ও প্রমাণিত হয় যে, এর মধ্যে মুক্তা আছে না তুচ্ছ পদার্থ আছে। চারাগাছ যখন একবার বৃদ্ধি পায় তখন এটা হয় কণ্টক, না হয় পুষ্প উৎপন্ন করবে; এটাকে পুনরায় জন্মাবার কোন প্রয়োজন নেই। অধিকন্তু প্রাকৃতিক আইন অনুযায়ী, জগতসমূহে সোজা নিয়মে অগ্রসর হওয়া অস্তিত্বের একটি কারণ এবং প্রকৃতির নিয়ম পদ্ধতির পরিপন্থী অগ্রসর হচ্ছে অনমিস্তত্বের কারণ। মৃত্যুর পর আত্মার প্রত্যাবর্তন, প্রাকৃতিক গতির পরিপন্থী এবং স্বর্গীয় পদ্ধতির বিপরীত।

অতএব প্রত্যাবর্তনের দ্বারা অস্তিত্ব লাভ সম্পূর্ণ অসম্ভব; এটা যেন মাতৃগর্ভ থেকে মুক্ত হওয়ার পর পুনরায় দ্বিতীয়বার এতে প্রত্যাবর্তন করছে। মনে মনে গভীরভাবে চিন্তা করে দেখ , এই কল্পনা কত ছেলেমি, যা পুনর্জন্ম ও দেহান্তর প্রাপ্তির অর্থ করা হয়েছে। পুনর্জন্মবাদের বিশ্বাসীরা দেহটিকে একটি পাত্রস্বরূপ মনে করে, যে পাত্রে আত্মা থাকে, যেমন একটি কাপ জল ধারণ করে ; এই জল একটি পেয়ালা থেকে নিয়ে অন্য একটি পেয়ালায় ঢালা হয়; এটা একটি ছেলে খেলা। তারা অনুভব করে না যে, আত্মা একটি অশরীরি অস্তিত্ব, এটা প্রবেশ করে না ও আসে না, কিন্তু দেহের সঙ্গে শুধুমাত্র সংযুক্ত করা হয়, যেমন দর্পনের সঙ্গে সূর্যের অবস্থান। যদি এইরূপ হত, জড় জগতে প্রত্যাবর্তনের দ্বারা আত্মা যদি ধাপসমূহের মধ্য দিয়ে অতিকমে করতে পারত এবং অত্যাবশ্যক পরোৎকর্ষসমূহ লাভ করত, তাহলে এটা উত্তম হত- যদি আল্লাহ্ এই জড় জগতে আত্মার জীবন দীর্ঘায়িত করতেন- যে পর্যন্ত না সেটা পরোৎকর্ষসমূহ ও অনুকম্প অর্জন করত; তাহলে আর একে মৃত্যুর পেয়ালার স্বাদ গ্রহণ করতে হত না অথবা দ্বিতীয় জীবন লাভ করতে হত না।

এই ধারণা যে, অস্তিত্ব এই নশ্বর পৃথিবীতে সীমাবদ্ধ এর স্বর্গীয় জগতসমূহের অস্তিত্বের অস্বীকৃতি মূলতঃ কতিপয় পুনর্জন্মবাদে বিশ্বাসীদের কল্পনা প্রসূত; কিন্তু স্বর্গীয় জগতসমূহ অসীম। যদি স্বর্গীয় জগতসমূহে এই জড় জগতে সর্বোচ্চ সীমা প্রাপ্ত হত, তাহলে সৃষ্টিজগত নিরর্থক হয়ে যেত, শুধু তাই নয়, অস্তিত্ব হয়ে যেত নিছক ছেলে খেলা। এই সমস্ত অবিরাম তথা অসীম অস্তিত্বসমূহের ফল তথা মানুষের মহৎ অস্তিত্ব এই নশ্বর বাসস্থানে কিছুদিনের জন্য আসা যাওয়া করত এবং পুরষ্কার ও শান্তি প্রাপ্তির পর অবশেষে সবাই পূর্ণতা পেত, স্বর্গীয় সৃষ্টি জগত এবং অসীম অস্তিত্ববান সবকিছুই পূর্ণতাপ্রাপ্ত ও নিখুঁত হয়ে যেত এবং অতঃপর খোদার খোদাইত্ব এবং খোদার নামাবলী ও গুণাবলী এই সমস্ত আধ্যাত্মিক অস্তিত্বসমূহের পক্ষে তাদের কর্মফলে- আলস্যে ও কর্মতৎপরতায় পরিণত হত। ছোবাহান আল্লাহ্ (প্রশংসা আল্লাহ্র) যে আল্লাহ্ তাদের সমস্ত বর্ণনা থেকে পবিত্রকৃত।

এইরূপই ছিল পূর্বেকার দার্শনিকদের সীমাবদ্ধ মন - যথা টলেমী ও অন্যান্য যারা বিশ্বাস করতেন এবং কল্পনা করতেন যে এই জগত, জীবন এবং অস্তিত্ব এই ভূগোলকের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল এবং এই সীমাহীন মহাশ্যূন্যের নয়টি মণ্ডলের মধ্যে সীমাবদ্ধ এবং সব ছিল শূন্য। মনে মনে গভীরভাবে চিন্তা করে দেখ, তাদের ভাবনা চিন্তা ছিল কত সীমাবদ্ধ, তাদের মন ছিল কত দুর্বল। যারা পুনঃ মানব দেহ গ্রহণে বিশ্বাস করত, তারা চিন্তা করত যে, আধ্যাত্মিক জগতসমূহ মনুষ্য কল্পনা জগতসমূহ সীমাবদ্ধ ছিল। অধিকন্ত ুতাদের মধ্যে অনেকে, যথা দ্রুজ ও নুসাইরীগণ চিন্তা করতেন যে, অস্তিত্ব জগত এই বাহ্য জগতে সীমাবদ্ধ । কি ভ্রান্ত অনুমান! কারণ আল্লহ্র এই বিশ্ব ব্রক্ষ্মাণ্ডের সৌন্দর্য, জাকজমক, জড় বিশ্বের আলোকময় তাড়কা রাজি সম্পূর্ণ- যা দৃষ্টিগোচর হয় যেগুলি অসংখ্য! তাহলে আমাদের অবশ্যই চিন্তা করতে হবে যে, আধ্যাত্মিক জগতসমূহ কত অসীম, যা হচ্ছে অত্যাবশ্যক ভিত। “সতর্ক হও, হে দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন মানব।”

এস এবার আমরা আমাদের প্রসঙ্গে ফিরে যাই। স্বর্গীয় ধর্মসমূহে “প্রত্যাবর্তনের” কথা বলা হয়েছে, কিন্তু অজ্ঞ লোকেরা এর অর্থ বুঝে নাই এবং যারা পুনঃ দেহ ধারণে বিশ্বাসী, তারাই এই বিষয়ে ধারণার সৃষ্টি করেছে। কারণ “প্রত্যাবর্তন” বলতে স্বর্গীয় বার্তাবাহকগণ যা বুঝাতে চেয়েছেন- সেই প্রত্যাবর্তন উপাদান তথা অস্তিত্বের নয়, সেটা গুণাবলীর বা গুণ বৈশিষ্ট্যের প্রত্যাবর্তন; এটা ঐশী প্রকাশদের প্রত্যাবর্তন নয়, বরং পূর্ণতাসমূহের প্রত্যাবর্তন। সুসমাচারে (গসপেলে) বলা হয়েছে যে, জাকারিয়ার পুত্র যোহন হচ্ছে ইলিয়অন। এই কথায় যোহনের দেহে ইলিয়াসের ব্যক্তিত্ব (ব্যক্তি সত্ত্বা) ও বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন আত্মার প্রত্যাবর্তন বুঝাচ্ছে না, বরং ইলিয়াসের পূর্ণতাসমূহ ও গুণ বৈশিষ্ট্য যোহনের মধ্যে আত্ম প্রকাশ করেছে বুঝাচ্ছে।

গতরাতে এই কক্ষে একটি প্রদীপ জ্বলেছিল এবং যখন আজ রাতে একটি প্রদীপ জ্বলছে, এতে আমরা বলে থাকি গত রাতের আলো পুনরায় জ্বলছে। একটি ঝরনা থেকে পানি প্রবাহিত হয়, অতঃপর এটা বন্ধ হয়, এবং পুনরায় যখন দ্বিতীয় বার এটা প্রবাহিগত হতে শুরু করে, তখন আমরা বলি একই পানি পুনরায় প্রবাহিত হচ্ছে; অথবা আমরা বলি এই আলো পূর্বের আলোর সমান বা একই। গতবারের বসন্তকালের সম্বন্ধে ঐ একই কথা- যখন পুষ্প মুকুল, পুষ্প এবং সুরভিত ঔষধি প্রষ্ফুটিত হয় এবয় উপাদেয় ফলসমূহ শোভা পায়। পরবর্তী বছর আমরা বলি যে ঐ সমস্ত উপাদেয় ফলসমূহ আবার ফিরে এসেছে এবং ঐ সমস্ত পুষ্প মুকুল, ফুলসমূহ, এবং ফল প্রত্যাবর্তন করেছে এবং ফিরে এসেছে। এতে এই বুঝায় না যে, পচন গলন তথা বিশ্লিষ্ট হওয়ার পর গতবারের পুষ্পরাজি ঠিক একই অণুপরমাণু দ্বারা সংযুক্ত হয়ে ফিরে এসেছে বা প্রত্যাবর্তন করেছে। পক্ষান্তরে এর অর্থ এই যে, গত বছরের পুষ্পরাজির মাধুর্য, সতেজতা, তৃপ্তিকর সুগন্ধ, এবং বিস্ময়কর রং এই বছরের পুষ্পরাজির মধ্যে ঠিক একইভাবে সুস্পষ্ট ও দৃশ্যমান হয়েছে। সংক্ষেপে এই উক্তি পূর্বের ও পরবর্তী পুষ্পরাজির মধ্যে সাদৃশ্য ও অনুলুপতা বুঝায়। “প্রত্যাবর্তন” যা স্বর্গীয় পবিত্র গ্রন্থসমূহে উল্লেখিত হয়েছে - তার অর্থ এই । এ সম্বন্ধে বাহা’উল্লাহ্র লেখনী পূর্ণভাবে “কিতাবুল ইক্কানে” ব্যাখ্যা করেছে; এটা পাঠ কর, যাতে তুমি স্বর্গীয় রহস্যাবলীর সত্য সম্বন্ধে অবগত হতে পার।

তোমাদের প্রতি অভিবাদন ও ধন্যবাদ।

62
সর্বেশ্বরবাদ

প্রশ্ন : কেমন করে ব্রক্ষ্মতত্ত্ববিদগণ ও সুফিগণ সর্বেশ্বরবাদের প্রশ্ন অনসুধাবন করে? সর্বেশ্বরবাদের অর্থ কি এবং এটা সত্যের কতখানি কাছাকাছি?

উত্তর : জেনে রাখ যে সর্বেশ্বরবাদের বিষয়টি প্রাচীন কাল থেকেই বিদ্যমান এই বিশ্বাস ব্র²জ্ঞানী ও সুফিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় বরং গ্রীসের কতিপয় জ্ঞানী ব্যক্তি এতে বিশ্বাস করতেন যথা এ্যরিষ্টটলÑ যিনি বলেন, “সমস্ত বস্তুই হচ্ছে একটি মাত্র মৌলিক সত্য, তাদের মধ্যে একটি নয়।” এক্ষেত্রে “একটি মাত্র” হচ্ছে “সংযুক্ত”কোন কিছুর বিপরীত; এটা বিচ্ছিন্ন তথা পৃথক বাস্তবতা, যা সংযুক্তি ও বিভাগ থেকে পুতঃপবিত্রকৃত এবং যা নিজেই অগণ্য আকারের মধ্যে বিশ্লিষ্ট তথা দ্রবীভূত হয়। অতএব বাস্ত সত্ত্বা (প্রকৃত অস্তিত্ব) হচ্ছে সমুদয় বস্তু, বস্তুসমূহরে মধ্যে নয়।

সংক্ষেপে সর্বেশ্বরবাদীরা বিশ্বাস করে যে, বাস্তব সত্ত্বাকে সমূদ্রের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে এবং বস্তুসমূহ সমূদ্রের ঊর্মিমালার ন্যায়। এই ঊর্মিমালা যা বস্তু সদৃশ উক্ত বাস্তব সত্ত্বার অসংখ্য আকার; অতএব পবিত্র বাস্তবতা (প্রকৃত সত্ত্বা) হচ্ছে পূর্ব থেকে অস্তিত্বে বিদ্যমানের সমুদ্র এবং সৃষ্ট প্রাণীকুলের অসংখ্য আকার হচ্ছে ঊর্মিমালা ঢেউ) যা দৃষ্টিগোচর হয়।

অনুরূপভাবে তারা এই মতবাদকে সংখ্যাসমূহের প্রকৃত ঐক্য ও অসীম-তার সঙ্গে তুলনা করে; প্রকৃত ঐক্য (একত্ব) অসীম সংখ্যাসমূহের ক্রমে (পর্যায়) স্বয়ং প্রতিফলিত হয় কারণ সংখ্যাসমূহের প্রকৃত ঐক্যের (একত্বের) পুনরুক্তি। সুতরাং সংখ্যা “দুই”হচ্ছে এক এর পুনরুক্তি এবং অন্যান্য সংখ্যার বিষয়বস্তুও ঐ একই।

তাদের একটি প্রমাণ হচ্ছে এই: সমুদয় অস্তিত্বই আল্লাহ্র জানা বস্তু; জ্ঞাত বস্তু ব্যতীত জ্ঞান টিকে থাকে না কারণ জ্ঞান সম্পর্কযুক্ত তারই সঙ্গে, যা বিদ্যমান থাকে- অস্তিত্বের সঙ্গে নয়। জ্ঞানের ধাপে নিছক অনস্তিত্বের কোন বিনির্দেশ ( নির্দিষ্টকরণের) অথবা বিশ্লিষ্টকরণের কিছু থাকতে পারে না। এমতাবস্থায় মহোচ্চ আল্লাহর জ্ঞাত বস্তুসমূহ তথা অস্তিত্বসমূহের বাস্তবতার অস্তিত্ব আছে- যে অস্তিত্ব জ্ঞানের আছে, যেহেতু অস্তিত্বসমূহের প্রকৃত সত্ত্বার স্বর্গীয় জ্ঞানের আকার আছে এবং তারা পূর্ব থেকে অস্তিত্ববান। যেহেতু জ্ঞান পূর্ব অস্তিত্ববান, সেহেতু জ্ঞাত বস্তুসমূহও ঐ একইরূপ এবং অস্তিত্বসমূহের বিশ্লিষ্টকরণ ও নিদের্শনাসমূহÑ যা একত্বের সারৎসার বস্তুর পূর্ব বিদ্যমান জ্ঞান, তা স্বয়ং স্বর্গীয় জ্ঞান। কারণ একত্ব, জ্ঞান ও জ্ঞাত বস্তুসমূহের সার বস্তুর বাস্তবতাসমূহ (প্রকৃত সত্ত্বাসমূহ) এর একটি চরম ও পরম একত্ব রয়েছে- যা বাস্তব ও প্রতিষ্ঠিত। অন্যথায় একত্বের সারৎসার উপাদান বহু প্রপঞ্চময় (দৃশ্যমান) বস্তুসমূহের স্থানে পরিণত হবে এবং পূর্ব থেকে অস্তিত্বসমূহের বিবিধত্ব (বহুত্ব) অপরিহার্য হয়ে পড়বেÑ যা একটি উদ্ভট হাস্যকর ব্যাপার।

অতএব এটা প্রমাণিত যে, জ্ঞাত বস্তুসমূহ স্বয়ং জ্ঞান গঠন করে এবং জ্ঞান সারৎসার বস্তুকেই গঠন করে; অর্থাৎ জ্ঞাতা, জ্ঞান ও জ্ঞাত বস্তুসমূহই হচ্ছে একক একমাত্র বাস্তবতা (প্রকৃত সত্ত্বা)। এবং যদি কেউ এর বাইরে কোন কিছু কল্পনা করে, তাহলে পূর্ব জন্মসমূহ ও সংযুক্তির বহু বিধিত্বর কাছে ফিরে আসার আবশ্যক করবে (অর্থাৎ কারণ ও ফলের অনন্ত অসীম ধারাবাহিকতায় ফিরে আসার আবশ্যক করবে) এবং পুর্বজন্মসমূহ (পূর্ব থেকে অস্তিত্ববান) অসংখ্যর দ্বারা শেষ হবে। যেহেতু আল্লাহ্র জ্ঞানে অস্তিত্বসমূহের বৈশিষ্ট্য দ্বারা চিহ্নিতকরণ ও নির্দিষ্টকরণ স্বয়ং একত্বের ছিল এবং যেহেতু তাদের মধ্যে কোন পার্থক্য ছিল না, সেহেতু একটি মাত্র প্রকৃত একত্ব বই আর কিছু ছিল না এবং সমুদয় জ্ঞাত বস্তু একক অস্তিত্বের বাস্তবতায় পরিব্যাপ্ত ও অন্তর্ভূক্ত ছিল; অর্থাৎ সরলতা ও একত্বের ধারণা অনুযায়ী তারা মহচ্চো আল্লাহর জ্ঞান ও বাস্তবতার উপাদান (অস্তিত্ব) গঠন করে। আল্লাহ যখন তাঁর দীপ্তি প্রকাশ করেন, তখন অস্তিত্বসমূহের এই বিশ্লিষ্টকরণসমূহ ও এই নির্দেশনাসমূহ, যার প্রকৃত একটা অস্তিত্ব ছিল, অর্থাৎ সেগুলি স্বর্গীয় জ্ঞানের একটা আকার ছিল বাহ্য জগতে তাদের অস্তিত্ব প্রমাণিত তথা বাস্তকবায়িত হল এবকং এই বাস্তব অস্তিত্ব স্বয়ং অসীম আকারসমূহে দ্রবীভূত হল। তাদের যুক্তির এইরূপই ভিত।

ব্রক্ষ্মজ্ঞানীগণ ও সুফিগণ দুই শাখায় বিভক্ত। বিরাট একদল, তাদের প্রসিদ্ধ পণ্ডিতগণের কথার মর্ম অনুধাবন না করে, নিছক অনুকরণের মানসিকতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সর্বেশ্বরবাদ বিশ্বাস করে। সুফিদের বিরাট দল বিশ্বাস করে যে, অস্তিত্বের তাৎপর্য আসলে সাধারণ অস্তিত্ব, যা যুক্তি ও বুদ্ধিমত্তার দ্বারা হৃদয়ঙ্গম করা যায়, অর্থাৎ মানুষ এটা হৃয়ঙ্গম করে। তার পরিবর্তে এটা সাধারণ অস্তিত্ব দৈব ঘটনাসমূহের মধ্যে একটি, যা অস্তিত্বসমূহে বাস্তবÑ তার ভিতরে প্রবেশ করে, এবং অস্তিত্বসমূহরে গুণ বৈশিষ্ট্যসমূহ হচ্ছে উপাদান (গঠন বা প্রকৃতি)। এই আপতিক (আকস্মিক) অস্তিত্ব, যা গঠন কা প্রকৃতিসমূহের উপর নির্ভর করে, এটা হচ্ছে বস্তুসমূহের অন্যান্য গুণ-ধর্মের ন্যায়, যা তাদের উপর নির্ভর করে। এটা দৈব ঘটনাসমূহের মধ্যে একটা দৈব বা দুর্ঘটনা, এবং নিশ্চয়ই যা অস্তিত্ব উপাদান তা দৈব ঘটনা থেকে উৎকৃষ্ট। কারণ অস্তিত্ব উপাদান হচ্ছে মূল, আর দৈব ঘটনা (দুর্ঘটনা) হচ্ছে ফল; অস্তিত্ব নিজের উপর নির্ভরশীল এবং দৈবঘটনা অন্য কিছুর উপর নির্ভর করে; অর্থাৎ এর একটা অস্তিত্বের প্রয়োজন যার উপর নির্ভর করতে পারে। এ বিষয়ে আল্লাহ সৃষ্ট বস্তুর ফল হবেন। তাঁর সৃষ্ট বস্তুর প্রয়োজন হবে, কিন্তু সৃষ্ট বস্তু আল্লাহ্ থেকে স্বাধীন।

উদাহরণস্বরূপ প্রত্যেকবার পৃথক উপাদানসমূহ স্বর্গীয় সার্বজনীন পদ্ধতির অনুরূপ মিলিত হয়, ফলে অস্তিত্বসমূহের মধ্যে একটি অস্তিত্ব পৃথিবীতে আসে। অর্থাৎ যখন নির্দিষ্ট উপাদাসমূহ একত্রে মিলিত হয়, একটি উদ্ভিদ অস্তিত্ব উৎপন্ন হয়; যখন অন্যান্য উপাদান একত্রে মিলিত হয়, তখন একটি প্রাণী উৎপন্ন হয়; পুনরায় যখন অন্যান্য উপাদান একত্রে মিলিত হয়, তখন উক্ত উপাদান বিভিন্ন প্রাণীকুল সৃষ্টি করে। এই ব্যাপারে, বস্তুসমূহের অস্তিত্ব হচ্ছে তাদের বাস্তবতার (প্রকৃত সত্ত্বা) ফল। তাহলে কেমন করে এই অস্তিত্ব- যা দৈবঘটনাসমূহের (দুর্ঘটনাসমূহের) মধ্যে একটা দুর্ঘটনা এবং অন্য একটি অস্তিত্বের উপর যার নির্ভর করার প্রয়োজন পড়ে- সমুদয় বস্তুর স্রষ্টা একটি পূর্ব থেকে অস্তিত্বশীল একটি অস্তিত্ব হবে? কিন্তু ব্রক্ষ্মতত্ত্বাবিদদের দীক্ষাপ্রাপ্ত পণ্ডিতগণ ও সুফিগণ, যারা এই প্রশ্ন সম্বন্ধে গবেষণা করেছেন, তারা মনে করেন দুই শ্রেণীর অস্তিত্ব আছে। একটি সাধারণ অস্তিত্ব যা মানুষের বুদ্ধিমত্তার দ্বারা হৃদয়ঙ্গম করা যায়। সেটা হচ্ছে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু- যা দৈব দুর্ঘটনাসমূহের একটি দুর্ঘটনা এবং বস্তুসমূহের বাস্তবতা হচ্ছে অস্তিত্ব। কিন্তু সর্বেশ্বরবাদ এই সাধারণ ও কাল্পনিক অস্তিত্ব ব্যবহার করে না- শুধুমাত্র প্রকৃত অস্তিত্ব ব্যতীত, যা সমস্ত ব্যাখ্যা থেকে মুক্ত ওপবিত্রকৃত। এই প্রকৃত অস্তিত্বের মাধ্যমে সমস্ত বস্তু জীবিত থাকে; এবং সেটাই এর একত্ব যার মাধ্যমে সমুদয় বস্তু পৃথিবীতে এসেছে, যথা পদার্থ, শক্তি এবং এই সাধারণ অস্তিত্ব যা মানুষের মন দ্বারা হৃদয়ঙ্গম করা যায়। ব্রক্ষ্মতত্ত্ববিদ ও সুফিদের মতানুসারে এই প্রশ্রে উত্তর এটাই।

সংক্ষেপে, সমুদয় বস্তুই একত্বের দ্বারা অস্তিত্ববান থাকে এই মতবাদ সম্বন্ধে সবাই একমত অর্থাৎ দার্শনিকগণ ও বার্তাবাহকগণ এটা স্বীকার করেছেন। কিন্তু তার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে; বার্তাবাহকগণ বলেন, “আল্লাহর জ্ঞানের বস্তুসমূহের অস্তিত্বের প্রয়োজন নেই, কিন্তু সৃষ্টজীবের জ্ঞানের জ্ঞাত বস্তুসমূহের অস্তিত্বের প্রয়োজন; যদি আল্লাহ্র জ্ঞানের অন্য কোন বস্তুর প্রয়োজন থাকতো, তাহলে এটা হত সৃষ্ট জীবের জ্ঞান, আল্লাহর জ্ঞানের নয়। কারণ পূর্বজন্ম অর্থাৎ পূর্ব থেকে অস্তিত্ববান কোন কিছু প্রপঞ্চময় (ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু সম্বন্ধীয়) কোন কিছু থেকে আলাদা এবং প্রপঞ্চময় কোন কিছু পূর্ব থেকে অস্তিত্ববান কোন কিছুর বিরোধী; যা কিছু আমরা সৃষ্ট জীবের প্রতি আরোপ করি- সেটা সাপেক্ষ তথা সম্ভাব্য অস্তিত্বসমূহের প্রয়োজনীয় বস্তু আমরা আল্লাহ্র পক্ষে অস্বীকার করি; কারণ অপূর্ণতাসমূহ থেকে শুদ্ধিকরণ অথবা পবিত্রকরণ হচ্ছে তাঁর অপরিহার্য গুণ-ধর্ম এর একটি। এমতাবস্থায় প্রপঞ্চময়ে আমরা অজ্ঞতা দেখি, পূর্ব থেকে অস্তিত্ববান আমরা শক্তি চিনতে পারি; প্রপঞ্চময়ে আমরা দারিদ্রতা দেখি, পূর্ব থেকে অস্তিত্ববান আমরা সম্পদ চিনি (স্বীকার করি)। সুতরায় প্রপঞ্চময় বস্তু হচ্ছে অপূর্ণতাসমূহের উৎস এবং পূর্ব থেকে অস্তিত্ববান কিছু হচ্ছে পূর্ণতাসমূহের সমষ্টি। প্রপঞ্চময় জ্ঞানের জ্ঞাত বস্তুসমূহের প্রয়োজন আছে, পূর্ব থেকে অস্তিত্ববাদ জ্ঞান, বস্তুসমূহের অস্তিত্ব থেকে স্বাধীন বা মুক্ত। সুতরাং মহোচ্চ আল্লাহ কর্তৃক জ্ঞাত অস্তিত্ব বা সত্ত্বাসমূহের বিনির্দেশ বা নির্দিষ্টকরণের ও বিশিষ্টকরণের বৈশিষ্ট্য দ্বারা চিহ্নিতকরণের) পূর্বস্থিতি বা পূর্ব অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকে না; এবং এই স্বর্গীয় ও পূর্ণাঙ্গ গুণাবলী বুদ্ধিমাত্রার দ্বারা এত মাত্রায় বুঝা যায় না, যাতে আমরা স্থির করতে পারি স্বর্গীয় জ্ঞানের জ্ঞাত বস্তুসমূহের প্রয়োজন আছে কি না।

সংক্ষেপে সুফিদের এই হচ্ছে প্রধান যুক্তি এবং আমরা যদি তাদের সমুদয় প্রমাণাবলী উল্লেখ করতে এবং তাদের উত্তরসমূহ ব্যাখ্যা করতে ইচ্ছা করি, তাহলে খুব লম্বা সময় লেগে যাবে। কমপক্ষে সুফি ও ব্রক্ষ্মতত্ত্ববিদ পণ্ডিতদের এটাই চূড়ান্ত ও সুস্পষ্ট যুক্তি।

কিন্তু প্রকৃত অস্তিত্বের প্রশ্ন- যদ্বারা সমস্ত বস্তু জীবিত থাকে, অর্থাৎ একত্বের অস্তিত্বের বাস্তবতা (বাস্তব-সত্ত্বা) যার মাধ্যমে সমস্ত সৃষ্ট প্রাণীকুল পৃথিবীতে এসেছে- সর্বজন স্বীকৃত। শুধু পার্থক্য রয়েছে সুফিরা যা বলছেন তার মধ্যে। সুফিরা বলছেন, “বস্তুসমূহের বাস্তবতা হচ্ছে প্রকৃত তথা বাস্তব একত্বের প্রকাশ।” কিন্তু পয়গম্বরগণ বলেন, “এটা বাস্তব একত্ব থেকে নির্গত হয়” এবং “নির্গমন” ও “প্রকাশের” মধ্যে বিরাট পার্থক্য। প্রকাশে আবির্ভাব অর্থ মাত্র একটি বস্তু অসীম আকারে আবির্ভূত হয়। উদাহরণস্বরূপ উদ্ভিদের বর্ধণসাধক পূর্ণতাসমূহের অধিকারী একটি মাত্র বীজ অসীম আকারে প্রকাশিত হয়। উক্ত বীজ স্বয়ং শাখা, পত্র, পুষ্প ও ফলসমূহে দ্রবীভূত হয়; একেই বলে প্রকাশের আবির্ভাব; পক্ষান্তরে নির্গমনের মাধমে আবির্ভাবে এই বাস্তব ঐক্য তথা একত্ব বহাল থাকে এবং এর সমুন্নত মর্যাদায় ক্রমাগত চলতে থাকে, কিন্তু সৃষ্ট প্রাণীকুল এটা থেকে নির্গত হয় এবং এর দ্বারা প্রকাশিত হয় না। এটাকে সূর্যের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে, যার থেকে আলো নির্গত হয়, যে আলো সমস্ত সৃষ্ট জীবের উপর বর্ষিত হয়- কিন্তু সূর্য তার পবিত্রতার মহা সমুন্নত মর্যাদায় বহাল থাকে। সূর্য অবতরণ করে না, এটা স্বয়ং আলোকময় আকারসমূহে দ্রবীভূত হয় না, বস্তুসমূহের বিনির্দেশ ও বিশিষ্টকরণের মাধ্যমে আকার আকৃতির পদার্থে এটা আবির্ভূত হয় না; পূর্ব জন্ম প্রাপ্ত (পূর্ব থেকে অস্তিত্ববান) প্রপঞ্চময়ে পরিণত হয় না; স্বাধীন সম্পদ শৃঙ্খলাবদ্ধ দারিদ্রে পরিণত হয় না, সম্পূর্ণ পরোৎকর্ষ, সম্পূর্ণ অসম্পূর্ণতায় পরিণত হয় না।

সংক্ষেপে পুনরালোচনা করছি: সুফিরা আল্লাহ্ ও সৃষ্ট বস্তুকে স্বীকার করেন এবং বলেন যে, আল্লাহ্ নিজেকে সৃষ্ট বস্তু- প্রাণীকুলের অসীম আকারসমূহের মধ্যে দ্রবীভূত করেন এবং সমূদ্রের ন্যায় প্রকাশ করেন, যে সমূদ্র ঊর্মিমালার অসীম আকারসমূহে দৃষ্টিগোচর হয়। এই প্রপঞ্চময় ও অসম্পূর্ণ তথা পরোৎকর্ষহীন ঊর্মিমালা পূর্ব জন্ম প্রাপ্ত অবিকল সমূদ্রসম, যে সমূদ্র সমস্ত স্বর্গীয় পরোৎকর্ষসমূহের সমষ্টি। পক্ষান্তরে পয়গম্বরগণ বিশ্বাস করেন যে, তিনটি জিনিস - ঐশী জগত, ঐশী সাম্রাজ্য-জগত, সৃষ্টি জগত বিদ্যমান আছে। আল্লাহ্ থেকে প্রথম নির্গমন হচ্ছে স্বর্গ রাজ্যের বদান্যতা, যা সৃষ্ট বস্তুসমূহের বাস্তবতায় নির্গত হয় ও প্রতিফলিত হয়- ঠিক আলোর মত, যা সূর্য থেকে নির্গত হয় এবং প্রাণীকুলের মধ্যে সমুজ্জ্বল হয়; এবং এই অনুকম্প, যা হচ্ছে আলো, তা সমুদয় বস্তুসমূহের বাস্তবতায় অসীম আকারে প্রতিফলিত হয় এবং বস্তুসমূহের ধারণশক্তি, যোগ্যতা ও অন্তর্নিহিত মূল্যানুযায়ী নির্দিষ্ট করে ও বিশিষ্ট করে। কিন্তু সম্ভাব্য তথা সাপেক্ষ অস্তিত্বের সীমাবদ্ধ অবস্থানুযায়ী সুফিদের দৃঢ় উক্তি দাবি করে যে, স্বাধীন সম্পদ দারিদ্রতার ধাপে অবতরণ করুক, পূর্বে জন্ম প্রাপ্ত অস্তিত্ব প্রপঞ্চময় আকারসমূহে সীমাবদ্ধ হোক এবং পবিত্র শক্তি দুর্বলতার অবস্থায় সীমাবদ্ধ হবে এবং এটা একটি সুস্পষ্ট ভ্রান্তি। লক্ষ্য কর যে, মানুষের বাস্তবতা- যে মানুষ সৃষ্ট জীবের মধ্যে সর্বাপেক্ষ মহৎ, ইতর প্রাণীর বাস্তবতায় অবতরণ করে না; ইতর প্রাণীর অস্তিত্ব, যা ভাবাবেগের শক্তি দ্বারা ভূষিত, উদ্ভিদের ধাপে নিজেকে হীনপদস্থ করে না এবং উদ্ভিদের বাস্তবতা, যা হচ্ছে বৃদ্ধির শক্তি, খনিজ পদার্থের বাস্তবতায় অবতরণ করে না।

সংক্ষেপে উৎকৃষ্ট বাস্তবতা অবতরণ করে না, নিকৃষ্ট অবস্থায়ও নিজেকে অবনমিত করে না, তাহলে এটা কেমন করে হতে পারে যে, আল্লাহ্র সার্বজনীন বাস্তবতা, যা সর্ব প্রকার বর্ণনা ও গুণাবলী থেকে মুক্ত, এতদসত্ত্বেও তাঁর চরম ও পরম পবিত্রতা ও শুদ্ধিতা সৃষ্ট প্রাণীকুলের বাস্তবতাসমূহের আকারসমূহে স্বয়ং দ্রবীভূত হবে? বিশেষ করে যা পরোৎকর্ষসমূহের উৎস? এটা একটা নিছক কল্পনা, যা কেউ কল্পনা করতে পারে না।

পক্ষান্তরে এই পবিত্র অস্তিত্ব হচ্ছে স্বর্গীয় পরোৎকর্ষসমূহের সমষ্টি; এবং সমগ্র সৃষ্ট প্রাণীকুল নির্গমনের মাধ্যমে জ্যোতির বদান্যতা দ্বারা অনুগ্রহপুষ্ট. এবং সৃষ্ট প্রাণীকুলের স্বর্গ রাজ্যের আলো, পূর্ণতা ও সৌন্দর্য লঅভ করে থাকে। অনুরূপভাবে সমুদয় পার্থিব সৃষ্ট বস্তু সূরর্যর রশ্মির আলোর বদাস্যতা লাভ করে, কিন্তু সূর্য অবতরণ করে না এবং পার্থব অস্তিত্বসমূহের অনুগৃহিত বাস্তবতার প্রতি নিজেকে অবনমিত তথা হীনপদস্থ করে না।

মধ্যাহ্ন ভোজনের পর, অনেক দেরি হয়ে যাওয়ার পরেপ্রেক্ষিতে আর ব্যাখ্যা করার মত সময় নেই।

-অভিবাদন।

63
জ্ঞান অর্জনের চারটি পদ্ধতি

কোনকিছু হৃদয়ঙ্গম করার চারটি স্বীকৃত নিয়ম বিদ্যমান; অর্থাৎ বস্তুসমূহের বাস্তবতা এই চারটি নিয়মের দ্বারা অনুধাবন করা যায়।

প্রথমটি হচ্ছে ইন্দ্রিয়ানুভূতির দ্বারা, অর্থাৎ যা কিছু চক্ষু, কর্ণ, আস্বাদন, ঘ্রাণ, স্পর্শ অনুভব করেÑ এই নিয়ম প্রণালীর দ্বারা হৃদয়ঙ্গম করা যায়। আজ এই পদ্ধতি সমস্ত ইউরোপীয় দার্শনিকদের দ্বারা সর্বাপেক্ষা নিখুঁত বলে বিবেচিব। তারা বলেন যে, জ্ঞানার্জনের প্রধান উপায় হচ্ছে ইন্দ্রিয়ানুভূতির মাধ্যমে; তাঁরা এটাকে সর্বোৎকৃষ্ট বলে বিবেচনা করেন, যদি এটা অসম্পূর্ণ, কারণ এটা ভুল করে। উদাহরণস্বরূপ ইন্দ্রিয় বস্তুসমূহের মধ্যে সর্বসেরা হচ্ছে দৃষ্টিশক্তি। দৃষ্টিশক্তি মরীচিকাকে পানি বলে ভ্রম করে এবং এটা দর্পনে প্রতিফলিত প্রতিবিম্ব দর্শন করে প্রকৃত বলে মনে করে; দূরবর্তী লম্ব তথা বিশাল দেহী লোকদের ক্ষুদ্র বলে মনে হয়, একয় দ্রুত ঘূর্ণায়মান বিন্দুকে একটি বৃত্ত বলে মনে হয়। দৃষ্টিশক্তি পৃথিবীকে গতিহীন বলে বিশ্বাস করে এবং সূর্যকে গতিশীল দেখে এবং অনেক অনুরূপ বিষয়ে ভুল করে। অতএব আমরা একে বিশ্বাস করতে পারি না।

দ্বিতীয়টি হচ্ছে যুক্তি পদ্ধতি, যা ছিল প্রাচীন দার্শনিকদের পদ্ধতি, তথা বিজ্ঞতার স্তম্ভ। এটাই জ্ঞান আহরণের মাধ্যম। যুক্তির মাধ্যমে তারা বিষয়বস্তু প্রমাণ করতেন এবং যুক্তি সংগত প্রমাণ বলে দৃঢ়ভাবে স্বীকার করতেন, তাদের সমস্ত যুক্তি “কারণের” উপর প্রতিষ্ঠিত। এতদসত্তে¡ও তাদের বিরাট মতানৈক্য ঘটতো এবং তাদের মতামত পরস্পর বিরোধী ছিল। এমনকি তারা তাদের মতামতও পরিবর্তন করতেন অর্থাৎ বিশ বছর যাবৎ তারা যুক্তি শাস্ত্রীয় প্রমাণ দ্বারা একটি বিষয় বা বস্তুর অস্তিত্ব প্রমাণ করতেন এবং পরে আবার সেটা তারা যুক্তি শাস্ত্রীয় প্রমাণ দ্বারা প্রত্যাখ্যান করতেন। এতদূর পর্যন্ত যে যুক্তি সংগতভাবে প্লাটো প্রথমে পৃথিবীর স্থিরতা ও সূর্যের চলন গতির প্রমাণ করেন, পরবর্তীকালে যুক্তি সংগত প্রমাণের দ্বারা তিনি প্রমাণ করেন যে, সূর্য ছির স্থির কেন্দ্র এবং পৃথিবী ছিল গতিশীল। পরবর্তীকালে টলেমীর মতবাদ বিদেশে প্রসার লাভ করে এবং প্লাটোর মতবাদ সম্পূর্ণরূপে বিস্মৃত হয়ে যায়, শেষ পর্যন্ত একজন নতুন আবিষ্কারক পুনরায় আসল তথ্য দান করেন। এইভাবে সমস্ত গলিতবিদ ভিন্ন মত পোষণ করেন, যদিও তাঁরা যুক্তির বিতর্কের উপর নির্ভর করতেন। অনুরূপভাবে তর্কশাস্ত্রের যুক্তি দ্বারা তাঁরা এক সময়ে একটি দুর্বোধ্য বিষয়ের সমাধান দিতেন এবং পরবর্তীকালে একই ধরণের যুক্তির দ্বারা সেটাকে প্রত্যাখ্যান করতেন। এমতে দার্শনিকদের একজন কিছু কালের জন্য একটি মতবাদ সমর্থন করার জন্য শক্তিশালী যুক্তি প্রমাণ দৃঢ়ভাবে তুলে ধরতে, যা পরবর্তীকালে তিন যুক্তির অবতারণার দ্বারা সেটাকে নাকোচ করে দিতেন। অতএব এটা সুস্পষ্ট যে, যুক্তি পদ্ধতি সঠিক নয়, কারণ প্রাছীন দার্শনিকদের মতানৈক্যসমূহ তাঁদের মতামতের পরিবর্তন ও স্থায়ীত্বের অভাব এটার ব্যর্থতা প্রমাণ করে। কারণ এটা যদি সঠিক হত, তাহলে তাঁদের মতবাদসমূহে ও মতামতে সবাই একমত পোষণ করতো।

জ্ঞানার্জনের তৃতীয় প্রণালী হচ্ছে ঐতিহ্য (পরম্পরাগত মতবাদ বা প্রথা) অর্থাৎ পবিত্র ধর্মগ্রন্থসমূহের মাধ্যমে। কারণ লোকে বলে: নতুন ও পুরাতন নিয়মে (বাইবেলে) আল্লাহ্ এইরূপ বলেন। এই পদ্ধতিও নিখুঁত নয়, কারণ জনশ্রুতিসমূহ যুক্তির দ্বারা গৃহিত হয়। যুক্তি স্বয়ংই যখন ভুলের অধীন, তাহলে কেমন করে এটা বলা যেতে পারে যে, পরম্পরাগত মতবাদের যে অর্থের ব্যাখ্যা এটা করেছে সেটা ভুল হবে না? কারণ যুক্তির পক্ষে ভুল করা সম্ভব এবং নিশ্চয়তা লাভ করা যাবে না। ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের এটাই হচ্ছে পদ্ধতি; গ্রন্থসমূহের মূলবচন থেকে যা তারা হৃদয়ঙ্গম করে ও অনুধাবন করে সেটাই হচ্ছে তাদের যুক্তি- যা মূলবচন থেকে হৃদয়ঙ্গম করে- অপরিহার্য ফলসমূহ সেটা সত্য নাও হতে পারে। কারণ যুক্তি হচ্ছে দাড়িপাল্লার ন্যায় এবং ধর্মগ্রন্থসমূহের বচনে নিহিত তাৎপর্যসমূহ হচ্ছে সেই বস্তুর ন্যায়, যা ওজন করা হয়। যদি দাড়িপাল্লা মিথ্যা হয়, তাহলে কিভাবে ওজন নির্ধারিত হতে পারে?

তাহলে জেনে রাখ, মানুষের হাতে যা কিছু আছে, যা কিছু তারা বিশ্বাস করে, তা ভুলের অধীন। কারণ কোন জিনিস প্রমাণ করতে অথবা প্রমাণ খণ্ডন করতে যেয়ে যদি আমাদের ইন্দ্রিয়লব্ধ প্রমাণ থেকে সেই প্রমাণ খাড়া করতে হয়, তাহলে এই পদ্ধতিÑ যা ইতিপূর্বে প্রমাণিত হয়েছে- নিখুঁত নয়, যদি সেটা বুদ্ধিবৃত্তি সংক্রান্ত প্রমাণিত হয়, তবুও সেটা নিখুঁত নয়, অথবা তা যদি ঐতিহ্যগত প্রমাণও হয় তবুও তা নিখুঁত নয়। অতএব মানুষের হাতে এমন কোন মানদণ্ড নেই যার উপর আমরা নির্ভর করতে পারি কিন্তু পবিত্র আত্মার বদান্যতা অভ্রান্ত ও সন্দেহমুক্ত জ্ঞানের প্রকৃত পদ্ধতি প্রদান করে। পবিত্র আত্মার সাহায্য- মাধ্যমেই এটা মানুষের কাছে আসে এবং এটাই শর্ত, যার মধ্যে একমাত্র নিশ্চয়তা লাভ করা যেতে পারে।

64
ঐশী প্রকাশদের শিক্ষা দীক্ষা অনুসরণের আবশ্যকতা

প্রশ্ন: যারা সৎকর্মাবলী ও সার্বজনীন বদান্যতার উদ্ভুদ্ধ, যাদের প্রশংসনীয় চরিত্র বৈশিষ্ট রয়েছে, যারা সর্বজীবের প্রতি দয়া প্রীতিসহকারে কার্য করে, যারা দরিদ্রের দেখাশোনা করে, যারা সার্বজনীন শান্তি প্রতিষ্ঠায় চেষ্টা করে স্বর্গীয় শিক্ষা-দীক্ষায় তাদের কি প্রয়োজন আছে, যা থেকে তারা মনে করে যে, তারা স্বাধীন? এই লোকগুলির অবস্থা কি?

উত্তর: যেনে রাখ যে, এরূপ কার্যাবলী, এরূপ চেষ্টা এবং এরূপ কথা প্রশংসনীয় ও অনুমোদিত এবং জাতীর অত্যান্ত গৌরবের বস্তু। কিন্তু শুধু এই কার্যাবলীই যথেষ্ট নয়; তবে এগুলি আত্মাবিহীন বৃহত্তম সৌন্দর্যের একটি দেহ মাত্র। না, সর্বপ্রথম যা চিরস্থায়ী জীবনের, শাশ্বত সম্মানের সার্বজনীন শিক্ষার, প্রকৃত মুত্তি ও সৌভাগ্যের কারণ, সেটা হচ্ছে আল্লাহ্র জ্ঞান। এটা সুবিদিত যে, সমুদয় জ্ঞানের পরপারে হচ্ছে আল্লাহ্ সন্বন্ধীয় জ্ঞান এবং মানব জগতে এটাই হচ্ছে সর্বাপেক্ষা গৌরবের বস্তু। কারণ বস্তু সমূহের বাস্তবতার বিদ্যামান জ্ঞানে পার্থিব সুযোগ-সুবিধা বিদ্যমান রয়েছে এবং এর মাধ্যমে বাহ্য সভ্যতা উন্নতি লাভ করে; কিন্তু আল্লাহ সন্বন্ধীয় জ্ঞান হচ্ছে আধ্যাত্মিক উন্নতি ও আকর্ষণের কারণ এবং এর মাধ্যমে সত্যের অনুভূতি, মানবতার উন্নতি, স্বর্গীয় সভ্যতা, রীতি-নীতি ও জ্ঞানালোকের সঠিকতা লাভ করা যায়।

দ্বিতীয়ত: আসছে আল্লাহর প্রেম, যারা আলো এমন লোকদের হৃদয় প্রদীপে আলোক বর্ষণ করে, যারা আল্লাহ এক জানে; এবং উজ্জ্বল রশ্নিসমূহ দিগন্তকে আলোকোদ্ভাসিত করে এবং মানুষকে স্বর্গরাজ্যের জীবন প্রদান করে। প্রকৃত পক্ষে, মানব অস্তিত্বের ফল হচ্ছে আল্লাহর প্রেম, কারণ এই প্রেমই হচ্ছে জীবনের আত্মা এবং শাশ্বত অনুকম্পা। যদি আল্লাহর প্রেমের অস্তিত্ব না থাকতো, তাহলে সাপেক্ষ (সম্ভাব্য) জগত অন্ধকারাচ্ছন্দ হয়ে যেত। যদি আল্লাহর প্রেমের অস্তিত্ব না থাকতো, মানব জাতির অন্তঃকরণ মৃত হত; যদি আল্লাহরপ্রেমের অস্তিত্ব না থাকত, তাহলে আধ্যাত্মিক মিলন নষ্ট হয়ে যেত। যদি আল্লাহর প্রেমের অস্তিত্ব না থাকতো, তাহলে একতার আলো মানবতাকে আলোকিত করতো না। যদি আল্লাহর প্রেমের অস্তিত্ব না থাকতো, তাহলে দুই প্রেমিকের ন্যায় পূর্ব-পশ্চিম একে অন্যকে আলিঙ্গন করতো না। যদিআল্লাহরপ্রেমের অস্তিত্ব না থাকতো, তাহলে বিভেদ ও অমিল ভ্রাতৃত্বে পরিবর্তিত হতো না। যদি আল্লাহর প্রেমের অস্তিত্ব না থাকতো, তাহলে উপেক্ষা স্নেহের মধ্যে স্থান পেত না; যদি আল্লাহর প্রেমের অস্তিত্ব না থাকতো, তাহলে বিদেশী বন্ধু হতো না। মন্যষ্যজগতের প্রেম আল্লাহর প্রেম থেকে বিকীর্ণ হয়েছে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ ও অনুকম্পার দ্বারা প্রকাশিত হয়েছে।

এটা পরিস্কার যে, মানব জাতির অবস্থা নানাবিধ, মতামত বিভিন্ন ধরনের ও ভাব প্রবণতা বিভিন্ন এবং মনুষ্য প্রজাতির মধ্যে মত, চিন্তা-ভাবনা, বুদ্ধি মত্তা, ভাবপ্রবণতার পার্থক্য অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজনীয়তা থেকে উদ্ভুত হয়েছে; কারণ সৃষ্ট জীবকূলের অস্তিত্বের ধাপে উক্ত পার্থক্যসমূহ হচ্ছে অস্তিত্বের আবশ্যকতার মধ্যে একটি, যা অসীম আকারসমূহে উদঘাটিত হয়। অতএব, আমাদের একটি সাধারণ সার্বজনীন শক্তির প্রয়োজন আছে যা সকলের উক্ত ভাব-প্রবণতা, মত এবং চিন্তাসমূহকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। ধন্যবাদ সেই বস্তুর প্রতি, যে বস্তুর কারণে এই বিভেদগুলির আর প্রভাব নেই এবং সমূদয় মানুষকে মানব জগতের একতার প্রভাবাধীনে আনা যেতে পারে। এটা পরিস্কার ও প্রমাণিত যে, মানব জগতে এই বৃহত্তম শক্তি হচ্ছে আল্লাহ্র ভালবাসা। এটা বিভিন্ন জাতিকে স্নেহের তাবুর ছায়ায় আনয়ন করছে; এটা বিরুদ্ধ ও শক্রভাবাপন্ন জাতিসমূহকে অনুরাগ ও মিলন দান করছে।

লক্ষ্য কর, যীশুখ্রিষ্টের সময়ের পর, আল্লাহর প্রেমের শক্তির মাধ্যমে কত জাতি, উপজাতি, পরিবার ও মানব সমাজ আল্লাহর বাণীর ছায়ায় এসেছে; হাজার বছরের ভেদাভেদ ও অমিল সম্পূণৃরূপে ধ্বংস ও বিনাশ প্রাপ্ত হয়েছে। জাতির ও পিতৃভূমির চিন্তা-ভাবনা সম্পূর্ণরূপে অস্তহিত হয়েছে: আত্মাসমূহের ও অস্তিত্বসমূহের মিলন ঘটেছে; সবাই প্রকৃত আধ্যাত্মিক খ্রিষ্টান হয়েছে।

মানবজাতির তৃতীয় গুণ হচ্ছে সদিচ্ছা, যা সৎকর্মাবলীর ভীত। কতিপয় দার্শনিকগণ কার্য অপেক্ষা উদ্দেশ্যের গুরুত্ব দিয়েছেন বেশী; কারণ, সদিচ্ছা হচ্ছে চূড়ান্ত আলো; এটা স্বার্থপরতার, শক্রতার, প্রবঞ্চনার নোংরামী থেকে পুত-পবিত্র। এক্ষণ এরূপ হতে পারে যে, কোন লোক একটি কার্য সম্পাদন করছে যা দৃশ্যত: সৎ কিন্তু বস্তুত: সেটা লোভ-লালসা প্রস্তুত। উদাহরণস্বরূপ একজন কসাই একটি মেস পালন করছে এবং এটার রক্ষনাবেক্ষণ করছে; কিন্তু কসাইয়ের এই সৎকর্ম মুনাফা অর্জনের লালসা দ্বারা তাড়িত এবং এই রক্ষণাবেক্ষণের ফল হচ্ছে এই হতভাগ্য মেষের নিধন প্রাপ্তি। কতই না সৎকার্যাবলী লালসার দ্বারা পরিচালিত হয়! কিন্তু সদিচ্ছা এইরূপ নোংরামী থেকে পবিত্র।

সংক্ষেপে যদি আল্লাহর সম্বন্ধে জ্ঞানের সঙ্গে আল্লাহর প্রেম, আকর্ষণ, উল্লাস ও সদিচ্ছা যুক্ত হয়, তাহলে একটি সৎকর্ম নিখুঁত ও পরিপূর্ণ তথা পূর্ণাঙ্গ হয়। অন্যথায় যদিও একটি সৎকর্ম প্রশংসনীয়, তবু এটা আল্লাহর জ্ঞান দ্বারা পরিপুষ্ট নয়, তথা আল্লাহর প্রেম দ্বারা পুষ্ট নয় এবং এরূপ একটি অকপট উদ্দেশ্য অপূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ মানুষের সত্ত্বাসমুদয় পূর্ণতাসমূহকে (পরোৎকর্ষকে) নিখুঁত হতে একতাবদ্ধ করবে। দৃষ্টিশক্তি চরম ও পরম মূল্যবান ও প্রশংসাযোগ্য, কিন্তু এটা শ্রবণশক্তি দ্বারা সাহায্যপুষ্ট হতে হবে; শ্রবণশক্তি খুবই প্রশংসাযোগ্য, কিন্তু এটাকে বাকশক্তির সাহায্যপুষ্ট হতে হবে; বাকশক্তি বৃত্তি খুবই গ্রহণযোগ্য, কিন্তু এটাকে যুক্তি শক্তির সাহায্যপুষ্ট হতে হবে; এবং ইত্যাদি ইত্যাদি। মানুষের অন্যান্য শক্তি, দেহযন্ত্র ও অঙ্গ প্রত্যঙ্গের সম্বন্ধে ঐ একই কথা। যখন এই শক্তিগুলি, এই ইন্দ্রিয় যন্ত্রগুলি, এই দেহ যন্ত্রগুলি, এই অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলি বিদ্যমান থাকে, তখন সে পূর্ণাঙ্গ।

আজ আমরা পৃথিবীতে এরূপ মানুষের সাক্ষাত পাচ্ছি যারা প্রকৃত পক্ষে সার্বজনীন মঙ্গল কামনা করেন এবং তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী অত্যাচারীতদের আশ্রয় দারিদ্রের সাহায্যদানে নিজেদের ব্যস্ত রেখেছেন; তাঁরা শান্তি ও সার্বজনীন মঙ্গলের জন্য উৎসাহী। যদিও এই দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁরা নিখুঁত হতে পারেন, কিন্তু যদি তাঁরা আল্লাহর জ্ঞান ও প্রেম থেকে বঞ্চিত হন, তাহলে তাঁরা অপূর্ণ।

চিকিৎসক গ্যালেন তাঁর পুস্তকে প্লাটোর সরকার সম্বন্ধীয় কলাকৌশল সম্বলিত রচনার উপর মন্তব্য করতে যেয়ে বলেন যে, ধর্মের মৌলিক নীতিমালার -একটি পূর্ণাঙ্গ সভ্যতার উপর বিরাট প্রভাব রয়েছে, কারণ “জনসাধারণ ব্যাখ্যামূলক বাক্যের সংযোগ হৃদয়ঙ্গম করতে পারে না; অতএব পরজগতের শান্তি ও পুরষ্কার ঘোষণাকারী প্রতীকরূপে ব্যবহৃত কথায় প্রয়োজন আছে”এবং তিনি বলেন, “এবং যা কিছু এই দৃঢ় উক্তির সত্যতা প্রমাণ করে, তা হচ্ছে এই যে, আজ আমরা খ্রিষ্টান নামে একটি জন সম্প্রদায় দেখছি, যারা শান্তি ও পুরষ্কার বিশ্বাস করেন; এবং এই সম্প্রদায় এমনি সুন্দর কর্মকাণ্ড সম্পাদন করছে যেগুলি একজন প্রকৃত দার্শনিক সম্পাদন করেন। সুতরাং আমরা সবাই দেখতে পাচ্ছি যে, তারা মৃত্যুকে ভয় করে না, তারা জনসাধারণের কাছ থেকে ন্যায়পরতা ও ন্যায়বিচার ব্যতীত আর কিছুই কামনা করে না এবং তাঁরা প্রকৃত দার্শনিকরূপে গণ্য।”

এখন লক্ষ্য কর, যীশুখ্রিষ্টের বিশ্বাসীদের অকপটতার, উৎসাহের আধ্যাত্মিক অনুভূতির, বন্ধুত্বের প্রতি বাধ্যবাধকতার এবং সৎকর্মাবলীর পরিমাণ এত ছিল যে, দার্শনিক চিকিৎসক গ্যালেন, যদিও তিনি খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী ছিলেন না তবু তিনি এই লোকগুলির নৈতিক ও সু রীতিনীতি ও পরোৎকর্ষসমূহের পরিচয় প্রদান করেন এবং প্রকৃত দার্শনিকদের পর্যায়ে তাদের টেনে আনেন। এই গুণাবলী , এই নীতিসমূহ শুধুমাত্র সৎ কর্মাবলীর মাধ্যমে অর্জিত হয় নাই, কারণ এই গুণ যদি শুধুমাত্র মঙ্গল লাভ ও প্রদানের ব্যাপার হত- যেমন এই প্রদীপ প্রজ্বলিত হচ্ছে এবং এই গ্রহকে আলোকিত করছে -তাহলে নিঃসন্দেহে এই আলোকপাত একটি উপকার - তাহলে কেন আমরা এই প্রদীপটির প্রশংসা করব না? সূর্য পৃথিবীর সমুদয় অস্তিত্বশীল বস্তুকে বৃদ্ধি করে এবং এর উত্তাপ এবং আলো বৃদ্ধি ও বিকাশ দান করে; এর চেয়ে বড় কোন উপকার আছে কি? এতদসত্ত্বেও যেহেতু আল্লাহর জ্ঞান ও প্রেম থেকে এই মঙ্গল আসে নাই, সেহেতু এটা অপূর্ণ।

পক্ষান্তরে যখন একজন লোক অন্য একজন লোককে এক পেয়ালা পানি দেয়, পানিপ্রাপ্ত লোকটি কৃতজ্ঞ হয় ও তাকে ধন্যবাদ দেয়। বিনা চিন্তায় একজন লোক বলবে, এই সূর্যম, যা পৃথিবীকে আলো দান করছে, এই অনুপম বদান্যতা যা এর মধ্যে ম্পষ্ট রয়েছে, এটা অবশ্যই প্রীতির সঙ্গে গণ্য ও প্রশংসিত হবে। সূর্যের কাছে, তার বদান্যতার জন্য, কেন আমরা কৃতজ্ঞ থাকব না যখন আমরা এমন লোকের প্রশংসা করি, যে একটা সাধারণ দয়ার কাজ করে? কিন্তু যদি আমরা সত্যানুসন্ধান করি, তাহলে আমরা দেখি যে, মানুষের এই অকিঞ্চিৎ দয়া সচেতন অনুভূতির কারণে হয়ে থাকে, সুতরাং এটা প্রশংসাযোগ্য; পক্ষান্তরে সূর্যের উত্তাপ ও আলো অনুভূতি ও সচেতনার কারণে নয়, সুতরাং এগুলি প্রশংসা ও গুণকীর্তনের যোগ্য নয়, ফলে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদপ্রাপ্তির যোগ্য নয়।

অনুরূপভাবে যখন একজন লোক একটি সৎকর্ম করে, যদিও এটা প্রশংসাযোগ্য, তবে যদি এটা আল্লাহ্র প্রেমের ও জ্ঞানের দ্বারা সংঘটিত না হয়, তাহলে এটা অসম্পূর্ণ। অধিকন্তু যদি তুমি সঠিকভাবে চিন্তা কর, তুমি দেখবে যে, অন্যান্য লোকের এই সৎকর্মাবলী , যারা আল্লাহকে জানে না বা চেনে না, মূলতঃ আল্লাহ্র শিক্ষা দ্বারা সংঘটিত; অর্থাৎ পূর্বের পয়গম্বরগণ মানুষকে এই কর্মগুলি সমাধা করতে অনুপ্রাণিত করতেন, সৎকার্যের সৌন্দর্য তাদের কাছে ব্যাখ্যা করতেন এবং সেগুলির চমৎকার ফল ঘোষণা করতেন; অতঃপর এই শিক্ষাগুলি মানুষের মধ্যে বিস্তার লাভ করত এবং পর্যায়ক্রমে একের পর এক তাদের কাছে পৌঁছে যেত এবং এই পরোৎবকর্ষসমূহের দিকে তাদের অন্তর ঝুকে পড়ত। যখন মানুষ দেখত যে এই কার্যগুলি সুন্দর বলে বিবেচিত এবং মানবজাতির সুখ ও আনন্দের কারণ হত, তখন তারা এগুলির সমর্থন করত।

অতএব এই কার্যগুলি আল্লাহর শিক্ষা থেকে আসে। কিন্তু এটা দেখার জন্য ন্যায়পরতার প্রয়োজন-বাদানুবাদ ও আলোচনা নয়। প্রশংসা আল্লাহর, তুমি পারস্যে গিয়েছ এবং তুমি দেখেছ, বাহা’উল্লাহর পবিত্র মৃদুমন্দ সমীরণের মাধ্যমে পারস্যবাসীরা মানুষের প্রতি কত দয়াপরবশ হয়েছে। পূর্বে যদি তারা অপর কোন জাতির কাউকে দেখতে পেত, তাহলে তারা তাকে উৎপীড়ন করতো, বৈরিতা, ঘৃণা ও হিংসায় পরিপূর্ণ হয়ে যেত; তার প্রতি তারা বর্শা নিক্ষেপ পর্যন্ত করতো। তারা সুসমাচার (গসপেলে) ও পুরাতন নিয়ম পুড়িয়ে ফেলতো এবং এই গ্রন্থগুলি স্পর্শের দ্বারা যদি তাদের হাত কলুষিত হত, তাহলে তারা হাত ধুয়ে ফেলতো। আজ তাদের বিরাট সংখ্যক লোক এই গ্রন্থসমূহের অধ্যায়গুলি ইচ্ছামাফিক তাদের বান্ধব সম্মেলনে ও সাধারণ জমায়েতে মধুর স্বরে আবৃত্তি করা হয় এবং তারা এগুলির গূঢ় অর্থের ব্যাখ্যা করে। তাদের শত্রুদের তারা অতিথি সৎকার করে। এই রক্ত পিপাসু নেকড়ে বাঘগুলি আল্লাহর প্রেমের উন্মুক্ত প্রান্তরসমূহে হরিণের মত শান্তশিষ্ট হয়েছে। তুমি তাদের রীতিনীতি ও আচার আচরণ দেখেছ, তুমি তাদের পূর্বেকার পারস্যবাসীদের রীতিনীতির কথা বলতে শুনেছ। রীতিনীতির এই রূপান্তর, আচরণ ও কথাবার্তার এই উন্নতি আল্লাহর প্রেমের মাধ্যমে ব্যতীত কি সম্ভব? না, আল্লাহর শপথ! জ্ঞান বিজ্ঞানের সাহায্যে আমরা যদি এই রীতি-নীতি ও সামাজিক প্রথা প্রচলনের ইচ্ছা করতাম, তাহলে সত্য সত্যই এটা হাজার হাজার বছর লেগে যেত এবং তবু সর্বত্র মানবমণ্ডলীর মধ্যে এটা বিস্তার লাভ করতো না।

আজ আল্লাহর প্রেমের প্রতি ধন্যবাদ, সর্বাপেক্ষা সহজভাবে সেগুলি এসে পৌঁছেছে।

সতর্ক হও, হে বুদ্ধিমত্তার অধিকারীরা।

`Abdu'l-Bahá

Windows / Mac